বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব-২২+২৩+২৪

0
435

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী

কুহু ফুপুর রুমে খাবার নিয়ে আসে। আফরোজা নাজনীন অসার হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। গত কয়েকদিনের পরিশ্রম এবং নিয়মিত খাবার না খাওয়ায় তিনি এমনিতেই দুর্বল ছিলেন। তারউপর মেয়ের বিদায়ের কষ্ট তিনি নিতে পারেননি। প্রেশার ফল করেছে ভয়ানকভাবে। ডক্টর এসে চেক-আপ করে ঔষধ লিখে দিয়েছে। তাহমিদ ঔষধ নিয়েও এসেছে।

কুহু ওর ফুপুর পাশে বসে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি খেতে চাইছেননা৷ কুহু বেশ জোরজবরদস্তি করে কয়েক লোকমা খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে দেয়। এরপর ফুপুর মাথার পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দেয় যতক্ষণ না ফুপু ঘুমায় একসময় তিনি ঘুমিয়ে পরলে কুহু দিদুনের কাছে আসে। তাহমিদ ড্রয়িংরুমে বসে কুহুর দিদুনের রুমে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। যখন দেখল কুহু দিদুনের রুমে যেয়ে দরজা লক করে দিয়েছে তখন সে নিজের রুমে আসে। আনান তাহমিদের বিছানার একপাশে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। ওর পাশে শিহাব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বাসায় আত্মীয় স্বজনরা থাকায় তাহমিদের রুমে কয়েকদিন থেকে শিহাব আর আনান থাকছে।
তাহমিদ ফ্রেশ হয়ে এসে ওর জন্য রাখা ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পরে। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করায়,শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। বিছানায় পিঠ ঠেকানোর প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পরে।

ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি কানে আসতেই ঘুম ভাঙ্গলো আয়েশা সালেহার। তিনি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসে কুহুকে ডাকেন।
পাশাপাশি নামাজে দাঁড়িয়েছে দুইজন, যাদের প্রজন্মের মাঝে অনেক তফাত। যাদের বয়সের ফারাক বিস্তর। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে আসার জন্য বয়সের কোন বাঁধা নেই। তাইতো দুই বয়সের দুইজন নারী একমনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে ব্যস্ত।
নামাজ শেষে আয়েশা সালেহা তসবিহ পাঠ করছিলেন। কুহু জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে বিছানায় উঠে। বাসায় অনেক লোকজন। তাই এখন ওর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। শুধু ফুপু ঘুম থেকে উঠলে তার কাছে যাবে। তবে ঘুমের ঔষধের প্রভাবে উনি সম্ভবত দেরি করে উঠবেন।

তাহমিনা আক্তার ফজরের নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে আসেন। নাজমা পারভিন, শাহনাজ সুলতানাও ততক্ষণে নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে এসেছেন। তারা হাতে হাত মিলিয়ে নাস্তা বানাতে শুরু করেন। অনেকক্ষণ পর শিউলি আক্তার এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।
আফরোজা নাজনীনের ছোট জা আসেন এরপর। তারা কয়েকজন মিলে সকলের খাবার তৈরি করেন।
একে একে সবাই আসতে শুরু করেছে ডাইনিং রুমে।
একসময় কুহু ধীর পায়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে। তাহমিনা আক্তার কুহুকে দেখেই বিগলিত গলায় কাছে ডাকেন। কুহু উনার কাছে গেলে, তিনি কুহুকে তার পাশে একটা টুলে বসান। তিনি প্লেটে দুইটা পরোটা, ডিম ভাজি এবং একটু মাংসের তরকারি নিয়ে কুহুর পাশে বসেন। পরোটার এককোণা ছিঁড়ে সাথে মাংস নিয়ে কুহুর মুখের সামনে ধরেন। তাহমিনা আক্তারের এহেন কাজে চমকিত কুহু সহসাই মুখ খুলতে পারেনা। আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে সে। নাজমা পারভিন এবং শাহনাজ সুলতানার চোখে পানি আসে। তার ছাড়াও কুহুকে ভালোবাসার কেউ আছে দেখলে আনন্দের অশ্রু বয় তাদের চোখ বেয়ে৷
শিউলি আক্তার চোখের সামনে এসব সহ্য করতে না পেরে ড্রইংরুমে আসে। রা’গে ফুঁ’স’ছে সে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ওঠে তার।
” কিমুন বেহায়া মাইয়া দেখছ! যারে ঐ বেডির পোলায় অপমান করল, এহন তার হাতেই খাবার খাইতাছে! ছি ছি ছি। আমার মাইয়াডা যে না খাইয়া রইছে সেদিকে কারও নজর নাই৷ খালি সকলে ঐ অ’প’য়া’রে নিয়া নাচে। ” আপনমনে গজগজ করছে শিউলি।

” এই যে মেয়ে, এভাবে মুখ বন্ধ রাখলে হবে? খেতে হবেনা? আমি কখন থেকে তোর মুখের সামনে খাবার ধরে আছি, কিন্তু তোর মুখ খোলারই নাম নেই! নাকি আমার হাতে খেতে চাসনা? ”
তাহমিনা আক্তারের কথা শুনে ঝটপট মুখ খোলে কুহু। পরোটা মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে।
” তুমি আমাকে খাওয়াচ্ছো আর আমি মুখ খুলবনা এটা কেমন করে হয় আন্টি! ”
” কোন কথা নয়। চুপচাপ খেয়ে নে। খাওয়া হলে তোর দিদুনকে গিয়ে খাওয়াবি। তাকে কষ্ট করে বাইরে আসতে হবেনা। কি রে পারবি তো? ”
” খুব পারব। কিন্তু আমাকে যে সবার আগে খাওয়াচ্ছো এটা কি ঠিক হলো? ”
” এত বেশি ভাবতে হবেনা তোকে। তুই শুধু খেয়ে নে। ”
নাজমা পারভিন এবং শাহনাজ সুলতানা দুই বোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা কোন কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। বিষয়টা তেমন হলে মন্দ হয়না। দুই বোন মুচকি মুচকি হাসছে।

কুহু ফুপুর রুমে এসে দেখল তিনি এখনও ঘুমাচ্ছেন। তাই সোজা চলে আসে সিক্তার রুমে। সেখানে সিক্তা, তনয়া, আরোশি, দৃষ্টি, সিক্তার চোট চাচার মেয়ে, আরও দুইজন মেয়ে বিছানা, মেঝে মিলে এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওদের অবস্থা দেখে কুহুর হাসি পায়। ভেতরে এসে ডাক দেয় সবাইকে। কিন্তু কেউই ওর ডাক শোনেনা। সবাই ঘুমে বিভোর। কপাল চাপড়ে ফিরে আসে দিদুনের কাছে।
” কুহুমনি, বান্ধবীদের ছেড়ে এই বুড়ির কাছে আবার আসছ। এসো বস, গল্প করি দুজনে। ”
কুহু দিদুনের পাশে বসে।
” বুঝলে কুহুমনি, বাসায় এই যে অনুষ্ঠান হচ্ছে। তোমার দাদু বেঁচে থাকলে খুব খুশি হত। তিনি সুপ্তিকে খুব আদর করতেন। নাতি-নাতনীদের মধ্যে তিনি তাহমিদ আর সুপ্তিকে বেশি ভালোবাসতেন। তাহমিদ তার প্রান ছিল। মেজো বউমা তাহমিদের জন্মের পর অসুস্থ হয়ে যায়, তখন বড় বউমা ওর দ্বায়িত্ব নেয়। এরপর সুপ্তির জন্ম হল। বিশাল এই সংসারের দ্বায়িত্ব আমাকে একা সামলাতে হত। বড় বউমা দুই ছেলে-মেয়েকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তখন তোমার দাদু বড় বউমার চাপ কমাতে তাহমিদ, সুপ্তিকে নিয়ে সময় কাটায়। ওদের এক দোলনায় শুইয়ে দিয়ে তোমার দাদু ওদের পাহারা দেয়। তবে রীতি, দূত্যি, তাওহীদকে যে ভালোবাসতোনা এমনটা নয়। ওরা তার কলিজা ছিল। কিন্তু এই দুটোর সাথে বেশি সময় কাটানোর দরুন এদের প্রতি বেশি মায়া জন্মে যায়। ধীরে ধীরে ওরা বড় হতে থাকে, আর সেই সাথে ওরা দাদুর ন্যাওটা হয়ে যায়। উঠতে, বসতে দাদু দাদু করতে থাকে।
তারপর একদিন উনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন। তখন ওদের বয়স পনের বছর। তাহমিদ দাদুর শোকে অসুস্থ হয়ে যায়। টানা সাতদিন ওকে স্যালাইন দিয়ে রাখতে হয়। সুপ্তি না খেয়ে থাকে কয়েকদিন। কিভাবে যে ওদের স্বাভাবিক করতে হয়েছে, সেসব মনে হলে কষ্ট লাগে৷ আজ সেই সুপ্তি অন্যের ঘর আলো করছে। ” বৃদ্ধা অতীত রোমন্থন করতে করতে যেন সেই অতীতেই চলে গেছেন। সেই সোনালী অতীত কভু ভুলবার নয়।
” দাদু বুঝি খুব ভালো মানুষ ছিল, দিদুন? তোমাকে খুব ভালোবাসত? ”
” তার মত মানুষ আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। তবে মাঝেমধ্যে তাহমিদের মাঝে তার ছায়া দেখতে পাই। তার প্রেমিক স্বত্বা, তার ব্যক্তিত্ব, তার কোমল মন সবকিছুই আমি তাহমিদের মাঝে দেখতে পাই। সেকারণেই বোধহয় আমি তাহমিদকে এত ভালোবাসি। ”
কুহু চুপচাপ দিদুনের কথা শুনছে। যেখানে তাহমিদকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে কুহু কথা বলতে নারাজ। বৃদ্ধা একমনে বলেই চলেছে,
” ভালোকথা, কুহুমনি আমার দাদুভাই তোমার কাছে মাফ চেয়েছে? সেদিনের পর থেকে ও কিন্তু খুব কষ্ট পাচ্ছে। তুমি ক্ষমা না করলে ওর শান্তি নেই। ভুলতো মানুষই করে। কিন্তু পরে যখন সেই মানুষ অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তখন তাকে ক্ষমা করা মনুষ্যত্বের পরিচয় বহন করে । কেউ ভুল করে, সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলে, তাকে সুযোগ দিতে হয়। ভুল এবং ক্ষমা একই মুদ্রার দুই দিকে অবস্থান করে। তাকে একটা সুযোগ দাও কুহুমনি। এরপর সে যদি কোন অন্যায় করে তবে কেউ তোমাকে আর ক্ষমা করতে বলবেনা। ” বৃদ্ধার গলায় আকুলতা লুকানো থাকেনা।
” দিদুন, তিনি কোন অন্যায় করেননি। তিনি আমাকে যা যা বলেছিলেন, তার থেকেও কঠিন কথা ছোটমা আমাকে প্রতিনিয়ত বলে। আমি ছোটমার ওপরও যেমন রা’গ করে থাকিনা, তেমনি উনার ওপরও আমার কোন রা’গ নেই। আমার শুধু কষ্ট হয়। বারবার মনে হয়, মা বেঁচে থাকলে এমনভাবে আমাকে কেউ বলতে পারতনা। মা বেঁচে থাকলে আমাকে এমনভাবে ভেসে বেড়াতে হতনা। আর তখন তাহমিদ ভাইয়া আমাকে সেই কথাগুলো বলার সুযোগও পেতনা। আমার সব রাগ নিজের ওপর, দিদুন। ” কুহু সব সময়ই মন খুলে যেভাবে দিদুনের সাথে কথা বলে, সেভাবে আর কারও সাথে বলতে পারেনা। তেমনই আজও সে মন খুলে দিদুনের সাথে কথা বলছে। কিন্তু ওরা কেউই জানতে পারলনা তাহমিদ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ওর সব কথা শুনছে।

ড্রয়িংরুমে লোকজনের শোরগোলে টেকা দায়। কুহুর এখানে কোন কাজ নেই। ও দিদুনের সাথে গল্প করে ফিরে আসে ফুপুদের কাছে। বড় ফুপু ততক্ষণে ঘুম থেকে জেগে গেছেন। তাকে খাবার খাইয়ে ঔষধ দিয়েছেন তাহমিনা আক্তার। কুহু বড় ফুপুর রুমে এসে তাকে জানায়, হোস্টেলে যেতে হবে। কমিউনিটি সেন্টার থেকে সোজা এখানে আসায় কোন পোশাক নিয়ে আসতে পারেনি। রাতে সিক্তার পোশাক পরেছিল, এখনও সেই পোশাকেই আছে। পোশাক নিতে হোস্টেলে যেতে হবে। আফরোজা নাজনীন কিছু বলার আগেই তাহমিনা আক্তার কুহুকে না করে দেন। তিনি জানান, তিনি কুহুর পোশাকের ব্যবস্থা করবেন। কুহু আর দ্বিমত করেনা।
তাহমিনা আক্তার তার ছোট ছেলেকে সকলের অগোচরে শপিংয়ে পাঠান, কুহুর পোশাক কিনতে। তাহমিদ মনের মত কয়েকটা রেডিমেড থ্রিপিস কিনে এনে মায়ের কাছে দেয়। তাহমিনা আক্তার সেগুলো তুলে দেন কুহুর কাছে। কুহু প্রথমে নিতে না চাইলেও তাহমিনা আক্তারের জেদের কাছে হার মানতে হয়।

কুহু গোসল সেরে একটা নতুন থ্রিপিস পরে ড্রয়িংরুমে আসতেই, ওর চোখ আটকে যায় সোফায় বসে থাকা বাবার দিকে। সেখানে বাবার কোলে শিহাব আর পাশে দৃষ্টি বসে খুনসুটিতে ব্যস্ত। আশেপাশে কি ঘটছে সেসব দেখার সময় নেই কারও। কুহু লক্ষ্য করেছে এবার বিয়েতে আসার পর থেকে বাবা ওর সাথে খুব একটা কথা বলেনি। শুধু যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই বলেছে। একবারও আদর করে কাছে ডাকেনি, বুকে টেনে নেয়নি কিংবা মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি। কষ্টে কুহুর চোখে পানি আসে। টুপটুপ করে ঝরে পরতে একটুও সময় নেয়না। ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে তাহমিদ সবটাই লক্ষ্য করে। কুহুর কান্না দেখে ওর ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ছুটে যেয়ে ওকে বুকে জরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেই উপায় ওর নেই। প্লেট রেখে রান্নাঘরে মায়ের কাছে আসে। সংক্ষেপে মা’কে জানায় কুহুর কান্নার কথা। তাহমিনা আক্তার তৎক্ষনাৎ কাজ ফেলে কুহুর কাছে আসেন। কুহুকে বুঝতে না দিয়ে ওকে নিয়ে রান্নাঘরে এসে টুকটাক কাজের ফাঁকে ফাঁকে কুহুর সাথে গল্প করতে থাকেন৷ নিমেষেই কুহুর মনের সকল মেঘ কেটে যায়। ভালোবাসার শক্তি এত বেশি, যেখানে ভালোবাসা থাকে সেখানে কষ্টের কোন লেশমাত্র থাকেনা।

চলবে…

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী

” কি রে নবাবজাদী, না’গ’র জুটাইতে গিয়া না’গ’রে’র মায়েরে পটাইছস দেখতাছি! যেই দেখলি হেই পোলা ফিইরাও তাকাইতাছেনা, ওমনি পোলার মায়েরে হাত করলি! যেই পোলা তরে বিয়া করতে মানা করছে, তার বাড়িতে আইতে তর ল’জ্জা করলনা? কি নি’র্ল’জ্জ মাইয়া তুই! ফুপুরা কইল, আর তুই নাচতে নাচতে ঢাকা আইলি। আমার কাছে থাইকা ন’ষ্টা’মি করবার পারতাছিলিনা তাই দূরে আইছস। যাতে ভালোভাবে ন’ষ্টা’মি করবার পারস? হা’রা’ম’জা’দি এত শখ না’গ’রে’র লগে ঢ’লা’ঢ’লি করার? ” কুহুর চুলের মু’ঠি ধরে ঝাঁ’কি’য়ে দেয় শিউলি আক্তার। কুহুর মনে হলো মাথাটা বুঝি ছিঁড়ে নিল ছোটমা।
” ছোটমা, আমি আন্টিকে বলেছিলাম, হোস্টেলে গিয়ে আমার কাপড়চোপড় নিয়ে আসব। কিন্তু তিনি আমার কথা শোনেননি। আমি অনেকবার তাকে বলেছি, তবুও তিনি আমাকে হোস্টেলে যেতে দেননি।” কুহু মাথা ধরে হেঁচকি তুলে কাঁদছে।
” তুই এই বাড়িতে আইলি ক্যা? ফুপুর উপ্রে দরদ উথলায় পরতাছে? তুই আইয়া ফুপুরে সুস্থ করছস? নাকি নাগরের মন পাওয়ার জন্য আইছস? ” কুহুর গাল চেপে ধরে বলে শিউলি। কুহু অনেক কষ্টে শিউলির হাত ছাড়ায়৷
” বিশ্বাস কর ছোটমা, বড় ফুপকে ঐ অবস্থায় দেখে আমি হোস্টেলে ফিরে যেতে পারিনি৷ সেখানে গেলেও আমি থাকতে পারতামনা। আমি কালকেই হোস্টেলে ফিরে যাব। ”
” কাইল সুপ্তির শ্বশুর বাড়ি থাইকা আইসা তুই সোজা হোস্টেলে যাবি। আমার কথা যেন মাথায় থাকে। ”
” মনে থাকবে ছোটমা। “। শিউলি আক্তার আবারও কুহুকে মা’র’তে যাচ্ছিল কিন্তু তাহমিদকে বারান্দায় আসতে দেখে থেমে যায়।
তাহমিদ কাউকে কিছু খুঁজছিল। কিন্তু সেখানে না পেয়ে ফিরে যায়। দুজনের কারও সাথে কথা বলেনা। কিন্তু ওরা কেউ জানতে পারলনা তাহমিদ শিউলি আর কুহুর কথপোকথন পুরোটাই শুনেছে। সে যখন বুঝতে পারল শিউলি আবার কুহুকে মা’র’বে তখন কাউকে খোঁজার অযুহাতে বারান্দায় এসেছিল।
কুহুকে আরেকবার মা’র’তে না পেরে শিউলি তড়পাচ্ছিল। কুহু এ বাড়িতে আসায় তার রা’গ নেই। তার রা’গ মুলত দৃষ্টিকে মাথায় না তুলে সবাই কেন কুহুকে মাথায় তুলে রাখছে। তাই সে ছুঁতো খুঁজছে কিভাবে কুহুকে অ’ত্যা’চা’র করা যায়।
এদিকে তাহমিদ নিজের রুমে এসে ছটফট করছে। সে ইচ্ছে করলেই শিউলি আক্তারকে দু-চারটা কথা শুনিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সেই কথার আঁচ এসে পরবে কুহুর কাছে। নিজের গ্রামে ওকে যেতেই হবে। তখন শিউলি আক্তার কুহুকে সেসব নিয়ে আবার অ’ত্যা’চা’র করবে। নানান কিছু ভেবে তাহমিদ শিউলিকে কিছু না বলে বারান্দা থেকে ফিরে আসে।
ওর বুকের ভিতর রা’গ ক্রমাগত হা’তু’ড়ি পে’টা’চ্ছে। একটা মানুষ এতটা নীচ কিভাবে হতে পারে! এত বাজেভাবে যে কেউ কথা বলতে পারে, তা আজ শিউলিকে না দেখলে বিশ্বাস করতনা। নাহোক কুহু তার নিজের মেয়ে, কিন্তু ও তো তার মেয়েরই মতন। তার সন্তানদের আর কুহুর মাঝে তো র’ক্তে’র সম্পর্ক। এতটা নি’কৃ’ষ্ট মানুষ কিভাবে হয়! নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছেনা তাহমিদ। একদিন দিদুনের কাছে কুহুর জীবনের গল্প শুনেছিল, আজ তার কিয়দংশ স্বচক্ষে দেখল। আজ তার আফসোস হচ্ছে সেদিনের সেই ভুলের জন্য। সেদিন সে রাজি থাকলে আজ কুহু এখানে সসম্মানে থাকত৷ ভালো থাকত। এত অ’প’বা’দ সইতে হতনা। তাহমিদ ভাবতে থাকে কিভাবে আবার কুহুকে বিয়ের কথা বড়মার কাছে উপস্থাপন করবে।

কুহু সিক্তার রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ওর বাইরে যাওয়ার মন-মানসিকতা এখন নেই। কাল সুপ্তি আপুর রিসিপশন পার্টি থেকে এসেই সোজা হোস্টেলে ফিরে যাবে। আর দ্বিতীয়বার এ বাড়ির ছায়া সে মাড়াবেনা। একবার ভাবল বাবার কাছে বিচার দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই গত কয়েকমাসের বাবার আচরণ পর্যবেক্ষন করে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। বাবা যেন হুট করেই পাল্টে গেছে। আগে নিয়ম করে প্রতিদিন তিনবার ফোন করত। এখন দিনে একবার ফোন করে। আবার কোনদিন তা-ও করেনা। অনেকসময় দেখা যায় কুহু ফোন দিলে তার সাথে কথা হয়, তাছাড়া নয়। বাবা হুট করে কেন পাল্টে গেল, তার কোন উত্তর খুঁজে পায়না কুহু। এবাবে কতদিন অন্যের আশ্রয়ে কাটবে আর ছোটমার পেষনে নি’ষ্পে’ষি’ত হবে?

বিকেল থেকেই আফরোজা নাজনীন কিছুটা সুস্থ বোধ করতে থাকেন। এরমাঝে কয়েকবার সুপ্তির সাথে কথা বলেছেন। তিনি মেয়েকে জানতে দেননি তার অসুস্থতার কথা। কিন্তু সুপ্তি ঠিকই বুঝে নেয়। সে-ও মায়ের জন্য কান্নাকাটি শুরু করেছে। সানাউল রাশেদিন পরেছেন বিপদে। তিনি না পারছেন মেয়ের কান্না থামাতে, না পারছেন স্ত্রীকে শান্ত করতে। দুই মা-মেয়ের মাঝখানে পরে তিনি মেয়ের জন্য নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে পারছেননা।

তাহমিদ দিদুনকে বলে, কুহুকে তার কাছে ডেকে নিতে। দিদুন তাহমিদের মুখ দেখেই বুঝে যান কিছু একটা ঘটেছে। তিনি তাহমিদকে কোন প্রশ্ন না করে রোজিকে দিয়ে কুহুকে ডাকতে পাঠান। কুহু দিদুনে ডাকছে শুনেই দেরি না করে দিদুনের রুমে আসে।
” আমি ভেবেছিলাম কুহু বোধহয় আমাকে ভুলেই গেছে। সেই সকালের পর থেকে তোমার কোন সাড়াশব্দ নেই। ” দিদুন আফসোস নিয়ে বলেন।
” আমি সিক্তার রুমে শুয়েছিলাম দিদুন। মাথা ব্যথা করছে তাই নিচে আসিনি। তুমি রাগ করোনা। ” কুহু ম্লান হেসে জবাব দেয়।
” আমার পাশে এসে বস। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, দেখ মাথা ব্যথা কোথায় পালাবে, তুমি বুঝতেই পারবেনা। ”
কুহুর চুলের গোড়ায় খুব ব্যথা করছে। দিদুন হাত দিলে যদি আরও ব্যথা পায়, তাই সে সাহস পায়না।
” তোমার কষ্ট করতে হবেনা দিদুন। ব্যথা এমনিতেই সেরে যাবে। তুমি বরং আমাকে দাদুর গল্প শোনাও। আমি শুয়ে শুয়ে শুনি। ” দিদুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পরে।

সন্ধ্যার পর রোজি কুহুকে টেনে ছাদে নিয়ে আসে। এ বাসায় আসা অবধি কুহু এখনও ছাদে আসেনি। ছাদে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ায় কুহু। তার লাগানো হাসনাহেনা গাছটা অনেক বড় হয়েছে। সেই সাথে পরিবর্তন করা হয়েছে টব। টবের জায়গায় একটা হাফ ড্রাম শোভা পাচ্ছে সেখানে। ফুলের ভারে হেলে পড়েছে গাছটি। কুহু কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে আসে গাছের দিকে। ছুঁয়ে দেয় ফুলগুলো।
” রোজি, হঠাৎ টব পরিবর্তন করেছ কেন? নিয়মিত যে যত্ন নাও তা বোঝাই যাচ্ছে। তোমাকে এত্ত এত্ত ধন্যবাদ। ” দুহাত প্রসারিত করে রোজিকে ধন্যবাদ জানায় কুহু।
” আপু, আমিতো টব পরিবর্তন করিনি। তাহমিদ ভাইয়া করেছে। ভাইয়াই নিয়মিত গাছের পরিচর্যা করে। আগে তো ভাইয়া ছাদে আসতনা, কিন্তু এখন প্রতিদিনই একবার করে ছাদে এসে গাছে পানি দেয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর এই হাসনাহেনা গাছটার যত্নের কোন ত্রুটি হতে দেয়না ভাইয়া। ”
রোজির কথা শুনে আরেকবার হোঁচট খায় কুহু।
” ভাইয়া জানে যে গাছটা আমি লাগিয়েছি? ” ইতস্তত করে জানতে চায় কুহু।
” জানেতো, সেই প্রথম দিনই আমি ভাইয়াকে জানিয়েছিলাম। ” উচ্ছ্বসিত হয়ে জবাব দেয় রোজি।
রোজির কথা শুনে কুহু বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ওর মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহমিদ ভাইয়া কেন ওর কেনা গাছের এত যত্ন নিচ্ছে!
একটু পর রোজি কাজের জন্য নিচে চলে যায়। কুহু ছাদেই থেকে যায়। রেলিং ধরে দাঁড়ায়। দখিনের পবনের সুশীতল স্পর্শে কুহুর শরীর জুড়িয়ে যায়। পবনের দোলায় নব কিশোলয়ের দল তিরতির করে কাঁপছে। মুগ্ধ নয়নে কুহু কিশোলয়ের কাঁপন দেখছে। সেই সাথে কাঁপছে ওর আঁখিপল্লব। ধরনী যেন পবনের দোলায় দুলছে। কুহু চোখ বুঁদে অনুভব করছে পবনের নিবিড় ছোঁয়া। যে ছোঁয়ায় মুছে যায় সকল ক্লেশ।
হঠাৎই পেছনে খুটখাট আওয়াজ শুনে চমকে তাকায় কুহু। রোজি চলে যাওয়ার পর ও ছাদের লাইট অফ করে দিয়েছিল। পুরো ছাদ অন্ধকারে ডুবে আছে। শুধু কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিল, কেউ এসেছে। কিন্তু কে!
” ও মা গো। ” বলে চিৎকার করে কুহু। বুকে ফুঁ দেয়।
ছাদের সেই আগন্তুকও কুহুর চিৎকারে কিছুটা দিগভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক চায়। সামনে রেলিঙের ধার ঘেষে দাঁড়ানো কাউকে আবিষ্কার করে। অন্ধকারে কে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে না পারলেও, গলার স্বরে বুঝে নেয়।
” ভয় পেওনা। আমি তাহমিদ। ” কথা বলেই পেছনে যেয়ে ঝটপট সুইচ অন করে
সুইচ অন করতেই, ঝলমলে আলোয় উদ্ভাসিত হয় চারপাশ। তাহমিদ দেখল তার সামনে এক শ্যামাঙ্গীনি দাঁড়িয়ে। কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। তার শ্যামাঙ্গীনির চোখমুখ বিষন্নতার চাদরে ঢাকা। ভয় সে ভালোমতোই পেয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছে তাহমিদ।
” অন্ধকারে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ” কুহু তাহমিদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
” চলে যাচ্ছ যে? ” তাহমিদ জানে তার প্রশ্নের উত্তর সে পাবেনা। সকালে যা হয়েছে, এরপর কুহু ওর সাথে কথা বলবেনা তা ভালো করেই জানে। শিউলি আক্তার যখনতখন চলে আসতে পারে ভেবেই তাহমিদ আর কথা বাড়ায়না।
কুহুও নিচে নামে।

চলবে…

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_২৪
জাওয়াদ জামী

কুহু নিচে এসে দিদুনের কাছে যায়। দিদুন জায়নামাজে বসে আছেন। কুহু ওয়াশরুমে ঢুকে, অজু করে এসে আরেকটা জায়নামাজ নিয়ে দিদুনের পাশে দাঁড়িয়ে যায়।
নামায শেষ করে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে, বিছানায় শুয়ে পরে।
” কুহুমনি, তুমি শুয়ে পরলে যে! এখনই ঘুমিওনা কিন্তু। রাতে খেয়েই তবে ঘুমাবে। ”
” না দিদুন, আমার খুব ঘুম পেয়েছে। আজ রাতে আর খাবনা। আমি ঘুমালাম, আমাকে ডেকোনা কেমন? ” কুহু দিদুনের কথা না শুনেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়। ছোটমা চুল ধরার পর থেকেই মাথাটা ভিষণ ব্যথা করছে। চুলের গোড়া ব্যথায় টনটন করছে। একটু না ঘুমালেই নয়।

” কুহু মা, ও কুহু মা। একটু ওঠ দেখি। খাবারটুকু খেয়ে নে। তারপর আবার ঘুমাবি। ” তাহমিনা আক্তার ক্রমাগত ডাকতে থাকে কুহুকে।
ঘুমে বিভোর কুহু তাহমিনা আক্তারের ডাক শুনে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠে।
” কি হয়েছে, আন্টি! আমাকে ডাকছেন যে! ” কুহু জিজ্ঞেস করে তাহমিনা আক্তারকে।
” কিছুই হয়নি পাগলি। এখন যা চোখমুখ ধুয়ে আয়। আমি তোকে খাইয়ে দিব। ”
” আমার ক্ষুধা নেই আন্টি। এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছেনা। ”
” এই মেয়ে, একদম বেশি কথা বলবিনা। যা চোখমুখে পানি দিয়ে আয়। তোর খাওয়া হলেই তবে আমি খাব। ”
তাহমিনা আক্তারের ধমকে কুহু কথা না বাড়িয়ে, বিছানা থেকে নেমে, চোখমুখে পানি দিয়ে আসে।
তাহমিনা আক্তার একটা প্লেটে গরম ভাত আর মুরগির মাংস নিয়ে এসেছেন। কুহুকে খাইয়ে দিয়ে, একটা পেইন কিলার কুহুর হাতে ধরিয়ে দেন। কুহু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে তিনি জানান, শ্বাশুড়ির কাছে মাথা ব্যথার কথা শুনে তিনি পেইন কিলার এনেছেন। কুহু জানতেও পারলনা তাহমিদ ওর মা’কে ঔষধ দিয়ে কুহুর কাছে পাঠিয়েছে।
কুহু ঔষধ খেয়ে পুনরায় শুয়ে পরে। ওর শরীর খারাপ থাকায় অল্প সময়েই ঘুমিয়ে পরে।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলে কুহু আবিষ্কার করে ওর আর মাথা ব্যথা নেই। খুশিমনে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বড় ফুপুর কাছে আসে। তিনি নিজ রুমে শুয়েছিলেন। তার প্রেশার এখনও কম। তাই কেউই তাকে কোন কাজ করতে দিচ্ছেনা।
” ফুপু, তোমার শরীর এখন কেমন আছে? কিছু খেয়েছ? আমার আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। ” কুহু মুখ কাঁচুমাচু করে ফুপুর সাথে কথা বলে।
” আমি আগের থেকে এখন অনেকটাই ভালো আছি। সকালে খেয়ে ঔষধও খেয়েছি। আমাকে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবেনা। তুই ডাইনিং রুমে যেয়ে কিছু খেয়ে নে। “। কুহু মাথা নেড়ে রুম থেকে বেরোতেই, আফরোজা নাজনীনের কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়।
” হ্যাঁ রে সোনা মা, তুই এই বাসায় এসেছিস বলে, তাহমিদ কি তোকে কিছু বলেছে? কিংবা ওর কোন বিরক্তি বুঝতে পারছিস? ”
” না ফুপু। তিনি তো আমার সামনে খুব একটা আসছেননা। তবে যে দুই-একবার সামনে পরেছে, মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে৷ ” কুহু মৃদুস্বরে জবাব দেয়।
আফরোজা নাজনীন হাঁফ ছাড়েন। হাত বাড়িয়ে কুহুকে কাছে ডাকেন। কুহু তার কাছে আসলে তিনি, কুহুকে পাশে বসান।
” সেদিন ও চরম অন্যায় করেছিল মানছি, কিন্তু তারপর থেকেই অনুশোচনায় ভুগেছে। আমি এটাও লক্ষ্য করেছি, ও চায় তুই আগেরমতই এই বাসায় আসিস। তাই সেদিনের কথা মনে রাখিসনা মা। ও যেমন আমার ছেলে, তুইও তেমনই আমার আরেকটা মেয়ে। তোরা দুজনেই আমার কাছে সমান। আমি মা হয়ে বলছি, তুই ওকে ক্ষমা করে দে। তবে আমাকে স্বার্থপর মনে করিসনা তুই। আমি চাই তুই পূর্বেরমতই এখানে এসে থাক। কয়েকমাস পর এইচএসসি দিবি। তারপর কোচিং করতে হবে। এরপর ভার্সিটিতে ভর্তি হবি। আমি চাইনা, শুধু হোস্টেলেই তোর জীবন কাটুক। তুই হোস্টেলে থাকিস, আমি থাকি টেনশনে। তোকে বোঝাতে পারবনা, কত চিন্তার মধ্যে আমার দিনরাতগুলো কাটে। ”
” ফুপু, তাহমিদ ভাইয়ার ওপর আমার কোন রা’গ নেই। কিন্তু তুমি যেটা বলছ, সেটা সম্ভব নয়। এই বাসায় থাকলে ছোটমা যদি রা’গ করে? ছোটমা চায়না, আমি এখানে থাকি। আমি এখানে এসেছি, ছোটমা এতে রা’গ করেছে। ”
” শিউলির, রাগ দেখতে তোকে কে বলেছে! তোর ভালোমন্দের বিষয় দেখার জন্য আমরা তিন বোন আছি। তোকে নিয়ে ওর ভেবে কোন কাজ নেই। ”
” তবুও তার কথা মানতেই হবে, ফুপু। হোস্টেলে তো আর সারা বছর থাকতে পারবনা। ছুটিতে আমাকে গ্রামে যেতেই হবে। ”
” তুই গ্রামে যাবি, তোর বাবার বাড়িতে। তুই কি ওর বাবার বাড়িতে যাবি! এত ভয় করিস জন্যই ও তোকে পেয়ে বসে। একটা কথা শুনে রাখ, ওর কোন কথার জবাব তুই দিবিনা, শুধু কাজে দেখিয়ে দিবি। তুই ওর শত বাঁধা স্বর্তেও জীবনে বড় হয়েছিস। শুধু ভয়কে জয় কর, দেখবি শিউলি তোকে সমঝে চলবে। ”
” ভয়কে জয় করতে হলে খুঁটির জোর থাকতে হয়, ফুপু। কিন্তু সেই খুঁটিই যদি নড়বড়ে হয়, তবে ভয়কে জয় করব কিভাবে! আমার খুঁটির জোরই হলো বাবা। কিন্তু সেই বাবাও অনেক দূরে সরে গেছে। আজকাল আমাকে দেবার জন্য ভালোবাসা তার কম পরেছে। কিন্তু আমাকে যে ফুলতলা যেতেই হবে ফুপু। আমার মা আছে সেখানে। আমার দাদু, দাদিমা সবাই আছে। আমার মায়ের স্মৃতি আছে ঐ বাড়িতে। আমি ছোটমাকে খুঁচিয়ে, ঐ বাড়িতে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করতে চাইনা। ” ফুঁপিয়ে কাঁদছে কুহু।
আফরোজা নাজনীন কুহুকে বুকে টেনে নেন। মেয়েটার যুক্তিও যে হেলা করার নয়।
” তুই কাঁদিসনা, সোনা মা। আমরা তোর পাশে আছি তো। তুই এখানে থাকতে না চাইলে থাকবিনা। কিন্তু মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসতে পারবি তো। শুধু শিউলিকে জানাবিনা এখানে এসেছিস। তুই এখানে আসায় সবাই খুব খুশি হয়েছে। তোর ফুপা পারলে আনন্দে কেঁদে দেয়। আমি শুধু চাইব, তুই এই মানুষগুলোকে এই আনন্দটুকুই দিস। এখন যা খেয়ে নে। এরপর গোসল সেরে, তৈরি হয়ে নিবি। সুপ্তির শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে। ”
কুহু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বেরিয়ে আসে।

” ও আমার কলিজার বইন, তুই তৈরি হবি কখন! আমরা সবাই তৈরি হয়েছি, কিন্তু তোর কোন খবর নেই! ” আনান বারবার তাড়া দিচ্ছে কুহুকে।
ঐদিকে তনয়া, আরোশি, সিক্তা, দৃষ্টি সবাই তৈরি হয়েছে। শুধু কুহুই বাকি আছে। দিদুনের শরীর খারাপ লাগায়, কুহু তার কাছে ছিল এতক্ষণ। এজন্য ও তৈরি হতে পারেনি।
” ভাইয়া, তুমি আমার সাথে কিছুদিন থেকে এভাবে কথা বলছ কেন! আগে তো এভাবে বলতেনা? ”
” আগের হিসেব আর এখনকার হিসেবের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। আগেরগুলোর জন্য এখন আমাকে নিয়ম করে তওবা করতে হয়। তাই ভবিষ্যতে সারাজীবন তওবা করতে চাইনা বলে, এখন থেকে প্র্যাকটিস করছি এভাবে ডেকে। ”
কুহু আনানের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝেনা। তাই কোন প্রত্যুত্তর না করে তৈরি হতে যায়।

শিউলি আক্তার তার ছেলে-মেয়েকে দামী কাপড়চোপড় কিনে দিয়েছে, বিয়ে উপলক্ষে। নিজেও দামী শাড়ি, গহনা কিনেছে। যাতে বিয়ে বাড়িতে কেউ কিছু বলতে না পারে। ছেলে-মেয়েকে তৈরি করিয়ে, নিজেও তৈরি হয়ে নেয়। আয়নায় বারবার ঘুরেফিরে নিজেকে দেখছে, আন তৃপ্ত হচ্ছে। কায়েসকে যখন বলছে, সুপ্তির বিয়ের জন্য কেনাকাটা করবে, কায়েস সাথে সাথেই রাজি হয়েছে। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে গিয়ে, ওদের পছন্দমত কেনাকাটা করেছে।
কেনাকাটার সময় কেউ ভুল করেও কুহুর নাম উচ্চারণ করেনি। কিন্তু শিহাব যখন দেখল, বাবা ওদের জন্যই সবকিছু কিনছে, কুহুর জন্য কিছুই নেয়নি। তখন ও বাবাকে কুহুর জন্যও কিনতে বলে। সাথে সাথে রে’গে উঠে শিউলি। কায়েসকে জানায় কুহুর অনেকগুলো নতুন জামাকাপড় আছে। তাই ওর জন্য কিছু না কিনলেও চলবে। কায়েসও স্ত্রীর কথামত কুহুর জন্য কিছুই নেয়না। সেদিন মনে মনে খুব হেসেছিল শিউলি। কুহু হোস্টেলে থাকায়, তার জন্য ভালোই হয়েছে। কুহুর বিরুদ্ধে নানান কথা বলে কায়েসকে নিজের দিকে টানতে পেরেছে। অবশ্য এর জন্য তাকে কম কসরত করতে হয়নি। অবশেষে অনেক সাধনার পর সে সফল হতে পেরেছে। তবে চিন্তা একটা থেকেই যায়, স্বামী, মেয়ে তার হাতের মুঠোয় এসেছে ঠিকই, শুধু শিহাবটাই দিনরাত কুহুর নাম জপে। ছেলেকে কুহুর কাছ থেকে কিভাবে সরাবে, সেই চিন্তাই এখন তার মাথা ঘুরে। একবার ছেলেকে নিজের দিকে আনতে পারলে, রইল তিন ননদ। আস্তেধীরে তাদেরকেও নিজের দিকে টানবে। তার আগে কুহুকে নিজেদের জীবন থেকে সরাতে হবে। কুহু যতদিন ফুপুদের সাথে যোগাযোগ রাখবে, ততদিন কুহুর কিছুই করতে পারবেনা। তাই সর্বপ্রথম কুহুকে সরাতে হবে। অবশ্য সব প্ল্যান তার ঠিক করাই আছে। যেহেতু স্বামীকে হাতের মুঠোয় আনা গেছে, তাই সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে কোন বাধাই নেই। নিজের বুদ্ধির বহর দেখে কিটকিটিয়ে হেসে উঠে শিউলি। ঐ কুহুর জন্য তাকে অনেক অপমানিত হতে হয়েছে। এবার সে সব শোধ একবারে নিবে।

তাহমিনা আক্তার কুহুকে সাজিয়ে দিয়েছেন। যদিও কুহু বেশ আঁইগুই করছিল, কিন্তু তিনি কুহুর কথা কানেই নেননি। মনের মত করে কুহুকে সাজিয়েছেন। তারা সবাই সুপ্তির রিসিপশন যাচ্ছেন। শুধু আফরোজা নাজনীন শরীর খারাপ থাকায় যেতে পারছেননা। আফরোজা নাজনীনকে দেখাশোনার জন্য তাহমিনা আক্তার থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বড় জায়ের মতামতের কাছে হার মেনে তাকেও যেতে হচ্ছে। তবে আফরোজা নাজনীনকে দেখে রাখার জন্য তিনি এ বাড়ির পুরোনো কাজের খালা, জাহেদাকে রেখে যাচ্ছেন।

তাহমিদ ড্রয়িংরুমে বসে আনান আর নিহানের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। মা, দিদুন আর কুহু আসলেই ওরা রওনা দিবে। আড্ডার মাঝেই ওর চোখ যায় সিঁড়ির দিকে। কুহু ডিপ পার্পল কালারের একটা লেহেঙ্গা একটু উঁচিয়ে ধরে নিচে নামছে। তাহমিদের হার্টবিট এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়।
ফ্রন্ট পাফ করা ঘন কালো চুল পিঠে লুটাচ্ছে। চোখে কাজল, ঠোঁট রাঙ্গিয়েছে হালকা কালারের লিপস্টিক দিয়ে। কানে পাথরের বড় ঝুমকা, হাতে পাথরের ব্রেসলেট। এতেই বেশ লজ্জা লাগছিল কুহুর। এমনভাবে আগে কখনোই সাজুগুজু করেনি ও।
তাহমিদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে। আনান সেটা লক্ষ্য করে জোরে শিষ বাজায়।
” সুপার বইন, সুপার। তোরে তো হিরোইন লাগছে। মানুষের হার্ট অ্যাটাক করানোর জন্যই কি এই লুকে হাজির হয়েছিস! আজ আমাকে হার্ট অ্যাটাকের রুগীর আশেপাশেই থাকতে হবে দেখছি। ” আনানের দিল খোলা কথায় বেশ লজ্জা পায় কুহু।
আনানের কথার জবাব না দিয়ে বড় ফুপুর কাছে যায় বিদায় নিতে।

আয়েশা সালেহা গাড়িতে উঠে তারপাশে কুহুকে বসতে বললেন। কুহুও দিদুনের কথামত তার পাশে বসে। এবার দিদুন তাদের কাছে তাহমিদকে ডেকে নেয়। এবার কুহু মহাফ্যাসাদে পরে যায়। তাহমিদ ভাইয়ার এখানে বসা মানেই, কুহুর পাশে তাকে বসতে হবে। আয়েশা সালেহা বুদ্ধি করেই নিজের কাছে কুহুকে বসিয়েছেন, আবার বুদ্ধি করেই তাহমিদকে একই গাড়িতে ডেকেছেন। এতে যদি দুজন একটু হলেও কাছে আসে।
ড্রাইভারের পাশে বসেছে আনান, পেছনে দিদুন, কুহু, তাহমিদ আর শিহাব। তাহমিদ কুহুর পাশে বসে মুচকি হাসে। চিপসের প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় কুহুর দিকে।
” নাও, চিপস খাও। ”
কুহু চিন্তায় অস্থির। ছোটমা এ নিয়ে আবার কোন কান্ড ঘটায়।
কুহু তাহমিদের কাছ থেকে চিপস নেয়।

চলবে…