#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_২৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
“আয়াতের আম্মু সবাইকে মিষ্টি মুখ করাও। তৃপ্তির রেশ প্রতিটি মানুষের মনে ঘিরে ধরেছে। সবার মুখখানা হাসিমাখা হয়ে উঠেছে। আয়াত আর আব্রাহাম নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। আয়াত মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। আব্রাহাম অসহায় দৃষ্টিতে আয়াতে’র দিকে তাকিয়ে আছে।
–অনেক রাত হয়েছে। এবার আমাদের বাসার বউকে নিয়ে, বাসায় ফিরে যেতে চাই। সফিউল চৌধুরীর কথায়, আজাদ শিকদার বলে উঠলো।
–অনেক রাত হয়েছে। এত রাতে কিছুতেই যেতে দিব না। আজকের রাতটা থেকে যান। কালকে ছোট করে একটু আয়োজন করবো। আয়োজন শেষ হলে, তারপরে যেতে দিব। এর আগে যেতে দিচ্ছি না। বলে দিলাম।
–অনেক রাত হয়েছে। আড্ডা কাল সকালে হবে। এখন সবাই ঘুমাবে। আয়াত’কে রুমে দিয়েছি আসছি। তোমরা সবাই ঘুমোতে যাও। আয়াতের আম্মুর কথায় সবার মুখ চুপসে গেল। মুখটা গম্ভীর করে ফেলল। আয়াত আম্মু হেসে বলল।
–মুখ গম্ভীর করে লাভ নেই। রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। শরীর খারাপ করে, আমার কোনো আড্ডা নেই। আয়াতের আম্মুর কথা শুনে, সবাই একটু হালকা খাবার খেল। খেয়ে সবাই রুমে চলে গেল। রজনী শশুর-শাশুড়ীকে রুম দেখিয়ে দিল। ড্রয়িং রুম ফাঁকা হতেই, আয়াতের আম্মু ঝাঁজালো কণ্ঠে আজাদ শিকদারকে উদ্দেশ্য করে বলল।
–তোমাকে কি আলাদা করে, দাওয়াত করতে হবে। এতক্ষণ ভালোই রাগ দেখালে, এখন এখানে বেকুবের মতো বসে আছো কেনো? আজাদ শিকদার কোনো কথা না বলে, হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল। আয়াতের আম্মু আব্রাহাম’কে উদ্দেশ্য করে বলল। তোমরা আমার সাথে আসো। বলেই আয়াতের রুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বলল।
–বিয়ের পরে স্বামীরাই মেয়েদের সব। একদম আব্রাহামের সাথে খারাপ ব্যবহার করবি না। আগের কথা তুলে, বর্তমানকে নষ্ট করবি না। আমাদের জীবন’টা আর কয়দিনই বা আছে। যে, ক’টাদিন বাঁচবি। সুন্দর করে নিজের জীবন কাটাবি। একদম আব্রাহামের সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলবি না। মায়ের কথা শুনে আয়াত গম্ভীর হয়ে, উত্তর দিল।
–তুমি যে, বাবার সাথে একটু আগে, বাজে ব্যবহার করলে? আয়াতের কথা শুনে, আয়াতের আম্মু রক্তিম চোখে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াতের প্রচুর হাসি পাচ্ছে। এই মুহূর্তে হাসা যাবে না। সে-তো বাবা-মায়ের ওপরে রেগে আছে। নিজের হাসিকে মাটি চাপা দিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলো। আয়াত আর আব্রাহামকে রুমে বসিয়ে দিয়ে, আয়াতের আম্মু চলে গেল। আয়াতের শাড়ি পড়ে থাকতে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। রুমে এসে কোনো কথা না বলে, ওয়াশরুমে চলে গেল। আব্রাহাম রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে, বিছানায় বসে আয়াতের জন্য অপেক্ষা করছে। একটু পরে আয়াত ফ্রেশ হয়ে, ড্রেস চেঞ্জ করে আসলো। আয়াত আব্রাহামে’র দিকে না তাকিয়েই, বিছানায় উঠে যাচ্ছিল। তখনই হাতে টান অনুভব করল। রাগান্বিত হয়ে আব্রাহামে’র দিকে তাকিয়ে আছে। আব্রাহাম আয়াত’কে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসলো। আয়াত হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য, হাত মোচড়ামুচড়ি করছে। রক্তিম চোখে আব্রাহামে’র দিকে তাকালো। আব্রাহাম আয়াতে’র দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে, আয়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আয়াত চাইলে-ও নড়াচড়া করতে পারছে না। এই প্রথম মানুষ’টা তাকে কাছে টেনে নিল। আজকে মানুষটার ব্যবহারে আয়াত অধিকারবোধ খুঁজে পেল। বড্ড অভিমান হচ্ছে মানুষটার ওপরে। ফিরে যদি আসারই ছিল, তাহলে চলে গিয়েছিল কেনো? আমি তোমাকে এত সহজে ছেড়ে দিব না আব্রাহাম। আমি যতগুলো কষ্ট পেয়েছি। প্রতিটি কষ্টের ছোঁয়া তোমাকে অনুভব করাবো। তোর থেকে দূরে যাবার সাধ্য আমার নেই। কিন্তু তোমার পাশে থেকে, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার আমার আছে। মানুষটা কাছে থাকলে, আয়াত অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করবে। মানুষটার দেখা আয়াতে’র হৃদয়কে কতটা শীতল করে দেয়। মানুষটা যদি জানতো। তাহলে কখনো তাকে রেখে পালিয়ে যেত না। মানুষটার মুখের দিকে তাকালে আর ক’টাদিন বেশি বাঁচতে ইচ্ছে করে। মানুষটার চেহারায় মনে হয় জাদু আছে। তা-না হলে আমার অভিমান গুলো’ও কি মানুষটার প্রেমে পড়তে পারে। আয়াত’কে পাথরের ন্যায় বসে থাকতে দেখে, আব্রাহাম নিজের বুক থেকে আয়াতকে তুলল। কাতর কণ্ঠে বলল।
–তুমি আমার ওপরে এখনো রেগে আছো? তাই না আয়াত।আয়াতের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর আসলো না। নিরুত্তর রইলো সে। মানুষটা কথা বললেই, তার অভিমান গুলো পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠে। আয়াত আবার দূরে সরে যেতে চাইলে, আব্রাহাম পেছনে থেকে দু’হাতে আবদ্ধ করে দিল। আয়াতের কণ্ঠদেশে চিবুক ঠেকিয়ে বলল।
–স্যরি আমাকে মাফ করে দাও। তুমি আমার সবকিছু জানো? কেনো আমি এমন করেছি। তারপরে-ও আমার সাথে কথা বলবে না। তোমার নিরবতা, আমাকে ভিষণ করে পিড়া দিচ্ছে। তোমার নিরবতায় আমার বুকের মধ্যে খানে, কি পরিমাণ যন্ত্রনা হয়। তা যদি এক বিন্দু অনুভব করতে পারতে, তাহলে তুমি চুপ থাকা ভুলে যেতে। এভাবে চুপ থেকো না। আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার হলে, আমার কাছে থেকে দিবে। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না। আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, আমি বড্ড এলোমেলো হয়ে যাব। এতটা এলোমেলো হয়ে যাব। যতটা এলোমেলো হয়ে গেলে, মানুষের আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এবার আয়াতের ঝাঁজালো কণ্ঠ ভেসে এলো।
–এর আগে রেখে পালিয়ে গিয়ে ছিলাম। তাই আমাকে এমন কথা বলা হচ্ছে, সে নিজে অকৃতজ্ঞ। তাই সবাইকে নিজের মতো মনে করে। আয়াতের কথায় আব্রাহাম এতটুকুও বেজার হলো না। অধরের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছে। আয়াত’কে দিয়ে কথা বলানোর জন্যই তো এত ছলনা করল সে। আব্রাহাম আয়াতকে আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে, আয়াতের গলদেশে অধর জোড়া চেপে ধরলো। আয়াতের পুরো শরীর তড়িৎ গতিতে কেঁপে উঠলো। পুরো শরীর শীতল হয়ে আসছে। হাত-পা কেমন অবশ হয়ে আসছে। শরীর থেকে, শক্ত গুলো জোট বেঁধে পালিয়ে যেতে শুরু করেছে। আয়াতকে সামনের দিকে ঘুরিয়ে আয়াতের সমস্ত মুখশ্রীতে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলো। মানুষটার একটু পাগলামি, আয়াতের দুর্বলতা। তার একটু পাগলামি আয়াতের সব দুঃখ কষ্ট মুহুর্তের মধ্যে ভুলিয়ে দেয়। এত সহজে দুর্বল হলে, তো চলবে না। আয়াত আব্রাহামকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিল। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।
–আর একবার যদি আমার কাছে আসার চেষ্টা করেছো? তাহলে আমি রুম থেকে বেড়িয়ে যাব। আমাকে তোমার কি মনে হয়। আমি পুতুল। আমাকে নিয়ে যখন ইচ্ছে, তখন খেলা যায়। তোমার যখন ইচ্ছে হবে। তুমি আমাকে কাছে টেনে নিবে। আর যখন ইচ্ছে হবে। আমাকে রেখে পালিয়ে যাবে। এত কিছুর পরে-ও স্বামীর অধিকার নিতে আসো কোন মুখে, আমি কিছু ভুলি নাই আব্রাহাম। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তার মানে এই না। যে, আমি তোমার সব অন্যায় মেনে দিব। যখন আমি নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য, পাগলের মতো ছটফট করেছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো জানো? আমি কারো সাথে কথা বলতে পারতাম না। আমি বাহিরে বের হলে, লোকে আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করতো। তুমি আমাকে হাসির বস্তু বানিয়ে ফেলছো। কান্না করতে করতে, আমার চোখ দু’টো যখন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। তখন কেউ আদর করে চোখ মুছিয়ে দেয় নাই। আমার খারাপ সময় গুলো, আমি নিজেই নিজেকে শান্তনা দিয়ে পার করেছি। আমার বিপদের সঙ্গী আমি নিজেই হয়েছি। এতগুলো দিন পরে তুমি আসলে, বললে আমাকে মাফ করে দাও। বললেই মাফ পাওয়া যায়। আমি যে, ভেতরে থেকে একটু একটু করে শেষ হয়ে গিয়েছি। তিলে তিলে তুমি আমাকে মেরে ফেলছো আব্রাহাম। এতকিছুর পরে-ও আমি তোমাকে ভালোবাসবো। সবকিছু ভুলে, তোমার সাথে নাচতে নাচতে সংসার করবো। আমি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে, তোমাকে বিয়ে করেছি। এটা ভেবো না। আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না। কথা গুলো বলতে বলতে আয়াতের দু-চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে। আব্রাহাম যত্ন সহকারে আয়াতের দুচোখের পানি মুছিয়ে দিল।আয়াত আব্রাহামে’র হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিল। মুখটা গম্ভীর করে নিয়ে, বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়লো। আব্রাহাম স্থীর হয়ে বসে রইলো। আয়াত একটা কথা’ও ভুল বলেনি। তার সামান্য ভুলের জন্য, কতগুলো মানুষ কষ্ট পেয়েছে। মানুষ ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আব্রাহাম। তোর এই একটা ভুল, তোকে অনেক বড় শিক্ষা দিয়েছে। অনেক তো ভেবেছিস অন্যের কথা। এবার নিজের ভালো থাকার কথাটা একটু তো ভাব। আয়াত অনেক কষ্ট পেয়েছে। আয়াতকে আর কখনো আয়াতকে কষ্ট পেতে দিব না। নিজের সর্বস্ব দিয়ে আয়াতকে ভালো রাখতে হবে। কথা গুলো ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আব্রাহাম।
আয়াত ওপাশ হয়ে শুয়ে আছে। একটু পর পর দু-চোখের অশ্রুকণা গুলো মুছে ফেলছে। আব্রাহাম আয়াতের পাশে শুয়ে আয়াতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপরে শাসিয়ে বলল।
–আর এক ফোঁটা খালি চোখের পানি ঝড়ুক। আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এত কান্না করার কি আছে। তোমার স্বামী তোমাকে রেখে পালিয়ে গিয়েছে। কোথায় তুমি স্বামী সাথে, চুল ছিঁড়াছিঁড়ি করবে। স্বামীর কলার চেপে ধরে, শাসিয়ে বলবে। এতদিন কোন মেয়ের সাথে ছিলি। তা-না করে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিয়েছো। আব্রাহামের কথা শুনে আয়াত রেগে আব্রাহামের হাতে কামড় বসিয়ে দিল। আব্রাহাম হালকা করে আয়াতের গলদেশ কামড় বসিয়ে দিল। আয়াত তেড়ে আব্রাহামের দিকে ঘুরতে যাবে। আব্রাহাম আয়াত’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল। মারামারি করার হলে, কালকে সকালে করবে। অনেক দিন শান্তি করে ঘুমোই না। আজকে শান্তি করে ঘুমাবো। আব্রাহামের কথা শুনে আয়াত মুখ বাকালো। তা দেখে আব্রাহাম হালকা হাসলো।
চলবে…..
#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_২৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
অন্ধকার রুমের মধ্যে বসে আছে আহনাফ আর আরোহী। বিধস্ত অবস্থায় আহনাফের সাথে মিলে, আছে আরোহী। মার খেতে খেতে, আরোহী ক্লান্ত হয়ে গেল। মারতে মারতে ক্লান্ত হলো না আহনাফ। অমানুষের মতো নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে আরোহীর ওপরে, আরোহী বারবার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। আহনাফ বারবার আরোহীর সেন্স ফিরিয়ে নিজের, কার্যক্রম শুরু করে দিচ্ছে। আরোহীর চুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।
–আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না আরোহী। ভালোবাসি বলে, তোমার সব জেদ সহ্য করছি। যেদিন সহ্যসীমা পার হয়ে যাবে। তোমার শরীর থেকে, মাথাটা আলাদা করে দিতে, দু’বার ভাববো না। আমার কথা মতো চলো। পৃথিবীর সমস্ত সুখ আমি তোমাকে এনে দিব। বারবার করে বলে ছিলাম। আব্রাহাম আর আয়াতের বিয়েটা আটকে দাও। আমার কথা রাখোনি। এখন একটা কাজে দিলাম। সেটা করতে-ও তুমি নারাজ। তুমি চাও’টা কি আমাকে বলতে পারো। আমার সাথে সারাজীবন থাকার ইচ্ছে আছে। আহনাফের কথা শুনে, আরোহী কাতর স্বরে বলল।
–আমি এত জঘন্যতম কাজ করতে পারবো না। দোহাই লাগে তোমার। আমাকে দিয়ে এতটা নিকৃষ্ট কাজ করিয়ে নিও না। আমি মরে যাব। তবু-ও এ কাজ করবো না। তুমি আমাকে মারতে মারতে মেরে ফেলো। তোমার হাতে আমার মৃত্যু হোক। তোমার মতো অমানুষকে ভালোবেসেছি। তোমাকে ভালোবাসার শাস্তি, আমার মৃত্যু দিয়েই শেষ হোক। আমি পরিবারকে ছেড়ে একটা ভরসা যোগ্য হাত ধরে ছিলাম। তখন কি বুঝেছিলাম। আমি কয়লাকে হীরা ভেবে কাছে টেনে নিয়েছিলাম। আমি যদি বাবা-মায়ের পছন্দ মতো বিয়ে করতাম। জীবনে অনেক সুখী হতাম। বাবা-মাকে কষ্ট দিয়েছি। তাদের চোখের পানি ঝরিয়েছি। তাদের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস আমাকে অভিশাপ দিয়েছে। তাই তো আমার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে। বাবা-মার মনে কষ্ট দিয়ে, কেউ কোনোদিন সুখী হতে পারে না। কথাটা আজকে বিশ্বাস করলাম। কারন আমি নিজে তার প্রমাণ।
–তুমি জানো না আরোহী। আমি কতটা খারাপ হতে পারি। তোমার কোনো ধারণা নেই। আমি তো সফিউল চৌধুরীর নিজের ছেলেই না। তাহলে আমি কিভাবে ওদের ওপরে মায়া দেখাবো। আমার সাথে সফিউল চৌধুরী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমি পুরো চৌধুরী পরিবারকে শেষ করে দিব। আব্রাহাম আমার থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিয়েছে। সবার আগে, আমি আব্রাহামকে খু’ন করবো। তার জন্য আমার তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। তুমি যদি আমাকে সাহায্য না করো। তাহলে এভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে আরোহী। আরোহীর থেকে কোনো রকম রেসপন্স আসলো না। আরোহী আবার সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। আহনাফ বিরক্ত হয়ে, আরোহীকে কোলে তুলে দিল।
চৌধুরী বাসায় আসতেই সবাই যে, যার মতো বাসার মধ্যে চলে গেল। আয়াতের স্থীর দৃষ্টিতে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। আয়াতের মনের ভাষা বুঝতে পেরে। আব্রাহাম তাচ্ছিল্য করে বলল।
–আমাকে বিয়ে করেছো। এর থেকে বেশি কিছু আশা করো না। আব্রাহামের কথায় বিরক্ত হলো সে। সকাল থেকে আব্রাহামের সাথে, একটা কথা-ও বলেনি সে। আয়াত কোনো কথা না বলে, মুখটা গম্ভীর করে বাসার মধ্যে প্রবেশ করল। মনের মধ্যে খানে, অজানা একটা কষ্ট রয়েই গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আব্রাহামের রুমের দিকে গেল। আয়াতের বাবার সামনে আব্রাহামের বাবা-মা যতটা ভালো ব্যবহার করে, নিজের বাসায় আসলে সবকিছু এক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। গিরগিটির থেকে-ও দ্রুত রং বদলে ফেলে, আব্রাহামের বাবা-মা। নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো আব্রাহাম বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সে বেশ ক্লান্ত। আয়াত প্রয়োজন ছাড়া একটা কথা-ও আব্রাহামের সাথে বলছে না। তাতে আব্রাহামের দুঃখ নেই। দুজন মিলে, একসাথে কষ্ট পাবার মধ্যে’ও আলাদা এক শান্তি আছে। একটু পরে রজনী এসে খাবার খাওয়ার জন্য ডেকে গেল। আব্রাহাম এই বাসায় খায় না। অনেক গুলো দিন হয়েছে। হসপিটালে যাওয়া হয় না। নিজের দায়িত্ব থেকে এভাবে সরে আসা যাবে না। তাই সে ঠিক করে নিল। এখন থেকে রোজ হসপিটালে যাবে। আব্রাহাম তৈরি হয়ে নিচে নামলো। আব্রাহামের সাথে আয়াত’ও নামলো। আব্রাহামকে সোজা বেড়িয়ে যেতে দেখে আয়াত কঠিন কণ্ঠে বলল।
–কোথায় যাচ্ছো তুমি? আয়াতের কথার মাঝে, আব্রাহামের আম্মু ফোঁড়ন কেটে বলল।
–মহারাজ এই বাসায় খান না। বাহিরে খান। তাই না খেয়ে হসপিটালে চলে যাচ্ছে। ওকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। বাহিরে গিয়ে ঠিক খেয়ে নিবে। ও তোমার কথা কয়দিন চিন্তা করছে। ওকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা করতে হবে না। তুমি খেতে বসো।
–আব্রাহামকে নিয়ে আমি চিন্তা না করলে, কে করবে আন্টি। সেখানে আব্রাহামকে নিয়ে, আপনার বেশি চিন্তা করার কথা। সেখানে মা হয়ে, নিজের ছেলেকে রেখে কিভাবে খেতে বসতে পারেন? মায়েরা তো এমন হয় না আন্টি। আমি যদি না খেয়ে কলেজে যাবার কথা বলি। আমার আম্মু আমার পুরো পরিবারকে ধুইয়ে দেয়। আপনার মধ্যে মাতৃত্বের স্বাদ খুঁজে পাচ্ছি না।
–বিয়ে হয়েছে। রাত পোহাতেই পারলো না। শাশুড়ীর সাথে তর্ক করতে শুরু করে দিয়েছো। আব্রাহামের বাবা-মা আমরা। আমাদের থেকে, তুমি বেশি ভালোবাসো নাকি আব্রাহামকে?
–সে কথা আমি কখন বলেছি। মানুষটাকে একবার ভালোবাসে কাছে ডেকে খাইয়ে দিলে কি হয়? আবরার ভাইয়া না খেয়ে চলে যেতে লাগলে, ঠিকি ভাইয়াকে ডেকে খাওয়ান। তাহলে আব্রাহামের বেলায় তা ভিন্ন কেনো?
–দেখেছো রজনী। তোমার বোন একদিন হলো বাসায় এসেছে। এসেই তোমাদের হিংসা করতে শুরু করে দিয়েছে। তোমার নিজের বোন হয়ে, যদি তোমাকে হিংসা করে। তাহলে মানুষ তো তোমাকে মাটির নিচে ফেলে কথা শোনাবে।
–এখানে পরিবারের লোক ছাড়া আর কেউ নেই আন্টি। তাই কথা গুলো বাহিরে যাবার কোনো চান্স নেই। এখন যদি ঘরের লোক গিয়ে, পরের কানে কানে গিয়ে বলে আসে।
–তোমরা কিছু শুরু করে দিয়েছো। আমি বাসার খাবারে অভ্যস্ত নই। আমি বাহিরের খাবারে অভস্ত্য। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বাহিরে থেকে খেয়ে নিব। আব্রাহামের কথায় বিরক্ত হলো আয়াত। গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
–তোমাকে কেউ কথা বলতে বলেছে। তোমরা যখন বড়রা কথা বলো। আমি একটা কথা’ও বলি না। তবে আমার কথার মাঝে এত বাঁধা সৃষ্টি করছো কেনো? নিজের বাসা থাকতে বাহিরে খাবে কেনো? এখন থেকে প্রতিদিন বাসা থেকে খেয়ে যাবে। কেউ যদি তোমার জন্য রান্না না করে, তাহলে আমি তোমার জন্য রান্না করবো। এখন থেকে না খেয়ে গেলে, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আয়াতের কথা শুনে, আব্রাহাম শক্ত হলো। কাঠিন্য কণ্ঠে বলল।
–আমার এই বাসায় খাবারে অভ্যাস নেই। সবকিছুতে পাগলামি চলে না আয়াত। আমি খাব না। তোমার যা ইচ্ছে খুশি করে নাও। আব্রাহাম আরো কিছু বলতে যাবে। আব্রাহামের কথায় পাত্তা না দিয়ে, আয়াত দ্রুত পায়ে ড্রয়িং রুম ত্যাগ করল। চোখের পলকে ওপরে চলে গেল। আব্রাহাম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আবরার আর রজনী মুখ চেপে হাসছে। বাবার’ও বাবা থাকে। আব্রাহামকে সবাই ভয় গেলেও আয়াত যে, এক বিন্দুও ভয় পায় না। তা প্রতিটি মুহুর্তে আব্রাহামকে উপলব্ধি করাচ্ছে আয়াত। আয়াতের জেদের কাছে আব্রাহামের জেদ অতি নগন্য। আব্রাহাম ভালে করেই জানে, ও মেয়ে রেগে গিয়েছে। আজ সারাদিনে একটা দানাও মুখে তুলবে না। আব্রাহাম ঠিক করল। বাহিরে থেকে খাবার নিয়ে, দ্রুত বাসায় আসার চেষ্টা করবে। আর রজনীকে দিয়ে, খাওয়ানোর চেষ্টা করাবে। এক মুহুর্ত দেরি করল না। দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেল।
ঘড়ির কাটায় রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। আব্রাহাম চুপি চুপি নিজের রুমে প্রবেশ করল। শেষ রক্ষা হলো না। আয়াত আব্রাহামের মুখের সামনে ফোন ধরে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
–কয়টা বাজে? এতক্ষণে আসার সময় হলো! এতক্ষণ কোন মেয়ের সাথে ছিলে?
–কি আশ্চর্য! আমি কেনো মেয়েদের সাথে থাকতে যাব। অনেক দিন হসপিটালে, যাওয়া হয় নাই। কিছু জরুরি কাজ ছিল। তাই আসতে দেরি হয়েছে।
–আজকে তোমার দিনে, ডিউটি ছিল। রাতে কার সাথে স্পেশাল ডিউটি করে আসলে? আমি কি তাকে দেখতে পারি। আয়াতের কথা উত্তর না দিয়ে, আব্রাহাম খাবারের প্যাকেট বের করে আয়াতের হাতে দিল। হাতে দিতে দেরি হলে-ও ছুড়ে ফেলতে এক মুহুর্ত সময় নিল না আয়াত। রেগে গর্জন করে উঠলো।
–সারাদিন পরে এসে নাটক করা হচ্ছে, এতক্ষণ কোথায় ছিলে। তোমার এত জেদ। সকালে খেয়ে যেতে বললাম। না খেয়ে চলে গেলে। আমি’ও দেখবো। তোমার জেদ কতক্ষণ থাকে। রজনী আপুকে দিয়ে, ছলনা করে আমাকে খাইয়ে নিয়েছো। এটা আমি বুঝবো না। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে, তোমার সাথে আছি। আমার সাথে ছলনা করো।
–যে বাসায় খাবারের খোটা দেওয়া হয়। সেই বাসায় অন্তত খাবার খাওয়া যায় না। বিষ খাওয়া। আর এই বাসার খাবার খাওয়া একই কথা। আব্রাহামের কথা শুনে, আয়াত কিছু একটা ভেবে বলল।
–আমি রান্না করলে খাবে?
–তুমি তো রান্না করে পারো না?
–আমি রজনী আপুর সাহায্য নিয়ে, রান্না করলাম তাহলে খাবে?
–হ্যাঁ খাওয়া যেতে পারে।
আয়াত আর কোনো কথা বলল না। একটা কাগজ আর কলম নিয়ে বসলো। একটু পরে একটা বড় লিস্ট আব্রাহামের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল।
–যাও এগুলো নিয়ে আসো। আয়াতের কথা শুনে, আব্রাহাম চোখ বড় বড় করে তাকালো। অবাক হয়ে বলল।
–এগুলো কি?
–এত পড়াশোনা করেছো? সামান্য বানান যদি পড়তে না পারো। তাহলে কিসের পড়াশোনা করেছো? তুমি এই বাসার খাবার খাবে না। তাই গ্যাসের চুলা থেকে, শুরু করে সংসারের যা যা লাগে, সবকিছু লিখেছি। আমি রান্না করবো। তুমি প্রতিদিন খেয়ে যাবে। আজ থেকে না খেয়ে বাসা থেকে বেরোনো তোমার জন্য সারাজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। আমার মুখের ওপরে কথা বললে, কি হবে। সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। অবশ্যই তোমার টাকায় নিয়ে আসতে হবে। তোমার টাকা না থাকলে, আমাকে বলবে। আব্বুর থেকে টাকা চেয়ে নিব। আয়াতের কথা শুনে, আব্রাহাম রাগান্বিত হয়ে বলল।
–বউকে ভরনপোষণ দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার আছে। বলেই হনহন করে চলে গেল। প্রায় তিন ঘন্টা পরে আব্রাহাম বাসায় আসলো। দু’জন লোক সবকিছু উপরে গিয়ে দিয়ে আসছে। আব্রাহামের রুমের পাশে, একটা ছোট রুম রয়েছে। সেটাকেই রান্না ঘর হিসেবে বেছে নিয়েছে আয়াত। আব্রাহাম প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে এসেছে। আরো অনেক কিছু কেনার বাকি আছে। সেগুলো কালকে গিয়ে কিনবে। আব্রাহামের সবকিছু আব্রাহামের বাবা-মা পর্যবেক্ষণ করছে। আব্রাহামের বাবা মুখ কালো করে বসে আছে। আব্রাহামের মা একটু পর পর মুখ বাকিয়ে চলেছে। আব্রাহামের বাবা মনে মনে ভাবতে লাগলো। মেয়েটা একদিনে এতকিছু করে ফেলছে। তাহলে আর ক’টাদিন থাকলে, কি করবে। খুব দ্রুত এদের বাসা থেকে বের করতে হবে। তা-না হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
আব্রাহাম চলে যাবার পরে, আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে ফ্লোরে থেকে খাবার গুলো তুলে, একটা প্লেটে রেখেছিল আয়াত। আব্রাহাম রুমে আসতেই, আব্রাহামের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল।
–খেয়ে নাও। আব্রাহাম হাত মুছতে মুছতে বলল।
–আমাকে দিয়ে এত কাজ করালে, এত রাতে এতগুলো জিনিস কেনালে, আমার নিজে হাতে খেতে বলছো। বিয়ে করলে, এত কষ্ট করতে হয়। আগে জানলে কোনোদিন বিয়েই করতাম না। আয়াত রাগান্বিত হয়ে আব্রাহাম দিকে তাকালো। আব্রাহাম বোকা বোকা চেহারা করে আয়াতের দিকে তাকালো। আয়াত নিজ দায়িত্বে আব্রাহামকে খাইয়ে দিল। আব্রাহামের খাওয়া শেষ হলে, আব্রাহামকে উদ্দেশ্য করে বলল।
–একা একা নির্লজ্জের মতো খেয়ে নিলে, আমি যে না খেয়ে আছি। সেদিকে তোমার কোনো খেয়াল আছে। তুমি এখন আমাকে রান্না করে খাওয়াবে। না হলে আজকে তোমার কোনো ঘুম নেই। আয়াতের কথা শুনে, আব্রাহাম আয়াতের নিজের কোলে বসিয়ে নিল। আয়াতের হাতের ভাজে হাত মিলিয়ে দিয়ে বলল।
–আস্তে বলো। পাশের রুমে ভাই ভাবি আছে। তারা শুনলে কি বলবে। আব্রাহামের বউয়ে লজ্জা নেই। তুমি আমাকে ঘুমোতে দিবে না ভালো কথা। আমার কোনো আপত্তি নেই। তোমারই তো বর। সারারাত যতখুশি আদর করতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না। বলেই আয়াতের গলদেশ মুখ লুকালো।
চলবে…..