#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৫১)
লাবিবার রক্তে ভেজা মাথাটা তানভীরের বুকে। চোখ নিভু নিভু। বার বার হাপড় টানছে। খামছে ধরেছে শার্টের কাপড়। তানভীর রোদ্রোজ্বল দুপুরে মানুষের ছাড়া দেখেই বীভৎস চিৎকার করে, ‘ কুত্তার বাচ্চা বেরিয়ে আয় বলছি কলিজায় হাত দিয়েছিস আমি তোদের ছাড়বোনা। ‘
তানভীর উঠতে চাইলে লাবিবা শক্ত করে ধরে। কয়েকজন স্টুডেন্ট বিল্ডিং এর পেছন দিকে দৌড় দেয়। ধরতে হবে ওদের কে। তানভীরের মস্তিষ্ক এলোমেলো। কি করতে হবে মাথা কাজ করছেনা। লাবিবাকে মেয়েরা ধরতে এলেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। প্রেয়সীর মাথায় রক্ত দেখে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে। লাবিবা বহু কষ্টে ডাকে, ‘ খান সাহেব!’
‘ আমার কলিজা! ‘ তানভীরের কন্ঠ কাঁপছে।
‘ কে ছিলো ওরা?’
‘ ঐ অফিসারটা।’
ফিরোজ খান ঘটনাস্থলে দৌড়ে এসে দেখেন লাবিবা রক্তাত্ব মাথায় তানভীরের বুকে কাতরাচ্ছে। জলদি তানভীরকে তাড়া দেয়।
‘ লাবিবাকে কোলে তুলে নাও জলদি। আমি ডাক্তারকে ফোন দিচ্ছি। ‘
তানভীর লাবিবাকে কোলে তুলে নিয়েই বারান্দায় বিছানো বেঞ্চিতে গিয়ে বসে। হসপিটাল কাছাকাছি হওয়ায় পাঁচ মিনিটের ভেতরেই ডাক্তার চলে আসে। লাবিবার কপাল সহ মাথার খানিকটা ওয়াশ করিয়ে দেয় তুলো ভিজিয়ে। শক্ত কিছু দ্বারা আঘাত করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। হিযাপ খুলে ফেলায় কোমড় অব্দি ঢেউ খেলানো চুল গুলো ঝরঝর করে কোলে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যান্ডেজ করে দেবার পর ডাক্তার সাহেব মন্তব্য করেন,’ বেশ শক্তপোক্ত মেয়ে। মাথা ফাটিয়ে দিলো অথচ একটি বারের জন্য জ্ঞান হারালো না। ‘
তানভীর লাবিবাকে আরেকটু বুকের মাঝে চেপে নিলো।
ফিরোজ খান লাবিবার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন,
‘ টেস্ট করলে ভালো হয় না?’
‘ টেস্ট তো করতেই হবে। রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে যাবে বাট ভেতরে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা দেখতে হবে। এমনিতে তো উপর থেকে ভালোই দেখায়। ‘
‘হুম। ‘
‘ আমি হসপিটালে যাচ্ছি এমপি সাহেব। টেস্ট করিয়ে নিয়ে আসবেন। ‘
‘ জি আপনি আসুন। ‘
ডক্টর বের হতে পারছিলো না। এতো ভিড় লেগে গেছে! অনুষ্টান আরো আগেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। সেজন্যই এখানে সবাই ঢলে পড়েছে। তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাঁদের প্রিন্সিপালের কোলে তাদের ই কারো ক্লাসমেট কারো সিনিয়র ঘাড় ছেড়ে দিয়ে আছে। এতো গুলো মানুষের সামনে তাঁদের শীর্ষ সম্মানীয় একজনের বুকে তাদের মতোই একজন বিষয়টা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। উৎসুক চোখে হা করে দেখছে। মুখে মুখে হৈ হৈ পড়ে গেছে। ‘ স্যারের কি হয়? লাবিবা বোন নাকি অন্য কেউ? ফিরোজ খানের কনসার্ন দেখেও বলাবলি শুরু হয়েছে। ফিরোজ খান তানভীর কে বলে,
‘ তানভীর লবিবাকে নিয়ে হসপিটালে চলো। ‘
‘ একটু পর যাচ্ছি। বেরিয়ে যান আপনি। ‘
‘ সিকিউরিটি রেখে যাচ্ছি। ‘
‘ প্রয়োজন নেই। ‘
ফিরোজ খান তানভীরের মনের অস্থিরতা বুঝতে পারে। লাবিবাকে এই অবস্থায় পেয়ে তানভীর এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। একদম ছোট বাচ্চার মতো বুকে মিশিয়ে নিয়ে আছে। চোখে মুখে আতঙ্ক ভাব এখনো কাটেনি। একটু হলেই যেনো কলিজাটা তার ছিঁড়ে যেতো। বউ তার। বউয়ের কষ্টও তার। এতো সাধনার বউটার যদি কিছু হয়ে যেতো? কি নিয়ে বাচতো সে? সেটা ভেবেই এখনো ঠাঁয় বসে আছে। লাবিবার ক্ষতের দিকে খেয়াল কিন্তু উৎসুক জনগনের দিকে খেয়াল নেই। ধীরে ধীরে তানভীর স্বাভাবিক হয়ে উঠে।লাবিবার রক্তে রাঙা আঁচল! শুকিয়েও গেছে যেনো। আলতো হাতে চুল গুলোকে হাতের ভাজে নিয়ে নেয়। চোখের জল গড়িয়ে পড়া গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। অনবরত জল পড়া চোখে তাকাতে পারলো না তানভীর। কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। চারজন ছেলে এসে বললো,
‘ পিংক কালার শার্ট আর রেড কালার টি শার্ট পড়া ছিলো স্যার। ধরতে পারিনি। চিনতেও পারিনি। ‘
তানভীর মাথা ঝুমালো। পিয়নকে বললো, ‘ আমার চেয়ারের উপর টাওয়েল আছে নিয়ে আসো। ‘ পিয়ন আদেশ পেতেই ছুটে গিয়ে টাওয়েল নিয়ে এলো। তানভীর লাবিবার উপর বড় টাওয়েল টা দিয়ে দিলো। মাথাটাও কাভার করে মুখটা খোলা রাখলো। পিয়নকে গাড়ির চাবিটা হাতে দিলো। ‘ গাড়িটা বের করে গেইটের মুখে নিয়ে রাখো আমি এক্ষুনি বের হবো। ‘
পিয়ন গাড়ি বের করে ফিরে এলো। তানভীর ভীড়টা চোখে অবজার্ব করলো।
‘ যাওয়ার রাস্তা করে দাও। ‘
পিয়ন সহ ডিপার্টমেন্ট গুলোর কেরানী ভিড় সরিয়ে রাস্তা করার বৃথা চেষ্টা করলো। তানভীর ছেলেগুলো কে বললো, ‘ সিসি ফুটেজ চেক করো। লোক দুটোকে দেখা গেলে ফুটেজ পাঠিয়ে দিবে আমাকে। ‘
লাবিবাকে কোলে করে সোজা ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো। ড্রাইভ করে সোজা কলেজ ক্যাম্পাস ছেড়ে নির্জন একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামালো। লাবিবাকে ফের বুকের মধ্যে টেনে নিলো। লাবিবা ব্যথা পেয়ে আহ! করে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে তানভীর ছেড়ে দিলো। চোখে চোখ রাখলো। মৃদু স্বরে ধমকালো, ‘ আমার জান বের করার জন্য তোর এতো তাড়া? বলেছিলাম না চোখে চোখে থাকবি? কথা কেনো শুনিশ না আমার একটা?’
লাবিবার চোখ থেকে পর পর জল গড়িয়ে পড়লো। তানভীরের সহ্য হলোনা। আবার নিজের দিকে টেনে নিলো। হাতের তালুতে গাল মুছে দিয়ে সেই গালেই ঠোঁট চেপে ধরলো। ছেড়ে আবার সারামুখে চুমু খেতে লাগলো। লাবিবা গোঙালো। ফিসফিসিয়ে জানালো,
‘ ঠিক আছি আমি। ‘
তানভীর শুনলো না। শুনলেও বুঝতে চাইলো না। প্রায় কেঁদে দিলো যেনো! দেখে বুঝা না গেলেও গলার স্বর ভেঙে গেলো।
‘ ঠিক নেই। একদম ঠিক নেই। আজ কিছু একটা হয়ে গেলে কি অবস্থা হতো? নিঃশ্বাস আটকে আটকে আসছিলো তোমার। ‘
এতো ব্যথার মাঝেও লাবিবা মুচকি হাসলো। মজার স্বরে বললো, ‘ এতো ভয় পাবার কি আছে?আমি একদম স্ট্রং আছি স্যার। জ্বর ছাড়া আর কিছুর সাধ্য নেই আমাকে কাবু করার। ‘
তানভীর সরল চোখে তাকালো। এতো ব্যথা পেয়েও বলছে জ্বর ছাড়া তাকে কাবু করার সাধ্য কারো নাই। তানভীর লাবিবাকে চেপে ধরল। মুখ এগিয়ে নিয়ে বললো,’ তোকে আমিইইইইই ‘ ।
লাবিবা চিৎকার করলো, ‘ আহ! খান সাহেব! না। না। ‘
মাথায় সিটি স্ক্যান করিয়ে নেওয়া হয়। রিপোর্ট দিবে বিকালের পর। তানভীর লাবিবাকে হাঁটতেই দিচ্ছে না। গাড়ি থেকে নেমেই কোলে করে হসপিটালে এখান থেকে ওখানে যাচ্ছে। টেস্ট করানোর আগে লাবিবাকে ইমার্জেন্সি কিছু মেডিসিন দিয়েছে। সেসব মেডিসিন নিয়ে লাবিবা হসপিটালেই রেস্ট নিচ্ছে। রিপোর্ট হাতে পেয়ে তারপর বাসায় যাবে। তানভীর এর ফাঁকেই সিসি ফুটেজ পেয়ে গেলো। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রোজীর এক্স হাজবেন্ড এবং দেবর কে। তানভীর এর ই মাঝে কিছু নিউজ কালেক্ট করে নিলো। যেখানে জানতে পারলো লাবিবার সাথে হওয়া ঝামেলার কথাটা। এতোবড়ো কথাটা লাবিবা তাকে বললো না? অথচ ইনজুরেড ঠিকি ছিলো। তানভীর ও তো চাপ দেয়নি।রাগে তানভীরের মাথা ফেটে যাচ্ছে। এখনি একটা খুন করতে না পারলে সে শান্ত হবে না। রাগে গজগজ করতে করতেই লাবিবাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ স্টেজের সামনে থেকে কোথায় গিয়েছিলে তুমি?’
লাবিবা ভয়ে ঢুক গিললো। মিনমিনিয়ে বললো,
‘ বাথরুমে গিয়েছিলাম। তারপর। তারপর বের হতেই আমাকে টেনে দেয়ালে ধাক্কা! ‘ বলতে বলতেই ফুঁপিয়ে উঠে লাবিবা। তানভীরের ক্রোধ আরো বেড়ে যায়। রেগে মেগে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। লাবিবা ভয় পেয়ে যায়। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটাবে। আটকাতে চায়। উঠে দাড়াতেই মাথা ঘুরে যায়। ঠায় বসে কাঁদতে থাকে লাবিবা। সাথে পার্স নেই ফোন নেই কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। নার্সের কাছে ফোন নিয়ে তামিমকে কল করে। তামিম তানভীরের রাগের কথা শুনে তেমন কোনো রিয়েকশন দেয় না। লাবিবা আহত হয়েছে এর উপর যেনো কোন কিছু না। রিপোর্ট পাওয়ার পর মেডিসিন সমেত লাবিবাকে নিয়ে বের হয় তামিম। তানভীর লাবিবাকে নিতেও আসেনা। তামিমের সামনে কান্নাকাটি করলে তামিম রিলাক্স হতে বলে।
‘ টেনশন নিও না। লোকটার জব চলে গেছে এখন পাগলা কুকুর হয়ে গেছে। তেমন ইনজুরি হয়নি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে । একটু ব্যথা সহ্য করে নাও।’
‘ উনি কোথায় গিয়েছেন তুমিও জানো না?’
‘ কুকুরের মস্তিষ্ক খোলাসা করতে। এসব তেমন কিছু না।রাতেই দেখতে পাবে তানভীরকে। অযথা কান্নাকাটি করে চোখের পানি নষ্ট করো না। ‘
মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়েছে লাবিবা। সারারাতেও ঘুম ভাঙেনি। সকালে চোখ মেলতেই দেখে তানভীর তাকিয়ে আছে তারদিকে। আধশোয়া হয়ে শুয়ে। লাবিবা অপলক তাকিয়ে রইলো। কথা বললো না। তানভীর গালে চুমু দিয়ে বললো, ‘ গুড মর্নিং জান। ‘
লাবিবা উঠে বসলো। একা একা বিছানা থেকে নামতে চাইলো। তানভীর তা হতে দিলো না। হাত ধরে নিয়ে
গেলো ওয়াশরুমে। কত যত্মের সাথে ফ্রেশ করিয়ে দিলো! যেনো কিছু ই হয়নি। লাবিবা অভিমানী হলো। প্রশ্ন করলো, ‘ কোথায় গিয়েছিলেন কাল আমাকে ফেলে?’
‘ আশেপাশেই। ‘
লাবিবার বিশ্বাস হলোনা। পরদিন যখন শ্বশুড়বাড়ির সবাই তাকে দেখতে এলো তখন ইসমাইলের সাথে তাদের কথপোকথন শুনতে পেলো।
‘ ছেলেটা কেমন আছে এখন?’
‘ বেশী ভালো না।হাত উপড়ে গেছে। মাঝবরাবর মাথা ফেটে গেছে। বেঁচে আছে এটাই বেশী। আমাদের বংশের ছেলেদের শরীরে আবার অনেক দয়া। ‘
‘ তানভীরকে এতো এগ্ৰেসিভ হতে নিষেধ করবেন বেয়াই সাহেব। ‘
ফিরোজ খান হাসতে হাসতে বলে, ‘ আরে কোনো চাপ নেই। আমার ছেলে! ভবিষ্যত লিডার বলে কথা!’
ইসমাইল মাথা ঝুমালো। দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এর জন্যই এই ছেলেকে তার পছন্দ না। যে কেউ লিডার হতে পারে না। নেতা মানুষ! লোকসম্মূখে যতই সচ্চরিত্রবান হোক ব্যাকগ্ৰাউন্ড সহ দুর্ধর্ষ হলে না হলে কেউ নিজের জায়গা ধরে রাখতে পারেনা। ফিরোজ খান ইসমাইলের মুখ দেখে আরেকবার হাসলেন। কাঁধ চাপড়ে বললেন,
‘ আমি বলেছিলাম না আপনার থেকে আপনার মেয়েকে আমার ছেলেই ভালো রাখতে পারবে? সেই দায়িত্ব চার বছর আগে থেকেই কাঁধে তুলে রেখেছে। আপনি হাত পা ছড়িয়ে আছেন নির্ভয়ে। তবু কেনো এতো অস্থিরতা?’
ইসমাইল কিছুক্ষন কথা বললেন না। মিনমিনিয়ে বললেন, ‘ ছেলেটা বেঁচে থাকলেই হয় । আর কিছু চাইছিনা। ‘
লাবিবা তানভীর কে খুঁজলো। তানভীর ছাদে আছে। সেও ছাদে গেলো। তানভীরের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আপনি আমাকে চার বছর আগে চিনতেন?’
‘ চিনতাম। ‘
‘ কিভাবে চিনতেন?’
‘ বন্ধুর বোন তাই। ‘
‘ ভাইয়া আপনার বন্ধু কিভাবে হলো?’
‘ আত্বীয় স্বজন বন্ধুর মতোই হয়। ‘
‘ কবে থেকে বন্ধু হলো?’
‘ যবে থেকে বন্ধুর বোন আমার হলো। ‘
‘ ক্লিয়ারলি বলুন। ‘
‘ তোমাকে অসুস্থ লাগছে। ‘
‘ আপনাকে এখন আমার সন্ডা পান্ডা মনে হচ্ছে। ‘
‘ আমি তাই। ‘
চলবে ___
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৫২)
তানভীর লাবিবার সন্দেহের লিস্টে যুক্ত হয়ে গেছে। মাথায় ভীষন প্রসার পড়ছে। তানভীরের মুখ থেকে কোন কিছু বের করা সম্ভব হবেনা। কিন্তু এখানে নিশ্চয় কোনো ঘাপলা আছে। তানভীরকে কতটুকুই চেনে! একসাথে থাকতে গেলে চেনা যায় কিছুটা। কিন্তু এই ব্যক্তি রাতে আসে সকালে যায় তাও কয়েকদিন পর পর। প্রতিদিন তাকে ধরা ছোঁয়ার সুযোগ কোথায়? লাবিবার টেনশন হচ্ছে। দুর্বল মস্তিষ্কে নানারকম কথা উঁকি দিচ্ছে। এ কয়দিনে তানভীরের সম্পর্কে লাবিবা ভেবেছিলো অনেকটায় আয়ত্ত করে নিয়েছে। সবটুকুই তো অন্যজনের আদৌলে। সব থেকে বেশি ইনফরমেশন পেয়েছে ফ্লোরার থেকে। কিন্তু সেটা কতটুকু! লাবিবার মস্তিষ্ক ঘুরে ফিরে একটা দিকেই যাচ্ছে। তানভীর কোনো খারাপ কাজের সাথে জড়িত নয়তো? কাঁদতে কাঁদতে তানভীরকে জিজ্ঞেস করলে তানভীর হেসে উড়িয়ে দেয়। অবাক হবার ভান করে।
‘ কেমন টাইপ খারাপ কাজ?’
‘ আপনাদের এমপি মন্ত্রী দের তো অনেক ক্ষমতা তাই না?’
‘ তো?’
‘ ক্ষমতাবান মানুষরা তো মারামারি কাটাকাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ‘
‘ আমাকে দেখেছো ব্যস্ত থাকতে?’
‘ তারা তো আন্ডার গ্ৰাউন্ডের_’
‘ স্টপ ইট। এতোদূর চলে গেছো? আমাকে দেখে কি তোমার তাই মনে হয়?’
‘ দেশের যতগুলো বড় বড় মাফিয়া ডিলার আছে তাদের এক দেখাতেই যে কেউ বলতে বাধ্য এদের থেকে সুদর্শন জ্যান্টলম্যান কোথায়ও নেই। ‘
লাবিবার কথায় তানভীর চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।
‘ কয়জন মাফিয়ার সাথে যোগাযোগ আছে তোমার?’
লাবিবা চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। সর্বনাশ কান্ডকারখানা! তানভীর হাত ধরে ঝাঁকি দেয়। ধমক দিতেই লাবিবা ঠোঁট ভেঙে ফেলে।
‘ আপনার যতজনের সাথে যোগাযোগ। ‘
‘ তাঁদের নাম্বার পেলে কোথায়?’
‘ আপনার ফোন থেকে। ‘
‘ ইনভেস্টিগেশন !’
‘ পাপা,আপনার সাথে ফ্রেন্ডশীপ কিভাবে হতে পারে উনাদের?’
তানভীরের দৃষ্টি শান্ত। কপালে ফুটে উঠে কয়েকটা ভাঁজ। লাবিবা মাথা নিচু করে আছে। এরপর তানভীর তাকে কি বলবে সে জানে না। আশানুরূপ কোনো রিয়েক্ট ই তানভীর করলোনা। লাবিবাকে দু হাতে আগলে নিলো।
‘ ঝামেলার গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই কেমন? আপাতত শুধু আমার গভীরে কখন ডুব দিবে সেই প্রহর গুনো।
‘ আপনাকে নিয়েই তো আমার যত চিন্তা। ‘
‘ দলের কাজের জন্য তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে হয়। তোমার শ্বশুর এক লয়্যাল নেতা। আমি তার ডান হাত। জাস্ট এটুকুই। আর কিচ্ছু না। শ্রীঘ্রই তোমাকে আমার অন্দরে নিয়ে যেতে চাই লাবিবা। যদি আমায় চাও আমার মমের সাথে থাকবে। তার থেকে তোমার অনেক কিছু শেখার আছে। ‘
‘ ফ্লোরা আপু আমাকে একটা কথা বলতো জানেন?’
‘ কি?’
‘ আপনি অনেক বড় একজন খেলোয়াড়। ‘
‘ লাবিবা তুমি আমার বউ। আমার জান। তোমার কথা শুধু প্রেমের কথা হওয়া চাই অন্য কোনো বিষয়ে না। ‘
‘ আমাকে খোলাশা করুন প্লিজ। আপনার প্রত্যেকটা গতি আমাকে জানতে হবে। আপনার সব বিষয়ে আমার নজর থাকতে হবে। আপনার আচরণ সম্পর্কে আমার পূর্বেই ধারণা করে নিতে হবে। নয়তো কেমন স্ত্রী আমি? আমি অনান্য স্ত্রীদের মতো হতে চাই। আপনার মতো চাই যেভাবে আপনি আমাকে বুঝেন আমাকে আগলে রাখেন। এইযে আমার এতো অস্থিরতা আপনি কেনো বোঝেন না আমার কষ্ট হয়। আপনাকে আমি আর চারপাচটা মেয়ের মতোই অবজার্ব করতে চাই। আমাকে ধাঁধায় ফেলে রেখেছেন। আমি এর থেকে বের হতে চাই।
– কি জানতে চাও তুমি?
– আমি একজন কলেজের প্রিন্সিপাল। এ এলাকার এমপির ছোট ছেলে। আর কিছু?
– মেয়র প্রার্থী।
– সেটা আপাতত হচ্ছে না। আমি অলরেডি নিজের পেশায় বিজি।
– আপনার পর আপনার জায়গায় কে বসবে খান সাহেব?
– অফকোর্স আমার ছেলে।
তানভীর সরাসরি লাবিবার চোখে তাকায়। লাবিবার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখ ঘোলাটে। তানভীর চোখ সরিয়ে নেয়। দূরদৃষ্টিতে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘ ভাইয়ার ছেলে। বিয়েটা হোক। অতি শীঘ্রই খান বংশের উত্তরসূরী আসবে। ‘
‘ তাহলে আমাকে কেনো বিয়ে করলেন খান সাহেব? আমাদের ফিউচার কি হবে?’
‘ সেটা সময় ই বলে দিবে। ‘
লাবিবা বিন্দু মাত্র শান্তি পাচ্ছে না। মেডিসিন দিয়ে গেছে সাবিনা। সেটাও ভুলে গেছে। মাথায় তীব্র ব্যাথা বুকে আকাশসম হা হা কার। দুইয়ে মিলে একদিনেই মুখটা শুকিয়ে গেছে। অপেক্ষাকৃত বেশি অসুস্থ দেখায় তাকে। সাবিনা এসে জানালো, ‘ তোমার জন্য বিয়েটা পিছিয়ে গেলো। এই শুক্রবার হচ্ছেনা। পরের শুক্রবার হবে। প্রথমে সবাই গাই গুই করলেও রোজী যেই বললো তেমনি সেই সবাই মেনে নিলো। বড্ড ভালো মেয়েটা। তোমার কথা ভাবে। ‘
‘ রোজী আপুকে একটু আসতে বলো আম্মু। তার সাথে কথা আছে। ‘
‘ আচ্ছা বলে দিচ্ছি। ‘
‘ তোমাদের জামাই ফোন দিয়েছিলো?’
‘ নাতো। কেনো তোমাকে ফোন দেই নি? ‘
‘ নাহ। ‘
‘ ঝগড়া করেছো লাবিমা? পরশু রাতে যখন চলে গেলো দেখলাম একদম শান্ত। প্রতিবার আমাকে বলে তারপর গাড়িতে উঠে। এবার তো কিছু বললো না। ‘
‘ ঝগড়া করেছি আম্মু। মাঝে মাঝে ঝগড়া করা ভালো। এতে টান বাড়ে। ‘
‘ ছেলেটা আসেই কিছুক্ষনের জন্য এরমধ্যে ঝগড়া করো কেনো বলতো? তুমি তো অবুঝ না। মিলেমিশে চলবে বুঝলে। ছেলেরা বাইরে কত ঝামেলা পোহিয়ে আসে! বউয়ের কাছে আসে শান্তির খোঁজে। সেই যখন ঝগড়া করে তখন কার ভালো লাগে?’
লাবিবা উত্তর দেয়না। বিরবিরিয়ে বলে, ‘ তুমি বুঝবেনা আম্মু, তুমি বুঝবেনা। ‘
সাবিনা উঠে যায় রোজীকে ফোন দিতে। লাবিবা হুট করেই পিছু ডাকে, ‘ আম্মু তুমি কি আগে থেকে তোমাদের জামাইকে চিনতে?’
‘ তো চিনবো না? তানভীরকে কে না চিনে!’
‘ তাহলে আমি কেনো চিনিনা?’
‘ কি বলো? তুমিও তো চেনো। হয়তো খেয়াল করো নি। বেশ কয়েকবার কবিরের সাথে তোমার বড়কাকার বাসায় এলো না? সেখানেই তো ছেলেটাকে আমার বেশ লেগেছে। মনে মনে আশাও করে বসছিলাম এমন চাঁদের মতো ছেলে যেনো আমার জামাতা হয়। তোমার কাকা তো ঝোঁকের বসে তোমার আব্বুকে নিয়ে প্রস্তাবও দিয়ে বসেছিলো। উনারা রিজেক্ট করে দেয় সাথে সাথে। আমারো রাগ হয়। তোমার আব্বুকে কতো বকা ঝকা করলাম এরকম পাগলামির জন্য। তুমি কিছুই জানোনা। তখন তুমি মাত্র ইন্টারে। ওতো ছোট মেয়ে আমি বিয়েও দিতাম না। তারপর তো কলেজে ভর্তি হয়েই দেখলে।’
লাবিবার পাগল হবার উপায়। কিসব বললো আম্মু? বিয়ের সমন্ধ! রিজেক্ট! চার বছর পর তাকেই বিয়ে! হেল্প করা! ঘটকালি করা! ইগনোর! আচমকা ভালোবাসা। আর চাপ নিতে পারলো না লাবিবা। বেহুসের মতো পড়ে রইলো। এই প্রথম অন্য কারণে তার জ্বর হলো। ভীষন জ্বর। রোজী এসে লাবিবার মাথায় জলপট্টি লাগিয়ে বসে রইলো। সন্ধ্যে হলে সাবিনা নিজে রোজীর বাবাকে ফোন করে রোজীর থেকে যাওয়ার জন্য অনুমতি নিলো। রোজীর ও ইচ্ছে করছিলো না লাবিবাকে ছেড়ে যেতে। লাবিবা রোজীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রোজীর নরম মনে অদ্ভুত এক টান ফিল হয় লাবিবার জন্যে। যেনো কতো আপন! লাবিবাকে আপন ভাবার স্পেসিফিক কোন কারণ কেউ দেখাতে পারবেনা। কিন্তু বাধ্যতামূলক যেনো টান ফিল করবে। মেয়েটার মধ্যে বিশেষ একটি শক্তি আছে।
লাবিবা রোজীর দিকে নিভু নিভু চোখে তাকায়। ধীরে গলায় বলে, ‘ ওকে ডাকো। ‘
‘ কাকে? তানভীর কে?’
‘ ডাকো। ‘
‘ তানভীর তো আজ সকালে চট্টগ্ৰাম গিয়েছে শিপমেন্টে কি একটা প্রবলেম হয়েছে। উনাদের ব্যবসা সংক্রান্ত ডাক্তারসাহেব বলছিলো। ‘
লাবিবা অনেক কষ্টে মৃদু হাসলো।
‘ আর কি কি বলে তোমার ডাক্তারসাহেব?’
‘ তানভীরের সম্পর্কে?’
‘ হুম। ‘
‘ তেমন কিছু না। এই এমনিই যা। ‘
‘ রোজী আপু। আমি তো তোমাকে কতো হেল্প করি। তুমি আমাকে একটা হেল্প করো না।’
‘ কি হেল্প করবো?’
‘ একটা সলুশন দাও। ঠিক সলুশন ও না। পথ দেখাও। ‘
রোজীর মুখটা হা হয়ে যায়। ঝটপটিয়ে বলে,
‘ আমিই তো তোমার কাছে পথ দেখিয়ে চাই। আমি কিভাবে পথ দেখাবো?’
‘ ইজি। তুমি পারবে। ‘
‘ আমার বিয়েটা একটা ধাঁধা আমার কাছে। তানভীর খান নিজেই এক ধাঁধা আমার কাছে। আমার আশেপাশে অনেক ক্লু। কিন্তু আমি মেলাতে পারছি না। আমি এমন একটা সম্পর্কে আছি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছি না। এতে নিজের ই লজ্জা। তুমি আমার খুব কাছের মানুষ। তাই তোমাকে বলছি। আমি আমার হাজব্যান্ড কে পুরোপুরি চিনি না। আমি এটাও বলছি চিনতেও চাইনা। এইযে তুমি বললে তাঁদের বিজনেস। আমি এই সম্পর্কেও জানতাম না। আমি আসলে ধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। ‘
‘ তানভীর ভাই তোমাকে অনেক ভালোবাসে লাবিবা। ‘
‘ সেটা তুমি বুঝবেনা। বউ বলে ঠেকে গেছে। ভালোতোবাসতেই হবে। ‘
‘ তুমিও কি একি কারণেই ভালোবাসো লাবিবা?’
লাবিবা মাথা নাড়ায়।
‘ তাহলে বিয়ের আগে থেকেই ভালোবাসো?’
‘ ঐ ছিলো কিছু একটা। ‘
‘ ক্রাশ?’
রোজী হাসে। লাবিবার মাথায় হাত বুলায়।
‘ চিন্তা করে দেখো লাবিবা তোমার বিয়ের সাক্ষী এমন কে আছে যে তোমাকে দ্বিধামুক্ত করতে পারবে। পুরোপুরি না পারুক একটু তো পারবে। ‘
‘ তোমার দেবর কেনো পারে না?’
‘ হয়তো তার কোথাও একটা বাঁধে। বা সে কিছুটা সাঁই ফিল করে। তুমি ও জানোনা আমিও জানিনা। সেজন্যই সাক্ষীর হেল্প নেওয়া। ‘
লাবিবা কিছুক্ষন চুপ চাপ ভাবে। হটাৎ তার মনে পড়ে কবিরের কথা। কবির তাকে বলেছিলো কয়েকবছর আগেই বিয়ের কথা। কেনো তাকে রিজেক্ট করা হয়েছিলো সেটা কবির জানে। আর কেনো তাকে বিয়ে করা হলো এটাও কবির জানে। কবির ই একমাত্র জানে পুরোটা।
‘ রোজী আপু। আমার ভাইয়া জানে ব্যপারটা। কিন্তু ভাইয়া তো দেশে নেই। মিশনে গেছে। কবে আসবে জানি না। ‘
‘ তাহলে সে পর্যন্ত ওয়েট করো। তানভীর ভাই তোমাকে ভালোবাসে লাবিবা। তোমার জন্য আমি তাকে অস্থির হয়ে উঠতে দেখেছি। এতো পাগল! তার সাথে কথা না হলে তুমি ফোন দাও। কথা বলো। তোমার বিয়েতে যদি কোনো ইস্যু থেকেও থাকে সেটা এখন জানলেও যা না জানলেও তা। বিয়ে হয়ে গেছে। তাছাড়া ভাইয়াই তোমাকে বলবে দেখো। সব সময় তার কাছে থাকো দেখবে কথায় কথায় বলে দিবে। সেসব চিন্তা মাথায় নিয়ে নিজেকে পেইন দিও না। তোমার ভাইয়া আসলে এমনিতেও সব জানতে পারবে। তাই বলে কি তুমি ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করবে?’
‘ ঝগড়া করিনি গো। ‘
‘ আন্টি আমাকে বলেছেন। তানভীর ভাই মন খারাপ করে চলে গেছেন। তার সাথে কথা বলো। খামখা এতো চিন্তা করো না। ‘
লাবিবা দু হাত বুকে চেপে ধরে। মনে মনে বলে, ‘ উনার মন খারাপ হবার কারণটাই তো আমার বড় চিন্তা। ভবিষ্যত নিয়ে কেনো এই কথা উনার? মনে মনে কি পরিকল্পনা?’
#ভালোবাসার_কাব্য_গাঁথবো
(৫৩)
রোজীকে বাসায় ড্রপ করে দেবার জন্য এসেছে তামিম।তামিমের সাথে এসেছেন সোহানা ইসলাম। বসার ঘরে বসতেই সাবিনা নাস্তা নিয়ে আসে। রোজী তামিমের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাবিনা রোজীকে বলে, ‘ তুমিও বসো মা। ব্রেকফাস্ট করে নাও। ‘
‘ লাবিবা আসুক।’
‘ তুমি বসো। ওকে নিয়ে আসছি আমি। ‘
সাবিনার সাথে সোহানা চলে গেলো। রোজী সোফার এক কোনায় বসে। তামিম বলে , ‘ আমি ব্রেকফাস্ট করেই বের হয়েছি। তুমি এখনো করোনি! মাত্র ঘুম ভাঙলো? ‘
রোজী বললোনা। আসলে তারা তো ঘুমায়ই নি। সারারাত বসে কাটিয়েছে গল্প করে। এড়িয়ে গেলো। মিনমিনিয়ে বললো, ‘ আমি চলে যেতাম। আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেনো?’
‘ তুমি মনে হয় এখনো আমার সাথে ইজি হতে পারোনি। এটা ঠিক নয় রোজী। ‘
রোজী মুচকি হাসি দিলো। ইজি হওয়া! এতো সহজ?চেষ্টার তো অন্ত নেই। লাবিবা এসে বসলো। তামিমের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলো। তামিম আহত দৃষ্টি ফেললো। আফসোসের সুরে বললো,
‘ লাব্বু মন খারাপ কেনো?তানভীর নেটওয়ার্কের একটু বাইরে আছে। কালই রওনা হবে। ‘
‘ সেজন্য মন খারাপ না ভাইয়া। একটা কথায় একটু কেমন যেনো লাগছে। ঐ যে থাকে না? আনএক্সপেক্টেড! যে বিষয়ের বিপরীতে চলেছে সব। ‘
‘ কি কথা? খুলে বলো। ‘
‘ আমি শুরু থেকেই দেখে আসছি আমার জন্য অনেক ছেলে পাগল। সব ছেলেকেই যে পাগল হতে হবে এমনটা বলছিনা। আসলে অভ্যস্ত তো! আমাকে অনেকেই ইগনোর করতে পারে। কিন্তু কেউ একজন ইগনোর করে আবার আমাকেই চায় ব্যপারটা কেমন না? ‘
তামিম ব্যপারটা বুঝতে পারে। কোন মেয়েই ইগনোর ব্যপারটা মেনে নিতে পারেনা। সে যেমন ই হোক না কেনো।
‘ হয়তো সে প্রথমে তোমাকে দেখেনি। চেনেও না।পরে চিনতে পেরেছে। ‘
‘ তেমনটাও না। উনি আমাকে প্রথম থেকেই চেনেন। আশ্চর্য বিষয় আমিই তাকে চিনতাম না। খেয়াল ই করিনি উনাকে। ‘
‘ এরজন্য মন খারাপ করতে হয়না। হতে পারে কিছু একটা।আমি তুমি তো আর জানিনা। ‘
‘ তুমি জানতেও পারো ভাইয়া। জিজ্ঞেস ই তো করতে পারছি না। বোকামো করা হয়ে যাবে না? উনি তো এমনিতেই আমার প্রতি নারাজ। এতো ধাঁধায় কেনো রাখে আমাকে? আমি একবার এই ধাঁধা থেকে বের হই আর কখনো কোনো বিষয় মাথায় তুলবোনা। ‘
মনে মনে বলে ব্রেডে কামড় বসায় লাবিবা। সাবিনার সাথে সোহানা আসে কিচেন থেকে। লাবিবাকে দেখে ভীষণ আহত হয়। অস্থির কন্ঠে বলে, ‘ এসব কি লাবিবা? এই অবস্থা কেনো? শরীরের কি হাল করেছো মা? ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছো না। সামনে বিয়ে আছে বাড়িতে তাড়াতাড়ি সুস্থ না হলে চলবে?’
তামিম হেসে বলে, ‘ আমাদের বাসায় নিয়ে চলো। নয়তো শরীর ঠিক হবেনা। ‘
‘ তাড়াতাড়ি ই নিয়ে যাবো। এবার তোমার পাপার কোনো কথাই আমি শুনবোনা দেখো। তোমার বিয়ে টা হয়ে যাক। ‘
‘ দুই পুত্রবধূ একসাথেই ঘরে তুলো মম। আর অপেক্ষা করাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। তোমরাও না বেশ বোকা।’
সোহানা রাগে ফুসফুস করে বলে, ‘ আমার কথা তো শুনতেই চাইনা। পাছে লোকে কিছু বলবে বলে আমাকে দমিয়ে রেখেছে। ‘
‘ এখন তো আরো বেশী বেশী বলছে। কলেজে যে ব্যাপারটা হলো! সবাইকে এবার জানানো উচিত যে লাবিবা আমাদের বাড়ির বউ। ‘
সোহানা ইসলাম সাবিনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। সাবিনা সায় দিলেন। বললেন, ‘ আমারো সেই মত। বেয়াই সাহেবকে বলুন। উনিই পারবেন আপনার বেয়াইকে রাজি করাতে। ‘
সন্ধ্যে বেলা ইসমাইলকে ডেকে নেওয়া হলো। ইসমাইল ফিরলো রাত এগারোটার দিকে। ফিরেই জানালো, ‘আগামী শুক্রবার দুটো বিয়ে। একসাথে।মেয়েকে এবার পরের ঘরে দিয়ে দিতেই হবে। আমি আমার মেয়েটাকে না দেখে থাকবো কি করে?’ বলতে বলতেই হো হো করে কেঁদে উঠে। সাবিনার চোখ ভরে আসে। আঁচলে চোখ মুছে স্বামীকে শান্ততা দেয়, ‘ মেয়ে হয়ে জম্মেছে পরের ঘরে তো যেতেই হবে। বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখে মেয়েটাকে তুলে দেবার আয়োজন করো। একটাই মেয়ে আমার। স্বামী সোহাগী হোক। সুখে থাকুক। দোয়া ছাড়া আর কি করতে পারি?’
‘ আমার ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাবে সাবিনা। আমি ঘরে ফেরার সময় কার জন্য মালাই নিয়ে আসবো? কে আমাকে ফোন করে বলবে আব্বু আসার সময় আইসক্রিম নিয়ে এসো। কে দৌড়ে এসে টাকা চাইবে? আমাকে ছাড়া কলেজ যাবেনা হুট হাট বায়না ধরবে। আমি কি নিয়ে থাকবো সাবিনা? আমার কলিজাটাকে তো ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। ‘
কান্নার শব্দে লাবিবা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। কে কাঁদছে বুঝতে পারে না। পুরুষ মানুষের কান্না স্বর। বাড়িতে একজন ই পুরুষ মাত্র। আব্বু তো কোনদিন কাঁদে না। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে লাবিবা দৌড়ে আসে। ইসমাইল দুহাতে মুখ চেপে বসে কাঁদছে। লাবিবা গিয়ে আতঙ্কে জিজ্ঞেস করে, ‘ আব্বু কাঁদছো কেনো? আব্বু কি হয়েছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে? আবার বুকে কষ্ট হচ্ছে? হসপিটালে নিয়ে যাবো? আব্বু?’
ইসমাইল মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাদেঁ। সাবিনা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গুনগুন করে কাঁদছে। লাবিবা হাঁসফাঁস করে। বাবা মার কান্নায় সেও কাঁদতে থাকে। কিন্তু তিনজন মিলে কেনো কাঁদছে লাবিবা জানে না। লাবিবা ঠিক থাকতে পারেনা। ছটফটানি বাড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ আব্বু তোমার কি হয়েছে? আব্বু তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’ ইসমাইল বুঝতে পারে তার মেয়ের বুকে ভয় জেঁকে বসেছে তাকে নিয়ে। ধীরে ধীরে ইসমাইল কান্না বন্ধ করে। লাবিবাকে বলে, ‘ আব্বুর কাছে থাকো। আব্বুর সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। ‘ লাবিবা আর নিজের ঘরে ফিরে যায়না। বাবা মেয়ে নিঃশব্দে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে বসে বসে কাঁদে। সাবিনা বিছানা পাতে। ওদের শোয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল সকাল কবীরের ফোন।
‘ কিরে লাব্বু? তোর নাকি বিয়ে? ভাবলাম কাজ বাজ শেষ। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে পার্টনারদের পাঠিয়ে কলকাতার শহরের একটু হাওয়া লাগাবো গায়ে। মজ মাস্তি করবো তোর ভাবী সাথে নেই বলে। আর তোর জন্য এখন আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। ‘
‘ তাড়াতাড়ি আসো ভাইয়া। আমি অপেক্ষা করছি সেই কবে থেকে। ‘
‘ কি কি লাগবে বল। নিয়ে যাই। তোর বিয়ের শপিং তো আমাকেই করে নিয়ে যেতে হবে। তানভীর হাতে একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। সুযোগ কুড়াচ্ছে বুঝলি। বোনটাকেও দিলাম। এবার বিয়ের শপিং ও করে দিবো। তোর ভাইয়ের এতো টাকা নেই বুঝলি! নয়তো শপিং এর টাকাটাও আমি দিতাম। ‘
‘ বোনটাকে কেনো দিলে ভাইয়া?’
‘ ওরেব্বাস! উপায় ছিলো! উগান্ডায় কিক মারতো না!’
‘ বাসায় ফিরো ভাইয়া। তোমার সাথে আমার ইমপর্টেন্ট কথা আছে। ভাবী কিছু বলেনি তোমাকে?’
কবিরের মুখটা ছোট হয়ে যায় । থমথমে গলায় বলে,
‘ কাল ই ফিরছি। তোদের মাঝে এতো কিসের প্রবলেম সেটাই সলভ করবো এবার। ‘
দুই দুটো ট্রলি ব্যাগ নিয়ে কবির হাজির হয়েছে একদিন পরই। এদিকে ফিরোজ খান রওনা করেছে বন্দরের উদ্দ্যেশে। বড় সড় একটা ঝামেলা হয়েছে। সরকারি লোক ছাড়া পসিবল নয়। সবাই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র সোহানা ইসলামকে দেখে বোঝা যায় উনি টেনশনে আছে। এরই মাঝে উনি লাবিবাকে বাড়ি বয়ে এসে দেখে যাচ্ছে। টেনশন কি জিনিস এবার লাবিবা বুঝতে পারে। সোহানা ইসলাম এবং তার দুজনের স্বামীই যে বাইরে! কবির লাবিবার বাসায় ট্রলি ব্যাগ দিতে আসে।লাবিবার রুমে গিয়ে বসে ভ্রু নাচায়।
‘ কি খবর তোর? বাহ! সুন্দর লাগছে। ফাটা মাথা নিয়ে এই প্রথম কোনো কনে বিয়ের পিঁড়িতে বসছে। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না? ‘
লাবিবা কপট রাগ দেখিয়ে তাকালো। বাইরে দেখে হালকা পাতলা শোরগোল শোনা যাচ্ছে। ভ্যানের আওয়াজ কানে আসে। লাবিবা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘ বাইরে কি হচ্ছে?’
‘ তোর বিয়ের গেট সাজানো হচ্ছে। ‘
‘ আজকে থেকেই ডেকোরেশন শুরু হয়েছে? ভাইয়া উনার সাথে তোমার কথা হয়েছে? ‘
‘ না। কেনো?’
‘ তুমি যে বললে লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। ‘
‘ মেইল সেন্ড করেছে। ফোন দেই নি। তানভীর আসুক এবার। দুটোকে একসাথে বসাবো তারপর দেখি কার কোথায় প্রবলেম আছে। সব সলভ করবো। ‘
‘ সেসব করতে হবেনা। তুমি শুধু আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তাহলেই সব প্রব্লেম সলভ হয়ে যাবে।’
‘ কি প্রশ্ন?’
‘ তানভীর খান তোমার ফ্রেন্ড হলো কিভাবে? না উনি তোমার সাথে পড়াশুনা করেছেন না পাশাপাশি এলাকা আর না তোমাদের আড্ডা চলতো । ‘
‘ ঐ তো হুটহাট কিভাবে যেনো হয়ে গেলো । ‘
বলেই কবির হাসতে লাগলো। লাবিবার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো। কবির হাঁসি থামায় কষ্টে। নয়তো এখনই যমুনার বাঁধ ভাঙবে। লাবিবার গাল টিপে দিয়ে বলে, ‘ এমপির ছেলে সারাবছর বিদেশে পড়াশুনা করেছে। সে কিভাবে আমার ফ্রেন্ড হবে? তার ফ্রেন্ডের কি অভাব পড়েছে? আমরা পুলিশের লোক তাঁদের কথায় উঠি বসি। সম্পর্কটা এখান থেকেই শুরু। আর কারণটা অবশ্যই তুই। ‘
‘ কিভাবে?’
‘ তানভীরের সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপের সম্পর্ক নেই। আমাদের শুরু থেকেই সমন্ধি বোন-জামাইয়ের সম্পর্ক। বলতে পারিস তোর প্রতি আসক্তি থেকেই আমার সাথে উঠা বসা। ‘
লাবিবা কবিরের কথা শুনে এলোমেলো হয়ে যায়। অবাকতা ছাড়িয়ে প্রশ্ন রাখে,
‘ তাহলে সবটাই কি পূর্ব পরিকল্পনা?’
‘ অনেক টা তেমনি আবার না ও। পরিস্থিতির সৃষ্টি সবটা। ‘
লাবিবা বালিশে মাথা রাখে। মাথা ব্যথা করছে তার। চিন চিন ব্যাথা। এতোদিন তার সাথে যা হয়েছে সবটাই নাটকীয় মনে হচ্ছে। তার এতো অস্থিরতা এতো চেষ্টা সব কিছুই বৃথা। কবির লাবিবার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। পাগলামো গুলো তো তার সামনেই হয়েছে। বোনকে আর আঁধারে রাখতে চায়না। দিনের বেলা লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে রুমে। লাইট অফ করে দিয়ে জানালার পর্দা খুলে দেয়। ছিটা ছিটা রোদের আলোতে রুমটা ভরে যায়। লাবিবার শিয়রে বসে কবির লাবিবার মাথাটা কোলের উপর তুলে নেয়। চুলে হাত বুলায়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে।
‘ সদরের থানায় প্রথম যখন ট্রান্সফার হয়ে আসি তখন একটা কেস নিয়ে তানভীর খানের সাথে আমার প্রথম কথা হয়। তোর হয়তো মনে নেই। এস এস সি দিয়েছিস মাত্র। ডিউটি চলা কালে রাস্তায় আমাকে দেখে তুই কাকার পাশ থেকে দৌড়ে চলে এসেছিলি। বায়না ধরেছিলি তোর সাথে বাড়ি ফিরতে। এতো বড় মেয়ে হয়েও তোর বায়না আমার মেয়ের মতো। তখন তোকে আইসক্রিম কিনে হাতে দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাকার সাথে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। তখন আমি সাধারণত পুলিশ। রিটেন ভাইভা দেবার পরেও এস আই এর পদটা নিয়েছি টাকা দিয়ে। সে সময় মন্ত্রীর ধারস্থ হই। ফিরোজ খান তখন ভূমি মন্ত্রী। সেসময়ে আমাকে হেল্পটা করেছিলো তানভীর। আমার পদটা পাবার পর বলেছিলো আমি যদি সরাসরি তাকে জানাতাম তাহলে আমার এক টাকাও দিতে হতো না। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সময় আমার কৃতজ্ঞতা গ্ৰহণ করেন না। সরাসরি বলে বসেন আপন মানুষ হয়ে যাও। আমি এই আপন মানুষের হবার কোনো কারণ বা পথ খোঁজে পাই না। তখন তানভীর ই আমাকে জানায় ভবিষ্যতে আমি তার আপনজন হতে চলছি। এরপর থেকেই তার সাথে উঠা বসা। সেই থেকেই একদিন জানতে পারি আমার বোনের দিকে তার চোখ পড়েছে। বিষয়টা আমার কাছে এস আই এর পদটা থেকেও বড় অনুভব হলো। আমি এই সুযোগ মিস করতে চাইলাম না। একবার মন ঘুরে গেলে তারপর আর চাঁদে হাত বাড়ানো পসিবল হবেনা। বাবার মাধ্যমে কাকাকে কোনভাবে রাজী করালাম। প্রস্তাব দিয়ে বসলাম। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজি হলেন না সেই বাড়ির লোকজন। ফিরোজ খান বিভিন্ন রিজন দেখিয়ে দিলো। মেয়ে অনেক ছোট । তানভীরের ও কোনো আগ্ৰহ দেখা গেলো না। প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমি তানভীরের সাথে উঠা বসা কমিয়ে দিলাম। নিজেই আগ্ৰহ প্রকাশ করে নিজেই আমার বোনকে রিজেক্ট করে বিষয়টা আমাকে জানানোর আগে তার আরেকবার ভাবার উচিৎ ছিলো। ততোদিনে তানভীরের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে আমার। না চাইতেও কষ্ট অনুভব করলাম। কিন্তু কাকার মাঝে কোনো কষ্ট দেখা গেলোনা। কাকা এমনিতেও তোকে বিয়ে দিতে চায়না। অনেক কষ্ট করে রাজি করানো হয়েছিলো জন্য ই খান বাড়িতে প্রস্তাব রেখেছিলো। কয়েকমাস পর হটাৎ একদিন তানভীর নিজে থেকে আমাকে ফোন করে। আমাকে বলে, ‘ তোর বোনের সাথে ছেলেটাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। এটাকে দূর কর। তোর বোন আজ হোক কাল হোক শুধু আমারই বউ হবে। অন্য কারো না। ‘
তোর মোফাজ্জল মামার ছেলেটাকে যে তখন আত্বীয়ের দোহায় দিয়ে তোর সাথে বাঁধতে চাইছিলেন তোর মনে আছে? আমি তখন রেগে ফেটে পড়ি। তানভীরকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি সে এখনো কেনো তোর পেছন ছাড়েনি? সে কি চায়? সে আমাকে জানালো তোকে চায়। তোর পড়াশোনা শেষ হওয়া অব্দি অপেক্ষা করতে চায়। আমি যেনো কাকাকে রাজি করিয়ে নিই। আমার পক্ষে এটা তখন অসম্ভব। কাকাকে রাজি করানোর চেষ্টা বাধ্য হয়ে করি। কিন্তু কাকা আর রাজি হয়না। বরং আমাকে বলে যখন রিজেক্ট করেছে তখন ঐ ফ্যামিলিতে মেয়ে বিয়ে দিবোনা। কাকার কথায় আমারো তাই মনে হয়। তোকেই যেহেতু লাগবে তখন রিজেক্ট করে দিলো কেনো? তানভীরের সাথে আমার দ্বন্দ সৃষ্টি হয়। কিন্তু তখনো আমার অনেক কিছুই অজানা। ‘
চলবে ___