তোমার জন্য এক পৃথিবী পর্ব-৫+৬

0
292

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৫।
অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, বড় স্যার শুধু বলা পর্যন্তই ক্ষান্ত থাকলেন না। পাত্রীও জোগাড় করে ফেললেন। তার স্ত্রীর আপন বোনের মেজ মেয়ে। শফিককে অফিস রুমে ডেকে আমিরার সম্পর্কে বিভিন্ন কথাবার্তা বললেন। কেমন মেয়ে, কী ধরনের পরিবার, কতদূর পড়াশুনা করেছে ইত্যাদি। শফিক প্রথমে কিছুটা সময় ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল,
– কী বলছেন স্যার!
– কী বলছি, তুমি শোনোনি?
– হ্যাঁ মানে শুনেছি। কিন্তু…
– তোমার কোনো আপত্তি থাকলে আমি এগোব না। দেখো শফিক। আমি তোমাকে নিজের ছেলের মতোই মনে করি। তাই নিজের ফ্যামিলিতেই তোমাকে রাখতে চেয়েছিলাম। তবে তোমার যদি অন্য কোথাও পছন্দ থাকে…
– মানে স্যার, আমার অন্য কোথাও পছন্দ নেই।
– তাহলে তুমি আমার ভাগ্নিকে বিয়ে করতে রাজি?
– ইয়ে মানে স্যার, আপনি কি সিরিয়াস?
এমডি স্যার হাসিমুখে কথা বলছিলেন। মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন,
– তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ফান করছি?
– স্যার প্লিজ মাইন্ড করবেন না। আমি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছি না আপনি আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছেন। আসলে এই ভাবনাটা তো আমার ফ্যামিলির করার কথা ছিল। কিন্তু ফ্যামিলি নেই। মাথার উপর সেরকম কোনো গার্ডিয়ানও নেই। মামা ছিলেন, কিন্তু…
এই পর্যায়ে এমডি স্যার উঠে এসে দাঁড়ালেন শফিকের পাশে। কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললেন,
– কী বললাম একটু আগে? আমি তোমাকে ছেলের মতোই দেখি।
– এটা আমার সৌভাগ্য, স্যার।
– এটা তুমি অ্যাচিভ করে নিয়েছ। আমি এই কোম্পানিটা চালাচ্ছি অনেকগুলো বছর। আমার আরও বিজনেস আছে। আমার আন্ডারে অনেক মানুষ কাজ করে। অনেককেই দেখেছি। তাদের মধ্যে তুমি এক্সেপশনাল। তোমার মধ্যে যে প্রতিভা আছে, যে সততা আর পরিশ্রম করার ইচ্ছে আছে, আমি মনে করি প্রপার গাইড পেলে তুমি কর্পোরেট লাইফে অনেক দূর যেতে পারবে।
শফিকের চোখজোড়া চকচক করে উঠল। এই চকচকানি কি অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে সমাজের প্রতিষ্ঠিত স্থানে দেখার আশায় নাকি এমডি স্যারের মতো একজন প্রভাবশালী মানুষের ছায়া ওর উপর পড়েছে বলে, চট করে বুঝা গেল না। হয়তো সে কাঁদছে, হয়তো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। সাথে এও বুঝল, এই স্বপ্ন সত্যি করতে হলে এমডি স্যারের সব কথায় ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। তার ভাগ্নিকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু জয়া? নাহ, জয়ার কথা মাথায় আসবে কেন? সে তো জয়াকে ভালোবাসে না। কখনো আলাদা চোখে দেখেওনি। তবে জয়ার দুর্বলতা আছে ওর প্রতি। সেই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিতে মন চায় খুব। বাস্তবতার কঠিন করাঘাত জীবনকে কোথা থেকে কোথায় ছিটকে ফেলে দিবে, এই ভয়ে সামনে পা বাড়ায় না। তাছাড়া, মামার সাথে চিরতরে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না সে। হাজার হলেও মামা ছোটবেলা থেকে ওকে পেলেপুষে বড় করেছেন। মামির অবদানও কম বলা চলে না। তাই তাদের মনে কষ্ট দেয়া চলবে না কোনো অবস্থাতেই। এর চেয়ে এমডি স্যারের ভাগ্নিকে বিয়ে করলেই ভালো হবে। কেমন দেখতে মেয়েটা? সুন্দরী? স্মার্ট? অফিসের মহিলা কলিগদের মতো?
না বোধহয়, স্যার তো বললেন অসহায় পরিবার। তিনটা মেয়ে পঙ্গু বাবার কাঁধে চড়ে বসে আছে। এদেরকে সহিসালামতে পার করার দায়িত্ব এসে পড়েছে স্যারের স্ত্রীর উপর। তাছাড়া এই পরিবারে একজন শক্ত সামর্থ পুরুষ দরকার, সেটা হতে হবে এই তিন মেয়েদের কারও স্বামী। বড় স্যারের হিসেব-নিকেশ খুব পরিস্কার আর পরিপাটি। শফিকের যেহেতু নিজের পরিবার বলতে কিছু নেই, তাই তিনি চাচ্ছেন ভাগ্নির বিয়ে দিতে।
স্বভাবতই শফিকের আপত্তি করার প্রশ্ন থাকে না। সে রাজি হয়ে গেছে। এরপর কথাবার্তা এগিয়েছে দুই পক্ষে। শফিকের দিকের সমস্ত মতামত বড় স্যারই নিচ্ছেন। শফিক তাকে বিনয়ের সুরে বলেছে,
– স্যার, আপনিই আমার ফ্যামিলি। আপনি যা ভালো বুঝেন, তাই হবে।
সেই জের ধরে আজ পাত্রী দেখতে যাবার কথা। আসলে ‘পাত্রী দেখা’ টার্মটা একটু ভারিক্কি ধরনের হয়ে যায়। খুব বেশি ফরমাল। তার চেয়ে বলা ভালো, স্যারের ভাগ্নিকে সামনাসামনি দেখা, তার সাথে কথা বলা। আর যেই পরিবারকে আপন করে নিতে হবে, তাদের সাথেও পরিচিত হওয়া। স্যার খুবই উদার মনের মানুষ। অযথা জোরজবরদস্তি পছন্দ করেন না। তিনি বলেছেন,
– শফিক, তুমি আগামী শুক্রবার আমার ভায়রার বাসায় যাও। ওদের সাথে দেখা করো। কথা বলো। আমিরার সাথে বুঝাপড়া কেমন হবে, যাচাই করে দেখো। আমি তো মনে করি, ওরা তিন বোনই যথেষ্ট লক্ষী ধরনের। যে কেউ পছন্দ করে ফেলবে। কিন্তু আমার মনে করাতেই তো সবটা হয় না। লাইফের খুব ইম্পরট্যান্ট একটা চ্যাপ্টার। সো, আমি চাইব তুমি নিজে ডিসিশন নাও। যদি আমিরাকে তোমার পছন্দ না হয়, ডোন্ট ওরি। আমি মাইন্ড করব, ওরকম কিছু ভেবো না। আমি তো বলেছি, তুমি আমার ছেলের মতো। তুমি গ্রিণ সিগন্যাল দিলে বিয়ের ডেট ফিক্স করে ফেলব নেক্সট মান্থে। না দিলে এই বিষয়ে আর কথা এগোবে না।
শফিকের চোখে পানি চলে এসেছিল কথাগুলো শুনেই। আহা, নিজের বাবা থাকলেও বুঝি এভাবেই বলতেন! মামাও চাইলে বলতে পারতেন। কিন্তু মামা গা-ঝাড়া ধরনের মানুষ। খাইয়ে-পরিয়ে এতদূর টেনে এনেছেন। এরপর আর কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি নন। তবু পাত্রী দেখতে তাকে ছাড়া যাওয়াটা মানায় না।
শফিক কল করল মামাকে। ওর ফোন পেয়ে তিনি খুবই বিরক্ত। চড়া সুরে বললেন,
– কী রে শফিক? কী খবর তোর? কী দরকারে কল দিলি?
– মামা, একটু কথা ছিল। আপনি কি ব্যস্ত?
– হ্যাঁ, অনেক কাজ পড়ে আছে। তুই কি বলবি তাড়াতাড়ি বলে ফেল।
– মামা, একটা ইম্পরট্যান্ট ব্যাপারে কথা বলতাম। আজ বিকেলে বাসায় আসি? আপনি থাকবেন?
– বাসায়? না, আমি থাকব না। আমার এক জায়গায় যাইতে হবে। ফিরব রাতে। তুই ফোনে বল।
– মামা, এইসব কথা ফোনে বলা যায় না। সামনাসামনি বলতে চাইছিলাম। আপনার রাত হোক। সমস্যা নাই। আপনি ফিরলেই আমি জাস্ট কথা বলেই চলে যাব।
– তোর মামি বাসায় থাকবে না। সে তার ভাইয়ের বাসায় যাইতেছে। তুই আরেকদিন কল দিস।
– মামা, আজই বলার দরকার ছিল। বাইরে কোথাও দেখা করি? আপনি কোথায় আছেন, বলেন। আমি আসতেছি।
– আমি দেখা করতে পারব না। তোর যা বলার, ফোনে বল। এত ভনিতা করতেছিস কেন?
অবশেষে মিনমিন করে পাত্রী দেখতে যাবার কথা বলেই ফেলল শফিক। মামা হতবাক। এই ছেলে চাকুরি পেতে না পেতেই মেয়ে দেখাদেখি শুরু করে দিয়েছে! অবশ্য এটা একদিক থেকে ভালোই। শফিক বিয়ে করে ফেললে জয়াকে নিয়ে টেনশন কম হবে। মেয়েটা আজকাল খুব জেদি হয়েছে। কখন কী করে ফেলে, তার ঠিক নেই। বললেন,
– কবে যাইতেছিস?
– এই শুক্রবার। বিকেলের দিকে।
– আচ্ছা, আমি তোর মামির সাথে কথা বলে কনফার্ম করতেছি। আমি একলা গেলে বিষয়টা কেমন দেখায়। পাত্রী দেখার ব্যাপার তোর মামি ভালো বুঝবে।
– ঠিক আছে।
এরপর দুই দিন কেটে গেছে। শফিকের মামা স্ত্রীর সাথে কথা বলে বিষয়টা কনফার্ম করেছেন। আজ মামা-মামিকে সাথে নিয়ে আমিরাকে দেখতে যাওয়া হচ্ছে। শফিক তৈরি হচ্ছিল। মামা বলেছেন, তিনি মামিকে নিয়ে সরাসরি ওর বাসায় চলে আসবেন। তারপর একসাথে তিনজন রওনা হবে।
কলিংবেল বাজতেই শফিক ঘড়ির দিকে তাকাল। সময় হয়ে গেছে। মামা-মামি বোধহয় চলে এসেছেন। তার মধ্যে দরজা খোলার তাড়া দেখা গেল না। বাসায় আরও লোকজন আছে। তারা খুলে দেবে। বরং সে তড়িঘড়ি করে তৈরি হতে লাগল। এর মধ্যে কানে বাজল মেয়েলি কন্ঠ। ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়ে শফিকের কথা জিজ্ঞেস করছে। দরজা খুলে দিয়েছে বোধহয় তারিক ভাই। উনার কন্ঠও শোনা যাচ্ছে। পরমুহূর্তে ভোজবাজির মতো ঘরের ভেতর উদয় হলো জয়া। শফিক ভুত দেখার মতো চমকে গেল। বলল,
– জয়া, তুই?
– হ্যাঁ শফিক ভাই। আম্মুর কাছে শুনলাম, তুমি নাকি আজকে মেয়ে দেখতে যাচ্ছ। আমাকে নিবা না সাথে?
শফিক তখনো ধাতস্থ হতে পারেনি। সে ধরে নিয়েছিল জয়াকে মামা-মামি জানাবেন না এই ব্যাপারে। কিন্তু দেখা গেল তার ধারণা ভুল। সে মিনমিন করে বলল,
– হ্যাঁ। তুই যেতে চাইলে যাবি।
– তুমি তো আমাকে কিছু বলো নাই!
– আরে, মামিকে তো বললাম। আমি ভাবছি, মামি তোকে সাথে নিবে।
– হু? তুমি জানো না আম্মু কীরকম? আমি তোমার আশপাশে থাকি, এইটা সে পছন্দ করে না।
– আরেহ, কী বলিস? পছন্দ করবে না কেন? ভাইয়ের আশপাশে বোন না থাকলে কি পাশের বাড়ির সিঙ্গেল মেয়ে থাকবে?
বলেই হেসে ফেলল। জয়া হাসল না। স্বাভাবিক সুরে বলল,
– রাইট। আর ভাই সিঙ্গেল হলে তো আরও বেশি ঘুরঘুর করতে হয় আশপাশে। নয়তো কে কখন ভাবি হওয়ার জন্য গলায় ঝুলে পড়ে, সেটা তো খেয়াল রাখতে হবে। যাকে-তাকে তো ভাবি বানানো সম্ভব না।
====

তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৬।
ছেলেপক্ষ চলে এসেছে। কিছুক্ষণ আগে কলিংবেল বাজল। আনিসা পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিয়েছিল তখন। সে জানাল, পাত্র চলে এসেছে। তাকে ড্রয়িংরুমে বসানো হচ্ছে। আমিরার সাজগোজ অনেক আগেই শেষ। আমিনা সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। তার নিজের একটা পাট ভাঙ্গা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। আমিরার চুলগুলো কোঁকড়ানো। সবসময় ফুলেফেঁপে থাকে। দেখতে ভালো লাগে না। মনে হয় মাথার উপর আস্ত কাকের বাসা। এই নিয়ে ছোটবেলা থেকেই ঝামেলায় আছে আমিরা। স্কুল-কলেজে এই নিয়ে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি ওকে। স্যার-ম্যাডাম থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী সবাই ওকে ‘কাউয়ার বাসা’ নামে চিনত। কারণ, ওর মাথায় চুলগুলো শুধু কোঁকড়াই না, সিল্কিও অনেক। যতই টানটান করে বাঁধা হোক না কেন, খানিকবাদে উঁচু হয়ে থাকবে। দেখতে পাখির বাসার মতো লাগে। স্কুলের ইংরেজি স্যার ডাকতেন বার্ড নেস্ট। শুনতে তবু ভালো লাগে। কিন্তু কাউয়ার বাসা কেমন শব্দ?
এই চুল নিয়ে আমিরার মাথাব্যাথা অনেক। তার মাথায় এত বেশি চুল। কপাল একদম ছোট বলা চলে। তাই সারাক্ষণ চুলে তেল দিয়ে রাখে। জবজব করে। প্রতিদিন বিকেলে তেল মেখে চুল আঁচড়ানো ওর রুটিন বলা চলে। আজ দুপুরে গোসলের সময় শ্যাম্পু করেছিল। এরপর তেল দেয়া হয়নি। পাত্রপক্ষ আসবে। এজন্য মা নিষেধ করল। চুলে তেল দেয়া থাকলে আবার আরেক ঝামেলা। এমনভাবে খুলির সাথে লেগে থাকে, ওভাবে দেখতেও ভালো লাগে না। মা বলেছিল, পারলার থেকে চুলটা বেঁধে আসতে। বড় আপা রাজি হলো না। বলল, নিজেই চুল সেট করে দিবে। তার কাছে চুল সেট করার জিনিসপত্র আছে।
শুধু চুল না, আমিরার আরও ঝামেলা আছে। তার ভ্রুঁ মোটা। দুই ভ্রুঁর মধ্যিখানে আবার লোমের ছড়াছড়ি। মানে জোড়া ভ্রুঁ। হাত-পা ভর্তি বড় বড় লোম। হাতগুলো দেখলে মনে হয় কোনো বনমানুষ। ওর নিজেরই অস্বস্তি লাগে। তাছাড়া বান্ধবীরাও এই নিয়ে অনেক হাসিতামাশা করে। একারণে আমিরা সবসময় লম্বা হাতার জামা পড়ে। আর্থিক অনটনের মধ্যে পারলারে যাবার বিলাসিতা করা সাজে না। তাই গ্রুমিং বলতে আজকাল যা বুঝায়, সেসবের ধারেকাছে যায়নি সে। আজ পাত্রী সাজাতে গিয়ে আমিনা ঘষেমেজে যতটা সম্ভব, সুন্দর সাজিয়ে দেবার ফাঁকে মাকে বলল, বিয়ে ঠিক হলে একবার পারলারে যেতে হবে। টাকা খরচ করে একবার গ্রুমিং করানো জরুরি। মা কিছু বলল না। আমিরা ফিসফিস করে বলল,
– আপা আমি বিয়ে করতে চাই না এখন। আমি পড়াশুনা করব।
কেউ ওর কথা শুনতে পেল না। অথবা আমিনা শুনলেও না শোনার ভান করল। সমাজে কিছু পরিবার আছে, যেখানে মনের কথা না শোনাই তাদের জন্য সবথেকে বড় সৌভাগ্য। বরং মনের কথা শুনতে গেলেই প্রতিটা পদে বিপদকে আলিঙ্গন করতে হয়। ওদের পরিবারটা সেরকম। আমিনা নিজের জীবনে থেকেও কম শিক্ষা পায়নি। সে জানে না, আমিরা কারও সাথে প্রেম করে কি না। কখনো সেরকম কিছু দেখেনি। কাউকে ভালো লাগে কি না, তাও জিজ্ঞেস করেনি। এই পরিবারে ওসব জিজ্ঞেস করা পাপ। আর ইতোমধ্যে যে এই পাপ করে ফেলেছে, তার কিছু জিজ্ঞেস করা সাজেও না।
আমিরা আবার বলল,
– আপা!
– হু, বল।
– আমি বিয়ে করব না।
– আচ্ছা করিস না।
চুলের ঝামেলা এখনো শেষ হয়নি। আমিনা আঁচড়ে দিচ্ছে। মাকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করতে গিয়ে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে তার। পাত্রপক্ষ আসবে বলে বাসায় সাজ-সাজ রব। উৎসবের আমেজ চারপাশে। জম্পেশ রান্নাবান্না হচ্ছে। আনিসা তার সবথেকে সুন্দর জামাটা পরেছে। বাবা গেল ঈদে বড় মেয়ের কাছ থেকে উপহার পাওয়া নতুন পাঞ্জাবি পরেছেন। মাও গোসলের পর আলমারি থেকে শাড়ি বের করে পরেছে। এতসবের মধ্যে সে আমিরাকে বলেছিল, চুলটা নিজেই আঁচড়ে নিতে। হেয়ার স্প্রে কেনা আছে বাসায়। ওটা দিয়ে মাথার সামনের দিকটা নিজে সেট করুক। কালো ক্লিপ দিয়ে আটকে নিলেই হবে। এরপর বাকিটা আমিনা ঠিক করে দিবে। কিন্তু দেখা গেল, আমিরা কিছুই করেনি। মাথার উপর আস্ত কাকের বাসা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে।
চুল আঁচড়ানোর ফাঁকেই উত্তর দিল আমিনা। আমিরা ঘুরে বসল এবার। উৎসুক দৃষ্টি মেলে বলল,
– সত্যি বলতেছ, আপা? তুমি আমাকে হেল্প করবা?
– কী হেল্প?
– এই বিয়েটা যেন না হয়, এই ব্যাপারে বাবা আর মায়ের সাথে কথা বলবা।
– তাদের সাথে কথা বলে লাভ নাই। আসল মানুষ হচ্ছে বড় খালা। উনি যা বলবে, ওটাই হবে।
– তুমি তাহলে বড় খালার সাথে কথা বলো!
– আমি?
আমিনা অবাক সুরে প্রশ্ন করল। হয়তো নিজেকেই। আমিরার সাহস নেই, খালার সামনে দাঁড়িয়ে বিয়ে না করার কথা বলবে। আমিনারও যে সাহস আছে খুব, তা না। বরং খালাকে সে সমীহ করে। তবে বাসার অন্য সদস্যদের চেয়ে তার সাথে খালার সখ্য আছে একটু-আধটু। রাজুর বাড়ি থেকে চলে আসার পর খালা ওকে প্রচন্ড মানসিক সমর্থন যুগিয়েছেন। আশপাশের মানুষদের কানকথা শোনা থেকে ওকে আগলে রেখেছেন। তিনিই সাহস দিয়েছেন নতুন জীবন শুরু করতে। নয়তো মায়ের কান্নাভেজা কন্ঠ শুনে তার আচানক মনে হয়েছিল, চলে আসাটা বোধহয় ঠিক হলো না। রাজু তো ওকে বের হয়ে যেতে বলেনি বাসা থেকে। প্রথম স্ত্রী হিসেবে যথাযথ সম্মান দিতে চেয়েছিল। আমিনা জানে, সম্মান রাজু অবশ্যই দিত। তাছাড়া, রাজুর অপরাধটা আসলে কী? দ্বিতীয় বিয়ে? ওটা তো ধর্মেই স্পষ্ট করে লেখা আছে, পুরুষের চারটা বিয়ে করা জায়েজ। মাও গুনগুন করে এই কথা বলে। প্রতিবেশিরা বাসায় আসে, ফিসফিস করে এটা-সেটা বলে। পরিচিত যারা আছে, তাদেরও সুর এক। সবার একটাই ভাষ্য, রাজু অন্যায় কিছু করেনি। সে বাচ্চার বাবা হতে চেয়েছে। এইজন্য আরেকটা বিয়ে করে এনেছে। এখানে আমিনার সমস্যা হবে কেন? সে তো বাচ্চা জন্ম দিতে অক্ষম। এই অক্ষমতার জন্য রাজুর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নেয়াটা কিছুই না।
চারপাশের এত ফিসফিসে কথা শুনে আমিনার হুট করে মনে হয়েছিল, এদের কথাই ঠিক। তার চলে আসার সিদ্ধান্তটা আসলে ভুল। ভেবেছিল, পরদিন সকালে আবার ফিরে যাবে। সদর্পে বের হয়ে এসেছিল। এখন ফিরতে হবে মাথা নিচু করে। শাশুড়ির কটু কথার বাণ আরও মাত্রা ছড়াবে। রাজুর ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গভরা হাসি ঝুলবে। শ্বশুরবাড়ির সবার চেহারায় ঘুরবে একটাই মনোভাব, ‘কী? খুব তো চ্যাত দেখাইয়া গেছিলা। এখন ফিরলা কেন? বাপ-মা তো রাখল না ঘরে। এখন কই গেল চ্যাত?’ স্পষ্ট করে বলতে গেলে, অপমানিত হতে হবে। আমিনা কী করে যেন মনে মনে প্রস্তুতও হয়ে গেছিল সেই অপমান গায়ে মেখে নিতে। সন্ধ্যার পর পর খালা আসলেন। প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে ছিলেন তিনি। আমিনার চলে আসার খবরটা ফোনে শুনেছেন। মা কেঁদেকেটে তাকে বলেছিল সব। খালা তখন একটা কথাই বললেন,
– আচ্ছা আমি আসতেছি। এরপর আমিনার সাথে কথা বলব।
সবাই ধরে নিয়েছিল, খালাও একই কথা বলবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অন্য চিত্র। খালা বাসায় পা দিয়েই আমিনার পিঠ চাপড়ে বাহবা দিলেন, ওই হারামজাদা রাজুর ঘর না করে বের হয়ে আসার জন্য। এরপর মাকে তিরস্কার করলেন, মেয়ের পাশে দাঁড়ায়নি বলে। শুধু তাই-ই না, পরিবার, পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয়-পরিচিত সবার মুখ তিনি বন্ধ করেছেন। ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষের চার বিয়ে করাটা কতখানি জায়েজ, আর কতখানি না-জায়েজ, পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলেছেন। এখানেই ক্ষান্ত হবার নন তিনি। একজন আলেমাকেও ডেকে এনে এর সত্যতা যাচাই করিয়েছেন। রাজুর অপরাধটা কী, তা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। রাজু বাবা হতে চাইলে সবার আগে তার উচিত ছিল আমিনার সাথে আলোচনা করা। দ্বিতীয় বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলা। মুসলিম শরীয়া আইনে দ্বিতীয় বিয়ে করতে স্ত্রী অনুমতি নেবার কথা বলা হয়নি। তবে স্ত্রীর সাথে আলোচনা করতে পরোক্ষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই বিষয়ে রাসূল সঃ এর হাদিসের রেফারেন্স টানা হয়েছে। যেমন, বিয়ের আগে তিনি আগের স্ত্রীকে জানাতেন। তাদের সাথে আলোচনা করতেন। স্ত্রীরা সম্মতি দিত। এরপরই তিনি বিয়ে করার উদ্দেশ্যে রওনা হতেন। শুধু তাই-ই না, তিনি প্রথম স্ত্রীর জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। সেই ঘরে তার পুত্র সন্তান ছিল না। তবু তিনি আক্ষেপ করেননি আরেকটা বিয়ের। খাদিজা রঃ মারা যাবার পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। এবং এরপর যতগুলো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, কোনোটাই তার নিজ মনোরঞ্জন বা প্রয়োজনে না। বরং সবগুলোই ছিল পরিস্থিতি সাপেক্ষে, যে কারণে তার পুর্ব স্ত্রীরাও এই নিয়ে আপত্তি করেননি।
রাজু কি এই হাদিস অনুসরণ করেছে? অবশ্যই না। সে আমিনার সাথে কোনোরকম আলোচনা করেনি। উলটো সবার অগোচরে পরকীয়া প্রেম করেছে কলিগের সাথে। এরপর কাউকে কিছু না জানিয়ে তাকে বিয়ে করেছে। বাড়ি অবধি নিয়ে এসেছে। এখানেও কি আমিনার অধিকার খর্ব হয়নি? স্ত্রীদের এক ছাদের নিচে রাখার যৌক্তিকতা কি আদৌ ইসলাম ধর্মে আছে? অবশ্যই না। স্ত্রী যদি তার সতীনদের সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে আপত্তি করে, তবে স্বামীর দায়িত্ব অতি অবশ্যই তার জন্য আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। রাজু এই দায়িত্বেরও ধারেকাছে যায়নি। উলটো আমিনাকে বাধ্য করছিল একই বাড়িতে থাকতে। এছাড়াও, ইসলাম ধর্মে নারীদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কোনো নারী যদি স্বামীর সাথে সুখী না হয়, তার প্রয়োজন যদি অপূর্ণ থাকে, তবে সে নিজ ইচ্ছেয় স্বামীকে তালাক দিতে পারবে। অতএব, আমিনা সতীনের ঘর করতে না চাইলে তাকে জোর করার কোনো বিধান নেই।
রাজুর পরিবারের সাথে এইসব নিয়ে অনেক বচসা হয়েছে। সবটাই খালা সামাল দিয়েছেন শক্ত হাতে। রাজুর পরিবারের যে অদ্ভুত বানোয়াট যুক্তি ছিল স্বপক্ষে, এক এক করে সবগুলোর মুখোশ তিনি খুলে দিয়েছেন। সেবার এলাকাবাসীও এই বচসায় শামিল হয়েছিল। সেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে মসজিদের ইমামও ছিলেন। কেউ খালার বক্তবের বিরোধিতা করতে পারেননি। উলটো সায় দিয়েছেন। চার বিয়ের নামে যে বানোয়াট নিয়ম প্রচলিত আছে সমাজে, তা আসলে পুরুষদের মনগড়া। তারা ইসলাম ধর্মকে কেবল খুটি হিসেবে ব্যবহার করে।
সবথেকে বড় কথা হচ্ছে, ইসলাম ধর্মে তখনই একাধিক বিয়ের কথা বলা হয়েছে, যখন পুরুষ তার সবগুলো স্ত্রীকে সমান অধিকার আর সমান ভরণপোষণ দিয়ে রাখতে হবে। স্ত্রী আলাদা বাসস্থান চাইলে তারও ব্যবস্থা করতে হবে। রাজুর কি আদৌ সেই যোগ্যতা আছে? সে কি পারবে আমিনাকে আলাদা বাসায় রাখতে? অথবা একসাথে দুই বউকে সমান অধিকার আর ভরণপোষণ দিতে? তার বেতনই বা কত? আগে সে প্রমাণ দেখাক, যোগ্যতা আছে কি না, এরপর বাকি কথা।
আমিনা খুব চমকিত হয়েছিল সেবার। খালার শক্ত কন্ঠ তাকে নতুন করে বাঁচতে উৎসাহিত করেছে। ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। যে কারণে ভরা মজলিশে মাথা নিচু করে সে রাজুর দুর্বলতা তুলে ধরতে পেরেছিল। রাজু তাকে শারীরিক সুখ দিতে অক্ষম। সে হয়তো বাবা হতে পারবে। তার সেরকম শারীরিক সমস্যা নেই। কিন্তু স্ত্রীকে সুখে রাখার যোগ্যতা তার নেই। তবু এই ত্যাগটুকু সে স্বীকার করে যাচ্ছিল। নিজের অক্ষমতা আর স্বামীর অক্ষমতা দুয়ে মিলে কাটাকাটি। এখন যেহেতু রাজু ত্যাগ স্বীকার করতে পারেনি। আরেকটা বিয়ে করে এনেছে, তাই সেও ডিভোর্স দিতে চায়। বাংলাদেশের মুসলিম আইনে কড়া নিয়ম আছে, প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করা যাবে না। আর রাজুর যোগ্যতা নেই স্ত্রীকে সুখে রাখার, এই দুটো কারণই যথেষ্ট ডিভোর্স দেবার।
এজন্য ওই ভঙ্গুর সময়ে খালার সাথে অনেকটাই সাবলীল হয়ে গিয়েছিল আমিনা। খালা নিজের কাজ ফেলে ওকে নিয়ে এখানে-সেখানে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। ডিভোর্সের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছেন। সেকারণে অন্য দুই ভাগ্নির সাথে তার সম্পর্ক খানিক দূরের হলেও আমিনা তার খুব কাছের মানুষ। তাকে আমিরার বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে পারার মতো মানুষ একমাত্র সে-ই।
আমিরা বলল,
– তুমি ছাড়া আর কে বলবে? তোমাকে খালা অনেক ভালো জানে। তুমি বললে অবশ্যই শুনবে।
আমিনা নিজেও অত নিশ্চিত না, যতটা দৃঢ় ভঙ্গিতে আমিরা বলছে। সে অন্যমনস্ক সুরে বলল,
– আচ্ছা কথা বলে দেখব।
– আপা, আরেকটা কথা।
– কী?
– আজ কি পাত্রের সামনে যেতেই হবে?
– কেন? গেলে কী সমস্যা?
– না মানে, যদি আমাকে ওদের পছন্দ হয়ে যায়? বড় খালা তো বলছিল, এই বিয়েটা একদম ঠিকঠাক। জাস্ট একটু দেখাদেখি হবে। পরে যদি খালা বেঁকে বসে, যদি বলে পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে, এখন আর পেছানোর উপায় নেই…
– তাহলে তুই কী করতে চাস?
– আমি জানি না।
আমিনার কী মনে হলো, সে চুলগুলো ছেঁড়ে দিল। বলল,
– এভাবেই যা। অত সেজেগুজে যাবার দরকার নাই। বিয়ে যদি হয় এখানে, শ্বশুরবাড়ির মানুষ তো দিনেরাতে সবসময়ই তোর মাথার উপর এই কাউয়ার বাসা দেখবে। তা বিয়ের আগেই দেখুক। সব দেখেশুনেই রাজি হয় কি না, সেটাও দেখার বিষয়!
আমিরা মহা খুশিতে জড়িয়ে ধরল বোনকে। প্রায় চিৎকার করে বলল,
– আপা, তুমি কী ভালো!!
==========