#অপেক্ষারা
১৬.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
একই বিছানায় আজ প্রথমবারের মতো ঘুমাবে সায়েম এবং নাজ। ভয়, লজ্জা, সংকোচ – এসকল অনুভূতির এক সংমিশ্রণ আঁকড়ে ধরেছে নাজকে। সায়েম বিছানার এক পাশে গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে ফোন টিপছে। রাত এগারটা চুয়াল্লিশ, এই সময়ে সাধারণত নাজ থাকে গভীর ঘুমে মগ্ন। অথচ সায়েমের চোখেমুখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। সে কি প্রতিদিন এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকে?
তার পাশে অথচ কিছুটা দূরে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বসে আছে নাজ। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সায়েম আড়চোখে কয়েক মুহূর্তের জন্যে পর্যবেক্ষণ করল তাকে।
অবশেষে ফোনটা বালিশের নিচে রেখে হাই তুলতে তুলতে বলল, “সারাটা রাত কি বসে বসেই কাটাবে? যদি সেই ইচ্ছাই থাকে তাহলে প্লিজ ওই চেয়ারটায় গিয়ে বসে থাক। আমি একটু আরাম করে ঘুমাই।”
নাজ ব্যথিত কণ্ঠে বলল, “বসে বসে কাটাতে যাবো কেন?”
সায়েম তাদের দুজনের মাঝখানে একটা কোলবালিশ রাখতে রাখতে বলল, “তাহলে শুয়ে পড়ো। সকালে উঠতে হবে তো!”
নাজ ইতস্তত করতে করতে সায়েমের পাশে শুয়ে পড়লো। কেন জানি তার ভয়ঙ্কর লজ্জা করছে। লজ্জায় চোখমুখ বন্ধ হয়ে আসছে।
তবুও বহুকষ্টে নিজেকে সামলে বলল, “শুনুন, আপনি কিন্তু সাবধানে ঘুমাবেন।”
“কেন?”
“ঘুমের মধ্যে আমি ফুটবলার হয়ে যাই। আমার পাশে যদি কেউ থাকে, তাহলে তাকে লাথি মেরে ফেলে দিই। ছোটোবেলায় একবার আমার এক ফুপাতো বোন আমাদের বাড়িতে এক মাসের জন্যে বেড়াতে এসেছিল। ওকে রাতে ঘুমাতে দেওয়া হলো আমার পাশে। একদিন বেচারিকে এমন লাথি মারলাম, যে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে ফেলল।”
সায়েম ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল, “তোমার কি ধারণা? তুমি আমাকে ফেলে দিতে পারবে?”
“কেন পারবো না?”
“আচ্ছা, দিও।” বলেই, সায়েম বাতি নিভিয়ে ওপাশ ফিরল।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরজুড়ে ভেসে এলো নাজের বিকট চিৎকার। নাজ আঁতকে উঠে বসে পড়ল।
সায়েম তার দিকে ফিরে ভ্রু কুঁচকে বলল, “এই মেয়ে! তুমি দেখছি সকলকে এ ঘরে জড়ো করবে। কী হলো আবার?”
নাজ লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আতঙ্কজড়িত কণ্ঠে বলল, “আপনি লাইট অফ করলেন কেন?জানেন না আমি অন্ধকারে ভয় পাই।”
“তাই বলে ঘুমানোর সময়েও লাইট জ্বালিয়ে রাখতে হবে?”
“হ্যাঁ! এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমার কোনদিনও ঘুম আসবে না। আপনি জলদি লাইটটা অন করুন তো!”
“ওয়েট আ মিনিট! তার মানে তুমি এতদিন লাইট অন রেখে ঘুমাতে? আর আমি ভাবতাম তুমি রাত জেগে পড়ছো।”
নাজ বিড়বিড় করে বলল, “দিনেই পড়ি না আবার রাত জেগে।”
তবে বিড়বিড় করে বললেও সায়েম বোধ হয় ঠিকই বুঝে গেল।
সায়েম লাইট অন করে আবারও আগেরও ভঙ্গিতে শুয়ে চোখদুটো বন্ধ করে বলল, “ঈদটা যেতে দাও, তুমি দিনেও পড়বে, রাত জেগেও পড়বে। গুড নাইট!”
নাজ যেন মনে মনে চমকে উঠলো। তার মনের কথাও সম্ভবত বুঝে ফেলার ক্ষমতা মানুষটার রয়েছে।
এ ঘরে বিশাল একটা দেয়াল ঘড়ি রয়েছে। ঘন্টার কাঁটা যখন নতুন ঘরে যায় তখন ক্রমশ উচ্চস্বরে টিকটিক শব্দ করে। আবার কয়েক মিনিট পরেই বন্ধ হয়ে যায়। এখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত তিনটা। ঘড়িটা যথানিয়মে টিকটিক শব্দ করতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে এই শব্দটা পৌঁছায় সায়েমের কর্ণকুহরে। এতে যে তার ঘুমের খুব একটা ব্যাঘাত ঘটে তা নয়।
তবে আজ ঘটল। কারণ দেয়াল ঘড়ির টিকটিক ধ্বনির সঙ্গে আরও একটা আওয়াজ ভেসে এলো সায়েমের কানে। একটা চিৎকারের শব্দ। চিৎকারটা অবশ্যই নাজের, তবে এবারের আগের তুলনায় কয়েকগুণ বিকট। এই মেয়ের সমস্যাটা কী? তাকে কি আজ চিৎকার-করা রোগে ধরলো?
সায়েম চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো। আশেপাশে কোথাও নাজকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু অস্ফুটস্বরে তার চাপা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! মেয়েটা গেল কোথায়?
কয়েক মুহূর্ত পর ঘুমের ঘোর কেটে গেলে সায়েম যখন সংবিৎ ফিরে পেল, তখন তার মনে হলো – মেয়েটা পড়ে যায়নি তো? খানিকটা ঝুঁকে মেঝের দিকে তাকাতেই তার ধারণার সত্যতা মিলল। নাজ মেঝেতে পড়ে আছে আর ডান হাতের কবজি চেপে ধরে নিঃশব্ধে কাঁদছে।
সায়েম তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে তার কাছে যেতে যেতে বলল, “নাজ? পড়ে গেলে কী করে?”
নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আমি কী জানি? আমি তো শান্তিতে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ কী যেন হলো, ধুম করে পড়ে গেলাম।”
“খুব তো বাহাদুরি করে বলছিলে, আমাকে ফেলে দেবে। শেষমেষ নিজেই পড়ে গেলে?”
নাজ সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “এক মিনিট! এক মিনিট! তার মানে আপনি?”
“আমি কী?”
“আপনি আমাকে ইচ্ছা করে ফেলে দিয়েছেন তাই না?”
সায়েম নাজের মুখোমুখি মেঝে বসতে বসতে বলল, “শাট আপ ইউ ইডিয়ট! আমি কি তোমার মতো ছেলেমানুষ যে ইচ্ছা করে ফেলে দেবো? কই দেখি, কোথায় লেগেছে?”
সঙ্গে সঙ্গে সায়েম নাজের ডান হাতটা ধরে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো ক্ষতচিহ্নটা। মানুষটার এই এতটুকু স্পর্শেই শিউরে উঠলো নাজ। তার স্পর্শে কী আছে কে জানে? স্বাভাবিকতা হারিয়ে কেমন যেন ঘোরের জগতে চলে গেল সে। প্রবল এক প্রশান্তির আন্দোলন বয়ে গেল তার সমস্ত অন্তরাত্মা জুড়ে।
সায়েম ধমকের সুরে বলল, “ইশ! কতখানি ছুলে গেছে! তুমি কি ঘুমের মধ্যেও শান্ত থাকতো পারো না নাজ? সব সময় শুধু বাঁদরামি!”
কথাগুলো ধমকের সুরে বললেও তার মাঝে এক সূক্ষ্ম উদ্বেগ লুকিয়ে রয়েছে তা ঠিকই টের পেলো নাজ।
“আর কোথাও লেগেছে?”
নাজ হঠাৎ চমকে উঠে ফিসফিস করে বলল, “না।”
কথাটা আসলে সত্যি নয়। নাজ হাঁটুতে বড়সড় চোট পেয়েছে। আচমকা পড়ে যাওয়ায় জায়গাটা এমন বাজেভাবে ছুলে গেছে যে সালোয়ারের খানিকটা অংশ পর্যন্ত ফেটে গেছে। কিন্তু এই কথা ছেলেটাকে বলা যাবে না। শেষমেষ বলে বসবে, “কই দেখি কী কান্ড ঘটিয়েছ!”
“উঠে বসো, আমি আসছি। উঠতে পারবে?”
“হুঁ।”
নাজ বিছানায় উঠে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সায়েম ফিরে এলো ফার্স্ট এইড কিড আর একটা বরফভর্তি বোতল নিয়ে।
বোতলটা নাজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আরও যেখানে লেগেছে, সেখানে এটা চেপে ধরো।”
নাজ হতভম্ব বনে গেল। নাজ যে আরও কোথায় ব্যাথা পেয়েছে, ছেলেটা বুঝলো কী করে? নাজের মনে মাঝে মাঝে প্রবল সন্দেহ জাগে। নির্ঘাত সে থট রিডিং জানে, মানুষের অজান্তেই তার মনের কথাগুলো পড়ে ফেলতে পারে।
নাজ ইতস্তত করে বোতলটা চেপে ধরলো তার বাম হাঁটুতে। এদিকে সায়েম গভীর মমতার সঙ্গে নাজের হাতে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।
নাজ নিচু গলায় বলল, “এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না কিন্তু।”
“আর তোমারও এভাবে পড়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কে বলেছিল একেবারে বিছানার কোণায় গিয়ে ঘুমাতে?”
নাজ কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “ভাবলাম আপনার যেন কোনো সমস্যা না হয়…”
“আমার সমস্যা হবে কেন? আমার কি তোমার মতো মানুষকে ফেলে দেওয়ার স্বভাব আছে? শুয়ে পড়ো তো এখন!”
ঘুমাতে এসে সায়েম লক্ষ করলো নাজ আবারও একেবারে বিছানার শেষ প্রান্ত ঘেঁষে শুয়ে আছে।
সায়েম তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “এই মেয়ে কাছে সরে আসো, আবারও পড়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে না-কি?”
নাজ ইতস্তত করতে করতে বেশ অনেকটা কাছেই চলে এলো সায়েমের। কোলবালিশটা ছাড়া তাদের মধ্যে খুব একটা ফাঁক নেই। এই মানুষটার দুই মিটার রেডিয়াসের ভেতরে কোনো একটা যাদু আছে। এই রেডিয়াসের ভেতরে এলেই মুগ্ধতায় আর অস্থিরতা কেমন যেনো এলোমেলো করে তোলে নাজকে।
অতিরিক্ত কোনো কিছুই সহ্য করা যায় না। অতিরিক্ত মুগ্ধতাও নয়। তাই চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে তলিয়ে নাজ।
পাঁচ মিনিট পর আবারও শোনা গেল সায়েমের কণ্ঠস্বর, “নাজ, এই নাজ?”
নাজ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “হুঁ?”
“নাজ! ওঠো না!”
“উফ! এত বিরক্ত করেন কেন আপনি? সবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
“এইটুকু সময়ের মধ্যে আবার কেউ ঘুমিয়ে পড়তে পারে না-কি?”
“আমি পারি।”
“উঠেই যখন পড়েছ তখন আমার ফোনটা চার্জে দিয়ে দাও না। তোমার হাতের কাছেই চার্জারটা।”
নাজ হতভম্ব গলায় বলল, “আপনি ফোনে চার্জ দেওয়ার জন্যে আমাকে ডেকে তুলেছেন?”
“হ্যাঁ, দেখো না মাত্র একুশ পার্সেন্ট চার্জ।”
নাজ সায়েমের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে চার্জে দিল। সায়েম কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো নাজ জেগে রইল সারারাত। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। নাজ নিশ্চিত, মানুষটা ইচ্ছা করে ডেকে তুলেছে তাকে।
শেষ রাতের দিকে চোখে ঘুম জড়িয়ে এলেও খুব সকাল সকাল উঠে পড়তে হলো নাজকে। নাজ প্রতিদিন সকালে উঠে ঘুম কাটার আগ পর্যন্ত টিভির সামনে বসে থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ঘুম তার চোখে এখনো দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে। নাজ বিরসমুখে টিভির চ্যানেল ঘোরাচ্ছে, আর সায়েম পাশের সোফাটায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে।
রান্নাঘর থেকে খুন্তি নাড়িনাড়ির শব্দ আসছে। হাসনা বেগম আর কনা অনেকক্ষণ যাবত কী যেন করছে। নাজের উচিত রান্নাঘরে গিয়ে তাদের সাহায্য করা। কিন্তু বিরক্তিতে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। বিরক্তি নিয়ে শাশুড়ির সামনে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
হাসনা বেগম রান্নাঘর থেকে উচ্চস্বরে বললেন, “বৌমা উঠেছ?”
“জি মা।”
“তুমি তো এখন বাড়ির বৌ তাই না? এত দেরি করে উঠলে কী করে হয় বলো?”
“আমার কোনো দোষ নেই না। সব দোষ আপনার ছেলের! আপনার ছেলে সারারাত আমাকে এক ফোঁটাও ঘুমাতে দেয় নেই।”
সায়েম সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকা থেকে মুখ তুলে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো নাজের দিকে।
ওদিকে হাসনা বেগম উচ্চস্বরে বললেন, “কী বললে? শুনতে পাইনি, কাছে এসে বলো।”
নাজ উঠতে যাবে তখনই সায়েম বলে উঠল, “আমার দোষ মানে? আমি কী করেছি?”
নাজ আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে বলল, “আপনার ফোনে চার্জ দিয়ে গিয়েই তো আমার ঘুমের বারোটা বাজলো।”
সায়েম কঠিন গলায় বলল, “তাও যদি ঠিক মতো চার্জ দিতে!”
“মানে?”
“মানে আজ সকালে উঠে দেখি সেই ফোনের চার্জ একুশ পাসেন্টই রয়ে গেছে। একটা কাজও যদি ঠিকমতো পারো। আর মাকে এমনভাবে বলছিলে, সে তো ভেবে বসবে সারারাত জাগিয়ে রেখেছিলাম অন্য কারণে।”
প্রবল লজ্জারা আঁকড়ে ধরলো নজকে। আসলেই তো। হাসনা বেগম না জানি কী ভেবে বসতো, ভাগ্যিস সে শুনতে পায়নি নাজের কথা।
হাসনা বেগম আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বসার ঘরে এসে বললেন, “কী বলছিলে বৌমা?”
নাজ হড়বড় করে বলল, “আসলে মা মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে যায়, আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে তুমুল ঝগড়া বেধেছিল। চেঁচামেচি, জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি! এর মধ্যে ঘুমানো যায় বলুন?”
“আহারে! মানুষ যে ঝগড়াঝাটি করে কী পায়।”
সায়েম দুষ্টুমিমিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “তাই না-কি নাজ? কই আমি তো শুনলাম না।”
রাগের তীব্র স্রোত গা বেয়ে বয়ে গেল নাজের। একে তো মাঝ রাতে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে আবার তার সঙ্গেই হেয়ালি করা হচ্ছে!
সায়েম অফিসে চলে গেছে। হাসনা বেগম আজ ইলিশ মাছ রাঁধবেন। রান্নার আগে কী এক কায়দায় মাছটা ভেজে নিতে হয়। নাজ তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছ ভাজা দেখছে। যদিও ইলিশ মাছ তার পছন্দ নয়, তবে রেসিপিটা জানা থাকলে তো আর ক্ষতি নেই।
কিছুক্ষন পর হুট করে কনা রান্নাঘরে এসে উৎফুল্ল গলায় বলল, “দোস্ত! চকলেট খাবি?”
নাজ ভ্রু কুঁচকে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল কনার হাতভর্তি চকলেট। একটা চকলেট খুলে ইতোমধ্যে খাওয়াও শুরু করেছে।
নাজ শঙ্কিত গলায় বলল, “চকলেট কোথায় পেলি?”
“এক লোক এসে দিয়ে গেল। এক বক্স চকলেট! আবার কোনো টাকাও নিলো না। কী অদ্ভুত তাই না?”
নাজ সঙ্গে সঙ্গে বেড়িয়ে এসে দেখল ডাইনিং টেবিলে বড়সড় একটা বাক্স পড়ে আছে। বাক্স ভর্তি দেশি বিদেশি সব চকলেট। ঠিক আগেরটার মতোই কুরিয়ারে এসেছে। বাক্সের ওপরে প্রেরকের নাম ঠিকানা কিছুই নেই। অথচ নাজের নাম ঠিকই আছে। কে এই বাক্সগুলোর প্রেরক? এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে?
(চলবে)
#অপেক্ষারা
১৭.
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“জিনিসগুলো কে পাঠাতে পারে বল তো?” চিন্তিত গলায় বলল নাজ।
কনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটাই তো ভাবছি। মানুষ হুটহাট এ ধরনের গিফট পেলে ধরেই নেয় এক্সের কাজ। কিন্তু তোর তো আবার এক্স-টেক্স নেই।”
“সেটাই তো! প্রথমবার যখন বক্সটা এল, ভেবেছিলাম ভুলে চলে এসেছে। কিন্তু এবার?”
কনা সন্দেহযুক্ত গলায় বলল, “নাজ?”
“হুঁ?”
“প্রত্যয়ের কাজ নয় তো?”
“প্রত্যয় কে?”
“আরে বাবা মনে নেই! ক্লাস নাইনে তোকে প্রপোজ করেছিল, তুই সকলের সামনে রিজেক্ট করলি।”
নাজ বিরক্ত গলায় বলল, “কী যে বলিস! কোথাকার কোন প্রত্যয়, আমার ঠিকানা জানবে কী করে?”
“জানতেই পারে। আজকাল ও ঢাকাতেই ওর মামার সঙ্গে থাকে। কী যেন নাম জায়গায়!”
কনা খানিকটা ভেবে বলল, “হাতির শূড়! হাতির শূড়ে ওদের বাসা।”
নাজ বিরস মুখে বলল, “ওটা হাতিরপুল হবে।”
“ওই একই কথা।”
“এক মিনিট! এক মিনিট! হাতিরপুল তো এখান থেকে অনেক কাছে।”
“তাই তো বলছি! মনে কর একদিন তুই কলেজ থেকে ফিরছিলি, আর বদটা তোর পিছু নিয়ে বাসার ঠিকানা জেনে গেল।”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “কেমনটা লাগে বল তো! আমি তো ওই ছেলেকে চিনি পর্যন্ত না। হুট করে একদিন সবার সামনে প্রপোজ করে বসলো, আমি রিজেক্ট করলাম। ব্যস এ পর্যন্তই। নতুন করে আবার এসবের মানে কী?”
“মনে হয় পুরনো প্রেম আবার জেগে উঠেছে।”
নাজ চিন্তিত গলায় বলল, “তোর ভাইয়া যদি জানতে পারে তাহলে কী হবে একবার ভেবে দেখ।”
“কী আর হবে? ছেলেটা তোকে এসব হাবিজাবি পাঠাচ্ছে, তোর তো এতে কোনো দোষ নেই।”
“তবুও…”
“আরে বাবা, এত চিন্তা করছিস কেন? সবে তো দুটো বক্স এলো। এখনই চিন্তার কিছু নেই, চিন্তার বিষয় হবে যদি আরেকটা বক্স আসে। এখন শান্তিতে চকলেটগুলো খেতে দে তো!”
নাজ আহত গলায় বলল, “একটা অচেনা মানুষ চকলেট পাঠিয়েছে আর তুই অনবরত খেয়েই যাচ্ছিস। যদি কিছু মেশানো থাকে?”
“কী মেশানো থাকবে? বিষ? বিষ মেশানো থাকলে মরবো, তবে কোনো আফসোস থাকবে না। ভালো জিনিস খেয়ে মরেছি।”
নাজ উঠে চলে এলো, এই মেয়ের সঙ্গে কথা বলে কোনোই লাভ নেই। চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে সারা ঘর জুড়ে। নাজ বরাবরই সাধারণ একটা জীবন যাপন করে এসেছে। যে জীবনে খুব একটা ঝামেলা আর দুশ্চিন্তা নেই। দুশ্চিন্তা করে অভ্যস্ত নয় বলেই হয়তো আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠেছে নাজ।
কেউ একজন তাকে ঘিরে রহস্যের জাল বুনছে, তাকে ভড়কে দেওয়ার চেষ্টা করছে। নাজ ভড়কে গেছেও। যে ছেলেটাকে সে চেনে পর্যন্ত না, তার পাঠানো উপহারগুলো কেন এত ভাবাচ্ছে নাজকে। ছেলেটা তার সামনে থাকলে এতক্ষণে তার একটা দাঁতও আস্ত থাকতো না, চোখের আড়ালে আছে বলেই এই সাহসটা পাচ্ছে।
নাজ ঠিক পরবর্তীতে নাম-ঠিকিনা বিহীন রহস্যময় এমন কোনো বক্স এলে সে রিসিভই করবে না। তার একমাত্র ভয় হচ্ছে সায়েমকে নিয়ে। সায়েম যদি উপহারের এই বিষয়টা জানতে পারে? যদি ভুল বোঝে তাকে?
নাজের প্রতি সায়েমের এক বিন্দুও ভালোলাগা আছে কিনা সন্দেহ, তাহলে নাজ এত ব্যাকুল হয়ে তাকে হারানোর দুশ্চিন্তা করছে কেন? আসলে মানুষটাতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রাগী-গম্ভীর ওই মানুষটাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে তার পৃথিবী। তাকে ছাড়া বাঁচার চিন্তা করা মোটেও সহজ নয় নাজের পক্ষে।
সন্ধ্যার পর পর নাজ ছাদ থেকে শুকনো কাপড়গুলো তুলে আনলো। ভেজা কাপড়গুলো দুপুরবেলা জরিনা মেলে এসেছে, ইতোমধ্যেই শুকিয়ে গেছে। কাপড়গুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছে নাজ। হাসনা বেগম আর শওকত সাহেবের কাপড়গুলো তাদের ঘরে রেখে এলো।
সায়েমের কাপড়গুলো যখন তার আলমারিতে রাখতে যাবে, তখনই কোত্থেকে যেন সায়েম ছুটে এসে বলল, “এই তুমি আমার আলমারির সামনে কী করছো?”
“আপনার কাপড়গুলো তুলে রাখছি।”
“তোমাকে এসব কে করতে বলেছে? দাও, আমি তুলে রাখছি।”
নাজ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। প্রথম থেকেই লক্ষ করছে মানুষটা তার ব্যক্তিগত জিনিস কাউকে ধরতে দেয় না। কাউকে বলতে নাজকে। মানুষটাকে সত্যিই বোঝা খুব কঠিন। তাকে মাঝে মাঝে মনে হয় খুব কাছের কেউ, আবার ঠিক পরমুহূর্তেই মনে হয় খুব দূরের।
নাজ গম্ভীর গলায় বলল, “তো রাখুন না! আমারও কোনো ইচ্ছা নেই আপনার আলমারিতে হাত দেওয়ার।”
নাজ হনহন করে বসার ঘরে চলে এল। সায়েম আজ আগে আগেই অফিস থেকে চলে এসেছে। কাল থেকে তার পাঁচ দিনের ঈদের ছুটি। আবার কাল থেকেই শুরু হবে বাড়ির সকলের ঈদের শপিং। হাসনা বেগম নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে ভাবুক গলায় একটা একটা জিনিসের নাম বলছেন, আর কনা বিরক্তগলা সেগুলো লিস্টে লিখছে।
নাজ কনার পাশে বসে আগ্রহ নিয়ে তাদের কর্মকান্ড দেখছে। কিছুটা সময় পর সায়েমও এসে বসল বসার ঘরের সোফায়।
“কী লিখেছিস? দারুচিনি?”
কনা শুকনো গলায় বলল, “হুঁ।”
“এবার লেখ, জায়ফল।”
“লিখেছি। তারপর?”
হাসনা বেগম কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “জয়ত্রী।”
কনা গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, ‘জয়তরি’।
লেখার সঙ্গে সঙ্গেই সায়েম বলে উঠল, “ছি ছি! কলেজে উঠেছিস আর জয়ত্রী বানান পারিস না? আজকাল চারিদিক বাজে ছাত্রীতে ভরে গেছে।”
নাজ সরু চোখে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। কথাটা যে তাকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে, তা বুঝতে বাকি রইল না।
কনা আহত গলায় বলল, “ভাইয়া এটা তো পরীক্ষার খাতা না, যে সঠিক বানান লিখতেই হবে! বানান ভুল করলে ম্যাডাম নাম্বার কাটবে! দোকানদার বুঝতে পারলেই তো হলো।”
“যা লিখেছিস দোকানদারও বুঝতে পারবে না। জয়তরি আবার কী? মনে হচ্ছে কোনো গ্রামের মেয়ের নাম।”
বিরক্তিতে কনার গা জ্বলে গেল, তবে সেই বিরক্তি প্রকাশ করলো মায়ের কাছে, “মা! এসব কোন দেশি মশলা নাম বলছো? বিরিয়ানি রাঁধতে আবার জয়ত্রী-টয়ত্রী লাগে না-কি?”
হাসনা বেগম গম্ভীর গলায় বললেন, “পারিস তো খালি খাওয়ার সময় হাজির হতে, রান্নার সময় কখনো পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছিস কীভাবে কী করছি?”
কনা কিছু বলে ওঠার আগেই নাজ বলল, “মা? আপনি আমাকে বিরিয়ানি রাঁধতে শেখাবেন?”
হাসনা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন, “সেকি বৌমা! তুমি বিরিয়ানি রাঁধতে পারো না?”
নাজ ইতস্তত করে বলল, “না মানে, পারি। তবে আপনার মতো পারি না।”
প্রংশায় বিগলিত হয়ে হাসনা বেগম প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বলল, “শেখাবো, শেখাবো। শাশুড়িরাই তো বৌদের হাতে ধরে রান্নাবান্না শেখায়। এবারের শীতের ছুটিতে যখন বাড়ি যাবে, তখন হাতে কলমে আমার সব রেসিপিগুলো শিখিয়ে দেবো।”
সায়েমের ঠোঁটে কোণে সূক্ষ্ম এক হাসির রেখা ফুটে উঠল। সকলের চোখ এড়িয়ে গেলেও নাজের চোখে ঠিকই ধরা পড়ল। হাসিটা যেন স্পষ্টভাবেই তাকে বলছে, “তুমি করবে রান্না! এ যেন অষ্টম আশ্চর্য!”
হাসনা বেগম কোমল গলায় বললেন, “সায়েম? বাবা শোন।”
সায়েম টিভিতে গেম খেলছে, হাতে গেমিং কনসোল। তার সমস্ত মনোযোগ এখন সেটাতেই আটকে আছে। এমন একটা ভাব যেন প্রলয় এসে গেলেও তার কিছু যায় আসে না।
না টিভির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, “বলো মা।”
“আহা, রাখ ওটা!”
“রাখতে পারবো না। কী বলবে বলো।”
হাসনা বেগম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, “বলছিলাম কী, তোদের বিয়েটা তো কেমন তাড়াহুড়োর মধ্যে দিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরদিনই আবার ঢাকায় চলে এলি। আত্মীয়-স্বজনরা তো ঠিকমত নাজকে দেখতেই পারলো। ওরা প্রায়ই ফোন করে জিজ্ঞেস করে, নতুন বৌকে কবে দেখবো।”
সায়েম স্বাভাবিক গলায় বলল, “ও আচ্ছা। তুমি বরং এক কাজ করো, নাজের কয়েকটা ছবি ওয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দাও। এই কনা, মাকে একটু হেল্প করিস তো!”
হাসনা বেগম বিরস গলায় বললেন, “সবসময় ফাজলামি করবি না তো! আমি ভাবছিলাম ঈদের পরপর তোদের বিয়ের একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়। বিয়ের পর পর এমন অনুষ্ঠান তো সবাই করে। একে কী যেন বলে, রিসিট…”
কনা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “মা, রিসিপশন।”
“হ্যাঁ রিসিপশন! আমি ভাবছিলাম, রাজ্যের আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে একটা রিসিপশন করবো। তাদের নতুন বৌ দেখাও হলো, তোদের বিয়ের ভালো একটা অনুষ্ঠান হলো।”
সায়েম হাই তুলতে তুলতে বলল, “এসব রিসিপশন-টিসিপশন ওয়েস্ট অফ টাইম ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া রিসিপশন হয় বিয়ের দুদিন পর, ছয় মাস পর নয়।”
“ছয় মাস এমন কোনো সময় হলো?”
“মা শোনো, গ্লোবালাইজেশনের যুগে আজকাল ছয় মাস অনেক লম্বা সময়।”
হাসনা বেগম ধমকের সুরে বললেন, “আমাকে জ্ঞান দিতে আসবি না! একবার যখন বলে দিয়েছি তোদের রিসিপশন হবে, তখন হবেই!”
সায়েম শান্ত গলায় বলল, “হতেই পারে, তবে সেখানে আমি থাকতে পারবো না। তুমি খুব ভালো করেই জানো এসব আত্মীয়দের দেখলে আমার গা ঘিনঘিন করে।”
হাসনা বেগম ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, “মা-বাবা, ভাই-বোন, বউ-বাচ্চা কেবল এগুলো ঘিরেই পরিবার হয় না সায়েম। আত্মীয়-স্বজনরাও তো পরিবারের অংশ। অবশ্য এসব কথা তোকে বুঝিয়ে লাভ নেই, তোকে বোঝাতে বোঝাতে আমার চুলগুলো পেকে গেল।”
হাসনা বেগম ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে চলে গেলেন তার ঘরে। নাজ খেয়াল করেছে, সায়েম বিয়ের ব্যাপারটা সকলের কাছ থেকে গোপন রাখতে চায়। সেদিন রেস্টুরেন্টে ওই মেয়েটার কাছ থেকে নিজের বিয়ের ব্যাপারে এড়িয়ে গেল। আবার ফেসবুকেও রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস এখনো সিঙ্গেল দিয়ে রেখেছে। অবশ্য তাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। নাজ নিজেও উচু গলায় সকলকে বলে বেড়ায় না সে বিবাহিত। কলেজে কয়েকজন ম্যাডাম ছাড়া তেমন কেউই জানে না, এমনকি তুষিও নয়।
হঠাৎ কী যেন মনে করে খিলখিল করে হেসে উঠল নাজ। তার হাসির ঝনঝন শব্দে চারিদিকে কেমন যেন অন্যরকম আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
সায়েম সরু গলায় বলল, “কী ব্যাপার? হাসছো কেন?”
নাজের হাসি যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে এমন একটা অবস্থা।
কনা ক্লান্ত গলায় বলল, “কী রে দোস্ত! পুরোপুরি পাগল হয়ে গেলি না-কি?”
নাজ কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, “আমি জানি আপনি কেন রিসিপশনের জন্যে রাজি হলেন না।”
“কেন?”
“কারণ তাহলে সবাই জেনে যাবে, আপনাকে বিয়ে না করে ওই মেয়েটা পালিয়ে গিয়েছিল।”
আবারও শুরু হলো নাজের খিলখিল হাসি। হাসলে মেয়েটাকে খারাপ লাগে না তো!
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল নাজের। এতটা ভোরে সাধরনত ঘুম ভাঙ্গে না তার। সূর্য কেবল তার উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে ধরণীতে। পাখিগুলোও আপন নীর ছেড়ে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে মুক্ত আকাশে, কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত করছে চারিদিক।
নাজ ঘুম জড়ানো চোখে তাকালো তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে। মানুষটার চেহারায় কেমন একটা প্রশান্তির ভাব লুকিয়ে আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় এই প্রশান্তি যেন বহু গুণ বেড়ে গেছে। সায়েমের অবাধ্য চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালের ওপর। চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে।
নাজ শুনেছে, মানুষ স্বপ্ন দেখলে তার চোখের পাতা এমন করে কাঁপে। একে বলে র্যাপিড আই মুভমেন্ট, সংক্ষেপে REM। মানুষটাকে নিশ্চয়ই সুন্দর কোনো স্বপ্ন দেখছে। আচ সায়েম কি কখনো নাজকে স্দেখলেও সেই স্বপ্নে নাজ কী রূপে ধরা দেয়, পড়াশোনায় অমনোযোগী বিচ্ছু একটি মেয়ে রূপে না-কি পুতুলের মতো সুন্দর ভালোলাগার মানুষ হিসেবে।
নাজ প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখদুটোকে অন্যদিকে ফেরাতে, পারছে না। ভাগ্যিস ছেলেটা জেগে নেই, না হলে এতক্ষণে খবর হয়ে যেত নাজের।
হঠাৎই সুপ্ত একটা ইচ্ছা জেগে উঠল নাজের মনে। ইচ্ছাটা হলো পাশে শুয়ে থাকা ওই মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়া। বেশিক্ষণ নয়, কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তাতে কি খুব বেশি পাপ হবে?
তাকে ছুঁয়ে দেখার জন্যে হাত বাড়ালো নাজ। সঙ্গে সঙ্গে সংবিৎ ফিরে ধড়মড় করে উঠে বসলো। কী সাংঘাতিক! নাজ আবার কবে থেকে ওই মানুষটার প্রতি এত দুর্বল হয়ে উঠল? তার কাছে তো সায়েম রাগী-গম্ভীর, করলার মতো তিতা একটা মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়।
নাজ সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। কয়েক মুহূর্ত আগে নিজের সম্পর্কে ভয়ঙ্কর এক সত্য আবিষ্কার করেছে সে। সত্যটা হলো সায়েম নামের ওই মানুষটাকে ঘিরে তার প্রচন্ড ভালোলাগা কাজ করে।
নাজ কখনো কাউকে ভালোবাসেনি, ভালোবাসা কী তার জানা নেই। তবে সে এতটুকু নিশ্চিতভাবে বলতে পারে সায়েমকে তার নিজের অস্তিত্ব কল্পনা করা তার পক্ষে অসম্ভব।
(চলবে)