#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৪৫)
সোহানা ইসলাম তামিমের পিছু নিয়েছে। ছেলেটা কোনো ভাবেই কথা শুনছে না। সকাল থেকে ঘুরেও কাজ হচ্ছে না। তামিম বাড়ি থেকে বেরোতেও পারছিলো না। কোনো ভাবে বেরিয়েছে এখন আর বাসায় ঢুকছে না। রাত গভীর হতে থাকলে ফিরোজ খান ফোন দেয় তামিম কে।
‘ কোথায় তুমি?’
তামিম বাড়িতেই আছে। পেছন দরজা দিয়ে ঢুকেছে। নিজের রুমে যায়নি। তানভীরের রুমে আছে। এখন যদি বলে তানভীরের রুমে তাহলে এসে আবার হানা দিবে। কি বলবে? মিথ্যা তো বলতে পারছেনা। তামিমের সিচুয়েশন বুঝে তানভীর নিজেই ফোনটা কান থেকে নিয়ে নেয় ।
‘ আমার রুমে আছে পাপা। ‘
‘ তোমার মম টেনশনে টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর তোমরা আড্ডা দিচ্ছো? ‘
‘ না পাপা। ঘুমুচ্ছি। ঘুমতে দাও। গুড নাইট। ‘
ফোন রেখে দিতেই তামিম চোখ গরম করে,
‘ এবার যদি মম এসে আমার মাথা খারাপ করে দেয় তোর খবর আছে। ‘
‘ আসবেনা ঘুমাও। এতোক্ষণে বোধহয় তোমার বাগদত্তা জেগে নেই।’
‘ ঘুমিয়েও নেই। ‘
‘ কি করে জানলে?’
‘ ডিপ্রেশনে থাকা মানুষের চোখে এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না। মিস রোজির সাথে যা হয়েছে তা নিয়ে উনি টোটালি ডিপ্রেসড। তিনি অবশ্যই ঘুমের মেডিসিন নিয়ে ঘুমান। শরীরের জন্য মোটেও ঠিক নয়। ‘
তানভীর মৃদু হাসে। ঘুমোতে বলে নিজেও ঘুমানোর ট্রাই করে। সে পর্যন্ত ই। কিন্তু ঘুমাতে পারেনা। অতিরিক্ত ক্লান্ত না হলে ঘুম আসে না। ফ্রমের বিছানাটা আজকাল শক্ত মনে হয়। বড্ড নিষ্প্রান। বালিশে মাথা রাখলে শুনতে পায় না হৃদস্পন্দন। মাথায় বিচরণ করে না একটা তুলতুলে নরম হাত। তানভীরের ছটফটানি তামিম খেয়াল করে। লম্বা শ্বাস ফেলে।
‘ তোর হয়ে পাপাকে রিকুয়েস্ট করবো অনুষ্ঠান ছাড়াই লাবিবাকে নিয়ে আসতে। পরে না হয় রিসিপশন করা যাবে। ‘
‘ পাপার এনস্যার হবে আগে বড় বউকে ঘরে তুলবো তারপর বড় বউ ছোট বউকে ঘরে তুলবে। ‘
তামিম বালিশ ছেড়ে উঠে বসে। তানভীর ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
‘ এনি প্রবলেম?’
‘ তোদের কি মনে হচ্ছে না তোরা আমাকে ট্রাপে ফেলে বিয়েটা করিয়ে নিচ্ছিস?’
‘ তার আগে তুমি সিরিয়াস হও। বলো ফ্লোরাকে এখনো চাও? বিলিভ মি। আমি ব্যবস্থা করব। ‘
তামিম মাথা নাড়ালো। সে চায় না। আবার শুয়ে পড়লো। পাশ ফিরে উল্টো দিক হলো। বিরক্তিমাখা কন্ঠে জানালো, ‘ তোর জন্য হলেও আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতেই হবে। ‘
‘ রোজী। না?’
‘ হুম। ‘
ঘর জুরে নেমে এলো নিরবতা। ঘুমোতে চাইলেও ঘুম এলো না তামিমের চোখে। প্রথমে ফ্লোরা তারপর রোজী । দুই নারীকে নিয়ে ধাঁধা সৃষ্টি করতে করতে রাত টুকু কেটে গেলো।
সকালে ছাড় পেলোনা তামিম। সোহানা শার্টের কাপড় সহ হাত ধরে রেখেছে। তামিম বিরক্ত হলো।
‘ আহ! মম। কি শুরু করেছো বলতো? কিছুদিন দেখলাম তানভীরের পিছু ছুটেছো আর এখন আবার আমি কেনো? ‘
‘ কিছু দিন আগে তানভীর টা দুধের বাচ্চা ছিলো এখন তুমি দুধের বাচ্চা হয়ে গেছো বাবা। প্লিজ রোজীকে কলটা করো।আমি গতকাল বলে রেখেছিলাম তুমি কল করবে। মেয়েটা কি ভাবলো বলোতো?কথা যদি না বলো বনিবনা হবে? চিনবে কিভাবে দুজন দুজনাকে? এসব তো আমি মেনে নিবো না। আমার দুই ছেলে ছেলেবউকে আমি বেস্ট কাপল ক্যাটাগরিতে দেখতে চাই। ‘
তামিম বুঝলো ফোনটা করতেই হবে। তাছাড়া সারারাত ভেবে দেখেছে নিজেকে আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত।আগে যা ছিলো তা ভুল। এখন শুধরে নেবার সময়। তাই ফোন নাম্বার নিয়ে নিজের ফোন থেকেই কল করলো।
রোজী জানালার বাইরে মুখ দিয়ে বসে আসে। সকালের মৃদু রোদ মুখের উপর পড়ছে। চকমক করছে স্কিন। রাতে কখন ঘুমিয়েছিলো মনে নেই। ঘুম থেকে উঠে এভাবেই বসে আছে। ফোনে কল আসাতে জানালা থেকে সরে আসে। আননোন নাম্বার। আন্দাজ করে তামিম ই হবে। গতকাল ফোন দেবার কথা ছিলো উনার। ফোন রিসিভ করে আবার জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। এখান থেকে 4G নেট পাওয়া যায়।
‘ আসসালামুয়ালাইকুম। ‘
‘ উহুম। ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি তামিম খান বলছি। আপনার__’
‘ জি চিনতে পেরেছি। বলুন। কেমন আছেন?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ। আপনার শরীর ভালো?’
‘ জি ভালো। ‘
‘ রাতে ঘুমান না কেনো? ‘
‘ জি? আমি_ আমি রাতে ঘুমাই। ‘
‘ ঘুমের মেডিসিন নিয়ে ঘুমান।আচ্ছা আপনার কি মাতালের মতো লাগে? মাথা ঘোরায় ? কথা বার্তা কম বলেন কেনো? একদম চুপচাপ থাকেন। ‘
‘ না না তা হবে কেনো?’
‘ আমার কত বছর ডাক্তারির এক্সপেরিয়েন্স জানেন? আই থিংক আপনার একবার আমার চেম্বারে আসা উচিত। হযরত শাহজালাল হসপিটাল ফিফথ ফ্লোরে বসি। রিসিপশনে গিয়ে আমার নাম বললেই রুমটা দেখিয়ে দিবে। কবে আসছেন আসার আগে আমাকে ইনফর্ম করবেন। ‘
‘ আপনি কি আমার ট্রিটমেন্ট করতে চাইছেন? লিসেন আমি কিন্তু মোটেই সিক নয়। সুস্থ স্বাভাবিক একটা মানুষ। ‘
‘ আপনি আগে আসুন। আপনাকে দেখি। আমি এক্সপেরিয়েন্সড ডক্টর। মানুষকে ভালোভাবে দেখলেই বলে দিতে পারি সে কোন রোগ কন্টিনিউ করছে। আসার আগে জানিয়ে আসবেন। আমি হসপিটালে নাও থাকতে পারি কিনা! আল্লাহ হাফেজ। ‘
কট করে ফোনটা কেটে শ্বাস ছাড়লো তামিম। একবার ই রোজীকে দেখেছে। অতটা ভালো করেও দেখতে পারেনি সবার মাঝে। আলাদা কথা বলা উচিত। রোজী অনেকক্ষন ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। দেখা করবে সরাসরি বললেই হতো। এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলবে? লাবিবা সত্যিই বলেছিলো পাগলের ডাক্তার। কিন্তু একা যাবে কিভাবে? সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষের কাছে কিভাবে একা একা দেখা করবে? বাবা মাকে বললে না করবে না। কিন্তু রোজীর ভীষণ আন ইজি লাগবে। যতই হোক দ্বিতীয়বার তার ইন্টারেস্ট দেখানো সবার চোখে লাগবে। রোজী লাবিবাকে টেক্সট করে দিলো। একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
রোজী জানালো সে আসছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই তামিম হসপিটালে নেই। সে বাসায় আছে। আছে পরিবারের প্রত্যেকটি পারসন। তামিম তড়িখড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। পথ আটকে দাঁড়ালো সোহানা ইসলাম। তার মতে হসপিটালে বা বাইরে দেখা না করে রোজীকে তার বাড়িতে নিয়ে আসা উচিত। এতে বাড়ির প্রত্যেকের সাথে দেখা হবে। বাড়িটাও দেখা হবে। ইচ্ছামতো দুজনে উইদাউট ডির্টার্ব টাইম স্পেন্ড করতে পারবে। একপ্রকার জোর করেই তামিমকে রাজি করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তানভীর হাসতে হাসতে বললো,
‘ ভাইয়া কি নার্ভাস ফিল করছো? দেখো তুমি কিন্তু নিজে থেকেই দেখা করতে চাইছো। ‘
‘ রোজী মেয়েটা কেমন হবে রে? নরম সরম মেয়ে? নাকি রণচন্ডী? কিছুই তো জানি না। ‘
‘ নিশ্চয় উল্টোপাল্টা কিছু বলেছো। ‘
তামিম আর বললো না যে রোজীকে চিকিৎসা করতে চেয়েছে। মেয়েটা নিশ্চয় রেগে আছে। তানভীর ব্যপারটা বুঝে বললো,
‘ ওকে চলো আমিও যাচ্ছি। একদম বাড়ি থেকেই গিয়ে নিয়ে আসবো। বাইরে কোথাও ওয়েট করানোর কোনো মানে হয়না। ‘
‘ ওর ফ্যামিলি কিছু বলবে না?’
‘ আরে ব্যপার না। চলো দেখছি ভাবীকে কিভাবে তুলে এনে আরেকটু রাগিয়ে দেওয়া যায়। ‘
তামিম বাঁকা চোখে তাকায়। তানভীর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে গাড়ির চাবি হাতে বেরিয়ে যায়।
চলবে ____
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৪৬)
তামিম তানভীর রোজীর বাসায় বসে। টেবিলে বিভিন্ন রকম ফল মিষ্টি দেওয়া হয়েছে। রোজীর মা না খাইয়ে কুটুম কে যেতেই দিবে না। তামিম নিজের কথা বললো না। সোহানা রোজীকে নিয়ে যেতে বলেছে জানালো। রোজীর বাবা আপত্তি করলো না। রোজীর মা মেয়ে রেডি হয়েছে কিনা খোঁজ নিতে গেলো। ছেলে মেয়ে যত একসাথে থাকবে ততো তাঁদের জন্য ভালো। রোজী টিয়া রংয়ের পাকিস্তানি সেলোয়ার কামিজ পড়েছে। চুল গুলো পেঁচিয়ে কাটা লাগিয়ে মাথায় ওড়না দিয়েছে। তাঁকে দেখতে খুব স্নিগ্ধ লাগছে। তামিমের চোখে চোখ পড়তেই দেখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এভাবে তাকানোর কি মানে? এখনো কি তাকে রোগী মনে করছে? রোজী এক পা দু পা পিছিয়ে জানালার সচ্ছ গ্লাসে উঁকি দিলো। নাহ তাকে তো তরতাজা দেখাচ্ছে। অসুস্থতার ছিটে ফোঁটাও চেহারায় নেই। তামিমের এরকম চাহনিতে কনফিডেন্স লেভেল কোথায়ও যেনো টুট যাচ্ছে। রোজী নার্ভাস। প্রচন্ড পরিমান নার্ভাস। তামিম ওকে নার্ভাস করে দিয়েছে। তানভীর কে দেখে রোজী আরো বেশি নার্ভাস। চার দেয়ালে বন্দী নারী জোয়ান দুজন পুরুষের সাথে এক গাড়িতে যাবে ভেবেই শরীরে কাটা দিয়ে উঠছে। তামিমের সাথে কিভাবে কথা বলবে? বুকে ভয় বাসা বেঁধেছে। শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সাথে কনভারসেশন গুলো কেমন হবে? ফ্যামিলির প্রত্যেকটা মেম্বার যেভাবে ঠাট পাট বজায় রেখে চলাফেরা করে! বড় লোক দের একটা আঙুল দেখেই বোঝা যায় তারা বড়লোক। সেখানে এই ফ্যামিলি তো রাজনৈতিক ফ্যামিলি।তার সাথে এদের আচরণ কেমন ধরনের হবে? রোজীর ভাবনার ভাটা পড়ে তামিমের ডাকে। তামিমের পেছন পেছন ই আসছিলো সে। তামিম সামনে সিটের ডোর খুলে দিয়ে বললো, ‘ উঠো। ‘
রোজী পেছন সিটের দিকে তাকালো। তার নাকের ডগা দিয়ে তানভীর গিয়ে পেছন সিটে বসে পড়লো। রোজী জোরে শ্বাস টেনে গাড়িতে উঠে বসলো। সরাসরি চোখ রাখলো বাহিরের দিকে। পুরো রাস্তা এভাবেই যাবে। একদমি তাকাবে না তামিমের দিকে।
ঘুমন্ত লাবিবাকে গাড়িতে দেখে তানভীর অবাকই হলো। তার তো জানার কথা নয় তানভীর এখানে এসেছে। কার সাথে এতোপথ আসলো? কখন ই বা আসলো? কেনো আসলো? ভেতরে গেলো না কেনো? না এই বউটা তানভীর কে পাগল করে ছাড়বে। নিশ্চয় একা এসেছে। গাড়িও তো নিয়ে আসেনি। নাকি রোজীর কাছেই এতোবেলা ছিলো? গাড়িতে বসে ঘুমুচ্ছে! হাতে কলেজ ব্যাগ। গাড়ি স্টার্ট দেবার শব্দেও ঘুম ভাঙল না। তানভীর নাকিব কে কল করলো। লাবিবার কথা জিজ্ঞেস করার আগেই নাকিব সোজা গড়গড় করে বলতে লাগলো,
‘ স্যার আমার কোনো দোষ নেই। ওকে আটকাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও বললো ওর নতুন জা নাকি বিপদে আছে তার পাশে থাকতে হবে। লাব্বু রোজী আপুর বাসায় গিয়েছে স্যার। ক্লাস শেষে আমি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও ক্লাস তো করলোই না উল্টে এস্যাইনমেন্ট টা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দৌড় দিলো। ‘
‘ আচ্ছা। আমার সাথেই আছে। রাখছি। ‘
‘ ওকে স্যার। ‘
তানভীর এতোক্ষনে বুঝলো গাড়িতে বসে ঘুমোনোর ব্যপারটা। রাত জেগে এস্যাইনমেন্ট করে সকালেই বেরিয়েছে। নিশ্চয় মাথা ব্যাথা করছিলো গাড়ি দেখতে পেয়ে উঠে বসে ঘুমিয়ে পড়েছে। তানভীর লাবিবাকে কাছে টেনে বসালো। ঘাড় টা ছেড়ে দিতেই ঝট করে ধরে ফেললো। একবাহু তে জড়িয়ে ধরে বসালো। কমফোর্টেবল হচ্ছে কিনা চেক করলো। জানালার কাঁচ টা খুলে দিলো। বাহিরে থেকে বাতাস আসাতে নাকের উপর উপর জমে থাকা ঘামের বিন্দু ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেলো। আরাম খুঁজতে লাবিবা ঘুমের মাঝেই আরো সেটিয়ে গেলো। তানভীর বুঝলো অসুবিধা হচ্ছে। মাথাটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দু হাতে জড়িয়ে রাখলো। কিছুক্ষন পর লাবিবার এক অদ্ভুত আচরণের সাথে তানভীর পরিচিত হলো। নাকটা থুতনির নিচে লাগিয়ে দিয়েছে। বুঝতে পেরেই তানভীর লাবিবার দিকে তাকালো। লাবিবা তানভীরের স্মেল পেয়ে নড়ে চড়ে পুরো শরীরের ভাড়টা ছেড়ে দিলো। দু হাতে পেট জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। তানভীর লাবিবার পাতলা উড়নাটা মুখের উপর মেলে দিলো যাতে রোদের আলোটা সরাসরি না পরে চোখে। লাবিবার নড়াচড়া থেমে গেলে তানভীর ঝুকে লাবিবার মাথার উপর ঠোঁট ছোয়ালো। কিছুক্ষন সময় নিয়ে জানালার বাইরে দিকে মুখটা বাড়িয়ে নিঃশব্দে হেসে দিলো। মিররে তামিম তানভীর কে হাসতে দেখলো। তানভীরের হাসিতে তামিম ও একটু হাসলো। মানুষ প্রেমে পড়লে এমনি হয়। কারণ অকারণে হাসে। ঘাড় ঘুরাতেই রোজীর চোখে চোখ পড়ে। তামিমের হাসিটা এতোক্ষন নজরে রাখলেও চোখাচোখি হবার সাথে সাথে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। তামিম হাসিমুখ নিয়েই আজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
খান বাড়িতে প্রবেশের পর তামিম গাড়ি থেকে নেমে যায়। রোজীও নেমে পাশে দাঁড়ায়। তামিম তানভীরের নামার অপেক্ষা করে। সে নামলে চাবিটা দারোয়ানের হাতে দিয়ে পার্কিং করতে বলে যাবে। দেড়ি দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘ নামছিস না কেনো?’
‘ বুকে বউ আছে। ‘
তামিম এগিয়ে এলো। জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই তানভীরের বুকে উড়নার নিচে লাবিবার ঘুমন্ত মুখটা দেখতে পেয়ে মুচকি হাসলো।
‘ ওহ মাই গুডনেস! লাবিবা কোথা থেকে এলো?’
‘ মাইগ্ৰেন প্রব্লেম আছে। ড্রয়িংরুমটা একটু চেক দিয়ে আসো। ‘
‘ প্রব্লেম হবেনা। নেমে আয়। আমরা ঢুকলে সবাই আমাদের নিয়েই বিজি হয়ে পড়বে। তখন তুই ওকে নিয়ে উপরে চলে যাস। ‘
লাবিবার নাম শুনে এতোক্ষণে চেপে রাখা অস্বস্তি রোজীর নিমেষেই কেটে এলো। তামিম সরে দাড়াতেই রোজী এসে লাবিবাকে ডাকতে লাগলো। তানভীর রোজীর দিকে কটমট করে তাকালো। রোজীর গলা মুহুর্তেই শুকিয়ে গেলো। সাহস নিয়ে বললো, ‘ ওকে ডেকে তুলুন। এসে গেছি তো। ‘
তামিম পিছু ডাকলো।
‘ রোজী পিছিয়ে দাঁড়াও। এদিকে এসো। ‘
রোজী ঝটপট তামিমের পাশে এসে দাঁড়ালো। তানভীর লাবিবাকে কোলে করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। লম্বা উড়নাটা মাটি ছোয়ালো। তামিম স্বযত্নে উড়নাটা তুলে নিলো। রোজী অবাক হয়ে তাদের এই বন্ডিং টা দেখলো। তামিম লাবিবার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘ ভুতনীটা কোথা থেকে এলো?’
‘ জানিনা। গাড়িতে উঠে দেখি বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। রাতে একটুও ঘুমায়নি আমি নিশ্চিত। ‘
তানভীর লাবিবাকে নিয়ে বাসার দিকে গেলে তামিম রোজীও পা বাড়ালো। রোজীর মুভমেন্ট বুঝতে পেরে তামিম বললো, ‘ লাবিবা এখন ঘুমোবে। ওকে পাবার আশা ছেড়ে দাও। ‘
রোজী একটু গাই গুই করে বলেই ফেললো, ‘ বাড়ির লোক দেখলে কি বলবে?’
তামিম হাসলো। রোজীর অবাক হওয়াটা কেনো যেনো ইনজয় করলো। রোজীর সাথে এতো সময়েই অনেককিছু বুঝে গেছে। এই মেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন পায়নি। সামান্য তম বিষয়ে তার অবাক হওয়াই তা প্রমান করে।
ড্রয়িংরুম ভর্তি লোকজন। তামিম যা ভেবেছিলো তাই। হবু বউ আসার খবর সোহানা তার চৌদ্দগুষ্টীতে ছড়িয়ে দিয়েছে আর তারাও এতোক্ষনে হাজির হয়ে গেছে। একান্তে কথা বলার সময় পেলেই হয়! এই মেয়ের সাথে অনেক কথা জানার এবং বলার আছে। তামিম রোজীকে নিয়ে আগেই বাসায় ঢুকলো। সুযোই পেয়ে তানভীর লাবিবাকে নিয়ে নিজ রুমে চলে গেলো। শুইয়ে দিতে গিয়ে লাবিবা জেগে গেলো। কিন্তু চোখ খুলতে পারলো না। বিছানায় হাত বুলালো। বামপাশে না পেয়ে ডানপাশে হাত রাখলো। তানভীর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাবিবার এসব কর্মকাণ্ড দেখছিলো আর নিঃশব্দে হাসছিলো। লাবিবা এই চোখ খুলবে খুলবে তাড়াহুড়ো করে তানভীরের লাবিবার দিকে ঝুঁকে উপরে সওয়ার হলো। সবথেকে প্রিয় স্মেলটা পেতেই লাবিবা থমকে গেলো। আবার ঘুমিয়ে গেলো। তানভীর ঘুমন্ত লাবিবার নাকে নিজের নাক ঘষলো। আদুরে সুরে বললো,
‘ আশেপাশে থাকলে বোঝে যাও, কাছাকাছি থাকলে ঘ্রাণ নাও। বউ! তোমার হাত থেকে আমার পাড় নেই। বড্ড চালাক হয়ে গেছো। ‘
কয়েকঘণ্টা পর তামিম রোজীকে একা পেলো। তামিম ডাকেনি। রোজীই এসেছে তামিমের রুমে। হাতে কফি মগ। নিশ্চয় কফির অযুহাতে মম এখানে পাঠিয়েছে। রোজী ডাকলো।
‘ আসবো। ‘
দরজায় কফি হাতে তামিম কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,
‘ এসো। মাঝবরাবর দাঁড়াও তো। একদম বেডের পাশে। ‘
তামিমের কথায় রোজী হকচকিয়ে গেলো। রুমের মাঝবরাবর কেনো দাঁড়াবে? রোজী দাড়াতেই তামিম রোজীকে অপলক দেখতে লাগলো। রোজীর অস্বস্তি তিনগুণ বেড়ে গেলো। আবার কি রোগী মনে করলো? পাগলের ডাক্তাররা নিজেরাও একেকটা পাগল হয়। তামিমের তো আবার প্রেমিকার শোক রয়েছে। পাগল না হলে বার বার এভাবে দেখার কি মানে?
‘আমাকে পটানোর বুদ্ধিটা কোথা থেকে পেলে?’
তামিমের প্রশ্নে রোজী অবাক হয়ে গেলো। কাঁপা গলায় উত্তর করলো, ‘ আআআমি আপনাকে চিনি না। ‘
‘ তাহলে আমার ফ্যামিলিকে কিভাবে চেনো? লাবিবাকে তো তোমার সাথে পরিচয় করানো হয়নি। ওদের বিয়েটাও তেমন ভাবে পাবলিশ হয়নি তোমার তো চেনার কথা নয়। ‘
‘ লাবিবা আমার পূর্ব পরিচিত। লাবিবার যে আগে একজনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো আমার এক্স হাজবেন্ড তার কাজিন ছিলো। লাবিবার বিয়ের পর ই আমাদের ডিভোর্স হয়েছে। ‘
‘ তারমানে আসল মাধ্যম লাবিবা? ইন্টারেস্টিং। ‘
‘ দেখুন আমি ঐ বাড়ির বউ হলে বউয়ের মর্যাদা কখনো পায়নি। বিয়ের পর থেকেই হ্যারেস হয়ে আসছি। হাজবেন্ড ও আমার সাথে ছিলো না। বলতে গেলে বছরে দু একবার ফিজিক্যাল ছাড়া আমাদের মাঝে কোন টান ই সৃষ্টি হয়নি। আমি ভালো ফ্যামিলির মেয়ে হলেও দাসীর মতো জীবন কাটিয়েছি। সাহস ছিলো না। সাপোর্ট ছিলো না। আমাকে সাহস যুগিয়েছে লাবিবা। আমি যদি সেখানে আর একটা বছর থাকতাম হয়তো বেচেই থাকতাম না। এমনিতেও মরার মতোই ছিলাম। আমি বুঝেগিয়েছিলাম সে আমার জন্য না। সে আগেই একটা বিয়ে করেছিলো আমি জানতাম। সবাই জানতো। যেখানে যেখানে পোষ্টিং হতো ঐ বউকে নিয়েই চলতো। আমি ছিলাম বাড়িতে শুধু তার পরিবারের কাজ করার জন্য। প্রকাশ করতে পারতাম না। আমার এক্স হাজবেন্ড আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়নি। আমি অনেক ঝড় ঝাপটা সামলিয়ে ডিভোর্স দিয়েছি। তিনি বা তার পরিবার এখনো আমার উপর নাখুশ। আমার ক্ষতি করার জন্য সুযোগ খুঁজে চলে। সেজন্যই আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায় বাবা। কিন্তু একজন ও দেখতে আসার পর টিকতে পারেনি। উনারা জিদ খেয়ে লেগেছেন আমার বিয়ে হতে দিবে না। একদিন লাবিবা যায় এমপি সাহেবকে নিয়ে। এমপি সাহেব আমাকে পছন্দ করেন। লাবিবার কথাতেই আমাকে দেখতে যান তিনি। এসবের আমি কিছুই জানি না। আমি ডিভোর্সী তাই বলে আমি লোভী নয়। আমাকে এমন দোষ দিবেন না যা আমি করিনি। আপনি একবার না করে দিন আমার বাবা বললে বিয়েটা ভেঙে দিবে। আপনাকে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না। ‘
‘ আমি আমার আগের স্ত্রীকে ভালোবাসি। ভীষণ ভাবে ভালোবাসি। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখন সে এক পথযাত্রী আমি এক পথযাত্রী। আমাদের এক হওয়া সম্ভব নয়। তার মানে এই নয় যে আমি আমার দায়িত্ব থেকে সরে আসবো। তোমার প্রতি আমার সব দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করবো। কিন্তু তুমি আমার প্রথম স্ত্রীর জায়গাটা পাবে না। তোমার কিছু বলার আছে?’
‘ এ পৃথিবীতে যারা ভালোবাসা বঞ্চিত মানুষ আমি তাদের দলের। কেউ আমাকে ভালোবাসুক আমি আশা করি না। ‘
‘ এতো নিল কিভাবে হলে? কিছু দিন হলো ডিভোর্স হয়েছে তোমার এক্সের প্রতি কি কোনো ভালোবাসা কাজ করেনা?’
‘ আমি উনাকে ঘৃণা করি। তার জন্য শুধুই আমার তরফ থেকে ঘৃণা। ‘
‘ তাহলে তো তুমি ঠকে গেলে রোজী। একসাথে থাকতে থাকতে হয়তো তুমি আমাকে ভালোবেসে ফেলবে কিন্তু আমি তো তোমাকে তা দিতে পারবো না। ‘
রোজী ছল ছল চোখে তাকালো। নাক টেনে বললো,
‘ আমার কিছু লাগবেনা। ‘ রোজী মাথা নিচু করে কাদছিলো তামিম বুঝতে পারলো। তামিম হেসে বললো, ‘ আমরা সামর্থবান মানুষকেই মনে হয় বেশি বেশি অফার দিই। তাঁরা আরো বড়ো অফারের জন্য প্রতিনিয়ত রিজেক্ট করে চলে। আমার মনে হয় তাঁদের পেছনে শ্রম ব্যয় না করে তাকে অফার করা উচিত যার কাছে ছোট্ট একটি অফারও আকাশের চাঁদ সমান। ডিনার করে যেও রোজী। য়্যু য়্যার মোষ্ট ওয়েল কাম। ‘
চলবে___
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৪৭)
‘ ডিসিশন কি নিলে?’
‘ আই ওয়ান্ট টু বি হ্যাপি উইথ রোজী।’
‘ মনকে শান্ত করো। তোমার উদাসীনতা আমাদের কষ্ট দেয়। ‘
তামিম মাথা নাড়ায়। ‘ জি পাপা। ‘
‘ সময় দাও। ঘুরো। দুজন দুজনকে চেনো। আমি রাজনৈতিক মানুষ। মানুষ চেনা আমার কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। তবুও পরখ করে দেখি। তানভীর যেমন আমাকে সময় দিয়েছে তেমন যদি তুমি আমাকে কিছুটা সময় দিতে তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। ‘
‘ তানভীর তোমাকে সময় দেয়নি পাপা। সে নিজেই নিজেকে সময় দিয়েছে। আমি জানতাম তুমি আপত্তি করবে না। সেজন্যই খালামনিকে দিয়ে প্রস্তাব রেখেছি।’
‘ ক্রেডিট তাহলে তোমার খালামনিকে দেওয়া উচিৎ। বুদ্ধিমতী না হলে হুট করে রাজী কেউ হতো না। ‘
‘ তাতো অবশ্যই পাপা। গাধাটা এভাবেই থাকতো। বিয়েও করতো না। লাবিবাকেও ছাড়তো না। ‘
লাবিবা চলে যাবে । শ্বশুর ভাসুরের কাছে বিদায় নিতে এসে তাদের কথা শুনে চমকে যায়।
‘ কে আমাকে ছাড়তো না পাপা? ‘
লাবিবার উপস্থিতিতে তামিম হাত বাড়ায়। ডাকে,
‘ আসো ।’
‘ ভাইয়া? কে আমাকে ছাড়তো না?’
‘ আমাদের বাসায় একটা পাঁচ ফুট এগারো ফুটিয়া চিমটা আছে। সে তোমাকে ছাড়বে না। ‘
তামিমের কথায় লাবিবা ফিক করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে সোফায় বসে। হাসি থামিয়ে বলে,
‘ আমাকে বোকা পেয়েছো ভাইয়া? এই বাড়িতে পাঁচ ফুট এগারো একমাত্র তোমার ভাই ই আছে। সে নাকি চিমটা! আমাকে ছাড়__কি? ‘
শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে হাসির ছলে বলতে গিয়ে কন্ঠ আটকে যায়। মুহুর্তেই একঝাঁক লজ্জাপাখি এসে ঘিরে ধরে। হুসে এসেই কাঁশতে থাকে। ফিরোজ খান ও খানিকটা কাশে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
‘ সাবধানে যেও মা আমাকে রেষ্ট নিতে হবে। ‘
তামিম লাবিবাকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ ফ্লোরার সাথে কথা হয়?’
‘ এখন হয়না। উনি নিষেধ করেছেন। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
‘ রোজী আপু অনেক ভালো। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
‘ আমাকে নিয়ে কি কথা বলছিলে?’
‘ তানভীর আর তোমাকে নিয়ে বলছিলাম। শুধু তোমাকে নিয়ে না। ‘
‘ বলো । ‘
তানভীরের ডাক আসে, ‘ লাবিবা। গাড়িতে এসো। ‘
আর ওয়েট করা যাবে না। লাবিবা তামিমকে বলে,
‘ পরে শুনবো। বাই ভাইয়া। ‘
‘ আচ্ছা। এসো। ‘
তামিম দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। এটা প্রত্যেকের চোখেই পড়েছে। ছেলেটা হাসিখুশি থাকে সবসময়। কিন্তু স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। তার ভেতর যে একটা কষ্ট রয়েছে বোঝার উপায় নেই। সেদিনের পর আর রোজীর সাথে কথা হয়নি। লাবিবা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ‘ ভাইয়া তুমি কতটা এবনর্মাল হয়ে যাচ্ছো একবার বোঝো। ‘
‘ কোথায় এবনর্মাল?’
‘ যেভাবে সব সময় হাসিখুসি থাকছো এতে শুধু আমরা না প্রত্যেকেই বলবে পাগলের ডাক্তার পাগল। ‘
‘ সুস্থ মানুষ হাসে না? ‘
‘ তোমার মতো হাসে না। একজন গম্ভীর মানুষ হুট করে হা হা করে উঠতে বসতে হাসলে থাকলে এটাতো পাগলের লক্ষন। ‘
‘ কি চাও?’
‘ আগের মতো হয়ে যাও। এভাবে ফেইক হাসবে না। ‘
‘ টপিক চেঞ্জ করো। ছোট মানুষ তুমি এতো বোঝবে না। ‘
লাবিবা অবাক হয়ে গেলো। সে নাকি ছোট মানুষ! আর কতো বড় হবে? তার বিয়ে হয়ে গেছে। থমথমে গলায় বললো, ‘ মেডিসিন দাও ভাইয়া। ঠোঁটের নিচে জ্বর ফোটা হয়েছে। ‘
তামিম একটা কাগজে লিখে লাবিবার হাতে ধরিয়ে দিলো। ‘ নিচে ফার্মিশিতে এটা দিলেই মেডিসিন দিয়ে দিবে। ‘
‘ হাজার টাকার নোট নিয়ে বেরিয়েছি। আমি ভাঙাবো না। ‘
‘ টাকা লাগবেনা। তুমি যাওয়ার সময় কাগজ টা দিয়ে দিও ওরা তোমাকে মেডিসিন দিয়ে দিবে। এখানে সবাই তোমাকে চেনে। ‘
লাবিবা হাঁসফাঁস করলো । সেতো এসব বলতে আসেনি। আসল কথাটাই তো বলতে সাহস পাচ্ছে না। যে মুড নিয়ে আছে! গাই গুই করে লাভ হবে না। তাই সরাসরিই বললো,
‘ ভাইয়া রোজী আপু তোমার সাথে ডেটে যাবে। ‘
‘ কিহ? ‘
‘ হুম। ‘
‘ রোজী বলেছে?’
‘ হুম। ‘
দাহা মিথ্যা। রোজীর হয়ে লাবিবাই বলছে। এতোবড় একটা ঘটনা তার হাত দিয়ে ঘটতে যাচ্ছে আর বলে নাকি ছোট! তামিম পুরো কনফিউজড হয়ে গেলো। রোজী মেয়েটাকে যা বুঝেছে নেশার ঘোরেও এই কথা বলবেনা। ‘ কবে ডেটে যেতে চেয়েছে?’
‘ তোমাকে ফিক্সড করতে বলেছে। ‘
‘ ওকে আমি জানাবো। ‘
‘ আমাকে জানাবে। ‘
‘ সরাসরি ওকেই জানাবো। ‘
‘ নাহ। আমাকে জানাবে। রোজী আপু ভীষন লাজুক। তোমার সাথে এই ব্যপারে কথা বলবেনা বলেই তো আমাকে দিয়ে বলালো। ‘
‘ টেল মি ওয়ান থিংক লাব্বু! তোমার কবে থেকে এসব ঘটক গিরি করার প্রতি ঝোঁক হলো?’
‘ ঘটক! এভাবে বলোনা ভাইয়া। আমি স্ত্রীলিঙ্গ। ‘
‘ আমি সরাসরি রোজীকেই জানাবো। ‘
এবার লাবিবা মেকি রাগ দেখালো, ‘ লিসেন ভাইয়া!ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। আম অলরেডি ম্যারিড। তোমার ভাইয়ের মতো যার বিয়ের ঘটকালি করতে যাবো তাকেই বিয়ে করে বসবো না। আমি যেহেতু প্রস্তাবটা রেখেছি সেহেতু আমিই ম্যানেজ করবো। ‘
‘ উল্টোপাল্টা বলছো কেনো? ‘
‘ জানিনা ভাইয়া । আমাকেই জানিও। আসি এখন। পরে কথা বলবো। ‘
‘ আরে __লাব্বু!’
ঘটনা কতদূর তামিমের বোঝতে দেড়ি নেই। লাবিবাকে পাঠিয়েছে রোজীকে আনতে। একটা রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করেছে। লাবিবা রোজীকে আনতে গিয়ে বিপত্তির জন্ম দেয়। রোজি বাড়ি থেকে বেরোতেই দু’জন তাঁদের ফলো করতে থাকে। লাবিবা না বুঝতে পারলেও রোজী ঠিক বোঝে। লাবিবার হাত চেপে ধরে প্রে করতে থাকে আল্লাহ বিপদ থেকে রক্ষা করো। সহি সালামতে পৌঁছতে দিও। খারাপ কিছু আর সে চায়না। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়না। মোড়ের মাথায় রিকশা পাওয়া যাবে। তার আগেই লোক দুটো ফাঁকা রাস্তা পেয়ে তাঁদের পথ আগলে ধরে। লোক দুটো রোজীর এক্স হাজবেন্ড আর ভাসুর। রোজী ভয়ে লাবিবার হাত আরো পাকড়াও করে ধরে। রোজীকে এভাবে ভয় পেতে দেখে লাবিবা কিছুটা আন্দাজ করে। চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি চাই?’
‘ তোমার কোনো প্রয়োজন নেই। সরে দাঁড়াও। ‘
‘ কাকে অর্ডার করছেন? আপনি জানেন আমি কে?’
‘ সরে দাঁড়াও মেয়ে। রোজীকে সাথে কথা আছে। ‘
‘ রোজীর কারো সাথে কথা নেই। ‘
‘ রক্ত গরম করো না। তোমাকে ভালো করেই চেনা আছে। ভাইয়ের প্রতিশোধ নিতে বাধ্য করো না। ‘
‘ আপনি মনে হয় আমাকে ঠিকভাবে চেনেন না। তাই চিনতে চাইছেন। সরুন। ‘
কাঁধে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় লাবিবা। দু পা পিছিয়ে যায় লোকটা। আরেকজন আঙুল তুলে চিৎকার করে উঠে। ‘ এই মেয়ে। অতিরিক্ত সাহস দেখিও না। গায়ে হাত দিলে পরে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেনা। এমপিও ছেলেও তাকিয়ে দেখবে না। ‘
‘ তাই নাকি? সাহস করে দেখুন। দিন গায়ে হাত। দেখি কত বড় কলিজা। ‘
‘ জহুর প্লিজ এটাকে সরা। ‘
রোজী এতোক্ষণ ভয়ে দুহাত বুকে চেপে ছিলো। লাবিবাকে হিট করার আগেই সে প্রতিবাদ করে উঠে,
‘ খবরদার হাত বাড়াবেনা। তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই। আমার সামনে আসবেনা। তোমাকে আমার চাইনা।’
‘ পাখা বড্ড গজিয়েছে না? বিয়ে করবি? তোর বিয়ের সাধ আমি মিটিয়ে দিবো না? খুঁজে খুঁজে এমপির পোলারে ধরছিস। তোরা দুইটাই শালী গোল্ড ডিগার। ‘
আর সহ্য করা গেলো না। কোমড় বরাবর লাথি দিয়ে ফেলে দেয় লাবিবা।
‘ খুব শক্তি না? মেয়ে মানুষ হয়ে পুলিশের সাথে লাগতে আসিস? দেখাচ্ছি শালী তোকে মজা। ভেবেছিলাম ছেড়ে দেবো তোকে। কিন্তু আর না। ‘
‘ মেয়ে মানুষ বলে কি লাগাতে পারবোনা দুই চারটে ঘা? সবাইকে রোজী ভাবিস না। তোদের মতো লোককে কিভাবে ঘায়েল করতে হয় আমার ভালো করেই জানা আছে। ‘
কথা বলতে বলতেই হাত মোজা দুটো ঝটপট পড়ে নেয় লাবিবা। লোক দুটোও ছাড় দেয় না। লাবিবা জানে কিভাবে নিজেকে প্রটেক্ট করতে হয়। এতো বছরের ক্যারাটে শিক্ষা নিজ কাজে লাগায়। রোজী লাবিবাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। পুতুলের মতো ইনোসেন্ট মেয়েটার ভেতর যে এমন তেজ! ভুল করেও কেউ ধারণা করতে পারবেনা। প্রত্যেকটা মেয়ের উচিত নিজেকে কিভাবে প্রটেক্ট করতে হয় তা শিখে নেওয়া। পাঁচ জনের সাথে লড়তে না পারলেও তো অন্তত দু একজন থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারবে। সবার যদি এই শিক্ষা টা থাকতো তাহলে যেখানে সেখানে থেকে এতো এতো ধর্ষনের নিউজ পাওয়া যেতো না। মেয়েরা স্বাভাবিক জীবনে নির্ভয়ে ছুটতে পারতো। তাঁদেরকে কেউ প্রতিরোধ করতে পারতো না।
তামিমের সাথে রোজীকে দিয়ে লাবিবা অন্য টেবিলে বসলো। মনটা ভালো নেই। চোট লেগেছে একটূ। এই ঘটনা না বলাই থাক। তামিম বললো, ‘ লাবিবা অর্ডার করো। ‘
‘ পাঁচটা চিজ বার্গার। পাঁচটা স্যান্ডুইচ। পাঁচটা ক্যান। ‘
‘ পাঁচটা?’
‘ তোমার বউকে আনতে গিয়ে অনেক এনার্জি লস করে ফেলেছি ভাই। এখন আমার বেশি বেশি খাবার চাই। ‘
লাবিবার মুখে বউ শব্দে রোজী হালকা লজ্জা পেয়ে যায়। তামিম আশ্চর্যতা নিয়ে অর্ডার দেয়। লাবিবা বসে না থেকে এদিক সেদিক হাঁটতে থাকে। ছাদের দিকে নজর পড়তেই দেখে ছাদটা ভীষন সুন্দর।নিচ থেকেই যতটুকু বুঝা যায়। অনেকে গিয়ে পিকচার নিয়ে আসছে। লাবিবা গুটি গুটি পায়ে ছাদে উঠে। যতটুকু ভেবেছিলো তার থেকেও সুন্দর। দুপাশে সেলফি কর্ণার ও করা আছে। ঝটপট কয়েকটা সেলফি নিয়ে নেয়। এদিক ওদিক কাপল রা হাত ধরে হাঁটছে। উফফ! ভালোবাসাগুলো দেখলেও ভালো লাগে। ভালোবাসার মানুষকে আরো বেশী ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। হটাৎ মনে হয় কেউ ওকে ডাকছে। আমলে নেয় না। পর পর ডাকে এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। নিচের দিকে তাকাতেই দেখে তানভীর হাত নাড়ছে। লাবিবা অবাক হয়ে যায় তানভীর কে দেখে। বিষন্ন মনটা নিমেষেই পুলকিত হয়। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। কোমড়ে দু হাত রেখে তানভীর লাবিবার হাসি মুগ্ধ চোখে দেখে।
‘ ছাদে কি করছো? নিচে আসো।’
লাবিবা রেলিংএ হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ায়।
‘ আপনি নিয়ে যান আমাকে। ‘
‘ তুমি এসো। ‘
‘ আমার তো লাফ দিতে ইচ্ছে করছে। ‘
‘ দাও। ‘
‘ সিরিয়াসলি? লাফ দিবো?’
‘ দাও। ‘
‘ সত্যি?’
‘ ভয় কিসের? আমি আছি তো। ‘
লাবিবার চোখ জোড়া ছল ছল করে উঠলো। মুখ ভরা হাসি। এতো ভরসা! এতো শান্তি! এতো বিশ্বাস! আর কোথায় পাওয়া যাবে নিজের মানুষটাকে ছাড়া?
লাবিবা রেলিং পার হয়ে ছাদের কিনারায় দাঁড়ালো।ছোট্ট জায়গায় দু পা কোনো ভাবে ধরে আছে। নিচ থেকে যারা লাবিবাকে দেখতে পেলো তারা পর পর চিৎকার দিয়ে উঠলো,
‘ এই মেয়ে! কি করছো? হুয়াট য়্যা য়্যু ডুয়িং? পড়ে যাবে তো। ‘
লাবিবা মুক্ত বিহঙ্গের মতো হাসছে। তানভীর একপা দুপা করে এগিয়ে যায়। সামনে দিকে হাত বাড়িয়ে বাড়ায়। আস্থা দিয়ে বলে,
‘ এসো। ‘
লাবিবা দুহাত দুপাশে মেলে দেয়। মোটেই ভয় পায়না। চোখে চোখ রেখেই হাসি মুখে দুতলা থেকে নিজেকে ছেড়ে দেয়। তানভীর আরো কয়েকপা এগিয়ে কেচ ধরে নেয়। লাবিবা কোলে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়। রেস্টুরেন্টের ভেতরে সকলের চোখ এখন তানভীর লাবিবার দিকে। কেউ কেউ হাসতে হাসতে বলে, পাগল ছেলে মেয়ে! কেউ কেউ আবার বাহবা দিতে থাকে। পুরো রেস্টুরেন্ট শোরগোল পড়ে যায়। লাবিবা ফিসফিসিয়ে বলে,
‘ খান সাহেব! জীবনটা এতো সুন্দর কেনো?’
তানভীর লাবিবার মাথায় ছোট্ট চুমু এঁকে বলে,
‘ তুমি আমি আমরা মিলে এভাবেই ভালোবাসার কাব্য গাথঁবো।’
চলবে __
Labiba Tanha Aliza-লাবিবা তানহা এলিজা