আজও বৃষ্টি নামুক পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
382

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৯
_________________

মেঘের গর্জন আর বৃষ্টির পানির শব্দে মুখরিত চারপাশ। বিষন্ন মাখা রাত। দুশ্চিন্তায় পঞ্চমুখ একটি মানুষ। অপূর্বের কি হলো, কেন হলো, কে করলো এই প্রশ্নে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম তার। প্রিয়তা আপাতত সব প্রশ্নকে দূরে সরিয়ে রেখে আস্তে আস্তে অপূর্বকে ধরে নিয়ে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। প্রিয়তার চোখ বেয়ে অশ্রু জড়ছে,নিশ্বাস আসছে আঁটকে। প্রিয়তার অবস্থাটা বরাবরে মতো আজও যেন বুঝলো অপূর্ব কারন সে যে জ্ঞান হারায় নি খানিকটা ক্লান্তিতার জন্য চোখ বন্ধ করে চুপ করে ছিল কতক্ষণ। কেমন যেন হুট করে প্রিয়তা জড়িয়ে ধরায় অপূর্ব নিশ্চুপ বনে যায়। জীবনে প্রথমবার কোনো মা ব্যতীত কোনো নারী তাকে ছুলো। কেমন যেন অনুভূতি হলো, তার যন্ত্রনায় কাতর হওয়া শরীরটাও কেমন যেন অবশ হয়ে পড়েছিল। অপূর্ব খানিকটা নড়লো। শীতল ভেজা কন্ঠে বললো,

‘ আরে মেয়ে তুমি কাঁদছো কেন, পাগল হলে বুঝি?’

প্রিয়তা যেন চমকে উঠলো। অপূর্ব জ্ঞান হারায় নি তবে। প্রিয়তা দ্রুত নিজের চোখের পানি মুছে অপূর্বকে খাটে বসালো তারপর উত্তেজিত কন্ঠে বললো,

‘ আপনার পিঠে রক্ত অপূর্ব?’

অপূর্ব খানিকটা হাসে। বলে,

‘ রক্তের কি দোষ বলো শরীরটাতেই তো আঘাতে ভরা।’

বলেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো অপূর্ব। আর সহ্য হচ্ছে না এবার বুঝি সত্যি সত্যি জ্ঞান হারাতে চলেছে অপূর্ব। প্রিয়তা অপূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ আমি কি ডাক্তার ডাকবো অপূর্ব?’

উওরে অপূর্ব উপুড় হয়ে শুয়েই বললো প্রিয়তাকে,

‘ না তার দরকার নেই।’

‘ তাহলে ঠিক হবেন কিভাবে?’

প্রিয়তার কথা শুনে হাল্কা হেঁসে মিষ্টি সুরে বলে অপূর্ব,

‘ আমায় একটু ছুঁয়ে দিবে মেয়ে, তুমি ছুঁয়ে দিলেই আমি ঠিক হয়ে যাবো দেখে নিও।’

প্রিয়তা শুনলো অপূর্বের কথা,অদ্ভুত শিহরণ বইলো তার ভিতর দিয়ে অবাকও হয়েছে সাথে। প্রিয়তা বিছানার পাশ দিয়ে বসে বললো,

‘ আমি কি ডাক্তার ডাকবো না অপূর্ব?’

অপূর্ব জবাব দেয় না। আবারও চোখ বুঝিয়ে ফেলেছে সে। বাহিরে ঝড় উঠেছে, মুষলধারে বর্ষণ হচ্ছে এই মুহূর্তে ডাক্তার ডাকার কথাটাও যে বড্ড বেমানান এটাও বুঝতে পেরেছে প্রিয়তা। প্রিয়তা ভেবে পাচ্ছে না কি করবে সে। প্রিয়তা অপূর্বের পিঠের দিকে তাকালো।

কালো শার্টটার পিছন থেকে অনেক জায়গা দিয়ে ছিঁড়ে গেছে যেন কেউ বেশ কয়েকবার ছুঁড়ি দিয়ে পিঠে আঘাত করেছিল খুব। রক্তে পিঠ ভিজে গেছে অপূর্বের। প্রিয়তার চোখ বেয়ে আবার পানি পড়তে নিলো, সঙ্গে সঙ্গে পানিটুকু মুছে নিজেকে সামলালো প্রিয়তা। এভাবে বসে থাকলে চলবে না কিছু একটা করতেই হবে। এই মুহূর্তে অপূর্বকে সুস্থ করাই তার মূখ্য উদ্দেশ্য যেন। কিন্তু কি করবে প্রিয়তা। বাড়িতে গ্র্যান্ডমা ছাড়া আর কেউ নেই। প্রিয়তা অনেক ভেবে চিন্তে বুঝতে পারলো যা করার তাকে একাই করতে হবে। ডাক্তার বা গ্র্যান্ডমা কেউই কিছু করতে পারবে না এখন। এই মুহূর্তে সর্বপ্রথম তাকে ফাস্ট এইডের বক্সটা আনতে হবে। যেটা গ্র্যান্ডমার রুমে গেলেই পাওয়া যাবে। প্রিয়তা অপূর্বের চেহারার পানে একপলক তাকিয়েই চলে গেল রুমের বাহিরে।’

ঘড়িয়ে তখন সাড়ে দশটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। গভীর ঘুমে মগ্ন গ্র্যান্ডমা। প্রিয়তা তার মোবাইল লাইটটা অন করে চুপিচুপি ঢুকলো রুমের ভিতরে তারপর ড্রয়ার খুলে খুব সাবধানে ফাস্ট এইডের বক্সটা বের করে হাতে নিলো প্রিয়তা। তারপর আস্তে আস্তে বের হলো রুমে থেকে হঠাৎই দড়িতে টানানো আয়মানের একটা শার্টের দিকে চোখ গেল প্রিয়তার। প্রিয়তা কি ভেবে যেন শার্টটা নিয়ে নিলো হাতে তারপর আর বেশি না ভেবে দ্রুত ছুটলো নিজ রুমের উদ্দেশ্যে।’

রুমে ঢুকেই আগের ন্যায় অপূর্বকে শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল প্রিয়তা বসলো অপূর্বের পাশ দিয়ে কিভাবে কি শুরু করবো ভেবে পায় না সে। কিছু করতে হলে অপূর্বের গায়ে জড়ানো শার্টটা খুলতে হবে তাকে। খানিকটা সংকোচতা ফিল হচ্ছে প্রিয়তার। প্রিয়তা জোরে একটা নিশ্বাস ফেললো। তারপর একা মনে আওড়ালো,

‘ এই মুহূর্তে কোনো সংকোচতাকেই বেশি আশকারা দেয়া যাবে না প্রিয়তা, ভুলে যাস না তুই যখন অসুস্থ ছিলি তখন এই ছেলেটাই তোকে সাহায্য করেছে নিজ হাত খাইয়ে দিয়েছে।’

এই রকম নানা কিছু ভেবে প্রিয়তা অপূর্বকে উল্টালো, তারপর আস্তে আস্তে শার্টের বোতাম খুললো সব, তারপর শার্ট খুলে রাখলো নিচে, তারপর আবার উপুড় করে শুয়ে দিলো অপূর্বকে। ফর্সা পিঠটার ক্ষতের দিকে চোখ যেতেই আঁতকে উঠলো প্রিয়তা। ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। এভাবে কে আঘাত করলো অপূর্বকে? কেনই বা করলো এমন।’

প্রিয়তা বেশি ভাবলো না আস্তে আস্তে ফাস্ট এইড বক্সটা খুলে স্যাভলন আর তুলো দিয়ে ক্ষতের জায়গাগুলো পরিষ্কার করে মলম দিতে লাগলো সে।’

নিকষ কালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। ঝিরিঝিরি শব্দে বৃষ্টি পড়ছে খুব, আকাশটা কালো মেঘে ঢাকা, গাছের পাতার শাঁ শাঁ শব্দ, হিম শীতল ভেজা বাতাসে জানালার পর্দারা নড়ছে খুব, রুমে কারেন্ট নেই যার দরুন এই ঝড়ে ভাসা প্রকৃতির ভিড়েই মোমবাতির বিন্দু বিন্দু আলোতে নিজের কাজ করছে প্রিয়তা। মাথার ভিতর হাজারো প্রশ্ন সাথে বুক ভরা বিষন্নতা নিয়েই অপূর্বের চিকিৎসা করছে সে।’

আর অপূর্ব আঘাতে জর্জরিত হয়ে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়,কেউ যে খুব যত্ন নিয়ে তার চিকিৎসা করছে এটা আপাতত চোখে পড়লো না তার। চোখে পড়লে হয়তো এই মুহূর্তে খুব খুশি হতো সে।’
____

সূর্যের প্রখর তেজ। রোদ্দুর উঠেছে আকাশ ছুঁয়ে। সেই রোদ্দুরের ছোঁয়া আসছে জানালা বেয়ে। পাখি ডাকছে কিচিরমিচির শব্দ করে, পানিতে থইথই করছে বাড়ি পিছনে নিচু জায়গাটা। তবে কাল রাতে যে খুব ভয়ংকর ভাবে ঝড় উঠেছিল তার ছিটেফোঁটাও বোঝা যাচ্ছে না রুমের ভিতর থেকে। কারন রুমটা যে আলোতে ভরপুর।’

আর এসবের মাঝেই বিছানার ওপর মাথা রেখে নিচে বসে ঘুমাচ্ছে প্রিয়তা। কাল শেষ রাতের দিকে অপূর্বকে পিঠে মলম আর ব্যান্ডেজ লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল প্রিয়তা। আর অপূর্বও সেই যে চোখ বুঝিয়েছিল আর খোলে নি। বেঘোরে ঘুমিয়ে ছিল সেও।’

হঠাৎই চোখ খুললো অপূর্ব, কিছু একটা মনে পড়লো তার। কাল রাতের হুট করে আসা এটাকের কথা মনে পড়লো অপূর্বের, আচমকাই অপূর্ব শোয়া থেকে উঠে বসলো, কাল রাতে কার লোক ছিল ওই গুন্ডাগুলো, কার ইশারায় এইভাবে তাকে পিছন থেকে এটাক করলো। তাকে এইভাবে আঘাত করলো জানতেই হবে। আর ওই ফোন কলটাও কার ছিল এটাও জানতে হবে অপূর্বকে।’

ফ্লাসবেক কাল রাতে,

অপূর্ব যখন গাড়ি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটছিল তখন একাই ছিল সে। তবে মাথায় ছিল প্রিয়তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। মেয়েটার সাথে কথা হয় না তার এক সপ্তাহ যাবৎ। অপূর্ব ইচ্ছে করেই নিজের ফোন বন্ধ রাখে, নিজেই কথা বলে না প্রিয়তার সাথে, অজানা ভয় তাকে হানা দেয় খুব। প্রেম, ভালোবাসা নামক যেদিকে পা বাড়াতে চায় না সে সেদিকেই বার বার ঝুকে পড়ছিল অপূর্ব, বলতে গেলে মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল অপূর্ব। না পারছিল প্রিয়তাকে মনের কথা খুুলে বলতে না পারছিল প্রিয়তাকে ছেড়ে দূরে সরতে।’

অপূর্ব যখন এসব ভাবনায় মগ্ন হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই ইচ্ছাকৃতভাবে পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে অপূর্বকে। হুট করে এমনটা হওয়াতে পুরোই অপ্রস্তুত ছিল অপূর্ব। যার দরুন তার গাড়ি ধাক্কা খায় একটা গাছের সাথে। তবে অপূর্ব বেঁচে যায় গাড়ি থেকে নামেও তখনই কতগুলো গুন্ডা এসে ঘিরে ধরে অপূর্বে। কোনো কারন ছাড়াই তুমুল বেগে মারামারি হয় তাদের সাথে কিন্তু শেষের দিকে তিনটে ছেলে ছুড়ি দিয়ে পিঠে আঘাত করে অপূর্বকে। আঘাত করেই পালিয়ে যায় তারা। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা কল আসে অপূর্বের ফোনে। উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলে কেউ,

‘ কিরে আঘাত পেয়েছিস তো অপূর্ব? তোকে আঘাত পেতে দেখলে না আমার বেশ লাগে। যদিও দূর থেকে দেখছি। তবে একটা কথা মনে রাখবি আজকের টা ডেমো ছিল শুধু। তুই যেভাবে আমায় আঘাত দিয়েছিস আমিও ঠিক সেইভাবেই তোকে আঘাত দিবো অপূর্ব। জাস্ট একটু সময়ের অপেক্ষা।’

বলেই হাসতে থাকে ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিটি। অপূর্ব যেন এই হাসিটা চেনে, সাথে কন্ঠ স্বরটা শুনেও খানিকটা চমকায়। বিচলিত কন্ঠে বলে,

‘ কে?’

উওরে জবাব দেয় না ফোন কেটে দেয় তক্ষৎনাত।’

আকাশে তখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, অপূর্ব বুঝেছিল বৃষ্টি নামবে, তার সাথে এও বুঝেছিল তার সাহায্য লাগবে আর সেই তখনই প্রিয়তার বাসার কথা মনে পড়ে অপূ্র্বের। ব্যস কোনো কিছু না ভেবেই চলে আসে এখানে।’

পর পর কথা ভেবেই আশেপাশে তাকালো অপূর্ব। না জানি প্রিয়তা মেয়েটাকে কতটা বিপাকে ফেলেছিল অপূর্ব। অপূর্ব নিজের দিকে তাকালো শরীরে শার্ট নেই ব্যান্ডেজ করা শুধু। অপূর্ব কি ভেবে যেন মুচকি হাসলো। তারপর তাকালো প্রিয়তার ঘুমন্ত মুখের দিকে। এক অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হলো অপূর্বের মাঝে। প্রিয়তার কপাল জুড়ে ছড়িয়ে ছিল কিছু অবাধ্য চুল। অপূর্ব কি ভেবে যেন চুলগুলো প্রিয়তার কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে খুব স্বল্প স্বরে বললো,

‘ তুমি বড্ড ভালো মেয়ে,
আর আমি খারাপ।
তুমি খুব সাধারণ আর আমার শত্রুতে ভরা।
তুমি চুপচাপ, আমি গম্ভীর।
তোমার পৃথিবী অন্ধকারের ভিড়েও রঙিন খুব আর আমার রঙিনের ভিড়ে কালো রঙের ধূসরতা।
তাই এত অমিলের মিলন না হওয়াই উওম।’
___

হঠাৎই ঘুমের ঘোরে কিছু অস্পষ্টনীয় কথা কানে বাজতেই ঘুম ভাঙলো প্রিয়তার। চোখের সামনেই অপূর্বকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো সে,

‘ আপনি কি কিছু বললেন অপূর্ব?’

অপূর্ব কোনো রিয়াকশন দেয় না। খুব সরলভাবেই বলে,

‘ কই না তো।’

প্রিয়তা মাথা তুলে বসে। কতক্ষণ চুপ থেকে ফট করেই বলে উঠল আবার,

‘ আমি আপনার চোখে কিছু দেখি অপূর্ব সেটা কি আধও সত্যি?’

অপূর্ব কি চমকালো, মোটেও চমকালো না উল্টো খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,

‘ মানে?’

#চলবে…..

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩০
_________________

‘ আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারেন নি অপূর্ব?’

খানিকটা হতাশা ভরা চেহারা আর কন্ঠ নিয়ে কথাটা বলে উঠল প্রিয়তা অপূর্বকে। আর প্রিয়তার কথা শুনে অপূর্ব বললো,

‘ আমার কি তোমার কথাটা বোঝার খুব দরকার ছিল, না বুঝলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে প্রিয়তা।’

অপূর্বের কথা শুনে অসহায় ফিল করলো প্রিয়তা। তবে কি সত্যি সে ভুলভাল ভাবছে। প্রিয়তা আর বেশি ভাবলো না। টপিক চেঞ্জ করে বললো,

‘ আপনায় কিছু বুঝতে হবে না অপূর্ব। আপনার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে আপনি বসুন আমি এক্ষুনি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করছি।’

বলেই উঠে দাড়িয়ে চলে গেল প্রিয়তা। আর অপূর্ব শুধু তাকিয়ে রইলো প্রিয়তার যাওয়ার পানে। একা মনে আওড়ালো খুব,

‘ তুমি আমার চোখ দেখে সব বুঝে গেলে মেয়ে? আমার বোধহয় আর তোমার থেকে দূরে যাওয়া হলো না। কিন্তু,,,

থেমে গেল অপূর্ব। হঠাৎই চোখ গেল অপূর্বের তার ঘুমানো বালিশের একদম কর্নারে আটকে থাকা মোবাইলটার দিকে। অপূর্ব মোবাইলটা দেখেই দ্রুত হাতে নিলো তারপর আকিবের নাম্বারে ফোন করলো। আকিব তখন বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে ছিল। কাল বাড়ি ফিরে সাড়ারাত আরোহীর সাথে বক বক করতে ব্যস্ত ছিল সে, যার দরুন এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। প্রথম কলটা বাজতে বাজতেই কেটে গেল। পরে আবার কল বাজলো এবারের কলটায় আকিবের ঘুম ভাঙলো, কোনো মতে ফোনটা সাতরে হাতে নিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বললো,

‘ হেলু,,

সঙ্গে সঙ্গে অপরপ্রান্তে থাকা অপূর্ব কর্কশ কন্ঠে থমকানো স্বরে বললো,

‘ ফোন ধরতে এতক্ষণ সময় লাগে আকিব?’

অপূর্ব কথাটা বলতে দেরি হলো কিন্তু আকিবে থমকে গিয়ে খাট থেকে পড়ে যাওয়া দেরি হলো না। এই সকাল বেলা অপূর্ব তাকে ফোন করেছে কেন। আকিব নিচে পড়ে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে বললো,

‘ ও মা আমার কোমড়।’

আকিবের কথাটা শুনলো অপূর্ব। বললো,

‘ তুমি পড়ে গেলে আকিব?’

উওরে আমতা আমতা করে বললো আকিব,

‘ ইয়ে না মানে ভাই আমি ঠিক আছি।’

বলেই ঘড়ির দিকে তাকালো আকিব। দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আর সে তো রোজ প্রায় এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকে অপূর্বদের বাসায় যায় তাহলে আজ এত দ্রুত ফোন করলো ভাই। তবে কি কাল ভাই দ্রুত যাওয়ার কথা বলেছিল আর আকিব তা ভুলে গেছে। আকিব শুঁকনো ঢোক গিলে বললো,

‘ আমাদের কি আজ দ্রুত কোথাও যাওয়ার কথা ছিল ভাই আমি না ভুলে গেছি।’

‘ কোথাও যাওয়ার নেই আকিব কিন্তু এখন তোমায় আসতে হবে।’

‘ কোথায় ভাই?’

আকিবের কথা শুনে অপূর্ব আশেপাশে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,

‘ প্রিয়তারদের বাড়ি আমি এখানেই আছি।’

বলেই ফোন কান থেকে দূরে সরালো অপূর্ব। কারন সে জানে আকিব এখন কি বলবে।’

অন্যদিকে আকিব। অপূর্ব কথা শুনে চোখ বড় বড় করে জোরে আওয়াজ করে বললো,

‘ কিইইইই?’

তিন সেকেন্ড যাওয়ার পর অপূর্ব আবার ফোনটা কানে ধরলো। বললো,

‘ তোমায় সব বুঝিয়ে বলবো আকিব আগে তুমি আসো গাড়িতে বসে সব বলছি।’

এবার আর বেশি না ভেবেই বললো আকিব,

‘ ঠিক আছে ভাই আমি আসছি।’

‘ হুম দ্রুত এসো।’

বলেই ফোন কাটলো অপূর্ব। আর আকিবও কিছুক্ষন হেবলা কান্তের মতো বসে থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। কেন যেন তার মনে হচ্ছে কাল কিছু একটা ঘটেছিল তার অপূর্ব ভাইয়ের সাথে।’
___

ফোন কেটে চুপচাপ বসে আছে অপূর্ব। গভীর ভাবনায় মগ্ন সে, কালকের ফোন কলের ভয়েসটা খুবই চেনা চেনা লাগছে অপূর্বের। কে ছিল ব্যাক্তিটি?’ আর কার ক্ষতি করেছে অপূর্ব। অপূর্ব চোখ বন্ধ করে তার মনে থাকা পুরো জীবনের ঘটে যাওয়া মুহূর্তগুলোর কথা ভাবলো। কতক্ষণ ভাবতেই বেশ অদ্ভুত স্বরে বললো,

‘ আহিল তুই? তবে কি তুই আমার ক্ষতি চাস কিন্তু তা কি করে সম্ভব তুই তো বিদেশ গিয়েছিলি তবে কি ফেরত এসেছিস। আমায় আজও ভুল বুঝে চলেছিস ভাই।’

ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো অপূর্ব।’

‘ আমরা খুব খারাপ একটুতেই মানুষের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু বুঝি না।’

….

গ্র্যান্ডমার রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে রুটি বেলছে প্রিয়তা। খানিকটা ভয়, খানিকটা হতাশা নিয়েই কাজ করছে সে। আচ্ছা প্রিয়তার কি উচিত অপূর্বের কথা গ্র্যান্ডমাকে বলে দেওয়া। কিন্তু গ্র্যান্ডমা যদি তাকে ভুল বুঝে তখন। আর অপূর্ব তো থাকছে না এখানে কিছুক্ষন পরই চলে যাবে হয়তো এতক্ষণে নিশ্চয়ই আকিব ভাইয়াকে ফোন করা হয়ে গেছে ওনার।’

গ্র্যান্ডমা নিজ রুমে বসে আছে চুপচাপ। প্রিয়তা মুড়ি আর বাতাসা দিয়ে এসেছে আপতত সেগুলোই চিবুচ্ছে গ্র্যান্ডমা। প্রিয়তা দ্রুত নিজের কাজ সারতে লাগলো যদিও গ্র্যান্ডমা তেমন একটা প্রিয়তার রুমে যায় না প্রিয়তাই থাকে এদিকটায় কিন্তু আজ যদি যায় তখন। ভাবলেও বুক কাঁপছে প্রিয়তার। তারওপর আয়মান যখন তখন চলে আসতে পারেন উনি দেখে ফেললে তো চরম বিপদ। না জানি কতশত প্রশ্ন করতেন।’

প্রায় আধ ঘন্টা পর আটার রুটি আর আলুভাজি করলো প্রিয়তা। তারপর আগে গ্র্যান্ডমাকে দিয়ে চুপিচুপি চললো প্রিয়তা নিজের রুমের উদ্দেশ্যে।’

ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে খুব সাবধানে খাটে বসলো অপূর্ব। এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবে না এমনিতেই খুব বিপাকে ফেলেছে সে প্রিয়তাকে। অপূর্ব নিজের ছেঁড়া শার্টটা নিলো কিন্তু পরার মতো উপযোগী নয় সেটা। অপূর্ব আবার তার ফোন ধরলো, আবার কল করলো আকিবকে। আকিব ফোন ধরতেই বললো,

‘ আকিব আমার জন্য আসার সময় একটা শার্ট বা টিশার্ট নিয়ে এসো আমি যেটা পড়া ছিলাম সেটা ছিঁড়ে গেছে।’

অপূর্বের এবারের কথা শুনে আকিব শেষ শার্ট ছিঁড়ে গেছে, শার্ট ছিঁড়লো কেমনে তবে কি ভাই ছিঃ ছিঃ কিসব ভাবছে আকিব। তোর অপূর্ব ভাই যথেষ্ট ভালো আকিব তুই দিনে দিনে খারাপ হচ্ছিল। আকিব নিজেকে অনেক কিছু বোঝালো তারপর বললো,

‘ আচ্ছা ভাই।’

উওরে অপূর্বও শুধু ‘হুম’ বলে ফোনটা কেটে দিলো। সে জানে এই আকিব তাকে নিয়ে এখন ভুলভাল ভাবছে, আপাতত ভাবুক সামনে এলে না হয় বোঝানো যাবে।’

‘ যতক্ষণে আকিব ভাইয়া আপনার জন্য শার্ট না নিয়ে আসে ততক্ষণ না হয় এটা পড়ে নিন অপূর্ব?’ (আয়মানের শার্টটা দেখিয়ে)

হঠাৎই নিজের ভাবনার মাঝখানে প্রিয়তার কণ্ঠ শুনতেই চোখ তুলে তাকালো অপূর্ব। প্রিয়তার হাতে খাবার আর একটা খয়েরী রঙের শার্ট দেখে বললো,

‘ এটা কার শার্ট?’

‘ গ্র্যান্ডমার নাতির আইথিংক আপনার হয়ে যাবে।’

অপূর্ব চুপ রইলো, অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,

‘ ঠিক আছে।’

অতঃপর অপূর্ব শার্ট নিলো খুব সাবধানে শার্টটা জড়ালো গায়ে খানিকটা আঘাত পেয়েছে ঠিকই কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। প্রিয়তা চেয়েছিল নিজ হাতে শার্টটা পড়াতে কিন্তু অপূর্ব একা পেরে ওঠায় আর ধরে নি।’

প্রিয়তা ড্রেসিং টেবিলের উপর মাত্র রাখা খাবারের প্লেটটা বিছানার উপর রাখলো তারপর অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘ খেয়ে নিন অপূর্ব?’

উওরে অপূর্ব বললো,

‘ আমি এখন খাবো না প্রিয়তা।’

‘ এটা কেমন কথা কাল রাত থেকে আপনি না খাওয়া খিদে টিদে লাগে নি নাকি।’

‘ সত্যি বলতে কি খিদে খুব লেগেছে কিন্তু কেন যেন খেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘ এটা কোনো কথা,

হাসে অপূর্ব। প্রাণ খোলা এক মিষ্টি হাসি দিলো সে। তার শরীরের আঘাতের অংশে বিষাক্ত যন্ত্রণা হচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। প্রিয়তা শুধু তাকিয়েই রইলো অপূর্বের মুখের দিকে। যা দেখে অপূর্ব বললো,

‘ এভাবে তাকিয়ে থেকো না মেয়ে আমি কিন্তু প্রেমে পড়ে যাবো।’

প্রিয়তা অবাক হয়ে তাকায় অপূর্বের দিকে, তারপর ফিক করেই হেঁসে দেয় আবার এই অপূর্ব ঠিক হওয়ার নয়। প্রিয়তাকে বিপাকে ফেলতে যেন তার বেশ লাগে।’

প্রিয়তা তার হাসি থামিয়ে দিয়ে বললো,

‘ এবার খেয়ে নিন অপূর্ব।’

অপূর্ব শোনে তারপর বাধ্য ছেলের মতোই খেতে শুরু করলো সে। অপূর্বের খাওয়ার মাঝেই প্রিয়তা প্রশ্ন করে,

‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো অপূর্ব?’

উওরে অপূর্বও খেতে খেতে জবাব দেয়,

‘ হুম বলো,

অপূর্বের কথা শেষ হতেই প্রিয়তা বেশি না ভেবেই বললো,

‘ কাল রাতে আপনার কি হয়েছিল অপূর্ব? আপনায় আঘাত কে করেছিল? আপনার আঘাত দেখে যা বুঝলাম কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবেই আপনায় আঘাত করেছে কে করেছে এমনটা?’

প্রিয়তার কথাগুলো খুব মন দিয়েই শুনলো অপূর্ব। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,

‘ তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে অনেক দিনই হলো কিন্তু তুমি হয়তো আমার বিষয়ে তেমন কিছুই জানোও আজ একটা বিষয় জানাই তোমায়, আমি একজন রাজনীতিবিদ প্রিয়তা। যে প্রয়োজন মনে করলে মানুষও খুন করতে পারে।’

প্রিয়তা আটকে গেল, থমকালো, ভড়কালো, চরমভাবে অবাক হলো। একা মনে বিড়বিড় করলো, ‘ কি অপূর্ব একজন রাজনীতিবিদ।’ প্রিয়তা কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে বললো,

‘ তার মানে এই আঘাতগুলো,

‘ হুম বিরোধীদলেরই কেউ দিয়েছে।’

প্রিয়তা আর কিছু বলতে পারলো না। তার বাবার কথা মনে পড়লো তার নিথর দেহের কথা মনে পড়লো প্রিয়তার। কারন প্রিয়তার বাবাও একসময় একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। প্রিয়তা বাবার মৃত্যুর সময় এই জিনিসটা না জানলেও বা না বুঝলেও মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে জেনেছে সাথে এটাও বুঝেছে বিরোধী দলের কোনো লোকই তার বাবাকে মেরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। আর আজ কি না অপূর্বও রাজনীতির দলেরই একজন হলো। প্রিয়তার কেমন যেন শুন্য শুন্য লাগছে, সে তো ভালোবাসে অপূর্বকে কিন্তু অপূর্বের পেশা। প্রিয়তা ছল ছল চোখে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে কেমন উদাসীন কন্ঠে বললো,

‘ রাজনীতিবিদ হওয়া কি খুব জরুরি ছিল অপূর্ব?’

প্রিয়তার কথা আর কন্ঠ শুনে অপূর্ব তাকালো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার ছলছল চোখের দিকে। প্রিয়তার চোখে পানি দেখতেই ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো অপূর্বের। খুব অদ্ভুত স্বরে বললো,

‘ তুমি কাঁদছো কেন?’

প্রিয়তা নিজেকে সামলালো চোখের পানিটুকু মুছে বললো,

‘ না আমি কাঁদছি না তো চোখে কি যেন একটা পড়েছে অপূর্ব?’

প্রিয়তার কথা কি অপূর্বের পছন্দ হলো মটেও হলো না। অপূর্ব খুব গম্ভীর স্বরে বললো,

‘ তুমি মিথ্যে বলতে জানো না মেয়ে?’

অপূর্বের কথা শুনে প্রিয়তা কেন যেন নিজেকে সামলাতে পারলো না। চোখ বেয়ে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো তার। প্রিয়তা খুব বেশি ইমোশনাল হলে অপূর্বের হাত ধরে বললো,

‘ আমি আপনায় ভালোবাসি অপূর্ব?’

#চলবে……

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩১
_________________

বেশ বিষন্ন মাখা মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা অপূর্বের মুখের দিকে। তার ফট করে বলে ফেলা ভালোবাসি কথাটা শুনে অপূর্বের রিয়াকশনটা কেমন হলো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কারন অপূর্বের দৃষ্টি শান্ত, মুখের ভাব ভঙ্গিও শুরু থেকে যেমন ছিল এখনও তেমনই। প্রিয়তা বুঝচ্ছে না অপূর্বকে ইমোশনাল হয়ে ভালোবাসি শব্দটা উচ্চারণ করে ভুল করলো কিনা। প্রিয়তার হুস আসলো হুট করেই নিজের হাতটা অপূর্বের হাতের ওপর থেকে সরিয়ে নিলো সে। বললো,

‘ আমি একটু আসছি,

বলেই দ্রুত বেগে বসা থেকে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল প্রিয়তা। কেমন একটা অসস্থিকর ফিলিংস হচ্ছে তার। সে কি ভুল করলো তবে অপূর্বকে তার চেপে রাখা মনে কথাগুলো বলে। প্রিয়তা চলে গেল, আর অপূর্ব চুপচাপ বসে রইলো। যেন নীরবতাই তার বর্তমান কাজ, অপূর্ব মুখে হাত দিলো এমনটা নয় অপূর্ব বুঝতে পারে নি প্রিয়তা তাকে পছন্দ করে। অপূর্ব অনেক আগে থেকেই বুঝেছিল প্রিয়তার চোখই তো দেখা হলে কথা বলতো। আর অপূর্বের চাহনীও যে প্রিয়তা বুঝতে পারে এটাও বুঝে ফেলেছে অপূর্ব। অপূর্ব যে মেয়েটাকে ভালোবাসে সেই মেয়েটাও অপূর্বকে ভালোবাসে কথাটা শোনার পর অবশ্যই অপূর্বের খুব খুশি হওয়ার কথা কিন্তু অপূর্ব খুশি হতে পারছে না বিশেষ করে কাল রাতের ঘটনার পর। এবার কি করবে অপূর্ব? অপূর্বের চোখে মুখে বিস্ময়ের আভাস ভেসে উঠলো। অপূর্ব তার চোখ বন্ধ করে ফেললো। কোথাও গিয়ে চরম লেভেলের ভয় কাজ করছে অপূর্বের মাঝে। না অপূর্বকে কেউ ভালোবাসতে পারে না। অপূর্বদের কখনো নিজের জীবনে কাউকে আনতে নেই, এতে তো অপূর্ব আর জীবনে আসা ব্যক্তি দুজনেরই ক্ষতি। কিন্তু অপূর্ব রাজনীতিবিদ কথা শোনার পর প্রিয়তা এত ইমোশনাল হয়ে পড়লো কেন?’

অপূর্ব একা মনে কথাগুলো ভেবে চোখ খুলে ফেললো। এমন সময় ফোনটা বাজলো তার আকিব কল করেছে অপূর্ব বেশি না ভেবেই কলটা ধরলো। অপূর্ব কল ধরতেই আকিব বলে উঠল,

‘ ভাই আমি এসেছি ভিতরে তো গাড়ি যাবে না।’

‘ তুমি ওখানেই থাকো আকিব আমি আসছি।’

‘ আচ্ছা ভাই।’

বলেই ফোন কাটলো আকিব।’

আর অপূর্ব কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। প্রিয়তার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে অপূর্বও না ইমোশনাল হয়ে পড়ে। কিন্তু অপূর্বকে কি এত দ্রুত ইমোশনাল করা সহজ, তারপরও ভয় লাগে। ইদানীং অপূর্বের ভয়ের পাল্লা কেমন যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই ভয়ই তো তাকে না দিচ্ছে কাছে যেতে না দিচ্ছে দূরে যেতে আর নাহি দিচ্ছে ভালো থাকতে।’

অপূর্ব না কিছু ভেবে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আশেপাশে তাকালো হঠাৎই চোখ গেল প্রিয়তার রুমের টেবিলটার দিকে। অপূর্ব বেশি না ভেবেই অগ্রসর হলো টেবিলটার দিকে।’

___

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা চোখ বেয়ে অজস্র পানি পড়ছে তার। প্রিয়তার খুব কষ্ট হচ্ছে, কষ্টটা ঠিক কোন বিষয়টা নিয়ে এটাই বুঝতে পারছে না সে। অপূর্ব একজন রাজনীতিবিদ এটা জানার পর থেকেই প্রিয়তার খারাপ লাগছে বাবার মৃতদেহটার কথা মনে পড়ছে। প্রিয়তা জানে, এই রাজনীতিবিদদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই যখন তখন যে কারো হাতে মৃত্যু ঘটতে পারে তাদের। আর অপূর্বের কিছু হয়ে গেলে তখন। না না প্রিয়তা এসব কি ভাবছে? ভালোবাসা পাওয়ার আগেই হারানোর ভয়। কিন্তু প্রিয়তা এখন অপূর্বের মুখোমুখি হবে কি করে? এইভাবে ফট করে ভালোবাসি কথা বলে চরম লেভেলের ভুল করেছে প্রিয়তা একদমই ঠিক হয় নি কাজটা।’

হঠাৎই প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই পিছন থেকে বললো গ্র্যান্ডমা,

‘ তোমার রুমে কি কাল কেউ ছিল প্রিয়তা?’

প্রিয়তা যেন চমকালো, ভড়কালো, অবাক হলো। পিছন ঘুরে বললো,

‘ কই না তো কে থাকবে গ্র্যান্ডমা।’

‘ আমি একবার তোমার রুমে যেতে চাই প্রিয়তা?’

প্রিয়তার বুকটা যেন কেঁপে উঠলো এখন কি করবে সে। কি জবাব দিবে গ্র্যান্ডমাকে। প্রিয়তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বললো গ্র্যান্ডমা,

‘ কি হলো চলো তোমার রুমে যাই প্রিয়তা?’

উত্তরে খানিকটা চমকানো গলায় বললো প্রিয়তা,

‘ হুম চলো কেন নয়।’

বলেই ভয়ে ভয়ে প্রিয়তা চললো গ্র্যান্ডমাকে নিয়ে। এদিকে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হচ্ছে প্রিয়তার। মনে মনে বলছে খুব অপূর্ব যেন এখন ওয়াশরুমে থাকে।’

অন্যদিকে গ্র্যান্ডমা এগিয়ে চলছেন প্রিয়তার রুমের দিকে। কতক্ষন আগে এখান থেকে কাউকে যেতে দেখেছে গ্র্যান্ডমা যদিও সেই সময় তার চোখে চশমা ছিল না সত্যি দেখেছে নাকি ভুল ঠিক বুঝতে পারছেন না তাই সন্দেহের বসেই প্রিয়তার রুমে যাওয়া তার।

প্রিয়তা তার হাত কচলাচ্ছে, গ্র্যান্ডমা অপূর্বকে দেখে ফেললে কি হবে কে জানে। অতঃপর প্রিয়তা আর গ্র্যান্ডমা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলো প্রিয়তার রুমের কাছে দরজা চাপানো ছিল। প্রিয়তার দরজার কাছাকাছি আসতেই খানিকটা উচ্চস্বরে বললো,

‘ দাদিমা তুমি এত দ্রুত হেঁটে কেন আমার রুমে যাচ্ছো একটু আস্তেও তো হাঁটতে পারো।’

উত্তরে গ্র্যান্ডমা কিছু না বলেই দ্রুত প্রিয়তার রুমের দরজা সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে ফেললেন। আশপাশে তাকাতেই মুচকি হাসলেন তিনি। কারন তার সন্দেহ ভুল কেউ নেই প্রিয়তার রুমে। তার মানে চোখে চশমা না থাকায় ভুলই দেখেছেন তিনি। প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে গ্র্যান্ডমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ দাদিমা কেউ কি আছে?’

প্রিয়তার কথা শুনে গ্র্যান্ডমাও বললেন,

‘ না আমার চোখের ভুল ছিল বোধহয়।’

এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো আয়মান। গ্র্যান্ডমা আর প্রিয়তাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,

‘ কি ব্যাপার তোমরা দুজন ওখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো গ্র্যান্ডমা?’

হুট করেই আয়মানের কন্ঠ কানে আসতেই গ্র্যান্ডমা, প্রিয়তা দুজনেই তাকালো আয়মানের দিকে। গ্র্যান্ডমা তো খুশি হয়ে বললো,

‘ তুমি এসেছো আয়মান?’

আয়মানও খুশি হয়ে বললো,

‘ হুম গ্র্যান্ডমা। কিন্তু তোমরা দুজন এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলে?’

উত্তরে আয়মানকে নিজের রুমের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো গ্র্যান্ডমা,

‘ তেমন কোনো ব্যাপার নয় আয়মান ওই একটু প্রিয়তার রুমে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকতে যাচ্ছিলাম।’

গ্র্যান্ডমার কথা শুনে একপলক প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে এতটুকুই বললো আয়মান,

‘ ওহ!’

গ্র্যান্ডমা আর আয়মান চলে গেল আর প্রিয়তা কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত ঢুকলো নিজের রুমে। অপূর্ব কোথায় লুকিয়েছে দেখতে হবে তাকে।’

প্রিয়তা রুমে ঢুকে আশেপাশে অপূর্বকে খুঁজতেই অবাক কারন রুমে অপূর্ব নেই প্রিয়তা ওয়াশরুম, বেলকনি, রান্নাঘর সবজায়গায় দেখলো কিন্তু অপূর্ব কোথায়ও নেই। তাহলে অপূর্ব গেল কই?’ প্রিয়তার চোখ যখন অস্থির হয়ে অপূর্বকে খুঁজছিল তখনই প্রিয়তার চোখ গেল তার টেবিলটার দিকে অপূর্বের গায়ে জড়ানো খয়েরী শার্টটাও সেখানে রয়েছে তার মানে অপূর্ব সত্যি সত্যিই চলে গেছে। আকিব এসে পড়েছিল বোধহয়।’

প্রিয়তা এগিয়ে গেল তার টেবিলটার দিকে কিছু একটা আছে সেখানে। হয়তো অপূর্বের দিয়ে যাওয়া কোনো মেসেজ।’

____

ঘড়িতে এগোটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। আকিবের আনা ক্রিম কালার ফুলহাতার টিশার্ট পড়ে গাড়িতে বসে আছে অপূর্ব। কতক্ষন আগেই গাড়িতে এসে বসেছে সে। অপূর্ব ঠিকভাবে বসতেই আকিব গাড়ি চালাতে শুরু করলো কতদূর এগোতেই বললো আকিব,

‘ ভাই কাল রাতে কি হয়েছিল আপনি প্রিয়তার এখানে কেন উঠে ছিলেন আর এত আঘাত কি করে পেলেন।’

উত্তরে গম্ভীর আওয়াজেই বললো অপূর্ব,

‘ প্রতিশোধের আঘাত দিয়েছে আকিব।’

আকিব যেন চরম ভাবে অবাক হলো। বললো,

‘ কি ভাই?’

‘ পুরনো দিনের ভুল বোঝাবুঝিটা বোধহয় আবার জাগ্রত হয়েছে আকিব।’

অপূর্বের কথা শুনে আকিব অনেকক্ষন চুপ থেকে বললো,

‘ সে ফিরে এসেছে ভাই?’

‘ হয়তো। আমার একটা ইনফরমেশন চাই আকিব?’

অপূর্বের কথা শুনে বিস্ময়ের ভিড়েই বললো আকিব,

‘ কোনো ব্যাপার না ভাই হয়ে যাবে।’

উত্তরে অপূর্ব আর কিছু বলে না। নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে জানালার দিকে তাকিয়ে রয় নিশ্চুপ প্রকৃতির দিকে। এই মুহূর্তে প্রিয়তাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না অপূর্বের। এতক্ষণে নিশ্চয়ই প্রিয়তা তার ক’অক্ষরের লিখে আসা চিরকুটটা পেয়েছে।’

‘ চিঠিটা পড়ে আঘাতটা কি খুব পাবে তুমি?’
___

নীরবে অপূর্বের লিখে যাওয়া চিরকুট হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে গেছে অপূর্ব,

‘ তুমি খুব ভালো মেয়ে কিন্তু কি বলো তো মাঝে মধ্যে কিছু কিছু অনুভূতিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। দুনিয়া বড্ড নিষ্ঠুর মায়াবিনী, এখানে ভালোবাসার মূল্য খুব কঠিনভাবে দিতে হয়। তাই আমি চাই না আমার জন্য তোমার জীবনটা কঠিন হোক, জটিলতায় ভেসে বেড়াক। আমার জীবন রঙিন নয় কিন্তু তোমার জীবন রঙিন হোক। পারলে আমায় ভুলে যেও,

আর হ্যাঁ সবসময় ভালো থাকবে। কারন তোমার জীবনটাকে যে সুন্দর করতে হবে। আমি আছি, কাছ থেকে না হলেও দূর থেকে আমি আছি তোমার পাশে। সবশেষে বলবো আমার সেবা করার জন্য শুকরিয়া প্রিয় প্রেমবালিকা। তোমার জীবনটা আমিহীন সুখের হোক।’

ইতি,
~ অপূর্ব!’

প্রিয়তা অপূর্বের চিরকুটটা বুকে জড়িয়ে ধরলো। খারাপ লাগছে তার। তার প্রথম ভালোবাসা বোধহয় অসমাপ্তই থেকে যাবে। প্রিয়তা কান্না ভেজা মুখশ্রী নিয়েই বললো,

‘ আমার সুখ চাইলেন অপূর্ব কিন্তু আমার সুখটা যে আপনি এটা বুঝলেন না।’

____

দুপুরের কড়া রোদ্দুরে আচ্ছন্ন চারপাশ। গাছের পাতা দুলছে থেকে থেকে বার বার, পাখিরা উড়ছে মন খুলে, বাতাস বইছে মন ছুঁয়ে, ঘাসের ডগায় ছোট্ট ছোট্ট ঘাসফড়িংরা লাফাচ্ছে বারংবার। আর এসবের ভিড়েই ভার্সিটি শেষে একটা বড় গাছের নিচে সাদা বেঞ্চের ভিড়ে বসে আছে প্রিয়তা। চোখে মুখে বিষন্নতা। আজ চারদিন হলো অপূর্বের সাথে তার দেখা নেই যোগাযোগ নেই। ভালোবাসা মানুষকে খুব কাঁদায় বেশি কাঁদায় প্রিয় মানুষটার শূন্যতায়, তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায়। প্রিয়তা দীর্ঘ শ্বাসের নিঃশ্বাস ফেলে একা একা আওড়ালো,

‘ আপনি খুব খারাপ অপূর্ব। আমাকে বুঝলেন না।’

প্রিয়তার কথা শেষ হতে না হতেই পাশ থেকে খুব গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল কেউ,

‘ আমাকে খারাপ বলো না মেয়ে, আমি সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেলে তুমি কিন্তু ভয় পেয়ে যাবে।’

#চলবে….