#পথের_ধারে_দূর্বাফুল
৬.
জীবন তার ছন্দে সদা নৃত্য করে। সময় তার রীতিতে সদা ছুটে বেড়ায়। কারো জন্য কখনই সময় নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারেনা। বর্ণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেই সময়ের স্রোতে ভেসে বেড়িয়ে অপেক্ষা নামক নামতা গুনতে। তবে তার নামতার প্রতি ঘরের ফলাফল কেবল অপেক্ষা আর নিছক শূন্যস্থান। ভাদ্র গেলো তার নিয়ম করে ভাদ্রের পর নিয়ম রক্ষার্থে আশ্বিন এলো ধরায়। আকাশের রঙ তখন মিঠে নীল। তুলোর মতন কয়েকফালি মেঘের ফাঁকে বিশাল রাজকীয় ভাবে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। বর্ণের ভীষণ মন খারাপ! তার ডাক্তারি জীবনে তার হাতে কখনোই রোগী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেনি তবে আজ করেছে। শ্যামলা গড়ণের ছিপছিপে মিষ্টি একটা মেয়ে। বয়সটা তার দূর্বাফুলের মতনই। চুল গুলোর ঘনত্ব যেন বর্ণের বর্তমানের মন খারাপের সমান ছিলো। অথচ এমন একটা তাজা প্রাণকে সে বাঁচাতে পারলো না। এই আফসোস তাকে বড্ড অশান্তি দিচ্ছে। ঘামছে তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ। ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে তার দূর্বাফুল ঠিক আছে তো! তার দূর্বাফুলের কিছু হয়নি তো! মেয়েটার মাঝে কোথাও একটা নীলাম্বরীর ঘ্রাণ আছে, নীলাম্বরীর ছাঁপ আছে যা বর্ণকে আরও অস্বস্তি দিচ্ছে। মৃত মেয়েটার পরিবারের মানুষদের আর্তনাদে হসপিটাল গুমোট পরিবেশ ধারণ করেছে। ডাক্তার হিসেবে এমন কান্না সে প্রায়ই দেখতে পায়। এ আর তেমন নতুন না কিন্তু আজকের ঘটনা তার পুরোনো অভিজ্ঞতার গায়েও আঁচড় কাটছে। কই, কখনো তো আগে এমন বুকের পাশে ব্যাথা হয়নি। আজ তবে মৃত্যুর ওজন এত ভারি লাগছে কেন!
বর্ণ ছটফটে মন নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো। মাথার উপর ভরদুপুর। দুপুরের এই সময়টা পরিবেশ উত্তপ্ত থাকার পাশাপাশি অনেক নীরব থাকে। যে যার কর্ম ব্যস্ততায একটু বিশ্রাম নিতে পারে এ সময়টায়। যানবাহনও তেমন চলাচল করেনা বলে রাস্তাও থাকে মরুভূমির মতন শূন্য, নিঃস্ব। বর্ণ পকেটে হাত দিলো ফোন বের করার জন্য। উদ্দেশ্য- ফোনে দেখবে আজ আশ্বিনের কত তারিখ। দূর্বাফুলের সাথে দেখা হওয়ার আদৌও সম্ভাবনা আছে কি-না। কিন্তু ফোন খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলো সে আজ ফোনই আনেনি। কী অদ্ভুত! ফোনটা কেবিনের ডেস্কের উপরই রেখে এলো তবে! নিজের উপর বড্ড বিরক্ত হলো সে। বিরক্ত হয়েই পায়ের কাছে থাকা ছোটো একটা নুড়িতে লাথি মারলো। বিরক্ত কমানোর প্রচেষ্টা বলা যায়। তৎক্ষণাৎ সে তার পাশ থেকে খুব নিকটেই শুনতে পেলো একটা রিনরিনে নারী কণ্ঠ,
“ডাক্তার সাহেব লাথিটা কাকে মারলো? বিরক্তটা ঠিক কার উপর? নিজের উপর না দূর্বাফুলের জন্য করা দীর্ঘ অপেক্ষার উপর?”
কণ্ঠটা পরিচিত হলেও বর্ণ চমকালো। খোলা রাস্তায় যে সে আশা করেনি দূর্বাফুলের সাক্ষাতের। চমকে সে পিছে তাকানোর আগেই নারী কণ্ঠটি বলে উঠলো,
“আজ আশ্বিনের সবে অষ্টম দিন। বড্ড দেরি কিন্তু এবার হয়নি।”
এবারও বর্ণ চমকালো। মেয়েটা তার মনের খবর জানলো কীভাবে! জাদু জানে নাকি! বর্ণের চমকটা তার চোখ মুখ জুড়েও প্রতিফলিত হলো। নীলাম্বরী আজ সাদা ধবধবে একটা শাড়ি পড়েছে। মাথা সাজিয়েছে রজনীগন্ধা আর বকুল দিয়ে। যার গম্ভীর সুঘ্রাণে বর্ণের নাসিকা হতে শুরু করে হৃদপিণ্ড মুগ্ধতায় ঝিমিয়ে এলো। ঘ্রাণটা কেমন শুদ্ধ, পবিত্র ঠেকলো তার কাছে!
বর্ণ মুগ্ধ কণ্ঠে বললো, “আজ শরীর উপচে এত মুগ্ধতা ঝড়ছে কেন আপনার! মারাত্মক পবিত্র লাগছে। কেন বলুন তো!”
“আপনি কী জানেন ডাক্তার সাহেব, মানুষকে দু’টো সময় কেবল পবিত্র লাগে। এক. সদ্য জন্মালে, দুই. মৃত্যুর পর। জন্ম তো আমার হয়ে গিয়েছে বহু বর্ষ আগে। তাহলে এই পবিত্রতা কিসের! মৃত্যুর!”
নীলাম্বরীর কথায় বর্ণের হৃদপিণ্ডটা কেঁপে উঠলো। আজকে মৃত্যু শব্দটা তার কাছে সকাল থেকেই ভয়ঙ্কর ঠেকছিল। এর মাঝেই কাঙ্খিত নারীর অনাকাঙ্খিত কথায় সেই ভয় মাথা উঁচু করে বাসা বাঁধলো। বর্ণ ধমকে উঠলো,
“কিসব বলছেন! এসব অদ্ভুত কথা বলার কোনো মানে আছে! আমারই ভুল হয়েছে আপনাকে কিছু বলা।”
নীলাম্বরী খিলখিল করে হেসে উঠলো। বর্ণের বা’হাত পেঁচিয়ে শক্ত করে ধরলো। ভাবুক স্বরে বলল,
“মৃত্যুকে ভয় পান কেন? একদিন তো সবাইকেই মরতে হবে তাই না?”
বর্ণ নীলাম্বরীর হাতটা শক্ত করে ধরলো। আবদারের সুরে বলল,
“এসব বলবেন না, দূর্বাফুল। আমার বুক কাঁপে।”
“বুক কাঁপে! কেন? হারিয়ে ফেলবেন ভেবে!”
বর্ণ উত্তর দিলো না। উদ্দেশহীন গন্তব্যে দু’জনই পা মেলালো। হাঁটতে হাঁটতে বর্ণের নাকে ভেসে এলো আগরবাতির ঘ্রাণ। শরীরের লোমকূপ কেঁপে উঠলো। এত মিষ্টি ঘ্রাণটাও তার কাছে বড্ড অসহ্যকর ঠেকলো। সে শক্ত হাতে নিজের নাক-মুখ চেপে ধরলো। তা দেখে ভ্রু কুঁচকালো নীলাম্বরী। অবাক কণ্ঠে বললো,
“ওমা, এমন করছেন কেন? শরীর খারাপ করছে?”
বর্ণ’র শরীর তখন অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। ঘাম উঁকি দিচ্ছি শরীর জুড়ে। কাঁপা কাঁপা পায়ে ফুটপাতের কিনারায় বসলো। বর্ণের বিচলিত অবস্থা দেখে বিচলিত হলো নীলাম্বরীও। তার হাতের ব্যাগ থেকে বের করলো ছোট্টো পানির বোতলটা। বর্ণের দিকে ব্যস্ত হাতে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানিটুকু খান দেখবেন ভালো লাগবে। এমন করছেন কেন!”
বর্ণ বোধহয় এই পানির পিপাসাতেই দিক ভ্রষ্ট ছিলো। পানি পেতেই সে ঢকঢক করে গিলে ফেলল সবটুকু পানি। অতঃপর শান্ত হলো তার চিত্তা। অস্থিরতা কমে গেলো মুহূর্তেই। বর্ণকে স্থির হতে দেখে প্রশ্ন করলো দূর্বাফুল,
“কি হয়েছিল আপনার! এমন করছিলেন কেন?”
“তুমি কী আগরবাতি, আতুরের ঘ্রাণ পেয়েছো! মৃত মানুষের আশেপাশে যে পাওয়া যায়?”
বর্ণের কণ্ঠে তখনও উত্তেজনার ছোঁয়া। নীলাম্বরী বর্ণের প্রশ্নে হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে রমণীর চক্ষুদ্বয় বেয়ে গড়িয়ে পড়লো মলিন অশ্রুর রেখা। পেট ফাটা হাসি থামিয়ে অতঃপর সে উত্তর দিলো,
“আমরা কোথায় আছি এখন বলুন তো? আমরা আছি শাহবাগ। এই যে দেখেন, ফুতপাতের কিনার ঘেঁষে কতো মন্দির, মসজিদ, মাজার কত ধর্মীয় পবিত্র স্থান! এখানে থেকেই তো আগরবাতি, মোমবাতির ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কী শুরু করলেন বলেন তো!”
“আমার কেমন একটা মৃত্যু ভীতি তৈরী হয়েছে, দূর্বাফুল। আপনাকে হারিয়ে ফেলার ভয় করছে।”
বর্ণের কণ্ঠে তুমুল অসহায়ত্ব। নীলাম্বরী বর্ণের হাতটা আঁকড়ে ধরলো গভীর আশ্বস্ততায়। কোমল কণ্ঠে বললো,
“কাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছেন? পৃথিবীর প্রতিটা জিনিসই প্রাপ্তির পর অপ্রাপ্তির খাতায় লিখাতেই হয়। আর মৃত্যুতে এত ভয়! আপনি জানেন না মৃত্যু আমাদের জীবনের নির্মল সত্য! এই সত্যি ভুলে যাওয়ার সাধ্য আমাদের আছে?”
বর্ণ যেন পছন্দ করলো না নীলাম্বরীর কথাটা। তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। নীলাম্বরীর হাত টেনে ফুটপাত থেকে উঠালো বর্ণ। ধমকে বলল,
“এক্ষুনি চলুন আমার সাথে। হেয়ালিপনা করবেন আমার ভালোবাসা নিয়ে! এত সাধ্য? আমাকে চিনলেনই না।”
নীলাম্বরী শত বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলোও থামলো না বর্ণ। তার ভেতর কেমন যেন একটা একরোখা ভাব চলে এসেছে। সে যেন পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে চায়, দূর্বাফুল তার। একান্তই তার।
_
বর্ণদের ড্রয়িং রুমে বসেছে রোজকারের মতন আলোচনা। বর্ণের বোন রঙ সবেই ভার্সিটি থেকে এসেছে। বর্ণের ছোটো ভাই এবং তার বউ নিরুপমাও বসে আছে সোফায়। মেয়েটার ছ’মাসের ফুলো ফুলো পেট নিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে আছে। বাহিরে কড়া রোদ।
তার মাঝেই ছটফট ভঙ্গিতে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো বর্ণ। ঘাম তার মুখ জুড়ে নিজের রাজত্ব চালাচ্ছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেই বলল,
“মা, এই যে দুর্বাফুল। আমার নীলাম্বরী। এই মেয়েটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”
বর্ণের কথায় উপস্থিত সকলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। রঙের সাথে আসা তার বান্ধবী তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো। একবার দরজায় দাঁড়ানো সুপুরুষের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার রঙের দিকে তাকাচ্ছে।
বর্ণ সবাইকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো। বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“মা, তুমি কী কিছু বলবে না? তোমরা কি চুপই থাকবে?”
বর্ণের মা রঙের বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে কেমন অস্বস্তি বোধ করলো। আমতা আমতা করে বলল,
“ওহ্ নীলাম্বরী! যা নিয়ে যা ওকে তোর ঘরে। এত গরমে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন! যা ঘরে গিয়ে বস। তারপর কথা হবে।”
মায়ের জবাবে সন্তুষ্ট হলো,বর্ণ। নীলাম্বরীকে টেনে নিয়ে গেলো নিজ রুমে। রঙের বান্ধবী দোয়েল শ্বাসবন্ধ করে কেবল তাকিয়ে দেখলো এ দৃশ্য। বর্ণ ঘরে যেতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো নিরুপমা। বর্ণের মা শারমিন চৌধুরীও আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন। দোয়েল তাজ্জব বনে অবশেষে প্রশ্ন করল,
“বর্ণ ভাইয়া কাকে নিয়ে গেলো ঘরে! উনার পাশে তো কাউকেই দেখলাম না!”
#চলবে
©মম সাহা