অপেক্ষারা পর্ব-২০+২১

0
609

#অপেক্ষারা
২০+২১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বিকেলের দিকে আকাশে মেঘাচ্ছন্ন ভাবের সৃষ্টি হলেও, এখনো তা বজায় আছে কিনা রাতের অন্ধকারের কারণে বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো আছে। কিছুক্ষণ পর পর আকাশে মেঘেরা গুড়গুড় শব্দ করছে। গ্রামে থাকতে বৃষ্টির আভাস পেলেই কেমন নেচে উঠতো নাজের মন। বৃষ্টি মানেই ছিল বান্ধবীরা দল বেঁধে বাড়ির উঠানে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির প্রতিযোগিতা। এখানে তো রাজ্যের সব বান্ধবীরা নেই, সুবিশাল উঠানও নেই।

নাজের মনটা তখন থেকে ভার হয়ে আছে। কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করছে না, কারও সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। সে এখন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে বিছানার এক কোণে। একটু আগে শাশুড়ি মা রাতের খাবারের জন্যে বহু ডাকাডাকি করে গেলেন, তবে নাজ শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে ঘরেই শুয়ে রইল।

কোনো প্রকার অজুহাত দিতে তার ভালো লাগে না, তবে না দিয়েই বা উপায় কী! শরীর খারাপ সকলের কাছে যতটা না স্বাভাবিক, মন খারাপ তার থেকেও বেশি অস্বাভাবিক। সায়েম তার পছন্দমতো গরু না আনায় মন খারাপ হয়েছে, মন খারাপ হয়েছে তার ধমকে।

এমন প্রচন্ড ধমকের কী প্রয়োজন ছিল? একটাবার সুন্দর করে বলে দেখলেও তো পারতো, “নাজ, যে গরুটা এনেছি আপাতত সেটাতেই খুশি থাকো। পরেরবার তোমার পছন্দমত গরুই আসবে।”

এমনটা আগে কখনো তো হয়নি। এর আগেও তো বহুবার সায়েমের কাছে ধমক খেয়েছে নাজ। কই তখন তো তার অন্তরাত্মা এভাবে এলোমেলো হয়ে যায়নি! কখনো মনে হয়নি এতটা কষ্ট সে জীবনেও পায়নি

কারো দৃঢ় পায়ের শব্দে চোখদুটো বুজে ফেলল নাজ। সেই কেউটা কে, বুঝতে তার খুব একটা সময় লাগলো না। ইতোমধ্যেই মিষ্টি একটা পারফিউমের সৌরভ ঘরজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। এই পারফিউম নাজের চেনা কেবল একটা মানুষই ব্যবহার করে, সায়েম।

সায়েম এসে নাজের মাথার কাছ বসে ডাকল, “নাজ!”

নাজ সাড়া না দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে রইল। ভাবটা এমন যেন, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে।

সায়েম আবারও বলল, “কী ব্যাপার নাজ? না খেয়ে শুয়ে পড়েছ কেন?”

নাজ শুকনো গলায় বলল, “শরীরটা ভালো লাগছে না।”

“শরীর ভালো লাগছে না মানে? কী হয়েছে?”

নাজ চুপ করে রইল।

“তোমার এসব ভান আমার সঙ্গে চলবে না নাজ, গেট আপ কুইক!”

“ভান করছি না তো!”

“তাহলে কী? আমার ওপরে রাগ করেছ তাই না?”

নাজ অভিমানজড়িত কণ্ঠে বলল, “না। আপনার ওপর রাগ করতে যাবো কেন?”

সায়েম কী যেন মনে করে অত্যন্ত কোমল স্বরে বলল, “আচ্ছা, আই অ্যাম সরি। একটু বেশিই বকে ফেলেছি তাই না? তুমি মাঝে মাঝে এমন বিরক্ত করো! আমার আর কীই আবার করার থাকে?”

নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আপনি সবসময় এমন করেন।”

“আচ্ছা বাবা সরি, এতটুকুর জন্যে কাঁদতে হবে না। এসো খেয়ে নাও, নাহলে সত্যি সত্যি শরীর খারাপ হবে।”

নাজের চোখ ক্রমশ ভিজে উঠছে। এবার আর মন খারাপের জন্যে নয়, বরং খুশিতে। মানুষটার এতটুকু মমতামাখা আবেদনের মধ্যে যে কতটা প্রশান্তি লুকিয়ে আছে তা সে কোনোদিন জানবে না।

পরদিন সকাল সকাল কনার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল নাজের।

কনা উৎফুল্ল গলায় বলল, “নাজ! দেখা যা কী কান্ড ঘটেছে!”

নাজ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে? তুই বয়ফ্রেন্ড পেয়ে গেছিস?”

“তার থেকেও ভালো! তাড়াতাড়ি ওঠ।”

নাজ উঠে বসতেই কনা তাকে টানতে টানতে নিয়ে এলো গ্যারেজে। গ্যারেজে আসতেই যেন তার চোখ দুটো উঠে গেল কপালে। তাদের হালকা বাদামি রঙের গরুটার পাশে বাঁধা রয়েছে সাদাকালো আরেকটি গরু।

নাজের আনন্দ যেন সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল। সায়েম নামের ওই মানুষটা যে মনে মনে তাকে নিয়ে ভাবে, এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই রইল না।
_____

আজ পবিত্র ঈদ উল আযহা। মুসল্লিদের ঘরে ঘরে ত্যাগের মহিমায় পালিত হচ্ছে পবিত্র এই উৎসবটি। দুঃখ-দুর্দশা, গ্লানি – জরা ত্যাগ করে সকলের উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠার দিন। সায়েম এবং শওকত সাহেব নামাজ পড়তে গেছে ঈদগাহে। এদিকে হাসনা বেগম আয়োজন করে সেমাই রাঁধতে বসেছেন। তারা ফিরে এলে সকলে একসঙ্গে সেমাই খাবে। এরপরই কোরবানি আর মূল রান্নাবান্নার পর্ব।

কনা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “দোস্ত! আমাকে সালামি দে!”

নাজ অবাক গলায় বলল, “আমি সালামি দেবো মানে? আমি কি তোর থেকে বড়? বরং তোর থেকে এক মাসের ছোট। সেই হিসাবে তুই আমাকে সালামি দিবি।”

“বয়সে ছোট হলে কী হবে? সম্পর্কে তো তুই-ই বড়! আর কথা বাড়াস না, জলদি সালামি দে!”

“আমাকে সালামি দেয় কে তারই নেই ঠিক, আমি আবার কীসের সালামি দেবো?”

“তোর কোনো অজুহাত চলবে না দোস্ত। সারাবছর কিপ্টামি করবি ভালো কথা, তাই বলে ঈদের দিনেও?”

অবশেষে নাছোড়বান্দা কনা বাধ্য করলো নাজকে সালামি দিতে। অবশ্য শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে সালামি পাওয়ায় খুব একটা আক্ষেপ রইল না নাজের।

কনা সালামির টাকা গুণে ব্যথিত কণ্ঠে মাকে বলল, “মা! তুমি নাজকে আমার থেকে বেশি দিলে কেন?”

“আহা! বেচারির নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে, তাছাড়া তোকে তো প্রতিবছরই দিই।”

“কেন? নাজকে তো গতবছরও দিয়েছিলি। মনে নেই, ও খালার রান্না করা জর্দ্দা নিয়ে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। তোমাকে সালাম করতেই তুমি আঁচল থেকে টাকা বের করে ওকে দিলে। কই, সেবার তো আমার থেকে বেশি দাওনি।”

“দিইনি কারণ সেবার নাজ আমার ছেলের বউ ছিল না। যা তো, কানের কাছে ভ্যাজর ভ্যাজর করবি না!”

কনা শুকনো মুখে বলল, “যাচ্ছি। আগে বলো আমরা বাড়ি ফিরে যাবো কবে?”

“হঠাৎ বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে এত পাগল হচ্ছিস কেন? গতকাল পর্যন্ত তো বলছিলি, সুযোগ পেলে সারাজীবন এখানে থাকতে পারবি!”

“বলছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঈদের সময় এখানে এসে বিরাট লস হয়ে গেল?”

“লস হয়ে গেল মানে?”

“তুমিই একবার ভেবে দেখো মা, বাড়িতে থাকলে এখন চাচা-চাচি, মামা-মামি, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের কাছ থেকে সালামি পেতাম। শোনো মা, ঈদের রেশ থাকতে থাকতেই বাড়িতে ফিরে সালামিগুলো তুলতে হবে।”

“কী ফাজিল মেয়ে রে বাবা! বাড়ি ফিরতে চাইছে সালামি তোলার জন্যে। দূর হ আমার সামনে থেকে!”

সায়েম বাবাকে নামাজ পড়ে ফিরলে কনা এবার তার পীড়াপীড়ি শুরু করলো সালামির জন্যে।

সায়েম হাই তুলতে তুলতে বলল, “সালামি পাওয়ার জন্যে তো সালামও করতে হয়। এই ম্যানারসটা অন্তত শেখ! সালামির কথা পরে ভাবা যাবে।”

কনা সায়েমকে সালাম করে বলল, “এবার দাও!”

সায়েম মানিব্যাগ থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে কনার হাতে ধরিয়ে দিলো।

কনা অসহায় গলায় বলল, “মাত্র একশ টাকা!”

“পুরোটা তোকে দিয়েছি না-কি? এক দৌড়ে নিচে যা, দোকান থেকে একটা কোক নিয়ে আয়। যা টাকা বাকি থাকবে সেটা তুই রেখে দিস!”

কনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “দোস্ত শুনলি!”

“ও কী শুনবে? তুই তাড়াতাড়ি দৌড় দে, একটু পর দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কিন্তু কোক ছাড়াই বিরিয়ানি খেতে হবে।”

ভাই-বোনের এই খুনসুটি মোহিত দৃষ্টিতে দেখছে নাজ। মাঝে মাঝে মনে হয়, তারও একটা ভাই বা বোন থাকলে মন্দ হতো না।

কনা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে চলে গেল কোক আনতে। সে ফিরে আসতেই সায়েম টাকাভর্তি একটা ব্যান্ডেল তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “এই নে, গাধা কোথাকার!” অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে গেল মানুষের উচ্ছাস যেন সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়। কনার বেলায়ও তাই ঘটল। মেয়েটাকে এতটা উচ্ছসিত হতে খুব কমই দেখেছে নাজ।

কিছুক্ষণ পর কসাই চলে আসতেই শুরু হয়ে গেল কোরবানির প্রক্রিয়া। পশু জবাইয়ের এই দৃশ্যটা নাজ কোনোকালেই দেখতে পারে না। রক্ত দেখলেই তার ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, মাথাও খানিকটা ঝিমঝিম করে।

কোরবানি শেষে মাংস ঘরে আনতে আনতে বেলা তিনটা বেজে গেল। এর ঠিক পরপরই শুরু হয়ে গেল হাসনা বেগমের রান্নার আয়োজন। এই পরিবারের ঈদের দিন মানেই তার হাতের বিরিয়ানি! সায়েমদের আত্মীয়-স্বজনেরা তার হাতের এই বিরিয়ানির জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন।

নাজ রান্নাবান্নার শাশুড়িকে সাহায্য করছে, হুট করেই সায়েম এসে বলল, “নাজ, শুনে যাও!”

শাশুড়ির অনুমতি চেয়ে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো নাজ।

হাসনা বেগম আন্তরিক গলায় বললেন, “যাও মা, শুনে এসো।”

নাজ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল সায়েম বাড়ির বাইরে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। ঈদের দিন আবার কোথায় যাওয়ার চিন্তা করছে মানুষটা? নাজ কোনো প্রশ্ন না করে তার পিছু পিছু বাইরে চলে এল। সায়েমের হাতে মাংসভর্তি দুটো ব্যাগ।

শহরে আজ রিকশা নেই বললেই চলে। সকলেই আজ মেয়ে উঠেছে আনন্দের উদ্দীপনায়। তবুও বহু খোঁজাখুঁজির পর একটা রিকশার দেখা মিলল। সেটাতেই উঠে বসলো তারা দুজনে। রিকশায় করে চলে এলো মেইন রোডে।

মেইন রোডগুলো শহরের ব্যস্ততম জায়গা। এখানে এলেই চোখে পড়ে নানান শ্রেণীর, নানান পেশার মানুষের ব্যস্ততা। ব্যস্ত মানুষগুলোর ভিড়েও আরেক শ্রেণীর মানুষের দেখা মেলে এখানে। আর্ত-দরিদ্র মানুষেরা। তারা হতে পারে বুড়ো থুড়থুড়ে কোনো ভিখারী কিংবা প্রাণচঞ্চল পথশিশু। রোজকার ব্যস্ততায় এই মানুষগুলোর অস্তিত্বের কথা আমরা প্রায় ভুলেই যাই। ঈদের মতো পবিত্র এই উৎসবগুলো এসে মনে করিয়ে দেয় এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো, তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার চেষ্টা করেও মনুষ্যত্বের বড় একটি বৈশিষ্ট্য।

সায়েম রিকশা থেকে নেমে দরিদ্রদের মাঝে মাংস বিতরণ করছে আর মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য দেখছে নাজ। সায়েমের মধ্যে যে অত্যন্ত ভালো মনের একটা মানুষ লুকিয়ে আছে তা অনেক আগেই টের পেয়েছিল নাজ, আজ আবারও চাক্ষুষ প্রমাণ পেল।

ঈদের দিনটা যে এত ভালো কাটবে, কল্পনাও করতে পারেনি না। হাসনা বেগমের রান্নাবান্না শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে গেলেও, তা খেতে হয়েছে অমৃতের মতো। শুধু শুধু তার বিরিয়ানির এত বিরিয়ানি আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এতটা খ্যাতি অর্জন করেনি। খাওয়া-দাওয়ার পর নাজ আর কনা টিভির সামনে বসলো ঈদের নাটক দেখতে। ঈদ উপলক্ষে টিভিতে ভালো ভালো কতোগুলো নাটক সম্প্রচার করে। এই নাটক নিয়েও দুই বান্ধবীর মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই।

কিছুক্ষণ বাদে সায়েম এসে বসার ঘরের আরেকটা সোফায় বসতে বসতে বলল, “কী পাস তোরা এসব নাটক দেখে?”

নাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আপনি বুঝবেন না।”

“কেন? এগুলো বুঝতে আইনস্টাইনের মতো ব্রেইন লাগে না-কি?”

নাজ হেয়ালীর স্বরে বলল, “কী যে বলেন আপনি! আমাদের ব্রেইন তো মাছের থেকেও ক্ষুদ্র। সেজন্যেই এসব নাটক দেখছি। কী বলিস কনা?”

কনাও একই সুর তুলে বলল, “হ্যাঁ ভাইয়া, আইনস্টাইনের মতো ব্রেইন তো তোমার। তাই তো সারাদিন কীসব হাবিজাবি ইংলিশ সিনেমা দেখো। আবার সেদিন তো দেখলাম ইংলিশ উপন্যাস পড়ছো। কী সাংঘাতিক!”

নাজ বলল, “ইংলিশ গানের কথা ভুলে গেলি?”

সায়েম তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “তোরা ইংলিশ পারিস না সেটা তোদের ব্যর্থতা। অন্য কেউ ইংলিশ পারলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি না করে, তার কাছ থেকে ইন্সপিরেশন নিতে হয়।”

কনা বিরক্ত গলায় বলল, “আহ্ ভাইয়া চুপ করো তো! এদিকে নায়িকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, আর তুমি জ্ঞান দিতে বসেছো।”

“নায়ক নিশ্চয়ই বেকার। বেচারার চাকরি নেই বলে নায়িকার বাবা অন্য এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে।”

কনা হতবাক গলায় বলল, “তুমি জানলে কী করে?”

“এতে জানারই বা কী আছে? সব নাটকগুলোর কাহিনী একই হয়। শেষে দেখবি হয় নায়িকার বাবা বেকার নায়ককে মেনে নিয়েছে, নাহলে নায়ক নায়িকা পালিয়ে গেছে।”

শেষমেশ সায়েমের প্রথম ভবিষ্যৎবাণীটাই সত্যি হলো। নায়িকার বাবা শেষমেশ বেকার নায়ককে মেনে নিলেন। শুধু মেনে নিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং নিজের সহায়-সম্পত্তির বড় একটা অংশ নায়কের নামে লিখে দিলেন।

পরবর্তী কয়েকটা দিন তাদের বিমলানন্দে কাটল। ঈদের দুদিন সকলে বেড়াতে গেল ফ্যান্টাসি কিংডমে। তবে হাসনা বেগম বাড়িতেই রয়ে গেলেন। ঈদের দিন সেই যে রান্নাঘরে ঢুকেছেন, শুধু ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বেশিরভাগ সময় তার এখন সেখানেই কাটছে।

আজ সায়েমের ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে। ওদিকে কাল থেকে কনার কলেজও খুলে যাবে। আনন্দ-উল্লাস শেষে আজ ঘরে ফেরার পালা। সায়েম এবং নাজ তাদের বিদায় জানতে বাস স্টেশন পর্যন্ত এসেছে। হাসনা বেগম তো কেঁদেকেটে একাকার!

একটু পর পর আঁচলে চোখ মুছছেন আর বলছেন, “বাবা! নিজের যত্ন নিবি কিন্তু। আহারে, কতদিন আমার ছেলেটাকে দেখবো না।”

সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “আহ্ মা! তুমি এমন ভাব করছো যেন আর জীবনেও দেখা হবে না।”

এদিকে কনা হতাশ কণ্ঠে নাজকে বলল, “একটা সময় ছিল, যখন প্রতিদিন দেখা হতো। আর আজ? এরপরে কবে দেখা হবে তারই ঠিক নেই।”

নাজ বলল, “ওমা! ঠিক থাকবে না কেন? তোর ভাইয়া না বলল, শীতের ছুটিতে আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবে।”

“শীত আসতে এখনো কত দেরি!”

নাজ ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “কী আর করা! দোস্ত শোন।”

“বল।”

“ওই বক্সগুলোর কথা কাউকে বলিস না কিন্তু!”

“কাকে আবার বলবো? তুই একবার বাড়িতে আয় না, দেখ ওই প্রত্যয় বেটাকে কীভাবে শায়েস্তা করি!”

কনাদের বাস ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাজের মনটা হুহু করে উঠল। বরাবরই সে স্বপ্ন দেখতো বড় একটা পরিবারের। যে পরিবারে বাবা-মা, ভাই-বোন সকলেই থাকবে। কয়েকদিনের জন্যে তেমন এক পরিবারের স্বাদও পেল সে। সেই স্বাদে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে তাদের অনুপস্থিতিতে ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

শ্বশুর-শাশুড়ি চলে গেছে, তাই সায়েম আর নাজের আজ থেকে আর এক ঘরে ঘুমোনোর প্রয়োজনও নেই। নাজের একবার বলতে খুব ইচ্ছে হলো, “আমি যদি এই ঘরে থেকে যাই, তাহলে কি আপনার খুব অসুবিধা হবে?” লজ্জায় বলতে পারলো না। মানুষটা কী ভেবে বসবে তার ঠিক আছে?

মধ্যরাতে নাজের ঘুম ভেঙে গেল। এই ঘরটায় কোনো দেয়াল ঘড়ি নেই, সায়েমের ঘরে আছে। তাই বাধ্য হয়েই বিছানায় হাতড়ে ফোনটা খুঁজে সময় দেখতে হলো তাকে। রাত একটা বত্রিশ। নাজের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ঘটনা খুবই দূর্লভ। সাধারণত এক ঘুমেই রাত কাবার করে সে। তবে আজ প্রখর তৃষ্ণায় খুব ভেঙে গেল তার। রাতে খুব একটা ঘুম ভাঙ্গে না বলে হাতের কাছে পানিও রাখা হয় না। তাই বাধ্য হয়েই নাজ পা বাড়ালো ডাইনিং রুমের দিকে।

ডাইনিং রুমে এসে প্রাণভরে তৃষ্ণা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে নাজ লক্ষ করলো বারান্দার বাতি জ্বলছে। কী আশ্চর্য! রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তো সে বাড়ির সবগুলো বাতি নিভিয়ে দিয়েছিল? এটা আবার জ্বলে উঠলো কী করে? সেদিকে এগিয়ে যেতেই সিগারেটের ধোঁয়া আর তার বিশ্রী গন্ধ ঝেঁকে ধরলো নাজকে।

বারান্দায় যেতেই নাজ দেখতে পেল, সায়েম আয়েশী ভঙ্গিতে মেঝেতে বসে আছে আর ভুষভুষ করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “একি? আপনি এখানে কী করেছেন?”

সায়েম স্বাভাবিক গলায় বলল, “ঘুম আসছিল না।”

নাজের হঠাৎ ইচ্ছা হলো ওই মানুষটার পাশে গিয়ে বসতে। তাতে কি সে খুব রাগ করবে? করুক গিয়ে। কীই বা হবে, বড়জোর নাজকে প্রচন্ড এক ধমক দেবে। দিক! তবুও নাজ তার ইচ্ছাটাকে অপূর্ণ রাখবে না। সে নিঃশব্দে গিয়ে বসলো সায়েমের পাশে। সায়েম কিছুই বলল না, আগের ভঙ্গিতেই সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে।

নাজ হালকা গলায় বলল, “ঘুম না এলে বুঝি বারান্দায় বসে এভাবে সিগারেট খেতে হয়?”

“ওরা আসার পর থেকে তো ঠিকমত সিগারেট খেতেই পারছি না। কেমন যেন হাপিয়ে উঠেছিলাম, তাই…”

“কী যে পান এসব ছাইপাশ খেয়ে!”

সায়েম ফাজলামির সুরে বলল, “একটা টান দিয়ে দেখবে না-কি?”

“আমার মাথা খারাপ হয়েছে?”

“প্রথমবার ট্রাই করার আগে অবশ্য মাথা খারাপ বলেই মনে হয়।”

“আচ্ছা, আপনি প্রথমবার ট্রাই করেছিলেন কেন?”

“কৌতূহল থেকে। তোমার মতো আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছিল, মানুষ কী পায় এসব ছাইপাশ খেয়ে।”

“পেয়েছিলেন কোথায়?”

“চুরি করেছিলাম। ঠিক চুরিও না, বলতে পারো ডাকাতি।”

“মানে?”

“আমার বাবা তো সিগারেট-টিগারেট খায় না, আর আমি নিজের কাছে জেদ ধরে বসেছি একবার জিনিসটা খেয়ে দেখবোই। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, আমাদের এলাকারই এক বড় ভাই আমাকে অংক শেখাতে আসতেন। সে আবার ছিল চেইন স্মোকার। মিনিটে মিনিটে সিগারেট ছাড়া তাকে দেখা যেত না। এদিকে আমার বাবা যে সিগারেট খায় না এটাও সে জানে না। আমি একদিন বুদ্ধি করে ভাইয়াকে বললাম, বাবার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। আমাকে দোকান থেকে এনে দিতে বলছে। এখন দোকানে গেলে অংক করায় ডিস্টার্ব হবে না? আপনি আপনার কাছ থেকে একটা সিগারেট দিন না!”

“উনি দিয়েও দিলেন?”

“হুঁ! আমি সেটা যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিলাম। পরে সময় করে একদিন সকলের চোখের আড়ালে ধরালাম জিনিসটা। একটা টান দিতেই কেশে-টেশে একাকার অবস্থা!”

“তাহলে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেলেন কী করে?”

“প্রথম প্রথম তো এই ধোঁয়া সহ্যই হতো না। কিন্তু এখন সেই অসহ্য জিনিসটাই নেশায় পরিনত হয়েছে।”

নাজ কৌতূহলী গলায় বলল, “বাবা-মার কাছে কখনো ধরা পড়েননি?”

“মায়ের কাছে কোনোদিন ধরা না পড়লেও বাবা একদিন ধরে ফেলেছিল।”

“সেকি তারপর?”

“আমার বাবাকে তো চেনোই! বেচারা ঝামেলাহীন মানুষ, তার মতে জীবনে যত ঝামেলা এড়িয়ে চলা যায় ততই ভালো। আমাকে সিগারেট খেতে দেখে বললেন, এসব ফেলে দে। আর কোনো দিন খাবি না কিন্তু। আর ভুলেও তোর মাকে বলবি না, তাহলে হার একটাও আস্ত থাকবে না।”

নাজ অন্যরকম গলায় বলল, “আমার বাবাও এমন ছিলেন জানেন।”

“তাই?”

“হুঁ। আমাকে যে কতবার মায়ের কাছ থেকে বাববাঁচিয়েছেন তার হিসাব নেই। একদিন মা বাইরে গেছে, বাড়িতে কেবল আমি আর বাবা। আমি হাত লেগে অসতর্কতাবশত একটা ফুলদানি পরে গেল। জিনিসটা আবার মায়ের খুবই প্রিয়। বাবা করলেন কী, সোজা মোটরসাইকেল নিয়ে বাজারে চলে গেলেন। হুবহ দেখতে একটা ফুলদানি নিয়ে আগের জায়গায় রেখে দিলেন। মা কিছু টেরই পেল না, আমাকে বকাও খেতে হলো না।”

নাজ কেমন যেন স্মৃতি-কাতর হয়ে উঠলো। তার গলার স্বরে অতিরিক্ত কোমলতা আর চোখের কোণে একরাশ জল, দুটোই দৃশ্যমান হয়ে উঠল।

নাজ সাবধানে চোখের জল আড়াল করে বলল, “বাবা যখন বেঁচে ছিল, জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল। কোনো কিছুর চিন্তা করতে হতো না, কাউকে ভয় পেতে হতো না। উনার পৃথিবীর পুরোটা জুড়ে আমিই ছিলাম। আপনাকে বলেছিলাম না, আমার এসএসসির খারাপ রেজাল্টের পরও উনি এলাকার সকলকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন!”

“হুঁ।”

“পৃথিবীর সকলে আমার ওপর হতাশ হলেও একমাত্র বাবাকে আমি কিছুতেই হতাশ করতে পারতাম না। আমি সব দোষগুলো ছাপিয়ে শুধুমাত্র গুণগুলোই তার চোখে ধরা দিতো।”

“কী হয়েছিল উনার?”

“ক্যান্সার। কয়েকদিন ধরে শুনছিলাম খাবারে অরুচি, পেটে ব্যাথা, মাথা ভনভন করছে। ভাবলাম কী আর হবে। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, ডাক্তার যথারীতি একগাদা টেস্ট আর ওষুধপত্র লিখে দেবেন। কিন্তু ডাক্তার যা বললেন তাতে আমার জীবনটাই পুরোপুরি বদলে গেল। বললেন, আর বড়জোর তিন মাস…”

কথাটা আর শেষ করতে পারলো না নাজ। প্রবল অশ্রুধারা আঁকড়ে ধরলো তাকে।

নাজ কোনমতে নিজেকে সামলে আবারও বলল, “সিনেমার মতো একটা মানুষের জীবনসীমা বেঁধে দিলেন তারা।”

“আই অ্যাম সরি।”

কয়েক মুহূর্ত পর চোখের জল মুছতে মুছতে নাজ যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল, “না, আই অ্যাম সরি! এমনিতে আমি সহজে ভেঙে পড়ি না, কিন্তু বাবার প্রসঙ্গ আসলেই…”

সায়েম কোমল স্বরে বলল, “কান্নার মধ্যে এত সংকোচের কী আছে নাজ?তুমি যদি মানুষের সামনে প্রাণ খুলে হাসতে পারো, তাহলে কাঁদতে সমস্যা কোথায়? আফটার অল কান্না তো যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ারই একটা উপায়।”

“যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আপনি কী করেন?”

“পালিয়ে যাই। যা যন্ত্রণা দেয়, তা থেকেই পালিয়ে বেড়াই।”

“মানে?”

“বাদ দাও, মানেটা অনেক কমপ্লিকেটেড।”

“তাহলে থাক। আচ্ছা আমরা সেই তখন থেকে কঠিন কঠিন সব কথা বলছি কেন? সহজ স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যায় না?”

“ওহ! ভালো কথা মনে করেছ। অনেক ফাঁকিবাজি হয়েছে, কাল থেকে কিন্তু সিরিয়াসলি পড়তে বসবে।”

নাজ গম্ভীর গলায় বলল, “ফাঁকিবাজির কী দেখলেন? ঈদের মধ্যে আনন্দ না করে সারাদিন বইয়ে মুখ গুজে থাকবো?”

“তাই বলে ঈদের আগের সাত দিন আর পরের সাত দিন বইয়ের আশেপাশেও যাবে না?”

“দেখুন ঈদ বছরে দুইবারই আসে। এই দুইবার যদি প্রাণ খুলে আনন্দই না করতে পারি তাহলে আর জীবনটা রেখে লাভ কী?”

“সেজন্যেই তো এতদিন কিছু বলেনি। কিন্তু কাল থেকে যদি সিরিয়াসলি পড়তে না দেখি তাহলে খবর আছে তোমার!”

“আপনারও খবর আছে।”

“মানে?”

“আপনাকে যদি কাল থেকে এসব ছাইপাশ খেতে দেখেছি তাহলে আপনারও খবর আছে।”

নাজ কথাটা বলেই সঙ্গে সঙ্গে সায়েমের হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা কেড়ে নিলো।

“ভয় দেখাচ্ছ তাই না? এতটুকু একটা মেয়ে, আমাকে ভয় দেখায়!”

“আপনি আমাকে প্রতিনিয়ত ভয় দেখাতে পারলে আমি পারবো না কেন? দেখবেন, কাল থেকে আমার সামনে সিগারেট ধরালেই সেটা কেড়ে নেবো!”

নাজ খিলখিল করে হেসে উঠলো। তার জীবনের সবথেকে সুন্দর মুহূর্তগুলোর একটি এটা। সময়টা যদি এখানেই থেকে যেত, মন্দ হতো না।

(চলবে)