তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
১৫।
আমিনা অল্প টাকার মধ্যে ভালোই বাজার করে এনেছে। এতটা বুদ্ধিমত্তা ওর কাছ থেকে আশা করেননি নাসিমা বানু। বাজারের বহর দেখে রীতিমতো চমকে গেছেন। অবশ্য তিনি নিজেও যে খুব উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী, তা নয়। খানিক আগেও টেনশনে তার মাথা ছিড়ে যাবার জোগাড় হয়েছিল। আমিনা যখন বাজারে গেল, দুশ্চিন্তা একটু কমলেও রেহাই মিলেনি। এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আমিনা এক কিলো চিনিগুড়া চাল কিনেছে, এর সাথে দুটো মুরগী। দোকান থেকেই চামড়া ছিলে নিয়ে এসেছে। সালাদের জন্য শসা, টমেটো, গাজর, ধনিয়াপাতা, ইত্যাদি কেনা হয়েছে। এক ডজন ডিমও এনেছে সে। এর বাইরে বাড়তি যা এনেছে, তা হলো এলাকার এক খাবারের হোটেল থেকে গরুর মাংস ভুনা, ইলিশ ভাজা আর বোরহানী। দাম বলা চলে কমের মধ্যেই পড়েছে। মাছ প্রতি পিস বিশ টাকায় বিক্রি করে। আমিনা দরাদরি করে মোট বারো পিস নিয়ে এসেছে দেড়শ টাকায়। পরিচিত বিধায় এই দামে পাওয়া গেল। মাছগুলো আগেই কেটে মশলা মাখিয়ে রাখা ছিল। কাস্টমার এলে গরম-গরম ভেজে দেয়া হবে। আমিনা দাঁড়িয়ে থেকে সবগুলো ভেজে নিয়ে এসেছে। ও হ্যাঁ, একটা বড় কোকের বোতলও আছে বাজারের ব্যাগে। অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো বাজার কিভাবে করল আমিনা, বুঝে আসে না নাসিমার। তবে আমিনা যা কিনেছে, এলাকার ভেতর থেকেই নিয়ে এসেছে।
আমিনা ফিরতেই রান্না চড়াতে আর দেরি হলো না। ঘড়িতে আটটা বেজে গেছে। নাসিমা বানু আগেই পেয়াজ মরিচ কেটে রেখেছিলেন। আমিনা তাকে প্রথমেই সালাদ কাটার কাজে লাগিয়ে দিল। সে নিজে চাল ধুয়ে পোলাও বসিয়ে দিল চুলায়। খুবই শর্টকাট পদ্ধতি। প্রথমে তেল দিয়ে পেঁয়াজ হালকা ভেজে নিল। এরপর তাতে লবণ দিয়েই পোলাওয়ের চালটা ঢেলে দিল। মোটামুটি ভালো জ্বাল রেখে চালটা কয়েক মিনিট ভেজে এরপর পানি দিয়ে দিল অনেকখানি। কতটুকু, তার কোনো মাপজোক নেই। নাসিমা বানু সালাদ কাটার ফাঁকে মেয়ের কাজের দিকে নজর রাখছিলেন। এবার হৈ-হৈ করে উঠলেন,
– এই কী করতেছিস? এইভাবে কেউ পোলাও রান্না করে?
আমিনা শক্ত সুরে উত্তর দিল,
– ভেজাল কইরো না, মা। তোমার মতো মান্ধাতা আমলের সিস্টেমে রান্না করতে গেলে আজকে আর শফিকের খাওয়া লাগবে না আমাদের এখানে। তাড়াতাড়ি করতে হবে, যা করার। তুমি মুখ বন্ধ করে সালাদ কাটো।
নাসিমা বানু বিরক্ত হলেন। কিন্তু কথা বাড়ালেন না। আমিনা রান্নাবান্না জানে না তেমন। ওকে কখনো রান্না করতে দেখেননি। যদিও শ্বশুরবাড়িতে নাকি সে নিজেই রান্না করত। কিন্তু সেই রান্নার দৌড় কতখানি, তার জানা নেই। এখন রান্নার বারোটা বাজিয়ে না ফেললেই হয়। পোলাওটা কীভাবে চটজলদি বসিয়ে দিল, দেখেই তার শঙ্কা হচ্ছে খুব। রান্নাঘরে দুই চুলার বার্নার। আরেকটায় ডিম সিদ্ধ বসিয়ে দিল আটটা। তারা মানুষ ছয় জন। দুটো বেশি থাকুক। শফিক যদি আরেকটা খেতে চায়! আবার বড় খালারও আসার কথা আছে। সালাদ কাঁটা হবার পর মুরগী কাটতে বসলেন নাসিমা বানু। একটা মুরগী চার পিস করে কাঁটা হবে। আমিনা দেখিয়ে দিল। ততক্ষণে পোলাও হয়ে এসেছে প্রায়। আমিনা কীভাবে কী করল, কে জানে। টুক করে পোলাওটা নামিয়ে ফেলল। এরপর পাতিল বসিয়ে দিল চুলায়। এটায় সে রোস্ট রান্না করবে। নাসিমা বানু বুঝতে পারছেন না, মেয়ে আসলে কী করছে। রোস্ট রান্না করতে বিভিন্ন মশলা লাগে। ওগুলো তো বাসায় নেই। আমিনাও কিনে আনেনি।
তিনি কথা বাড়ালেন না। হাতের কাছ মোটামুটি শেষ। তাই বের হয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। সেয়ানা ছেলে আর মেয়ে ঘরের ভেতর অনেকক্ষণ ধরে বসা। ওদিকে নজর রাখতে হবে। কোন ফাঁকে দরজা লাগিয়ে দিলে সমস্যা আছে। অনেকক্ষণ তো তাদের সাড়াশব্দও নেই। আনিসা এতক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছিল। আমিরা টের পেয়ে বোধহয় চোখ রাঙ্গানি দিয়েছে। সে এখন বসার ঘরে টিভি দেখায় মগ্ন। ওরা ঘরের ভেতর কী করছে, তা তো দেখা দরকার। সত্যি বলতে, নাসিমা বানুর এখন শফিকের উপরই বিরক্তি ধরে যাচ্ছে। কপাল কুঁচকে রেখেছেন তিনি। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে মেয়েদের শোবার দিকে রওনা হয়েছিলেন। দরজা খোলাই আছে। ঠিক তখন শফিক চলে এলো বাইরে। ওর পেছনে আমিরা। শফিক বলল,
– আন্টি, আমি আসি।
নাসিমা বানু চোখ কপালে তুলে ফেললেন,
– আল্লাহ, তুমি চলে যাবা কেন? রান্না হইতেছে তো। রাতে খেয়ে যাও।
– না মানে আন্টি আমার আসলে তাড়া আছে একটু। ফিরতে হবে জলদি।
– তোমার তো তাড়া সেই কখন থেকেই শুনতেছি। এতক্ষণ ধরে আছ। আরেকটু থাকলে কী আর হবে?
নিজের অজান্তেই বোধহয় নাসিমা বানু খোঁচা দিয়ে ফেললেন পরোক্ষভাবে। শফিক তা ঠিক বুঝল। খানিক অপ্রস্তুত হয়ে গেল সে। আমিরাও চট করে মুখ ভার করে ফেলেছে। মা এভাবে কথা বলছে কেন? কী সমস্যা? অল্পসময়েই শফিকের প্রতি তার এক ধরনের অধিকারবোধ চলে এসেছে। এজন্য মায়ের কথা হজম করতে পারল না। চট করে বলল,
– বাবাই তো বলল, যেন রাতে খেয়ে যায়। উনি অনেকক্ষণ ধরেই চলে যাইতে চাচ্ছিলেন। আমিই বারবার মানা করলাম।
নাসিমা বানু কথা বাড়ালেন না। শফিক বলল,
– আমি আসলে কথা বলতে গিয়ে খুব বেশি সময় নিয়ে ফেললাম। আমি…
বসার ঘরে বসে আজগর আলী শুনতে পাচ্ছেন কথোপকথন। স্ত্রীর বেকুবপনা দেখে তিনি যারপরনাই বিরক্ত। এই মহিলা আজীবন বোকামি করেই জীবন পার করল। নিজের নাই দুই আনা বুদ্ধি। সে আবার অন্যকে গলা উচু করে কথা বলার সাহস করে কীভাবে? মাঝেমধ্যে স্ত্রীর উপর এই বিরক্তি চলে আসে আজগর আলীর। মনে হয় নাসিমাকে বিয়ে করাটা তার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল। দুই বোন, একই মায়ের পেটে জন্ম নিয়েছে। একসাথে বেড়ে উঠেছে। অথচ তাদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। আমিনার বড় খালা আজ সমাজের উঁচু স্তরে পৌঁছে গেছেন। দেখতে অত সুন্দরী না হলেও কাজেকর্মে খুব চটপটে ছিলেন। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় তার খুব জুড়ি ছিল। পড়াশুনা অত করেননি। কিন্তু তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই। এই স্মার্টনেসের জোরেই বড়লোক বাড়ির বউ হয়েছেন শাহীনা বানু। তাতেও ক্ষান্ত হননি। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে ওই বাড়ির সাথে নিজেকে সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। বাবা-মায়ের দেখভাল করেছেন। বোনের দায়িত্ব পুরোটাই নিয়েছিলেন। এগুলো তিনি স্বামীর টাকায় করলেও কাউকে কিছু বলার সুযোগ দেননি। ঘরের বাইরে ও ভেতর বিভিন্ন কাজকর্মের মাধ্যমে লোক দেখানো আয় করেছেন অল্পসল্প। ওটুকু দিয়েই মানুষের চোখ ঢাকার ব্যবস্থা করতেন। অনেক টাকাপয়সা আর প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ঘরে বসেই ক্যাটারিঙয়ের কাজ করতেন। নিজে রান্না করে বিভিন্ন জায়গায় খাবার পাঠাতেন। তার রান্নার হাতও বেশ ভালো। যাই রান্না করেন, খেতে সুস্বাদু লাগে। এর বাইরেও নিজ আগ্রহে বিভিন্ন কোর্স করেছেন রান্নাবান্নার। একসময় তার ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল। বেশ নামডাক হলো। আর এখন তো ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। সংসারের পিছুটান সেভাবে নেই। তাই এই ব্যবসা, ওই ব্যবসা, এই ইভেন্ট, সমাজসেবা এসবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। মাসে দুই-একবার বিদেশ যাওয়া হয়।
নাসিমা বানু বোনের কাছে ছিলেন। কিন্তু শিখেননি কিছুই। না রান্নার হাত ভালো, না চটপটে। রান্না করতে বসলে এক ঘন্টার জায়গায় পাঁচ ঘন্টা লাগবে। তাও যদি সুস্বাদু হতো খাবার! খুব যে খারাপ রাধেন, ব্যাপারটা সেরকম না। তাই বলে হৈ-চৈ ফেলে দেবার মতো আহামরি কিছু না। বিয়ের পর তিন মেয়ের লালনপালন করতে গিয়েই এত হাঁপিয়ে গেছেন, স্বামীর আয়ের বাইরে আর চোখ দেননি। এই মহিলার নির্বুদ্ধিতার কারণেই আজ অন্যের টাকা হাত পেতে নিতে হয়। শাহীনা বানুর অঢেল আছে। উদার মানসিকতার তিনি। ছোট বোনকে কখনোই ফেলে দেননি। একারণে চলেফিরে জীবন পার করা যাচ্ছে। যদি বোনের অঢেল না থাকত, যদি বোন দান-খয়রাতের বেলায় কিপ্টেমি করত, কীভাবে চলত পাঁচ সদস্যের এই সংসার?
মেয়েগুলোও মোটামুটি মায়ের ধাত পেয়েছে। এজন্যই চিন্তা হয় খুব। আমিনা আজকাল স্মার্টনেস শিখেছে। কিন্তু কতদিন ধরে রাখতে পারে, তাও দেখার বিষয়। মেয়েটাকে সারাজীবন তো বসিয়ে খাওয়ানো যাবে না। বিয়েশাদি দিতে হবে আবার। তখন যদি মায়ের মতো মিইয়ে যায়, কপালে ভোগান্তি বৈ আর কিছু মিলবে না। তার তো আর নাসিমা বানুর মতো বড়লোক বোন নেই। এর আগে বিয়ে হয়েছিল। সেখানেও বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে পারলে ভালো করত। আত্মসম্মান দেখিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হয়ে আসা লাগত না। জামাই কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সাথে মিশছে, সেসবের খেয়াল রাখা দরকার ছিল। তাহলে কি রাজু পরকীয়ার সুযোগ পেত? বিয়ে তো একদিনেই করে নিয়ে আসেনি সে। ঘরের বউকে হতে হয় ট্যাটনা। চোখ-কান সর্বক্ষণ টনটনে রাখতে হয়।
এইসব কথা তিনি বলতে পারেননি মেয়েকে। বাবা হয়ে সবকিছু বলা যায় না। মাকে বলতে হয়। কিন্তু নাসিমা বানুর মাথায় গোবর ভর্তি। এগুলো তিনি বুঝবেন না। বুঝলে শফিকের সাথে ছ্যানছ্যান করতেন না। নাহয় চারটা ডালভাতের কথাই বলা হয়েছিল। নাহয় একটু আয়োজনই করতে হচ্ছে কোনোমতে। সেজন্য রাগ দেখাতে হবে কেন? রাগ হবার প্রশ্নই বা আসে কী করে?
অন্য সময় হলে স্ত্রীকে একদফা কথা শুনিয়ে দিতেন আজগর আলী। আজ কিছু বললেন না। নাসিমা বানুর আর কোনো গুণ না থাকলেও মুখরা বেশ। কথা একটাও মাটিতে পড়তে দেন না। তার উপর তার বোনের টাকায় এই সংসার চলে, এই দাপটের জোরে তো কথাও বলার উপায় থাকে না। তাও মাঝেমধ্যে একটু-আধটু বলেন না পারতে। তখন তুমুলে লেগে যায়। আজ শফিকের সামনে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া বেঁধে গেলে মানইজ্জত আর থাকবে না।
তিনি শফিককে ডাকলেন,
– বাবা শফিক, তুমি এইখানে আসো তো। এত যাই যাই করতেছ কেন? এতক্ষণ বসে গল্প করছ আমিরার সাথে। আমি খুব খুশি হইছি। বিয়েটা তো একদিনের না। আমি চাই, তোমরা বিয়ের আগে নিজেদের মধ্যে জানাশোনা করে নাও। তোমার কাছে লুকানোর কিছু নাই। দুইদিন পর তুমি আমার ঘরেরই মানুষ হবা। আমার অবস্থা তো কমবেশি জানছ। পঙ্গু হয়ে পড়ে আছি। আমার জেঠাস যদি পাশে না দাঁড়াইতেন, কী করতাম এই মেয়েগুলোকে নিয়ে। কোথায় যাইতাম, ওইসব কথা চিন্তা করতে গেলে আমার ভয় লাগে। আল্লাহ সহায় ছিলেন। আর বড়াপাও ওছিলা হইছেন বলে বাঁচা গেছে। আবার আমিনার সাথে এত বড় অঘটন হইল। আমি চাই, আমিরা এমন একজনের ঘরে যাক, যেইখানে সে ভালো থাকবে। স্বামীর সাথে কোনোরকম বাদাবাদি যেন তার না হয়। হুড়মুড় করে বিয়ে তো দেয়াই যায়। এরপর যদি বাপের বাড়ি ফিরত আসে…
শফিক সোফায় এসে বসেছে। একদম আজগর আলীর পাশেই। হাত বাড়িয়ে তার হাত চেপে ধরল সে। বলল,
– আংকেল, আপনি আমিরাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। আজকে থেকে মনে করেন, ও আপনার কাছে আমার আমানত। আমি খুব তাড়াতাড়িই আসব, আমানত বুঝে নিতে। আজকে মামা-মামি আসলে হয়তো বিয়ের ডেট ফিক্স করে ফেলতাম। যেহেতু কেউ আসে নাই, আর আমিও চাইতেছি না মামা-মামিকে ছাড়া কথা বাড়াইতে। আফটার অল, তারা আমাকে পেলেপুষে বড় করছে। ফুপু তো সবসময় যোগাযোগ রাখত। কিন্তু মামা-মামিই আমাকে দেখেশুনে রাখছে এই পর্যন্ত।
– হ্যাঁ বুঝতে পারছি।
– আমি খুব শিগগিরই আসব আবার। আমিরাকেও বলছি এই কথা। ওকে আমার পছন্দ হয়েছে। ওর দিক থেকেও মনে হয় না কোনো আপত্তি আছে।
– আলহামদুলিল্লাহ। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। অনেক খুশি হইলাম বাবা। ওর বড় খালা বলেই রাখছিল বিয়ে ঠিক। তারপরেও মনের মধ্যে ঘুটঘুট করতেছিল। কানে শোনা আর চোখের দেখা দুইটা আলাদা বিষয়। তুমি এতদিন আমাদের সম্পর্কে শুনছ, আমিরার কথা জানছ। কিন্তু দেখো তো নাই!
– জি। আর আপনি বিয়ের পরের লাইফ নিয়েও ভাববেন না। আমিরার দায়িত্ব আমি নিলাম। আমাদের যদি বনিবনা না হয়, সেটা আমরা নিজেরাই সর্ট আউট করব। আপনার কাছে আমিরা অন্তত ফেরত আসবে না। এইটুকু কথা আমি দিতে পারি।
=================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
১৬।
খেতে বসে আমিনার হাতের মুন্সিয়ানা টের পাওয়া গেল। একঘন্টায় অনেকগুলো পদ তৈরি করে ফেলেছে। কোথা দিয়ে কী করল, বুঝে উঠার উপায় নেই। যে পোলাও নিয়ে নাসিমা বানুর এত বিরক্তি ছিল, সেটা মুখে দেবার পর বুঝা গেল, অমৃতের সাথে এর তুলনা হতেই পারে। চাল বসিয়ে দেবার সময়ই বোধহয় এলাচ, দারচিনি আর লবঙ্গ দিয়েছিল আমিনা। বেরেস্তা দেয়নি। কিন্তু শুরুর দিকে তেলে পেঁয়াজ ভেজেছিল হালকা করে। ওটাই পোলাওয়ের মধ্যিখানে ভেসে ভেসে আছে। পোলাও থেকে ঘিয়ের গন্ধ নাকে এসে পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি উলটে দেবার জোগাড়। শফিক খুবই প্রশংসা করল পোলাওয়ের। বারবার বলল, পোলাও তো জীবনে কমবেশি খাওয়া হয়েছে। কিন্তু এরকম অসাধারণ স্বাদের পোলাও সে কখনোই খায়নি।
নাসিমা বানু খোঁচা দেবার পর থেকেই খানিকটা চুপচাপ ছিল সে। খুব বেশি কথা বলেনি। আজগর আলীই যা বলার বলেছেন, সে হু-হা করেছে। এই বাসায় পা দিয়েই তার চোখমুখে যেরকম উচ্ছ্বল ছটা দেখা যাচ্ছিল, পরে তা অনেকটাই ম্লান ছিল। আজগর আলী বুঝতে পেরেছিলেন কি না, কে জানে। কিন্তু আমিরার মনের মধ্যে অশুভ ঘনঘটা বাজছিল। মায়ের মুখ সামলে কথা বলার অভ্যেস আজ অবধি হলো না! কেন ওভাবে বলতে গেল শফিককে? এই নিয়ে কি শেষ অব্দি বিয়ে ভাঙ্গবে? শফিক কি এখান থেকে বের হয়েই মত পালটে ফেলবে?
শফিকের কথাবার্তায় ওরকম কোনো আভাস নেই। আজগর আলীকে সে আশ্বাস দিয়েছে বেশ শক্ত করেই। কথাবার্তায় বুঝা যায়, চালচলনে খুব একটা ধার্মিক না হলেও আল্লাহ ভীরু মানুষ সে। আমিরার সঙ্গে তার আজীবন থাকা হবে কি না, তা নিয়ে তার মনে সংশয় আছে। আল্লাহ কখন কার কপালে কী লিখে রেখেছেন, তা মানুষ জানে না। জানতেও পারে না কখনো। এই বিশ্বাসটুকু তার মধ্যে খুব ভালোভাবেই বলবৎ। তাই বলে আমিরাকে বানের জলে ভাসিয়ে দেবার মানসিকতা তার নেই। একজন বাবার জন্য মেয়েকে সুখে রাখার আশ্বাসের চেয়ে এই কথাটুকুই অনেক বেশি স্বস্তির। মেয়ে সুখে না থাকলে না থাকবে। অন্তত বিয়ের কয়েক বছর পর যেন আঁতকা ফেরত না আসে। এই সমাজে ডিভোর্সী মেয়ের বিয়ে দিতে অনেক হ্যাপা। আমিনার বেলায়ই ভালো টের পাচ্ছেন। আমিনার বিয়ে নিয়ে এই মুহূর্তে অত তাড়া নেই। কিন্তু আশপাশ থেকে ফিসফাসের ছিটেফোঁটা যা পাওয়া যায়, ওটুকুতেই বুঝা যায় এই মেয়ে আরও একবার পার করতে ভালোই জল ঘোলা হবে। শাহীনা বানু ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেছেন। বড় ভাগ্নির বিয়ে তিনি নিজ দায়িত্বে ঠিক করবেন এবং যোগ্য মানুষের সাথেই। তবু বাবার মন, সহজে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চায় না।
শফিকের চুপচাপ হয়ে যাওয়াটা আরও একটা আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছিল। তবে খাওয়ার টেবিলে বসে তার স্বতঃস্ফুর্ত অনুভূতির প্রকাশ সবার মনকেই মোটামুটি হালকা করে দিল। নাসিমা বানুর চোখে অবশ্য আরও একটা বিষয় ধরা পড়ল। আমিরাকে দেখতে এসে আমিনার হাতের রান্নার প্রশংসা করাটা। সরল দৃষ্টিতে বিষয়টা কিছুই না। কিন্তু খতিয়ে দেখতে গেলে অবশ্যই দৃষ্টিকটু। এটা কি শুধু তারই মনে হচ্ছে?
খাওয়া শেষ হবার পর শফিককে আর ধরে রাখা গেলই না। আগেই চলে যাবার জন্য মরিয়া হয়েছিল সে। নাসিমা বানুর কথা শুনে মাথা হেট হয়ে যাচ্ছিল তার। খাওয়ার অজুহাতেই এতক্ষণ বসে থাকা। এরপর কি তাকে ধরে রাখা যায়? আজগর আলী আরও খানিক পীড়াপীড়ি করলেন। খাওয়ার পরই অমনি উঠতে হয় না। খানিকক্ষণ বিশ্রাম করে যাক। কিন্তু শফিকের তাড়া এবার অনেক বেশি। সে একরকম ঝট করেই চলে গেল। যাবার আগে আমিরার দিকে এক ঝলক তাকাতে ভুল করেনি। সবার অগোচরে চোখাচোখি হলো কয়েক মুহূর্তের। দুই জোড়া আকুলি-বিকুলি করে অনেক কথা বলল। সেই কথামালা মন পর্যন্ত পৌঁছুতে পারল কি না, তা অজানা।
শফিক চলে যাবার পর আমিরা এক দৌড়ে শোবার ঘরে চলে এলো। তার কান্না পাচ্ছে খুব। শফিক যেন তার প্রাণটাই ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঝট করে জানালার সামনে দাঁড়াল সে। শফিককে এক ঝলক দেখতে পাবার আশায়। শফিক কি বিকেলের মতো ওই চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় পেছনে ফিরে তাকাবে? আমিরা মনে মনে সময় গুণতে লাগল। মাত্রই দোতলা থেকে বের হয়েছে। নিচতলায় নেমে বাড়ি থেকে বের হয়ে কয়েক কদম এগোলেই ওই চায়ের দোকান। বলা চলে, বাড়িটা থেকে কোণাকুণি দূরত্বেই। আর কতক্ষণ? আমিরার মনে হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। ওর পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। টের পেয়েও সে ঘুরে তাকাল না। তার চোখ অস্থির ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে বাইরের পানে। শফিককে দেখা যাচ্ছে না কেন?
হঠাৎ দুই বাহুতে হাতের চাপ। কানের কাছে আমিনার ফিসফিসে কন্ঠ,
– চল একটা খেলা হয়ে যাক।
আমিরা ফিসফিস করে উত্তর দিল,
– কী খেলা?
– এখান দিয়ে যাবার সময় শফিক ভাই যদি পেছন ফিরে এদিকে তাকায়, তাহলে বুঝতে হবে উনি তোকে সত্যিকার ভালোবাসবে।
– তাই? আর যদি না তাকায়? যদি সোজা হেঁটে চলে যায়?
আমিরা প্রবল উত্তেজনা ও অনিশ্চিত আতঙ্কে ছটফট করে উঠল। বড় আপাটা যে কী! এভাবে টেনশন ঢুকিয়ে দিল মাথায়। এখন যদি শফিক পেছন ফিরে না তাকায়! কী হয়? কী হবে?
মুহূর্তগুলো যেন আচানক দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। আমিরার হাসফাঁস লাগতে শুরু করল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। দমবন্ধ করে রেখেছে প্রায়। ওই তো দেখা যাচ্ছে শফিককে। বাড়ি থেকে বের হয়েই মোবাইল ফোন বের করেছে পকেট থেকে। কারও সাথে কথা বলছে বোধহয়। কার সাথে? মামা-মামি? হয়তো ফিরতে রাত হচ্ছে বলে ওর বাসা থেকে কল করেছে! হয়তো মামা জানতে চাচ্ছেন কেন দেরি হচ্ছে। অথবা আমিরাকে তার কেমন লাগল? মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি না। কী কৈফিয়ত দিচ্ছে সে? আমিরার হৃদপিন্ড লাফিয়ে গলার কাছে চলে এলো। শফিক চলে যাচ্ছে! একবার তো ফিরেও তাকাল না। ফোনে কথা বলার এতই মগ্ন যে, আমিরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, এই বিষয়টা তার মাথা থেকে সরে গেছে। অবশ্য সে জানেও না এই কথা। আমিরা তো বলেনি, যাওয়ার সময় এখানে দাঁড়িয়ে দেখা হবে। খেলায় কি তাহলে হেরেই গেল? শফিক কি তবে সত্যিকার ভালোবাসবে না ওকে?
চায়ের দোকানের সামনে খুব বেশি জায়গা জুড়ে দেখা যায় না। অল্প একটু সময়। এক সেকেন্ড কি দুই সেকেন্ড। শফিক চোখের আড়াল হতেই আমিরার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমিনার কন্ঠ বাজল কানের কাছে,
– যাহ! একবার ঘুরেও তাকাইল না!
আনিসাও চলে এসেছে। বলল,
– তার মানে কি শফিক ভাই মেজপাকে ভালোবাসবে না? আমার মনে হয় কী, এই বিয়েটা না হলেই ভালো। ভালোই যদি না বাসে, তাইলে বিয়ে করার দরকারটা কী?
আমিনা ওর মাথায় চাটি মারল। বলল,
– ভালোবাসার কী বুঝিস তুই? এইটুকু পিচ্চি একটা।
– আমি পিচ্চি না। অনেক বড় হয়ে গেছি।
– হু, কত বড় হইছিস জানি তো! বেশি বুঝতে যাস না। এইসব ভালোবাসার নাম আর মুখে আনবি না। আমাদের লাইফে কখনো সত্যিকার ভালোবাসা আসবে না। আমাদের আছে কী, বল? ভালোবাসতে শুধু মনটাই লাগে না, আরও অনেক কিছু লাগে। বুঝলি?
আমিনা কথা বলতে-বলতে ঘরের অন্যপাশে যাচ্ছে। তার কন্ঠ দূরে সরে যাচ্ছে আমিরার কান থেকে। আমিরা এখনো সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার চোখ টলমল করছে নোনাপানিতে। হাপুস নয়নে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এখন যদি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সে, খুব কি ছেলেমানুষী হয়ে যাবে? হঠাৎ আনিসার চাপা ও উত্তেজিত কন্ঠ শোনা গেল,
– মেজপা, দেখো। শফিক ভাই!
আমিরা ঝট করে দুই চোখ মুছল। পরক্ষণে যা দেখল, তার চোখ বিস্মিত। শফিক চলেই গিয়েছিল ওই জায়গাটুকু পার হয়ে। তারপর আবার ফিরে এসেছে! তবে কি হুট করেই তার মনে হয়েছে, আমিরা এখানে দাঁড়িয়ে আছে তার আশায়? কানে তখনো ফোন। ওই অবস্থাতেই এক হাত নাড়ল। মুখে চওড়া হাসি। আমিরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আননন্দের কান্না। মুখে হাসি চলে এসেছে তার। সেও হাত নাড়ল। শফিক তখনই চলে গেল না। দাঁড়িয়ে রইল আরেকটু সময়। কথা বলা শেষ করেই পকেটে ফোনটা রাখল সে। তারপর দুই হাতে একটা সাইন দেখাল, যার মানে দাঁড়ায়, আমি তোমাকে ভালোবাসি!
আমিরাও ফিসফিস করে উত্তর দিল,
– ভালোবাসি!
===============================