গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক ২ পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
657

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৯ এবং শেষ)
সিজন ২
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৪০.
মেহজাকে রিসিপশনে শাড়ি পড়ানো হলো। হালকা বেগুনী রঙের মধ্যে রূপালি রঙের ঝিলিক দেওয়া সুন্দর একটি জর্জেটের শাড়ি। দেখতে পাতলা মনে হলো মূলত ভীষণ ভারি শাড়ি। মেহজার খুবই ক’ষ্ট হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে নিজেকে দো’ষ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কেননা সে নিজেই এটা পছন্দ করেছিল।

রিসিপশনের অনুষ্ঠানটাও কমিউনিটি সেন্টারে হলো বেশ বড় আয়োজন করে। মেহজা সেই সন্ধ্যা থেকে সং সেজে আসা যাওয়া করে মানুষদের সাথে আলাপ করছে ছবি তুলছে। একজনকে চিনলে দশজনকেই চিনতে পারছেনা। তার পরিচিত লোকের সংখ্যা খুব কম। মেহজা এখানে এসেছে থেকেই দুই বান্ধবীকে পাচ্ছে না। অনা দুই বার এসে ঘুরে গেলেও প্রথি শুরুতে যে দেখা করেছে তারপর আর এই মুখো হয়নি। মেহজা অবশ্য লক্ষ্য করেছে প্রথি অয়নের সাথেই সময় কাটাচ্ছে। অয়নকে মেহজার অসহ্য লাগছে। দুইদিন আগে তার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছিল ছেলেটা। এখন আবার তার বান্ধবীকে ধরেছে। নিশ্চয়ই ছেলের চ’রি’ত্রে গড়বড় রয়েছে। প্রথিকে সা’ব’ধা’ন করতে হবে।

ইরফান নিজের পরিচিত, বন্ধু বান্ধবদের সাথে আলাপ শেষ করে মেহজার পাশে এসে বসে। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে,
-‘খা’রা’প লাগছে?’

মেহজা চোখ মুখ বি’র’ক্তি’তে কুঁচকে নিল। এতক্ষণ পর সে এসেছে খবর নিতে! ঢং পেয়েছে। ওই বন্ধুরাই সব। বৌ কিছুই না। আর কতগুলো মেয়ে বন্ধুও তো লোকটার রয়েছে। এত দারুন, আভিজাত্যে মোড়া, সুন্দরী মেয়ে রেখে সে তাকে কি করে বিয়ে করেছে সেটা ভেবেই সে অবাক। ইরফান বলল,
-‘কি হলো? কথা বলছ না কেন! বেশি খা’রা’প লাগছে?’
-‘না।’

থমথমে গলা শুনে ইরফান বুঝেই নিল মেহজা রে’গে আছে। সে কি তার উপর রা’গ করেছে নাকি? করতেও পারে। এই মেয়েকে সে বোঝেনা। বোঝেনা কোনো মেয়েকেই। নিজের মা, বোনদের ও বোঝেনা। ইরফান হঠাৎ করেই ভাবল ভবিষ্যৎে তার মেয়েকে সে বুঝতে পারবে তো!

অনুষ্ঠান খুব সুন্দর ভাবেই সমাপ্ত হলো। অনা বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মেহজার সাথে দেখা করে নিয়েছে। প্রথিকে ডাকতে গেলেই কোথা থেকে সামনে সিনান এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখেই মুখ দিয়ে বি’র’ক্তি’তে ‘চ’ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। সিনান মেহজাদের পরিচিত হওয়ায় দাওয়াত পেয়েছে। বিয়েতে আসতে পারেনি তবে বৌভাতে রাদিফ বলল যেন কোনোভাবেই মিস না দেয়। আসতেই হবে। অনুরোধ রক্ষার্থেই আসা। আর এসেই তার মনে হলো এখানে না এলে সে অনেক বড় কিছু মিস করতে যাচ্ছিল।
-‘এভাবে হুটহাট সামনে এসে দাঁড়ানো কোন ধরনের ভদ্রতা?’
-‘ভদ্রতা না বলে সরাসরি অ’ভদ্রতা বলেই দাও।’

অনা খেয়াল করল লোকটি তাকে তুমি করে বলেছে। এই ব্যাপারটা তার পছন্দ হলো না। অপরিচিত লোকের মুখে তুমি বলা তার ভালোই লাগেনা। তারওপর সেই মানুষটি সিনান! প্রথম দেখাতেই এই লোক তাকে একটা বা’জে অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। সেই ঘটনা সে ভোলেনি এখনও। তবে লোকটা ভারি নির্ল’জ্জ। কি সুন্দর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। গ’র্দ’ভ শব্দটা বিড়বিড় করে বলল সে।

-‘আপনি ভালো আছেন?’
-‘এতক্ষণ ছিলাম। বিশ্বাস করুন, আপনাকে দেখে সেই ভালো চলে গেছে।’
-‘তাই নাকি! কি বলেন! তাহলে আমারই তো দায়িত্ব সেই ভালোটা ফিরিয়ে আনার।’
-‘জ্বি অবশ্যই আপনার দায়িত্ব। এবার সামনে থেকে সরুন। আমি ভালো হয়ে যাব।’
-‘না না। সরলে চলবেনা। একটা কাজে এসেছি। সেটা তো শেষ করতে হবে।’
-‘কি কাজ?’
-‘আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে খুব। বিয়ের বয়স হয়েছে তাই প্রেম ট্রেমে যেতে চাইছিনা। সোজা বিয়ে করতে চাইছি। আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন?’

কথাটা শুনে রা’গে অনা ফুঁ’স’তে লাগল। এত বড় সাহস লোকটার? সে ভাবল কীভাবে অনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা!
-‘কখনোই করব না। আপনি এই কথা বলেন কীভাবে!’
-‘করবেন না?’
-‘না।’
-‘সত্যি?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘বাহ! বেশ বেশ। আমি খুশি হলাম।’

অনা চমকে গেল। খুশি হলো মানে? এতক্ষণ কি তবে অনার সাথে মশকরা করছিল?
-‘তবে মিস. অনা! আমার আসলে কোনো কিছু সহজে পেয়ে যেতে ভালো লাগেনা। জোর করে নিতেই আমি অভ্যস্ত এবং সেটা পছন্দও করি। ভালো লাগল যে আপনাকেও জোর করে নিতে পারব।’

কথাটা বলেই সিনান চলে গেল জায়গাটা ছেড়ে। অনার মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেল। লোকটা এত বড় ই’ত’র!

মেহজাকে এখন তাদের বাসায় আনা হয়েছে। সাজ পোশাক সব বদলে খাবারও খাওয়া হয়েছে। আপাতত সে এবং ইরফান ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু বাতাসে মেহজার পরণের হাফ সিল্ক শাড়িটা দুলছে। ইরফান বেতের চেয়ারে বসে একমনে সেই দৃশ্য দেখছে। তার অতীতের কিছু দৃশ্য মনে পড়ল। প্রথমদিন মেহজাকে লিফটে দেখেছিল। সেদিন প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে তার কেমন অদ্ভুত ভাবে ভালো লেগে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল মানুষ হিসেবে ভালো লেগেছে। এত ছোট মেয়ের প্রতি ওই ভালোবাসা বা ভালোলাগা আসবে না। প্রশ্নই উঠেনা! কিন্তু দিন বদলায়, মেহজাকে আরেকটু কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। ইমার অনুপস্থিতে যখন সে মেহজার পরীক্ষা নিচ্ছিল তখন খোলা চুলের মেহজাকে তার আবারও ভালো লেগেছিল। তাই তো পরবর্তীতে বলল চুল খোলা রাখার জন্য। তবুও তার মনকে সে বোঝায় এসব কিছুই না। সব স্বাভাবিক। কিন্তু অয়ন যখন মেহজাকে পছন্দ করা শুরু করেছিল, মেহজার মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিল তখন হৃদয়ের কোথাও একটা ঈ’র্ষা হা’না দিত। ততদিনে অবশ্য সে নিজেও বুঝে গিয়েছিল যে মেহজা তাকে পছন্দ করে। ভালোবাসার কথা না জানুক পছন্দের টা জানতে পারল বলেই খুশি। এইদিকে মা বোনদের ইশারা ইঙ্গিতও সে বহু আগেই ধরে ফেলেছিল। মানা কখনোই করতে চায়নি। তবুও একটু ভাব ধরত যে সে চাইছেনা। কারণ তার কাছে ব্যাপারটা কিছুটা ল’জ্জার। নিজ থেকে এত ছোট বয়সের মেয়েকে বিয়ে করার সে কোনো যথাযথ কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। তবে সেদিন ইলার কথা শোনার পর মেহজার হৃদয় ভা’ঙা’র শব্দ সে কেন যেন পাচ্ছিল। মেহজার মন সে আ’ঘা’ত দিতে চায়নি। সে ভাবত প্রথম প্রথম তার মা বোন হয়তো মেয়েটিকে তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তবে তার ধারণা ভুল ছিল। যখন সে তা অনুধাবন করল তখন আর তার মনে আপত্তি রইল না। মেহজা ছাড়া সেই মুহূর্তে এবং এখনও সে বিকল্প কাউকে দেখছেনা, সত্যি বলতে দেখতে চাইছেনা।

৪১.
মেহজার মনটা ভালো। ইরফান আশেপাশে থাকলেই তার ভালো লাগে। এখন আর কোনো ল’জ্জা কিংবা জ’ড়’তা কাজ করেনা। সকাল বেলা ঘুম থেকে যখন উঠেছিল ইরফানকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে তার অতীত মনে পড়ছিল। সে ইরফানকে প্রথম তো সেভাবেই দেখেছিল! খালি গায়ে পিঠ দেখিয়ে ঘুমাচ্ছিল। ইরফানের ঘুমানোর স্টাইল এটাই হয়তো। মেহজার হাসি পেল কেন যেন! মনে হলো ইরফান ব্যাঙের মতো ঘুমায়।
-‘হাসছ কেন?’
-‘একটা মজার কথা ভাবছি, তাই।’

মেহজা ইরফানের পাশের চেয়ারে বসল। ইরফানের গা ঘেসেই বসল। ইরফান তাতে কিছুটা চমকে গিয়েছিল। একটু আগেও মেয়েটা তার উপর রে’গে ছিল। তাই হঠাৎ কাছে আসাটা তার কাছে অদ্ভুত ঠেকল।
-‘কেমন মজার কথা ভাবছ? আমাকেও বলো। একটু হাসি আমিও।’
-‘কিন্তু আপনি তো কথাটা শুনে হাসবেন না। রা’গ করবেন।’
-‘তুমি কি তবে আমাকে নিয়েই কিছু ভাবছ?’
-‘অবশ্যই।’
-‘আচ্ছা বলো ফেলো। রা’গ করব কিনা সেটা পরে দেখা যাবে।’
-‘বলব?’
-‘বলতেই তো বলছি!’
-‘আমি এটা ভাবছিলাম যে আপনি ব্যাঙের মতো ঘুমান।’

কথাটা বলেই মেহজা এবার শব্দ করে হাসতে লাগল। আর ইরফান বিস্ময় ভরা চোখে মেহজার দিকে তাকিয়ে রইল। ব্যাঙ? সত্যিই! তার মুখটা থমথমে আকার ধারণ করল। মেহজা এমনটা ভাবল কেন?
-‘ব্যাঙ বলছ ইনডিরেক্টলি?’
-‘ব্যাঙ বলছি না তো। বলছি ব্যাঙের মতো ঘুমান। হা হা হা।’

ইরফান উঠে চলে যাচ্ছিল। মেহজা হাত ধরে ফেলল,
-‘বসুন। আরো একটা কথা বলার আছে।’
-‘আরো একটা অ’প’মা’ন তবে!’
-‘শুনবেন না তাই তো?’
-‘শুনব না বলিনি।’
-‘বেশ। তবে শুনুন!’
মেহজা আকস্মিক ইরফানের গলা দুই হাত দিয়ে পেচিয়ে ধরল। মুখটা তার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘আমি আপনাকে ভালোবাসি।’
ইরফানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটল। সে নিজেও মেহজার কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘জানি।’

চমকে গিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মেহজা বলল,
-‘জানেন মানে!’
-‘জানি মানে কি আবার? জানি মানে জানা। অনেক আগে থেকেই জানি।’
-‘আমি তো কখনো বলিনি।’
-‘সব কিছু মুখে বলতে হয় তা কে বলল? আর সব কিছু যে মুখে না বললে বোঝা যাবেনা সেটাও বা কে বলল!’

মেহজা সরে এলো ইরফানের পাশ থেকে। ইরফান তবে জানে! সে তো জানেনা ইরফানের মনের কথা। ইরফান তাকে বিয়ে করল কেন? প্রশ্নটা এত বেশি মাথায় আসছে! তার মনে হয় কেবল পরিবারের কথাতেই সে বিয়েটা করেছে। মেহজা তো ভালো করেই জানে পিতা মাতার বাধ্যগত সন্তান ইরফান। তবে কি শুধু মাত্র মাতৃ আজ্ঞা পালন? তার মনটা খা’রা’প হয়ে গেল। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চাঁদটা একমনে তাকিয়ে দেখে। হঠাৎ পেছন থেকে তাকে দুইটা বলিষ্ঠ হাত জড়িয়ে ধরে। সেই হাতের মালিককে সে চেনে। ইরফানের উষ্ণ স্পর্শ সে অনুভব করে। তার চুল গুলো একপাশে সরিয়ে কানের লতিতে আলতো করে কামড় দিয়ে ইরফান তখনিই বলল সবচেয়ে সুন্দর কথাটা।
-‘The moon is beautiful, isn’t it?’

মেহজা কেঁ’পে উঠল। সে এই কথাটির অর্থ জানে। উহু! এই কথার অর্থ এটা নয় যে, ‘চাঁদটা সুন্দর, তাই নয় কি!’ এই কথার মূল উদ্দেশ্য আরেকটি। বাংলা ট্রান্সলেট যদিও এটি হবে তবুও এর আসল ভাষা, মূলভাব সম্পূর্ণ আলাদা। এর মূল অর্থ হলো ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এবং এই কথাটা জাপানিজ কোনো এক সাহিত্যতে প্রকাশ পেয়েছিল।

সে পেছন ফিরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার স্বপ্ন পুরুষকে। বলল,
-‘Yes, it is!’

ইরফানের ঠোঁটে এক টুকরো প্রশান্তির দেখা মিলল। সে জানে মেহজার সাহিত্যপ্রেম সম্পর্কে। তাই তো ভালোবাসার প্রকাশটা সাহিত্যিক ভাবেই করল।

দু’টো মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। চাঁদের আলো তাদের সেই মুহূর্তটা ধীরে ধীরে রোমাঞ্চকর করে তুলছে। দখিনা হাওয়া তাদের ছুঁয়ে দিচ্ছে। এবং সেই বাতাসে বহিছে প্রেম। তাদের নয়নেও রয়েছে নেশা।

এখন হয়তো গোধূলী লগ্ন নেই। তবে এক গোধূলী লগ্নে যখন গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক ছিল তখনই ইরফান তার জীবনের এক বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সন্ধ্যার হওয়ার সেই মুহূর্তে লিফটে মেহজার সাথে দাঁড়িয়ে সে মেহজার প্রতিটি নিঃশ্বাসও বোধহয় অনুভব করেছিল। সে তখন মেহজাকে ভালোবেসেছিল, যেমনই বাসে আজ এবং আগামীতেও সে বাসবে।

(সমাপ্ত)