অপেক্ষারা পর্ব-৫৬+৫৭+৫৮

0
463

#অপেক্ষারা
৫৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“আমরা এখানে এসেছি কেন?” কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বলল নাজ।

সায়েম শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “জানি না। তোমার ডক্টর ফোন করে আসতে বললেন। কী যেন জরুরি কথা আছে।”

নাজ কঠিন গলায় বলল, “তো জরুরি কথাটা ফোন বললেই তো হতো। শুধু শুধু ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছে কেন?”

“আহ্! শান্ত হও নাজ। কয়েক মিনিটেরই তো ব্যাপার।”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “এই জায়গাটা আর অসহ্য লাগে সায়েম। কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে। এখানেই তো ওর চেকআপের জন্যে আসতাম, আর এখানেই…”

কথাটা শেষ হবার আগেই নাজকে থামিয়ে দিয়ে সায়েম কোমল স্বরে বলল, “হয়েছে। আর বলতে হবে না। সারাটাদিন শুধু মনমরা হয়ে থাকা। তোমাকে না বলেছি, এখন থেকে রেগুলার ক্লাস করতে? ওই ঘটনার পর থেকে নিজেকে একেবারে ঘরবন্দী করে রেখেছ। এভাবে কি জীবন চলে?”

“আমার ইচ্ছা করে না ক্লাসে যেতে। কী হবে লেখাপড়া করে? আমি তো নিজের সন্তানকেই বাঁচাতে পারলাম না।”

সায়েম সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “আবারও একই কথা! সত্যিটা মেনে নাও নাজ, প্লিজ। আল্লাহ চাইলে খুব শীঘ্রই আমরা বাবা-মা হবো, আমদের কোল আলো করে ফুটফুটে একটা বাবু আসবে।”

নাজ কৌতূহলী গলায় বলল, “কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে।”

“আবার কী প্রশ্ন?”

“আমার বাচ্চাকে আমি হারালাম কেন? ও পেটে আসার পর কি আমি খুব বাইরে বেরিয়েছে? মা কি তাহলে ঠিকই বলেন? আমি ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছি এরজন্যেই কি ও চলে গেল?”

“মায়ের কথাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ে মন খারাপ করো না। আমাদের মতো উনিই তো ভেঙ্গে পড়েছেন। শোনো নাজ, একটা মেয়ে প্রথমবারের মতো কনসিভ করলে মিসক্যারেজের একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।”

নাজ নিচু গলায় বলল, “আমাদের ক্ষেত্রেই কেন সম্ভাবনাটা সত্যি হলো?”

সায়েম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “হয়ে গেছে, আমাদের হাতে তো আর কিছুই নেই। তুমি এবার একটু স্বাভাবিক হও প্লিজ!”

নাজ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই শোনা গেল ডক্টর রেহেনার অ্যাসিস্টেন্টের কণ্ঠস্বর, “মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী, ম্যাডাম আপনাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে তৈরি।”

সায়েম নাজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে বিচিত্র এক হাসির আভাস নিয়ে বলল, “চলুন মিসেস চৌধুরী, শুনি আসি আপনার ডক্টর কী বলে!”

অতি ক্ষীণ এক হাসির রেখা ফুটে উঠলো নাজের ঠোঁটের কোণেও। ভাগ্যিস মানুষটা এসেছিল তার জীবনে। জীবনের এই কঠিনতম সময়ে তার পাশে কেবল একটা মানুষই কাছে। সান্ত্বনা ছায়ায় ঘিরে রেখেছে, নানান অজুহাতে কষ্টগুলো ভুলিয়ে দিচ্ছে।

ডক্টর রেহানার চেম্বারে এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছিল দুজনে। তবে প্রতিবারই চোখে চকচকে স্বপ্ন আর ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন হাসি নিয়ে। তবে আজ সেসবের কিছুই নেই। বাবুটাও যে নেই। চেম্বারে ঢোকার পর থেকেই নাজের মাথার দুপাশের রগ দপদপ করে জ্বলে উঠছে। মনে পড়ে যাচ্ছে বাবুকে ঘিরে ডাক্তারের দেওয়া প্রতিটি পরামর্শগুলো।

ডক্টর রেহানা পৃথিবীর সরলতম নারীদের একজন। খুব একটা মারপ্যাঁচ যে তার মস্তিষ্কে খেলে তার ছাপ চেহারাতেই ফুটে উঠেছে। নাজ আর সায়েম চেম্বারে আসার পর থেকেই অনবরত ঘামছেন তিনি। বারবার টিসু দিয়ে মুছছেন হাতের তালুতে জমে থাকার ঘামের বিন্দুগুলো।

নাজের বিধ্বস্ত মুখটা দেখে ডক্টর রেহানা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “আপনি ঠিক আছেন তো মিসেস নাজনীন?”

নাজ স্বভাবসুলভ হেসে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।

ডক্টর রেহানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “সতেরো বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ার আমার। আমার এই হাতদুটো ধরে যে কত শিশু পৃথিবীতে এসেছে, তার হিসাব নেই। অসংখ্য বাবা-মায়ের মুখে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসি ফুটে উঠতে দেখেছি। সেই সাথে দেখেছি হাসিটা ফুটে ওঠার আগেই নিভে যাওয়ার কষ্ট। দুর্ভাগ্যবশত আপনাদের হাসিটা দেখা হলো না।”

ডক্টরের উচ্চারিত প্রতিটা বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে নাজ যেন হারিয়ে যাচ্ছে অন্য একটা জগতে। যে জগতের পুরোটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পরিস্থিতি সহজ করার জন্যে সায়েম বলল, “আমরা বরং ওই বিষয়ে আর কথা না বলি।”

ডক্টর রেহানা ইতস্তত করে বললেন, “জি অবশ্যই। আসলে আজ আপনাদের দুজনকে ডেকেছি বিশেষ একটা কারণে। আবার ঠিক বিশেষও বলা যায় না।”

সায়েম চিন্তিত গলায় বলল, “কোন ব্যাপারে ম্যাম?”

“চাইলে যেদিন উনাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হলো সেদিনই বলতে পারতাম কথাটা। আসলে ওই সময়টায় আপনারা এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে আর বলা হয়ে ওঠেনি। তবে অনেক ভেবে দেখলাম আর বেশি দেরি করা হলে মিসেস নাজনীনেরই ক্ষতি।”

সায়েম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “ওর ক্ষতি মানে? ম্যাম কী হয়েছে, একটু ক্লিয়ারলি বলবেন প্লিজ?”

“অবশ্যই। আসলে মিসক্যারেজের পর আমরা বেশ কিছু টেস্ট করি। টেস্টের রিপোর্টগুলোও আপনাকে দেওয়া হয়েছিল। তবে একটা টেস্টের রিপোর্ট আমি নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলাম।”

“কোন টেস্ট?”

“একটা আল্ট্রাসাউন্ড। আমরা কয়েকজন ডক্টর মিলে ওই আল্ট্রাসোনোগ্রাফিটা অনেক অ্যানালাইসিস করেছি।”

সায়েম ব্যাকুল হয়ে বলল, “আপনি প্লিজ ধোঁয়াশা না করে বলুন কীসের আল্ট্রাসাউন্ড? আর সবাই মিলে অ্যানালাইসিস করারই বা কী আছে?”

ডক্টর রেহানা প্রায় অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বললেন, “আপনার স্ত্রীর দুটো ওভারিতেই সিস্ট পাওয়া গেছে, এন্ডোমেট্রিওসিস। সাধারণত প্রেগন্যান্সির আট সপ্তাহ পার হলেই আমি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দিই। উনার আট সপ্তাহ আসার আগেই মিসক্যারেজটা হয়ে যায় বলে ধরতে পারিনি।”

ভয়ঙ্কর বিস্ময়ে একে অপরের দিকে তাকালো নাজ এবং সায়েম। সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। দুজনে কথাগুলো ঠিকই বুঝতে পারছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কিছুই বোঝেনি। ডক্টরের কথাগুলো কি আসলেই সত্যি? এও কি সম্ভব? চোখমুখে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে আবারও তার দিকে তাকালো দুজনে। আরও কিছু শোনার আশায়। কী প্রশ্ন করবে তারা জানে না, তবে এতটুকু জানে রেহানার কাছ থেকে আরও কিছু জানার বাকি আছে তাদের।

“আমরা ডক্টরের টিম মিলে দীর্ঘ মিটিং চালিয়েছি। যেহেতু উনার কম বয়স তাই অনেক চেষ্টা করেছি অন্য কোনো উপায় খুঁজে বের করার। কিন্তু সিস্টগুলো দিনদিন ভয়ঙ্কর আকার ধারন করছে। সাধারণত পাঁচ সেন্টিমিটারের চেয়ে কম আকারের সিস্টের ক্ষেত্রে অপারেশন ছাড়াও চিকিৎসার একটা চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু আপনার সিস্টটা তার থেকে অনেক বেশি বড়।”

সায়েম লক্ষ করলো কেমন এক ঘোরের জগতে হারিয়ে অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠেছে নাজ। তার হাত-পায়ের এই কম্পন যেন শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্পকেও হার মানাবে। চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠেছে। সায়েম শক্ত করে নাজের বাম হাতটা চেপে ধরলো। আকস্মিক এই স্পর্শে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হলো না নাজের। এখনো মেয়েটা হারিয়ে আছে কোথায় যেন।

ক্ষণিকের নীরবতা ভঙ্গ করে সায়েম অস্পষ্ট গলায় বলল, “তাহলে এখন?”

ডক্টর রেহানা পরিষ্কার গলায় থেমে থেমে বললেন, “আই অ্যাম সরি, অপারেশন ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। অপারেশনের মাধ্যমে উনার ওভারি এবং ইউটেরাস বাদ দিতে হবে।”

মুহূর্তেই ঘোরের জগত থেকে ফিরে এলো নাজ। কম্পিত স্বরে বলল, “তার মানে? আমি আর কখনো মা হতে পারবো না?”

ডক্টর রেহানা চুপ করে রইলেন। নিরবতাই মাঝে মাঝে সরবতার অভাব পূরণ করে দেয়।নাজ চোখদুটো নিমিষেই ভর্তি হয়ে গেল অবাধ্য অশ্রুগুলোর দ্বারা। মেয়েটা কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। কিছু একটা করতে চাইছে, কিন্তু করতে পারছে না।

হঠাৎ কী যেন মনে করে চেয়ার ছেড়ে উঠে ছুটে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে। নাজের বেরিয়ে যাওয়ায় তখনো কোনোপ্রকার ভাবান্তর হয়নি সায়েমের মাঝে। সেই তখন থেকে থ হয়ে বসে আছে ছেলেটা। হাত-পা কেমন যেন আসাড় হয়ে আসছে। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। এসব কী হচ্ছে তাদের জীবনে? একের পর এক দুর্যোগের কালো মেঘ কেন এসে নামছে তাদের জীবনে? কীসের শাস্তি দিচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা তাদের? কী করে সামলাবে সায়েম নিজেকে? তার থেকেও বড় কথা কী করে সামলাবে নাজকে?

নাজের কথা মনে আসতেই সংবিৎ ফিরে পেল সায়েম। মেয়েটা হুট করে কোথায় গেল? আশেপাশে তো কোথাও নেই! ডক্টর বললেন কয়েক সেকেন্ড আগেই বেরিয়ে গেছে নাজ। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল সায়েমও।

আশপাশে বিশাল ওয়েটিং এরিয়া। অসংখ্য মানুষ প্রতীক্ষমান হয়ে বসে আছেন তাদের কাঙ্ক্ষিত ডাক্তারের জন্যে। চারিদিকে এত মানুষ অথচ নাজকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। প্রচন্ড দিশেহারা বলে মনে হচ্ছে নিজেকে? কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কী অনুভব করবে তাও বুঝতে পারছে না। বুঝবে কী করে? প্রকৃতি তো এর থেকে বেশি কঠিন পরিস্থিতিতে কখনো এনে ফেলেনি তাকে।

হঠাৎ কানে ভেসে এলো ডক্টর রেহেনার অ্যাসিস্টেন্টের কণ্ঠস্বর, “স্যার, আপনার ওয়াইফকে দেখলাম ছুটে সিড়ি বেয়ে নিচে চলে যেতে। সব ঠিক আছে তো?”

সব যে ঠিক নেই তা বলার অবকাশ আর পেল না সায়েম। তড়িৎ গতিতে পা বাড়ালো সিড়ির দিকে। নিচতলাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলো, নাজ কোথাও নেই। তবে কি একা একা বাড়ি ফিরে গেল মেয়েটা? শরীর আর মনের যে অবস্থা, তাতে করে একা একা বাড়ি ফিরে যাওয়া তো নাজের পক্ষে অসম্ভব। কী করবে সায়েম? কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ মনে পড়লো হসপিটালের বেজমেন্টের গ্যারেজে তাদের গাড়িটা পার্ক করা আছে। নাজ সেখানে যায়নি তো? সায়েম ছুটে গেল গ্যারেজের উদ্দেশ্যে।

সায়েমের ধারণাই সত্যি হলো। ক্ষীণ আলোয় ঘেরা বিশাল গ্যারেজটার এক কোণে মেঝেতে গুটিশুটি মেরে বসে আছে নাজ। দীর্ঘ খোঁজাখুঁজি শেষে মেয়েটাকে পেয়েও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলো না সায়েম। নাজকে এক নজর দেখতেই বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো। মেয়েটা কেঁদে আর্তনাদ করছে না। কেমন স্থির হয়ে বসে একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। কষ্ট পেতে পেতে ব্যথাহীন হয়ে গেছে তার হৃদয়টা। যেকোনো অসহনীয় ব্যাথাকেও সহ্যাতীত মনে হয় না এখন আর। ভাবনা-চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে নাজ। মস্তিকে নিস্তব্ধ এক শূন্যতা বিরাজ করছে কেবল।

নাজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল নাজের দিকে।

তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়তে পড়তে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “নাজ? এখানে এসে বসে আছো কেন? তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেছি আমি।”

নাজ শান্ত কিন্তু ভয়ঙ্কর বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল, “কেন খুঁজছিলে?”

সায়েম অসহায় গলায় বলল, “কেন খুঁজছিলাম মানে? কী বলছো এসব নাজ?”

নাজ অস্থির গলায় বলল, “তুমি শুনতে পাওনি উনি কী বললেন? আমি আর কোনোদিন মা হতে পারবো না সায়েম।”

সায়েম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি জানি তোমার কষ্ট হচ্ছে নাজ। আমারও তো কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে বলো? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো।”

নাজ বিলাপের সুরে বলল, “কিচ্ছু ঠিক হবে না। আমাকে কেউ কোনোদিন মা ডাকবে না। আমি কোনদিনও পারবো না তোমাকে বাবা ডাক শোনাতে।”

নাজের কণ্ঠস্বরে ভয়াবহ এক অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলো সায়েম। মেয়েটার অস্তিত্ব এ জগতে আর অবশিষ্ট নেই। শোকে আচ্ছন্ন এক জগতে আটকে গেছে তার সমস্ত অন্তরাত্মা।

“নাজ?”

নাজ বিড়বিড় করে বলল, “আমাকে কেউ কোনোদিন মা ডাকবে না সায়েম। কোনদিনও না।”

কথাগুলো বলতে বলতেই জ্ঞান হারিয়ে নাজ লুটিয়ে পড়লো সায়েমের বুকে। কয়েকটা মুহূর্ত নাজকে আঁকড়ে ধরে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল সায়েম। এই ভয়ানক বিপদ থেকে কী করে উদ্ধার করবে সে মেয়েটাকে?

(চলবে)

#অপেক্ষারা
৫৭+৫৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

অন্ধকার ঘরে গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে আছে নাজ। বিকেলের দিকে দুচোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছিল। দিনের আলোয় ঘুমিয়ে রাতে উঠলে মনে কেমন যেন একটা শূন্যতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। শূন্যতার অনুভূতি অবশ্য আজকাল নাজের প্রতিদিনের সঙ্গী। একটা মানুষ উঠতে-বসতে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। অথচ একরাশ শূন্যতা সারাটাক্ষণ ঘিরে রাখছে তাকে।

সপ্তাহখানেক হলো নাজের অপারেশন হয়েছে। হাসপাতালে বেশি দিন থাকতে হয়নি, সাতদিন থাকার পরই ওরা ছেড়ে দিয়েছে। এই পুরোটা সময় সর্বক্ষণ নাজের পাশে ছিল সায়েম। সুদৃঢ় কোনো আঠার মতো লেগে ছিল তার সঙ্গে। নাজ যতবারই কেঁদে আকুল হয়েছে, ততবারই তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছে সায়েম।

নাজ যতবারই বিরক্ত গলায় বলেছে, “আমাকে একা থাকতে দাও সায়েম।”

সেই কথাটাকে তাচ্ছিল্য করে ঠিক ততবারই সায়েম বলেছে, “কেন একা থাকতে দেব? সবসময় তোমার পাশে থাকবো।”

মানুষটার এত আদর, এত ভালোবাসা – তবুও কেন এই শূন্যতার অনুভূতি নাজের মাঝে? কারণটা অবশ্য তার অজানা নয়। প্রকৃতি এই পৃথিবীতে নারীদের এক অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে পাঠায়। নতুন একটা প্রাণকে তার মাঝে বাড়িয়ে তোলার ক্ষমতা, সেই প্রাণটাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার ক্ষমতা। যে প্রাণের অস্তিত্বই আগে ছিল না, নারীরা সেই প্রাণটা পৃথিবীতে নিয়ে আসে। এটা ক্ষমতা অলৌকিক নয় তো কী?

তবে নিষ্ঠুর প্রকৃতি ক্ষমতা দেওয়ার পাশাপাশি আবার কারও কারও কাছ থেকে সেই ক্ষমতা ছিনিয়েও নেয়। নাজ সেই হতভাগাদের একজন। আচ্ছা, তার সঙ্গেই কেন এমনটা হলো? এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের জীবনে গুরুতর কোনো পাপ করেছে বলে তো মনে পড়ে না? তবে নাজের সঙ্গেই কেন?

এমন বহু হৃদয়হীনা মায়ের পরিচয় পাওয়া গেছে, যারা সন্তানকে নিজের বলে স্বীকারই করে নেয়নি কখনো। মা বেঁচে থাকতেও সন্তান বড় হচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়। এমন ঘটনা তো পুরনো কিছু নয়, রোজই ঘটছে। প্রকৃতি তবুও ওই হৃদয়হীনা মায়েদের ‘মা’ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। অথচ যে মেয়েটা ব্যাকুল হয়ে আছে শুধু একটাবার ওই মা ডাকটা শোনার জন্যে, তার বেলায় কেড়ে নিলো সমস্ত অধিকার।

হুট করে বেজে উঠলো নাজের ফোনের রিংটোন। এই সামান্য শব্দটুকুতেই ঝনঝন করে উঠলো তার ব্রহ্মতালু। আজকাল কোনোকিছুই আর সহ্য হয় না, সবকিছুর ওপরেই যেন তিক্ততা জমে গেছে।

বিরক্তি নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো নাজ। মায়ের নামটা ভেসে উঠেছে। জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, অথচ নিজের মাকে কিছুই জানানো হয়নি। আয়েশা বেগমের ফোন গত কয়েকদিন ধরেই আসছে। নাজ কোনোবারই রিসিভ করেনি। রিসিভ করে কীই বা হবে? ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়ানো আর নাজের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য নেই আয়েশা বেগমের। তবুও কী যেন মনে করে ফোনটা রিসিভ করলো নাজ।

শোনা গেল আয়েশা বেগমের উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত কন্ঠ, “নাজ! কী সমস্যা তোর? দিনের পর দিন ফোন করে যাচ্ছি, ফোন ধরছিস না কেন?”

নাজ ক্লান্ত গলায় বলল, “কিছু বলবে মা?”

“এসব কী শুনছি আমি নাজ? তুই না-কি… তুই না-কি কোনোদিন মা হতে পারবি না?”

নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “ঠিকই শুনেছ।”

আয়েশা বেগম কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “হায় আল্লাহ! এসব কী বলছিস তুই নাজ? এটা কীভাবে সম্ভব?”

নাজ কঠিন গলায় বলল, “মা শোনো, তোমার কাঁদতে হলে ফোনটা কেটে কাঁদো। তোমার কান্না শুনতে ইচ্ছা করছে না।”

“নাজ? মা সত্যি করে বল তো কী হয়েছে। আজ সকালে হাসনা ভাবিকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, তিনিও পরিষ্কার করে কিছু বললেন না। ওখানে কী হচ্ছে মা, বল না আমাকে।”

নাজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার ওভারিতে একটা সিস্ট পাওয়া গিয়েছিল। বিশাল আকারের সিস্ট। ওই সিস্ট নিয়ে বেঁচে থাকা আর জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা একই কথা। তাই ডাক্তারা অপারেশন করে আমার দুটো ওভারিই ফেলে দিয়েছে।”

আয়েশা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, “মানে কী এসবের নাজ? কী করে হলো এসব?”

নাজ কিছুই বলল না, নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণনের দিকে।

“এত বড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেল, আর তোরা আমাকে কিচ্ছু জানালি না? আমি কি এতটাই পর হয়ে গেলাম?”

নাজ ফিকে গলায় বলল, “সুখবর যেহেতু না তাই লাফিয়ে পড়ে বলারও কিছু নেই। ধীরে-সুস্থে বলতাম।”

“এখন তোর কী হবে মা? বাচ্চা জন্ম দিতে না পারা মেয়েদের জীবনটাই তো শেষ হয়ে যায়। শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী কেউই আর আগের মতো ভালোবাসে না।”

নাজ অন্যরকম গলায় বলল, “বাসে না তাই না?”

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে আয়েশা বেগম বললেন, “নাজ, তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমাদের এখানে এক কবিরাজ আছে বুঝলি। সর্দার বাড়ির বউটার দীর্ঘদিন বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছিল না। কবিরাজের এক ঝাড়াতেই কাজ হলো। পরের মাসেই ওই বউটার পেটে বাচ্চা আসলো। দাঁড়া, তোকেও উনার কাছে নিয়ে যাবো।”

রেগেমেগে তীক্ষ্ণ গলায় নাজ বলল, “কী যা তা বলছো মা! ওভারি না থাকলে বাচ্চা আসবে কী করে? হওয়ায় ভেসে ভেসে?”

অপরপ্রান্ত থেকে মায়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিলো নাজ। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে তার। যন্ত্রণাটা বড়ই অদ্ভুত, মনে হচ্ছে কেউ যেন হাজারখানেক সূচালো সুঁই একসঙ্গে গেঁথে দিচ্ছে তার মস্তিষ্কের ভেতরে। নাজ কাঁদতে চাইছে, চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে। কিন্তু অশ্রুগুলো ভেতরে জমাট বেঁধে রয়েছে, বাইরে আসতে চাইছে না।

আশেপাশের মানুষগুলোকে আজকাল বড্ড অসহ্য লাগে তার। চেনা-জানা কাছের মানুষগুলো হুট করে বদলে গেল। সকলের মনে হয়, নাজ এমন একটা মেয়ে যে কোনোদিন মা হতে পারে না। অথচ সকলে এটা ভুলে যায়, মা হতে না পারলেও নাজ একটা মানুষ। সেও অনুভব করতে পারে, তারও কষ্ট হয়।

আজ দুপুরের ঘটনা। ঘরজুড়ে হাঁটাহাঁটি করছিল নাজ। শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো তখনই কানে ভেসে আসে তাদের মধ্যকার কথোপকথন। আড়ি পেতে কথা শোনা নাজের স্বভাবে নেই। তবুও এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না।

হাসনা বেগম বিলাপের সুরে বললেন, “কপাল খারাপ বুঝলে, কপাল খারাপ হলে এমনটাই তো হবে। আশেপাশে কত মানুষের মুখে সুখবর শুনি। আমাদের বেলায়ও সুখবর এলো, আবার সেটা দুঃসংবাদও হয়ে গেল। আর না-কি কোনদিনও সুখবর আসবে না!”

শওকত সাহেব শান্ত গলায় বললেন, “আহ্! থামো এবার তুমি।”

“কেন থামবো? সায়েমকে বারবার বলেছিলাম, নিজের পছন্দে বিয়ে করিস না। অল্পবয়সী মেয়েদের নানান সমস্যা থাকে। শুনলো আমার কথা?”

“সেই কবেকার কথা টেনে এনে বিলাপ করছো তুমি? এখন কি আর এসব বলে লাভ আছে?”

“একটাবার যদি ছেলেটা আমার কথা শুনতো! আজ আমরাও দাদা-দাদী হতে পারতাম। আমার কপালটাই খারাপ। চোখের সামনে ছেলেটাকে একটা বন্ধ্যা মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে দেখছি, অথচ কিছুই করতে পারছি না।”

বন্ধ্যা! সেই থেকে অনবরত শব্দটা ঝনঝন করে কানে বেজে যাচ্ছে নাজের দু কানে। আসলেই তো! সুস্থ-স্বাভাবিক একটা মানুষ থেকে হুট করে সে পরিণত হলো বন্ধ্যায়। সন্তান জন্ম দেওয়ার আগ পর্যন্ত না-কি একটা মেয়ের জীবন পূর্ণতাই পায় না। তাহলে নাজের জীবনটার কী হবে? তার জীবনটা তো তাহলে আমৃত্যু অপূর্ণই থেকে যাবে।

আচ্ছা, সায়েম তাকে সহ্য করে কী করে? তার প্রতি কি কোনপ্রকার বিরক্তি, রাগ বা ঘৃণা জন্মায় না সায়েমের? ভেতরে ভেতরে ছেলেটাও তো জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মুখ ফুটে কিছু বলে না, সুদুক্ষ অভিনেতার মতো নিজের কষ্টগুলোকে আড়াল করে রাখে। যাতে নাজ কষ্ট না পায়।

অভিনয়ে খুঁত না থাকলেও সায়েমের চোখদুটোতে ঠিকই প্রকাশ পায় ভেতরকার কষ্টগুলো। নাজ স্পষ্ট দেখতে পায়। নিজের প্রতি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। অসম্ভব ঘৃণা হচ্ছে নিজেকে। নাজ কি করে পারলো ওই মানুষটা কষ্ট দিতে? এই পৃথিবীর এক বিন্দু কষ্টও কি ওই মানুষটার প্রাপ্য?

একটা সময়ে হয়তো অন্যান্য সকলের মতো সায়েমের তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাকে আগের মতো আর ভালোবাসবে না। কে জানে হয়তো, এখনই বাসে না। একটা সময়ে নাজের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যাবে তার, আর সহ্য হবে না তাকে। এমন দিন যদি সত্যি আসে তাহলে কি করবে নাজ? সহ্য করতে পারবে তার ভালোবাসার মানুষটার অবহেলা?

হঠাৎই কে যেন ঘরের বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিলো। সেই কেউ একজনটা নাজের আর কেউ নয়, নাজের মস্তিষ্কজুড়ে বিচরণ করতে থাকা মানুষটাই, সায়েম। সায়েম আজ দীর্ঘ দশদিন পর অফিসে গিয়েছিল। এই দশদিনের মনটার ওপর দিয়ে যে কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে গেছে, তাতে আর কাজের কথা মাথাতেও আসেনি।

সায়েম প্রথমে অন্ধকারে ঘেরা ঘর দেখে মনে করেছিল নাজ ঘুমাচ্ছে। তবে ধীর পায়ে তার কাছে এগিয়ে যেতেই দেখলো মেয়েটার চোখদুটো খোলা। তার স্থির দৃষ্টি যে কোথায় আটকে আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

সায়েম কোমল স্বরে বলল, “নাজ! ঘর অন্ধকার করে বসে ছিলে কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”

নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “হুঁ।”

সায়েম বিছানায় নাজের মাথার কাছে বসে পড়লো। একটা হাত তার কপালে রাখতেই শিউরে উঠলো। তীব্র জ্বরে মেয়েটার গা পুড়ে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! এত জ্বর এলো কী করে?

সায়েম উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “এত জ্বর এসেছে তার তুমি চুপচাপ শুয়ে আছো? ওষুধও নিশ্চয়ই খাওনি!”

নাজ না-সূচক মাথা নাড়লো।

সায়েম মিনতির স্বরে বলল, “এমন করলে কী করে চলবে নাজ? দিনদিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। নিজেকে এত কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে আছে? অন্তত আমার জন্যে হলেও প্লিজ নিজেকে কষ্ট দেওয়াটা বন্ধ করো।”

প্রবল এক অচেনা ঘোরে ডুবে নাজ ক্ষীণ গলায় বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“কী?”

“তুমি আমাকে বিয়ে করতে গেলে কেন বলো তো?”

সায়েম ভ্রূযুগল কিছুটা কুঁচকে বলল, “এসব প্রশ্নের মানে কী নাজ?”

নাজ উঠে বসতে বসতে আক্ষেপের স্বরে বলল, “কী দরকার ছিল ভালোমানুষী করে ওই গ্রাম্য অসহায় মেয়েটাকে বিয়ে করার? পচে মরতাম আমি ওখানে। কী দরকার ছিলো আমাকে এত সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার, এত ভালোবাসা দেওয়ার? বিনিময়ে কী দিতে পারলাম আমি তোমাকে?”

সায়েম বিড়বিড় করে বলল, “তোমার বাজে কথাগুলো বন্ধ করো নাজ।”

নাজ ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, “তুমি বুঝতে পারছো না তাই না? আমাদের কখনো বাবু হবে না সায়েম। আমি কখনো মা হতে পারবো না। শুধুমাত্র আমার জন্যে তোমাকে কেউ বাবা ডাকবে না।”

সায়েম তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “তোমার দোষটা কোথায় এখানে? একটু ভেবে দেখো তো নিজের কোনো দোষ পাও কিনা? ভাগ্যে নেই তাই কোনোদিন আমাদের সন্তান আসবে না। এখানে তোমার তো কোনো দোষ নেই নাজ।”

নাজ থেমে থেমে বলল, “আমাদের না, আমার ভাগ্যে নেই।”

“মানে?”

“তোমাকে একটা বুদ্ধি দিই। তুমি না আমাকে ছেড়ে দাও।”

নাজ কড়া গলায় বলল, “কী বললে তুমি?”

নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “আমি তো কোনদিনও তোমাকে বাবা ডাক শোনাতে পারবো না, কখনো হাসি ফোটাতে পারবো না তোমর মুখে। আমার সঙ্গে থেকে লাভটা কী?”

প্রচন্ড ক্রোধে হুংকার দিয়ে সায়েম বলল, “আর কোনোদিন যদি এমন কথা শুনি থাপ্পড় দিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো। সাহস কী করে হয় আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে?”

আনমনেই দুয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নাজের দুই গাল বেয়ে। রাগ-টাগ ভুলে মুহূর্তেই মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিলো সায়েম।

শান্ত গলায় বলল, “সরি নাজ, সরি। আর কেঁদো না তো। আমার দিকে তাকাও।”

নাজ সায়েমের বুক থেকে মাথা তুলে অশ্রুসিক্ত ওই দুই নয়নে তাকালো তার দিকে।

সায়েম অতি যত্নে তার চোখের জলগুলো মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “কে ঢোকাচ্ছে তোমার মাথায় এসব কথা? আমার মুখে কখনো হাসি ফোটাতে পারবে না মানে? তুমিই তো আমার হাসির একমাত্র কারণ।”

নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কেউ আমাকে সহ্য করতে পারে না সায়েম। সবাই আমাকে ঘৃণা করে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল সায়েম। তার বুঝতে বাকি রইলো না কারা তার মাথায় ঢোকাচ্ছে এসব।

নাজের কপালে নিজের শীতল ঠোঁটের দৃঢ় স্পর্শ এঁকে সায়েম বলল, “বললেই হলো? তোমার মতো চমৎকার একটা মেয়েকে কেউ ঘৃণা করতে পারে না-কি? আর কাঁদে না নাজ। আমি তো আছি। যা হবার আমরা একসাথে ফেস করবো।”

ভালোবাসা জিনিসটা এমনই। যতই প্রতিকূলতা আসুক না কেন, ভালোবাসার মানুষটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা প্রকৃতি কাউকে দেয়নি। প্রতিটি মানুষের মনের মাঝে সুপ্রশস্ত একটা জগত থাকে। সায়েমের সেই জগতটা জুড়ে কেবল একটা মানুষেরই বিচরণ। সেই মানুষটার কাছ থেকে কী করে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে?

শুধুমাত্র নাজের জন্যে পৃথিবীসুদ্ধ সকল মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে দ্বিধা নেই তার। শুধুমাত্র নাজের জন্যে সে প্রস্তুত যেকোনো অসাধ্যকে সাধন করতে। যার বুকের ঠিক মাঝখানটায় এই মেয়েটার বসবাস, সে কি পারে তার কষ্টগুলোকে সহ্য করতে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় জাদুর কোনো ছড়ি দিয়ে নাজের সকল কষ্টগুলোকে দূর করে দিতে। তবে সমস্যা একটাই। জীবনটা কোনো রূপকথার গল্প নয়, এখানে জাদুর ছড়িও নেই, চাইলেই কষ্টগুলোকে দূর করার উপায়ও নেই।

নিজ হাতে নাজকে খাইয়ে দিলো সায়েম। প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে সবগুলো ওষুধও খাওয়ালো। নাজের মাথায় খানিকক্ষণ হাত বোলাতেই মেয়েটা ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রইলো সায়েম। তাকিয়ে রইলো নাজের ঘুমন্ত মায়াভরা মুখটার দিকে।

সকাল সকাল সায়েমের ঘুম ভাঙলো কনার ডাকে। ছোটোবেলা থেকেই কনার এই এক বদভ্যাস। কারণে-অকারণে সকাল সকাল সায়েমের ঘুমের বারোটা বাজানো। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

কনা ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকলো, “ভাইয়া! ভাইয়া তাড়াতাড়ি ওঠো।”

কনার ব্যাকুল ডাকে যদিও সায়েমের ঘুমে কোনো ব্যাঘাত ঘটলো না। সেই আগের ভঙ্গিতেই ঘুমিয়ে রইলো ছেলেটা।

“ভাইয়া!”

সায়েম এবার ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “উফ! কী হয়েছে?”

কনা ব্যস্ত গলায় বলল, “ওঠো না প্লিজ!”

সায়েম উঠে বসতে বসতে বিরক্ত গলায় বলল, “কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছিস কেন ষাঁড়ের মতো?”

কনা চিন্তিত গলায় বলল, “ভাইয়া নাজ বাসায় নেই।”

“কোথায় গেছে?”

“আমি কী করে বলবো কোথায় গেছে? আমি আর মা তো সেই ভোর বেলা উঠেছি। ভেবেছিলাম নাজ বোধহয় ঘুমাচ্ছে তাই আর ডাকিনি। কিন্তু যেই না আটটা বেজে গেল আমার সন্দেহ হলো। এতক্ষণে তো নাজের উঠে যাওয়ার কথা। এ ঘরে এসে দেখি দরজার লক খোলা, আর নাজ ভেতরে নেই।”

সায়েম হাই তুলতে তুলতে বলল, “গেছে হয় তো পাশের বাসায়।”

“কোথাও নেই ভাইয়া। আশেপাশের সবগুলো ফ্ল্যাটে খোঁজ নিয়ে দেখেছি। ছাদেও গিয়েছিলাম। নাজ কোথাও নেই।”

সায়েম ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী আশ্চর্য! একটা মানুষ বাইরে যেতে পারে না? ফোন করেছিস ওকে?”

কনা ইতস্তত করে বলল, “না আসলে…”

সায়েম বালিশের নিচ থেকে ফোনটা হতে নিতে নিতে বলল, “কনা, তুই না সেই গাধাই রয়ে গেলি! দুনিয়ার সব জায়গায় খুঁজেছিস, অথচ একটা ফোন করলেই যে কাজ হয় তা আর মাথায় আসেনি।”

নাজের নম্বরে ডায়াল করে দুটো রিং বাজতেই চমকে উঠলো সায়েম। কারণ, নাজের ফোনের রিংটোন শোনা যাচ্ছে। ওই তো! খাটের পাশে থাকা সাইড টেবিলে তার ফোনটা দেখাও যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! মেয়েটা বাইরে গেছে, অথচ ফোন নিয়ে যায়নি?

সায়েম ব্যস্ত ভঙ্গিতে বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে ফোন করলো এ বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডকে।

সিকিউরিটি গার্ড একটা রিং বাজতেই ফোন রিসিভ করে বলল, “আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।”

“ওয়ালাইকুমআসসালাম। তোমার ম্যাডামকে দেখেছো কোথাও?”

“জি স্যার। উনি তো সেই ভোর বেলা বাইর হইয়া গেলেন।”

“কোথায় গেছে, কিছু বলেছে?”

“জি না স্যার। আমিও জিগাই নাই, কোথায় যান জিগাইলে আবার মাইনসে মাইন্ড করে।”

চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরজুড়ে পায়চারি করছে সায়েম। চিন্তার সঙ্গে খানিকটা বিরক্তিও কাজ করছে তার মধ্যে। একটা মেয়ে সকাল সকাল বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে যাবে, এটা কেমন কথা? তাও আবার মেয়েটা সুস্থ নয়! গত রাত পর্যন্ত গা কাঁপানো জ্বরে ভুগেছে নাজ, কে জানে এখনও সেই জ্বর আছে কি-না।

পায়চারি করতে করতেই সায়েমের চোখদুটো আটকে গেল ড্রেসিং টেবিলের ওপরে। একটা ভাঁজ করা হলুদ রঙের কাগজ চাপা দেওয়া আছে তার অ্যাস্ট্রে দিয়ে। আর এক মুহূর্তও অপচয় না করে সায়েম ছুটে গেল কাগজটার কাছে।

কাগজের ভাঁজ খুলতেই সায়েমের শিরদাঁড়া প্রকম্পিত করে বয়ে গেল প্রবল এক স্রোত। নাজের গোটা গোটা মুক্তার মতো হাতের লেখায় একটা চিঠি। মনে একরাশ সংশয় আর দুশ্চিন্তা নিয়ে সায়েম চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

“সায়েম,

কতগুলো কথা বলবো তোমাকে। কথাগুলো তোমার সামনাসামনি বসে, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলার সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। তাই লিখতে বসলাম।

মনে আছে? তোমাকে একবার আমার ছোটবেলার গল্প করেছিলাম। ছোটোবেলা থেকেই আমার আত্মীয়-স্বজনেরা আমাকে ছোট করার, অপমান করার, হেও করার কোনো সুযোগই ছাড়তো না। যেন আমি পৃথিবীতে এসেছিই তাদের কটাক্ষের শিকার হতে। আমি পড়ালেখায় ভালো না, আদব-কায়দা জানি না, সারাদিন বাঁদরের মতো ঘুরে বেড়াই – না জানি কত কী!

কিন্তু একটা পর্যায়ে সব বদলে গেল। পড়ালেখায় মনোযোগ দিলাম, আদব-কায়দা শিখলাম, বাঁদরের মতো ঘোরাঘুরি ছেড়ে ঘরের লক্ষ্মী বউ হয়ে উঠলাম। সেই সাথে হয়ে উঠলাম সকলের পছন্দের। জীবনের সেরা সময় সম্ভবত ওটাই ছিল। জানো? মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতাম নিজেকে, ভাগ্য তো চিরকাল আমার বিপক্ষেই ছিল। আজ হঠাৎ পক্ষে এলো কী করে? তখন বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝি। ভাগ্যের যে আমার থেকে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটাই ছিনিয়ে নেওয়ার ছিল।

একটা মেয়ে হাজারটা স্বপ্ন দেখে। পড়ালেখা করার স্বপ্ন, ভালো ক্যারিয়ারের স্বপ্ন, সুন্দর একটা পরিবারের স্বপ্ন, ভালোবাসার মানুষের স্বপ্ন – না জানি কত কী! কিন্তু দিনশেষে তার প্রত্যেকটা স্বপ্নকেই ছাপিয়ে যায় মা হওয়ার স্বপ্ন। প্রত্যেকটা মেয়ে স্বপ্ন দেখে সন্তানকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবে, বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়াবে, স্কুলে নিয়ে যাবে। আমিও তো আর দশটা সাধারণ মেয়ে মতো এই সাধারণ স্বপ্নগুলোই দেখেছিলাম। কিন্তু ভাগ্য কী করলো? আমাকেই সাধারণ দশটা মেয়ের থেকে আলাদা করে দিলো।

আমি মা হতে পারবো না, কেউ কোনদিনও মা ডাকবে না আমাকে। কী দোষ করেছিলাম আমি বলতো? আমি তো একটা সাধারণ জীবন চেয়েছিলাম। এতটুকু চাওয়া কী দোষের বলো?

যে আমি একটা সময়ে সকলের পছন্দের হয়ে উঠেছিলাম, সেই আমাকেই আজ কেউ সহ্য করতে পারে না। আমার মা, শ্বশুর-শাশুড়ি চিরচেনা বান্ধবীরা – সকলেই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হয়তো ভেতরে ভেতরে তুমিও আমাকে সহ্য করতে পারছো না। অবশ্য সহ্য না করতে পারাটাই তো স্বাভাবিক।

একটা ছেলে জীবনে সবথেকে বেশি খুশি হয়, যখন জানতে পারে সে বাবা হতে যাচ্ছে। তোমাকে যেদিন বলেছিলাম, আমাদের সন্তান আসছে – তোমার চোখেমুখে অদ্ভুত এক আনন্দ দেখতে পেয়েছিলাম। তোমার চোখদুটো আনন্দের অশ্রুতে ছলছল করছিল। তোমার ওই মুখটা আমি এখনো ভুলতে পারি না জানো? ঠিক এই মুহূর্তেও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

কত স্বপ্ন দেখেছিলে আমাদের বাবুকে নিয়ে! নিজের হাতে ওর ঘর সাজালে, ওর জন্যে কত কেনাকাটা করলে। বাবা ডাক শোনার তীব্র ইচ্ছা নিশ্চয়ই তোমাকে ঘিরে ধরেছিলো। আর আমি কী করলাম? তোমার সেই সব স্বপ্নগুলো পানি ঢেলে দিলাম। আরও একবার হেরে গেলাম আমি। আরও একবার আমার কারণে হতাশ হলো আশেপাশের মানুষগুলো।

আশেপাশের মানুষগুলোকে আমি তোয়াক্কা করি না। কিন্তু তুমি? তোমার যন্ত্রণাগুলো তো আমার সহ্য হয় না সায়েম। তোমাকে হতাশ করে ভালো থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি বলো না? ধৈর্য ধরতে, একদিন না-কি সব ঠিক হয়ে যাবে! আমি পারি না ধৈর্য ধরতে। কারণ কিচ্ছু ঠিক হবে না। যন্ত্রণার যে আগুনটা তোমার ভেতরে জ্বলছে তা আজীবন ভোগাবে তোমাকে। তুমি কষ্ট পাবে, এই কষ্ট কোনোদিন কমবে না। চিরকাল স্থায়ীভাবে পড়ে থাকবে মনের এক কোণে।

তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি তো, তাই তুমি দিনের পর দিন কষ্ট পাবে মানতে পারছি না। অনেক ভেবেছি, ভাবতে ভাবতে যা বুঝতে পারলাম, তা হলো আমার সঙ্গে তুমি কোনোদিনই সুখী হবে না। আমি তো কোনোদিন পারবো না তোমাকে বাবা ডাক শোনাতে। তুমিই একবার ভেবে দেখো, আমি মা হতে পারবো না তার মানে তো এই নয় যে তুমি বাবা হতে পারবে না।

আমার সঙ্গে সারাজীবন থাকলে তুমি কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না। তুমি আবার বিয়ে করো। আমার থেকে ঢের বেশি সুন্দরী, আর যোগ্যতাসম্পন্ন একটা মেয়েকে। যে মেয়েটা আনন্দে তোমার ঘর ভরিয়ে রাখবে। যাকে বিয়ে করে তোমার মধ্যে কোনপ্রকার আক্ষেপ থাকবে না। আমি দূর থেকে চিরকাল তোমার জন্যে দোয়া করে যাবো।

আমি চলে যাচ্ছি সায়েম। জানি না কোথায়, কিন্তু তোমার থেকে অনেক দূরে। যত দূরে গেলে তুমি আমাকে আর কোনোদিন খুঁজে পাবে না, ঠিক ততটা দূরে। আমাকে আর খোঁজার চেষ্টা কোরো না। মনে কর, নাজ নামের কেউ কোনোদিন তোমার জীবনে আসেনি। আমার কষ্ট হচ্ছে, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তোমার ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু তবুও, চোখের সামনে প্রতিনিয়ত তোমাকে কষ্ট পেতে দেখার থেকে এই তো ভালো তাই না?

ইতি,
জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া ব্যর্থ মেয়েটা।”

(চলবে)