এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব-২৯+৩০

0
234

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৯
দেখতে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল। পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো মাস। ঋতুর পরিবর্তনে প্রকৃতিতে এখন শীতের শেষোর্ধ! এই লম্বা সময়ে অনেক কিছুই বদলেছে। বেড়েছে ব্যাস্ততা ও কমেছে সময় স্বল্পতা। টিউশনি করিয়ে সবে বাড়ি ফিরল তিতির। ঘড়িতে এখন রাত সাড়ে আটটা। ক্লান্ত শরীরে সোফায় গা এলিয়ে দেওয়া মাত্রই নিদ্রাকন্যারা যেন অক্ষিপল্লবে ভর করে আসছে! যার দরুণ চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে পরেছে। কিন্তু ঘুমানো যে যাবে না! পড়তে বসতে হবে।

তখন হিয়া হায়াতকে নিয়ে এসে তিতিরের পাশে বসে। পাশে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে চোখে খুলে একবার দেখে নিয়ে আবার বন্ধ করে নেয়। সে বলে,

“কীরে? পড়তে বসিস না? তোর না সামনে পরীক্ষা?”

“আমি পরীক্ষা দিব না।”

হিয়ার মুখ থেকে এহেনো কথা শুনে চমকে নেত্র মেলে তাকায়। ভ্রুঁকুটি করে বলে,
“মানে? হঠাৎ কী হলো?”

“তোকে বলেছিলাম না? আমার এক ব্যাচ সিনিয়র কয়েকদিন যাবত আমার পিছে পরেছে!”

“হ্যাঁ। সে পিছে পরেছে বলে কি তুই পরীক্ষা দিবি না? আজব! তোর পরীক্ষা তুই দিবি।”

হিয়া মুখ কালো করে হায়াতকে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“আমি আর ওখানে পড়বই না। আমাকে দেখলেই ছুটে আসে। আমার ভালো লাগে না। তাকে এতোবার বলেছি, আমি ম্যারিড। এখন বিধবা ও বাচ্চা আছে। তাও বুঝতে চায় না। আজ তো বাড়ি অবধি চলে এসেছিল!”

তিতির তাচ্ছিল্য হাসে। অতঃপর বলে,
“জানিনা কার মনে কি আছে! খবরের কাগজে কম তো খবর পড়িনি যে, বিধবাদের প্র*লোভন দেখিয়ে বি’ক্রি করে দেয়! আবার ধ*র্ষ*ণ করে। কিন্তু বিয়ে! হাহ্! ওসব চোখের ধুলো! বিধবাদের তো কোনো বিপত্নীক পুরুষও বিয়ে করতে চায় না! সেখানে ওরা অবিবাহিত হয়ে! এদের ফাঁদে পা না দেওয়াই ভালো। আমরা যদি আবেগে ভেসে গিয়ে তাদের প্রস্তাবে রাজী হই, তখন দেখবি বিয়ের সময় এলে বলবে, ‘আমার বাড়ির লোক মানছে না। প্লিজ আমায় মাফ করে দিও! তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। একজন বিধবাকে বাড়ির লোক কোনোভাবেই মানছে না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। আমি পারব না সবার মনে কষ্ট দিয়ে তোমায় বিয়ে করতে।’ খুব সুন্দর অজুহাত না? একদম করুণ, দুঃখে ভরা অজুহাত! আমার কথা হলো, যখন প্রেম করেছিল, তখন তো জানতো মেয়েটা বিধবা। তাহলে তখন বাড়ির লোকের থেকে অনুমতি কেনো নেয়নি? তখন যেহেতু বাড়ির লোকের অনুমতি নেয়নি, তাদেরকে জিজ্ঞেসা করেনি, তাহলে বিয়ে করার সময় তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো অর্থ আমি পাইনা। আসলে সব টাইমপাস! এরকম যদি একটা অবিবাহিত মেয়ের সাথে করত, তবে সে আপ্রাণ চেষ্টা করত নয়তো পালিয়ে যেত। তাই এদের মন ভুলানো কথা পাত্তা দিয়ে নিজের জীবনের গতি রোধ করাটা বোকামি।”

হিয়া হতাশ নিঃশ্বাস ছেলে শুধায়,
“কী করব এখন? আমার ক্লাসমেটরাও আমাকে কেমন করে যেন দেখে।”

“আচ্ছা শোন, কাল আবার যখন ছেলেটা তোকে বিরক্ত করতে আসবে, তখন তুই ছেলেটার সাথে কথা বলবি। তাকে বলবি সে যেন তার মাকে নিয়ে আসে। তার মায়ের সামনে বলতে বলবি যে সে তোকে ভালবাসে! যদি সে বলতে পারে বা তার মাকে নিয়ে আসে তাহলে তুই ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারিস। যদি তোর মন সায় দেয় তবেই। আর যদি তোর মন সায় না দেয় তাহলে ছেলেটাকে সরাসরি বলে দিবি।”

“হ্যাঁ। তাই করব। তবে কালকে না। রবিবারে বলব। এমনিতে ছেলেটাকে দেখে অতো সুবিধার মনে হয় না। রবিবারে একদম সরাসরি বলব তখন দেখব।”

হিয়ার এরকম উত্তেজনাপূর্ণ কথায় তিতির হেসে ফেলে। হাত বাড়িয়ে হায়াতকে কোলে নেয়। মা ও ফুপির কথা এতক্ষণ সে একদম শান্ত বাচ্চার মত শুনেছে। কোনো রাখ-ঢাক ছিল না।

“আমার হায়াত আম্মুটা কত শান্ত। তাও ওর মা শুধু শুধু ওর নামে মি*থ্যাচার করে! তাই না মা?”

কথার তালে তালে হায়াতও মুখ দিয়ে বিভিন্ন রকম আধো আনন্দ ধ্বনি করছে। কিছুটা সময় ফুফি-ভাতিজির এই কাণ্ড চলতে থাকে। তিতির হিয়াকে একটু অনুরোধের স্বরে বলে,

“একটু ব্ল্যাক কফি বানিয়ে দিবি প্লিজ। কড়া করে। আমার পড়তে বসতে হবে। বারবার ঘুম পাচ্ছে।”

হিয়া চোখ পাঁকিয়ে বলে,
“এই ব্ল্যাক কফির কৌটা তোকে আমি কিনতেই মানা করেছিলাম। প্রতিটা দিন তুই এই ব্ল্যাক কফি খাস। খুব শখ করে টেস্ট করার জন্য ব্ল্যাক কফি কিনেছিলি। আরে এটা বেশি খাওয়া ঠিক না। আর তুই সকালে খেয়ে যাস আবার বাসায় এসে খাস। এবার কোটাটা শেষ হোক শুধু। যদি ভুলেও তুই কফি জাতীয় কিছু বাসায় আনছিস তো দেখিস! চা খাবি তাও ভালো।”

তিতির করুণ স্বরে বলে,
“এমন করিস কেন? জানিসই তো ঘুমের যন্ত্রণায় পড়তে পারি না। খুব টায়ার্ড লাগে সারাদিনের এত ক্লান্তিতে।”

তিতিরের করুণ কণ্ঠস্বরে হিয়া বাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“যাচ্ছি। হায়াতকে রাখ।”

এই বলে হিয়া ব্ল্যাক কফি বানাতে যায়।

__

মহিমা বেগম তার মেয়ে রিতিকা, মেয়ের জামাই সায়ান ও নাতি রিয়ান ছুটির দিনে আসাতে সবাইকে নিয়ে টাঙাইলের বাড়িতে গিয়েছেন। সায়ানের আবদার শাশুড়ির হাতে কাচ্চি বিরিয়ানি খাবে। মেয়ের জামাইয়ের সাথে সাথে নাতিও আবদার করে বসে। তাই তো তিনি কাচ্চি বানাতে লেগে পরেছেন। রিতিকা মাকে সাহায্য করতে বারকয়েক রান্নাঘরে গেছে। এরইমধ্যে কাশফা দুই দফা এই বাড়িতে এসে ঘুরে গেছে। এসেই রিতিকার সাথে কিসব গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে তা মহিমা বেগম লক্ষ্য করলেও ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন না। তবে আন্দাজ করতে পারছেন আলাপ-আলোচোনার মুখ্য বিষয় মাশরিফকে নিয়েই! মাশরিফ দেড় মাস আগে একবার এসে দুইদিন থেকে গেছে। কী একটা কাজে মির্জাপুরে এসেছিল তাই মায়ের সাথে দুইদিন কোয়াটারে থেকে গেছে।

রিতিকা কাশফার সাথে এতো কী কথা বলে জানতে তিনি রিতিকাকে ডাক দেন। রিতিকা মায়ের ডাকে রান্নাঘরে আসলে মহিমা বেগম জিজ্ঞেসা করেন,

“কী হয়েছে রে? কাশফা বারবার এখানে কেন আসছে? এসেই তোর সাথে কি গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে! কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

মায়ের কথায় রিতিকা ভড়কে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
“কই কিছুনা তো!”

“কিছু না হলে, বারবার যায় আসে কেন?”

“এমনিতেই। অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছি তো, তাই দেখতে এসেছে। একটু কথা বলতে এসেছে। ”

“ওহ আচ্ছা।”

মায়ের প্রত্যুত্তরে রিতিকা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ধরলেই, মহিমা বেগম আবার ডাক দিয়ে বলেন,

” সালাদ বানা রিতি। আজকে কিন্তু বাসায় আমার বোন আর বোনের পরিবারও আসবে। তোকে মনে হয় বলা হয়নি।”

মায়ের কথায় রিতিকা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। অতঃপর জিজ্ঞাসা করে,
“ওই যে তোমার এতোদিন পর ফিরে পাওয়া চাচাতো বোন?”

“হ্যাঁ নাজমা ও নাজমার মেয়ে-বৌ নাতনি সহ আসতে বলেছি। শুক্রবার তো আজ। নাজমার মেয়ের ক্লাস নাই।”

মহিমা বেগমের কন্ঠে স্পষ্ট উচ্ছাসতা প্রকাশ পাচ্ছে। রিতিকার ভাবলেশহীন জবাব,

“এতদিন পর তুমি তোমার চাচাতো বোনকে কিভাবে খুঁজে পেলে তাই তো বুঝতে পারলাম না! এতদিন পর খুঁজে পেলে, এর আগে কেন পেলে না?”

মেয়ের এই প্রশ্নের মহিমা বেগম কেনো জবাব দিলেন না। তিনি মেয়েকে জানাননি যে তিনি তার চাচাতো বোনকে মাশরিফের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছেন। এমনকি এখনো অবধি তিতিরের ব্যাপারেও রিতিকাকে অবগত করেননি। আজ যেহেতু সবাই একসাথে হবে তাই রাতের বেলা রিতিকাকে ও সায়ানকে জানানোর ইচ্ছা পোষণ করেন।

রিতিকা মায়ের থেকে কোন জবাব না পেয়ে শসা, পেঁয়াজ, টমেটো কা*টতে শুরু করে।

______

নাজমা বেগম ফজর ওয়াক্ত থেকে থেকে তিতির ও হিয়াকে তাড়া দিয়ে রেখেছিলেন। প্রথমবার বোনের বাড়িতে যাবেন বলে কথা! আগের দিন থেকে কী কী নিবেন তারও লিস্ট করে রেখেছিলেন। এদিকে তিতির সাপ্তাহিক ছুটির দিন পেয়ে একটু আলসেমি করছিল। আবার পড়াতেও যেতে হবে। তাই স্টুডেন্টকে ফোন করে সকাল সকাল পড়াতে যাবে বলার পর স্টুডেন্ট পড়িয়ে সাড়ে দশটার মধ্যে বাড়িতে এসে পরেছিল। এরপর রওনা করেছে। এখন বাসে ওরা। তিতির জানালা দিয়ে বাহিরে অন্যমনা হয়ে চেয়ে আছে।
মাশরিফ সত্যি তার কথা রেখেছে। একবারও কোনো ফোন, চিঠি দেয়নি। সেই সাথে কোনো খোঁজও নাই। সিনিয়রদের মধ্যে অর্ক ও রাফি চলে গেছে নিজ নিজ শহরে। শুভ এক বছর আছে তার প্রেয়সী রিনির জন্য। কিন্তু তার সাথে তিতিরের দেখাই হয় না! কালেভদ্রে কোনো সময় যদি হসপিটালের করিডোরে দেখাও হয় তাহলেও আগের মতো আন্তরিকতা আর দেখা যায় না। হালকা হাসি বিনিময়ে পাশ কা*টানো! কেমন যেনো যান্ত্রিক সব! তিতিরের ভাবতেও কষ্ট হয় যে, একটা মানুষের উপর তার এতো গুলো সম্পর্ক নির্ভর করে।

ফুঁস করে হতাশ নিঃশ্বাস গুলো ছেড়ে আবারও ছুটে চলা গাছ-পালা ও ভবন দেখতে লেগে পরে। তার অবচেতন মন বারবার মাশরিফের কথাই ভাবছে। মাশরিফদের বাড়িতে যাচ্ছে, সেখানে মাশরিফের সাথে দেখা হলে কী হবে না হবে! এসব! নিজের ভাবনার উপর যেন তার নিজেরই নিয়ন্ত্রণ নাই।
আবারও দুইবার মা-থা ঝাঁকিয়ে এসব অবান্তর ভাবনা-চিন্তা গুলো ঝেঁড়ে ফেলতে চাইলো। কিন্তু! একটা চিন্তা মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে সেটার শেষ না দেখা অবধি যেন নিস্তার নাই। তিতির নিজের উপর খুব বিরক্ত। একই ভাবনা বারবার তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবনার লাগাম টানতে এবার সে হিয়ার কোল থেকে হায়াতকে কোলে নিয়ে বলে,

“তুই অনেকক্ষণ ওকে নিয়েছিস। হাত ব্যাথা করছে হয়তো। এবার আমি নেই।”

হিয়াও আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ সিটে গা এলিয়ে দেয়। বাসের কন্টাক্টারের ভাষ্যমতে ওরা প্রায় পৌঁছে গেছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩০
বাসস্ট্যান্ড থেকে তিতিরদের বাড়িতে আনতে মহিমা বেগম করিম চাচাকে পাঠিয়েছেন। করিম চাচার কাছে তিতিরের মায়ের নাম্বারটাও তিনি দিয়ে দিয়েছেন, যাতে দরকার পড়লে বা চিনতে না পারলে যেন ফোন করতে পারে।
করিম চাচা বাসস্টপে যাওয়ার আধাঘণ্টা পর নাজমা বেগম ও তিতিরদের নিয়ে বাড়িতে ফিরেন। মহিমা বেগম বোনকে দেখে আবেগে জড়িয়ে ধরেন। তিনি জিজ্ঞেসা করেন,

“আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

নাজমা বেগম হাস্যজ্জল জবাব দেন,
“আরে না। বাস থেকে নামার আগেই করিম ভাইয়ের ফোন পেয়ে আর কোনো অসুবিধাই হয়নি।”

মহিমা বেগম স্বস্থির নিঃশ্বাস নিয়ে হিয়ার কোল থেকে হায়াতকে নিয়ে তার মেয়ে ও মেয়ে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“রিতি, সায়ান। দেখো, নাজমা হচ্ছে আমার চাচাতো বোন। মানে আমার আপন বোনের মতোই। এরা( তিতির ও হিয়াকে দেখিয়ে) হচ্ছে নাজমার মেয়ে ও ছেলের বউ। আমার কোলের এই ছোট্ট বাচ্চাটা হিয়ার চার মাসের মেয়েটা হায়াত।”

বাচ্চাটার কথা শুনে রিতিকা বাচ্চাটার কাছে গিয়ে হাত ধরে আদর করলেও কোলে নিল না! ব্যাপারটা সায়ানের কাছে ভালো লাগল না। দিন দিন রিতিকার ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সায়ান। তার স্ত্রী তো এতটাও হৃদয়হীনা কখনো ছিল না! সায়ন এবার নিজে গিয়ে হায়াতকে কোলে নিল। বাবাহীন মেয়েটা সায়ানের কোলে গিয়ে একদম বুকের সাথে মিশে আছে। সায়ান ও রিতিকার ছেলে রিয়ানও ছোটো বাচ্চা দেখে বারবার কোলে নিতে চাইছে।

পরিচয় পর্ব ও কুশলাদি শেষে মহিমা বেগম তিতিরদের রেস্ট নেওয়ার জন্য গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়। একটু পরেই দুপুরের খাবারের জন্য সবাই একত্রিত হবে। গেস্টরুমটা মাশরিফের রুমের পাশেই। নাজমা বেগম ভুল করে মাশরাফির রুমের দরজায় হাত দিলে রিতিকা পেছন থেকে এসে বলে,

” ওটা গেস্ট রুম না আন্টি। ওটা আমার ভাইয়ের রুম। পাশেরটা গেস্ট রুম।”

নাজমা বেগম রিতিকার কথায় পেছনে ঘুরে তাকিয়ে হালকা হেসে বলেন,
” পাশাপাশি রুম তো, তাই বুঝতে পারিনি।”

প্রত্যুত্তরে রিতিকা জোরপূর্বক হাসে। নাজমা বেগম রিতিকার মনোভাব বুঝতে না পারলেও তিতির ঠিকই বুঝতে পেরেছে। রিতিকা যে তাদেরকে ভালোভাবে নিচ্ছে না, তা তার কথার ধাঁচে পরিলক্ষিত। তিতির মা ও হিয়াকে নিয়ে গেস্ট রুমের ভিতরে চলে গেল। দরজা লাগিয়ে তিতির বলে,

“সবাই যে আমাদের ভালোভাবে গ্রহণ করছে না তা লক্ষ্য করেছ?”

নাজমা বেগম ভ্রুঁ কুঁচকালেন।
“কই? কে ভালোভাবে গ্রহণ করছে না?”

“কেনো? মহিমা আন্টির মেয়ে। কথা তো একটু সুন্দর করেও বলা যায়।”

“বাদ দে তো। আমরা এসেছি কিছু সময়ে জন্য। হঠাৎ করে মায়ের বাপের বাড়ির আত্মীয় দেখলে অন্যরকম লাগবেই। তাছাড়া মহিমা আপাকে তো বাবা-চাচারা মেনে নেয়নি। মেয়েটার মনে হয়তো তা নিয়ে কোনো তিক্ততা আছে।”

মায়ের অকাট্য যুক্তিতে তিতিরের আর যুক্তি উপস্থাপন করতে ইচ্ছে হলো না। হাত-মুখ ধুঁয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

______

খাবার টেবিলে ওরা সবাই খেতে বসেছে। নাজমা বেগম মাশরিফকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেসা করেন,
“আপা, মাশরিফ কই? ওকে তো দেখছি না।”

মাশরিফের কথা উঠতেই তিতিরের হাত থেমে গেল আর রিতিকার কপাল কুঁচকে গেল। মহিমা বেগম জবাবে বলেন,
“ওর তো ছুটি পরেনি। ছুটি পরলেই আসে।”

এবার রিতিকা প্রশ্ন করে,
“আন্টি, আপনি আমার ভাইকে চিনেন?”

রিতিকার সন্ধিহান প্রশ্নের মানে নাজমা বেগম ধরতে পারলেন না। তিনি সরল মনে বলতে থাকেন,
“মাশরিফের মাধ্যমেই তো এতো বছর পর আমাদের সাক্ষাৎ হলো। ছেলেটা আমাদের কত সাহায্য করেছে জানো? ফরিদপুরে আমাদের বাড়ি বিক্রি করতেও মাশরিফ অনেক সাহায্য করেছে। তিতিরকে ময়মনসিংহতে ট্রান্সফার হতেও সাহায্য করেছে।”

রিতিকা আবারো প্রশ্ন করে,
“ওহ আচ্ছা! কিন্তু ভাই আপনাদের চিনল কিভাবে?”

“এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে মাশরিফ আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাছাড়া আমার মেয়ের জামাইও তো আর্মিতে ছিল। ওভাবেই।”

“আর্মিতে ছিল মানে? এখন নেই?”

রিতিকার পাল্টা প্রশ্নে নাজমা বেগম চুপসে যান। তিনি বুঝতে পারলেন তার এখন রাহানের ব্যাপারটা উল্লেখ করা করা উচিত হয়নি। এদিকে তিতির মায়ের এই সবাইকে আপন ভাবার স্বভাবটার জন্য মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়। রিতিকার প্রশ্নের জবাবে তিতির বলে,

” না আপু। আমার হাজব্যান্ড আর এই দুনিয়াতে নেই।”

কথাটা শোনার জন্য রিতিকা ও সায়ান কেউই প্রস্তুত ছিল না। রিতিকা চুপ করে যায়। টেবিলের মহল অনুকূল করতে মহিমা বেগম বলেন,

“বাদ দাও তো সব। খাওয়ার সময় খাও। এতো কথা কিসের? আর তুইও রিতি! এতো প্রশ্ন কেন করতে হবে তোর?”

রিতিকা মায়ের বিরক্তি দেখে আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ খেতে থাকে।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে প্রায় অনেকটা সময় গল্প গুজবেই চলে যায়। ঘড়ির কাঁটা যখন পাঁচটার ঘরের কাছাকাছি তখন নাজমা বেগম বলেন,
“আপা, আজকে আমাদের যেতে হবে। সন্ধ্যা নেমে যাচ্ছে।”

মহিমা বেগম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিয়ে বলেন,
“না। আজ কোথাও যাওয়া চলবে না। আজকে তোরা থেকে যা। কালকে যাস। আগামীকাল সায়ান তোদের পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

এরইমধ্যে তিতির ইতস্তত করে বলে,
“আন্টি, আমার সকালে ক্লাস আছে। আমরা আজই একা একা যেতে পারব। সমস্যা হবে না। তাছাড়া বেশি সময় তো লাগবে না। আড়াই-তিন ঘন্টা লাগবে।”

কিন্তু মহিমা বেগম একদম নারাজ। তিনি তার কথায় অটল।
“না বাবা! একদিন ক্লাস মিস দিলে কিছু হবে না। বন্ধুদের থেকে নোটস নিয়ে নিবে। এই সন্ধ্যা করে করে তোদের আমি ছাড়ছি না।”

তিতির কয়েকবার বুঝিয়েও সুবিধা করতে পারল না। মহিমা বেগম বাধ্য করলেন আজ থেকে যেতে। এদিকে রিতিকার ভালো লাগছে না। সে মায়ের সাথে কথা বলার পরিবেশ খুঁজছে কিন্তু মনে হচ্ছে আজও হবে না। রিতিকার অস্থীরতা সায়ান বেশ অনেকটক সময় ধরে লক্ষ্য করছে। সায়ান কাজের বাহানায় রিতিকাকে একটু ঘরে আসতে বলে আসর ছেড়ে উঠে গেল। রিতিকা পিছু গেলে সায়ান দরজা লক করে রিতিকাকে জিজ্ঞেসা করে,

“কী হয়েছে তোমার? সকাল থেকে তোমাকে কেমন অস্থীর লাগছে।”

রিতিকা আমতা আমতা করে বলল,
“কই কিছু নাতো। কী হবে আবার?”

“তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ কেনো? মনে কিছু থাকলে বলো তো।”

রিতিকা কিয়ৎ মৌন রয়। নিজের মস্তিষ্কের শব্দগুচ্ছ একটু গুছিয়ে নিয়ে বলে,
“আসলে আমি মায়ের সাথে কাশফার সম্পর্কে কথা বলতে চাইছিলাম।”

কাশফার নামটা শুনেই তৎক্ষণাৎ সায়ানের কপাল কুঁচকে গেল।
“কাশফার সম্পর্কে? কী কথা?”

“কাশফা ও মাশরিফের বিয়ে নিয়ে।”

কথাটা শোনামাত্রই সায়ান উত্তেজিত হয়ে খানিক উুঁচু স্বরে বলে ওঠে,
“হোয়াট! কাশফা ও মাশরিফের বিয়ে! সেদিন না মাশরিফ তোমাকে ক্লিয়ারলি বলে দিয়েছিল, সে কাশফাকে পছন্দ করেনা এবং বিয়েও করবে না।”

সায়ানের উচ্চস্বর শুনে রিতিকা ইশারায় সায়ানকে শান্ত হতে বলে। অতঃপর বলে,
“এখন ভালো না বাসলে যে বিয়ে করতে পারবে না! এমন তো কোন কারণ নেই। সবাই কি লাভ ম্যারেজ করে নাকি? পারিবারিক পছন্দেও তো বিয়ে করে। তাছাড়া কাশফা যেহেতু মাশরিফকে পছন্দ করে তাহলে বিয়ে করতে সমস্যাটা কোথায়?”

“সমস্যাটা কোথায় তুমি জানো না? মাশরিফ চায় না কাশফাকে বিয়ে করতে। তারপরেও তুমি জোর করছ। তোমাকে বারবার মানা করি, ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ না করতে। তাও তুমি কথা শোনো না। মেয়েটা যে প্রতিনিয়ত তোমাকে বোকা বানাচ্ছে ও ব্রেণ ওয়াশ করছে তা তো তুমি বুঝতেও পারছ না।”

রিতিকা বিরক্ত হয়ে বলল,
“আমি ছোটো বাচ্চা না যে বুঝব না। বরং তোমরা বুঝো না। বাদ দাও। আমি মায়ের সাথে কথা বলব।”

“যা খুশি করো। আমার মনে হয় না, মা রাজি হবেন!”

“দেখা যাক।”
এই বলে রিতিকা দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পেছোনে সায়ান হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,