#চিরকুট ( দশম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৮>
এই কষ্ট, এই অনুশোচনার ভিড়েই দিনগুলো কাটছিল গৌরবের। তবে ধীরে ধীরে ও আর সৃজার এই চুপ করে থাকাটাকে মেনে নিতে পারছিল না যেন। কেমন অস্থির হয়ে উঠছিল রোজ। সেই জন্য সেই শনিবার ব্যাঙ্ক ছুটি হওয়ার পর সৃজা স্টেশনে আসতে গৌরব আর প্ল্যাটফর্মে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। সৃজার কাছে এগিয়ে এসে বলে উঠেছিল,
——–” প্লিজ, আমি আর এইভাবে পারছি না! এতটা দূরের করে দিও না আমাকে। আর চিরকুট কে ছাড়া, তোমাকে ছাড়া ওই ফ্ল্যাটটা ভীষণ ফাঁকা! আমি আর একা থাকতে পারছি না। প্লিজ ফিরে চলো। আর চিরকুট তো আমারও মেয়ে! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল গৌরব। কিন্তু ওর এই শেষ কথায় সৃজা কিছুটা অবাক হয়ে বলেছিল,
——–” তোমার মেয়ে! কি বলছো? কোন ব্লাড রিলেশন আছে তোমাদের! ও কি করে তোমার মেয়ে হয়? ”
প্রশ্নটা গৌরবের চোখে চোখ রেখে করেছিল সৃজা; কিন্তু এই প্রশ্নের কোন উত্তর ছিল না ওর কাছে। চোখ দুটো তাই আপনাআপনি নিচে নেমে গেছিল সেই মুহূর্তে। তবে গৌরব এবার আস্তে গলায় বললো,
———” ওই ফাঁকা ফ্ল্যাটটা আমাকে আমার ভুল গুলো খুব ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে সৃজা। চিরকুট আমার জীবনে কতটা ইম্পর্টেন্ট, সেটা আমি এখন জানি। জানি না তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারবো কি না; কিন্তু আমি সত্যি আমার মেয়েকে খুব ভালোবাসি। ওকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয় রোজ। ”
কথাগুলো বলতে বলতে গৌরবের যন্ত্রণায় গলাটা বুঁজে আসছিল যেন। সৃজা এই সময় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
———” তুমি সেদিন যেই যেই কথাগুলো বলেছিলে, সেগুলো ভুলতে আমার সময় লাগবে। আর যতোদিন না ওই কথাগুলো ভুলতে পারছি, ততদিন তোমার কাছে মেয়েকে নিয়ে ফেরা আমার পক্ষে সম্ভব না। ”
কথাটা কেমন কঠিন গলায় বলেছিল সৃজা; আর এরপরই ট্রেন চলে এসেছিল প্ল্যাটফর্মে। তাই আর ও দাঁড়ায়নি। গৌরবের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে ট্রেনে উঠে পড়েছিল। কিন্তু সেদিন গৌরব সৃজার মতন ট্রেনে উঠতে পারেনি। থমকে দাঁড়িয়ে ছিল এক জায়গায়। এরপর ট্রেনটা ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম খালি করে চলে গেছিল অনেক দূরে! কিন্তু গৌরব স্থির হয়ে ছিল কেমন। আসলে বুকের মধ্যে জমাট কষ্টটা কিরকম দলা পাকিয়ে আসছে যেন। গৌরব আর পারছে না এইভাবে বাঁচতে! এইভাবে একলা হয়ে বাঁচতে।
না, সেদিন এরপর আর বাড়ি ফেরেনি গৌরব। আসলে ওই ফাঁকা ফ্ল্যাটটায় ফার্নিচার গুলোর সাথে থাকতে কেমন দম বন্ধ লাগে ওর। তাই কোন্নগরে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসেছিল সন্ধ্যে থেকে। শরীরটা কেমন ছেড়ে দিয়েছিল ওর। খিদে তৃষ্ণা সব যেন শেষ হয়ে গেছিল! এর মধ্যে আকাশে কালো মেঘ করে এসেছিল সেইদিন। একটু রাত বাড়তেই বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছিল। কিন্তু সেইসব দেখেও গৌরব ওঠেনি সেদিন ঘাট থেকে। মনে হচ্ছিল এই উদ্দেশ্যহীন ভাবে বসে থাকাটাই ওর জীবনের কাজ; কারণ নিজের লোক বলতে তো কেউ নেই আর কাছে!
এরপর ধীরে ধীরে মেঘ ভেঙে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়েছিল শহরে। সারা রাত ধরে চলেছিল সেই বৃষ্টি। তবে গৌরব এই বৃষ্টির হাত থেকেও নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করেনি আর। কেমন অগোছালো মানুষের মতন বসে ছিল সেই বৃষ্টির মধ্যে। কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে চারিদিকটা ঝাপসা হতে শুরু করেছিল ওর। অনেকদিন ধরেই ঠিকঠাকভাবে খাওয়া দাওয়া করতো না আসলে। তাই শরীর এমনিই দুর্বল ছিল। তার মধ্যে এইভাবে এক টানা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শরীরটা একদম নিস্তেজ হয়ে এলো যেন ছেলেটার। চোখ দুটো বুঁজে এলো হঠাৎ। আর গৌরব হুমড়ি খেয়ে বেঞ্চটা থেকে পড়ে গেল মাটিতে, পুরোপুরি সেন্সলেস হয়ে।
<১৯>
সেদিন ওইভাবে প্রায় তিন চার ঘণ্টা ধরে পড়ে ছিল গৌরব গঙ্গার ধারে। কিন্তু সকালে ওই গঙ্গার ঘাটেই মর্নিং ওয়াক করতে আসেন ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি ইনচার্জ গোবিন্দ বাবু। সেদিন বন্ধুদের সাথে প্রত্যেকদিন এর মতনই গল্প করতে করতে হাঁটছিলেন উনি। তবে হঠাৎই হাঁটার গতি কমে গেল দূরে মাটিতে পড়ে থাকা গৌরবকে দেখে! যদিও প্রথমে ও দূর থেকে চিনতে পারেনি গৌরবকে। শুধু এইভাবে একটা ছেলেকে পড়ে থাকতে দেখে কৌতূহলের বশেই গেছিল বন্ধুদের সাথে এগিয়ে। কিন্তু কাছে এসে গৌরবের পা টা থমকে যায় ওনার! তাড়াতাড়ি বন্ধুদের সাথে ধরাধরি করে গৌরবকে বেঞ্চের উপর তুলে চোখে মুখে জল দিয়েছিল গোবিন্দ বাবু। কিন্তু তাতেও গৌরবের কোন সাড়া না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এম্বুলেন্সকে কল করেছিলেন উনি। তবে কিভাবে ছেলেটা এখানে এই অবস্থায় পড়ে ছিল; সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না গোবিন্দ বাবু, তবে গৌরবের ভেজা জামা কাপড় দেখে এটুকু মনে হয়েছে যে ছেলেটা সারা রাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজেছে!
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই উনি আরেকজনের নাম্বার ডায়েল করেছিলেন ফোনে, সে হলো সৃজা। কয়েকদিন ধরেই অফিসে এসেও গৌরবের সাথে যে সৃজা একদম কথা বলছিল না, এটা ব্যাঙ্কের প্রায় সবাই খেয়াল করেছিল। আবার অনেকের মুখে এটাও গোবিন্দ বাবু শুনেছিলেন যে সৃজা এখন আলাদা থাকছে মেয়েকে নিয়ে। এইসব অশান্তির জন্যই কি ছেলেটা সারা রাত এইভাবে গঙ্গার ঘাটে বৃষ্টির মধ্যে পড়ে রইলো! বাড়িই ফিরলো না আর! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই উনি সৃজাকে ফোন করলেন। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর সৃজা ফোনটা ধরে একটু অবাক হয়েই যেন বললো,
——-” হ্যালো গোবিন্দ বাবু! বলুন। এত সকাল সকাল ফোন করলেন? ”
প্রশ্নটা শুনে গোবিন্দ বাবু সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো,
——-” সৃজা আমি মর্নিং ওয়াক করতে গঙ্গার ঘাটে এসে দেখি গৌরব স্যার সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে এখানে, কোন্নগরের গঙ্গার ঘাটে! মনে হয় সারা রাত ধরে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে এখানেই পড়েছিলেন উনি! আমি আর আমার বন্ধুরা চোখে মুখে জল দিয়ে সেন্স আনার চেষ্টা করলাম অনেক, কিন্তু কোন লাভ হলো না। আমরা তাই গৌরব স্যারকে নিয়ে এখানকার ইউনাইটেড নার্সিং হোমে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল গোবিন্দ। কিন্তু সৃজার যেন এইসব শুনে ধাক্কা লেগেছিল একটা! গৌরব তার মানে কাল বাড়ি ফেরেনি! কিন্তু কাল বিকেলেই তো কথা হলো ছেলেটার সাথে। এরপর এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে গৌরবের শরীর এত খারাপ হয়ে গেল কি করে! আর কাল সারা রাত ধরে তো মুষলধারায় বৃষ্টি পড়েছে সব জায়গায়। তার মানে গৌরব সেই বৃষ্টির মধ্যে সারা রাত ধরে ভিজেছে! কথাগুলো ভেবেই কেমন এলোমেলো লাগছিল যেন সৃজার। এর মধ্যেই ও কোন মতে মা কে খবরটা জানিয়ে ব্যাগে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে বেরিয়ে গেছিল বাড়ি থেকে। তারপর একটা ট্যাক্সি বুক করে সোজা পৌঁছেছিল কোণ্নগরে ইউনাইটেড নার্সিং হোমে।
তবে গৌরবের কেবিনের সামনে এসে ও যেন কেমন থমকে গেছিল সেই মুহূর্তে। ভিতরে না ঢুকেই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিল নিস্তেজ ছেলেটাকে। হাতে স্যালাইনের চ্যানেল, মুখে অক্সিজেন মাস্ক! গৌরবকে এই অবস্থায় দেখে সৃজা হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল ভীষণ কান্নায়। আসলে কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয় এসে ঘিরে ধরেছিল ওকে। মনে হয়েছিল ওই হাসিখুশি ছেলেটা কোথায় চলে গেল হঠাৎ! সৃজা কি এতদিন দূরে থেকে ওকে অনেক বেশি শাস্তি দিয়ে ফেললো! যার জন্য ছেলেটা আজ এরকম অবস্থায় পরে আছে হসপিটালে। কথাগুলো এক মনে ভাবতে ভাবতেই গোবিন্দ বাবু সৃজার কাছে এসে বলে উঠলো,
——-” চিন্তা কোরো না। ঠিক হয়ে যাবে গৌরব স্যার। কিন্তু প্লিজ, নিজেদের মধ্যে যদি কোন প্রব্লেম থাকে, তাহলে সেটা মিটিয়ে ফেল। এইভাবে দূরে থেকে সব কিছু শেষ হতে দিও না! ”
কথাগুলো শুনে সেই মুহূর্তে সৃজার চোখে জল চলে এসেছিল। মনে হচ্ছিল অনেকটা দেরি করে ফেললো হয়তো গৌরবের কাছে আসতে! খুব কষ্ট দিয়ে ফেললো ছেলেটাকে।
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই ডাক্তার এসে বলেছিল,
———” প্রেশার খুব লো ওনার। মনে হয় অনেকদিন ধরে ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করেনি। সেই জন্যই সেন্সলেস হয়ে গেছিল। আর অতক্ষণ ধরে সেন্সলেস থাকার জন্য অক্সিজেন লেভেল নেমে গেছে খুব। সেভেন্টিতে চলে এসেছে অক্সিজেন স্যাচুরেশন। চব্বিশ ঘন্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না! ”
ডাক্তার মুখার্জি এক নিঃশ্বাসে বলেছিলেন কথাগুলো। কিন্তু এইসব শুনে সৃজার বুকটা যেন শুকিয়ে এসেছিল হঠাৎ! গৌরবের অক্সিজেন লেভেল এতটা কমে গেছে! ওর শরীর এত খারাপ! আর সৃজা এতদিন ধরে সেইসব কিছুই বুঝলো না! এতটা অন্ধের মতন দিনের পর দিন রইলো গৌরবের সামনে! আর কালও তো ছেলেটা নিজে এসেছিল ওর কাছে। তখনও যদি সৃজা একটু মন দিয়ে খেয়াল করতো গৌরবের চেহারাটা, ওর চোখের কোণের কালি, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুখটাকে, তাহলে আজ হয়তো এই দিনটা আসতো না! এইভাবে গৌরব নিজেকে শেষ করতো না একটু একটু করে। কথাগুলো ভেবে কেমন এলোমেলো লাগছিল যেন সৃজার। শেষ হয়ে যাচ্ছিল ও ভিতর থেকে। এর মধ্যে প্রায় সাত আট ঘণ্টা কেটে গেছিল হসপিটালে। ঘড়িতে যখন সন্ধ্যে সাতটা তখন গৌরবের কেবিনে যাওয়ার পারমিশন পেয়েছিল সৃজা। কিন্তু ছেলেটা সেই মুহূর্তেও একই অবস্থায় ছিল। জ্ঞান আসেনি তখনও। অক্সিজেন মাস্ক এর আড়ালে মুখটা ঢাকা ছিল ওর। সৃজা খুব কাছ থেকে গৌরবকে এই অবস্থায় দেখে ভেঙে পরেছিল কেমন কান্নায়। ওর হাতটা সেই সময় ধরতে গিয়ে খেয়াল করেছিল স্যালাইনের চ্যানেলটা। আর মনে পরে গেছিল একটা পুরনো ঘটনা। তখনও বিয়ে হয়নি ওদের! সেই সময় কোন একদিন গৌরবের লোহায় হাত কেটে গেছিল। কিন্তু ইঞ্জেকশন দিতে গৌরবের এত ভয় ছিল যে সৃজাকে রীতিমত জোর করে বকে ঝকে নিয়ে যেতে হয়েছিল টিটেনাস দিতে ওষুধের দোকানে! কথাটা ভেবেই ওর চোখ দুটো জলে ভরে গেল কেমন। মনে হলো কতটা কষ্ট পাচ্ছে গৌরব!
সেদিন এই ভাবনার ভিড়েই সৃজা নিস্তেজ গৌরবের হাতটা ধরেছিল আলতো করে। তারপর নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
——-” এম সরি.. রিয়ালি সরি.. প্লিজ ওঠো এবার। একবার তাকাও আমার দিকে! আমি আর কখনো যাবো না তোমাকে ছেড়ে! সব সময় সঙ্গে থাকবো। আই প্রমিজ.. প্লিজ এইভাবে আর থেকো না! কথা বলো আমার সাথে। ”
কথাগুলো বলতে বলতে সৃজার চারিদিকটা আবছা হয়ে এসেছিল হঠাৎ। কেমন অসহায় ছন্নছাড়া লাগছিল নিজেকে। মনে হচ্ছিল কেন কাল রাতে একবার ফোন করলো না গৌরবকে! কেন একবারও জানার চেষ্টা করলো না ও কোথায়! কেন একটু কথা বললো না ছেলেটার সাথে! তাহলে ওইভাবে সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে বসে থেকে নিজের এই অবস্থা করতো না গৌরব!
সেদিন এই খারাপ লাগার মধ্যে দিয়েই রাতটা কেটেছিল সৃজার। তবে পরের দিন ভোরে গৌরবের জ্ঞান ফিরেছিল অবশেষে। শ্বাস কষ্টটাও কমেছিল কিছুটা। তবে সেই সময় ও এতটাই ক্লান্ত আর নিস্তেজ ছিল, যে সৃজাকে সামনে দেখেও বিশ্বাস করেনি ঠিক! আবছা চোখে শুধু ফিল করেছিল সৃজার হাতের নরম স্পর্শটা। তবে সেটা সত্যি না মিথ্যে সেটা না বুঝেই ঘুমিয়ে পড়েছিল গৌরব আবার।
< ২০ >
এরপর যখন গৌরব চোখ খুলেছিল তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে শহরে। সৃজা এই পুরো সময়টা গৌরবের সাথেই ছিল। শুধু ভাবছিল কখন ছেলেটা আবার আগের মতন কথা বলবে! কিন্তু গৌরব সেই মুহুর্তে চোখ খুলে সৃজাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। যদিও শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত ছিল। কিন্তু সেই ক্লান্তির মধ্যেও মনে হচ্ছিল সৃজা কি তাহলে সব দূরত্ব ভেঙে ফিরে এলো ওর কাছে!
তবে এই ভাবনার ভিড়েই সৃজা বলে উঠেছিল,
———” কেমন লাগছে এখন? কষ্ট হচ্ছে কোন? ”
কথাটা শুনে গৌরব কিছুটা সময় নিয়ে বললো,
———” না, ঠিক আছি। কিন্তু আমি এখানে কিভাবে এলাম! আমার কিছুই মনে পড়ছে না! আমি তো গঙ্গার ঘাটে ছিলাম। ”
কথাগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে বললো গৌরব। কিন্তু এইসব শুনে সৃজা ভেজা চোখেই বলে উঠলো,
———-” হ্যাঁ, তুমি সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে ভিজে গঙ্গার ঘাটে সেন্সলেস হয়ে পড়ে ছিলে। ভাগ্যিস আমাদের ব্যাঙ্কের গোবিন্দ বাবু ঐদিকে মর্নিং ওয়াক করতে যায়! উনি তোমায় ভোর বেলা দেখে আমাকে কল করেছিল। তারপর উনি আর কয়েক জন লোকাল লোক মিলে তোমাকে এই ইউনাইটেড নার্সিং হোমে এডমিট করেছে। দেড় দিন ধরে তুমি আছো এখানে! ঠিকভাবে শ্বাস টুকু নিতে পারছিলে না প্রথমে; তোমার শরীর এতটাই খারাপ ছিল! ”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বললো সৃজা। কিন্তু এই সময় ওর গলাটাও বুঁজে আসছে কান্নায়। অদ্ভুত একটা অভিমান আর কষ্ট হচ্ছে মনে। তবে গৌরব এইসব শুনেও চুপ ছিল সেই মুহূর্তে। যেন ওর কিছুই বলার নেই আজ। তবে সৃজা চুপ না থেকেই বলে উঠলো আবার,
——-” কেন করলে এরকম? কেন সেদিন বাড়ি ফিরলে না তুমি! ওইভাবে সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে কেউ বসে থাকে! তোমার যদি কিছু হয়ে যেত, তাহলে আমি কি করতাম! একবারও ভাবলে না? ”
কথাগুলো ভীষণ অভিমানী গলায় বললো সৃজা। কিন্তু এটা শুনে গৌরব খুব থমকে উত্তর দিল,
———” বাড়ি ফিরতে ভালো লাগে না আমার। তুমি আর চিরকুট ছাড়া ওই ফ্ল্যাটটা ভীষণ ফাঁকা! দম বন্ধ হয়ে যায় আমার ওই একা ফ্ল্যাটে। তাই যাইনি আর। ”
কথাগুলো বলতে বলতে গৌরবের গলাটাও বুঁজে এলো এবার কষ্টে। আর যেন কিছু উত্তর দিতে পারলো না ঠিক! কিন্তু সৃজা এবার নিজের সবটা দিয়ে গৌরবের হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,
———-” এম সরি.. এম রিয়ালি সরি.. আমি আর কোনদিন তোমাকে এইভাবে একা করে দেব না! আর কখনো রাগ করবো না। কিন্তু প্লিজ, এইভাবে নিজেকে আর হার্ট কোরো না কোনদিন! নিজেকে এতটা কষ্ট দিও না প্লিজ! তোমার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি পারবো না বাঁচতে! ”
কথাগুলো কেমন অসহায় ভাবে বললো সৃজা। কিন্তু গৌরব এর উত্তরে নিজে ভীষণ থমকে বললো,
———-” হার্ট তো আমি করেছি তোমাদের। তোমাকে আর চিরকুটকে! আমি কিভাবে এতটা ইন্সেনসিটিভ হলাম আমি জানি না। ওইটুকু বাচ্চাকে আমি ভালোবাসতে পারলাম না! নিজের করে নিতে পারলাম না! ওই ছোট্ট মেয়েটার সাথে এতটা হিসেব করে চললাম! আমি আসলে খুব খারাপ একটা মানুষ। খুব ছোট মনের মানুষ। ”
কথাগুলো নিজের মনের রাগ থেকে বললো গৌরব। কিন্তু সৃজা এইসব শুনে সঙ্গে সঙ্গে ওকে থামিয়ে বললো,
———” না গৌরব, একেবারেই না। তুমি খুব ভালো একজন মানুষ। আমি জানি। আমি তোমাকে তোমার থেকেও বেশি ভালো করে চিনি। আর ভুল তো প্রত্যেক মানুষেরই হয়। এর জন্য কেউ খারাপ হয়ে যায় না। ”
কথাগুলো খুব জোর দিয়ে বললো সৃজা। কিন্তু গৌরব এবার সেই অসহায় স্বরেই রিকুয়েস্ট করলো ওকে,
——–” আমাকে আর একটা সুযোগ দেবে প্লিজ! আর একবার চিরকুট কে নিয়ে আমার কাছে আসবে? আমাকে আর একবার সুযোগ দেবে ওর বাবা হওয়ার? চিরকুট একবার দূরে যেতে বুঝেছি, ও কতটা ইম্পর্টেন্ট আমার লাইফে! ওর হাসি,ওর কথা, ওর দুষ্টুমি, এইসব ছাড়া আমার সব কিছুই ইনকমপ্লিট! প্লিজ আরেকবার ফিরে আসবে আমার কাছে? প্লিজ! ”
কথাগুলো বলতে বলতে গৌরব কেঁদে ফেললো হঠাৎ সেই মুহূর্তে। তবে সৃজা এবার ওকে জড়িয়ে ধরলো খুব শক্ত করে। না, আর পারছে না গৌরবকে এরকম ছন্নছাড়া অবস্থায় দেখতে। আর এই ছেলেটার থেকে দূরে থাকা সম্ভব না। বরং আরো বেশি করে আগলে রাখবে ও নিজের মধ্যে গৌরবকে! আর কখনো ওকে কষ্ট পেতে দেবে না এইভাবে।
( চলবে)