আজও বৃষ্টি নামুক পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
570

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৮
_________________

অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আকিব অপূর্বের মুখের দিকে। কি বলছে তার অপূর্ব ভাই প্রিয়তা তাকে মারে নি মানে?’ আকিব কয়েক কদম এগিয়ে গেল অপূর্বের দিকে। তারপর বললো,

‘ আপনি এসব কি বলছেন ভাই? প্রিয়তা তো আমাদের সামনে বসেই আপনায় গুলির করলো। তাহলে?’

উত্তরে বেশি না ভেবেই জবাব দিলো অপূর্ব,

‘ প্রিয়তা গুলি চালাই নি আকিব।’

আকিব বড্ড অবাক হলো অপূর্বের কথা শুনে। অবাক হয়েই বললো,

‘ আমি আপনার কথা কিছু বুঝচ্ছি না ভাই।’

এবার অপূর্ব কিছু ভাবতে ভাবতে বললো,

দুদিন আগে যে মুহূর্তে প্রিয়তা অপূর্বকে বুক বরাবর রিভলবার রেখেছিল সেদিন আসলে প্রিয়তা গুলি করে নি বরং দূর থেকে সেই ফাঁকা বিল্ডিংটার ওপর থেকে কেউ একজন গুলি করেছিল। লোকটা যখন গুলি করেছিল উদ্দেশ্য ছিল একদম অপূর্বের বুক বরাবর গুলি করার কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা কাক আচমকা সামনে আসায় নিশানা ঘুরে যায় আর অপূর্ব বুকের থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে গুলি লাগে। অপূর্ব যখন প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ছিল তখনই সে বিষয়টা খেয়াল করে, অপূর্ব জানতো প্রিয়তা তার বুকে গুলি করতে পারবে না। কারন সে জানে তার ভালোবাসা ঠুনকো ছিল না।’

পর পর কথাগুলো বলেই আকিবকে উদ্দেশ্য করে বললো অপূর্ব,

‘ বুঝলে আকিব অনেক সময় চোখের সামনে যা ঘটে তা আসলে সত্যি হয় না।’

আকিব বুঝলো অপূর্বের কথা। অনেকক্ষন চুপ থেকে বললো,

‘ একটা প্রশ্ন করবো ভাই?’

উত্তরে অপূর্বও বলে,

‘ হুম করো।’

অপূর্বের কথা শুনে সব দ্বিধা সরিয়ে রেখেই বললো আকিব,

‘ আপনি কি সত্যিই প্রিয়তার বাবাকে মেরেছিলেন ভাই?’

আকিবের এবারের কথা শুনে অপূর্ব অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,

‘ না, আমি প্রিয়তার বাবাকে মারি নি।’

‘ তাহলে ওই ভিডিওটা কিসের ছিল?’

ফ্লাসবেক___

৩ বছর আগে তারিখ ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২০। গভীর রাত। অপূর্ব তখন নিউ নিউ রাজনীতিতে ঢুকেছে। কোনো এক কাজে সেদিন খুলনা এসেছিল সে। তো কাজ সেরে খুলনা ছেড়ে বাড়ি ফেরার পথে একাই ছিল অপূর্ব গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎই ল্যামপোস্টের সামনে একটা লোককে আহত অবস্থায় দেখতে পেয়ে অপূর্ব গাড়ি থামিয়ে এগিয়ে যায়। লোকটাকে অপূর্ব চিনতো, কারন কয়েকবার মিটিংয়ের উছিলায় তাদের দেখা হয়েছিল। অপূর্ব তাকে স্যার বলে ডাকতো। অপূর্ব এগিয়ে গেল। বেশ অবাক হয়ে বললো,

‘ এসব কি করে হলো স্যার?’

উত্তরে প্রিয়তার বাবা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না। শুধু বললো,

‘ আমার পেটের চাকুটা বের করে দেও অপূর্ব?’

অপূর্বও শোনে সাথে তাই করে। সেদিন প্রিয়তার বাবা আর্তনাদ ছিল খুব। অপূর্ব সেই আর্তনাদ ভরা চেহারা নিয়েই প্রিয়তার বাবাকে নিয়ে গিয়েছিল হসপিটাল। ভেবেছিল বাঁচাতে পারবে কিন্তু পারে নি হসপিটালে বসে অপূর্বের ফোন আসে তার মা অসু্স্থ হয়ে পড়ে তাকে লাগবে। অপূর্ব বাধ্য হয়ে সেদিন প্রিয়তার বাবাকে হসপিটালে রেখে চলে আসে আর তারই সুযোগ নিয়ে হসপিটাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর প্রিয়তার বাবাকে দ্বিতীয় বারের মতো আবারও আঘাত করে পুরোপুরি মেরে ফেলে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়। এই কাজগুলো সবই মুখার্জি মশাইয়ের কথায় করা হয়েছিল অপূর্ব ভেবেছিল কিছু করবে কিন্তু পরে আর করা হয় নি। সময়ের সাথে সাথে ধামা চাপা পড়ে সব। লাইটপোস্টের ওপর একটা সিসি ক্যামেরা ছিল সেখানে অপূর্ব আর যারা খুন করেছিল তাদের সবার ভিডিও ফুটেজ ছিল যেটা পরে সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু শেষে গিয়ে সেই ভিডিওই অপূর্বের শত্রু হলো।’

পর পর কথাগুলো আকিবের সামনে বলে খুব আফসোসের সঙ্গে বললো অপূর্ব,

‘ আমি যদি সেদিন তাকে হসপিটালে না রেখে আসতাম একটু মায়া দেখিয়ে ওখানে থাকতাম তাহলে আজ উনি হয়তো বেঁচে থাকতো আকিব। আর প্রেমা প্রিয়তার জীবনটাও অন্যরকম হতো।
যখন আমি প্রিয়তার মুখে ওর বাবার খুন হওয়ার কথা শুনেছিলাম আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল কেন যেন নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়েছিল। বার বার মনে হয়েছিল প্রিয়তা এসব জানলে আমায় ক্ষমা করবে না। বার বার আঙুল তুলে বলবে, আপনি সেদিন কেন হসপিটালে থাকলেন না অপূর্ব কিন্তু আমি কি করে বুঝাতাম আমার মাও যে।’

অপূর্ব থেমে যায় আর কিছু বলতে পারছে না বুকে খানিকটা ব্যাথা অনুভব করে সে। অপর্বের অবস্থাটা বুঝতে পেরে আকিব ধরে ঠিক মতো শুয়ে দেয় অপূর্বকে বলে,

‘ আপনি ঠিক আছেন তো ভাই?’

‘ হুম আমি ঠিক আছি।’

‘ সবই বুঝলাম ভাই কিন্তু এসব কথা প্রিয়তাকে বললো কে? আর আপনায়ও মারলো বা কে?’ তার কি লাভ হলো আপনার আর প্রিয়তার সম্পর্ক নষ্ট করে?’

উত্তরে অপূর্ব অনেকক্ষন চুপ থেকে বললো,

‘ আমি সব জানি কে এসব করেছে কেন করেছে এবার সময় এসেছে আকিব সব রহস্যের দরজা খোলার।’

আকিব আবারও অবাক হলো। চমকানো গলায় বললো,

‘ ঠিক বুঝলাম না ভাই?’

‘ তোমার ফোনটা দেও,

আকিব দিল। অপূর্ব মোবাইল নিয়েই কারো একটা নাম্বারে কল করলো।’
___

ঢাকার কোতোয়ালি থানার সামনে এসে থামলো একটা গাড়ি। গাড়ি থেকে নামলো একজন পুরুষ মানুষ, পরনে তার পুলিশের ইউনিফর্ম, ঝাকড়া চুল মাথায়, হাতে ঘড়ি, পারফেক্ট বডিফিগার। পুরোই হিরোদের মতো এডিটিউড নিয়ে থানার ভিতর পা রাখলেন তিনি। আশেপাশের সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বান্দরবন শহর ছেড়ে ঢাকায় নিউ নিউ বদলি হয়ে এসেছে মোঃ তানভীর আহমেদ ইফতি। কঠোর এবং ন্যায়ের পথে চলা সৎ পুলিশ অফিসার তিনি। বেশ নাম ডাক আছে তার। তানভীর এখানে জয়েন হয়েছে আজ দু’দিন হলো। বেশ সম্মানের সাথেই দুদিন কেটেছে তার। হঠাৎই তানভীরের ফোনটা বাজলো তানভীরও বেশি না ভেবে ফোনটা তুললো। বললো,

‘ হ্যালো,

—-

নিজের রুমে বসে কাঁদছিল প্রিয়তা। সে যে ভুল করেছে তা প্রিয়তা জানে। প্রিয়তা সেদিন নিজেও স্তব্ধ ছিল। প্রিয়তা অপূর্বকে মারার জন্য গেলেও অপূর্বকে মারে নি যেটা সে প্রথমে বুঝতে পারে নি কিন্তু পরে পেরেছিল। প্রিয়তা বুঝতে পেরেছিল সেদিন গুলিটা আসলে সে চালায় নি অন্যকেউ চালিয়ে ছিল। প্রিয়তা অপূর্বের থেকে আগে সব সত্যিটা জানার উদ্দেশ্য নিয়েই গিয়েছিল রিভলবারটা তো এমনি বের করেছিল সে। কিন্তু অপূর্ব কিছু বলার আগেই কেউ তাকে গুলি করে দেয়। প্রিয়তা জানে এই কথা গুলো অপূর্বকে বললে অপূর্ব হয়তো বুঝবে না বা বিশ্বাসও করবে না। কারন সব তো সবার চোখের সামনে দিয়েই ঘটেছিল। প্রিয়তা আর্তনাদ ভরা চেহারা নিয়ে বললো,

‘ আপনি আমায় কখনো ক্ষমা করবেন না আমি জানি অপূর্ব। আমিই ভুল করেছি প্রতিশোধের আগুনে নিজের বোধ বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছিল অপূর্ব। এ ভুলের কি ক্ষমা আছে অপূর্ব জানি নেই।’

প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই দরজায় নক করলো কেউ। প্রিয়তা খানিকটা চমকে উঠলো এতে, দ্রুত নিজের চোখ মুখ মুছে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা খুলতেই আচমকা দুটো লোক প্রিয়তার মুখে রুমাল চেপে ধরলো আর প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই জ্ঞান হারালো।’

….

স্তব্ধতায় ভরপুর রহিম মির্জাদের বাড়ি। সবার মুখ শুঁকনো আজ কতগুলো দিন গেল বাড়ি ছেলে আর বাড়ি ফেরে না। বাড়ির উঠানে স্তব্ধ হয়েই বসে আছে সবাই শুধু প্রেমা নেই, এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো পুলিশ, বাড়িতে পুলিশ দেখায় রহিমের বাবা এগিয়ে গেলেন। বললেন,

‘ কি হয়েছে অফিসার?’

‘ আমরা প্রেমা মির্জাকে এরেস্ট করতে এসেছি।’

বাড়ি শুদ্ধ সবাই যেন চমকালো। প্রেমাকে কেন পুুলিশে ধরে নিয়ে যাবে। রহিমের বাবা বেশ হতাশ হয়ে বললেন,

‘ আমার বউমাকে কেন এরেস্ট করবেন অফিসার তার কি দোষ?’

উত্তরে অফিসার কিছু বলবে এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হলো প্রেমা। খুবই সাদামাটা আর অগোছালো অবস্থায়। প্রেমা এগিয়ে এসে বললো,

‘ আমায় নিয়ে চলুন অফিসার আমি আপনাদের সাথে যেতে প্রস্তুত।’

প্রেমার কথাগুলো যেন সবার মাথার উপর দিয়ে গেল। প্রেমার শাশুড়ী দৌড়ে এসে বললো প্রেমাকে,

‘ তোমার কি মাথার ঠিক আছে বউমা কিসব বলছো তুমি?’

শাশুড়ী মায়ের কথা শুনে প্রেমা ছলছল চোখে শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ পারলে আমায় ক্ষমা করবেন মা এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না।’

বলেই প্রেমা এগিয়ে যায় অফিসারদের দিকে। একজন লেডি পুলিশ হাতে হেনকাপ পড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো প্রেমাকে আর প্রেমাও এগিয়ে গেল বাহিরের দিকে। রহিম মির্জা হতাশ হয়ে পুলিশের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ আমার বউমা করেছে কি অফিসার? আমার ছেলের তদন্ত করার ছিল আপনাদের আমার বউমাকে কেন ধরছেন তাহলে?’

উত্তরে পুলিশ বললো,

‘ খাবারের ভিতর বিষ মিশিয়ে নিজের স্বামীকে নিজেই খুন করেছে এই প্রেমা মির্জা। তাই খুন করার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হলো। আপনার ছেলের মৃত্যুর রহস্য করতে গিয়েই এই তথ্য পেয়েছি আমরা।’

সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবেশ যেন হয়ে গেল আরো স্তব্ধ। কি রহিমকে শেষে কিনা প্রেমা নিজেই মেরেছে। কিন্তু কেন?’ প্রশ্নটা রয়েই গেল জানা আর হলো কারন যে জানাবে সেই তো পুলিশের সাথে চলে গেল।’

অতঃপর অফিস বেরিয়ে গেলেন সঙ্গে নিয়ে গেল প্রেমাকে। প্রেমা এটা জানতো এমনটা হবেই তাই তো পুলিশ দেখেই বেরিয়ে এসেছে সে। সবাই নির্বিকার হয়ে বাড়ি থেকে বের হলো প্রেমা এমন কেন করলো?’

প্রেমা পুলিশের গাড়িতে উঠতে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে কাউকে দেখে অবাক চোখে তাকালো কারন প্রেমা একা নয় আজ সঙ্গে গ্রেফতার আরও একজন হয়েছে আর সে হলো প্রেমার চাঁচি। তবে কারনটা ভিন্ন।’

প্রেমা বেশি ভাবলো না উঠে বসলো গাড়িতে চাঁচির পাশ দিয়ে তার হাতেও হেনকাপ পড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। পিছন থেকে বাড়ির সবাই আবারও বেশ অবাক হলো এমন অদ্ভুত ঘটনা দেখে প্রেমার চাঁচিকে কেন পুলিশে ধরেছে কি করেছে উনি। তবে কি রহিমের হত্যার পিছনে এরও হাত আছে।’

সবার মাথায় যেন নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এসব কি ঘটছে আজ?’
___

ভার্সিটিতে স্টুডেন্টদের পড়াচ্ছিল আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি। চোখে চশমা, গায়ে পেস্ট কালার শার্ট, কালো প্যান্ট, শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত বোল্ড করা, মাথা সিল্কি চুল। আব্রাহাম তার চশমাটা ঠিক কে বোর্ডে কিছু লিখছিল এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো অফিসার তানভীর আহমেদ ইফতি। সাথে আরো কিছু পুলিশ। তানভীর আব্রাহামের দিকে গুলি তাক করে বলে উঠল,

‘ আপনার খেল খতম। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট মিস্টার আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি ওরোফে আহিল মাহামুদ।’

#চলবে…..

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৯
_________________

ভার্সিটির পুরো ক্লাসরুম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের আব্রাহাম স্যার আর পুলিশগুলোর দিকে। তারা কেউ বুঝচ্ছে না হুট করে পুলিশ কেন তাদের স্যারকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। কি করেছে কি তাদের আব্রাহাম স্যার।’

এদিকে,

আব্রাহাম তাকিয়ে আছে পুলিশগুলোর দিকে বিষয়টা একদমই তার ধারনার বাহিরে ছিল। তবে আব্রাহাম বেশি ঘাবড়ালো না খুব স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,

‘ আমার অপরাধ কি অফিসার?’

উত্তরে তানভীর বললো,

‘ অপরাধের কথা না হয় পুলিশ স্টেশন গিয়ে বলা যাক মিস্টার আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি। যদিও এটা নকল নাম। তবে আপাতত আপনি ধরে নিতে পারেন অন্যের আইডেন্টিটি নিয়ে ভার্সিটির টিচার হিসেবে বেআইনিভাবে জয়েন হওয়ার অপরাধে আপনায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। আর বাকিটা না হয় কারাগারে বন্দী হয়ে শুনবেন। বিশেষ কেউ বলবে!’

এই বলে আব্রাহামের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। ক্লাসরুমের উপস্থিত সবাই জাস্ট অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো পুলিশদের যাওয়ার পানে। অদ্ভুত কান্ড এতদিন তারা যাকে তাদের আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি নামে যাকে ইংরেজি টিচার বলে জানতো অথচ আজ জানলো ওনার নাম আব্রাহাম নয় আহিল মাহামুদ। সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো পুরো। সবটাই যেন তাদের মাথার উপর দিয়ে গেল।’

___

অন্ধকার রুম। চারপাশে আলোর রেখা নেই মোটেও। ভাঙাচোরা কিছু আসবাবপত্রে ঘেরা চারপাশ, আর এসবের মাঝেই হাত পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রয়েছে প্রিয়তা। জ্ঞান নেই তার। আচমকাই নড়েচড়ে উঠলো সে পুরোপুরি হুস আসতেই আশেপাশে তাকালো প্রিয়তা। কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রিয়তার মাথার উপরের দিকটায় ছোট্ট একটা জানালা আছে যেখান থেকে বিন্দু বিন্দু আলো আসছে তাও সুক্ষ্ম। বোধহয় বাহিরে সন্ধ্যা নেমে গেছে। প্রিয়তা বুঝলো না তাকে এখানে কে আনলো?’

হঠাৎই কারো পায়ের ধ্বনি কানে আসলো। পায়ের শব্দ কানে আসতেই ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসলো প্রিয়তা। ধীরে ধীরে পায়ের শব্দ আরো নিকটে আসতে লাগলো প্রিয়তা বুঝেছে কেউ একজন আসছে তার দিকে। কিছু সেকেন্ড যেতে না যেতেই একটা গান কানে ভাসলো প্রিয়তার। কেউ গাইছে,

‘ তুমি আমার অনেক শখের,
খুঁজে পাওয়া এক প্রজাপতি নীল
‘ আমি রংধনু রঙে সাজিয়েছি
দেখ এক আকাশ স্বপ্নীল!’

কন্ঠটা যেন চেনা। তবে কি অপূর্ব এসেছে? কিন্তু তা কি করে সম্ভব সে তো। প্রিয়তা বেশি না ভেবে অধিক আগ্রহে তাকালো সামনে কিন্তু অন্ধকারে সামনের ব্যক্তিটিকে চেনা যেন দায়। প্রিয়তার মুখ বাঁধা তাই সে তেমন কোনো শব্দও করতে পারছে না।’

অতঃপর সময়ের অবসান ঘটলো দেখা গেল সেই মধুরকন্ঠস্বরে গেয়ে আসা মানবের মুখশ্রী। কারন তার হাতে ছিল একটা মোমবাতি। মুখটা দেখা যাচ্ছে এখন। প্রিয়তা যেন সত্যি চমকালো মানবের মুখখানা দেখে কারন তার সামনে সত্যি সত্যিই অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে। তবে কি অপূর্ব সুস্থ হয়ে গেছে আচ্ছা গুলিতে আহত হওয়া ব্যক্তিটি কি এত দ্রুত সুস্থ হতে পারে হয়তো পারে হয়তো পারে না।’

অপূর্ব এগিয়ে গেল, আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে। কিন্তু পরে কি যেন ভেবে অপূর্ব আর বেশিদূর এগোলে না কয়েককদম এগিয়ে গিয়ে আবার অন্যদিকে ঘুরে গেল। আগে রুমে লাইট জ্বালানো প্রয়োজন। অপূর্ব তাই করলো পুরো রুম সাঁতরে সুইচ খুঁজে বের করে রুমের লাইট জ্বালালো তাও যেন অন্ধকার ঘুচলো না জিরো পাওয়ারের একটা লাইট জ্বলছে। লাইটের আলো এতটাই কম যে এর চেয়ে মোমবাতির আলোও বোধহয় বেশি।

অপূর্ব আশেপাশে তাকিয়ে হাতের মোমবাতিটা রাখলো একপাশে। তারপর পুনরায় এগিয়ে চললো প্রিয়তার দিকে। মেয়েটা বোধহয় খুব ভয় পাচ্ছে। অপূর্ব ইচ্ছাকৃতভাবে জুতায় খটখট আওয়াজ করছে। কারন এতে প্রিয়তার বোধহয় ভয় পাওয়ার বিষয়টা পুরোপুরি ভয় পাওয়ার রূপে পরিনত হচ্ছে। অপূর্ব তার বুকে হাত দিল ব্যাথাটা যেন আবার নাড়া দিচ্ছে। আজ একপ্রকার জোর জবরদস্তি করে হসপিটাল থেকে চলে এসেছে অপূর্ব। ডাক্তারটা অনেক রাখার চেষ্টা করলেও সক্ষম হয় নি। অপূর্বের হসপিটাল জিনিসটা একদমই পছন্দ হয় না। কেমন যেন অসহ্য অসহ্য লাগে। তারওপর তার বুকে ব্যাথা।’

অপূর্ব তার বুকে হাত রেখেই চেয়ার টেনে বসলো প্রিয়তার সামনে। কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো প্রিয়তার চোখের দিকে তারপর মুখ খুলে খুব শীতল স্বরে বললো,

‘ তুমি কি জানো মেয়ে আমি তোমার চোখে বার বার আমার ধ্বংস হওয়া দেখি। আচ্ছা আমায় ধ্বংস করে কি তুমি খুব মজা পাও। হয়তো পাও না হলে এভাবে গুলির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতে পারতে নাকি।’

প্রিয়তা কিছু বললো না মুখ যে তার বাঁধা যদিও মুখ খোলা থাকলেও এই মুহূর্তে সে কিছু বলতে পারতো না। চুপ করেই রইতো। প্রিয়তা জানে অপূর্ব তাকে আর বিশ্বাস করে না, সে যে গুলি করে নি এটা বললেও অপূর্ব হয়তো বিশ্বাস করবে না। প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফেললো। যা দেখে অপূর্ব বললো,

‘ বেশি মন খারাপ করো না তো, তুমি হয়তো জানো না তোমার মন খারাপেও আমার হৃদয় পুড়ে।’

প্রিয়তা আবার তাকালো অপূর্বের দিকে। অপূর্বের হাবভাব ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। হুট করেই অপূর্ব কি ভেবে যেন প্রিয়তার মুখে বাঁধা কাপড়টা খুলে দিল। মুখ খুলতেই প্রিয়তা নিশ্বাস ফেললো বার কয়েক। তারপর বললো,

‘ আমায় মেরে ফেলবেন অপূর্ব?’

অপূর্ব হাসে। কি রহস্যময়ী হাসি তার। সে কি খুব মজা পেয়েছে প্রিয়তার প্রশ্নে। অপূর্ব হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,

‘ এটা বলার মতো প্রশ্ন। তোমায় যে মারবো এটা নিশ্চিত। তাই বেশি ভেবো না। অপূর্বের দিকে রিভলবার রেখেছো তার হৃদয়ের আঘাত করেছো এমনি এমনি আর ছেড়ে দিবো নাকি। অপূর্বকে আঘাত করার ফল কতটা ভয়ংকর হয় এটা তো তোমায় জানতে হবে তাই না মেয়ে।’

প্রিয়তা জবাব দেয় না। চুপচাপ মাথা নিচু করে আবার। অপূর্ব যেন এতে বিরক্ত হয় খুব কঠিন গলায় বলে,

‘ একবার বলেছি না মন খারাপ করবে না আমি নিতে পারি না।’

অপূর্বের কথার প্রতি উত্তরে খুব শান্তসৃষ্ট জবাব প্রিয়তার,

‘ আমি মন খারাপ করছি না তো। জানেন অপূর্ব আমার দুলাভাইকে কে মেরে ছিল?’

অপূর্ব যেন খানিকটা অবাক হলো মেয়েটা কি সব জানে তবে। অপূর্ব খানিকটা অবাক স্বরে বললো,

‘ কে?’

‘ আমার বুবু। আজ হয়তো তাকে পুলিশেও ধরে নিয়ে গেছে। সঙ্গে হয়তো চাঁচিও গেছে। চাঁচির বিষয়টা ঠিক জানা নেই। তবে বুবুকে নিয়ে যাবে এতটুকু জানি। কাল রাতে বুবু ফোন করে বলেছিল আজ হয়তো তাকে নিয়ে যাবে। আপনি কি বলতে পারবেন পুলিশগুলো বুবুকে নিয়ে গেছে কি না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।’

অপূর্ব অনেকক্ষন চুপ থেকে বললো,

‘ তোমার বুবু সবটা বলেছে তোমায়?’

‘ কতটুকু সবটা এটা জানি না। বুবু কাল রাতে হুট করেই ফোন করে বলেছিল তাকে নাকি আজ পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে সাথে নাকি চাঁচিও থাকতে পারে। পরে কারন জিজ্ঞেস করায় শুধু তারটা বলেছিল সে নাকি দুলাভাইকে মেরে ফেলেছে তাই তাকে নিবে তবে চাঁচির বিষয়টা কিছু বলে নি শুধু তার টুকুই বলেছিল। সবটা জানার জন্য আজ আমি খুলনা যাওয়ার যাবো ভেবেছিলাম কিন্তু তার আগেই আপনি নিয়ে এসেছেন। যাইহোক একটু বলবেন প্লিজ বুবুকে সত্যি নিয়ে গেছে কি না বা আপনি আপনার ফোন থেকে আমার ছোট আব্বু মানে চাচার নাম্বারে একটা কল করে দিন আমি জেনে নিচ্ছি।’

অপূর্ব আবার হাসলো। মেয়েটা বোধহয় তাকে হাসানোর সব পরিকল্পনা ভেবে রেখেছে। অপূর্বের হাসির দিকে নির্বিকার চোখে তাকিয়ে রইলো প্রিয়তা। যা দেখে অপূর্ব বললো,

‘ আচ্ছা তুমি ভাবছো কি করে তুমি বলবে আর আমিও শুনবো।’

‘ ভাবছি না তো শুধু অনুরোধ করছি এখন শুনবেন কি শুনবেন না এটা তো আপনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। শুধু আমার একটু আফসোস থেকে যাবে আমি কিছু জানতে পারলাম না।’

প্রিয়তার কথা শুনে অপূর্ব অনেকক্ষন চুপ থাকলো। তারপর বললো,

‘ তোমার বুবুকে সকালেই পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে আমি নিজেই তোমার বুবুকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি।’

অপূর্ব এবারের কথা শুনে চরম বেগে যেন অবাক হলো প্রিয়তা। অপূর্ব ধরিয়ে দিয়েছে মানে। প্রিয়তার অবাক হওয়ার বিষয়টা অপূর্ব যেন বুঝলো। বললো,

‘ খুব অবাক হলে তাই না। তুমি কি জানো তোমাদের ইউনিভার্সিটির স্যার মিস্টার আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি এখন জেলে। তোমার এই স্যারের কথাতেই তো তুমি আমায় খুন করতে গিয়েছিলে তাই না।’

প্রিয়তা যেন আরো অবাক হলো অপূর্ব এসব কি করে জানলো। প্রিয়তার ভাবনার মাঝে আবারও বললো অপূর্ব,

‘ কি আবারও অবাক হলে তো। আমরা আব্রাহামের বিষয়টায় পড়ে আসি আগে তোমার বুবুর বিষয়টায় যাওয়া যাক। তোমার চাঁচি একটা ব্যবসা করতো এটা তুমি নিশ্চয়ই জানো।’

অপূর্বের কথা শুনে হ্যা বোধক মাথায় নাড়ায় প্রিয়তা যা দেখে অপূর্ব বলে,

‘ কিন্তু কিসের ব্যবসা করে তা হয়তো জানো না।’

এবার না বোধক মাথা নাড়ায় প্রিয়তা। যা দেখে আরো বলে অপূর্ব,

‘ তোমার চাঁচি মেয়ে পাচারের ব্যবসা করতো আর সেই ব্যবসায়ের মুখ্য লিডার ছিল তোমার দুলাভাই। কোন দেশে কোন মেয়ে কতগুলো মেয়ে যায় এইসবই তোমার দুলাভাই দেখতো। মোটামুটি সবই ঠিক ছিল কিন্তু ভেজাল বাজলো কিছুদিন আগে, যখন বিদেশে মেয়ে পাঠাতে গিয়ে একটা মেয়ে কম পড়েছিল। চারিদিকে যখন মেয়ে খোঁজা নিয়ে হুল্লোড় পড়েছিল তখনই তোমার দুলাভাইর নজর আসে তোমার ওপর। মনে পড়ে তোমার কথা। তোমার উপর রাগ তার আগে থেকেই ছিল তাই তোমাকে পাচার করার কথাই ভাবে তোমার দুলাভাই। তো তোমার বুবু কয়েকদিন আগেই জেনে ছিল তোমার চাঁচি আর তোমার দুলাভাইর এই যগন্য ব্যবসার কথা। তখনই তোমাকে পাচার করার কথাটা যখন শোনে তখন আর তোমার বুবু চুপ থাকে না। চুপিসারে খাবারে ভিতর বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলে তোমার দুলাভাইকে, ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টা ছিল জাস্ট লোক দেখানো। এখন তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে তো এতকিছু আমি কি করে জানি। তুমি হয়তো সেদিন খুলনা বসে তোমার বুবুকে আমার আর আমার রাজনীতিবিদের কথা বলেছিল। তোমার বুবু সেদিন ছাঁদে বসে আমায় দেখেছিল অনেক্ক্ষণ। আমি বুঝেছিলাম সে বোধহয় কিছু বলতে চাইছে আমায়। তারপর তার সাথে ফোনে কথা হয়, সবটা জানি আমি। এর মাঝে একবার তোমাদের খুলনাতেও গিয়েছিলাম তোমার বুবুর সাথে দেখা করতে তখন জানতে পারি এই ঘটনায় শুধু তোমার দুলাভাই নয় তোমার চাঁচিও আছে।’

প্রিয়তা অপূর্বের কথা শুনে ভাবলো কিছু, সেদিন সত্যি অপূর্বের কথা প্রিয়তা বলেছিল তার বোন প্রেমাকে। অপূর্ব যে রাজনীতিবিদ এটাও বলেছে প্রিয়তা। তার আর অপূর্বের মাঝে ঘটা সব ঘটনাই বলেছিল প্রেমাকে। আর তখনই কি জন্য যেন অপূর্বের ফোন নাম্বারও রেখেছিল সেদিন প্রিয়তা ওতোটা ভাবে নি তবে আজ বুঝলো সব ঘটনা।’

কি অদ্ভুত কান্ড! শেষে কি না প্রিয়তার জন্যই প্রেমা খুনি হলো।’

#চলবে…..

#আজও_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪০
_________________

‘ খুব বিপাকে পড়েছো তাই না মেয়ে?’

খুব অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়েই তাকিয়ে ছিল প্রিয়তা অপূর্বের মুখের দিকে। আর তখনই উপরের কথাটা বলে অপূর্ব প্রিয়তাকে। প্রিয়তা সত্যিই স্তব্ধ তার আড়ালে তার বুবু এতকিছু করে ফেললো অথচ সে কিছুই জানে না। তার জন্যই শেষে কিনা তার বুবু জেলে। প্রিয়তার ভাবনার মাঝে আবারও বললো অপূর্ব,

‘ এবার কি তবে আব্রাহামের বিষয়টায় যাবো প্রিয়তা?’

প্রিয়তা নিরাশ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো অপূর্বের দিকে। সে কিছু বলার আগেই অপূর্ব বলে উঠল,

‘ তুমি হয়তো জানো না যবে থেকে আমি তোমার প্রতি আমার দুর্বলতা বুঝতে পেরেছি তবে থেকে আমি তোমার পিছনে আমার দুজন লোককে তোমার উপর নজর রাখার জন্য লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি কখন কোথায় যাও, কার সাথে যাও, কার সাথে কি কর, কার সাথে কি কথা বলো ইত্যাদি ইত্যাদি আমি সব আগে থেকেই জানতাম। তোমার সাথে তোমার আব্রাহাম স্যারের কবে থেকে পরিচয় উনি তোমাদের ভার্সিটির প্রফেসর হলেন কবে থেকে ইত্যাদি সবই আমি আগে থেকেই জানি। শুধু ওকে ধরতে একটু টাইম লেগেছে আমার। আমি কিন্তু তোমার আর আয়মানের বিষয়টাও জানি। এমনকি তুমি যে আয়মানের সামনে একদিন আমায় প্রিয় মানুষ বলে পরিচিয় করিয়েছিলে তাও আমি জানি। তুমি হয়তো জানো না তোমার এই আয়মানকে আমায় প্রিয় বলাটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারন আব্রাহাম তো এই আয়মানের থেকেই জেনেছিল আমি আসলে তোমার কি হই?’ আর আমিও যে তোমায় ভা__ বলেও থেমে যা অপূর্ব। শব্দটা যেন আর বের করতেও কেমন লাগছে অপূর্বের। অপূর্ব কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে আমিও যে তোমায় চাই এটাও আব্রাহাম জেনে যায় তাই তো এত কিছু। তুমি কি জানো আব্রাহাম ইফতিয়াত আসফি নামের মানুষটা আসলে সত্যি নয় ওর আসল নাম আহিল মাহামুদ। যে কোনো ভার্সিটির প্রফেসর নয়।’

অপূর্বের এবারের কথা শুনে প্রিয়তার চক্ষু যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। কি আব্রাহাম স্যার আসলে আব্রাহাম স্যার নয়। অপূর্ব প্রিয়তার রিয়েকশন দেখলো খানিকক্ষন চুপ থেকে প্রিয়তার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে খুব ঠান্ডা গলায় বলতে লাগলো,

‘ প্রায় বছর কয়েক আগে আমি তখন ভার্সিটির স্টুডেন্ট। আমার জীবনে বন্ধুবান্ধবদের কখনোই কমতি ছিল না। তবে এই বন্ধুদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় একজন বন্ধু ছিল আহিল মাহামুদ। একসাথে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির বন্ধু ছিলাম আমরা। আকিবও চেনে ওকে। যাইহোক ভার্সিটিতে ও একটা মেয়েকে ভালোবাসতো টানা তিনবছর সেই ভালোবাসা ছিল ওর, কখনো মুখ ফোটে বলেনি মেয়েটাকে এমন কি আমাকেও প্রথমে বলতে চায় নি। পরে অবশ্য বলেছিল তাও অনেক সময় নিয়ে। ওদের ভালোবাসার কথা জানার পর আমিই ওকে বলেছিলাম ও জাতে মেয়েটাকে বলে ওর ভালোবাসার কথা। মেয়েটা আমাদের থেকে এক বছরের জুনিয়র ছিল। দেখতেও সুন্দরই ছিল। আহিলের সাথে বেশ মানাতো বলে আমার ধারনা। তো একদিন ওকে একদম জোরজবরদস্তি করে মেয়েটার কাছে পাঠিয়ে ছিলাম মেয়েটাকে যাতে ওর ভালোবাসার কথা বলে। ও সাহস করে সেদিন বলেও আর মেয়েটাও মেনে নেয়। মেয়েটাকে আহিল প্রচন্ড ভালোবাসতো। মেয়েটাও বোধহয় বাসতো। সবই ঠিক ছিল কিন্তু মেয়েটা একদিন,

বলতে গিয়েও থেমে যায় অপূর্ব দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো আপনাআপনি। অপূর্বকে চুপ হতে দেখে প্রিয়তা বললো,

‘ কিন্তু কি?’

অপূর্ব তাকায় প্রিয়তার চোখের দিকে দৃঢ়তা ভরা চাহনি নিয়ে বলে,

‘ হঠাৎ একদিন মেয়েটা আত্নহত্যা করে বসে। একদমই হুট করে। খুব আকস্মিক বিষয় ছিল মেয়েটা চিঠি দিয়ে লিখে যায় আমার জন্য নাকি মেয়েটা মারা গেছে, আমিই নাকি মেয়েটাকে বাধ্য করেছিলাম আত্মহত্যা করার জন্য। কিন্তু সত্যি বলতে আমিই কিছুই জানতামই না। ওদের রিলেশনের ভিড়ের মাঝে দু’ একবার কথা ছাড়া আমাদের মধ্যে কোনো কনট্রেকই ছিল না। কিন্তু এই বিষয়টা আমি আহিলকে বোঝাতে পারি নি। রুহির লিখে যাওয়া চিঠিটাই বিশ্বাস করে নিলো গভীরভাবে। ও ভেবে নিয়েছে ওর ভালোবাসার মানুষকে আমিই মেরেছি। কিন্তু সত্যি বলতে আমি এমনটা কিছুই করি নি। ছেলেটা রুহির ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ ছিল যে মেয়েটাকে মেরে আমার কি লাভ হবে এটাই বুঝতে চাইলো না। অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু মানতে চায় নি, শেষ গিয়ে ও দেশ ছেড়ে চলে যায়। তবে আমি সত্যিই ভাবি নি ও এইভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফিরে আসবে। হয়তো আমার ভালোবাসার হাতে আমার মৃত্যু হোক এটাই ওর প্রতিশোধ নেওয়ার মূল অস্ত্র মনে হলো। এতে হয়তো আমি ওর থেকে আঘাত বেশি পেতাম। তবে কি জানো, আমি এটা ভাবি নি তুমি সামান্য একটা ভিডিও দেখে এইভাবে আমায় খুন করতে চলে আসবে। তুমি হয়তো আমায় ভালোবাসো নি। না হলে বলো না তুমি এইভাবে আমায় আঘাত করতে পারতে নাকি,

বলেই বুকের গুলি লাগার জায়গাটায় হাত রাখলো অপূর্ব খুব কঠিন ভাবে আঘাত লেগেছে তার। অপূর্ব হাত নামালো আরো বললো,

‘ আর একটা কথা আমি তোমার বাবাকে মারি নি। ওনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারি নি, তার আফসোস ছিল আমার,আমি বুঝতে পারি নি হসপিটালে তোমার বাবাকে একা রেখে এসে আমি ভুল করছি।’

প্রিয়তা সব শুনলো অপূর্বের কথা। ভিতরে ভিতরে চরম অপরাধী ফিল হচ্ছে নিজেকে। সে ভুল করেছে, চরম ভুল। অপূর্বকে অবিশ্বাস করে ভুল করেছে। কিন্তু এটা তো সত্যি নয় যে সে সেদিন অপূর্বকে খুন করতে গিয়েছিল হুম এটা ঠিক সে রিভলবার নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু অপূর্বকে মারার জন্য নয় শুধুই নিজের প্রতিহিংসাটাকে নিজের আয়ত্তে আনতে না পেরে নিয়ে গিয়েছিল। আচ্ছা অপূর্ব তো এতকিছু জানে কিন্তু এটা জানলো না সে অপূর্বকে সেদিন গুলি করে নি। তার রিভলভার থেকে একটাও গুলি বের হয় নি সেদিন। প্রিয়তা অনেকক্ষন কান্নাভেজা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো অপূর্বের মুখের দিকে। একবার কি ক্ষমা চাইবে অপূর্বের কাছে ক্ষমা করুক বা না করুক ক্ষমা চাইতে তো ক্ষতি নেই। প্রিয়তা তার চোখ মুছলো। খুব শীতল কণ্ঠে বলতে নিলো,

‘ অপ,,

আর কিছু বলার আগেই অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে কড়া কন্ঠে বলে উঠল,

‘ একদম ক্ষমা চাওয়ার জন্য মুখ খুলবে না মেয়ে, তাহলে কিন্তু এক্ষুনি গুলির আঘাতে নিঃস্ব করে দিবো তোমায়।’

প্রিয়তা দমে গেল মুখ আঁটকে গেল ওখানেই। অপূর্ব তাকে বোধহয় আর সহ্য করতেই পারছে না। প্রিয়তা মাথা নুড়ে ফেললো। স্তব্ধ হয়ে বললো,

‘ মেরে ফেলুন অপূর্ব?’ আমি থাকলে বোধহয় আপনার ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হবে না।’

অপূর্ব হাসে। যেন মজার কথা বলেছে প্রিয়তা। অপূর্ব নিজের হাসি থামিয়ে বলে,

‘ মারবো তো বটেই কারন সত্যি তুমি বেঁচে থাকলে আমার ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হবে না।’

অপূর্বের কথায় অসহায় দৃষ্টি নিয়ে প্রিয়তা তাকালো অপূর্বের দিকে। পরক্ষনেই চোখ সরিয়ে চুপ করে রইলো সে। হঠাৎই কি ভেবে যেন একটা প্রশ্ন করতে মন চাইলো প্রিয়তার। বেশ নিরাশা ভরা কন্ঠে বললো,

‘ আপনায় ক্ষমা ছাড়া একটা প্রশ্ন করবো অপূর্ব?’

অপূর্ব আবারও তাকালো প্রিয়তার দিকে অনেক ভেবে জবাব দিলো,

‘ কি প্রশ্ন?’

অপূর্বের কথা শুনে প্রিয়তা থেমে থেমে বললো,

‘ এই রুহি কেন আত্মহত্যা করেছিল এটা আপনি পরে জানেন নি?’

প্রিয়তার প্রশ্ন শুনে বেশি না ভেবেই বললো অপূর্ব,

‘ রুহি কোনো আত্মহত্যা করে নি ওকে খুন করা হয়েছিল?__ কিন্তু পুরো বিষয়টাকে কেউ একজন আত্মহত্যা রূপে সাজিয়ে আমাদের দুই বন্ধুর মধ্যে প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছিল।’

‘ এমনটা কে করেছে আপনি জানেন না?’

উত্তরে একঝলক প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে বললো অপূর্ব,

‘ না জানি না।’

অপূর্বের এই কথাটা কেন যেন প্রিয়তার বিশ্বাস করতে মন চাইলো না। সে ফট করেই বলে উঠল,

‘ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি এই কথাটা মিথ্যে বলছেন অপূর্ব। আপনি সব জানেন।’

অপূর্ব হাসে। প্রাণ খোলা এক রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলে,

‘ হুম হয়তো জানি।’

‘ কে ছিল?’

অপূর্ব জবাব দেয় না। তার ফোনটা বেজে উঠল উঠলো। তানভীর ফোন করেছে। অপূর্ব ফোনটা রিসিভ করেই বললো,

‘ জেলে বন্দী করেছো তানভীর?’

উত্তরে তানভীরও বলে,

‘ জ্বী ভাই।”

তানভীরের কথা শুনে অপূর্বও বলে,

‘ ঠিক আছে আমি আসছি।’

বলেই ফোন কাটে অপূর্ব। তারপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে শাসানো গলায় বলে,

‘ শোনো মেয়ে, দরজা খুলে যাচ্ছি বলে ভেবো না তোমায় ছেড়ে দিয়েছি, তোমার ছাড় নেই। এই অপূর্বের পিছু তুমি এই জনমে আর ছাড়াতে পারবে না। আমাদের খুব শীঘ্রই দেখা হবে। আর যেদিন দেখা হবে সেদিনই তোমায় মারবো আমি এমন মরণ দিবো তোমায় যার যন্ত্রণা তুমি এ জনমে ভুলতে পারবে না। অপূর্বের হৃদয়ে আঘাত করার ফল ঠিক কতটা ভয়ংকর সেদিন বুঝতে পারবে তুমি। ততদিন পর্যন্ত ভালো থাকো।’

বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অপূর্ব। জেল খানায় যেতে হবে তাকে। দীর্ঘ দূরত্বের, দীর্ঘ দিনের পরিচিত সেই বন্ধুর সাথে দেখা করতে হবে যে সাথে প্রতিশোধের আগুনটা আরো কতটা জ্বলবে বুঝতে হবে তো তাকে।’

অতঃপর অপূর্ব চলে গেল। আর প্রিয়তা ঠায় বসে তাকিয়ে রইলো অপূর্বের যাওয়ার পানে। চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো তার। খুব অসহায়ত্বের সঙ্গে বললো,

‘ আমিও সেদিন আপনার হাতের মরণ নিতে প্রস্তুত হয়ে আসবো অপূর্ব। হয়তো আপনার হাতের মরণই আমার ভুলের বড় মাশুল।’

#চলবে…..