এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব-২৫+২৬

0
241

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৫
আচমকা ছেলের চিৎকারে মহিমা বেগম থতমত খেয়ে ওঠেন। কী হয়েছে বোঝার জন্য দ্রুত ছেলের ঘরের দিকে অগ্রসর হন। মহিমা বেগমের মতো রণিত, রাতুল, অভীও সেদিকে গেল। গিয়ে দেখল রুমের দরজার কাছে মাশরিফ হাত মুষ্টিমেয় করে দাঁড়িয়ে আছে। আর ঘরের ভেতর একটা মেয়ে মাশরিফের শার্ট হাতে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ানো। মেয়েটা যে কাশফা তা উপস্থিত সকলেই জানে। মাকে দেখে মাশরিফ ক্ষিপ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

“এই মেয়েটা আমার ঘরে কী করে মা? ওকে আমার ঘরে ঢোকার পারমিশন কে দিয়েছে?!

মহিমা বেগম নিজেই অবাক হয়ে যান। একটু আগেই কাসফা যখন বাড়িতে এসেছিল তখন মাশরিফের খোঁজ করছিল কিন্তু মাশরিফ বাসায় নেই শুনে সে মহিমা বেগমের সাথে একটু কথা-টথা বলে সে চলে যাচ্ছে বলেছিল। কিন্তু মেয়েটা যে যায়নি সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। মহিমা বেগম হাসার চেষ্টা করে কাশফাকে বলেন,

” কাশফা তুমি না বলেছিলে তুমি চলে যাচ্ছ? তাহলে এখানে?”

কাশফা দৃষ্টি নিচু করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। হুট করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে হড়বড়িয়ে বলল,
“আসলে হয়েছে কি আন্টি, আমি চলেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে মাশরিফের ঘরের দিকে নজর যায়। ঘরটা খোলা ছিল তো! তখন দেখলাম যে ঘরের মধ্যে কাপড়চোপড় এলোমেলো করে ফেলানো। তাই ভাবলাম…”

কাশফাকে আর বলতে না দিয়ে মাশরিফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“একটু গুছিয়ে দেই! তাই না?”

কাশফা ধরা পড়ে গিয়ে বোকার মত হাসলো। তারপর বলল,
” ঠিক বলেছ! একটু গুছিয়ে দিচ্ছিলাম।”

“ধন্যবাদ আমার গোছানো ঘরকে আরেকটু গুছিয়ে দেওয়ার জন্য! এবার প্লিজ নিজের বাড়ি গিয়ে নিজের ঘর গোছান।”

কাশফা মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর আর কোন বাক্যব্যয় না কেরে চুপচাপ চলে যায়। কাশফা ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর পর পর মাশরিফ নিজে গিয়ে বাড়িয়ে সদর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসে। তারপর নিজের ঘরে এসে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” একটা কথা বলি মা, তুমি আর আপু কিভাবে ভুলে যাও এই মেয়েটা দুই বছর আগে কী করেছিল? ওর জন্য আমি আমার আর্মি জবটা হারাতে বসেছিলাম! এই মেয়েটা যে কতটা জঘন্য তা তুমিও জানো আর আপুও জানে। তারপরও আপু যে কেন এই মেয়েটার তরফদারি করে আমি বুঝতে পারি না। আপু হয়তো মনে করে মেয়েটা তখন বাচ্চা ছিল! তাই এরকম করেছে। অতটাও কিন্তু বাচ্চা ছিল না মা। ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়া মেয়ে কখনোই বাচ্চা হতে পারে না। একটা ছেলেকে জেনে বুঝে ফাঁ*সানোর মতো অন্যায় সে করেছিল। ভাগ্য ভালো, মসজিদের ইমাম সাহেব ও পাশের বাসার হাসান আংকেল ঘটনাটা দেখে ফেলেছিল।”

ছেলে যে খুব রেগে গেছে মহিমা বেগম বুঝতে পারছেন। ছেলেকে শান্ত করতে তিনি বলেন,
“আমরা কেউ ঘটনাটা ভুলিনি। আসলে হয়তো কাশফা বুঝতে পারেনি যে ওর সামান্য মজা করে করা দুষ্টুমির কারণে তোর আর্মি জব নিয়ে টানাটানি লেগে যাবে।”

মাশরিফ তাচ্ছিল্য হাসলো। সে বলল,
“তোমরা ওর অন্যায়কে দুষ্টমি বলেই চালিয়ে দাও! আসলে কি বলতো বাবা-মায়ের দুলালী! আবার মিষ্টি ভাষী! তার জন্য তোমাদের বশ করা কোনো ব্যাপারই না। বা হাতের খেল তার।”

” আরে বাবা! পুরানো কথা বাদ দে না। মেয়েটার সাথে এত রুড ব্যবহার করিস না। স্বাভাবিক কথাবার্তা বল।”

মাশরিফ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমরা তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছো না? তো করো। আমায় কেন বলছ? আমার ইচ্ছে হয় না, আমি করি না! তাকে স্ট্রিটলি বলে দিবে সে যেন আমার ঘরে ভুলেও পা না দেয়। তাহলে কিন্তু আমি কখন তাকে চ**ড়-থা*প্প*র দিয়ে দেই নিজেও বলতে পারি না। এরকম নিচু স্বভাবের মেয়ে আমার পছন্দ না।”

কথা কাটাতে অভী এসে বলল,
“আরে বাদ দে তো ওসব। চল পিঠে খাব।”

অভী মহিমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আন্টি, পিঠে গুলো আগে দিয়ে যান। তারপর আস্তে আস্তে চা আনেন। হেমন্তের প্রথম পিঠে! ইশ শুনেই জীভে জল চলে আসছে।”

মহিমা বেগম আলতো হাসেন। তিনি বলেন,
“আচ্ছা, তোরা গিয়ে বস। আমি পিঠে নিয়ে আসছি।”

মহিমা বেগম চলে গেলে অভী মাশরিফকে গিয়ে ধরে।
” আজকে তুই এত রাগ কেন করছিস? সময় দে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিতিরের দিকটাও একটু ভাব। সে কিছুদিন হলো জানতে পেরেছে তার স্বামী মা*রা গেছে।”

প্রত্যুত্তরে মাশরিফ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
” আমি মোটেও তিতিরের সাথে কি হয়েছে সেই ঘটনা নিয়ে রিয়াক্ট করছি না। ওর দিকটা আমিও বুঝি। তাও আমি সব সাইডে রেখে ওর সাথে থাকতে চেয়েছি কারণ আমি জানি এই স্বার্থপর দুনিয়াতে একা টিকে থাকা মুশকিল। আব্বুর মৃত্যুর পর আমি নিজেই এটা বুঝেছি। তোরা তো দেখেছিস। সংসারের সাপোর্ট দিতে আমি মেডিকেল ছেড়েছি। মেডিকেলে সময় লাগে অনেকটা। সেখানে আর্মিতে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাডেট অবস্থাতেই আমার একাউন্টে টাকা জমা হচ্ছে। সেই টাকা আমি নির্দিষ্ট সময় পর যখন আর্মি ক্যাডেট থেকে একজন আর্মি হবো তখন একসাথে পাবো। তাছাড়া বাবা বলে গিয়েছিলেন, “দেশের জন্য যা দরকার করবে।” সবটা বিবেচনা করে আজ আমি আর্মিতে। আমার এখনো মনে পড়ে ওই কাশফা মেয়েটার জন্য আমি আমার ডিপার্টমেন্টে কীরকম জবাবদিহি করেছি। তুই তো সাথে ছিলিস। তুই তো সবই জানিস। ওই মেয়েটার সাথে মা যেমনটা নয় তেমনটাই করে কিন্তু আপু যা করে সেটা দেখলে আমার সত্যি প্রচণ্ড রাগ হয়। আপু কেন এই মেয়েটাকে এত মাথায় তোলে বুঝি না। আমার তো মেয়েটাকে দেখলেই রাগ ওঠে।”

রাতুল হাই তুলতে তুলতে বলল,
“রিতিকা আপু কেনো মাথায় তোলে তা তো তুই জানিসই। একটু আগে তুই নিজেই তো বললি মেয়েটা মিষ্টি ভাষী! তো মিষ্টি ভাষী মেয়েদের মুখে মধু থাকে তা তো জানিস। মধুর মতো সুইট সুইট কথার দ্বারা সে সবাইকে বশ করে ফেলে। এখন ওই মেয়েটার কথা বাদ দে। চল পিঠা খাব। ওসব ঝামেলা এখন ভালো লাগছে না।”

মাশরিফ কপালে হাত ঘষে চোখ বন্ধ করে বলে,
“তোরা যা। আমি আসছি।”

রাতুলরা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে। মাশরিফ হাত-মুখ ধুয়ে এসে ওদের সাথে বসে।

_________

বাজার করে এসে ঘর গুছিয়ে তিতির ক্লান্তিতে সোফায় বসে আছে। হিয়া ও নাজমা বেগমও এসে ওর পাশে বসে। তিতির জিজ্ঞেসা করে,
“হায়াত ঘুমিয়েছে?”

“হ্যাঁ। এতক্ষণে কেঁদে-কে*টে অস্থীর হয়ে এখন ঘুমিয়েছে।”

নাজমা বেগম বলেন,
“ভাগ্যিস তোর চাচি খাবার প্যাক করে দিয়েছিল। নাহলে এখন এসে বাজার করে রান্না করতে হতো।”

“হ্যাঁ। আচ্ছা মা, হিয়াকে আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি করব? নাকি পলিটেকনিকে? হিয়া তুই বল। তোর কোনটাতে ইচ্ছে?”

হিয়া কিয়ৎ ভেবে বলে,
“পলিটেকনিকেই মনে হয় আমার জন্য ভালো হবে।”

“আচ্ছা তবে তাই দেখি।”

তখনি হঠাৎ তিতিরের বিকেলের কথা গুলো মনে পরে। তিতির উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে খামটা নিয়ে আসে। অতঃপর মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“দেখো তো মা, এতে কী আছে? একজন দিলো। বলল তোমাকে দিতে।”

“কে দিলো?”
“বলছি। আগে খুলে দেখো।”

নাজমা বেগম খামটা খুললেন। সেখানে একটা ছবি রাখা। ছবিটা দেখে নাজমা বেগমের চোখ ভিজে ওঠল। তিনি ছবিটার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে কাঁদতে লাগলেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৬
মাকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিতির ভীষণ অবাক হয়। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে মায়ের কাঁধে ধরে বলল,
“কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছো কেনো?”

তিতিরের প্রশ্নে নাজমা বেগম কোন প্রত্যুত্তর করতে পারলেন না। তিনি অবিরত কান্না করে চলেছেন। মায়ের এভাবে কান্নার কারণ জানতে তিতির ও হিয়া মরিয়া হয়ে উঠল। মায়ের হাত থেকে ছবিটা এবার কেড়েই নিলো তিতির। ছবিটা নিয়ে নিজে দেখতে লাগল। ছবিটার মধ্যে নাজমা বেগমের অনেক পুরনো একটা ছবি সাথে আরেকজন মহিলা। ছবিটার দিকে তিতিরকে ভ্রুঁকুঞ্চন করে দেখতে দেখে হিয়াও ছবিটা নেয়। সেও অপর মহিলাটিকে চিনতে পারছে না। হিয়া নাজমা বেগমকে জিজ্ঞেসা করে,

“মা, তোমার পাশে ইনি কে?”

নাজমা বেগম নিজেকে সামলে ভাঙা কণ্ঠে জবাব দেন,
“ইনি আমার বড়ো বোন। আপন বোন না হলেও আমরা যৌথ পরিবারে চাচাতো বোনেরাও আপন বোনের মতো হয়।”

তিতির ও হিয়া দুজনেই ভীষণ অবাক হয়। তিতির সন্দিহান কণ্ঠে শুধায়,
” কই কখনো তো উনাকে দেখিনি। নানু বাড়িতে তো কতো গিয়েছি। উনার কথাতো কাউকে বলতে শুনিনি তাছাড়া কখনো দেখিওনি।”

নাজমা বেগম হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তারপর বলেন,
“তোরা দেখবি কি করে! সে তো অনেক আগেই আমাদের থেকে বহু দূরে চলে গেছে! বাড়িতে আপুর নাম নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আপুর কারণে বড়ো চাচার অনেক অ*পমা*ন হয়েছিল।”

নাজমা বেগমের কথায় তিতির ও হিয়া দুইজনেই কৌতুহলী হয়। হিয়া জিজ্ঞাসা করে,
“কেনো? উনি কী করেছিলেন?”

“আপা যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়তেন, তখন আপা একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলেন! ছেলেটা আপার ক্লাসমেট ছিল। বাড়ি থেকে বড়ো চাচা ও বাবা মিলে আপার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। বেশ বড়ো ঘরেই বিয়ে ঠিক করেছিলেন যেহেতু আমাদের পরিবারের নাম-ডাক ছিল। কিন্তু আপা যে একজনকে মন দিয়ে বসেছিলেন! সেটা আমরা জানতাম না। বড়ো চাচা ও বাবাকে আপা অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উনারা কেউ বুঝতে চাননি কারণ ততোদিনে ছেলে পক্ষকে কথা দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। আপা শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সবার সাথে পেরে ওঠেনি। বিয়ের চার দিন আগে আপা একটা চিঠি লিখে বাড়ি ছেড়েছিলেন।”

এইটুকু বলে নাজমা বেগম লম্বা শ্বাস নেন। তিতির ও হিয়া তন্ময় হয়ে নাজমা বেগমের কথা শুনছিল। হঠাৎ থেমে যাওয়াতে তিতির অধির আগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করে,

“উনি এখন কোথায় মা? তোমরা কি উনার কোন খোঁজ খবর নেওনি?”

“নাহ্। আপা কোথায় আছে? কেমন আছে? আমরা কিছু জানি না! তবে আমি বোন হওয়ার সুবাদে আপা চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমাকে কান্না করতে করতে বলেছিলেন যে আপা যাকে ভালোবাসেন তিনি আর্মিতে আছেন। মানে তখনো আর্মি হয়নি। আর্মি ক্যাডেট হিসেবে। এক বছরের মধ্যে আর্মি হয়ে যাবেন এমনটাই জানিয়েছিল আপা।”

কথাটা শুনে তিতির কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল,
“দুনিয়ার সব আর্মির সাথে কি আমাদেরই দেখা হয়? কী আজব !”

তিতিরের ভাবনা চিন্তার মাঝে নাজমা বেগম ওকে প্রশ্ন করেন,
” কিন্তু তুই এই ছবিটা কোথায় পেলি? আমিও তো তোদের কখনো আমার আপাকে নিয়ে কিছু বলিনি। তাহলে এই ছবিটা কোথা থেকে পেলি?”

“তোমার মনে আছে মা? এক ঝড় বৃষ্টির রাতে একটা লোক আমাদের বাড়িতে এসেছিল!”

নাজমা বেগম জবাবে বলেন,
“মাশরিফ?”

“হ্যাঁ ওই মাশরিফ! ওই লোকটা আমাকে এই ছবিটা দিয়েছে।”

নাজমা বেগম অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করেন,
“ওই ছেলেটা তোকে ছবিটা কিভাবে দিল? আর ছেলেটাইবা তোর ঠিকানা জানলো কিভাবে?”

তিতির পরে গেছে মহা মুশকিলে। তার মা যে এতো প্রশ্ন করতে পারে তা জানা ছিল না। তিতির এখন তো তার মাকে পুরো ঘটনা বলতে পারবে না! তাই কোনো রকমে বোঝানোর জন্য বলে,

” আরে মা, ওটা হসপিটাল! হসপিটালে তো মানুষ আসবেই। তাই না? ওই লোকটাও এসেছিল হয়তো কোনো কারনে। যেহেতু লোকটা আমাদের বাড়ি বিক্রি করতে ও ময়মনসিংহে আসার জন্য অনেক সাহায্য করেছে, তাহলে লোকটা নিশ্চয়ই আমাকেও চিনে। হসপিটালে দেখা হবার পর তিনি আমাকে একটা খাম দিল। বলেছে খামটা যেন তুমি খোলো। আমি যেন না খুলি।”

নাজমা বেগম দোটানায় পড়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না, মাশরিফ নামের ওই ছেলেটার কাছে কিভাবে এই ছবিটা এলো? তবে কি মাশরিফ আপাকে চেনে? প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত তার মস্তিষ্ক! এরই মধ্যে তিতির বলে ওঠে,

” জানো মা মাশরিফ নামক লোকটাও আর্মিতে আছে। মেজর পদে!”

“কী বলছিস? ছেলেটাকে একটা ফোন করে দেখতো।”

নাজমা বেগমকে এতটা উত্তেজিত হতে দেখে তিতির থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলল,
” আরে মা! বাদ দাও না। কী দরকার?”

“কোন বাদ দেওয়া-দেওয়ি নেই! আমার তো জানতে হবে। আপাকে মাশরিফ কীভাবে চিনে? আপা এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? সব জানতে হবে। তুই এখনই ফোন লাগা। দাঁড়া আমি আমার ফোনটা নিয়ে আসছি। সেখানে নাম্বারটা আছে।”

এই বলে নাজমা বেগম ফোন আনতে ভেতরে রুমে গেলেন। মায়ের কাণ্ডে তিতির মাথায় হাত দিয়ে বসলো। পাশ থেকে হিয়া বলল,

“কী হয়েছে রে? তুই এত চিন্তিত কেন? তুই নিজেই মাকে ছবিটা দেখালি। এখন মা যোগাযোগ করতে চাইছে। তাতেও তুই চিন্তিত! কী হয়েছে? সত্যি করে বল।”

“পরে বলব। আমার মন-মেজাজ ভালো নেই!”

এরই মধ্যে নাজমা বেগম ফোন নিয়ে হাজির! তিনি ফোনটা তিতিরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“নে। এই ফোনটা থেকে মাশরিফের নাম্বারটা নিয়ে তোর ফোন থেকে ফোন দে। আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই।”

তিতির হতবাক হয়ে মায়ের দিকে চাইল। সে কীনা নিজের ফোন থেকে মাশরিফকে ফোন দিবে! এটা তো সে করবেই না। কিন্তু মা যে বুঝতে চাইবেন না! কী করবে কী না করবে ভেবে দাঁতে নখ কা*টতে কা*টতে মা*থায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার! সে হড়বড়িয়ে বলল,

“আমার ফোনেও তো ব্যালেন্স নাই! ফোন কীভাবে দিব?”

নাজমা বেগম অবাক হন। তিনি বলেন,
“কী বলিস? তুই না দুপুরেও আমাকে ফোন করলি?”

এবার তিতির কোনো কিছু না ভেবে দ্রুত অস্থীর কণ্ঠে জবাব দেয়,
“দুপুরে ছিল। এখন নাই। আর টাকা ভরার সময় পাইনি।”

কথাটা শুনে নাজমা বেগমের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি মন খারাপ করে বলেন,
“তাহলে আর কি! আজকে আর ফোন দেওয়া হচ্ছে না। কালকে কিন্তু ফোনে টাকা ভরবি। আমারটাতেও ভরবি, তোরটাতেও ভরবি। তারপর আমি মাশরিফকে ফোন করব।”

তিতির জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কালকে ক্লাস শেষে ফেরার পথে টাকা ভরে দিব।”

“আচ্ছা। মনে করে ভরিস।”

নাজমা বেগম ভেতরের রুমে চলে গেলে তিতির হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সোফা থেকে উঠে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে হিয়া গিয়ে পাশে বসে। ফিসফিস কন্ঠে প্রশ্ন করে,

“ব্যাপারটা কী রে তিতির? তোর ফোনে কি আসলেই ব্যালেন্স নেই? নাকি শুধু মাকে মিথ্যে বললি? ”

“ব্যালেন্স আছে আমার ফোনে। কিন্তু আমি ওই লোকটাকে ফোন দিতে চাইছি না। তাই মাকে মিথ্যে বলেছি। আর কালকের মধ্যে মায়ের ওসব মনেও থাকবে না। ভুলে যাবে।”

“কেনো? উনাকে ফোন করলে কী হবে? তাছাড়া মায়েরও তো জানা উচিত, তার আপা কোথায় আছে? এতদিন পর হারানো বোনকে ফিরে পাচ্ছে, আর তুই কীনা বলছিস তুই ওই লোকটাকে ফোন করবি না!”

তিতির এবার চটে গেল। সে রুষ্ট কন্ঠে বলল,
“আমার ইচ্ছে আমি ফোন দিব না। তার যদি বলারই হতো, তাহলে তখনই বলে যেত। তখন বলল না কেনো? একটা সাসপেন্স রেখে খাম দিয়ে গেল!”

এগুলো প্রকাশ্যে বললেও, তিতির মনে মনে বলে,
“বুঝি তো! সব বুঝি। আমার দ্বারা যোগাযোগ করানোর ধা*ন্ধা! যাতে তাকে আমি ফোন করি আর সে নিজেকে কতো কিছু ভেবে বসুক! করবো না আমি ফোন। মায়ের যদি লাগে, মা নিজে দোকানে গিয়ে টাকা ভরে নিজে ফোন করবে। আমি তো করবোই না। ধা*ন্ধাবাজ লোকটার মতিগতি আমি বুঝি। পরে বলবে, ‘তিতিরপাখি, আপনিই তো আমাকে আসতে বলেছেন!’ আরে বেটা তুই সিচুয়েশন ক্রিয়েটই করেছিস এমন! আর্মিতে চাকুরি না করে যদি ধা*ন্ধাবা*জি করতো তবে বহুদূরে যেতে পারতো।”

তিতিরের এতো সবকিছু ভাবার মধ্যে হিয়া ওকে ঝাঁকি দিয়ে বলল,
“কীরে? চুপ করে আছিস কেনো? বল?”

তিতির হকচকিয়ে ওঠে। বলে,
“কী বলব? চিনি না, জানি না একটা ছেলের কাছে ফোন দিব! আমি পারবো না বাবা!”

“তুই যদি নাই চিনিস তাহলে ওই ছেলেটার কাছ থেকে খামটা নিলি কেন?”

এবার তো আবার ফাঁসাদে পরে গেল! তিতির এবার ভ্রুঁকুটি করে বলল,
“এতো প্রশ্ন করিস কেনো? যা তো। আমি পড়ব।”

হিয়া মুখ লটকিয়ে বলে,
“যাহ্ বাবা! আমি কই এতো প্রশ্ন করলাম। যা একটু জিজ্ঞাসা করেছি সেটারই সঠিক জবাব দিতে পারছিস না! তার জন্যই তো কথা বাড়ছে। তুই সরাসরি সত্যটা বলে দিলেই তো আমি আর প্রশ্ন করি না।”

“আমি বলব না। যা তো। অনেক পড়া বাকি। ডিস্ট্রাব করবি না।”

হিয়া মুখ ভে*ঙচি দিয়ে উঠে গেল। তিতির বইটা নিয়ে পাতা উলটাতে লাগল।

___________

এদিকে মাশরিফ বারবার ফোন দেখছে। সে অপেক্ষা করছে কখন তিতির বা তার মা ফোন করবে। এখনও ফোন কেনো আসছে না বুঝতে পারছে না। মাশরিফকে বারবার ফোনের দিকে তাকাতে দেখে রণিত ওর ফোনটা হাত থেকে কেড়ে নিল। মাশরিফ হতচকিত হয়ে বলল,

“ফোনটা নিলি কেনো?

“তুই পিঠে না খেয়ে ফোনে কী দেখিস? আমরা যে এতো কথা বলছি তা তো মনে হয় শুনছিসও না।”

মাশরিফ বিরক্ত হয়ে বলল,
“ফোনটা দে। আমার কাজ আছে।”
অভীও এবার প্রশ্ন করে,
“কী-সের কাজ?”

“তোরা বুঝবি না। তোর খেলা দেখ আর পিঠে খা।”

“বুঝালেই বুঝব। আমরা তো আর বাচ্চা না।”

মাশরিফ রণিতের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে রাতুলকে জবাব দেয়,
“কিন্তু আমি বোঝাতে চাচ্ছি না। আমার মাথা ধরেছে আমি ঘরে গেলাম।”

এই বলে মাশরিফ সেখান থেকে উঠে যায়। অভী, রণিত, রাতুল একে-অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে। রাতুল বলে,
“কিছু তো ওর মাথায় ঘুরছেই। ও কিছু তো করেছেই। নয়তো তিতির রিজেক্ট করার পরেও এতো শান্ত! মানলাম একটু খিঁটখিঁটে হয়েছে কিন্তু তাও কতো স্বাভাবিক আছে।”

অভী সোফায় গা এলিয়ে বলে,
“আর্মি ব্রেন বস! চতুর তো হবেই। এখন আমরা নিজেদের ব্রেন না খাটাই। সময় হলে ও নিজেই বলবে।”

“সেটাই। আপডেট তো পাবোই। তাতেই হবে। এমনিতেও ও আজ একটু নিরব। মন ভালো হলে নিজ থেকেই বলবে।”

চলবে ইনশাআল্লাহ,