তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩।
আমিনা কলেজে পড়াকালীন সময়ে রাজু নামে এক ছেলের সাথে প্রেম করত। তার সাথেই পালিয়ে গেল। কাজি অফিসে গিয়ে একাই বিয়ে করে ফেলল। এরপর দুই পরিবার অনেক দেনদরবার করে বিয়েটা মেনে নিলেও শেষ অবধি সংসার টিকেনি। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে। তবু আমিনা মা হতে পারেনি। সমস্যা তারই। মা হতে গিয়ে বিভিন্ন জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছিল। চিকিৎসা করা যাবে। কিন্তু তা ব্যয়বহুল। রাজু স্ত্রীর চিকিৎসা বাবদ টাকাপয়সা খরচ করতে অনীহা বোধ করছিল। বাড়ির বড় ছেলে সে। বাবা-মা, ভাইবোন সবার ভরণপোষণ তাকেই টানতে হয়। চাকুরি একটা করে। কিন্তু তা থেকে আহামরি কোনো বেতন আসে না, যা দিয়ে সংসারের খরচ চালানোর পর বাড়তি খরচ করা যাবে। আবার সন্তানের মুখও দেখা চাই। এজন্য সে দ্বিতীয় বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করল।
পাত্রী তারই অফিসের মহিলা কলিগ। আমিনা আগেই টের পেয়েছিল, সুন্দরী কলিগের সাথে রাজুর প্রণয় চলছে। তবু মুখ বুজে চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছিল। শ্বশুরবাড়ির লোকজন এমনিতেই তার উপর নাখোশ। পালিয়ে বিয়ে, তাই বাপের বাড়ি থেকে রাজ্যের যৌতুক আনতে পারেনি বউ। পরে দুই পরিবারে মিটমাট হলেও সেভাবে আয়োজন করা হয়নি। বাপের বাড়ির সেই সাধ্য থাকলে তো! তার উপর হয় না বাচ্চা। তাই দিনেরাতে সব সময় শাশুড়ির মুখ ঝামটার উপর থাকতে হয়েছে তাকে। বাড়ির সমস্ত কাজ সে একাই করত। তবু উনিশ-বিশ হলেই নানান কথা শুনতে হতো। কষ্ট করেছে। তবু মুখ খোলেনি। কিন্তু রাজুর দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারেনি। রাজুর জন্যই এতকাল সমস্ত গঞ্জনা আর খোঁটা সহ্য করেছে সে। রাজুকে ভালোবাসে, তাই। এরপর কি আর ওই বাড়িতে থাকা মানায়? নাকি সম্পর্কটা বয়ে বেড়ানো যায়?
আমিনা কোনো কথা না বলে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছে ওখান থেকে। রাজু অবশ্য বলেছিল, প্রথম স্ত্রী হিসেবে আমিনাকে সসম্মানে রাখবে সে। কিন্তু আমিনার মনে হলো, ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এর চেয়ে বড় অসম্মান আর হয় না। বিয়েটা পারিবারিক পছন্দে হলে নাহয় মানা যেত। আমিনা নানা পারিপার্শ্বিকতা আর পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রথম স্ত্রী হিসেবে নিজ স্থানে বলবৎ থাকত। কিন্তু রাজুর সাথে তার সম্পর্ক অন্যরকম। এখানে অন্য কারও স্থান নেই।
আমিনার এই চলে আসাটাকে ওর বাবা-মা খুব একটা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। বড় মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করায় আগেই মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখেছিল তারা। তার উপর ঘরে আরও দুটি বোন আছে। সংসারে নেই আয়। অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর ভরসা করে জীবন চলছে, এমতাবস্থায় ডিভোর্সী মেয়ে মানেই বিপদের পাল্লা ভারী হওয়া। তার চেয়ে রাজুর ঘরে থাকলেই কি ভালো হতো না? কিন্তু শাহীনা বানু বললেন, আমিনা ঠিক কাজটাই করেছে। সংসার চলে পারস্পারিক বিশ্বাস আর সম্মানের ভিত্তিতে। রাজু অনেক আগেই বিশ্বাস ভেঙ্গেছে স্ত্রীর। গোপনে প্রেম চালিয়েছে কলিগের সাথে। আর তাকেই বিয়ে করার ঘোষণা দিয়ে আমিনার সম্মানে আঘাত করেছে। একবারও ভাবেনি, আমিনার কেমন অনুভূতি হবে। আজকে আমিনার সমস্যা বলে রাজু চট করে দ্বিতীয় বিয়ের কথা তুলে ফেলতে পারল। অফিসের সুন্দরী কলিগের সাথে প্রেম জমাতে পারল। যদি সমস্যাটা তার হতো, আমিনা কি আবার বিয়ের কথা ভাবত? নাকি চাকুরির নাম করে পুরুষ কলিগের সাথে প্রেম করে বেড়াত?
মুলত খালার সমর্থন পেয়েই আমিনা নতুন জীবন শুরু করেছে। সংসারে যেন অকেজো হয়ে পড়ে না থাকে, সেজন্য প্রথম থেকেই টিউশনি করেছে। খালার সাথে বিভিন্ন এনজিওর ইভেন্টে ভলান্টিয়ারি কাজ করেছে। সেখান থেকেই পরিচয় হলো লিটল স্টার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার সাথে। খালার সাথে তার ভালো সম্পর্ক বিধায় একবার অনুরোধ করতেই স্কুলের চাকুরিটা হয়ে গেছে।
আমিনার পালিয়ে যাওয়াটা পরিবারের সবার উপর এত বেশি প্রভাব ফেলেছে, বাবা-মা দুজনই বিয়ে বিয়ে করে আমিরার মাথা খেয়ে ফেলেছে। তাদের ধারণা আমিনার মতো সেও বুঝি পালিয়ে যাবে। পরিবারের মুখে চুনকালি দেবে। অথচ আমিরা আজ অবধি চোখ তুলে কোনো ছেলের দিকে তাকায়নি। সে ওরকম সুন্দরীও না বড় আপার মতো। তাই ছেলেরাও ওকে খুব একটা পাত্তা দেবার কথা ভাবেনি কখনো। তবে হ্যাঁ, একটা ছেলে ছিল। এই এলাকায়ই বাসা ছিল। ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করত। তাই হলে থাকত। মাঝেমধ্যে বাসায় আসত। আমিরাদের বাড়ির ঠিক বিপরীত দিকের বাড়ির দোতলায় ভাড়া এসেছিল। আমিরাদের বাসা ছিল তখন নিচতলায়। বাসার সামনে বড় চওড়া আকারের বারান্দা। এর সাথেই বাইরে বের হবার গেট। খুবই ছোট বাসা। দুই রুমের। একটায় বাবা-মা। অন্যটায় তিন বোন। তাই বারান্দার একপাশে পর্দা টাঙ্গিয়ে বসার ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অবসর সময়ে আমিরা বসার ঘরে বসে গান শুনত। কখনোবা টিভি দেখত। ওই ছেলেটা দোতলার বারান্দা থেকে ওকে লক্ষ করত প্রায়ই। একদিন আচানক চোখে চোখ পড়ল। ছেলেটা ইশারা করল হাত নাড়িয়ে। রাস্তাঘাটে দেখা হলে মুখ চেপে হাসত। কথা বলার চেষ্টাও করেছিল। আমিরা সুযোগ দেয়নি। আমিনার বিয়ের পর এমনিতেই ওকে খুব চোখে চোখে রাখা হতো তখন। মা নিজেই ওকে আর আনিসাকে স্কুলে আনানেয়া করত। কয়েক মাস পর ছেলের পরিবার বাসা পালটে চলে গেল।
আমিরার প্রায়ই মনে হয় ছেলেটার কথা। কিন্তু মাথার ভেতর ভাবনাটাকে গেড়ে বসতে দেয় না। বোনের ঘটনা তার জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে। বাবার পঙ্গু হওয়া, পরিবারের এই বিপর্যয়, সামাজিক অবস্থান নিচে নেমে যাওয়া ইত্যাদি এক এক করে তাকে বুঝতে শিখিয়েছে, প্রেম করাটা তার জন্য অসম্ভব জিনিস। জীবনে সবকিছুকে দু-হাত ভরে আগলে নিলেও প্রেমকে সবসময় পায়ে ঠেলতে হবে। নয়তো জীবনযুদ্ধে মুখ থুবড়ে পড়াটা অবশ্যম্ভাবী। বোনের ফিরে আসাটা এই প্রত্যয়কে আরও দৃঢ় করে তুলেছে।
আমিরা মাকে অনেক বুঝিয়েছে, এখন সে বিয়ে করবে না। তার ইচ্ছে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। মা অতশত বুঝতে চায় না। মেয়েরা যেন দিনকে দিন তার মাথার উপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমিরার ইউনিভার্সিটিতে পড়ার শখ শুনে এমনভাবে তাকিয়েছিল, যেন নিষিদ্ধ জগতে পা বাড়াতে চাচ্ছে মেয়ে। এরপর যথারীতি খালার কানে চলে গেল খবর। খালা এক বিকেলে গাড়ি বয়ে এলেন বাসায়। আমিরাকে কাছে ডেকে, মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝালেন, এই মুহূর্তে বিয়ে করাটা কতখানি জরুরি। আমিনার জীবনে এত বড় বিপর্যয় ঘটে যাবার পর আমিরাকেই শক্ত হাতে পরিবার সামাল দিতে হবে। সেজন্য মাথার উপর একটা ছায়া দরকার। যে ছায়া কি না পরিবারে বড় ছেলের দায়িত্ব পালন করবে। রাজুর সাথে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক ভালো থাকলেও সে কখনো দায়িত্ব নেবার দরকার মনে করেনি। সেরকম আগ্রহও দেখায়নি। তিনি এখন বোনের সংসার দেখভাল করছেন। তাই বলে আজীবন করবেন, বিষয়টা তেমন না। তাই আমিরাকে ভালো কোনো ছেলের সাথে সোর্পদ করতে চান, যে কি না স্ত্রীর পরিবারেও অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
আমিরা এরপর কথা বাড়ায়নি। বাবাও চায়, তার বিয়ে হোক। বাবা-মায়ের প্রবল আকুতি আর খালার এই বক্তব্যের পর তার আদতেই কিছু বলার থাকে না। থাকলেও তা বলা বারণ। বলতে গেলেই আমিনার উপর আঙুল উঠানো হবে। আমিরা খুব ভালোবাসে বোনকে। তাই তার মনে কোনোরকম কষ্ট দিতে চায় না। তার কষ্টের কারণও হতে চায় না।
সেই থেকে শুরু। খালা একের পর এক পাত্র নিয়ে আসেন। সেজেগুজে তাকে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে হয়। দেখাদেখি হয়। কথাবার্তা চলে। পাত্রপক্ষ আসবে তাই বিশাল আয়োজন করা হয়। তারা খেয়েদেয়ে বিদেয় হয়। এরপর আর কোনো কথা বলে না। আজকাল সবাই আশা করে, অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়েকে বিয়ে করবে যাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক বাবদ কিছু মিলে। আমিরার পরিবার সেরকম না। উলটো আমিরাকে বিয়ে করলে তাদেরই প্রতি মাসে শ্বশুরবাড়িতে কিছু না কিছু দিতে হবে। অনেকের তা দিতেও আপত্তি নেই, যদি বিয়ের সময় বিশাল যৌতুক মিলে। বড় খালা চাইলে এই যৌতুক দেয়াটা তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু তিনি যৌতুকের ঘোর বিরোধী। তার একটাই কথা, বিয়ের সময় মেয়েকে যথাসাধ্য সাজিয়ে-গুছিয়ে দেবেন। দরকার পড়লে কিছু আসবাবপত্র পাঠানো হবে। তাই বলে বড় সাইজের টিভি, সোফাসেট, ফ্রিজ, মোটরবাইক বা গাড়ি দেয়া সম্ভব না। একবার শ্বশুরবাড়ি থেকে বিশাল যৌতুক পেয়ে গেলে পাত্রপক্ষের জিহবা সোয়া হাত লম্বা হয়ে যাবে। আরও পাবার লোভে চকচক করবে তাদের চোখ।
এইবার যে প্রস্তাবটা এসেছে, খালার ভাষ্যমতে ছেলেটা খুবই ভালো। বাবা-মা নেই। পারিবারিক কোনো পিছুটানও নেই। মামার সংসারে বড় হয়েছে। এখন চাকুরি পাবার পর পুরোপুরি একা। অতএব, আমিরার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত পাত্র আর হয় না। ছেলের সেরকম দাবিদাওয়া নেই। যৌতুক চায় না। মৌখিক বায়োডাটা শোনার পর বাবা-মা কেউ অমত করেনি। এমনিতেও খালার উপর তারা কোনো কথা বলে না। এই পরিবারের খালার কথাই চুড়ান্ত। আমিরাও কিছু বলেনি। চুপচাপ শুনেছে। অবশ্য তাকে জিজ্ঞেস করার দরকার কেউ মনে করেনি। দেখা যাক, শফিক আসলে কীরকম হয়।
আচ্ছা, সত্যিই কি কলিংবেলটা শফিক বাজাল? রাস্তায় দাঁড়ানো ওই ছেলেটাই কি শফিক? এক পলকের দেখা। তবু আমিরার মনের মধ্যে ঘুটঘুট করছে। হয়তো শফিকই। তা না হলে এভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে তো তাকাত না। আর সে জানলই বা কী করে, ওই জানালায় তার হবু বউ দাঁড়ানো? বাড়ির দিকে তাকায়নি। দোতলার দিকেও না। একদম সরাসরি জানালার দিকে চোখ পড়েছিল তার। ওই নজরটুকুই মুহূর্তের মধ্যে আমিরার ভেতরটা তোলপাড় করে তুলেছে।
=====
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৪।
শফিক খুব ছা-পোষা ধরনের ছেলে। পড়াশুনা শেষ করেছে প্রায় বছর পাঁচেক আগে। এরপর বেকার ছিল। চাকুরির আশায় এদিক-সেদিক ছুটেছে। ভাগ্য সহায় হয়নি। অনেক চেষ্টা আর তদবিরের পর বছরখানেক আগে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকুরি হয়েছে। পোস্ট খুব বড় কিছু না। বেতনও অল্প। তবু চলে যাচ্ছে আপাতত। একদম নাই মামার চেয়ে কানা মামাও তো ভালো!
চাকুরিতে যোগদানের পর থেকে শফিক নজরে পড়ে গেছে এমডি সাহেবের। এক ঝলক পর্যবেক্ষণ করেই তিনি বুঝে গেছেন, লেগে থাকলে অনেকদূর যাবে এই ছেলে। এই এক বছরে তাকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন। অন্য কেউ হলে হয়তো অধীনস্থ কাউকে কাজ শেখানোর দায়িত্ব দিতেন। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের দিন থেকে শফিকের প্রতি যে মুগ্ধতা কাজ করছে, তা অন্য কেউ বুঝে উঠবে না। অসম্ভব মেধাবী এই ছেলে। ইন্টারভিউতে অন্যসব প্রার্থীদের মতো তাকেও কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। সবাই বই থেকে মুখস্ত করা গৎবাঁধা উত্তর দিলেও শফিক ব্যতিক্রম ভঙ্গিতে উত্তর দিয়েছে। সরাসরি থিউরি না বলে প্র্যাকটিক্যালি বুঝিয়েছে উত্তর। তাও সাবলীল ভঙ্গিতে। অবশ্যই তা চমক ছিল। ইন্টারভিউতে এসে প্রার্থীরা ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। কিন্তু শফিককে দেখে বুঝার উপায় হয়নি সে এই অফিসে নতুন। সম্ভবত চার বছর ধরে একের পর এক ইন্টারভিউ দিতে দিতে এই লাইনে সে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হয়ে গেছে। ইন্টারভিউ দেয়াটা তার জন্য প্রতিদিনকার ডালভাত। এমডির ইচ্ছে, এই ছেলেকে নিজ হাতে গড়েপিঠে তুলবেন। হয়তো সেই ইচ্ছেটুকু আরও বলবৎ করতেই ভাগ্নির জামাই করতে আগ্রহী হয়েছেন। শফিকও বুঝে গেছে বড় স্যার তাকে খুব স্নেহ করে। অন্য সবার থেকে বেশি মনোযোগ তার দিকে দেয়। বাবা-মা হীন জীবনে স্নেহ খুব বেশি পাওয়া হয়নি তার। মামার কাছে বড় হয়েছে ঠিকই। মামা পড়াশুনা শিখিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। অতটুকুই, এর বাইরে কিছু আশা করা যায়নি। মামি দায়সারা ভঙ্গিতে যতটুকু করার, করেছেন। একারণে মাথার উপর একটা শক্ত ছায়ার বড়ই অভাব ছিল। চাকুরিতে যোগদানের পর সেই ছায়া খুঁজে পেয়েছে সে। গত এক বছরে বড় স্যারের সাথে তার সম্পর্কটা চাকুরিজীবনে বাইরে পা দিয়েছে। প্রায়ই ব্যক্তিগত বিষয়ে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করেন তিনি। শফিকের বৃত্তান্ত অনেকটাই জেনে নিয়েছেন। অতি অবশ্যই এই বিষয়টা অফিসের অন্যসব কর্মচারীরা ভালো চোখে দেখে না। তারা শফিকের পেছনে লেগেই থাকে কোনো না কোনো কারণে। প্রায়ই তার নামে অভিযোগ আসে। এমডি ঘাগু মানুষ। হিংসা তার চোখ এড়ায় না। এজন্য অভিযোগগুলো কখনো সেভাবে পাত্তা পায় না। আবার একেবারে হেসেও উড়িয়ে দেন না তিনি। দুইয়ের মধ্যিখানে সমতা বজায় রাখেন। শফিককে যেমন ছাড় দেন না, আবার অন্যদের অভিযোগও সিরিয়াসলি কানে তোলেন না।
চাকুরি পাবার পর থেকেই ঘাড় থেকে বোঝা নামাতে মামা-মামি হন্যে হয়ে উঠেছেন। পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন এবারে আলাদা বাসা করে থাকা হোক। মামার ঘাড়ে বসে আর কত? শফিক যদিও চাকুরির প্রথম বেতন পেয়েই মামির হাতে তুলে দিয়েছিল। মামা-মামি আর মামাত ভাইবোনদের জন্য শপিং করে এনেছিল। মামার পরিবারকে সে নিজের মনে করে। মামা-মামিও সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। প্রতি মাসে নিজের জন্য অল্প কিছু হাতখরচ রেখে বেতনের বাকিটা মামির হাতে তুলে দিয়েছে শফিক। চাকুরি পাবার পর মামির কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে অনেক। এখন রীতিমতো জামাই আদর চলে। কিন্তু এই আদর তা বেশিদিন কপালে সয়নি। এর কারণ মামাত বোন, জয়া। কলেজে পড়ছে। উঠতি বয়সে চট করেই সে প্রেমে পড়ে গেছে শফিকের। এই ভালো লাগা বহুদিন সে নিজের মধ্যে পুষে রেখেছিল। একদিকে শফিকের চালচুলো নেই, বাবা-মা হীন এতিম ছেলে মামার সংসারে অনাদরে বেড়ে উঠেছে। অন্যদিকে বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা। মেয়ে দেখতে সুন্দরী। পড়াশুনায় খুব একটা ভালো না। কিন্তু টাকাপয়সা খরচ করে তাকে প্রাইভেট পড়িয়ে, কোচিং করিয়ে এই অবধি টেনে নিয়ে আসা হয়েছে। গুণের মধ্যে একটাই, গান। খুব ভালো গাইতে পারে। মামির ইচ্ছে, তার মেয়ে একদিন গানের জগতে খুব নাম করবে। সেজন্য ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনার পাশাপাশি জয়াকে গানের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। গানের স্কুলে ভর্তি করেছেন। জয়া এখন মোটামুটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পরিচিতমহলে। প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গায়। মামিই আগ্রহ করে নামিদামি অনুষ্ঠানগুলোতে মেয়ের অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে মদদ দেন। যাতে ভালো কোনো মিউজিক ডিরেক্টরের নজরে পড়ে। জয়ার কপালই খুলে যাবে!
কিন্তু এই মেয়ে বেকুবের মতো প্রেমে পড়েছে। তাও কার প্রেমে? শফিকের। যার কি না পায়ের তলায় মাটি নেই। আর মাথার উপর খোলা আকাশ। ছন্নছাড়া এই ছেলেকে এতকাল দয়া করে লালনপালন করেছেন। তাই বলে মেয়ের জামাই হিসেবে মানা যায় না। মুলত জয়ার প্রেমে পড়ার বিষয়টা নজরে আসার পরই মামি উঠেপড়ে লেগেছিলেন শফিককে বিদায় করতে। গত মাসে বেতন পেয়েই মামির হাতে তুলে দিতে গেল সে। মামি টাকাটা নিল না। বলল,
– জমিয়ে রাখ। সব টাকা আমার হাতে তুলে দিলে তোর থাকল কী?
শফিক হেসে বলল,
– তোমরাই আমার সবকিছু, মামি। আমার তো আলাদা করে কিছু দরকার নেই!
মামি মুখ বেঁকাল। শফিকের দুরভিসন্ধি তিনি টের পেয়ে গেছেন। সামান্য ক’টা টাকা হাতে তুলে দিয়েই এই ধুরন্ধর ছেলে তার মেয়েকে বাগানোর পায়তারা করছে! সেই রাতেই স্বামীর কান ভার করলেন তিনি। এরপর কলকাঠি যা নাড়ার, মামাই নেড়েছেন। ফলশ্রুতিতে এই মাসের এক তারিখে শফিক মামার বাসা ছেঁড়ে এসেছে। সহকর্মী মোক্তারের বাসায় এক রুম সাবলেটে ভাড়া নিয়েছে। বাসাটা মুলত ব্যাচেলরদের। তিনটা রুমে মোট ছয়জন কর্মজীবি ছেলে। শফিকের সাথে আরও একটা ছেলে আছে রুমে। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। সবকিছু ঠিক থাকলেও শফিকের খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে খুব। একটা ছুটা বুয়া আছে। দিনে দুইবার এসে রান্নাবান্না ঝাড়মোছ সবটা করে দিয়ে যায়। কিন্তু তার রান্না মুখে তোলার যোগ্য না। বাসার অন্যরা এই রান্না খেয়ে অভ্যস্ত হলেও শফিক পারছে না। মামির হাতের সুস্বাদু রান্না খেয়ে অভ্যেস। সহজে তা থেকে দূরে সরে আসতে পারবে না। থিতু হতে পারবে না বুয়ার রান্না করা খাবারে। একারণে প্রায়ই বাইরে থেকে খেয়ে আসে। কখনো খাবার কিনে আনে। তবু ঘরের খাবারের জন্য মন পোড়ে। বাইরের খাবার খেয়েও পেট খারাপ হচ্ছে প্রায়ই। একদিন বড় স্যার কথাপ্রসঙ্গে এই কাহিনি জানার পর হাসতে হাসতে বললেন,
– বিয়ে করে ফেল, শফিক। বউ তোমাকে রান্না করে খাওয়াবে।
শফিক তখনো বিষয়টা সিরিয়াসলি নেয়নি। বিয়ের বয়স হয়েছে তার। কিন্তু ওরকম করে ভাবা হয়নি। এই জীবনে কখনো কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। জয়া মাঝেমধ্যে খুব কাছাকাছি চলে আসত। যদিও জয়ার প্রতি তার মনে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেনি। ওকে বোনের দৃষ্টিতে দেখত। আবার এও টের পেত, জয়া ওকে ভাইয়ের বৃষ্টিতে দেখে না। জয়া অনেকবার কিছু বলার চেষ্টা করেছে। বলার সুযোগ হয়নি অথবা শফিক নিজের অজান্তেই এই সুযোগটা দেয়নি। তার ভয় হতো খুব। কেউ না বললেও আপনাতেই সে বুঝতে পেরেছে, মামা-মামি কখনোই এই সম্পর্কটা মেনে নিবেন না। আর জয়া তাদের একমাত্র মেয়ে। তাই কখনো তেমন পরিস্থিতি তৈরি হতেই দেয়নি।
মামার বাসা থেকে বের হয়ে আসার পর কয়েকবার মনে হয়েছে, জয়ার সাথে প্রেম হলে বেশ জমত। মামা-মামি না মানলে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলত। তারপর আলাদা সংসার পাতত। সেই সংসারে প্রতিদিন রান্না করত জয়া। শুধুই শফিকের জন্য। এই মনে হওয়াটা ক্ষণিকের। পরমুহূর্তে মন সতর্ক করেছে, এগুলো কেবল রূপকথা। ঘরকন্না করার মতো মেয়ে নয় জয়া। মামি ওকে ওভাবে বড় করেননি। রান্নার কাজ শেখার চেয়ে, ভালো গৃহিনী হবার চেয়ে গান আর পড়াশুনার প্রতি জোর দিয়েছেন। মেয়েকে শিখিয়েছেন, বড় হয়ে ক্যারিয়ার গড়তে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজে আয় করতে হবে। নিজের একটা আইডেন্টিটি যেন থাকে। এরকম মেয়ের আসলে শফিকের মতো ছাপোষা কারও সাথে মানায় না। তাই মনকে সে সামলে রেখেছে। জয়ার পাগলামিগুলোকে পাত্তা দেয়নি বিশেষ।
======