চিরকুট পর্ব-১১

0
147

#চিরকুট ( একাদশ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<২১>
সৃজা এরপর গৌরবকে আর এক মুহূর্তের জন্যও একা ছাড়েনি। একদিন বাদে গৌরবকে নার্সিং হোম থেকে রিলিজ দিয়ে দিয়েছিল। তারপর সৃজা ওর সাথেই ফ্ল্যাটে এসেছিল চিরকুটকে নিয়ে। এরপর দিন রাত ছায়ার মতন ছিল সৃজা ওর কাছে। গৌরবকে ঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো, সব কিছু করেছিল নিজে। আসলে হসপিটালে সেই দিনটায় গৌরবকে ওইভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ওর মনে একটা ভয় তৈরি হয়েছে খুব। গৌরবকে হারিয়ে ফেলার ভয়। তাই ওকে আগলে রাখার চেষ্টাটাও বেড়ে গেছে ভীষণ। যাইহোক, এইভাবেই দিনগুলো এগোচ্ছিল। কিন্তু এই সময়ে গৌরব বার বার চিরকুটের কথা জিজ্ঞেস করতো ওকে। আসলে শরীরটা খুব উইক ছিল বলে ও কদিন ঘরবন্দী! তবে এই সময়ে কেন চিরকুট একবারও ওর ঘরে আসে না, কথা বলে না, ডাকলেও সাড়া দেয় না, প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে সারাক্ষণ চলতে থাকতো গৌরবের। তবে সৃজা প্রথম প্রথম এসব শুনে চুপ থাকলেও পরে বাধ্য হয়ে বলেছিল খুব ক্লান্ত স্বরে,
——– ” সেদিন রাতে তুমি যা যা বলেছিল, চিরকুট সব শুনেছে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে। ও এখন এটা জানে আমরা ওর বাবা মা নোই। আমি যেই কথাটা ওকে আরেকটু বড় হলে জানাতে চেয়েছিলাম, সেটা চিরকুট খুব ছোট বয়সে জেনে গেছে। আর এটা ওকে খুব এফেক্ট করেছে! যদিও আমি ওর খুব ক্লোজ বলে আমাকে মা হিসেবে মেনে নিতে ওর কোন হেজিটেশন নেই। কিন্তু সেই রাতের পর ও এটা বুঝে গেছে যে তুমি ওকে পছন্দ করো না। তাই আর চিরকুট তোমার কাছে আসে না। ”
কথাগুলো বলে সৃজা খেয়াল করেছিল গৌরবের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মুখটা। ও কিরকম চুপ করে গেছিল যেন কয়েক সেকেন্ড এইসব শুনে! তারপর নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
——-” আমি এটা কি করলাম! ওইটুকু একটা বাচ্চাকে এতটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম! কেন আমি সেদিন ড্রিঙ্ক করতে গেছিলাম! কেন!”
কথাগুলো বলতে বলতে ও হাত দুটো মুঠো করে ফেললো নিজের আফসোসে। কিন্তু এই মুহূর্তে সৃজা ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
——–” এইভাবে নিজের ওপর রাগ রেখো না। চিরকুট তো বাচ্চা, ওকে একটু সময় দাও। হয়তো এই ঘটনাটা ও ভুলে যাবে কদিন বাদে! তখন আবার আসবে তোমার কাছে। ”
কথাগুলো ও গৌরবকে বোঝানোর জন্য বললো, যাতে ছেলেটা আর নিজেকে কোনভাবে হার্ট না করে! তবে গৌরব এই মুহূর্তে কিছুটা সময় নিয়ে বললো,
———” চিরকুটকে আসতে হবে না। আমি যাবো আমার মেয়ের কাছে। আমি ওকে বোঝাবো যে আমি ওর নিজের। আমিই ওর বাবা। আর এর জন্য যতটা এফোর্ট দিতে হয় আমি দেব। যতদিন অপেক্ষা করতে হয়, আমি করবো। কিন্তু আমার মেয়ের মনে নিজের জন্য জায়গা আমি তৈরি করবোই। ”
কথাগুলো খুব দৃর ভাবে বললো গৌরব। তবে সৃজা এর উত্তরে কিছুই আর ঠিক বলতে পারলো না। শুধু চোখ দুটো ভিজে এলো ওর। অনেকদিন ধরে যেই টান, যেই ভালোবাসাটা গৌরবের চোখে দেখতে চেয়েছিল ও চিরকুটের জন্য, অবশেষে তার দেখা পেয়েছে বলে মনে হলো।
তবে এরপর গৌরব চিরকুটের সাথে নিজের দূরত্ব ভাঙার চেষ্টা করতো রোজ। কখনো মেয়ের ফেভারিট চকলেট নিয়ে এসে, তো কখনো কোন খেলনা নিয়ে এসে চিরকুটের ঘরে যেত। যদিও চিরকুট সেইসব দেখে খুশি হতো না আর! ভীষণ চুপ করে থাকতো গৌরবের সামনে। তাও গৌরব সহজ হয়ে আবার পরেরদিন নতুন করে কথা শুরু করার চেষ্টা করতো! এই যেমন সেদিন ও সৃজাকে নিজে থেকে বলেছিল,
——” আজ চিরকুটকে স্কুল থেকে আমি নিয়ে আসবো। তোমার যাওয়ার দরকার নেই। ”
কথাটায় সৃজা অবাক হয়েই বলেছিল,
——-” কিন্তু তোমার তো খুব কাজের চাপ! বেরোতে পারবে অফিস থেকে আগে? ”
এটা শুনে গৌরব বেশ জোর দিয়ে বলেছিল,
———” হ্যাঁ, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক চলে যাবো। ”
এরপর গৌরব ঠিক বিকেল চারটের সময় পৌঁছে গেছিল স্কুলে। এই প্রথম গৌরব চিরকুটের স্কুলে এসেছিল। যদিও চিরকুট আজ সেটা দেখে একদমই খুশি হয়নি। ও গৌরবের কাছে এসে খুব থমকেই জিজ্ঞেস করেছিল,
———” মাম্মা কোথায়? তুমি কেন এলে? ”
কথাটায় গৌরব বুঝেছিল চিরকুটের মন খারাপ হয়ে গেছে ওকে দেখে। সত্যি, একটা সময় মেয়েটা কত করে বলতো ওকে স্কুলে আসতে! চিরকুট এর এনোয়াল ফাংশনের সময়ও তো বলেছিল, স্কুলে আসলে ও ওর বন্ধুদের সাথে আলাপ করিয়ে দেবে। কিন্তু গৌরব তখন আসেনি। একবারও চিরকুটের ছোট্ট মনটার কথা ভাবেনি। তাই নিজের মেয়ের সাথে আজ এতটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও বলেছিল,
———-” মাম্মা আজ বাড়ি চলে গেছে। তাই আমি এসেছি। ”
কথাটা বলে ওকে কোলে তুলে গাড়িতে বসিয়েছিল। তবে গাড়ির মধ্যেও চিরকুট চুপ ছিল। কিন্তু গৌরব এই রাস্তার মাঝে আলতো হেসে বলেছিল,
——–” আইসক্রিম খাবে তুমি? আমি একটা খুব ভালো আইসক্রিম পার্লার চিনি। তুমি যাবে আমার সাথে? ”
কথাটা শুনে চিরকুট সেই অন্ধকার মুখেই বলেছিল আস্তে গলায়,
——-” না, আমি মাম্মার কাছে যাবো। ”
কথাটা বলতে বলতে চিরকুট হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল নিজের মনে। গৌরব সেটা দেখে বেশ ব্যাস্ত হয়েই বলেছিল,
——–” মা তুমি কাঁদছো কেন! এই তো আমরা যাচ্ছি মাম্মার কাছে। কেঁদো না সোনা। ”
কথাটা বলেই ও গাড়ির স্পিড বাড়িয়েছিল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখেছিল চিরকুট কেমন ছুটে গিয়ে সৃজা কে জড়িয়ে ধরলো। যেন প্রাণ ফিরে পেল মেয়েটা।
গৌরব এসব দেখে বুঝেছিল চিরকুট কতটা আড়ষ্ট ওর কাছে! কতটা কুঁকড়ে থাকে ওর সামনে। কথাটা ভেবে নিজের ওপরই রাগ হলো ভীষণ। যদি প্রথম থেকে চিরকুটের সাথে সহজ হয়ে মিশতো, তাহলে আজ এইভাবে নিজের মেয়ের সাথে এতটা দূরত্ব তৈরি হতো না ওর। এমন কি চিরকুট তো এখন ওকে আর বাবা বলেও ডাকে না! এতটাই দূরের ভাবে গৌরবকে।
<২২>
যাইহোক, এরপর কটা দিন কেটে গেছিল একইভাবে। কিন্তু এই নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে সৃজার একটা কাজ চলে এলো হঠাৎ। ওকে মা কে নিয়ে চেন্নাই যেতে হবে তিন চার দিনের জন্য মায়ের চোখ দেখাতে সংকর নেত্রালয়ে। কিন্তু চিরকুটের এই সময় এক্সাম চলছে, তাই ও সঙ্গে গেলে পরীক্ষাটা মিস হয়ে যাবে! আর গৌরবের তো অফিসে এতটা কাজের চাপ যে ও কিছুতেই যেতে পারবে না। কথাটা ভেবে বেশ চিন্তায় ছিল সৃজা। ও চলে গেলে চিরকুট কে দেখবে কে! এটাই ভাবছিল সারাক্ষণ। সেই জন্য মুখটাও অন্ধকার ছিল ওর দুদিন ধরে। তবে গৌরব এবার নিজে থেকে এসে বলেছিল,
——–” তুমি এই ছোট্ট ব্যাপারে এত টেনশন না করে নিশ্চিন্তে মা কে নিয়ে চেন্নাই যাও। চার দিনের তো ব্যাপার। আর আমি তো আছি চিরকুটের সাথে! ”
কথাগুলো শুনে সৃজা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলেছিল,
——–” না মানে তুমি পারবে? ওকে খাওয়ানো, স্কুলের জন্য রেডি করা, ঠিক সময়ে স্কুল থেকে নিয়ে আসা, অনেক কাজ! তোমার প্রব্লেম হবে। ”
কথাগুলো বলে সৃজা খেয়াল করেছিল গৌরবের চোখ দুটো হঠাৎ নিচে নেমে গেছিল সেই সময়। ও খুব আস্তে গলায় বলেছিল,
———-” জানি, আমি অনেকদিন চিরকুটের কোন দায়িত্বই নিইনি। নিজের মনের জটিল চিন্তাভাবনার মধ্যেই ব্যাস্ত থাকতাম। তবে আমার ভুলটা ভেঙেছে সৃজা। আজ আমি দিন রাত শুধু একটাই জিনিস চাই; আমার মেয়ের মুখে বাবা ডাকটা শুনতে। তুমি একটু ভরসা করো আমাকে, আমি এই চারদিন চিরকুটের কোন অসুবিধা হতে দেব না। ”
কথাগুলো খুব দৃর গলায় বললো গৌরব। আর এরপর এর সৃজা না বলতে পারলো না ওকে। সেই জন্য চেন্নাই যাওয়ার টিকিটটা কেটেই ফেললো অবশেষে।
তবে এই চেন্নাই যাবার কথাটা চিরকুটকে বলেনি ও ইচ্ছে করেই। কারণ তাহলেই মেয়েটা কান্নাকাটি শুরু করবে। তাই সেদিন চিরকুট স্কুলে গেছিল যখন, সেই ফাঁকে সৃজা বেরিয়ে গেছিল এয়ারপোর্টের জন্য। তবে বিকেলে স্কুলের সামনে গৌরবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিরকুটের ভালো লাগেনি একটুও। মুখটাকে উদাস করেই গাড়িতে উঠেছিল। আর এরপর বাড়িতে এসে মা কে দেখতে না পেয়ে কিরকম চোখে জল চলে এসেছিল ওর। নিজের ঘরে গিয়ে একা একা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল চিরকুট। তবে এই রিয়্যাকশনটার ব্যাপারে গৌরব আগে থেকেই আন্দাজ করেছিল। তাই অফিস থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে একটা বার্বি ডল কিনেছিল মেয়ের জন্য। এই মুহূর্তে সেই পুতুলটা নিয়েই চিরকুটের কাছে গেছিল ও। তারপর একটু আলতো স্বরে বলেছিল,
———” মাম্মা যাওয়ার আগে এই ডলটা কিনে পাঠিয়েছে তোমার জন্য। আসলে মাম্মা তো জানতো, চিরকুটের খুব মন খারাপ হয়ে যাবে বাড়ি এসে মাম্মাকে না দেখে! তাই এটা দিয়ে গেছিল আমাকে তোমাকে দেয়ার জন্য। ”
কথাগুলো খুব সহজভাবে বলেছিল ও। হ্যাঁ, মিথ্যাই বলেছিল চিরকুটকে; কারণ গৌরব জানতো যে পুতুলটা ও কিনেছে জানলে চিরকুট সেটাকে খুশি মনে নেবে না। যাইহোক, এই কথাটা শুনে চিরকুট ভেজা চোখেই গৌরবের কাছে এসে পুতুলটা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
———” মাম্মা কবে ফিরবে বাড়ি? ”
এই প্রশ্নে গৌরব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,
———-” তিন চার দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে মাম্মা। আসলে দিদার চোখে ব্যাথা তো! তাই দিদাকে ভালো একটা ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছে মাম্মা। ”
কথাটা শুনে চিরকুট এরপর আর কিছু বলেনি ওকে। চুপচাপ নিজের খাটে গিয়ে পুতুলটাকে নিয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছিল।
তবে রাতে ওর মন আবার অস্থির হয়ে উঠেছিল মায়ের জন্য। একটা ভীষণ মন কেমন শুরু হয়েছিল মায়ের কথা ভেবে। সেই জন্য গৌরব যখন ডিনার নিয়ে চিরকুটকে খাওয়াতে এসেছিল মেয়েটা জল ভর্তি চোখে চুপচাপ বসেছিল এক জায়গায়। গৌরবের এই দৃশ্য দেখে খারাপ লাগছিল খুব, আর নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল। আসলে এই বাচ্চাটার থেকে নিজেকে প্রথম থেকে এতটা দূরে রেখেছিল ও যে গৌরবের সাথে থাকার অভ্যাসই তৈরি হয়নি চিরকুটের। তাই এই বাড়িতে ওর এত একা লাগছে সৃজাকে ছাড়া। আর মেয়েটা স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে কিছুই খায়নি এখনও পর্যন্ত। কথাটা ভেবে গৌরব এবার মেয়ের কাছে গিয়ে বলেছিল,
——–” তুমি মাম্মার সাথে দেখা করবে? কথা বলবে? ”
এই প্রশ্নে চিরকুট জল ভর্তি চোখেই বলেছিল,
——–” মাম্মা তো অনেক দূরে! কি করে কথা বলবো? ”
এটা শুনে গৌরব অল্প হেসে ভিডিও কল করেছিল সৃজাকে। তারপর ফোনটা মেয়ের সামনে ধরতেই মেয়ের মুখে হাসি। অবশেষে মায়ের দেখা পেয়েছে ও। তারপর এক মুহূর্তে কালো মেঘ কাটিয়ে রোদেলা আকাশ চিরকুটের চোখে। সৃজা কে দেখতে পেয়ে নানা রকম এলোমেলো কথা শুরু ওর। তবে গৌরব এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে অল্প অল্প রুটির টুকরো ছিঁড়ে চিরকুটের মুখে পুরে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। আর সৃজার সাথে কথা বলতে বলতে চিরকুট আনমনে খেয়েও নিচ্ছিল সব। তারপর বেশ কিছুটা সময় পার করে ক্লান্ত শরীরে ফোনটা রেখে গৌরবের কোলে মাথা দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল চিরকুট। আর এই প্রথম মেয়েকে এতটা কাছ থেকে পেয়ে গৌরবের চোখ দুটো আবছা হয়ে এসেছিল যেন। সত্যি! কি বোকামি করেছিল এতদিন ধরে! এরকম ফুটফুটে একটা মেয়ে থাকতেও নিজেকে নিঃসন্তান ভাবতো ও! বাবা হওয়ার সুখটা পেয়েও উপলব্ধি করতো না শুধুমাত্র নিজের রক্ত নেই বলে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চিরকুটের মাথায় হাত বুলিয়ে খুব আদর করলো গৌরব। তারপর আলতো করে ওকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল।
<২৩>
এরপরের দিন গৌরব নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট রান্না করেছিল। যদিও চিরকুটের সৃজার জন্য মন কেমন করছিল খুব! তাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে মুখ ভার করে বসেছিল। গৌরবের সেটা দেখে একটা আইডিয়া এসেছিল মাথায়। ও ডিম পাউরুটি টোস্টটার ওপর কেচ আপ দিয়ে একটা স্মাইলি এঁকে চিরকুটের সামনে দিয়েছিল। সেটা দেখেই মেয়ের মুখে আলতো হাসি। ও এবার এর মুখ গোমড়া না করে খেতে শুরু করেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে চিরকুট খেয়াল করেছিল গৌরব কিছুই খাচ্ছে না। তাই অল্প ভেবেই জিজ্ঞেস করেছিল,
——–” তুমি খাচ্ছো না কেন? ”
এই কথায় গৌরব একটু অন্ধকার মুখে কিছু কথা সাজিয়ে বলেছিল,
——–” তোমার মাম্মা বাড়িতে নেই। তাই আমারও মন খারাপ। সেই জন্য খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
এটা শুনে চিরকুট নিজের মনে কিছু একটা ভেবে ওর সামনে এক টুকরো পাউরুটি তুলে ধরে বলেছিল,
———” এই নাও। খেয়ে নাও। না খেয়ে থাকতে নেই। ”
সেই মুহূর্তে গৌরব যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিল কেমন! অদ্ভুত একটা ভালো লাগা ছড়িয়ে গেছিল মনে। গৌরব সঙ্গে সঙ্গে চিরকুটকে আদর করে কোলে বসিয়ে নিয়েছিল নিজের। তারপর ওর হাত থেকে পাউরুটির টুকরোটা খেয়েছিল চরম তৃপ্তিতে।
এরপর থেকে তিনটে দিনে গৌরব সম্পূর্ন ভাবে একটা মেয়ের বাবা হয়ে উঠেছিল। চিরকুট এর চুলে বিনুনি বেঁধে দেয়া থেকে ওর সাথে পুতুল খেলা, বুঝিয়ে বুঝিয়ে হোম ওয়ার্ক করানো, গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো সব কিছু করেছিল গৌরব ভীষণ মন থেকে। চিরকুটও এই দিনগুলোতে পুরনো স্মৃতি ভুলে ওর খুব কাছে চলে এসেছিল। সেই আড়ষ্ট ভাবটা কাটিয়ে সহজ হয়েছিল গৌরবের কাছে। আগের মতন ও গৌরবকে দেখে আর চুপ করে যেত না। টুকরো টুকরো কথা, হাসি, গল্প করতো গৌরবের সাথে। এইভাবেই চারটে দিন কাটিয়ে সৃজার ফেরার দিনটা চলে এসেছিল শহরে। সেদিন সকালে তখনও গৌরবের ঘুমটা ভাঙেনি। স্বপ্নের দেশের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছিল ও। তখনই একটা ছোট্ট নরম হাত ওকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে এসে বললো,
——–” বাবা, ওঠো। কতক্ষণ ঘুমোবে আর! ওঠো।”
আধো আধো স্বরে এই বাবা ডাকটা শুনে গৌরবের এক মুহূর্তেই ঘুমের ঘোরটা কেটে গেল কেমন! ও চমকে উঠে চিরকুটের দিকে তাকালো। তখনই চিরকুট আবার বলে উঠলো,
———” বাবা উঠে পড়ো। মাম্মা আসবে তো আজ! আমি কিন্তু স্কুল যাবো না। ”
শেষ কথাটা বেশ আবদারের সুরে বললো চিরকুট। কিন্তু গৌরব কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল যেন আরেকবার চিরকুটের মুখে বাবা ডাকটা শুনে। ও কেমন স্থির গলায় বললো,
——-” কি বলে ডাকলি আমাকে? বাবা! ”
চিরকুট এই প্রশ্নে কোন উত্তর না দিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর নিজের মনেই বলে উঠলো,
——-” কেন! তুমি কি আমার নিজের বাবা নও? আমার বার্থডের দিন বলছিলে যে! কিন্তু তোমাকেই তো আমার নিজের বাবা লাগে। তুমি আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসো, খাইয়ে দাও, হোম টাস্ক করিয়ে দাও, কত আদর করো! আমার অন্য ফ্রেন্ডসদের বাবারাও তো এরকমই করে।”
কথাগুলো শুনে অনুশোচনায় গৌরবের চোখ দুটো ভিজে এলো কেমন। ও সঙ্গে সঙ্গে চিরকুটকে আঁকড়ে ধরে বললো,
——” না মা, একদম সেদিনের কথা মনে রাখবি না! আমি যা বলেছিলাম, ভুল বলেছিলাম। আমিই তোর বাবা। আমি তোকে খুব ভালোবাসি সোনা। খুব ভালোবাসি। ”
কথাগুলো খুব এলোমেলো হয়ে বললো গৌরব। কিন্তু চিরকুট এইসব শুনে বেশ অবাক হয়ে বললো,
——-” কাঁদছো কেন বাবা? কি হয়েছে তোমার? মাম্মা আসবে তো আজকে! চলো, একসাথে মিলে ব্রেকফাস্ট বানাবো আজ মাম্মার জন্য। কেঁদো না প্লিজ।”
কথাগুলো বলতে বলতে ও জড়িয়ে ধরলো গৌরবকে নিজের ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে। আর গৌরবের মনে হলো জীবনের সব থেকে দামী মুহূর্তটা পাওয়া হয়ে গেছে! নিজের মেয়ের ভালোবাসা, আদর পাওয়া হয়ে গেছে। গৌরব এই সময় কিছু না বলে শুধু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো চিরকুটকে, আর নিঃশব্দে মুহূর্তগুলোকে ফিল করলো ভীষণ মন থেকে।
( চলবে)