#অপেক্ষারা
৩৫+৩৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“নাজ? তোমাকে কি কেউ পার্সেল করে আকাশি রঙের একটা শাড়ি পাঠিয়েছিল?” রহস্যময় কণ্ঠে বলল সায়েম।
নাজ কয়েক মুহূর্ত তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
সায়েম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আমার বাসায় কিছু আসবে আর আমি জানবো না?”
“তাই বলে শাড়ির রংটা পর্যন্ত জানবেন?”
“সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো জিনিসটা তোমাকে কে পাঠিয়েছে!”
“আমি কী করে জানবো?”
“তোমার ঠিকানায় পাঠিয়েছে অথচ তুমিই জানো না।”
নাজ না-সূচক মাথা নাড়ল।
সায়েম সন্দিহান স্বরে বলল, “আমার তো মনে হচ্ছে জানো, এখন ভান করছো জানো না।
“কী আশ্চর্য! আমি ভান করতে যাবো কেন?”
“হতে পারে না? তুমি আমার অগোচরে কারোর সঙ্গে প্রেম করছো, সে-ই শাড়িটা পাঠিয়ে তোমাকে।”
নাজের বুকটা ধক করে উঠল। দীর্ঘদিন পর মেয়েটা মুক্তি পেয়েছে কষ্টের কারাগার থেকে। মনের মাঝে বয়ে চলা ঝড়ো হাওয়াটা অবশেষে শান্ত হয়েছে। আবারও নতুন করে কোনো বিপত্তি ঘটতে যাচ্ছে না-কি? কী যন্ত্রণায় পড়া গেল! ওই পার্সেল কে পাঠিয়েছে তা সে আজও জানে না।
নাজ আঁতকে উঠে বলল, “ছি ছি! কী বলছেন এসব আপনি?”
“সত্যি করে বলো তো নাজ, আর কী কী পাঠিয়েছে।”
নাজ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “আর কিছু পাঠায়নি!”
“এইতো আরেকটা মিথ্যা বললে। শাড়ির পর বক্স ভর্তি চকলেটও তো পাঠিয়েছিল।”
“পাঠিয়েছিল কিন্তু একটা চকলেটও আমি খাইনি, সব আপনার বোন খেয়েছে। বিশ্বাস না হলে ফোন করে জিজ্ঞেস করুন কনাকে!”
নাজের চোখের মুখে ভয়ের আভা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। তার ভয়ার্ত এই মুখটা দেখে সায়েম না হেসে থাকতে পারলো না।
হাসতে হাসতেই বলল, “এত বোকা কেন তুমি নাজ? এখনো বুঝতে পারলে না কে পাঠিয়েছিল ওগুলো?”
নাজ ভ্রুযুগল সামান্য কুঁচকে বলল, “আপনি?”
“তাছাড়া আর কার সাহস আছে আমার বউকে শাড়ি পাঠানোর?”
নিমিষেই ভয়গুলো কেটে গিয়ে নাজের চোখেমুখে জড়ো হলো একরাশ লজ্জা, চেহারা টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করল। কী বলল মানুষটা? বউ? সে কি সত্যিই নাজকে বউ ডেকেছে না সবটাই মনের ভুল? আচমকা নাজের লজ্জা পেয়ে যাওয়াটা চোখ এড়িয়ে গেল না সায়েমের।
তাই তাকে সহজ করতে বলল, “এতদিন পরোনি কেন শাড়িটা?”
“কেন পরবো? কে না কে পাঠিয়েছে তাই তো জানতাম না।”
“এখন তো জানো! তাহলে পরে ফেল।”
“অসম্ভব! শাড়ি পরে আমি আবারও জার্নি করতে পারবো না। মনে নেই? সেবার কুঁচি-চুঁচি খুলে কী একটা অবস্থা হলো?”
সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “অসুবিধা কোথায়? সেবার যে কুঁচি ঠিক করে দিয়েছিল আজও না হয় সেই দেবে!”
নাজ লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে বলল, “হয়েছে! জার্নিতে আমি ওসব শাড়ি-টাড়ি পরতে পারবো না।
নাজ ছুটে চলে এল নিজের ঘরে। আলমারির ওপরের তাক থেকে বের করলো সেই পার্সেলের বাক্সটা। জিনিসগুলো ঠিক সেভাবেই পড়ে আছে। প্রথমবার বাক্সটা খুলে মনে হয়েছিল, কেউ একজন দূর থেকে পরম যত্নে সাজাতে চাইছে তাকে। সেই ‘কেউ একজন’টা কি পারতো না, একবার সামনে এসে নিজ থেকে তাকে সাজিয়ে দিতে। দূরে দূরে থেকে লাভটা কী হলো?
জীবন বড়ই অদ্ভুত। কখন যে কোন অপ্রত্যাশিত বাকে মোড় নেবে কেউ বলতে পারে না। তবে জীবন আজ যে রাস্তাটায় এনে দাঁড় করিয়েছে, সেখানেই আজীবন থেকে যেতে চায় নাজ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অনুভূতি হলো, ভালোবাসার মানুষটার ভালোবাসা পাবার অনুভূতি। যে অনুভূতি সংজ্ঞাতীত, ব্যাখ্যাতীত। ভালোবাসা মানুষের সাহস বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। এই মুহূর্তে জীবনের সবকিছু হারিয়ে ফেললেও কোনো আক্ষেপ থাকবে না নাজের। কারণ তার কাছে সায়েম আছে। সুটকেস খুলে সাবধানে পার্সেলের বাক্সটা রেখে দিলো নাজ।
আজ প্রায় বছর খানেক তারা যাচ্ছে ময়মনসিংহে। ঢাকা থেকে বাসে করে সেখানে যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টার একটু বেশি। ভাগ্যক্রমে রাস্তায় যানজট না থাকলে অবশ্য আড়াই ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। অন্যদিকে ট্রেনে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি। তাদের গ্রামটা আবার স্টেশন থেকে বেশ দূরে। তাই বরাবরই বাসে যাতায়াত করে সায়েম।
তবে নাজের বহুদিনের ইচ্ছা ঢাকা থেকে ট্রেনে করে বাড়ি যাবে। কখনো ট্রেনে চড়েনি সে। যে মানুষটা এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পায়, তার কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখতে হয় না। তাই সায়েম গতকাল ট্রেনের টিকিটই নিয়ে এল। গোটা একটা কেবিন বুক করা হয়েছে তাদের দুজনের জন্যে।
কেবিন থেকে নাজের চোখদুটো যেন চকচক করে উঠল। যা দেখছে তাতেই বিস্ময়ে খাবি খাচ্ছে।
নাজ মুগ্ধ গলায় বলল, “কী ঝকঝকে ট্রেন দেখেছেন! মনে হচ্ছে যেন বিদেশের কোনো ট্রেনে উঠেছি।”
সায়েম তাদের সুটকেসটা সিটের নিচে ঠেলে রাখতে রাখতে বলল, “সম্ভবত ট্রেনটা নতুন। কয়েকবছর পর এই একই জায়গায় এসে দেখো না! দেখবে জায়গায় জায়গায় পানের পিক, সিটগুলো অপরিচ্ছন্ন, পর্দায় ধুলো।”
সায়েমের এই আক্ষেপের বাণী নাজের বিস্ময়ে কোনো ছেদ ফেলতে পারলো। এখনো আগের ভঙ্গিতেই ঘুরে ঘুরে দেখছে কেবিনটা।
“ওমা! এটা কী?”
সায়েম বসতে বসতে বলল, “রিডিং লাইট। ওই লাইটের সামনে বসে বই পড়া যায়।”
নাজ হতভম্ব হয়ে বলল, “বলেন কী? পড়ে দেখি তো।”
সায়েম অসহায় গলায় বলল, “আর কত পড়বে? পড়তে পড়তেই তো চোখদুটোর বারোটা বাজিয়েছো। তাছাড়া এখানে বই পাবে কোথায়?”
“তাই তো!”
বই না থাকলেও সেই রিডিং লাইট জ্বালালো নাজ। চমৎকার একটা জিনিস! হালকা হলদেটে আলোর আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। এমন আলোতে পড়লে চোখের আরাম, মনেরও শান্তি।
নাজ মোহিত গলায় বলল, “আমার ঘরেও এমন একটা লাইট লাগিয়ে দেবেন?”
সায়েম জবাব না দিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে রইল নাজের দিকে। আমার ঘর মানে কী? মেয়েটার কি সারাজীবন আলাদা ঘরে থাকার পরিকল্পনা আছে না-কি?
আবারও শোনা গেল নাজের মোহিত গলা, “দেখুন দেখুন! এটাই কি সেই বিখ্যাত ট্রেনের চেইন?”
“হুঁ।”
“এটা টেনে ধরলে সত্যি সত্যিই ট্রেন থেমে যাবে?”
“হ্যাঁ। ট্রাই করে দেখবে না-কি?”
“এখন তো ট্রেন চলছেই না।”
“সেজন্যেই তো ট্রাই করতে বলছি। চলন্ত ট্রেনের চেইন টেনে আমাকে জরিমানা খাওয়ানোর ধান্দা আছে?”
“তাতে কী? মোটে দুইশ টাকা জরিমানা!”
সায়েম দুষ্টুমির হাসি আড়াল করে বলল, “নাজ? তোমার ফেসবুকে ফলোয়ার যেন কত?”
নাজ ইতস্তত করে বলল, “দুইশ তেরো।”
“তাহলে বরং এক কাজ করি। তুমি চেইন টেনে ধরলে দুইশ টাকার বদলে দুইশ ফলোয়ারওয়ালা তোমার ফেসবুক আইডি দিয়ে দিই। কী বলো?”
নাজ সায়েমের মুখোমুখি থাকা সিটে বসতে বসতে শুকনো গলায় বলল, “সেটাই! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি একজন মহাকিপ্টা।”
সায়েম ধমকের সুরে বলল, “ওখানে বসেছো কেন? আমার পাশে এসে বসো।”
নাজ গুটি গুটি পায়ে গিয়ে বসলো তার প্রিয় মানুষটার পাশে। সায়েমের পাশে যে এর আগে সে কোনোদিন বসেনি তা নয়। তবুও আজ হঠাৎ এমন লাগছে কেন? মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সকল সুখানুভূতি এসে জড়ো হয়েছে রেলের এই কেবিনটার মাঝে।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। নাজ আগ্রহ নিয়ে জানালার বাইরে তাকালো। প্রচন্ড গতিতে পেছনে সরে যাচ্ছে রাস্তার গাছপালা, গাড়ি আর মানুষগুলো। ইঞ্জিনের ঝুঁক-ঝুঁক শব্দে কখন যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল, নাজ নিজেও জানে না। গভীর ঘুমে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলছে মেয়েটা। কতগুলো রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। নির্ঘুম সেই রাতগুলোর অবশেষে অবসান হলো। ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার আক্ষেপ যখন মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় না, তখন যে এতটা স্বস্তি অনুভূত হয় কে জানত!
এদিকে সায়েম পড়েছে বিপদে। সময়টা যেন কাটতেই চাইছে না। চলন্ত ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। নাজ জেগে থাকলেও একটা কথা ছিল। তার বিখ্যাত এফএম রেডিও শুনে শুনে সময়টা পার করা যেত। একটা সময় মেয়েটার অনবরত কথার ঝুলি থেকে রেহাই পেতে চাইতো সায়েম। অথচ আজ যেন নিজে থেকেই চাইছে কথা বলে বলে মাথাটা ধরিয়ে দিক নাজ।
ঘুমের ঘোরেই আচমকা সায়েমের কাঁধে মাথা রাখলো নাজ। ভালোলাগার অনুভূতিগুলো তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়লো সায়েমের সমস্ত শরীরজুড়ে। ঠিক এই মুহূর্তটা কোনো স্বপ্নদৃশ্য বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। যে মানুষটাকে এতকাল দূর থেকে ভালোবেসে আসলো, কখনোই ভাবতেই পারেনি তার সঙ্গে এমন একটা একান্ত মুহূর্ত পাবে সায়েম।
তার ভয় হতো, ভালোবাসার কথাটা নাজকে বলে দিলে সে যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়? প্রত্যাখ্যান করে তার সকল অনুভূতিগুলোকে? ভয়ের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল ভালোবাসাটা দীর্ঘদিন থেকে গেছে মনের আড়ালেই। তবে বলতেই হয় নাজের সাহস আছে! সাহস না থাকলে একটা মেয়ে অমন সাবলীল ভাষায় নিজের মনের কথাগুলো লিখতে পারে?
সায়েম আড়চোখে তাকালো নাজের দিকে। বাচ্চা এই মেয়েটার মধ্যে সে যে কী খুঁজে পেয়েছিল তা আজও জানা নেই, সে জানতে চায়ও না। মনে হচ্ছে নাজ যেন মহা শক্তিশালী এক কৃষ্ণগহ্বর আর সায়েম ক্ষুদ্র কোনো গ্রহাণু। নাহ্ ঘুমন্ত এই নিষ্পাপ মুখটার মায়া দিয়ে ক্রমশ এই গ্রহাণুকে টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে।
অবাধ্য চুলগুলো বারবার এসে আছড়ে পড়েছে নাজের মুখের ওপর। কোমল স্পর্শে তা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তবে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। নাজের ঠোঁটদুটোর মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক। দুচোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে। এসবের মাঝে কতক্ষন নিজেকে সামলে রাখা যাবে কে জানে! নাহ্! অর্নথ ঘটে যাওয়ার আগে সাধের ঘুম থেকে মেয়েটাকে ডেকে তুলতেই হচ্ছে।
“নাজ? এই নাজ! উঠে পড়ো!”
নাজ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল “হুঁ? চলে এসেছি?”
“নাহ্! এখনো তিন ঘন্টার পথ বাকি।”
নাজ অসহায় গলায় বলল, “তাহলে আমাকে ডেকে তুললেন কেন?”
“একা একা আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়!”
“তাই বলে আমার সাধের ঘুমটা নষ্ট করবেন? আহারে! কী দারুণ একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।”
সায়েম কৌতূহলী গলায় বলল, “কী স্বপ্ন?”
নাজ আগ্রহ নিয়ে বলল, “শুনুন তাহলে, স্বপ্নে দেখি আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসে হৃত্বিক রোশন।”
“কে?”
“আরে বাবা হৃত্বিক রোশন! তারপর কী হলো শুনুন, গ্রামের সব মেয়েরা তাকে ঘিরে রেখেছে। সবাই তাকে গ্রামটা ঘুরে দেখাতে চাচ্ছে, কিন্তু সে হঠাৎ আমার দিকে আঙুল তাক করে বলল, আমি এই মেয়েটার সঙ্গে গ্রাম ঘুরে দেখবো।”
“বাব্বাহ! তারপর?”
“তারপর আর কী? তাকে পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখালাম, আমাদের এলাকার বিখ্যাত মিষ্টিও খাওয়ালাম। দিন শেষে প্রপোজ করতেই যাচ্ছিলাম, কেবল আপনার জন্যে পারলাম না।”
মেয়েটার চালাকি বুঝতে আর বাকি রইল না। সাধের ঘুম থেকে ডেকে তোলার প্রতিশোধ হিসেবে সায়েমকে জেলাস ফিল করাতে চাইছে। তার মতো বাচ্চা মানুষ হলে হয়তো কিছুটা জেলাস হয়েও যেত।
সায়েম কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “ভাগ্যিস ডেকেছিলাম!”
“স্বপ্নেই তো প্রপোজ করছিলাম, বাস্তবে তো আর না।”
নাজ আশা করেছিল সায়েম ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। রাগে হয়তো বাকিটা পথ কথাই বলবে না। কিন্তু সেসবের কিছুই হলো না।
বরং সায়েম ফুর্তির স্বরে বলল,“তোমার চয়েজ বরাবরই বাজে। প্রপোজ করবে ভালো কথা, তাই বলে দুই বাচ্চার বাপকে?”
রেল স্টেশনে নেমে দুজনে অটোতে চড়ে বসলো। ময়মনসিংহের বাতাসে বিচিত্র এক ধরনের প্রশান্তি বয়ে চলে। ঢাকার বাতাসে এ ব্যাপারটা নেই। সেখানে দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নিলে মনে হয় যেন ফুসফুসের বড় একটা অংশ ফাঁকাই রয়ে গেছে। এখানে তা মনে হয় না।
নাজ বলল, “আপনি কি আজ আমাকে রেখে আবারও ফিরে যাবেন?”
“না। সাত দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি।”
নাজ খোঁচা মেরে বলল, “বাব্বাহ! সাত দিন! এই সাত দিনে আপনার কাজে ক্ষতি হয়ে যাবে না। আহারে! বেচারা অফিস না পেয়ে কেঁদে মরবে।”
সায়েম হেয়ালির স্বরে বলল, “কী আর করা? এতদিন যে কেঁদে মরলো এবার তাকেও তো একটু সময় দিতে হয়।”
মুহূর্তেই একরাশ লজ্জারা এসে জড়ো হলো নাজের চোখেমুখে। কথাটার কী জবাব দেওয়া যায় ভেবে পেল না মেয়েটা।
আটো গ্রামের কাছে পৌঁছাতে নাজের চোখদুটো উঠে গেল কপালে। গ্রামের মুখে বিশাল এক গেট। গেট থেকেই ঝুলছে প্রকান্ড এক ব্যানার। ব্যানারে লেখা, “ভাবখালী গ্রামের কৃতি ছাত্রী নাজনীন চৌধুরীর সাফল্যে গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে প্রাণঢালা অভিনন্দন।” লেখাটার পাশেই বড় করে ছাপা হয়েছে তার এক পাসপোর্ট সাইজ ছবি।
গেটের নিচেই আবার ব্যান্ডপার্টি। শুধু ব্যান্ডপার্টিই নয়, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, বান্ধবীরা – সকলেই অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে। ছোট ছোট বাচ্চারা ব্যান্ডপার্টির বাজনার তালে তালে নাচছে।
নাজ হতবিহ্বল গলায় বলল, “এ কী?”
সায়েম তার ক্যামেরাটা অন করতে করতে বলল, “ব্যানারটার সামনে গিয়ে দাঁড়াও তো নাজ! তোমার কভার পিকচার চেঞ্জ করতে হবে না?”
সাফল্য এমনই এক সোনার হরিণ যার জন্যে প্রতিটা মানুষ আজীবন প্রতীক্ষা করে থাকে। তবে কেবল প্রতীক্ষা করলেই সাফল্যের দেখা পাওয়া যায় না। কঠোর পরিশ্রম আর নিজের প্রতি আস্থা রাখতে হয়। নাজ তাই করেছিল, ফলটাও দেখতে পাচ্ছে সচক্ষে।
যে মানুষগুলো একটা সময় মনে করতো নাজ কোনোদিন লেখাপড়ায় ভালো করতে পারবে না, তারাও আজ এসেছে অভিনন্দন জানাতে। প্রকৃত সাফল্য তো এটাই!
বিশাল ওই গেটের কাছে সকলের সঙ্গে ছবি তুলতে হলো। বাচ্চাদের কাছ থেকে তোড়ায় তোড়ায় কতগুলো যে গোলাপ নাজ পেল, তার কোনো হিসাব নেই।
নাজকে সর্বপ্রথম শ্বশুরবাড়িতেই আনা হলো। তার মাও অবশ্য এখানেই আছেন। এদিকে হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়েছেন হাসনা বেগম এবং শওকত সাহেব। তাঁদের একমাত্র বৌমা গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছে বলে কথা! আজ সন্ধ্যায় বাড়িতে বিশাল পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। এই উপলক্ষে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা সকল আত্মীয়দের জড়ো করা হয়েছে।
ডেকোরেটরের লোকরা মরিচবাতি দিয়ে পুরো বাড়িটা ইতোমধ্যেই মুড়িয়ে ফেলেছে। বাড়ির ভেতরেও চলছে সাজসজ্জা। বসার ঘরে বিশাল এক স্টেজ করা হচ্ছে। নাজকে না-কি আজ এখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতাও দিতে হবে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
বাড়িতে আজকে ঘিরে রেখেছে সকলে। চারিদিকে এত মানুষ তবুও তার চঞ্চল চোখদুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে ওই একটা মানুষকে। ছেলেটা গেল কোথায়?
ছোট ছোট স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারা প্রশ্ন করে করে মাথা ধরিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছে। এই যেমন, “নাজ আপু তুমি দিনে কত ঘন্টা পড়তে?” অথবা, “নাজ আপু তুমি কি মুখস্ত করার জন্যে বিশেষ কোনো টেকনিক ব্যবহার করতে?” নাজ অবশ্য মিষ্টি গলাতেই সকলের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।
হাসনা বেগম নাজকে নিয়ে গেলেন থুড়থুড়ে এক বৃদ্ধার কাছে।
হাসনা বেগম হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললেন, “বৌমা! ইনি আমার ফুপু শাশুড়ি, তোমার ফুপু দাদী। সালাম করো!”
নাজ ভদ্রভাবেই সালাম করলো তার ফুপু শাশুড়িকে।
বৃদ্ধা দারাজ গলায় বলল, “বেঁচে থাক বাছা। তোমার রেজাল্ট জেনে খুবই খুশি হয়েছি, আমার বংশের মুখ উজ্জ্বল করলে তুমি।”
“থ্যাংক ইউ দাদী।”
“সায়েমটাকে কত করে বলতাম, তুই ডাক্তার হবি। বিনামূল্যে গরীব-দুঃখীদের সেবা করবি। আমার সে কথা তো কানেও তুলল না। তোমাকেই কিন্তু এবার আমার ইচ্ছা পূরণ করতে হবে বাছা।”
নাজ হেসে বলল, “আপনার নাতির মতো আমিও যে কমার্সের ছাত্রী দাদী। আমি ডাক্তার হবো কী করে?”
বৃদ্ধা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভারী গলায় বললেন, “আহারে! কত ইচ্ছা ছিল, বংশে একটা ডাক্তার থাকবে। আমাদের কপালটাই খারাপ।”
হাসনা বেগম ভ্রু সামান্য কুঁচকে বললেন, “ফুপুজান আপনি সেকেলেই রয়ে গেলেন। গরীব মানুষের সেবা করতে হলে ডাক্তারই হতে হবে, এমন কোনো নিয়ম আছে? মানুষ ব্যবসা করেও তো গরীবদের সেবা করতে পারে। ভালো কাজ করতে হলে ভালো আত্মা লাগে ফুপুজান। ভালো ডাক্তার-ইঞ্জিয়ার হলেও অনেকে ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।”
নাজ মুগ্ধ হয়ে শুনলো হাসনা বেগমের কথাগুলো। শাশুড়ি পেয়েছে একটা! এমন শাশুড়ি কজনের ভাগ্যে জোটে?
নাজ অন্যরকম গলায় বলল, “মা? যে মেয়েটা আপনার ছেলেকে বিয়ে না করে পালিয়ে গিয়েছিল, সে কীসে পড়ত?”
হাসনা বেগম ইতস্তত করে বললেন, “হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“আহা বলুন না!”
হাসনা বেগম তো তো করে বললেন, “অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।”
“তার মানে এইচএসসি পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল? সেও কি এইচএসসিতে এ প্লাস পেয়েছিল?”
“নাহ্! কী যে বলো বৌমা? সবাই তো আর তোমার মতো ভালো ছাত্রী। তোমার সঙ্গে কারো তুলনাই হয় না।”
হাসনা বেগমের কথা শেষ হবার আগেই নাজ খিলখিল করে হেসে উঠল।
“হাসছো কেন বৌমা?”
“আপনার বানানো কাহিনী শুনে। আর কাহিনী বানাতে হবে না মা। আপনার ছেলে আমাকে সব বলে দিয়েছে।”
“সায়েম বলেছে? সত্যি?”
ধরা পড়ে যাওয়ায় খুব একটা বিব্রত বলে মন হলো না হাসনা বেগমকে। বরং ছেলে আর বৌমার দূরত্ব মিটে যাওয়ায় বিমলানন্দে প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
(চলবে)