তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২৩।
রিফায়াত আমিরাকে নিয়ে এসেছে কাজি অফিসে। আসার সময়ই ফোনে কয়েকজনের সাথে কথা বলেছিল। কী বলেছে, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে ওগুলো কিছুই আমিরা কানে ঢুকায়নি। গাড়িতে বসার পর তার এত বেশি আরাম লাগছিল! তার উপর ভরপেট। মনে হচ্ছিল ঘুমিয়েই যাবে। যদিও সারাটা পথ ঘুমোয়নি সে। ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির ভেতরটা দেখার আগ্রহে ঘুম পালিয়েছে। গাড়িতে যে এই প্রথম চড়ল, ব্যাপারটা এমন না। বেশ কয়েকবার বড় খালার গাড়িতে চড়েছে সে। খালার বাসায় কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াত থাকলেই ফিরতে ওদের রাত হয়। সমস্ত মেহমান চলে যাবার পর ওদের ফেরার পালা শুরু হয়। মাঝেমধ্যে খালা বলেন, বসার ঘরটা একটু গুছিয়ে দিতে। কাজের মেয়েরাও ক্লান্ত। সবাই মিলে হাতে-হাতে গুছিয়ে ফেললে অত কষ্ট হবে না। এছাড়াও অনুষ্ঠান শেষে যেসব খাবার বাড়তি হয়, সেগুলো গৃহকর্মী আর ওদেরকে দিয়ে দেন খালা। তখন তো গাড়ি লাগবেই। ড্রাইভার একগাদা খাবার সমেত ওদেরকে বাসার সামনে পৌঁছে দেয়। আর এমনিতে দুই-একবার উবারে চড়া হয়েছে। স্কুলের চাকুরিটা শুরু করার আগে আমিনা একটা অফিসে কাজ করত। অল্প কয়েকদিনই করেছে, বড়জোর মাসদুয়েক। তার মধ্যেই একদিন অফিস থেকে পিকনিকে গিয়েছিল। আমিনার সাথে আমিরা আর আনিসাও গিয়েছিল সেবার। সারাদিনের হৈ-হল্লা আর আনন্দ উদযাপনের পর ফেরার পথে এত ঝক্কি হয়েছিল, বাস ঢাকায় পৌছুবার পর সবার থেকে বিদায় নিয়ে আরও একবার লোকাল বাসে চড়ার কথা মাথায় ঢুকেনি। রাতও হয়ে যাচ্ছিল। তাই আমিনা উবার কল করেছিল।
এই গাড়িটা রিফায়াতের। সে নাকি নিজের টাকায় কিনেছে! আমিরা দাম জিজ্ঞেস করতে সাহস পায়নি। গাড়ি দেখেই তার চক্ষু চড়কগাছ। গাড়ির দাম সংক্রান্ত ধারণা খুব একটা নেই ওর। তবু আন্দাজ করতে পারে, কয়েক লক্ষ তো হবেই। আরও বেশি হতে পারে। গাড়ির হালহকিত দেখেই বুঝা যায় দামি। আমিরার মনে হচ্ছিল নতুন এক জগতে সে চলে এসেছে। গাড়ির ভেতর কী সুঘ্রাণ! এর মধ্যে রিফায়াতের দিকে তার খেয়াল হয়নি। রিফায়াতও গাড়ি ড্রাইভ করার সময় অন্য কারও সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল। এই কথা বলার ভঙ্গিটাও অদ্ভুত। এক কানে হেডফোন জাতীয় কিছু লাগানো আছে। ওটায় মাঝেমধ্যেই নীল আলো বিপ বিপ করছে। আর ফোনটা শুরুর দিকে আমিরা খুজেই পাচ্ছিল না। পরে দেখল এসির বাতাস যেদিক দিয়ে বের হয়, তার উপর কিছু একটার সাথে লাগানো আছে। ফোনের সাথে হেডফোনের কোনো সংযোগ নেই। এই অবস্থায় কীভাবে কথা বলা সম্ভব, তার ঘটে ঢুকে না। শুরুর দিকে তো বুঝতেই পারেনি বিষয়টা। রিফায়াত কথা বলছিল আর সে ভেবেছিল তাকে উদ্দেশ্য করে বলা। নিচু সুরে জিজ্ঞেস করল,
– কী বললেন? আমি শুনতে পাইনি।
রিফায়াত ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে চুপ থাকতে ইশারা করল। তারপর কানের হেডফোনটা দেখাল। তখন আমিরা শুধু এটাই বুঝেছে, কথাগুলো ওকে বলা হয়নি। হেডফোনের ওপাশে আরেকজন আছে। আমিরা তখনই চট করে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। খানিকবাদে তার মনে হলো, রিফায়াত কার সাথে কথা বলছে! ওর ফুপুর সাথে নয় তো? সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় চিৎকার করে বলল,
– ফোন রাখেন। এখনই রাখবেন। প্লিজ!
রিফায়াত হতভম্ব। ফোন রাখতে গিয়ে হুড়মুড় করে সে গাড়ি রাস্তার একপাশে থামিয়ে দিল। অবাক সুরে বলল,
– কী হয়েছে, আমিরা? এনি প্রবলেম?
– আপনি কাকে কল করেছেন? কার সাথে কথা বলছিলেন?
– আমার এক বন্ধু। কেন?
– না মানে আপনার ফুপুকে কল দেননি তো?
– এখনো দেইনি। তবে তুমি টেনশন করো না। ফুপুর সাথে আমি পরে কথা বলব।
– পরে কখন?
– দেখি, এখন ঠিক বলতে পারছি না। আমার মনে হয়, আগে মামিকে বললে ভালো হবে।
কী বললে ভালো হবে, ওই কথা আমিরা জিজ্ঞেস করল না আর। ফুপুকে কল না দিলেই হলো। রিফায়াতও বলল না। আমিরাকে আপাতত আশ্বস্ত হতে দেখে আবার গাড়ি চালানোয় মন দিল সে।
– আমিরা, অ্যাম স্যরি। তোমাকে আগেই বলা দরকার ছিল। কিন্তু বলিনি। আমি আসলে চান্স পাইনি। দেখলাই তো ফোনে কথা বললাম।
– হু।
– আসলে আমার প্ল্যান হচ্ছে, আমরা এখন বিয়ে করব।
আমিরা নিশ্চিন্ত মনে বসেছিল সিটে। গাড়ি পুরান ঢাকা থেকে বের হয়ে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। চারদিকে নতুন নতুন বিল্ডিং। এদিকটায় কখনো আসা হয়নি আমিরার। তাই বাইরের দিকে তাকিয়েছিল পুরোটা পথ। এর মধ্যে গাড়ি একটা বিল্ডিংয়ের সামনে থামল। নিচতলায় বড় করে লেখা, ‘কাজি অফিস’। লেখাটা দেখেছে সে। তারপরও নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকাচ্ছিল এদিক-ওদিক। বিয়ে করাটা রিফায়াতের প্ল্যান, দেখার পরও বুঝতে পারেনি। অবশ্য ফোনালাপ মন দিয়ে শুনলে আরও আগেই বুঝতে পারত।
রিফায়াতের তিন-চারজন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে কাজি অফিসের সামনে। তারা আগেই চলে এসেছে। এরপর কাজির সাথে কথাবার্তা বলেছে। কেবল পাত্র-পাত্রীরই পৌঁছুনো বাকি ছিল। এখানে পৌছুবার পর চট করে রিফায়াতের মনে হলো, আমিরাকে কিছু বলা হয়নি। ভেবেছিল, গাড়ি চালানোর ফাঁকে বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু সময়-সুযোগ মিলেনি। যদিও সবটাই আমিরার ধর্তব্যে আছে। ফোনের কথাবার্তা নিশ্চয়ই শুনেছে সে! তবু সরাসরি তো বলা উচিত একবার।
আমিরা লাফিয়ে উঠল। চোখ বড় করে বলল,
– কী?
– বিয়ে। মানে আমরা আজ এবং এক্ষনি বিয়ে করব।
– কেন?
– কেন মানে কী? আমাদের তো বিয়ের কথা ঠিক হয়েই আছে।
– হ্যাঁ। কিন্তু এখন কেন?
– এখন হলে কী সমস্যা? দুইদিন বাদে তো বিয়ে হবেই!
– আপনি কি আপনার ফুপুকে কল দিয়েছিলেন?
– না। তবে তুমি চাইলে এখনই কল দিব।
– না, না। দরকার নাই। কিন্তু আমি এখন বিয়ে করব না।
– কেন?
– এভাবে বিয়ে হয় নাকি? কাজি অফিসে বিয়ে করাটা ভালো না। কাজি অফিসে বসে বিয়ে করতে নাই। তাহলে বিয়ে টিকে না।
– এই কথা আবার কে বলল?
– আমি জানি। বড়াপা বিয়ে করেছিল কাজি অফিসে গিয়ে। ফ্যামিলি-ট্যামিলি ছাড়াই। শুধু দুলাভাই আর আপা গেছিল। ওদের বিয়ে তো টিকল না।
– শোন, কাজি অফিসে বিয়ে করার সাথে বিয়ে টেকার কোনো সম্পর্ক নাই। এটা টোটালি ডিফ্রেন্ট একটা টপিক। তোমার আপার বিয়ে টিকেনি অন্য কারণে।
– হ্যাঁ। অন্য কারণ তো ছিলই। আপার বাচ্চা হচ্ছিল না। কী জানি সমস্যা আছে, তাই বাচ্চা হবে না। কিন্তু মা বলছিল, কাজি অফিসে গিয়ে একা একা বিয়ে করছে, এইজন্য আল্লাহ গজব ফেলছেন। একা বিয়ে করলে নাকি আল্লাহর রহমত থাকে না। এজন্য বিয়ে টিকে না।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। আমরা আবার বিয়ে করব। আমাদের ফ্যামিলি সহ আরও একবার। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজেরা বিয়ে করাটা জরুরি। তুমি কি বুঝতে পারছ, এইছাড়া আর কোনো অপশন নাই আমাদের হাতে?
– নাই?
– কীভাবে থাকবে, বলো! তোমার মা আর বড় আপা যেভাবে থ্রি-সিক্সটি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেছেন, এরপর তো আমার মনে হচ্ছে না তাদের উপর ভরসা করা যায়। বাকি রইলেন তোমার বাবা। উনি পুরোপুরি আমাদের সাপোর্টে আছেন, তাও কিন্তু নিশ্চিত বলা যায় না।
– হু।
– আর তুমি বললে আজ তোমার খালা-খালু আসবেন তোমাদের বাসায়, তাদের পছন্দের ছেলেকে নিয়ে। যদি আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দেয়? যদি বলে, আজই আকদ হোক। কী করবা তুমি?
– আমি তো আজকে বাসায়ই পা দিব না। শুধু আজ না, আগামী কয়েকদিন লাপাত্তা হয়ে থাকব।
– আমিরা, একটা কথা বলি। ঢাকা শহর কিন্তু মেয়েদের জন্য সেফ না। একটা মেয়ে ফ্যামিলি ছাড়া একাকি কয়েকদিন থাকছে বাসার বাইরে, এই বিষয়টা খুব সহজে কেউ হজম করবে না। জানাজানি হলে তোমারই বিপদ। আর আজ তুমি বাসায় না ফিরলে তোমার ফ্যামিলি ডেফিনিটলি খোঁজাখুঁজি করবে। পুলিশের কাছে যাবে। পত্রিকা-খবরের কাগজে তোমার ছবি ছাপবে। বুঝতে পারছ ঘটনা?
– হু।
– আমরা যদি নিজেরাই বিয়ে করে ফেলি, তাহলে কিন্তু এখন ঝামেলা হবে না। বিয়ের খবরটা জানাজানি হলে তোমার ফ্যামিলি অ্যাকসেপ্ট করে নিবে। তোমার বড় খালাই তখন বলবেন, বিয়ে করে ফেলছে। এখন তো মেনে নেয়া ছাড়া আর কিছু করার নাই।
– আপনি শিউর?
– হ্যাঁ। তুমি নিশ্চয়ই আশা করো না তোমার বড় খালার বুদ্ধিতে তোমার মা আর বড় আপা আমাদের ডিভোর্স করিয়ে এরপর তোমার বিয়ে দিবেন ওই ছেলের সাথে! ওই ছেলেও রাজি হবে না। অলরেডি ম্যারিড একটা মেয়েকে কোনো আনম্যারিড ছেলে বিয়ে করার আগে দুইবার ভাববে।
– কিন্তু…
– কিন্তু কী?
– যদি এরকম হয়, আপনি বিয়ের পর মাইন্ড চেঞ্জ করে ফেললেন। আপনার যদি মনে হয়, আপনি ঠকে গেলেন। অথবা বিয়ে না করলেই ভালো হতো।
রিফায়াত হাসল। খানিক এগিয়ে এসে আমিরার গালে আলতো করে হাত রাখল। গাঢ় সুরে বলল,
– এরকমটা মনে হবার পেছনে কারণ কী? কেন মনে হচ্ছে আমি বিয়ের পর মাইন্ড চেঞ্জ করব?
রিফায়াত খুব কাছে এগিয়ে এসেছে। আমিরা গাড়ির সিটের সাথে সিটিয়ে গেল। বড়সড় ঢোক গিলে বলল, – মানে এরকম হতেও পারে। তাই না? আপনি কিন্তু আমাকে খুব বেশি চিনেন না।
রিফায়াতের হাসি চওড়া হলো। সে বলল,
– আমার মনে হয়, গতকাল তোমার সাথে কথা বলে আর আজ এই পর্যন্ত তোমাকে যতটা চিনলাম, সারাজীবন একসাথে থাকার জন্য যথেষ্ট। তোমার কি আমাকে নিয়ে এখনো কনফিউশন আছে?
রিফায়াতের চোখের দিকে সরাসরি তাকানো যাচ্ছে না। এমন বিপদজনক ভঙ্গিতে কেউ কাছে আসে? তাও গাড়ির ভেতর বসা অবস্থায়। বাইরে থেকে তো সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। আমিরা মাথা নিচু করে ফেলল। রীতিমতো ঘামছে সে। কপালের পাশ বেয়ে দরদর করে ঘামের সরু কণা নেমে যাচ্ছে। এখন কি মাথা নাড়তে হবে হ্যাঁ সুচক? নাকি মুখে বলতে হবে? রিফায়াতের তো আবার সরাসরি স্বীকারোক্তি ছাড়া কাজ হয় না। সবকিছু স্পষ্ট করে বলতে হয়!
আচ্ছা, এখন কি রিফায়াতকে বলে দেয়া উচিত ভুল বুঝাবুঝির বিষয়টা? এই অবধি যতটুকু জেনেছে, তাতে মনে হলো, রিফায়াত পুরান ঢাকার কোনো এক ঠিকানায় এসেছিল গতকাল। একটা মেয়েকে দেখতে, যে কি না ওর দাদাবাড়ির গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের ভাইয়ের মেয়ে, যাকে সে বড় স্যার সম্বোধন করে। এই লোকটা হচ্ছে রিফায়াতের বাবার বাল্যবন্ধু। গ্রামের স্কুলে একসাথে পড়াশুনা করেছিলেন তারা। পরবর্তীতে রিফায়াতের বাবা ঢাকায় চলে আসেন। বহু বছর পর গ্রামে গিয়ে বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছিল তার। তখনই সম্ভবত এই বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল। বন্ধু তখন প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে শাদি করেননি। তাই ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা তার কাছে সন্তানতুল্য। ভাতিজিকে তিনি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন। এই মেয়েটার নামও বোধহয় আমিরা।
রিফায়াত পুরান ঢাকায় আগে কখনো পা দেয়নি। গতকালই প্রথম এসেছিল। স্বভাবতই ঠিকানা গুলিয়ে ফেলেছে। চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে আমিরাদের বাসা কোনটা। দোকানদার দেখিয়ে দিয়েছে অন্য এক আমিরার বাসা। ভুলটা হয়েছে এখানেই। আমিরার বাবা-মা বোন এমনকি আমিরা নিজেও বুঝতে পারেনি এই ভুলটা। শফিকের না আসার মেসেজটা যদি বড় খালু আগে পড়তেন, যদি খালাকে আগেই জানাতেন, তাহলে এই ভুল বুঝাবুঝি বেশিদূর এগোত না।
আমিরার গতকাল সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছিল শফিকের উপর। বলদ আসবে না, ভালো কথা। কোনো কাজে আটকে যেতেই পারে। কিন্তু না আসার খবরটা অফিসের বড় স্যারকে দিতে হবে কেন? তার কাছে কি আমিরার বায়োডাটা নেই? সেখানে তো বড় আপার মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে স্পষ্ট করে। ওই নাম্বারে কল করলে কি মহাভারত খুব বেশি অশুদ্ধ হয়ে যেত? নাকি মাথার উপর বাজ পড়ত? এই লোকটাই যত ঝামেলা লাগিয়েছে। সরাসরি কল না করে বহু অলিগলি ঘুরিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে।
আমিরা ইতস্তত করছে। রিফায়াতকে এই ভুল ঠিকানার ব্যাপারটা বলা দরকার। কিন্তু কীভাবে বলবে, বুঝতে পারছে না। মন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক অংশ বলছে, ভুলটা বলে দেয়ার এখনই সময়। এরপর খুব বেশি দেরি হয়ে যাবে। আরেকটা অংশ বলছে, মুখ বন্ধ রাখতে। রিফায়াত একসময় সত্যিটা জানবেই। ওটা আগেভাগে বলার দরকার নেই। বরং এখন জানলেই বিপদ। সত্যিটা জানার পর রিফায়াত পালটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। বিয়ে করার জন্য যেভাবে উতলা হয়ে আছে সে, এই আকুলতা তখন থাকবে না। উল্টো অপরিচিতের মতো আচরণ করবে। ভাগ্য এখন নির্ভর করছে আমিরার মতিগতির উপর। সে কি রিফায়াতকে চিরতরে হারিয়ে ফেলতে চায়? নাকি সারাজীবনের জন্য আপন করে পেতে চায়?
===========================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২৪।
আমিরা সম্পূর্ণ ঘোরগ্রস্ত হয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। মনের ভেতর থেকে প্রচুর তাগিদ পাচ্ছে রিফায়াতকে ভুলটা ভাঙ্গিয়ে দেয়ার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যতবার সে রিফায়াতের দিকে তাকায়, যতবারই কথাগুলো বলার প্রস্তুতি নেয়, ততবারই আটকে যায়। এদিকে রিফায়াতের তাড়া লেগেছে। সে মোটামুটি জোর করেই আমিরাকে গাড়ি থেকে বের করল। তার বন্ধুরা এগিয়ে এসেছে। তারা সালাম বিনিময় করল। একেকজনের মুখে চোরা হাসি। আমিরার সামনে তারা হাসতে চাচ্ছে না, আবার হাসি লুকিয়েও রাখতে পারছে না। এর পেছনে কারণ আছে অবশ্য। রিফায়াতের সাথে তাদের বন্ধুত্ব দুদিনের না, অনেক পুরনো। এতগুলো বছরে রিফায়াত প্রেম করেছে অনেক। কারও সাথেই সম্পর্ক টিকেনি, নানা কারণে। শেষবার রিফায়াত বলেছিল,
– মেয়ে জাতটাই হইতেছে খারাপ। এদের পেটের মধ্যে কী লেভেলের ঘুলঘুলি, এরা নিজেরাও জানে না মনে হয়। এত প্যাঁচ নিয়া এরা লাইফ লিড করে কেমনে? পেট খারাপ হয় না কখনো?
বিষয়টা রিফায়াতের জন্য প্যারাদায়ক হলেও বন্ধুরা এটাকে হাসাহাসির রসদ হিসেবে নিয়েছে। রিফায়াত কানে ধরে উঠবস করেছিল দিনে-দুপুরে। বলেছিল,
– আজকের পর যদি কোনো মেয়ের সাথে আমি প্রেম করি, তো আমার নাম রিফায়াত না। প্রেম তো দূরে থাক, মেয়ে দেখলেই আমি একশ হাত দূরে থাকব।
সে-ই রিফায়াতকে আজ আরেক মেয়ের সাথে দেখা যাচ্ছে। তবে আগের সম্পর্কগুলোর চেয়ে খানিক উন্নত মনে হচ্ছে। প্রেম-টেম টপকে সরাসরি কাজি অফিসে এন্ট্রি নিতে প্রস্তুত। মেয়েটাকে দেখেও একটু অদ্ভুত লাগছে। স্কুল-কলেজে পড়ে নাকি? এই বয়সী মেয়ে কোথা থেকে জুটল রিফায়াতের সাথে?
এক বন্ধু, নাম কমল। সে রিফায়াতকে কথা বলার অজুহাতে একটু আড়ালে নিয়ে গেল। বলল,
– এই পিচ্চিরে তুই কইত্থে জুটাইছিস?
– পিচ্চি কে বলছে তোকে? কলেজে পড়ে। আর কয়েক মাস পর এইচএসসি এক্সাম দিবে।
– কলেজ মানেই তো পিচ্চি। তোর নিজের দিকে তাকায় দেখছস? নাকি তুই নিজেরে ইউনিভার্সিটির পোলা মনে করোস?
রিফায়াত মেজাজ খারাপ করা ভঙ্গিতে বলল,
– কী বলতে চাস তুই? পরিস্কার করে বল।
– এই মেয়ে আন্ডারএইজড। তুই এরে পটাইছস বিয়ে করার জন্য। পরে তো শ্বশুরবাড়ি থেকে প্যাদানি খাইবি। পুলিশ কেসও হইতে পারে।
– ওর ফ্যামিলি কোনোদিনও পুলিশের ভেজালে যাবে না। তারা বরং ওরে বিয়ে দিয়ে বাসা থেকে বিদায় করতে অস্থির হয়ে আছে।
– কেস কী?
– কেস সেরকম কিছুই না। ফ্যামিলিতে ফিন্যান্সিয়াল প্রবলেম। ওর বাবা সিক। খালার টাকায় আপাতত চলতেছে। বড় বোন ডিভোর্সড। পিঠাপিঠি টাইপের ছোট আরেকটা আছে। সো, বুঝতেই পারতেছিস আমিরা বিদায় হলে এদের শান্তি।
– তুই শিউর?
– হু।
– আর কাজি?
– তোদের কল দিছিলাম কী জন্য? ভ্যারেন্ডা ভাঁজতে? কাজির সাথে কথা বলিস নাই?
– বলছি। টাকা-পয়সাও মোটামুটি সেটেলড হয়ে গেছে।
– তাইলে আর কী সমস্যা?
– সমস্যা নাই! কিন্তু যেভাবে সেট আপ করছি, খুব একটা মজবুত না। কাজি মানুষ। দুই নাম্বারির মধ্যে থাকতে চায় না। তার উপর পুলিশের ভেজাল হলে তো…
– পুলিশ-টুলিশের ভেজাল হবে না।
দুই বন্ধুকে ফুসুর-ফাসুর করতে দেখে আরেক বন্ধু এগিয়ে এলো। রিফায়াতের কাঁধ চাপড়ে বলল,
– কী দোস্ত! লাস্ট টাইম এত প্রমিজ-টমিজ করলা। কান কাইটা নাকি কুত্তারে খাওয়াবা। মাইয়া দেখলেই একশ হাত দূরে যাইবা গা। তো এই চিজ জুটাইলা কইত্থে?
– ফুপু ঠিক করছে। অ্যারেঞ্জড।
– অ্যা? অ্যারেঞ্জড মানে?
– অ্যারেঞ্জড মানে প্রেম-টেম আমি করি নাই ওর সাথে। একদিন দেখা করতে গেছিলাম বাসায়। আজকে সেকেন্ড টাইম দেখা।
দুই বন্ধু খানিক সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। একজন বলল,
– চাপা মারিস না প্লিজ। চাপাবাজি সবাইকে দিয়ে হয় না। এইটা রপ্ত করা লাগে। ইটস অ্যান আর্ট।
– তোর কেন মনে হইল আমি চাপা মারতেছি?
– ফ্যামিলি যদি অ্যারেঞ্জ করে, তাইলে তুই কাজি অফিসে আসছিস কেন তারে নিয়া? ফ্যামিলিরেই বল কাজি বাসায় ডাইকা নিয়া যাইতে। বিষয়টা আরও সলিড হইত।
– ওর বাসায় ভেজাল লাগছে। ওর খালা আমার সাথে বিয়ে দিতে ইন্টারেস্টেড না। আর ওর ফ্যামিলি চলে খালার টাকায়…
– অহ। ভেজালের উপর ভেজাল!
– কিন্তু আমার ওরেই লাগবে। আমার মরা বাপের পছন্দের মেয়ে! যেই সময় এই মেয়ে লেংটা হয়ে ঘুরত, আমিও জাইংগা পরে দৌড়াইতাম, ওই সময় আমার বাপ আর ওর চাচা মিলে বিয়ে ঠিক করছে। আর আমার ফুপুরে তো তোরা চিনিস। দুনিয়ার ইমোশন তারেই দিছে আল্লাহ! তার ভ্যাজর-ভ্যাজর আর নিতে পারতেছি না। হয় সে মুখ বন্ধ করবে, নাইলে আমি বিয়ে করব। এস্পার-ওস্পার করেই ছাড়ব।
দুই বন্ধু শব্দ করে হেসে ফেলল। একজন বলল,
– বাল্য কালের প্রেম রাইখা তুমি বন্ধু এতকাল হুদ্দাই অন্য মাইয়ার সাথে চিপকাইছ। ভাবিজান এই খবর যদি শুনে…
– চুপ! একদম মুখ বন্ধ রাখবি।
আরেকজন অবাক সুরে বলল,
– তুই ভাবিকে তোর পাস্ট রিলেশন নিয়ে কিছু বলিস নাই?
– এইগুলা জনে-জনে বলে বেড়ানোর জিনিস না। আর ওর সাথে আমার অ্যারেঞ্জড বিয়ে হচ্ছে। প্রেম না। তাছাড়া স্পেসিফিক করে বলার মতো কিছু নাই। বিয়ের আগে দু-চারটা রিলেশন কতই থাকে। এইসব বলা মানে সারাজীবন খোঁটা দিবে বউ। অশান্তি করবে সংসারে। কে যাবে সেধে সেধে ঝামেলা ডেকে আনতে? আমি তো বিয়ের পর আরেক মেয়ের সাথে প্রেম করতে যাব না।
– হুমম। লজিক আছে তোর কথায়।
বন্ধুদের গুজুর-গুজুর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আমিরা গলা চড়িয়ে ডাকল,
– অ্যাই যে শুনেন!
রিফায়াত ঝেড়ে দৌড় দিয়ে চলে গেল ওর কাছে। এক বন্ধু কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল। তার বলা হলো না আর। সে ফিসফিস করে আরেক বন্ধুকে বলল,
– তোর কি মনে হয় এই মেয়েকে রিফায়াত বিয়ে করতেছে কেন? দেখতে তো খুব একটা জুতের লাগতেছে না। রিফায়াতের হাইট আন্দাজে এই মেয়ে ভালোই শর্ট। গায়ের রঙ কালো। চেহারাও সুবিধার না। বাঙ্গালী চেহারা না হইলে আফ্রিকান নিগ্রো বইলা চালায় দেয়া যাইত। আর মাথার উপর কাউয়ার বাসাটা দেখ! বাচ্চাকাচ্চা হইলে তাদের মাথায়ও কাউয়ার বাচ্চা জেনেটিক্যালি চলে আসবে কি না, তার গ্যারান্টি কী।
– সামথিং ইজ রঙ, দোস্ত। রিফায়াত যা বলল, তাও বিশ্বাসযোগ্য মনে হইতেছে না।
– কেন?
– ওর আব্বা ছোটবেলায় বিয়ে ঠিক করল, এটা মোটামুটি বিলিভ করা যায়। ওইটা পাস্ট টেন্স। কিন্তু এই প্রেজেন্ট টেন্সে ওর ফুপু কী দেখে এই মেয়ে পছন্দ করল? ওর মামা-মামিও অ্যাকসেপ্ট করে নিল! স্ট্রেঞ্জ না?
– ঠিক। তোর মনে আচ্ছে রিমার কথা? রিমা দেখতে উজ্জ্বল শ্যামলা ছিল। কিন্তু মেকআপ করলে ফর্সাই লাগত। চেহারাও খুব সুইট ছিল। কিন্তু রিফায়াত যেদিন ওকে বাসায় নিয়ে গেল, ওর মামি কীরকম অপমান করছিল! রিমা অনেক কান্নাকাটি করছিল এই নিয়ে। রিফায়াতও বহুদিন মামির সাথে কথা বলে নাই। বাসা থেকে বের হয়ে গেছিল। হলে থাকছে মাসুদের রুমে। পরে তো ব্রেকআপ হয়ে গেল। রিফায়াতের মামা রিমারে কী সিস্টেম করছে কে জানে, রিমা এরপর রিফায়াতের চেহারাই দেখতে চায় না। রিফায়াত তো পারলে সুইসাইড করতে যায় এমন অবস্থা। কত্তগুলা ঘুমের ওষুধ খাইছিল, মনে আছে তোর? অথচ এই মেয়েরে নিয়ে মামা-মামির কোনো অবজেকশন নাই! হাউজ দ্যাট পসিবল? এই পিচ্চি তো রিমার পায়ের কড়ে আঙ্গুলের যোগ্যও না।
রিফায়াত ডাকল ওদের,
– ওখানে দাঁড়িয়েই কি সারাদিন পার করে দিবি, ঠিক করছিস?
===========================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
২৫।
কাজি অফিসে আগে কখনো আসেনি আমিরা। খুব একটা ধারণাও নেই। শুধু জানে, কাজি বিয়ে পড়ান। কীভাবে পড়ানো হয় বিয়ে, তাও স্পষ্ট জানে না। ওরা ভেতরে এসে বসেছে কিছুক্ষণ আগে। রিফায়াত আমিরার কাছ থেকে যাবতীয় অফিশিয়াল তথ্য জেনে কাজিকে দিয়েছে। তিনি এখন রেজিস্টার খাতায় নিকাহনামা লিখছেন। একবার মুখ তুলে আমিরার বয়স জিজ্ঞেস করলেন। আমিরা মাথা নেড়ে বলল,
– আঠারো হয় নাই। নয় মাস বাকি আছে।
– তাইলে আম্মা এখনই বিয়ে করতে পাগল হইছেন কেন? নয়টা মাস পরে করলে হইত না?
রিফায়াত উত্তর দিল,
– ওর ফ্যামিলিতে অনেক ঝামেলা করতেছে। তারা অন্য জায়গায় ওর বিয়ে ঠিক করছে।
– ঠিক করছে শুধু। বিয়ে তো এখনই দিতেছে না।
– না মানে আপনি বিষয়টা বুঝতেছেন না। ওর বড় খালা আর মা মিলে বুদ্ধি করেছে, পাত্র দেখতে এসেই আকদ হবে। তারা পাত্রের সাথে ওভাবেই কথা বলেছে। ওকে জানায়নি। কিন্তু ও আড়াল থেকে শুনে ফেলছে।
কাজি আবার আমিরার দিকে তাকালেন,
– এইজন্য কি পালাইয়া আসতে হবে? বাপ-মায়ের মনে কষ্ট দিয়া কি আপনে সুখি হইতে পারবেন?
রিফায়াতের মেজাজ খারাপ হলো। তবে কাজিকে সরাসরি কিছু না বলে বন্ধুদের দিকে তাকাল সে। বন্ধুরাই এই কাজির ঠিকানা জোগাড় করেছে। ইনি নাকি আমিরার বয়সের সার্টিফিকেট ছাড়াই বিয়ে পড়াবেন, কিছু বখশিশের বিনিময়ে! বন্ধুরা অপ্রস্তুত। রিফায়াতকে তারা মোটামুটি সমীহ করে চলে। সহজে ক্ষেপায় না। কারণ রিফায়াতের কাছ থেকে প্রায়ই আর্থিক সাহায্য পায় তারা। লোন হিসেবে নিলেও আজ অবধি তা শোধ করেনি কেউ। রিফায়াতও কখনো টাকার প্রসঙ্গ তোলে না। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছে, রিফায়াত ক্ষেপে যাচ্ছে। তারা কাজির সাথে কথাবার্তা বলতে লাগল,
– আপনাকে তো আগেই পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। এরপরেও এই ধরনের প্রশ্ন করে ভাবিকে কনফিউজড করে দিচ্ছেন কেন? বাপ-মায়ের মনে কি ভাবি ইচ্ছা করে কষ্ট দিতেছে? বাপ-মা যদি মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করত, তাইলে তো তারাই আপনাকে ডাক দিয়ে আমার বন্ধুর সাথে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করত।
– বুঝছি বিষয়টা। তবু আমাকে তো ক্লিয়ার হইতে হবে। কনে নিজে কথা বলুক। আমি তো বলি নাই বিয়ে পড়ানো যাবে না। আমার দায়িত্ব হচ্ছে, বিয়ে পড়ানোর আগে ছেলে-মেয়ে দুইজনের কাছ থেকে ক্লিয়ার কনসেন্ট নেয়া।
– তাইলে জিজ্ঞেস করেন এই বিয়েতে তার কোনো আপত্তি আছে নাকি! বাপ-মায়ের মনে কষ্ট দেওয়ার কথা বলতেছেন কী জন্য?
বাকবিতন্ডা চলতে থাকার ফাঁকে আমিরার মনে প্রশ্নটা ঘুরছে। সে আসলেই দ্বিধাগ্রস্ত। বাবা-মায়ের সংসারে বরাবরই আদর-যত্মের সাথে দিন কেটেছে তার। বাবা ওদের তিন বোনকে মাথায় তুলে রাখত। কখনো কোনো আবদার ফেলত না। মাও তিন মেয়েকে চোখে হারাত। সংসার চুলোয় তুলে মেয়েদের পেছনেই তার সময় কাটত বেশি। এর স্কুল, ওর আঁকার ক্লাস, তার আবার জ্বর হয়েছে। দৌড়াও ডাক্তারের কাছে। একারণে প্রায়ই বাবা অফিস থেকে ফিরে দেখত, মা কেবলই রান্না বসিয়েছে। বাবা রাগ করত না। হাতমুখ ধুয়ে চা পান করত। মেয়েদের সাথে গল্প করত। আর ক্ষুধা সহ্য করে সময় গুনত, কখন খাবার রেডি হবে। মা চটজলদি রান্না করত। বাবা-মা অনেক ত্যাগ করেছে তিন মেয়েকে বড় করতে গিয়ে। নিজেরা অসময়ে ক্ষুধা নিবারণ করলেও মেয়েদের বেলায় খাওয়ার রুটিনে কোনো হেরফের হতো না। মা হাজার ব্যস্ততার ফাঁকে মেয়েদের ঠিক সময়ে খাইয়ে দিত।
ওই সময়টা সুখের ছিল। বাবা পঙ্গু হবার পর সুখপাখি চিরতরে বিদায় নিয়েছে ওদের বাসা থেকে। গত কয়েক বছরে খুব যে অসুখী জীবনযাপন করছে, বিষয়টা তা না। সংসারে অভাব থাকলেও মোটামুটি ভালোই আছে বলা যায়। বড় খালার আর্থিক সহায়তার কল্যাণে জীবন অনেকটাই ঝড়ঝাপটাবিহীন। তবু নিজেকে সুখী বলা যায় না। টাকার ছড়াছড়ি না থাকলেও একদমই সংকট নেই। কিন্তু বুকের মধ্যে জমা হওয়া অনুভূতিরা খচমচ করে। সমাজের চোখে নিচু হয়ে যাবার অস্বস্তি খুব খোঁচায়। বাবার পঙ্গুত্ব দেখলে খুব অসহায় লাগে। একসময় সংসারের মাথা ছিল সে। আর এখন? সংসারের এক কোণে পড়ে থাকা জড় পদার্থ ছাড়া আর কী বলা যায় বাবাকে?
বড় বোনের খামখেয়ালীপনা আচরণ যেমন তার নিজেকে ভুগিয়েছে, পরিবারের অন্যদেরও কম ভোগায়নি। আমিরার তো মনে হয়, সবথেকে বড় ভুক্তভোগী সে নিজেই। বড়াপা হোঁচট খেলেও মোটামুটি গুছিয়ে ফেলেছে নিজেকে। সে ডিভোর্সড, তার উপর বন্ধ্যা। তাই তার বিয়ে নিয়ে অত হৈ-চৈ নেই। চাকুরি করছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে। বরং আমিরার মাথার উপরই চাপ প্রবল। মায়ের ধারণা, মেয়েদের অত পড়াশুনা করতে নেই। পড়ালেখা করে শিক্ষিত হলে পাঙ্খা গজায়। তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। পরিবারের তোয়াক্কা না করে ভ্যাগাবন্ডের হাত ধরে ঘর পালায়। এজন্য তিনি সময় থাকতেই আমিরার পাঙ্খা কাটতে উদগ্রীব। বাবা মাঝেমধ্যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিলেও কেটে দেয়া দরকার। নয়তো ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে বয়ফ্রেন্ড জুটাবে। চুটিয়ে প্রেম করবে। তারপর বড় বোনের মতোই ওই ভ্যাগাবন্ডের হাত ধরে পালিয়ে যাবে।
ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আমিরা প্রেম-ভালোবাসার বিপক্ষে। তার মতে, প্রেম ভালোবাসা নির্ভর করে পারিবারিক পরিস্থিতির উপর। পরিবার যদি সচ্ছ্বল হয়, সামাজিক স্ট্যাটাস উপরের দিকে থাকে, জীবনযুদ্ধে শামিল যদি হতে না হয়, সেক্ষেত্রে প্রেম করাটা কোনো সমস্যা না। বরং সারাজীবন একসাথে পথ চলার সঙ্গীটি নিজ পছন্দের হওয়াই উচিত। তার নিজের অবস্থা একদম বিপরীত। বাবার পঙ্গুত্ব ওদেরকে এত বেশি অসহায় করে দিয়েছে যে, নিজের মেরুদন্ড নিজেকেই শক্ত করতে হবে। পায়ের তলায় মাটি নিজেরই তৈরি করে নিতে হবে। এর জন্য পড়াশুনার কোনো বিকল্প নেই। পড়াশুনা শেষ করতে পারলে এই সমাজে মাথা উঁচু করে চলার পথ হবে মসৃণ। তখন কত ছেলে পেছনে লাইন ধরবে, তা আর বলতে! প্রেম করার তখনই আসল বয়স। এই যে বড়াপা, আজ যদি সে পড়াশুনা শেষ করে তবেই রাজু ভাইয়ের সাথে প্রেম করত, দু-চার বছর প্রেম করে এরপর বিয়ের পিড়িতে বসত, তাহলে আজকের এই অবস্থায় পড়তে হতো না। বন্ধ্যা হলেও স্বামী-শ্বশুরবাড়ি তাকে মাথায় তুলে রাখত। দ্বিতীয় বিয়ের নামই মুখে আনত না। কারণ, ঘরের বউ শিক্ষিত। সে বাচ্চা দিতে না পারলেও রোজগার করে খাওয়াতে পারবে। বড়াপা এখন অবশ্য রোজগার করছে। কিন্তু তা আহামরি কিছু না। অন্তত রাজু ভাইকে দেখিয়ে দেবার মতো অবস্থান এখনো তৈরি হয়নি।
আমিরা প্রেম-বিয়ের পর্বে পা দেবার আগে এই অবস্থান তৈরি করতে ইচ্ছুক। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি তার অনুকূলে নেই। বড় বোনের ভুলের দায় আর বাবার পঙ্গুত্বের কারণে সামাজিক অবস্থান নিচে নেমে যাওয়া সবটার দায় বহন করতে হচ্ছে তাকে। ‘বিয়ে’ নামক বলি দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। গত দুই বছর ধরে আমিরার মনের উপর দিয়ে কীরকম চাপ যাচ্ছে, যদি কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারত! যদি তার অনুভূতি অন্য কেউ অনুভব করতে পারত! বাইরে থেকে সবটাই স্বাভাবিক মনে হয়। সময় তো চলছে আপন নিয়মেই। দিনও কেটে যাচ্ছে আপনতালে। আমিরার ভেতরটা কতখানি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, দিনকে দিন কী পরিমাণ আতঙ্ক তার উপর ভর করে থাকছে, তা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এক ধরনের মানসিক কষ্ট, যা আর বয়ে বেড়াতে পারছে না সে। ক্লান্তি এমনভাবে ছেকে ধরেছে, নিজেকে সময়ের গতিপথে ছেঁড়ে দিয়েছে। ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করেছে নিজেকে। ভাগ্যটাই এখন তার একমাত্র সম্বল। ভাগ্যে যদি লেখা থাকে বিয়েশাদি করে সংসার করা, তাহলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চিন্তা করে লাভ কী?
আচানক সে বলল,
– আপনার কী মনে হয়, বাবা-মা কি আসলেই সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে? আসলেই কি সন্তানের চাওয়া-পাওয়ার উপর তাদের প্রায়োরিটি থাকে? নাকি নিজের স্বার্থের জন্য সন্তানকে ইউজ করে? নিজের ভালোর জন্য, মাথা থেকে দুশ্চিন্তা নামিয়ে ফেলার জন্য সন্তানকে কি কুরবানি দেয় না?
কাজি স্তব্ধ হয়ে রইলেন কতক্ষণ। রিফায়াতের বন্ধুরাও চুপ হয়ে গেছে। রিফায়াত অবাক হয়নি। আমিরার মধ্যে এক ধরনের বিষন্নতা খেয়াল করেছে সে। মেয়েটা কথা বলে সাবলীল ভঙ্গিতে। কিন্তু সেই কথাবার্তায় মিশে থাকে সুক্ষ্ম কিছু অস্বস্তি, কিছু অপূর্ণতা, কিছু না-পাওয়া আর স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। চট করে ধরতে পারা যায় না। আমিরা গতকালই বলেছিল, বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু পরিবারের চাপে পড়ে পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসতে হয়। তার খুব শখ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। এবং সে খুব ভালো করেই জানে, এই শখ শুধুই একটা ভ্রম।
রিফায়াত আমিরার হাত চেপে ধরল। আমিরা চট করে ঘুরে তাকাল। চার চোখের দৃষ্টি স্থির রইল কিছুক্ষণ। পরমুহূর্তে কাজির গলা খাকারি শুনে মনোযোগ ঘুরল সামনের দিকে। কাজি বললেন,
– দেনমোহর কত হবে? আর উসুল?
প্রশ্নটা আমিরার দিকে তাকিয়ে করেছেন। রিফায়াতও ওর দিকে তাকাল। সবার উৎসুক দৃষ্টি আমিরার দিকে। আমিরা মিনমিন করে বলল,
– নরমালি যত হয়, ততই দেন।
– অ্যামাউন্ট বলেন আপনি। কত চান দেনমোহর?
আমিরা চুপ করে রইল। কাজি আবার বললেন,
– দেনমোহর কী, জানেন তো? স্ত্রী হিসেবে এইটা আপনার হক। বিয়ের সময় আপনার হাজব্যান্ড আপনার চাহিদা অনুসারে এই টাকা আপনার হাতে দিতে বাধ্য থাকবে।
আমিরা রিফায়াতের দিকে ঘুরে বলল,
– আপনার কাছে কত টাকা আছে?
রিফায়াত হতবিহ্বল ভঙ্গিতে বলল,
– ক্যাশ?
– হু।
পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল রিফায়াত। ক্যাশ টাকা সচরাচর থাকে না তার কাছে। সবসময় কার্ড ব্যবহার করে। কোনো কারণে ক্যাশ দরকার পড়লে এটিএম থেকে তুলে। এই মুহূর্তে একটা এক হাজার টাকার নোট, একটা পাঁচশ টাকার নোট আর দুই-তিনটা একশ টাকার নোট আছে ওয়ালেটে। আমিরা বলল,
– সব টাকা বের করেন।
রিফায়াত টাকাগুলো বের করে ওর হাতে দিল। আমিরা টাকা গুনতে লাগল। সর্বমোট আঠারোশ পঞ্চাশ টাকা আছে। টাকাগুলো আমিরা হাতের মধ্যে মুঠ করে রেখে বলল,
– এগুলোই? আর নাই?
রিফায়াত আবার ওয়ালেটে হাত দিল। এবার বের হলো কিছু খুচরো পয়সা। সেগুলো হিসেব করে বারো টাকা হলো। আমিরা এই পয়সাগুলো হাতে নিয়ে কাজির উদ্দেশ্যে বলল,
– লিখেন, আঠারোশ বাষট্টি টাকা।
কাজি হতভম্ব! আদতে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়েছে। রিফায়াত গলা নামিয়ে বলল,
– দেনমোহর এত কম টাকা হয় না, আমিরা।
– ওহ। মিনিমাম কত হওয়া লাগে?
এর উত্তর রিফায়াত জানে না। দুজনই তাকাল কাজির দিকে। কাজি বললেন,
– মিনিমাম-ম্যাক্সিমাম কিছু নাই। দেনমোহর ধার্য করা লাগে ছেলের আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে মেয়ে যত টাকায় সম্মতি দেয়।
আমিরা বলল,
– তাহলে তো ঠিকই আছে। আপনি আঠারোশ বাষট্টি টাকা লিখেন। উনার কাছে এর বেশি নাই!
কাজি বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে রিফায়াতের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট প্রশ্ন, আসলেই কি আঠারোশ বাষট্টি টাকার বেশি আর নেই? রিফায়াতের এক বন্ধুর মজা লাগছে আমিরার দেনমোহর বিষয়ক অজ্ঞতা দেখে। তাছাড়া মনের মধ্যে সন্দেহ তো আগেই গেড়ে আছে। রিফায়াত কী বুঝে এই মেয়েকে বিয়ে করছে, বন্ধু জানে না। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, কিছু একটা ঠিক নেই। তাই সে তড়িঘড়ি করে বলল,
– রিফায়াতের আব্বা-আম্মা কেউ নাই। এতিম ছেলে। মামার কাছে বড় হইছে। মামা পড়াশুনা করিয়ে শিক্ষিত বানাইছে। বুঝেনই তো ব্যাপারটা। বাপ-মা থাকলে তো দেনমোহর নিয়ে চিন্তাই করা লাগত না। যদিও আমার বন্ধু চাকরি করে। কিন্তু বেতন তো আহামরি কিছু পায় না। এই বেতন দিয়ে তার নিজেরই চলতে গিয়ে টানাটানি লাগে।
শেষের দুই লাইন আমিরাকে শুনিয়ে বলা হলো। বেতনের কথা শুনে আমিরার কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা দেখার ইচ্ছে তার। কিন্তু আমিরা নির্বিকার। উলটো রিফায়াতের প্রতিক্রিয়া হয়েছে দেখার মতো। সে এমনভাবে বন্ধুর দিকে তাকিয়েছে যেন এই রকম অদ্ভুত কথা জীবনেও শুনেনি। বন্ধু ইশারায় চুপ থাকতে বলল। আরেকজন ইশারা করে আমিরাকে দেখাল। আমিরা ওই টাকাগুলো নিজের ব্যাগে ঢুকাচ্ছে।
কাজির বোধহয় বিরক্ত লাগছে। তিনি চুপচাপ দেনমোহর সংক্রান্ত তথ্য লিখতে লাগলেন কাবিননামায়। খানিকবাদে বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। আমিরা আগে কখনো বিয়ে পড়ানো দেখেনি। কনের লাজুকতা তার মধ্যে অবশ্যই আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে লাজুকতার চেয়ে বিয়ে পড়ানো দেখার উৎসাহ তার মধ্যে বেশি কাজ করছে। কাজি রেজিস্টার খাতা এগিয়ে দেয়ার আগপর্যন্ত সে ধরতেই পারেনি, বিয়ে পড়ানো হয়ে যাচ্ছে। কাজি বললেন,
– এইখানে সাইন করেন।
আমিরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার রেজিস্টার খাতার দিকে তাকাল। পরক্ষণে রিফায়াতের দিকে। তারপর কাজিকে বলল,
– সাইন করলেই কি বিয়ে হয়ে গেল?
– জি। আপনারা সাইন করলে এরপর মোনাজাত ধরব।
আমিরার হাতে কলম। রেজিস্টার খাতার উপর যেখানে কনের স্বাক্ষর দিতে হয়, সেখানে কলমের নিব রেখে স্থির বসে আছে সে। মাথার ভেতর প্রচন্ড গতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে চিন্তাভাবনা। এই একটা স্বাক্ষরের উপর নির্ভর করছে তার পুরোটা জীবন! আরেকটু সময় নিবে কি? এত তাড়াহুড়ো না করে একটু চিন্তাভাবনা করলে ভালো হতো না?
সে ঝট করে চেয়ার ছেঁড়ে উঠল। রিফায়াতের দিকে তাকিয়ে বলল,
– আমি বিয়ে করব না।
বলেই ব্যাগ থেকে দেনমোহরের টাকা বের করল। রিফায়াতের হাতে আঠারোশ বাষট্টি টাকা গুঁজে দিয়ে দরজার দিকে এগোতে শুরু করল সে। ঘটনার আকস্মিকতায় রিফায়াত হতভম্ব। আমিরা কী করছে, বুঝতে তার খানিক সময় লাগল। তাও সহজে নড়ত না, যদি তার বন্ধু কেউ একজন আলতো ধাক্কা না দিত। বন্ধুরা ইশারায় বুঝাল, আমিরা হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবার আগেই যেন তাকে আটকানো হয়। রিফায়াতের সংবিৎ ফিরল তখন। ঝেড়ে দৌড় দিল সে। কাজি সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে ওর বন্ধুদের বললেন,
– মেয়েরে কি জোর করে ধরে আনছেন বিয়ে করাইতে? কেস কী?
==================