#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৩০
#রাউফুন
রৌফ সুলতান দুপুরে খাবার খেয়ে অনেক প্রসংশা করলেন তুলিকার। এরকম রান্না খেয়ে ভীষণ ইমোশনাল হয়ে গেছিলেন তিনি। তার প্রথম স্ত্রীর মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কিভাবে একটা মানুষকে দিনের পর দিন তিনি ঠকিয়ে গেছেন। অথচ আসমা সিদ্দিকা সব জেনেও চুপচাপ ছিলেন তার মায়ের ভয়ে। আর অন্য দিকে শাপলা সেই সুযোগ নিয়ে তার ব্রেইন ওয়াশ করে গেছে যে আসমা, তার মাকে ভীষণ ভাবে জ্বালাতন করেন। খেতে দেই না। বুড়ি বুড়ি বলে লাথি -ঝে’টা পে’টা করে। নিজের মায়ের সঙ্গে ওমন বা’জে আচরণ করে জানতে পেরে সে-সময় রৌফ সুলতানের ভালোবাসাও কমতে থাকে আসমা সিদ্দিকার উপর থেকে। কে সহ্য করবে নিজের জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে ওরা অবিচার। সেও পারেনি সইতে। তার মা ও এসে এটা সেটা বলতেন আসমার নামে,মায়ের কথায় অবিশ্বাস করার জায়গা তিনি পান নি।
সব মিলিয়ে আসমার প্রতি মনটা বিষিয়ে যায় দিন দিন। আর ধীরে ধীরে শাপলার প্রতি দুর্বল হয়ে পরেন। এক সময় আসমা সিদ্দিকা সবটা জানতে পারেন তার আর শাপলার অবৈধ সম্পর্কের কথা। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নেন তার থেকে। ধীরে ধীরে নিঃশ্বেষ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢেলে পরেন আসমা। আজ যখন রৌফ সুলতান তুলিকার হাতের রান্না খাচ্ছিলেন খুব, খুব মনে পরছিলো আসমার কথা। আসমার রান্নার হাতও এরকম সুন্দর ছিলো। কি ভীষণ ভালো রান্না করতেন আসমা। গাড়িতে যেতে যেতে তিনি নানান কথা ভেবে চললেন। নিজের ভেতরের অপরাধ বোধ কোনো ভাবেই কমছে না। নিজের ছেলের সঙ্গে অবিরাম, অন্তহীন অত্যাচার হয়েছে তার ছিটেফোঁটাও জানতে পারেন নি। নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন তিনি। নিজের স্ত্রীকে কিভাবে অবিশ্বাস করেছে অন্যের কথায়। কোনো রকম যাচাই বাছাই করার প্রয়োজন মনে করেন নি। আসমাও হইতো তার প্রতি তীব্র অভিমান থেকে কিছু বলেনি। বা ভয়ে কিছু বলার সাহস করেননি।
‘স্পাইনলেস! ইউ আর স্পাইনলেস রৌফ সুলতান। নিজের স্ত্রী,সন্তানের দায়িত্বের প্রতি অপরাগ তুই। তোর কোনো অধিকার নেই কারোর ভালোবাসা পাওয়ার।’ নিজের মনে কথা বলে কাঁন্নায় ভেঙে পরলেন রৌফ সুলতান।
•
মাইজিন কখন থেকে ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছে। এখনো বের হওয়ার নাম নেই। তুলিকা দরজায় ঠকঠক করলো।
‘মাইজিন দরজা খুলুন। কি করছেন ভেতরে?’
‘ওঁ আমাকে মা’র’বে! আমি যাবো না। যাবো না কোথাও!’
‘কে মা’র”বে? কি সব বলছেন? দেখি দরজা খুলুন!’
‘না, না তুমি মা’রবে আমি জানি! তুমি ভালো না। পঁচা মহিলা একটা!’
‘আমি? আমি কেন মা’র’বো? মাইজিন কি হয়েছে আপনার?’
এরপর কোনো উত্তর এলো না। বিচলিত হলো তুলিকা। এদিকে চিন্তায় মাথা ফে’টে যাওয়ার যোগাড়। আরও কিছুক্ষন পর মাইজিন বাইরে এলো। সে সম্পুর্ন স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে এলো। তুলিকা আশ্চর্যজনক ভাবে তাকিয়ে থাকে কিয়ৎক্ষন তার দিকে। তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে ভয়ে। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাইজিনকে। মাইজিন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
‘আল্লাহ্, আল্লাহ্, আল্লাহ্! আমি কি এখন একটু ওয়াশরুমেও যেতে পারবো না? আমার বউ আমাকে এতোটা চোখে হারাই?’
‘একটু আগে এসব কি আজেবাজে কথা বলছিলেন? আপনি আধ ঘন্টা থেকে ওয়াশরুমে ঢুকে বসে আছেন চিন্তা হবে না?’
‘কি বলছো এসব? আমি তো মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই ওয়াশরুমে গেলাম!’
আপনাআপনি তুলিকার ভ্রুদ্বয় কুচকে যায়। আচ্ছা সমস্যা টা কার? তার নাকি মাইজিনের? সে কি পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু সে তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মাইজিন হুট করেই অস্বাভাবিক আচরণ করছে আবার কয়েক মিনিটের মধ্যে স্বাভাবিকও হচ্ছে। কাল রিপোর্ট আনতে যেতে হবে মাইজিনের। তার ওমন চরম মাথা ব্যথার উৎস কি ছিলো জানতে হবে।
‘আঃ তুলিকা কাঁদছো কেন? আমার কিছু হয়েছে? হয়নি তো তাইনা? এই দেখো আমি একদম ফীট এন্ড ফাইন!’ মাইজিন তার চোখ মুছে দিলো।
রাত দুটো। মাইজিন লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে চিৎকার শুরু করে। তুলিকা হুরমুরিয়ে উঠে হাতড়ে লাইট জ্বালিয়ে দিলো।
‘আমি কি ম’রে গেছি? আমার শরীরে আত্মা নেই কেন? আমার আত্মা কই? আমি বোধহয় ম’রেই গেছি!’
মিষ্টি পাশের রুম থেকে ছুটে এসে মাইজিনের এমন পা’গ’লের প্রলাপ বকা দেখে ভয় পেয়ে যায়।
‘এই বুবুজান কি হয়েছে?’
‘দেখ না তোর মাইজিন ভাইয়া আবার পা’গ’লামি শুরু করেছে। কেমন ডেস্পারেট হয়ে গেছে। নাফিস ভাইকে কল করে ডাক!’
‘আমি, আমি, আমি মরলাম কেন? বেঁচে নেই কেন? তুমি,এই তুমি আমাকে মে’রে ফেলেছো? কু’চু’টে মহিলা!’
‘মাইজিন, মাইজিন আপনি শান্ত হোন৷ আপনার কিচ্ছুব হয়নি। আপনি একদম সুস্থ আছেন। এই দেখুন আমি আপনাকে ছুঁ’তে পারছি।’
মাইজিন অসম্ভব চ’টে যায়। একটা ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো নিজের হাত। তুলিকা তাল সামলাতে পারে না। মিষ্টি ভয়ে আঁতকে উঠলো। সে ছুটে গিয়ে নিজের বুবুজানকে আঁকড়ে ধরলো দুই হাতে।
‘আমাকে কেউ-ই টাচ্ করবে না। খবরদার কেউ না!’
মাইজিনের ওমন আক্রমনাত্মক অবস্থা দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেছে তারা। দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছে। তখনই কলিং বেল বাজে। মিষ্টি কোনো রকমে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অগোছালো নাফিস এক প্রকার হাঁপাচ্ছে। বোঝায় যাচ্ছে মিষ্টির মুখে মাইজিনের কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। তুলিকা দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে কাঁদছে। কাঁদছে মিষ্টিও।
‘নাফিস ভাই দেখুন না মাইজিন ভাইয়া কেমন করছে।’
নাফিস ভেতরে প্রবেশ করলো। দেখলো সবটা স্বাভাবিক।
‘মিষ্টি! সব তো ঠিকই আছে! মাইজিন ঘুমোচ্ছে!’
‘কি বলছেন এসব? দেখুন!’
তুলিকা আর মিষ্টি দুজনেই হতবাক, হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। যেনো ঝ’ড় থেমে গিয়ে সবটা শান্ত, নিস্তব্ধ! যেনো কিছুই হয়নি সব ঠিক ঠাক।
‘ভাবি কিছুই হয়নি। নিশ্চয়ই খুব খা’রাপ স্বপ্ন দেখছিলেন!’
‘উফফ নাফিস ভাই। এক সাথে আমরা দুজনেই স্বপ্ন দেখছিলাম? আপনি জানেন না একটু আগে মাইজিন ভাই কি রকম করছিলো। এখন উনাকে ঠিক যতটা শান্ত দেখাচ্ছে ঠিক ততটাই ভয়ংকর রকমের আচরণ করছিলেন তিনি!’
‘রিল্যাক্স মিষ্টি। কি হয়েছিলো সবটা খুলে বলুন তো ভাবি।’
‘আরে নাফিস? এতো রাতে তুই এখানে? রাত ক’টা বাজে সে খেয়াল আছে?’
মাইজিনের কন্ঠ পেয়ে নাফিস অপ্রস্তুত বনে যায়। আমতাআমতা করে। কিছু বলতে চেয়েও পারে না। কি বলবে সে? এতো রাতে এখানে কেন এসেছে এটা বললে যদি হিতে বিপরীত হয়!
‘তুই আসতেই পারিস কিন্তু সময় টা দেখবি তো নাকি?’ বললো মাইজিন।
‘আসলে, মানে তুই না-কি অসুস্থ তাই ভাবি ডেকেছিলেন! তোর জন্য চিন্তা করছিলো খুব।’
‘কিহ আমি অসুস্থ? আমাকে দেখে কি তোর অসুস্থ মনে হচ্ছে? এই দেখ আমি একদম সুস্থ আছি! তোর ভাবির আমাকে নিয়ে বেশিই চিন্তা। মাথাটা কি পুরোপুরি গেছে তোমার তুলিকা? এতো রাতে শুধু শুধুই নাফিসকে ডেকেছো!”
‘না, আসলে আপনি কেমন করছিলেন তাই ভয় পেয়ে গেছি!’
‘কেমন করছিলাম আমি?’
‘আপনি ভুলে গেলেন এর মধ্যেই?’
‘আরে কিছু হলে তো মনে রাখবো? মিষ্টি ঘুমোও নি কেন এখনো? যাও ঘুমাও। আর নাফিস যাহ তুইও গিয়ে ঘুম দে। এই মেয়েটা পা’গ’ল বানিয়ে দেবে আমাকে। সাথে তোদেরকেও।’
নাফিস চলে যায়। সে রাতে আর ঘুমাতে পারলো না তুলিকা। প্রিয় মানুষের এমন অসময়ে কি ঘুমানো সম্ভব? মাইজিনের মাথায় হাত বুলিয়ে একটা উষ্ণ চুম্বন এঁকে দিলো সে। চোখ থেকে বেরিয়ে এলো নোনা জল। খুব ভয় হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে কিছু একটা হারাতে বসেছে সে। সকালে উঠে তুলিকা প্রথমে নাফিসের সঙ্গে দেখা করে। মাইজিনের বিগত চারদিনের কার্য কলাপ পূঙ্খানুপুঙ্খ বণর্না দিলো। নাফিসের কপালে চিন্তার ভাজ পরে। তার কিছুই বোধগম্য হয় না কি জন্য এসব হচ্ছে।
‘ভাবি আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ডক্টর এর কাছে যাবো। ওঁর রিপোর্টস গুলো নিয়ে আসবো।’
‘আচ্ছা ভাই!’একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুলিকা আবারও বললো, ‘আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি ভাই। আসলে মাইজিনের জন্যই যেতে পারছি না কোথাও। কখন কি করে বসে। সব সময় একটা আতংক তা’ড়া করছে আমায়। মাইজিনের যদি জোড়ালো কিছু হয়?ভেবেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।’
‘ভাবি শান্ত হোন। আপনি রুমে যানতো।’
মিষ্টি রেডি হয়ে নিচে নামছিলো। তারও মনটা বিষন্ন হয়ে আছে। মাইজিনের উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণের রেশ এখনো মাথা থেকে বের করতে পারেনি সে।
‘মিষ্টি আসো তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।’
মিষ্টি বাঁধা দেইনি। বরং নিরবে গিয়ে গাড়িতে বসেছে। নাফিস গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টিকে অবলোকন করছিলো।
‘চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘মাইজিন ভাইয়ার কি হয়েছে বলুন তো? হঠাৎই এরকম আচরণের মানে টা কি? একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কি হচ্ছে মাঝে মধ্যে?’
‘জানি না মিষ্টি। দেখি ডক্টর এর কাছে যাচ্ছি রিপোর্ট দেখে কি বলেন!’
মিষ্টি মুখ চেপে হুহু করে কাঁন্না করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘মাইজিন ভাইয়ার যদি কিছু হয়ে যায় আপু বাঁচবে না। শেষ হয়ে যাবে আপু!’
‘কেঁদো না আমার বাচ্চা মরিচ! সহ্য করতে পারি না!’
মিষ্টি কান্না থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নাফিস আলতো হাসে আড়ালে। মিষ্টি এই প্রথম বার নাফিসকে খেয়াল করলো৷ কি সুন্দর মানুষটার মুখটা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বাইরে তাকালো।
‘আজকে স্কুলে না গেলে কি হতো না?’ বলল নাফিস।
‘আজ আমার এক্সাম! নাইনের ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়েছে। টেন এ উঠবো আমি। আর বাচ্চা মরিচ বলবেন না আশা করি।’
‘ওহো তাই তো বড় হয়ে গেছে আমার বাচ্চা মরিচ। তা ভালো ভাবে পড়েছো?’
‘হ্যাঁ পড়েছি। ঘটনা তো রাত দুইটা বেজে ঘটেছে। রাতেই পড়া কমপ্লিট করে ঘুমিয়েছিলাম আমি।’
‘গুড। ভালো ভাবে এক্সাম দাও। আমি আনতে যাবো এক্সামের পর।’
‘দরকার নেই আমি চলে আসবো। আপনার যাওয়া লাগবে না। আমার বান্ধবীরা ক্ষ্যাপাবে আমায়।’
‘ক্ষ্যাপাবে কেন?’
‘কারণ আপনি বুড়ো। এমন বুড়োর সঙ্গে দেখলে ওঁরা নির্ঘাত ক্ষ্যাপাবে আমায়।’
‘ক্ষ্যাপালে ক্ষ্যাপাবে। না হয় একটু সহ্য করে নিও। অভ্যাস হয়ে যাবে বিয়ের আগে।’
‘আমি একাই আসবো।’
‘জেদ করো না মিষ্টি! তোমার মানসিক অবস্থা ভালো নেই।’
আজ আর বেশি বাঁধা দিলো না মিষ্টি। না কোনো রাগ দেখালো নাফিসের কথায়। অন্য সময় হলে হইতো এতক্ষণে একটা কুরুক্ষেত্র হয়ে যেতো৷ ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে নাফিস। মিষ্টিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে নাফিস হসপিটাল গেলো৷ ডক্টর রিপোর্ট দেখে যা জানালেন তা ছিলো অভাবনীয়। মাইজিনের স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার ( মাল্টিপল ডিসওর্ডার!) অর্থাৎ একজন মেন্টাল পেসেন্ট!
#চলবে
#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৩১
#রাউফুন
মাইজিনের সিকনেস যখন দিনকে দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো তখনই অত্যন্ত খুশির এক বার্তা বয়ে এলো তাদের সংসারে। আজকে টেষ্ট করার পর তুলিকা জানতে পেরেছে সে মা হতে চলেছে। সে হাউমাউ করে কাঁন্না করে দিয়েছিলো। তার ভেতরে আরেকটা সত্তার অনুভব করলো মন প্রাণ দিয়ে। চোখের পানি বাঁধন ছাড়া। সে খুশিতে মাইজিনের কাছে ছুটে যায়। শুয়ে থাকা মাইজিনের বুকের উপর শুয়ে তাকে দুই হাতে জাপটে ধরে। মাইজিনকে জড়িয়ে ধরার পর তার কান্নার বেগ দ্বিগুণ হাড়ে বেড়ে যায়।
মাইজিনের ঘুম ভেঙে যায় এতে। সে তুলিকাকে সম্পুর্ন ভাবে জড়িয়ে ধরে আলতো হাসে। হেসে বলে, ‘এই পা’গ’লি এভাবে কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? এতো কান্নাঁ কিভাবে করো তুমি?’
‘মাইজিন আমি আজকে ভীষণ খুশি। আপনি শুধু এখন সুস্থ হলে আমরা সম্পুর্ন। আমরা খুব শীঘ্রই একটা ফ্যামিলিতে পরিপূর্ণ হবো মাইজিন।’
মাইজিন উঠে বসে। তুলিকা সেভাবেই পরে থাকে মাইজিনের বুকে। কান্নার দাপট কমার বদলে বাড়লো আরও। মাইজিন তাকে চেয়েও শান্ত করতে পারলো না। মাইজিন তুলিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর শান্ত করতে চাইছে।
‘খুশি তুমি তবে এভাবে কাঁদছো কেন?’
‘আপনি জানেন না কেন কাঁন্না করছি। জানলে আমার চেয়েও বেশি খুশি আপনি হবেন। আল্লাহ যে কত বড় একটা উপহার দিয়েছেন আমাদের সেজন্য খুশি। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। এবার আপনি খুব শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবেন।’
‘কি হয়েছে বলবা?’
‘আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন মাইজিন।’
যেনো এর চেয়ে মধুর বাক্য আর একটিও নেই। মাইজিনের দু-চোখ ভরে উঠে। সেও জাপটে ধরে তুলিকাকে। কাঁন্না করতে করতে দু’জনেই হারিয়ে যায় কোথাও যেনো।
‘এখন আপনি কাঁদছেন কেন?’
এরকম স্বাভাবিক মুহুর্তেই ঘটে অযাচিত, অস্বাভাবিক ঘটনা। মাইজিন হুট করেই হিংস্র হয়ে তুলিকাকে সরিয়ে দিলো নিজের থেকে।
‘বাচ্চা, বাচ্চা হবে? ও এলে ওঁকেও পঁচা মহিলাটা মা’র’বে। মা’রা’র পর৷ ধা’রা’লো ব্লে’ড দিয়ে আঁ’চ’ড়ে দিবে। ওর নরম ছো’ট্ট শরীর র’ক্তা’ক্ত করে মরিচের প্রলেপ লাগাবে সেই ক্ষ’ততে। আহঃ আমি সহ্য করতে পারবো না। তুমি জানো না কত ব্যথা। কত ব্যথা জানো না! না না এটা হতে পারে না। হতে দিবো না আমি।’
ঠিক এই ভয় টাই পাচ্ছিলো তুলিকা। আর সেজন্যই কাঁন্নায় ভেঙে পরছিলো বার বার। মাইজিন মাথার চু’ল টেনে ধরলো। আঃ আঃ করে চিৎকারে ঘরের জিনিস পত্র ভাঙতে থাকে।
‘বাচ্চা আসবে না। না, না আসবে না ওঁ। ওঁকে এতো কষ্ট দিতে দিবো না। না না দিবো না কষ্ট। আমার বাচ্চা কষ্ট পাবে না।’
মাইজিন ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে ফল কা’টা’র ছুড়ি আনে। তুলিকার দিকে আগাই এক পা এক পা করে। ভয়ে আঁতকে উঠলো তুলিকা। গুটি শুটি হয়ে পিছনে পিছিয়ে গেলো সে।
‘মাইজিন ওঁ আমার আর আপনার বাচ্চা। আমরা ওঁকে এক সাথে মানুষ করবো। ওঁকে কষ্ট পেতে দিবো না।’
‘না না বাচ্চা মানেই কষ্ট। আমাকে, আমাকে মে’রেছে। খুব মে’রেছে। তুমি আসো, আসো আমার কাছে। ওঁকে পে’ট থেকে ফেলে দিবো শুধু। আসো না! কোনো কষ্ট হবে না আমার বাচ্চার।’
তুলিকা সুযোগ বুঝে অন্য রুমে চলে যায়। দরজা আটকে দিয়ে নাফিসকে কল করলো সে। ঘটনা খুলে বললে সে রওনা দিলো এখানে আসার জন্য। মিষ্টি এক্সাম দিয়ে ফিরে নি এখনো। আজ লাষ্ট এক্সাম তার। মাইজিনকে এতো দিন যে সে কিভাবে সামলেছে এক মাত্র সেই জানে। প্রতিটি মুহুর্তে গুমরে গুমরে কেঁদেছে সে। মাইজিনের শারীরিক অবস্থার কথা শুনে চেচিয়ে কেঁদেছে সে। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। সে ভেবেছিলো বাচ্চার কথা শুনে মাইজিন একটু ভালো হবে। সে যখন খুশিতে তার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদছিলো, তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছিলো, তখন এক মুহুর্তের জন্য ভীষণ খুশি হয়ে গেছিলো সে।
নাফিস আসলে দরজা খুলে দিলো তুলিকা। কারন সে দৌঁড়ে মিষ্টির রুমে চলে এসেছিলো। নাফিস এসেছে সে জানে। তাই দরজা খুলে দিয়ে বিছানায় বসে জোরে কাঁন্না করে দিলো।
‘ভাবি আবার কি হয়েছে? এই দুইদিন তো কোনো রকম পা’গ’লামি করে নি শুনলাম। শুনে ভালোও লাগছিলো। কিন্তু আজ আবার এরকম কেন হলো?’
‘উনি এতোদিন তো পারিপার্শ্বিক ভাবে আমার বা মিষ্টির ক্ষতি করতে চান নি। কিন্তু আজ? আজ যখন সে জানতে পারলো সে বাবা হতে যাচ্ছে তখন সে এই বাচ্চাকে মে’রে ফেলতে চাইছে। সে আর বাচ্চা চাইছে না। আমি এখন কি করবো নাফিস ভাই?’
‘ভাবি প্লিজ শান্ত হোন। আপনি এভাবে কান্না করলে কি করে হবে? আপনাকে এবার ভালো থাকতে হবে আপনার সন্তানের কথা ভেবে। এভাবে ভেঙে পরবেন না।’
‘আর কতো বলতে পারেন? আপনার বন্ধুর এই অবস্থা আমি আর সইতে পারছি না। ডক্টর এর কথা মতো তো সবই করছি। আমি ভেবেছিলাম একটু ইম্প্রুভ করেছে মাইজিন। কিন্তু আজকের পর মনে হলো তাকে ঠিক করতে আমি ব্যর্থ! আমি ব্যর্থ! আমি হেরে যা-ওয়া একজন মানুষ!’
নাফিস কি বলে স্বান্তনা দিবে ভেবে পেলো না। এই মেয়েটা প্রাণ-পণে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের স্বামীকে সুস্থ করতে। দিন রাত খে’টে যাচ্ছে যাতে মাইজিনের অবস্থা ভালো হয়। কিন্তু নাফিসের মনে হচ্ছে আজকের ঘটনার পর ভালো সাইক্রেটিসকে দেখাতেই হবে।
‘শুনুন ভাবি এবারে আমাদের লাস্ট স্টেপ গ্রহণ করতে হবে। সব কিছু তো চেষ্টা করলাম। তবে মাইজিন যদি নিজে উপলব্ধি করতে পারতো সে সত্যিই সমস্যায় ভুগছে তাহলে তা সমাধানের পথও মাইজিন বের করতে পারতো। কিন্তু সে তা বুঝতে পারেনি। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে ওঁর পাগলামির ভিডিও করে ওঁকে স্বচক্ষে দেখাতে হয়েছে সে কি করে। ওঁর অবচেতন মনে যা কিছু আসতো সেটা শুধু আমাদেরকে শেয়ার করতে বলেছিলাম। ওঁ সেটা করেওছে। এবং বিশ্বাস করেছে। ডক্টর বলেছিলো বন্ধুত্বকে কাজে লাগান। যেহেতু আমি ছাড়া আর কোনো বন্ধু ওঁর নেই সেখানে আমাকেই তো ওর পাশে থাকতে হবে। নিয়মিত মেডিটেশন করানো, আমি নিজে ওঁকে এটাতে সাহায্য করেছি
(মেডিটেশন এক প্রকার মনের ব্যায়াম।এটি সচেতনভাবে দেহ মন এবং মস্তিষ্ককে শিথিল করার আধুনিক বৈজ্ঞানিক এবং সহজ প্রক্রিয়া।মেডিটেশনের মাধ্যমে আমরা মনকে একাগ্র করি, নির্দিষ্ট কিছুক্ষনের জন্য নিজেকে দূরে সরিয়ে আনি দৈনন্দিন জীবনের শত সমস্যা থেকে।এতে মনে প্রশান্তি আসে, ধীরে ধীরে কাজে মনোযোগ বাড়ে, নিজের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসে। বিজ্ঞানীদের মতে,
“মনোদৈহিক ৭৫ ভাগ রোগের কারণই টেনশন।তাই মেডিটেশন করলে আপনি অনায়াসেই শতকরা ৭৫ ভাগ মনোদৈহিক রোগ থেকে মুক্তি পাবেন। আর পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারও একটি মনোদৈহিক সমস্যার অন্তর্গত।” )
আপনি, আমি, মিষ্টি একমাত্র ওর কাছের বন্ধু। আমাদের কাছে ওর মনে হওয়াটা তো শেয়ার করেছে। আমি খেয়াল করতাম ও যখন সবকিছু শেয়ার করতো কতটা হালকা হতো। ওকে রিল্যাক্স দেখাতো সে-সময়। কতটা হালকা অনুভূব করতো ওঁ। আমি জানি মাইজিন ইম্প্রুভ করছে। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আবার যদি এরকম লক্ষ্মণ দেখা যায় তবে সেক্ষেত্রে মনোরোগ বিদের সঙ্গে দেখা করাতে হবে৷ সুনির্দিষ্ট ধরন অনুযায়ী পথ্য, তথ্য কিংবা পরামর্শও জরুরি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আমাদের এবারে মাইজিনকে সাইকোলজিক্যাল থেরাপি দিতে হবে। এটাই লাষ্ট সুযোগ ভাবি তবেই মাইজিনকে এই ডিসঅর্ডার থেকে বের করে আনতে পারবো। এবং আমাদেরকেও সাহায্য করতে হবে। ওঁকে রিহ্যাবে দিতে হবে। আপনি এবারে নিজেকে শক্ত করুন। আর যেহেতু মাইজিন ফার্স্ট স্টেজে সেহেতু সে খুব তারাতাড়ি সেরে উঠবে।’
‘আমি আপনার আমার জন্য এই অনবদ্য পরিশ্রম ভুলবো না নাফিস ভাই। আমি আপনাকে সারাজীবন মনে রাখবো। কে এতোটা করে বলুন তো আজকাল নিজের বন্ধুর জন্য?’
‘এরকম বললে কিন্তু আমি আর আসবো না। আপনি বোধহয় এখনো আমাকে নিজের বড় ভাই হিসেবে ভাবতে পারেন নি। তাই এতোটা ফর্মালিটি দেখাচ্ছেন। এভাবে ফর্মালিটি দেখালে কিন্তু আমি খুব রাগ করবো এবারে।’
‘আপনিও তো ফর্মালিটি দেখাচ্ছেন ভাই।’
‘মোটেও না। আমি কোন সময় আপনার সঙ্গে ফর্মালিটি করলাম?
‘এই যে নিজেকে বড় ভাই দাবী করছেন অথচ আপনি সম্বোধন করছেন! এটা কি ফর্মালিটি নয়?’
‘তবে কি বলবো?’
‘বোন বলবেন। তুই অথবা তুমি বললে খুশি হবো।’
‘ঠিক আছে।’
এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। তুলিকা নাফিসকে বসতে বলে পীপহোলে চোখ রাখলো। সে চমকে উঠলো রীতিমতো।
‘কি হলো এভাবে চমকে উঠলে কেন?’
‘নাফিস ভাই শাপলা আন্টি এসেছে।’
‘কিহ?’
‘ হ্যাঁ। কি করবো এখন? উনি কেন এসেছেন বলুন তো?’
‘কিছু হবে না দরজা খুলে দাও।’
তুলিকা দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে দিতেই শাপলা হুরমুরিয়ে তুলিকার পায়ের উপর পরলো। তুলিকার পা ধরে কাঁন্না করতে করতে বললো, ‘আমাকে বাঁচাও মা। তুমিই একমাত্র পারো আমাকে বাঁচাতে। দয়া করো আমাকে।’
‘একি আপনি এভাবে আমার পা ধরছেন কেন?’
‘ক্ষমা করো আমাকে। নইলে তোমার শশুড় আমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেবে!’
তুলিকা আর নাফিস হতভম্ব। কি বলছে এসব এই মহিলা? শাপলার কান্না দেখে তুলিকার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগছে না। এই মহিলার জন্য আজকে তার ভালোবাসার মানুষ টার এই অবস্থা। এই মহিলাকে ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না।
‘আপনার যা শাস্তি প্রাপ্য তা আপনি পাবেন মিসেস শাপলা সিদ্দিকা। আপনি একজন মা হয়ে সন্তানের মতো ছেলেকে এভাবে কি করে নির্যাতন করতেন বলুন?আপনার বুক কাঁপে নি একটুও। ছোট থেকে একটা না-বালক ছেলেকে দিনের পর দিন এমন অ’ত্যা’চার করেছেন যে এখন সে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। আপনার কোনো ক্ষমা নেই। যান এখান থেকে।’
মাইজিনকে ছোট থেকে যেভাবে অত্যা’চার করেছে ঠিক সেটারই রিফ্লেক্টশন তার উপর পরেছে। সে বেশির ভাগ সময় যখন পা’গ’লামি করে তখন শাপলার করা অ’ত্যা’চা’রে’র কিছু অংশই বেশি আওড়াতে থাকে। নিজের প্রাণ প্রিয় স্বামীর প্রতি অন্যায় সে গ্রাহ্য করলো না৷ দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো শাপলাকে। তম্বন্ধে রৌফ সুলতান এসে শাপলাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে আবারও ফিরে এলেন তুলিকার কাছে। শাপলা অনবরত চিৎকার করে তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছিলো। তার মুক্তির জন্য ছটফট করছিলো। তুলিকার ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগা কাজ করলেও মাইজিনের প্রতি হওয়া অন্যায়ের কথা ভেবে সেই খারাপ লাগাকে উড়িয়ে দিলো। শাপলাফ বোঝা উচিত যন্ত্রণা কি জিনিস।যে যন্ত্রণা তিনি মাইজিনকে দিয়েছেন। যার ফলস্বরূপ আজকে মানুষ টা স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসওর্ডারে ভুগছে। তাকে কোনো দিনও ক্ষমা করতে পারবে না তুলিকা। কোনো দিন ও না। তুলিকা বসে পরলো ফ্লোরে৷ হাঁটুতে মুখ গুঁজে হামলে কাঁন্না করে দিলো। নাফিস, রৌফ সুলতান তাকিয়ে দেখলেন একটা মেয়ের ভে’ঙে গুড়িয়ে যাওয়াকে। যে স্বামীর এরকম অবস্থা জেনেও তার হাত ছাড়েনি। অন্য কেউ হলে বোধহয় কবে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতো। দুনিয়ায় বাঁচা বড্ড কঠিন।বড্ড কঠিন।
‘আমি আপনার সঙ্গে কার অন্যায় কারীকে ক্ষমা করিনি মাইজিন।আমি ক্ষমা করতাম কি করে বলুন? ওই মহিলাকে ক্ষমা করলে যে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। কিছুতেই না।’
#চলবে