#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২১
তিতিরের করা প্রশ্নে চমকে ওঠে মাশরিফ। আমতা আমতা করে কী জবাব দিবে ভেবে পেলো না। তারপর ভাবলো সত্যটাই বলে দিক। একদিন যখন সত্যটা জানতে পারবে তখন হয়তো ভুল বুঝবে! তাই আগেভাগেই সত্যটা বলে দিলে এই ভুল বোঝাবুঝিটা হবে না বা কিছুটা হলেও কমবে। তাই মাশরিফ মুচকি হেসে তিতিরের প্রশ্নের জবাবে বলল,
“হ্যাঁ। আমি আর্মিতে আছি। হঠাৎ আপনার এই প্রশ্নটা কেন মনে হলো?”
জবাবের বদলে তিতির পাল্টা প্রশ্ন করল,
“আপনি যে আর্মিতে আছেন এটা সেদিন বললেন না কেন? আপনাকে তো জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি কী-সে পড়েন বা কী করেন?”
তিতির কথায় সন্দেহের ধাঁচ। মাশরিফ ঠোঁট কা*ম*ড়ে হেসে উত্তর দিল,
“কী করি তা জিজ্ঞেসা করা হয়নি। আমি মেডিকেলে পড়ি কী-না তা জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল। তাই ওইটুকুই জবাব দিয়েছি। তাছাড়া আমি তো এখন পড়াশোনাই করছি না।”
এমন দুর্বোধ্য জবাবে তিতির থতমত খেয়ে গেলো। ছেলেটা সহজ প্রশ্নের ঘুরিয়ে জবাব দেয়! যেনো, খাবার সরাসরি না খেয়ে মাথার পেছোন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে খাওয়া! তিতির ফুঁস করে লম্বা শ্বাস ফেলে বলে,
“আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা তো আপনাকে জিজ্ঞাসা করিনি, আপনি কোথায় জব করেন? তাই না? আপনার জবাব আপনার দিক দিয়ে ঠিকই আছে। মানে জিজ্ঞাসা না করলে কেনই বা বলবেন!”
মাশরিফ ঠোঁট চেপে হাসি কন্ট্রোল করল। তারপর একটুখানি হেসে বলল,
“তোমার মনে কোন প্রশ্ন থাকলে সরাসরি প্রশ্ন করবে। সংকোচ করবে না। আমি জবাব দিতে একটুও কার্পণ্য করি না। এই যে একটু আগে প্রশ্ন করলে, আমি আর্মিতে কিনা? জবাব তো দিলাম। তাই না?”
তিতির অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মুখ হালকা ভে*ঙাল! তারপর বিড়বিড় করে বলল,
“এহ! এসেছে প্রশ্নের জবাব দিতে! প্রতিটা কথায় নিজেই প্যাঁ*চ লাগিয়ে মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করে দেয়! সে আবার জবাব দিবে!”
কিন্তু এসবেও তিতিরের মনে একটা খুঁতখুঁতে ভাব রয়ে যায়। তার মনে একটা প্রশ্ন উুঁকি দিচ্ছে। করবে কি? করবে না? ভেবে মৌন থাকার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু মাশরিফ তো এই অস্থীরতা তিতিরের মুখ দেখে বুঝে গেছে। তাই মাশরিফ নিজেই জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি কি কিছু বলতে চাও? বলতে চাইলে নিঃসন্দেহে, নিঃসংকোচে বলো।”
তিতির হকচকিয়ে তাকায়। লোকটা কি তার মনের খবরও রাখে! এখন সে প্রশ্নটা করতে চাইল না। কারণ যাতে মাশরিফের চিন্তাশক্তি সত্য প্রমান না হয়। তিতির মাথা নাড়িয়ে বলল,
“কই নাতো।”
মাশরিফ আর জবাবে কিছু বলল না। অভী এবার বলে ওঠে,
“গাইজ, আমাদের বার্থডে বয় নিজের হাতে কাল রাতে তার মায়ের রাগ ভাঙ্গাতে কেক বানিয়েছে। কিন্তু আন্টির তো ডা*য়বেটিস আছে তাই আন্টি এক পিসের বেশি খেতে পারেনি। ওদের বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। তাই সে কেকটা আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে। ওয়ান্না টেস্ট ইট?”
ইমরান, রণক সবার আগে সমস্বরে উৎসাহী কন্ঠে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ হ্যাঁ।”
নাদিয়া অবিশ্বাস্য কণ্ঠে শুধাল,
“সত্যি? সত্যি ভাইয়া নিজে কেক বানিয়েছেন? ওয়াও! তাহলে তো টেস্ট করে দেখতে হয়।”
অর্ক একটু গর্ব করে বলল,
“আমাদের মাশরিফ সবসময় অলরাউন্ডার! রান্নাবান্না থেকে কাপড় কাঁচা সবেতে সে সেরা!”
অর্কর কথায় সবাই ফিক করে হেসে ফেলল। মাশরিফ অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
“আরে না। আমি মায়ের রাগ ভাঙাতে অনেকটা সময় নিয়ে ইউটিউবে ভিডিও দেখে দেখে কেকটা বানিয়েছি। এমনিতে রান্না বলতে ডিম ভা*জি, ডিম পোস ও কফি বানাতে পারি।”
জারিন বলে,
“সমস্যা নাই ভাইয়া। আপনি কেকটা বের করেন। আমরাও একটু টেস্ট করি।”
মাশরিফ হাতে থাকা ছোটো শপিং ব্যাগ থেকে একটা বাটি বের করল। তাতে কেকের পিস কে*টে কে*টে আনা হয়েছে। তারপর নিজেই সবার কাছে বাটি নিয়ে গেল। সবাই এক পিস করে কেক তুলে নেয়। তিতিরও ভদ্রতা সূচক হেসে কেকের পিস তুলে নেয়। কেকটা সামান্য খেয়ে মনে হলো ভালোই খেতে। সবাই প্রশংসা করল। তিতির এবার পাশে বসা ফাইজাকে নিচু স্বরে বলল,
“শোন, উনাকে জিজ্ঞেসা করতো, উনি আর্মিতে কোন পদে আছে?”
ফাইজা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“তুই জিজ্ঞেসা কর।”
“আরে তুই কর না। কৌতুহল হচ্ছে।”
“আচ্ছা ওয়েট। একটু পর জিজ্ঞাসা করি।”
মাশরিফ তিতিরের দিকে আড় নজরে লক্ষ্য করছিল। তিতিরকে ফাইজার কানের কাছে কিছু বলতে দেখে তার মন কৌতুহলী হলো কিন্তু সে তো ওদের ফিসফিসানি কথা শুনতে পাচ্ছে না। এদিকে মাশরিফের বন্ধুরা কেকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
কেক খাওয়া শেষ হওয়ার পর ফাইজা বলল,
“ভাইয়া তো দারুন কেক বানান। কেকটা জাস্ট ওয়াও! একজন আর্মির হাতের কেকও যে এতো সফট হতে পারে ধারণাতে ছিল না। ভেবেছিলাম হয়তো সফট হবে না। কিন্তু ধারণা বদলে গেলো। তা ভাইয়া? আপনি আর্মিতে কোন পদে আছেন?”
মাশরিফ চোখে হাসল। খানিক উ*সকা-তে বলল,
“যার প্রশ্ন সে করলেই পারত। আমি মাইন্ড করতাম না। আমি আর্মিতে মেজর পদে আছি। এই এক মাসের কিছুটা বেশি সময় হলো মেজর পদে পদোন্নতি হয়েছে।”
মাশরিফের প্রথম কথাটাতে তিতির খুব অপ্রস্তুত হয়ে পরল। কিছুক্ষণ আগেও এই প্রশ্নটা সে জিজ্ঞেসা করতে চেয়েও করেনি আর এখন বান্ধবীকে দিয়ে বলানোর পরেও বুঝে গেল! কিভাবে তা বোধগম্য হচ্ছে না তার। কিন্তু শেষোক্ত কথায় তার বুক ধ্বক করে ওঠল। মেজর! মনে সন্দেহের দানা যেনো কুঁড়িতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
জারিন এবার মাশরিফকে প্রশ্ন করল,
“আর্মিতে ঢুকেছেন কতো বছর হলো ভাইয়া? এতো দ্রুত মেজর কিভাবে হলেন? না মানে, কিছু মনে করবেন না। আমার আইডিয়া নেই ব্যাপারটাতে।”
মাশরিফ হেসে জবাব দিল,
“আরেহ না। আমি কিছু মনে করেনি। আমাদের এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের পরপরই আমি আর্মিতে ভর্তি হই ক্যাডার হিসেবে। তখনি এপ্লাই করতে হয়। তারপর চার বছর কোর্সের শেষে দুই বছর আগে সেকেন্ড ল্যাফটেনেন্ট(আমার জানামতে সেকেন্ড ল্যাফটেনেন্ট প্রথমে হয়) হই তারপর আমার পদোন্নতি দ্রুতই হয়। সেই সাথে অভীরও। যেহেতু আমি ও অভী ক্যাডেটের স্টুডেন্ট এবং সবার থেকে আমার ও অভীর পারফর্মেন্স ভালো ছিল এটাও একটা কারণ তবে আমাদের দুজনের বাবাও আর্মিতে ছিলেন ও আছেন। তাছাড়া পদোন্নতির জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অনেকের দ্রুত পদোন্নতি হয় আবার অনেকের দেরীতে। আর্মিতে পদোন্নতি দেরিতে হলে চাকুরির সময়ও জলদি শেষ হয়। দুই বছরে আমি মেজর হয়েছি।”
“ওহ আচ্ছা।”
তিতির নিরবে নিজের মনের ভিতরেই হিসেব মিলানোর চেষ্টাতে আছে। ‘এই মেজর মাশরিফ ইকবাল কোনোভাবে সেই চিঠির মালিক নাতো? আবার সেদিন সন্ধ্যায় যেই লোকটা আশ্রয়ের জন্য এসেছিল, তার নামও মা তো মাশরিফই বলেছিল।’ তিতিরের মস্তিস্কে একের পর এক তথ্য খোঁ*চাচ্ছে কিন্তু ক্লিয়ার হতে পারছে না।
ওদের কথার মাঝেই সেখানে ইনায়া, আরভি, রিনি, তাইজুল, আসফি, তাওহীদরা হাজির। ইনায়া এসে উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলল,
“হাই গাইজ। কেমন আছো সবাই?”
তৎক্ষণাৎ রাফি কপালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। ইনায়া গিয়ে রাফির পাশেই বসল। তারপর সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছু*ড়ল,
“কী নিয়ে কথা হচ্ছে? আরেহ! রণিত, রাতুল, মাশরিফ, অভী ভাইয়ারাও এসেছেন দেখছি। কেমন আছেন আপনারা?
রাতুল রাফির অবস্থা দেখে হাসি চেপে রেখে বলে,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ্। তুমি কেমন আছো ইনায়া?”
“কেমন থাকতে পারি বলুন? আপনার বন্ধু তো আমায় চোখেই দেখে না।”
ইনায়ার কন্ঠে দুঃখী ভাব। রণিক ফিক করে হেসে দেয়। রাফি ওর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালে রণিত নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে। অভী ইনায়ার কথার ধাঁচেই বলল,
“আহারে! এটাতো মহা অন্যায়! একে তো চরম থেকে চরমতর শা*স্তি দিতে হয়।”
মাশরিফও অভীর সাথে তাল মিলিয়ে বলল,
“একদম। বল রাফি, ১৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাঠ ১০ বার চক্কর দেওয়ার পা*নিশমে*ন্ট নিবি?”
“মে*রে*ই ফেল আমাকে!”
রাফির কথায় সবাই হেসে ওঠে। মাঝ দিয়ে রিনি বলল,
“তোমরা সবাই আমার এই ছোটো সুইট, ইনোসেন্ট বোনটার সাথে মজা নিচ্ছ কেনো? হ্যাঁ? আর রাফি ভাই, তুমিও?”
“এরে ভুলেও ইনোসেন্ট বলো না রিনি। তোমাকে বাজারে দশবার বে*চে-কি*নে আসতে পারবে।”
রাফির কথায় আবারও হাসির রোল পরে। ইনায়া মুখ ফুলিয়ে বসল। হাসির মধ্যেই মাশরিফ কেকের বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও কেক নাও।”
ইনায়া ফটাফট কেক নিয়ে খেতে শুরু করে। রিনি কেকের পিস নিতে নিতে বলল,
“হঠাৎ কেক কেনো?”
রিনির প্রশ্নের জবাবে শুভ বলল,
“তুমি তো নিজের জন্মদিনই ভুলে যাও। কিভাবে যে আমারটা মনে রাখো আল্লাহ জানে! তাও একবার বারোটা এক মিনিটে লাস্ট মনে হয় আমাদের রিলেশনের প্রথম দিকে একবার উইশ করেছিলে। তারপর থেকে আধাঘণ্টা, দুই ঘন্টা, সকালে এভাবে উইশ করো। তাহলে তুমি মাশরিফের জন্মদিন জানবেই বা কিভাবে? অথচ এক বছর আগে ভালোই ট্রিট নিয়েছিলে।”
রিনি হালকা হেসে মাশরিফকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানায়। সেই সাথে ইনায়ারাও। রিনি তারপর বলে,
“মেডিকেলে পড়তে পড়তে মনে হয় স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। আর এক বছর ইন্টার্নির পর আবার এফসিপিএসের জন্য পড়াও শুরু করতে হবে। সেই সাথে মেডিকেল জবও। তোমাদের আর এক মাস বাকি তারপর তোমরাও পড়া শুরু করবে।”
অর্ক বলে,
“এখনি না। বিসিএসের জন্য তো সমানতালে তো পড়ছিই। এফসিপিএস কয়েকমাস পর ভর্তি হবো। জীবনটা শেষ হয়ে গেল! কই বিয়ে-টিয়ে করে সংসার করব! তা না!”
আরভি একটু লাজুক স্বরে বলল,
“মানা করল কে? করে ফেলুন। সব রাজি তো কেয়া করেগা কাজি!”
“ঠিক বলেছ। এক মাস পর বাসায় গিয়ে সরাসরি বিয়ের পিঁড়িতে বসব। মা তো মেয়ে ঠিক করেই রেখেছে।”
অর্ক কথাটা ইচ্ছাকৃতই বলেছে। আরভি মেয়েটা খারাপ না কিন্তু সে ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করতে নারাজ।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২২
মাগরিবের আজান এখনি পরবে। দ্রুত পা চালাচ্ছে তিতির। পশ্চিমাকাশে গোধূলি রঙে রক্তিম আভায় পরিপূর্ণ। ভাড়া বাসাটায় নিজের সাথে থাকা কিছু কাচের জিনিসপত্র রাখতে গিয়েছিল যাতে কাল হুড়োহুড়ি না লাগে। হুড়োহুড়িতে ভেঙে গেলে ঝামেলা। মেডিকেল কলেজ থেকে বাসাটা বেশি দূরে না। যাওয়ার পথে রিকশাতে গেলেও আসার পথে হেঁটে ফিরছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে বলে রিকশার দাম চওড়া। এই সময়টা যেনো রিকশাওয়ালাদের নিজস্ব সময়! মেডিকেলের গেইটে ঢুকবে তখনি একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এসে তিতিরের পথ আগলে দাঁড়ায়। তিতির ভ্রুঁ কুঞ্চন করে তাকিয়ে বাচ্চা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে,
“কী হয়েছে? কিছু বলবে?”
ছেলেটি তার ফোঁকলা দাঁতে হাসি দিয়ে বলল,
“আপা আপনে খুব সুন্দর। একদম পরীর লাহান!”
বাচ্চা ছেলেটির কথায় ঠোঁট এলিয়ে হাসল তিতির। অতঃপর জিজ্ঞেসা করল,
“ওমা তাই নাকি? তুমি এই কারণে আমার পথ আগলে দাঁড়িয়েছ?”
“না আপা।”
প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে কেনো?”
ছেলেটি এবার তার পেছোনে লুকানো হাতের দিকে তাকাল। তিতিরও দেখতে চাইল ছেলেটির হাতে কী? ছেলেটি আরেকটু সরে গিয়ে বলল,
“আপনারে কিছু দিতে আইছি।”
“কী দিবে?”
এবার ছেলেটি তার হাত সামনে আনে। হাতে একটা র্যাপিং করা বক্স। বক্সটা তিতিরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“এই বক্সটা রাখেন আপা।”
তিতির সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ভ্রুঁ কুঁচকে চেয়ে বলল,
“কী আছে এতে?”
“আপনেই দেইখা লন।”
এই বলে ছেলেটি তিতিরের হাতে জোড় করে বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়। তিতির বোকার মতো কিছু সময় চেয়ে থাকে। যখনি মাগরিবের আজানের ধ্বনি মসজিদ থেকে ভেসে আসে তখনি হুঁশে ফিরলে বক্সটাতে কী আছে না ভেবে বক্সটা নিয়েই দ্রুত হোস্টেলের পথ ধরে।
হোস্টেলে ফিরে তিতির আগে নামাজটা পড়ে বক্সটা নিয়ে বসে। সুন্দর সাদা র্যাপিং পেপারে মোড়ানো। ছোটো থেকে তার র্যাপিং পেপার খুব পছন্দের। তাই সাবধানে র্যাপিং পেপারটা খুলল। তারপর বক্সটা খুলে দেখল তাতে একটা সুন্দর হালকা লেমন কফি কালারের হিজাব ও দুই জোড়া ডিজাইনার চুড়ি রাখা। সাথে একটা কাগজও আছে। তিতির আগে কাগজটাই হাতে নিল। খুলে দেখল তাতে লেখা,
“এই তিতিরপাখি, কেমন আছো? উপহার সামগ্রী পছন্দ হয়েছে? উপহার আমার পাওয়ার কথা থাকলেও পাচ্ছ তুমি! কী সৌভাগ্য বলো। তবে আমিও আমার উপহার বুঝে নিব। চিরকুটটা তুমি যখন পাবে, ততক্ষণে আমার উপহার বুঝে নেওয়াও শেষ! তোমার ঠোঁটের মিষ্টি হাসিই যে আমার উপহার!”
তিতির চিরকুটটা ভাজ করে রাখল। তার সন্দেহের তি’র লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছে বলেই তার মনে হচ্ছে। কতোটা মিল! তিতির মনে মনে সমীকরণ মিলাতে থাকে। ‘তিতিরপাখি সম্বোধন, পত্রদাতা মেজর M.I, সেদিন বৃষ্টির সন্ধ্যায় আগুন্তকের নাম মাশরিফ, সিনিয়র ভাইদের বন্ধুর নাম মাশরিফ ইকবাল আবার সে মেজরও, উপহার পত্রদাতার পাওয়ার কথা তার মানে কোনো বিশেষ দিন। আবার উপহার পৌঁছানোর আগেই পত্রদাতা তার উপহার বুঝে নিয়েছে, আজ আবার মাশরিফের জন্মদিন!’ এতো এতো ক্লু যে কী নির্দেশ করে তা ভেবেই তিতির দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বক্সটা টেবিলের উপর রেখে দেয়।
লিরা ও জুলিয়া তিতিরকে এতক্ষণ দেখছিল। এবার জুলিয়া জিজ্ঞেসা করে,
“এসব কী টিটির?”
তিতির চোখ বন্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“কারও অযাচিত উপহার।”
লিরা তিতিরের বলা ‘অযাচিত’ শব্দটা বুঝতে না পেরে বলল,
“অযাযিট মানে!”
লিরার উচ্চারণ শুনে তিতির অজান্তেই হেসে ফেলল। বলল,
“অযাচিত মানে আনওয়ান্টেড গিফট।”
“ওহ। গিফট তো আনওয়ান্টেডই হয়।”
“হুম। তবে সে এটার অধিকার একেবারেই রাখে না। পরবর্তীতে আমি তাকে নিজে বুঝিয়ে দিব।”
লিরা ও জুলিয়া একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর কী বলবে আর কথা খুঁজে পেলো না।
________
হোস্টেলে নিজের বেডে বসে আরভি থেমে থেমে কাঁদছে আর টিসু দিয়ে রুমটাকে ভরিয়ে ফেলছে। ইনায়া বিরক্ত হয়ে আরেক রুমমেটের দিকে তাকায়। সেই রুমমেটও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ইনায়া এবার উঠে গিয়ে আরভির হাত থেকে টিসুর বক্সটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“কী সমস্যা তোর? রাফিও তো আমাকে কতোকিছুই বলে। আমি কি তোর মতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদি?”
“তুই বুঝবি না রে। রাফি ভাই ও অর্ক ভাই এক না। তাদের স্বভাব ভিন্ন। রাফি ভাই কি বলছে? সে ডাক্তার মেয়ে বিয়ে করবে না? বলে নাই তো। কিন্তু অর্ক ভাই বলছে। সে আমাকে আপুও ডাকছে।”
“আচ্ছা থাম না।”
“না আমি থামব না।”
আরভি আরও কাঁদতে লাগল। লাগাতার এক ঘণ্টা যাবত থেমে থেমে কাঁদছে। এর জন্য ইনায়াকে ডিউটি ছেড়ে আসতে হয়েছে। ইনায়া এবার অর্কর নাম্বারে কল করল। দুইবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলে কোনো হাই, হ্যালো না করে সরাসরি বলে,
“এই অর্ক ভাই, যা বলার সরাসরি বলবেন। কথা একদিন একটু, আরেকদিন একটু এভাবে বলবেন না। আর আপনার রগচটা বন্ধুর মতো তো প্যাঁচালো কথা বলবেনই না।”
ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তির কপাল কুঁচকে যায়। আঁখিজোড়া সংকুচিত করে সে শুধায়,
“আচ্ছা, অর্কর কোন বন্ধুকে বলতে হবে তা যদি বলতেন। খুব উপকার হতো।”
আচমকা রাফির কণ্ঠস্বরে হতবাক হয়ে যায় ইনায়া। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চোখের সামনে এনে স্ক্রিনে দেখে নিলো। না, সে তো অর্কর নাম্বারেই ফোন করেছে। ইনায়া ফোনটাকে আবার কানের কাছে নিয়ে বলল,
“যে ফোন ধরেছে তাকেই। এবার অর্ক ভাইকে দেন। আপনার সাথে কথা বলার সময় নাই।”
রাফি অবাক হয়ে যায়। তখন অর্ক এসে জিজ্ঞেসা করে,
“কীরে? কার সাথে কথা বলিস?”
রাফি আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে অর্কর হাতে ফোনটা দিয়ে নিজের জায়গায় চলে যায়। অর্ক বিষয়টা বুঝতে পারল না। তারপর ফোনটা কানে নিয়ে হ্যালো বলা মাত্রই ইনায়া গর্জে ওঠল,
“আপনার ফোন আপনার বন্ধু ধরছে কেন?”
অর্ক খানিক থতমত খেয়ে যায়। সে জবাব দেয়,
“আমি বাথরুমে ছিলাম তো।”
“ওহ। এখন কোনো রকম ভণিতা ছাড়া জবাব দেন, যে আপনি কি আমার ফ্রেন্ডকে পছন্দ করেন?”
অর্ক কিছু বুঝতে না পেরে এবার ফোনের স্ক্রিণে নামটা দেখল। তারপর আবার ফোন কানে নিয়ে বলল,
“ওহ ইনায়া তুমি!”
“হ্যাঁ আমি। এবার জবাব দেন।”
অর্ক লম্বাশ্বাস নিয়ে বলল,
“দেখো সত্যি বলতে আরভির প্রতি আমার কোনো স্পেশাল ফিলিংস আসে না। কারণ আমি মেডিকেল প্রিপারেশনের সময় বুঝেছিলাম যে আমি নিজে ডাক্তার হলে পার্টনার তো ডাক্তার চাইবই না। আমার ধারণা ও চিন্তা-ভাবনার সাথে কারও কোনো সম্পৃক্ততা নাই। সবারই একটা নিজস্ব চিন্তা থাকে। আমার নিজেরই তো সময় থাকবে না। যা একটু ফ্রি টাইম থাকবে তখন যদি পার্টনারের ফ্রি টাইম না থাকে তবে? এটা সম্পূর্ণ আমার একান্ত ভাবনা। আমাদের দেশে কিন্তু ডাক্তার-ডাক্তারেরই বেশি বিয়ে হয়। আমি চাইনা আমার ওয়াইফ ডাক্তার হোক। সে জব করুক নো প্রবলেম। কিন্তু ডাক্তার না।”
ইনায়া আরভির দিকে তাকালো। আরভি কান্না থামিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইনায়া হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিক আছে। আমি আরভিকে বুঝাব।”
“ধন্যবাদ ইনু।”
অর্ক কল কে’টে নিজের বিছানায় মাথা নিচু করে বসল। শুভ ও রাফি এসে ওর পাশে এসে বসল। শুভ বলল,
“তোর মনে কি সত্যি আরভির জন্য কিছু নেই?”
অর্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নাহ্। আমি কখোনোই সেটা আনতে চাইনি। কারণ আমি জানতাম আমার কার সাথে বিয়ে ঠিক। তাই কাউকে নিজের জীবনে এনে মিথ্যে স্বপ্ন দেখানোর মানেই হয় না।”
রাফি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“মানে?”
“আমার মামাতো বোন প্রীতিশা। নানুমনি মা*রা গেছেন দশ বছর হলো। যখন আমরা খুব ছোটো মানে স্কুলে ভর্তি হইনি। তখনকার একটা ঘটনা আমার মনে আছে। প্রীতিশা লাল শাড়ি পড়ে তার ছোটো ছোটো হাতে শাড়ির আঁচল ও কুঁচি ধরে আমার কাছে হেঁটে আসছিল। মুখে তার প্রাণখোলা হাসি। তখন বাড়ির সবাই ছিল। এক হুজুরও ছিল। আমি তখন বুঝিনি। আমাকে আবার পাঞ্জাবীও পড়ানো হয়েছিল। তখন আমার বয়স ছয় বছর। আর প্রীতিশার আড়াই বছর। গ্রামে ডিসেম্বরে শীতের সময় গিয়েছিলাম। আমার মা আমাকে এখনও নিজ খেকে সেই ঘটনার ব্যাপারে কিছু বলেনি কিন্তু কলেজে উঠার পর যখন ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিলাম তখন প্রীতিশাকে আবারও লাল শাড়ি পড়ে ছাদে আমার বোনের সাথে ছবি তুলতে দেখে ঘটনাটা আবছা মনে পরে। আমি শিউর না বলে কারও সাথে শেয়ার করিনি। কিন্তু আমার মন বলছে বিয়ে পড়ানো হয়েছিল। যদিও তখন আমরা দুজনেই নাবালক ছিলাম। এরকম অনেক সময় পরিবার করে রাখে। তাই ইচ্ছাকৃতই আমি আর কারও প্রতি ফিলিংস আনিনি। আমার মন বলছে মা যে পাত্রী ঠিক করে রেখেছে আর আমাকে বলছে, সারপ্রাইজ! সেই পাত্রীটা প্রীতিশাই।”
শুভ ও রাফি তন্ময় হয়ে সবটা শোনে। শুভ একটু হাসার চেষ্টা করে বলে,
“আমারও এখন ভয় হচ্ছে। ছোটোবেলাতে আবার কারও সাথে বিয়ে-টিয়ে দিয়ে রাখেনি তো? আমার রিনির কী হবে?”
শুভর কথায় রাফি কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,
“এজন্যই বলি, প্রেম-টেম করে কী লাভ? যদি সে জীবনসঙ্গিনী না হয়!”
শুভ এবার রম্যস্বরে বলল,
“যাই অর্কর বিয়ে খবরটা মাশরিফ, রাতুল, রণিতকে দিয়ে দেই। ওরা এতক্ষণে মির্জাপুর পৌঁছে গেছে মনে হয়।”
চলবে ইনশাআল্লাহ,