#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩২
_________________
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা অপূর্বের মুখের দিকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ অপূর্ব মুখে মাস্ক পড়েনি খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে বসেছে সে প্রিয়তার পাশে। কিন্তু অপূর্বের কথাটা। এই লোকটা সবসময় এমন করেই কথা বলে। কিন্তু শুনতে বেশ লাগে। প্রিয়তা কিছু বলছে না চুপচাপ বসে রয়েছে শুধু।’
অন্যদিকে অপূর্ব চুপচাপ তাকিয়ে আছে প্রিয়তার মায়া ভরা সেই চোখের দিকে। যা দেখে প্রিয়তা বললো,
‘ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
উওরে অপূর্ব খুব স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,
‘ বারে কারো পাশে এসে বসেছি, যার পাশে বসেছি সেই ব্যক্তিটা আমায় খারাপ বললো অথচ তাকে আমি দেখবো না এমনটা হয় হয় নাকি। যতই হোক সাবধানতারও তো একটা বিষয় আছে।’
অপূর্বের কথা শুনে হতাশ প্রিয়তা। এই লোকটা অলওয়েজ ত্যাড়া। ঘুরিয়ে কথায় বলতেও যেন বেশ পটু। প্রিয়তা অপূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ খারাপ বললেই দেখতে হবে নাকি।’
‘ অবশ্যই হবে। যতই হোক প্রেম বালিকা বলে কথা। কখন সখন মেরে দেয় বলা যায়।’
প্রিয়তা আর জবাব দিলো না। কিছুক্ষন চুপ থেকে পুরোই উল্টোটপিকে বললো,
‘ আমি জানি অপূর্ব আপনি কেন আমায় আপনাকে ভুলে যেতে বলেছেন। আমি এটাও জানি আপনিও আমাতে আসক্ত। শুধু পরিস্থিতির জন্য হয়তো কাছে আসতে চান না। আপনার চিরকুট, আপনার কথা বলার ধরন, আপনার চোখ সবই বুঝতে পারি আমি। আপনিও আমায় ভালোবাসেন তাই না অপূর্ব?’
অপূর্ব জবাব দেয় না চুপ করে রয়। এই প্রশ্নের উত্তর অপূর্বের কাছে বারংবার বাজছে হা বাসি। কিন্তু মুখ ফুটে বলছে না। অপূর্বকে চুপ থাকতে দেখে প্রিয়তার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। প্রিয়তা সামনের দিকে তাকালো। খুব শান্ত স্বরেই বলতে লাগলো,
‘ আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। নতুনই ভর্তি হয়েছি কেবল। আনুমানিক প্রায় তিন চার বছর আগের কথা। আমার বাবাও আপনার মতো একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন অপূর্ব। আমি আর আমার বুবু বাবা মায়ের দুই সন্তান ছিলাম। বাবা আমাদের দুই বোনকেই ভীষণ ভালো বাসতেন। বাবা আমাকে আদর করে ‘পিহু’ বলে ডাকতেন। বাবা মাকেও ভীষণ ভালোবাসতেন শুনেছিলাম তাদের নাকি লাভ ম্যারেঞ্জ হয়েছিল। যাই হোক সব মিলিয়ে আমাদের পরিবারটা খুব সুন্দরই ছিল। বাবার আদর, মায়ের বকা, বুবুর ভালোবাসায় পুরো ভরপুর ছিলাম আমি। কিন্তু হঠাৎ একদিন খবর এলো বাবাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথায় গেছে না গেছে কেউই কিছু বলতে পারছিল না। বাবার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও তখন চুপচাপ ছিলেন। সেইসময় আমাদের পরিবারের ওপর দিয়ে যে কি গিয়েছিল অপূর্ব তা বোঝানো সম্ভব নয়। বাবা সেই বছরেই ইলেকশনে দাড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু ইলেকশনের ১৭ দিন আগেই বাবা নিখোঁজ হলেন। তারপর টানা ১৫ দিন পর ইলেকশনের ঠিক দুইদিন আগে বাবার মরদেহ মিললো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে বেশ খানিকটা দূরে নর্দমার একটা ডাস্টবিনে মধ্যে। ব্যাস বাবা চলে গেলেন, কেউ তাকে চাকুর আঘাতে আঘাতে নিহত করেছিল। বাবার মারা যাওয়ার শোকে মাও চলে গেলেন তারপরই শুরু আমাদের দু’বোনের অবহেলা। শুরুতে শুরুতে চাঁচি বেশ ভালোবাসতেন আমাদের। কিন্তু ধীরে ধীরে চাঁচির ব্যবহার বদলে গেল খুলনায় আমাদের বড় হয়ে ওঠা স্মৃতির বাড়িটাও বিক্রি করে দিলেন। বুবুর জীবনে একটা কাপুরুষকে এনে দিলেন। জানেন তো অপূর্ব বুবুর বরটা না মোটেও ভালো না চরিত্রহীন বলতে পারেন। বুবুকে যে কতবার মারে তার হিসাব নেই। কয়েকবার আমার সাথেও,
বলেও থেমে গেল প্রিয়তা না আর বলা যাচ্ছে না নিশ্বাস ভাড়ি হচ্ছে তার খুব বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছে প্রিয়তা। চোখ ভিজে গেছে তার।’
প্রিয়তার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল অপূর্ব। অপূর্ব খুব নিশ্চুপেই বললো,
‘ তোমার সাথে কি করেছে?’
প্রিয়তা থেমে থাকে না এই কথাগুলো প্রিয়তা কাউকে বলে নি। কিন্তু কেন যেন মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো আজ। প্রিয়তা চুপ থাকে তারপর বলে,
‘ লোকটা খুব বাজে অপূর্ব। খুব বাজেভাবে স্পর্শ করতে চাইতো আমায়। সেদিন ছিল এক অন্ধকার রাত বুবু বিয়ের পর সেইবার দ্বিতীয়বারের মতো আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সচরাচর আমি দরজা আঁটকে ঘুমাই না সেদিনও ঘুমাই নি। তখন রাতে,
আর বলতে চায় না প্রিয়তা ওসব ভাবলে নিজের ওপর ঘৃণা আসে প্রিয়তার। প্রিয়তা তাও থেমে যায় নি। কান্না ভেজা স্বরে বললো,
‘ খুব বাজে। কেন যেন মনে হচ্ছে কথাগুলো বললে আপনি আমায় পছন্দ করতে চাইবেন না। কিন্তু তাও আমি বলবো আমায় বাজে ভাবে ছুঁতে চেয়েছিল অপূর্ব। কিন্তু ভাগ্য ভালো থাকায় কিছু করতে পারে নি। সেদিন আমি খুব পেয়েছিলাম বুবুকে বলবো তাও বলতে পারি নি। এরপর থেকেই শয়তানটার থেকে দূরে দূরে থাকি আমি।’
এভাবে চলছিল জীবন। চাঁচির আড়ালে পড়াশোনা করেছি। তারপর যখন দেখলাম চাঁচি আমাকে টাকার বিনিময়ে ৬০ বছরের বুড়োর সাথে বিয়ে দিতে চাইলো তখনই ঠিক করলাম এ বাড়িতে আর নয়। তাই সেদিন বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। বুবুকেও বলেছিলাম আমার সাথে আসতে কিন্তু শোনে নি। বাবার জন্যই আজ আমাদের এই অবস্থা মা নাকি অনেকবার বাবাকে রাজনীতি থেকে সরে আসতে বলেছিল কিন্তু বাবা শোনে নি যার পরিনতি আজ আমাদের দুইবোনকে ভোগ করতে হচ্ছে। তারা তো চলে গেছেন আর আমাদের দেখুন। যাই হোক,
এই কথাগুলোর বলার অর্থ এতটুকুই অপূর্ব আমার বাবাও শক্তিশালী ছিলেন কিন্তু শেষ পরিনতি সেই অন্যের হাতের মৃত্যুই হলো। বিরোধী দলের লোকেরাই এমনটা করেছিলেন। তবে জীবনে যদি খোঁজ পেতাম কে এমনটা করেছে তাহলে আমি নিজ হাতে তাকে খুন করতাম অপূর্ব। আমার জীবনে দুজন মানুষকে খুন করার খুব ইচ্ছে। এক. বুবুর বর রহিম মির্জা আর আমার বাবার খুনি।
জীবন খুব ক্ষুদ্র অপূর্ব, রাজনীতি ভালো নয়। এটা নিজের সাথে সাথে প্রিয়জনদেরও ক্ষতি করে। আপনি আমার হতে চাইলে নিশ্চয়ই এটাকে ছেড়েই আসতে হবে। হয়তো আপনি আসবেন না। তাও আমি বললাম।’
প্রিয়তার কথা শুনে অপূর্ব কিছু বলে না। নিশ্চুপ থাকে সে। অপূর্ব অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে,
‘ তোমার বাবার নাম কি ছিল প্রিয়তা?’
অপূর্বের কথা শুনে প্রিয়তাও বেশি না ভেবে বললো,
‘ আতিকুল ইসলাম।’
নামটা শুনে অপূর্বের বুকে কামড় দিলো। তিন চার বছর আগের একটা রাতের কথা ভেসে উঠলো। লোকটা আর্তনাদ করছিল কিন্তু অপূর্ব শোনে নি। অপূর্ব পুরো দমে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তবে কি সেই?’
অপূর্ব আর ভাবতে পারলো না সব এলেমেলো হয়ে গেল তার। ঘুটঘুটে নীরবতায় চললো চারপাশে প্রিয়তা ওতটুকু বলে চুপ হয়ে গেল নীরবে। তারপর কিছুক্ষন পর আবার বললো,
‘ জানেন অপূর্ব শুনেছিলাম ঢাকার একজন নেতা আশিকুর জামান যাকে সংক্ষেপে মুখার্জি মশাই ডাকা হয়। সেই নাকি তার দলের কোনো এক ছেলেকে দিয়ে মেরেছিল বাবাকে। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে ছিল কিন্তু ক্ষমতার জোরে খুনটাকে এক্সিডেন্ট বলে ধামাচাপা দেওয়া হলো। না জানি কতটা যন্ত্রণা নিয়ে বাবা দুনিয়া ছাড়লেন, কেউ হয়তো একটু এগিয়েও যায় নি সেদিন। এগিয়ে গেলে হয়তো বাবা বেঁচে যেতেন।’
বলেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো প্রিয়তা। অতঃপর প্রিয়তা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। অপূর্বের কিছু বলার অপেক্ষার না থেকেই বললো,
‘ আমায় যেতে হবে অপূর্ব। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা বলবো ভবিষ্যতে কি হবে এটা ভেবে এখনই কষ্ট পাবেন না। আমাকে যেতে হবে যাচ্ছি আমি ভালো থাকবেন অপূর্ব। আপনার জীবন আমিহীন সুখের হোক।’
বলেই আর না দাঁড়িয়ে চলে যায় প্রিয়তা। অন্যসময় হলে অপূর্ব ঠিক বলতো গাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু এই মুহূর্তে কেমন একটা হয়ে গেছে অপূর্ব। মন তাকে বার বার হানা দিচ্ছে ‘ভুল করেছিস অপূর্ব, অনেক বড় ভুল সেদিন তুই একটু মায়া দেখালে আজ হয়তো সত্যি প্রিয়তার আর ওর বুবুর জীবনটা অন্যরকম হতো। তুই অপরাধী অপূর্ব, প্রিয়তা তোকে কখনো ক্ষমা করবে না।’
অপূর্ব তার ফোনটা বের করলো আকিবকে একটা কল করে বললো,
‘ আকিব বাড়ি যাবো গাড়ি নিয়ে আমার সামনের রাস্তায় আসো।’
উওরে আকিবও ‘ঠিক আছে ভাই’ বলে গাড়ি নিয়ে ছুটে আসলো।’
____
নির্জন রাত। নিজের বিছানায় চুপচাপ বসে আছে অপূর্ব অপরাধ বোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তারওপর প্রিয়তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রিয়তার দুলাভাইকে তো একদমই ছাড়বে না অপূর্ব। একদমই না।’
অপূর্ব হন হন করে কিছু একটা ভেবে রুম থেকে বের হলো। আকিব মেসেজ দিলো,
‘ আকিব খুলনা যাবো একটা কাজ আছে আমার। একটা লোককে খুন করতে হবে।’
অতঃপর অপূর্ব বেরিয়ে গেল।’
…
রাত জুড়ে বিষন্নতা। পড়ার টেবিলে চুপচাপ বসে আছে প্রিয়তা। আজ অপূর্বকে কতকিছু বলে ফেললো সে। হঠাৎই প্রিয়তার মোবাইলটা টুুং করে উঠলো অপূর্ব মেসেজ দিয়েছে। প্রিয়তা খুশি মনে মেসেজটা দেখলো মেসেজ দেখেই চোখ মুখ ঘাবড়ে গেল প্রিয়তার। কারন অপূর্ব লিখেছে,
‘ শোনো মেয়ে, আমি যদি তোমার হয়ে কাউকে খুন করে দেই তাহলে কি তুমি খুব বেশি কষ্ট পাবে?’
#চলবে….
#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৩
_________________
অপূর্বের এমন খুন করার মেসেজ দেখে ভয়ংকরভাবে চমকে উঠলো প্রিয়তা। কাকে খুন করার কথা বলছে অপূর্ব। প্রিয়তা কতক্ষণ ভেবেই বুঝতে পারলো অপূর্ব কার কথা বলছে। প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে দ্রুত লিখলো,
‘ এমনটা করবেন না অপূর্ব। আমার জন্য আপনি খুনি হবেন না প্লিজ।’
মেসেজ তো লিখলো কিন্তু অপূর্ব কি দেখলো মোটেও দেখলো না। উল্টো মোবাইল অফ করে নিজের গন্তব্যে ছুটলো সে।’
আর প্রিয়তা,
অপূর্বের মেসেজের রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়লো পড়ার টেবিলের বইয়ের ভাজের ওপরে।’
গভীর রাত তখন। আকাশে তারা নেই কোনো,নির্জন পরিবেশ একদম গাছের পাতাও নড়ছে না তবে মেঘ জমেছে, চাঁদটাকে পুরোদমে ডেকে দিয়েছে মেঘেদের ভিড়ে। তবে কি আজও বৃষ্টি নামবে?’
হয়তো নামবে হয়তো না।’
____
ভয়ংকর সকাল! হঠাৎই মোবাইলটা বিকট শব্দে বেজে উঠতেই ঘুমটা ভাঙলো প্রিয়তার। ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে, কাল রাতে কখন টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই তার। প্রিয়তা চটজলদি ফোনটা ধরতে নিলো কিন্তু ধরতে ধরতে কলটা কেটে গেছে একবার। প্রিয়তা মোবাইলের টাইমটা দেখলো সকাল ৬ঃ০০টা বাজে এত সকালে কে ফোন করলো। এরই মাঝে আবারও ফোনটা বেজে উঠলো প্রিয়তা নাম্বার দেখেই বুঝলো প্রিয়তার চাচা ফোন করেছে সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতর কামড় দিয়ে উঠলো প্রিয়তার। তাহলে কি অপূর্ব? আর ভাবলো না প্রিয়তা দ্রুত কলটা ধরে বললো,
‘ হ্যালো ছোট আব্বু।’
সঙ্গে সঙ্গে অপরপ্রান্তে থাকা চাচার মুখে সব শুনেই স্তব্ধ হয়ে গেল প্রিয়তা। শরীর মন মস্তিষ্ক সব থরথর করে কেঁপে উঠলো তার, তবে কি অপূর্ব কাজটা করেই ছাড়লো। প্রিয়তা কতক্ষণ থ মেরে থেকে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
‘ আমি আসছি ছোট আব্বু।’
ব্যস এতটুকু বলেই ফোনটা কাটলো প্রিয়তা। না এই মুহূর্তে এখানে বসে থাকা যাবে না তার বুবুর যে তাকে প্রয়োজন।’
প্রিয়তা দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে ছুট লাগালো। অপূর্ব সত্যি সত্যি তার দুলাভাইকে মেরে দিবে এটা কল্পনাও করতে পারে নি প্রিয়তা। প্রিয়তার বুক কাঁপছে, ভয় লাগছে হুট করেই। প্রিয়তা কান্নাভেজা স্বরে বললো,
‘ আপনি দুলাভাইকে সত্যি সত্যিই মেরে দিলেন অপূর্ব?’ আমি বারন করে ছিলাম তো।’
প্রিয়তা আর ভাবতে পারছে না। তার দুলাভাই অনেক খারাপ এটা প্রিয়তা জানে কিন্তু তাও এইভাবে মেরে দেওয়াটা কি ঠিক হলো। বুবুটা কি মেনে নিতে পারছে স্বামীর মৃত্যুটা। কষ্ট পাচ্ছে খুব, নাকি মনে মনে আনন্দিত হয়েছে।’
না প্রিয়তা আর ভাব্বে না বলতে বলতে ঢুকলো সে ওয়াশরুমের ভিতর।’
প্রিয়তা তার ব্যাগটা নিলো, একটা জামা নিল। যদিও সে থাকবে না। প্রিয়তা একটা ঢিলাঢালা কালো রঙের বোরকা নিকাব সুন্দর মতো পড়ে নিয়ে দ্রুত ব্যাগ নিয়ে রুম লক করে বের হলো। গ্র্যান্ডমাকে এখন কিছু বলবে না পরে না হয় ফোন করে জানাবে। এমনটা ভেবে দ্রুত বের হলো প্রিয়তা। এখন বের হলে নির্ঘাত ১১টার মাঝে খুলনা পৌঁছাবে সে, জ্যাম না থাকলে তার আগেও যেতে পারে।’
____
বিষন্নতায় ঘেরা গ্রাম। খুলনার গ্রাম। ঘড়িতে বেলা সাড়ে এগারোটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। ‘বড় বাড়ি’ নামক কাল্পনিক এক পাড়ায় কান্নার রোল পড়ে গেছে। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনে ভরে গেছে চারপাশ। রহিম মির্জা মারা গেছে, কিভাবে মারা গেছে? কেউ মেরেছে নাকি নিজে মরছে বোঝা যাচ্ছে না। সকাল বেলা হুট করেই রহিম মির্জার বউ প্রেমা মির্জার হতভম্ব হয়ে দৌড়ে শশুর শাশুড়ির রুমে যাওয়ায় সবাই ছুটে গেলে রহিম মির্জার লাইব্রেরি রুমে ছেলেকে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় ঝুলে থাকতে দেখে জ্ঞান হারালেন রহিম মির্জার মা ফাতেমা মির্জা সচরাচর এই রুমটাতে রহিম ছাড়া আর কেউ আসে না। কালও আসে নি। সকালে স্বামীকে ডাকতে এসে এমন কান্ড দেখে থমকে গেল প্রেমা তক্ষৎনাত দৌড়ে ডাকলো সবাইকে।’
বাড়ির উঠোনে মানুষের ভিড়। একপাশে রহিম মির্জার বউ আর একপাশে মা মাটিতে বসে আছে। সামনেই ছেলের মৃতদেহ চাদরে মুড়িয়ে পাটিতে শোয়ানো। প্রেমা কাঁদছে না, চোখের পানি বোধহয় শুকিয়ে গেছে তার। বউয়ের না কান্নার কারনটা হয়তো অনেকেই বুঝেছে কারন বউটাকে আনার পর একদিনও না মেরে রেখেছে কি না জানা নেই কারো। আর রহিমের মা উনি কাঁদছেন ওনাকে শান্ত করা হচ্ছে। তবে প্রেমা শব্দ করে না কাঁদলেও নীরবে চোখের পানি ফেলছে স্বামীর দেহের দিকে তাকিয়ে, তাকে অত্যাচার করা মানুষটি আর নেই। তাকে আর মারবে না কেউ, অহেতুক কথা শোনাবে না কেউ। কিন্তু , প্রেমা তার পেটে হাত দিলো আজ তিন মাস হলো প্রেমা গর্ভবতী অথচ গর্বের সন্তানের বাবা আর বেঁচে নেই।’
প্রেমা নিজেকে শক্ত করলো। নানা কিছু ভাবছে আর স্বামীর দেহের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেমার চাচা চাঁচিও এসেছে এখানে। চাঁচির অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না। রহিম মারা গেছে এটাই যেন মানতে পারছেন না তিনি। কিভাবে কি হলো, কাল রাতেও তো ছেলেটা ঠিক ছিল তাহলে মরলো কি করে? লোকের মুখে শুনেছে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু রহিম আত্মহত্যা করবে কেন?’ এসব ভাবছে চাঁচি চাঁচি।’
অন্যদিকে,
এদের সবার থেকে দূরে মুখে মাস্ক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব। তার পাশেই আকিব। সেও মাস্ক পড়া। তাদের দৃষ্টিও রহিম মির্জার মৃতদেহের দিকে। অপূর্বকে দেখেও কিছু বোঝা যাচ্ছে না, চোখ শান্ত, মনে প্রশ্ন আর অশেষ গরমিল।’
এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো কালো বোরকা পরিধিত এক রমনী। রমনীটি আর কেউ না আমাদের প্রিয়তা। যদিও এত মানুষের ভিড়ে তাকে তেমন কেউ নজরে আনছে না। তবে প্রিয়তার বাড়ি ঢুকেই সর্বপ্রথম নজরে গেল মাস্ক পরিধিত দুই যুবক আকিব আর অপূর্বের দিকে। প্রিয়তা যেন চরম অবাক হলো অপূর্বকে এখানে দেখে। অপূর্ব যায় নি কেন?’ খুন করেও কি শান্তি মেলেনি তার। প্রিয়তা মনে মনে কথাগুলো বলে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল বোনটার দিকে। বোনটা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মাটিতে। চোখ মুখ অগোছালো।’
প্রিয়তা ধীরে ধীরে গিয়ে বসলো বুবুর পাশে। হাতটা ধরলো চুপ করে তারপর খুব ফিসফিস করে বললো,
‘ বুবু।’
সঙ্গে সঙ্গে প্রেমা তাকালো প্রিয়তার দিকে। মেয়েটার চোখ ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এমন ভাবে এসেছে ও যে প্রিয়তা এটা বোঝা দায় প্রায়। তবে প্রেমা চিনেছে প্রিয়তার কন্ঠস্বর শুনেই বুঝেছে সে। প্রেমা খানিকটা শব্দ করে কেঁদে উঠলো বোনকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও ধরলো না। প্রিয়তা দেখলো সেটা তার ভিতরটাও দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার বুবুটা ভালো নেই। বুবু খুশি হয় নি। অপূর্ব কাজটা ঠিক করে নি।’
প্রিয়তা প্রেমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
‘ কাঁদিস না বুবু দেখবি ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
প্রেমা জবাব দেয় না। চুপচাপ বসে রয় শুধু।’
পুলিশ এসেছে অনেক আগে, চারপাশে জিজ্ঞাসা বাদ চলছে। কেউ কোনো কিছু সন্দেহ জনক দেখেছে কি না তাই জিজ্ঞেস করছে। কতক্ষণের মাঝেই বডি পোস্ট মর্টেমের জন্য নিয়ে যাবে। এটা খুন নাকি আত্মহত্যা সবই বেরিয়ে আসবে তখন। অনেক আগেই নিয়ে যেতেন কিন্তু রহিমের বাবার জন্য নেওয়া হয় নি। উনি কোথাও একটা গিয়েছেন সাথে বলে গেছেন উনি না আসা পর্যন্ত তার ছেলেকে কোথাও না নিতে। গ্রামের মেম্বার তিনি।’
অতঃপর সময় ঘনিয়ে এলো রহিমের বাবাও চলে এলেন। ছেলের মৃত্যু সইতে পারছেন না তিনি। শেষমেশ সবাইকে ছেড়ে রহিম পাড়ি জমালো দূরে প্রেমা শুধু দেখেই গেল চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো তার। কেন যেন মনে হচ্ছে তার স্বামী তাকে বলছে,
‘ আমি চলে যাচ্ছি তুমি ভালো থেকো।’
কিন্তু আধও কি প্রেমার স্বামী এমনটা বলতে পারে। কখনোই পারে না। লোকটা আঘাত ছাড়া আর তো কিছু দেয় নি। প্রেমা বাড়ির ভিতরের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে লাগলো খুবই স্তব্ধ পায়ে। প্রিয়তা শুধু তাকিয়ে রইলো বোনের যাওয়ার পানে। কি করে যে বলবে তার বোনকে, আজ এই ঘটনার জন্য একমাত্র দায়ী প্রিয়তা। কারন প্রিয়তা যদি কাল অপূর্বকে ওই কথাগুলো না বলতো তাহলে অপূর্ব আজ কিছুই করতো না। তার বোনের স্বামীটা আজ বেঁচে থাকতো।’
প্রিয়তা অজানা ক্ষোভ নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো অপূর্বের দিকে। অপূর্ব আর আকিব তখনও ওখানে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। আকিব তাদের দিকে একটা মহিলাকে আসতে দেখে বললো,
‘ ভাই ওই মহিলাটা আমাদের দিকে তেড়ে আসছে কেন?’
উওরে আকিব মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়েই বললো,
‘ ও প্রিয়তা আকিব।’
সঙ্গে সঙ্গে বিষম খেল আকিব। বললো,
‘ কি, দেখে বয়স্ক বয়স্ক মনে হচ্ছে।’
‘ বুঝতে হবে আকিব ও ছদ্মবেশ নিয়ে এসেছে, আমি জানি ও এখন আমায় কি বলবে তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো আমি আর প্রিয়তা আসছি।’
আকিবও শুনলো তক্ষৎনাত ‘ঠিক আছে ভাই’ বলেই চললো সে।’
অন্যদিকে অপূর্বের দৃষ্টি প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা সবার চোখে ফাঁকি দিতে পারলেও তাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। প্রিয়তার উপস্থিতি তো অনেক আগেই বুঝেছিল অপূর্ব। আর প্রিয়তার ওই চোখ এত সহজে ভোলা যাবে নাকি।’
প্রিয়তা দ্রুত এগিয়ে আসলো তারপর অপূর্বের পাশ দিয়ে দাড়িয়ে রাগান্বিত গলায় বললো,
‘ আপনি দুলাভাইকে কেন মারলেন অপূর্ব? আমি আপনায় বারন করেছিলাম তো।’
উওরে বুকে হাত বেঁধে খুব শান্ত স্বরেই বললো অপূর্ব,
‘ তুমি কি বিশ্বাস করবে মেয়ে আমি তোমার দুলাভাইকে মারি নি। হুম এটা ঠিক কাল আমি তোমার দুলাভাইকে মারার উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছিলাম। কিন্তু কাল অনেক রাত করে এদিকে আসায় আমার এখানে আসতে আসতে সকাল হয়ে যায়। ভেবেছিলাম আজ রাতে মারবো কিন্তু তার আগেই কেউ তোমার দুলাভাইকে মেরে দিয়েছে। তোমার দুলাভাই তার লাইব্রেরির রুমের ফ্যানের সাথে ঝুলে ছিল। সবাই বলছে আত্মহত্যা করেছে কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা আত্নহত্যা নয় খুন হয়েছে।’
অপূর্বের কথা শুনে এবার যেন সত্যি সত্যিই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো প্রিয়তার। কি বলছে এই অপূর্ব উনি মারে নি রহিম মির্জাকে। তাহলে মারলো কে? কে ঘটালো প্রেমার স্বামীর মৃত্যু?’
#চলবে……
#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৪
_________________
বেশ রহস্যময়ী চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা অপূর্বের মুখের দিকে। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না অপূর্ব প্রেমার স্বামীকে মারে নি বলে। অপূর্ব যে তাকে মিথ্যে বলবে না এটাও প্রিয়তা জানে। তবে প্রশ্ন হলো অপূর্ব কিছু না করলে রহিম মির্জাকে মারলো কে?’ কার সাথে রহিমের শত্রুতা ছিল? কে এমনটা ঘটাতে পারে? কার এত সাহস হলো বাড়ির ভিতর ঢুকে লাইব্রেরির ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রেখে রহিম মির্জার মৃত্যু ঘটানোর। প্রিয়তা যখন অপূর্বের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ব্যস্ত ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই অপূর্ব প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল,
‘ ওভাবে তাকিয়ে থেকো না তো, আমার কষ্ট হয়।’
প্রিয়তা চমকে উঠলো। চোখ নামিয়ে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। তবে চুপ না থেকে বললো,
‘ আমারও কষ্ট হয় অপূর্ব।’
উত্তরে প্রিয়তার দিকে দৃষ্টি রাখলো অপূর্ব। খানিকটা অবাকের স্বরে বললো,
‘ কষ্ট হওয়ার কি আছে? আর এমনিতেও যে তোমার দুলাভাইকে মেরেছে সে না মারলেও আজ আমি মেরে দিতাম। তাই কষ্ট পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
অপূর্বের কথা শুনে প্রিয়তা অসহায় ফিল করলো। সে কি দুলাভাইকে নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কথা বলেছে নাকি। প্রিয়তার বিন্দু মাত্র কষ্ট নেই তার দুলাভাই মারা গেছে বলে। শুধু বুবুটার জন্য খারাপ লাগা।
প্রিয়তা খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে খুব ধীর স্বরে বললো,
‘ আফসোস আপনি আমার কথার আসল অর্থ বুঝলেন না অপূর্ব।’
বলেই প্রিয়তা কিছু একটা ভেবে উল্টোদিক ঘুরে হাঁটা ধরলো। তার হাঁটার দিকে তাকিয়ে অপূর্ব বললো,
‘ আমি কিন্তু আধ ঘন্টার মতো আছি প্রেম বালিকা, তার মধ্যে বোনের সাথে কথা বলে ফিরে এসো আমরা একসাথেই ফিরবো।’
অপূর্বের কথা শুনে প্রিয়তা চরমভাবে অবাক হলো। অপূর্ব কি করে বুঝলো সে এখন তার বোনের কাছে যাচ্ছে। প্রিয়তা অপূর্বের দিকে তাকিয়ে কিছু বলবে তার আগেই অপূর্ব বলে উঠল,
‘ দ্রুত যাও আর দ্রুত ফিরে এসো মেয়ে, আর হা কিভাবে কি বুঝেছি তা নয় হয় অন্য আরেকদিন বলবো।’
প্রিয়তা আর দাঁড়ায় নি অপূর্বের কথার বিপরীতেও কিছু বলে নি শুধু কিছুক্ষন শান্ত দৃষ্টিতে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায় সে। খুব সাবধানেই ঢোকে প্রেমার শশুর বাড়ির ভিতর। আশেপাশে মানুষের আনাগোনা খুব কম সবাই লাশের পিছু পিছু ছুটেছে।’
এদিকে,
অপূর্ব প্রিয়তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে খুব নীরব স্বরে বললো,
‘ আমি তোমায় বুঝবো না, তোমার কথার অর্থ বুঝবো না এমনটা কি হয় মেয়ে। কিন্তু আমারও যে ভয় হয়, হুম অপূর্বও ভয় পায়। এই প্রথম কোনো মানুষকে হারানোর চরম ভয় পাচ্ছে অপূর্ব। এটা তোমায় কি করে বোঝাবো?’ আমাদের মাঝে যে বড্ড অমিল, এত অমিলের মিলন ঘটাই কি করে বলো?’
এমন সময় অপূর্বের ফোন বাজলো আকিব কল করেছে। অপূর্ব ফোনটা তুলে বললো,
‘ আধ ঘন্টা অপেক্ষা করো আকিব, আমি প্রিয়তাকে নিয়েই আসছি।’
উত্তরে আকিবও বললো,
‘ ঠিক আছে ভাই।’
আকিবের কথা শুনেই কল কাটে অপূর্ব তারপর তার পাশে থাকা একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বুক হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ এখন শুধু অপেক্ষা প্রিয়তার আসার।’
____
নির্জন দুপুর! ঘড়ির কাঁটায় প্রায় দেড়টা বাজে। কিন্তু আকাশ পথে কোনো রোদ নেই। রহিমদের বাড়িটা বেশ ছাউনি দিয়ে গড়া বাড়ির চারদিকে বড়সড় গাছেদপর মেলা আছে কি না। দোতলার একদম কর্নারের রুমটায় জানালার পাশে বিছানার ওপর বসে আছে প্রেমা। চোখে পানি নেই, খুব চুপচাপ বসে আছে। কিছু একটা ভাবছে যেন। পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলালো প্রেমা। রহিম বেশিভাগ সময়তেই পাঞ্জাবি পড়তো, সেই পাঞ্জাবিগুলোই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো রুম জুড়ে। হঠাৎই প্রেমার চোখ গেল আলনার সাথে রহিমের একটা পাঞ্জাবি ঝুলে থাকার দিকে গতকাল ঠিক এই সময়তেই রহিম তার গায়ের ওপর ওটাকে ছুঁড়ে মেরে ধুতে বলেছিল কিন্তু শরীরটা একটু খারাপ থাকায় ধুতে পারে নি প্রেমা। সকালে ধুয়ে দিবে এমনটা ভেবে রেখেছিল ওখানে। রাতে অবশ্য এর জন্য রহিম কথাও শুনিয়েছিল তাকে। প্রেমার চোখ বেয়ে আপনাআপনি যেন পানি গড়িয়ে পড়লো তার কি কষ্ট হচ্ছে। এ কি কষ্টের কান্না নাকি আনন্দের? ঠিক বুঝচ্ছে না প্রেমা।’
‘ বুবু।’
হঠাৎই চিরচেনা বোনটার ভয়েসটা কানে আসতেই বিষন্নতায় ঘেরা চোখ দুটো দিয়ে তাকালো প্রেমা প্রিয়তার দিকে।’
বোনকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে প্রিয়তাও আর নিজেকে সামলাতে না পেরে দ্রুত ছুটে গেল বোনটার দিকে। ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,
‘ বুবু, তুই ঠিক আছিস তো?’
উত্তরে প্রেমা কিছু বলে না শুধু বোনকে জড়িয়ে ধরে চুপ থাকে অনেকক্ষন। বেশ কিছুক্ষন সময় যাওয়ার পর বোনকে ছাড়িয়ে বলে প্রেমা,
‘ তুই কেমন আছিস বোন?’
প্রেমার কথা শুনে প্রিয়তাও বলে,
‘ আমি ঠিক আছি বুবু। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তিও হয়ে গেছি তোকে কতবার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু বেশিরভাগ সময় দুলাভাই ধরায় কথা বলতে পারি নি। জানিস বুবু,
প্রিয়তার কথা শুনে বেশ আগ্রহের স্বরে বললো প্রেমা,
‘ কি জানবো,
প্রিয়তা থেমে যায় জবাব দেয় না। চুপ থাকে। সাথে ভাবে, অপূর্বের কথা কি এই মুহূর্তে বুবুকে বলা ঠিক হবে তার।’
___
ঘড়ির কাটা টিক টিক শব্দ করে ছুটছে, অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে নিজের হাত ঘড়িটা দেখছে প্রিয়তা যাওয়ার পঁচিশ মিনিট হয়ে গেছে আর পাঁচ মিনিটের মাঝেই প্রিয়তা চলে আসবে তো। অনেকক্ষণ হয়েছে সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেউ কোনোভাবে কিছু ভাবছে কি না কে জানে বিশেষ করে প্রিয়তার চাঁচি যদিও তাকে চেনা একটু টাফ আপাতত। মুখে মাস্ক চোখে চশমা। হঠাৎই অপূর্ব খেয়াল করলো প্রিয়তার চাঁচি কারো সাথে খুব চেঁচিয়ে কথা বলছে। কিন্তু কি বলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। এরই মাঝে সেখানে হাজির হলো প্রিয়তা, আর তার পাশেই প্রিয়তার চাচা নির্ঘাত আসার পথে দেখা হয়েছিল। অপূর্ব কিছু একটা ভাবলো বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে, প্রিয়তার চাঁচি যদি তাদের দেখে সাথে চিনে ফেলে তাহলে সমস্যা। অপূর্বের যেতে যেতে কানে এলো প্রিয়তার চাঁচি কাউকে বলছে,
‘ রহিম মারা গেছে ইরশাদ তাই আজ থেকে আমার ব্যবসার সব দায়িত্ব অর্থাৎ রহিমের জায়গাটা তোকেই নিতে হবে। আর বিদেশি খদ্দেরদের বলবি মাল পৌঁছাতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। এখনো সবটা জোগাড় হয় নি।’
অপূর্ব কোনো রকমের চাঁচির কথাগুলো কানে নিয়ে প্রিয়তার সামনে গিয়ে বললো,
‘ দ্রুত চলো এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।’
প্রিয়তা শুনলো তার চাচাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ আমি পৌঁছে তোমায় ফোন দিবো।”
উত্তরে শুধু মাথা নাড়ায় প্রিয়তার চাচা। অতঃপর বোন আর চাচাকে বিদায় জানিয়ে চাঁচি দাঁড়িয়ে থাকার ঠিক উল্টো দিকের রাস্তা ধরে এগোতে লাগলো প্রিয়তা আর অপূর্ব। আর চাচা শুধু তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা কে? জানার ইচ্ছে থাকলেও এই মুহূর্তে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না উনি হয়তো এটা মূখ্য সময় নয়। বউডা জানি কোন চিপায় আছে যখন তখন দেখে ফেলতে পারে।’
____
গাড়ির ভিতর ড্রাইভিং সিটের জানালার ওপর মাথা রেখে পা তার উল্টোদিকের জানালার সোজাসুজি পায়ের ওপর পা রেখে শুয়ে শুয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে আকিব। আজ কতদিন পর আরোহীর সাথে কথা বলছে সে। হঠাৎই অপরপাশে থাকা আরোহী বললো,
‘ আমায় বিয়ে কবে করছো তুমি?’
সঙ্গে সঙ্গে আকিবের কাশি উঠে গেল। কাশতে কাশতেই বললো,
‘ এই তো আর কিছুদিন পর।’
‘ কেশো না তো একদম তুমি শুধু বলো তুমি নিজে অপূর্ব ভাইকে আমাদের বিয়ের কথা বলবে নাকি আমি বলবো।’
আরোহীর এবারের কথা শুনে আকিব থমকে গেলো গাড়ির দরজাটা খানিকটা খুলে যাওয়ায় আকিব হাল্কা নড়তেই ছিটকে পড়লো নিচে। বললো,
‘ ও মা গো গেলাম রে।’
বলেই উপরে দিকে তাকাতেই সামনে অপূর্ব আর প্রিয়তাকে দেখে আরোই ঘাবড়ে গেল আকিব। ওরা মাত্রই এসেছিল প্রিয়তা তো আকিবের কান্ড দেখে হেঁসে ফেলে মুহূর্তেই। আকিব প্রিয়তার হাসির শব্দ পেতেই লজ্জায় লাল হলো। আর অপূর্বের গম্ভীর চাহনি দেখে নিচে শুয়ে শুয়েই বললো,
‘ ভালো আছেন ভাই?’
উত্তরে অপূর্ব বললো,
‘ আমি তো ভালোই আছি কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই আকিব।’
আকিব দ্রুত নিচে পড়া থেকে উঠে দাঁড়ালো হতভম্ব হয়ে ফোনটা কাটলো আরোহী ‘হ্যালো হ্যালো’ করছিল। আকিব ফোনটা কেটে অপূর্বের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আসলে হয়েছে কি ভাই?’
আকিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই অপূর্ব বললো,
‘ আরোহীর সাথে কথা বলছিলে নিশ্চয়ই।’
অপূর্বের কথা শুনে আকিবও মাথা নিচু করে হা বোধক মাথা নাড়ায়। যা দেখে অপূর্ব গাড়িতে উঠতে উঠতে বলে,
‘ তুমিও না আকিব এবার তোমার আর আরোহীর বিয়েটা দিতেই হবে বুঝেছি আমি। গাড়িতে ওঠো জলদি।’
আকিব শুনলো অবাক কান্ড আরোহীও বিয়ের কথা বলছিল আর এখন অপূর্ব ভাইও বলছে। আকিব দ্রুত গিয়ে গাড়ির সিটে বসলো। তারপর বললো,
‘ আপনি বিয়ে না করলে আমি কি করে করি ভাই?’
উত্তরে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো অপূর্ব,
‘ আগে তুমি করো তারপর দেখছি।’
উত্তরে আকিব আর কিছু বলে না। ছুট লাগায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর প্রিয়তা চুপচাপ বসে থাকে জানালার দিকে মুখ করে। অপূর্বের কথাটা আপাতত নেয় নি সে কারন সে জানে অপূর্ব তার জন্য কখনোই রাজনীতি ছাড়বে। তাকে পেতে হলে অপূর্বকে রাজনীতি ছাড়তেই হবে।’
প্রিয়তা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।’
বুবুর সাথে আবার কবে দেখা হবে কে জানে? তার সাথে আসার জন্য বলেছিল কিন্তু বুবু রাজি হয় নি। যদিও এই মুহূর্তে তার সাথে যাওয়াটা সত্যি যুক্তিযুক্ত নয়। তাও প্রিয়তা একবার এমনি বলেছিল।’
__
গাড়ি ছুটছে তার আপন গতিতে। হঠাৎ অপূর্ব বললো,
‘ তুমি কিন্তু এইভাবে হুট করে এখানে এসে কাজটা ঠিক করো নি প্রিয়তা।’
উত্তরে খুব শান্ত স্বরেই জবাব দেয় প্রিয়তা,
‘ আমি ঠিক ভুল জানি না অপূর্ব বুবুটার জন্যই এসেছিলাম।’
‘ বুঝতে পেরেছি তাও ঠিক হয় নি।’
‘ জীবনে যদি সবসময়ই ঠিক ভুল নিয়ে বসে থাকি অপূর্ব তবে কি জীবন চলবে বলুন। মাঝে মাঝে দু’একটা ভুলও করতে হয়। কেননা সব ভুলই কষ্ট দেয় না কিছু কিছু ভুল প্রশান্তিও আনে।’
প্রিয়তার কথা শুনে অপূর্ব খুব শীতল দৃষ্টি নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকালো। মনে হলো কথাটা যেন তাকেই বললো মেয়েটা।’
অপূর্ব কিছু বললো না শুধু আকাশ পথে তাকিয়ে নিজ মনে আওড়ালো,
‘ তবে কি আমারও একটা ভুল করা উচিত মেয়ে?’ যে ভুল আমায় প্রশান্তি এনে দিবে। আনন্দ দিবে হৃদয়টাকে। খন্ড খন্ড হতে থাকা মনটাকে জোড়া দিবে আনমনে। কিন্তু,,,
চলবে….