তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩১।
বসার ঘরে তুমুল চিৎকার-চেঁচামেচি হচ্ছে। এই চেঁচামেচিটা রিফায়াতের মামি একাই করছেন। কারণ আর কারও গলার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে না। এমনকি রিফায়াতেরও না। খানিক আগে বুয়া ডেকে নিয়েছে রিফায়াতকে। আমিরাও সঙ্গে যাবার পায়তারা করছিল। মামি যেহেতু রিফায়াতের পছন্দ মেনে নিয়েছেন, আর তো ভয় নেই। কিন্তু রিফায়াত কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে। সে বলল,
– তোমার যাবার দরকার নাই। তুমি এখানে থাকো। আমি না ডাকলে ঘর থেকে বের হবা না। আমি বুয়াকে বলতেছি তোমাকে যেন ডিনারটা ঘরে এনে দেয়।
– আমি বসার ঘরে গেলে কি খুব সমস্যা হবে? আপনি তো বললেন, মামির পা ধরায় কাজ হয়েছে।
– আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। সম্ভবত আবার কোনো গ্যাঞ্জাম হয়েছে। নয়তো বুয়া তোমাকে কালসাপ বলত না।
কালসাপ কথাটা আমিরাও শুনেছে। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় ঠিকঠাক হজম করে উঠতে পারেনি। তবে রিফায়াত চট করে বিপদ-মুসিবতের গন্ধ পেয়ে গেছে। এরপর সে চলে গেল। আগের মতোই ঘরের দরজা আটকে রেখে গেছে। আমিরা অবশ্য বিছানায় চুপচাপ বসে নেই। দরজার এইপ্রান্তে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাইরের কথাবার্তা শুনছে। অবশ্য কান না পাতলেও চলত। রিফায়াতের মামি যেভাবে গলা চড়িয়েছেন, তাতে বিছানায় বসেও আরামসে সবটা শোনা যেত।
রিফায়াত চলে যাবার একটু পরেই বুয়া এসেছিল। হাতে খাবারের প্লেট। ঘরে ঢুকেই বলল,
– তুমি কেডা গো? রিফায়াত ভাইকে মিছা কথা বইলা বিয়া করছ কিল্লাই? তুমার উদ্দেশ্য কী? সম্পত্তি হাতাইবার চাও? আমি আগেই বইলা দিতেছি, তুমার এই উদ্দেশ্য জীবনেও সাকসেস হইব না। মামি হইবার দিব না। সব হেয় কন্ট্রোল করে। তুমি মনে করছিলা, এতিম পুলা। বিশাল সয়সম্পত্তির মালিক। এরে বাগাইতে পারলে এক্কেরে লারে লাপ্পা হইয়া যাইবা! তাই না? ওই আশায় পানি ঢালো। রিফায়াত ভাই আজকা তুমারে ভালোই সাইজ দিব। মামি সব জারিজুরি ফাঁস কইরা দিতাছে।
আমিরার মুখ শুঁকিয়ে আছে। সে কোনো কথা বলল না। ভয়ে তার অজ্ঞান হবার দশা। এই সময়টার অপেক্ষা করছিল সে দিনভর। কখন রিফায়াত ধরতে পারবে, পুরো বিষয়টা ছিল ভুল বুঝাবুঝি। ভুল মানুষকে বিয়ে করা। আজ সারাদিনে কয়েকবার সে ফুপুকে কল করতে চেয়েছে। আমিরা প্রতিবারই নিষেধ করেছে। একবার তো কল করেই ফেলেছিল প্রায়। বিয়ে হয়ে যাবার পর বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে যখন গাড়িতে উঠে বসল ওরা, রিফায়াত হুট করেই ফুপুর নাম্বারে কল দিল। আমিরা শুরুতে খেয়াল করেনি। রিফায়াত ‘ফুপু’ বলতেই তার আত্মা উড়ি-উড়ি করতে লাগল। ঝট করে মোবাইলটা রিফায়াতের হাত থেকে কেড়ে নিল সে। তারপর কল কেটে দিল। রিফায়াত হতবাক সুরে বলল,
– এইটা কী করলা তুমি?
আমিরা জোর গলায় উত্তর দিল,
– ঠিক করছি একদম। আপনি ফুপুকে বিয়ের খবর দেয়ার জন্য পাগল হইছেন কেন? পরে কি বলা যাবে না?
– পরে বলব কেন? ফুপুর জন্যই তো আজকে বিয়ে করলাম। তাই না? ফুপু যদি জোরাজুরি না করত, যদি বারবার তোমার সাথে দেখা করার কথা না বলত, আমি কোনোদিন তোমাদের বাসায় যেতামই না।
– তা ঠিক আছে। কিন্তু এখন উনাকে কিছু বলার দরকার নাই। আমি একসাথে দুই প্যারা নিতে পারব না।
– দুই প্যারা মানে?
– মানে আপনার মামি! উনি তো সহজে মানবেন মনে হচ্ছে না। উনাকে আগে মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর রইল আমার ফ্যামিলি। তারপর নাহয় ফুপুকে কল দিয়েন। ফুপুকে তো ম্যানেজ করার কিছু নাই। উনি তো আগে থেকেই এই বিয়েতে রাজি।
– আমি ভাবছিলাম, ফুপুকে তোমার বড় খালার কথা আর তোমার মা-বোনের থ্রি সিক্সটি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে যাবার কথাটা জানালে ভালো হয়। ফুপু তাহলে বড় স্যারকে জানাত। তারপর বড় স্যার তোমার খালা বা মায়ের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলত। উনি নিজেও তো কাইন্ড অফ অভিভাবক তোমার, তাই না? বাবার পরে অভিভাবক চাচাই হয়। উনার কথা নিশ্চয়ই ফেলবেন না তোমার খালা। তোমার সাইডের প্রবলেম আপনাআপনি সলভ হয়ে যাবে। আমাদের বিয়ে নিয়ে কেউ আর কোনো কথাই বলবে না।
– কচু হবে। আপনি আমার ফ্যামিলিকে আমার থেকে বেশি চিনেন? বড় খালার একটা কথারও নড়চড় কোনোদিন হয় নাই আমাদের বাসায়। সে যা বলে, আমার মা আর বড়াপা একদম হুজুর-হুজুর করে মানে। তাদের কাছে বড় খালাই হান্ড্রেন্ড পারসেন্ট ঠিক। আর বাকি সব মিথ্যা বা ভুল।
– অহ।
তখনকার মতো রিফায়াতকে দমিয়ে রাখা গেছে। আমিরা আসলে নিজেই বলতে চাচ্ছিল বিষয়টা। রিফায়াত অন্য কারও মুখ থেকে শোনার আগে সে নিজে যদি বুঝিয়ে বলতে পারে, রিফায়াত কি পিছিয়ে যাবে? অবশ্যই না। আমিরা ইতোমধ্যে রিফায়াতের মন পড়ে ফেলেছে। হয়তো বাবার পছন্দের মেয়েকে দেখতেই গতকাল ভুল ঠিকানায় গিয়েছিল দেখতে। দেখেছে, কথাও বলেছে। এরপর নিজ বাসায় ফিরেছে। আজ সকালে বারগার শপে দেখা হবার আগপর্যন্তও আমিরাকে নিয়ে তার মনে বিশেষ কোনো অনুভূতি তৈরি হয়নি। ফুপুর ভাষ্যমতে, মরহুম বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল এটা। এজন্যই মুলত রিফায়াতের যত আগ্রহ ছিল। কিন্তু এরপর যত সময় গড়িয়েছে, তার চোখে মুগ্ধতা তৈরি হয়েছে। সেই মুগ্ধতার পরিমাণও চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। রিফায়াত একবার বলেও ফেলেছে,
– তুমি বাবার পছন্দ করা মেয়ে হও আর ফপুর। তোমার সাথে দেখা না হলে আমার সারাটা জীবনই ইনকমপ্লিট হয়ে থাকত!
আমিরা তখনই মনস্থির করে ফেলেছিল, রিফায়াতকে সবটুকু জানিয়ে দেবে। হারানোর ভয়টা তখন অনেকটাই উবে গেছে। কিন্তু বলা হয়নি আর। কীভাবে কথা শুরু করবে, ভাবতে না ভাবতেই রিফায়াত গাড়ি চালাতে শুরু করল। রাস্তাঘাটে বিশাল জ্যাম। তার উপর রিকশাদের কোনো নিয়মনীতি নেই। তারা অবাধে চলাফেরা করে পুরো রাস্তা জুড়ে। পারলে গাড়ির সামনেও আচানক চলে আসে। পেছন থেকে গাড়ির হর্ন তাদেরকে কোনোভাবেই বিচলিত করতে পারে না। সব মিলে বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। এরপর বাসায় ফিরল। মামিকে নিয়েই তখন মাথা নষ্ট।
কিছুক্ষণ আগে অবশ্য সুযোগ মিলেছিল। যদিও খুবই অল্পসময়ের। আমিরা বুঝেশুনে প্রসঙ্গ তুলতে শুরু করেছে। ‘ভুল মানুষ’ বিয়ে করার প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতেই রিফায়াতকে আসল কথাটা বলে দেবার চিন্তা করেছিল। কিন্তু বিধি বাম। মামি আবার ডেকে পাঠিয়েছেন। রিফায়াতও তটস্থ হয়ে গেল মুহূর্তেই। আমিরার কথা শোনার মতো অবস্থায় সে রইল না। আমিরা তবু বলেছিল,
– আমার একটা কথা ছিল আপনার সাথে। খুব ইম্পরট্যান্ট।
– পরে শুনি, আমিরা। আগে মামির সাথে কথা বলে আসি।
– আমারটা আগে শুনলে ভালো হতো। মামির চেয়েও ইম্পরট্যান্ট।
– কী বিষয়ে?
– আমাদের বিয়ে। মানে আমরা ভুল মানুষকে বিয়ে করছি।
– এটা কোনো ইম্পরট্যান্ট কথা না। ‘ভুল মানুষকে বিয়ে করা’- এই চিন্তাভাবনাটাই অ্যাবসার্ড। বুঝতে পারছ? ভুল মানুষকে কখনোই বিয়ে করা যায় না। নেভার। কাজি অফিসের মতো এখানেও তোমার ধারণায় গলদ আছে। আমি আগে মামির সাথে কথা বলে আসি। এরপর তোমার ভুল ভাঙ্গানো লাগবে।
বলাই বাহুল্য, স্ত্রীর ভুল ভাঙ্গানোর মিশনে নামার প্রস্তুতি আর রিফায়াতকে নিতে হয়নি। সে নিজেই কতখানি ভুল পথে চলছে দু’দিন ধরে, তা জানার পর মোটামুটি শকে আছে। আমিরা অবশ্য ওর চেহারা এখনো দেখেনি। তবে অনুমান করাই যাচ্ছে। রিফায়াতের কোনো সাড়াশব্দই নেই। মামি একাই চিৎকার করছেন। কখনো রিফায়াতের সাথে, কখনো মামার সাথে। ফোনে ফুপুও সংযুক্ত আছেন। স্পিকার ফোনে তার কন্ঠ একটু-আধটু শোনা যাচ্ছে। তিনি কী বলছেন সেটা অবশ্য স্পষ্ট না। তার কথা শোনার দরকারও নেই আমিরার। সে জানে, তিনি কতটা কী বলতে পারেন।
বুয়া আর মামির চিল-চিৎকারের বদৌলতে পুরো কাহিনি বুঝে ফেলতে আমিরার বিন্দুমাত্র পরিশ্রম হয়নি। রিফায়াতের সামনে মামি হার মানার ভান করলেও আদতে তিনি মন পরিবর্তন করেননি। রিফায়াতের সামনে ভান করেছিলেন শুধু। সঙ্গত কারণেই ভান করতে হয়েছিল। কারণ রিফায়াত এখন আর ছোট বাচ্চা নয়। সাবালক হয়েছে বহু আগেই। বর্তমানে তাকে যথেষ্ট বুঝদার আর পরিপক্ক মানসিকতারও বলা যায়। এজন্য তাকে বুঝে-সমঝে চলতে হয়। মামি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু বাবার পছন্দ করা মেয়ে বলেই নয়, রিফায়াতের নিজ আগ্রহও আছে আমিরার প্রতি। আমিরাকে তার ব্যক্তিগতভাবেও ভালো লেগেছে। তাই হাবিজাবি বুঝ দিয়ে তাকে এই পথ থেকে সরানো যাবে না। আবার এত সহজে হাল ছাড়তেও রাজি নন তিনি।
তাই রিফায়াতের পছন্দকে মেনে নেবার ভান করেছিলেন। এরপর সুযোগ মিলতেই ফুপুকে কল দিয়েছেন। যাচ্ছেতাই বলেছেন আমিরার নামে। কতটা ভালো ঘরের মেয়ে হলে বিয়ের আগেই শ্বশুরবাড়িতে পা দেয় সে? তার বাবা-মাই বা কীভাবে এলাউ করল বিষয়টা? নাকি বাবা-মা জানেই না। এই মেয়ের পরনে কলেজের ইউনিফর্ম। এর মানেই বুঝা যায়, কলেজের নাম করে বাসা থেকে বের হয়েছে। এবং রিফায়াতের সঙ্গে এই বাড়ি অবধি চলেও এসেছে। এই মুহূর্তে সে বসে আছে রিফায়াতের শোবার ঘরে। এগুলো কি ভালো কোনো অর্থ বহন করে? এই মেয়ে যে কলেজের নাম করে আরও কোনো ছেলের সাথে প্রেম করেনি, তার নিশ্চয়তা কী? আর প্রেম করলে তার বাসায়ও গেছে। বুঝাই যাচ্ছে, মেয়েটা ভালো মানসিকতার না। হতে পারে, রিফায়াতের বাবা পছন্দ করেছিলেন ছোটবেলায়। কিন্তু সেই সময় আর এখনকার মধ্যে অনেক পার্থক্য। মাঝখানে এতগুলো বছর এই মেয়ের পরিবারের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। মেয়ে কোথায়, কীভাবে বড় হয়েছে, কাদের সাথে মিশেছে, এগুলো অজানাই রয়ে গেছে। শুধুমাত্র মৌখিক কথাবার্তার ভিত্তিতে এই বিয়ের কথা আগানো কি ঠিক হচ্ছে? ফুপু ইমোশনাল হয়ে কি ভাতিজার জীবনটাই নষ্ট করে দিচ্ছে না?
যথারীতি ফুপু বিভ্রান্ত। বড় স্যারের ভাইয়ের মেয়েকে তিনি যতটুকু জানে, যথেষ্ট লাজুক আর ভদ্র। পর্দা করে নিয়মিত। বোরকা পরে চলাফেরা করে। তার পরিবারও যথেষ্ট রক্ষণশীল। মেয়েকে একা ঘরের বাইরে কোথাও যেতে দেয় না। সবসময় মেয়ের মা অথবা বোন সাথে যায়। কলেজে তার একা যাওয়ার অনুমতিটা পর্যন্ত নেই। মেয়ের মায়ের সাথে ফুপুর বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। তিনি মেয়েকে কলেজে আনা-নেয়া করতে গিয়ে হাঁপিয়ে যান। সংসার সামলে উঠার সুযোগ পান না। তার সংসার জীবনের আগাগোড়াই মেয়েদের নিয়ে। সংসার আসলে তিনি করেনও না। কোনোরকমে ঠেলেঠুলে চলে। এই নিয়ে মেয়ের বাবারও আপত্তি নেই। তিনিও মনে করেন, সংসারে মন দেয়ার থেকে বেশি জরুরী মেয়েদেরকে সঙ্গে থাকা। মেয়েদের প্রতি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। অথচ সেই মেয়ে কি না মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে রিফায়াতের সাথে বাসা অবধি চলে এসেছে! নিশ্চয়ই মা জানে না। তিনি মেয়েকে কলেজের গেটে ঢুকিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত মনে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। ওদিকে মেয়ে যে আবার গেট থেকে বের হয়ে এসেছে, তার জানা নেই। ঘটনা এরকম হলে তো আসলেই ভাববার বিষয়।
আপাতত তিনি কোনোরকম বাদানুবাদে গেলেন না মামির সাথে। এমনিতে তাদের সম্পর্ক দা-কুড়াল হলেও একটা জায়গায় দুজনই এক দলে। তা হলো, রিফায়াত। ভাগ্নে-ভাতিজার জন্য দুজনই জীবন দিতে পারেন। রিফায়াত তাদের দুজনের কাছেই প্রাণপ্রিয়। নিজের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম না। ফুপু এরপর কল করেছিলেন বড় স্যারকে অথবা মেয়ের মাকে। সেখান থেকে জানা গেছে, মেয়ে বাসায়ই আছে। মুলত মায়ের মোবাইল ফোন সে নিজেই রিসিভ করেছিল। মাগরিবের সময় পার হয়েছে খানিক আগে। তার মা রোজা ছিলেন সারাদিন। এই মুহূর্তে তিনি নামাজ শেষ করে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করছেন। আরও জানা গেল, গতকাল রিফায়াতের যাওয়ার কথা ছিল ওদের বাসায়। ওরা অপেক্ষা করেছে সারা বিকেল-সন্ধ্যা। কিন্তু রিফায়াতের দেখা মিলেনি। বিষয়টা মেয়ের চাচাকে তখনই জানানো হয়েছে। চাচা জানতেন রিফায়াতের গড়িমসির কথা। তাই মেয়েপক্ষকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে, ছেলেটা হয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অথবা পাত্রী দেখার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না। সে চাইলে সময় নিক। বিয়েশাদির ব্যাপার। অত তাড়াহুড়ো করলে ফল ভালো হবে না।
ফুপু আর কথা বাড়াননি। এরপর বিষয়টা মামির কানে এসেছে। দুজনই বিস্মিত এই ভেবে, এই মেয়েটা আসলে কে। আরও একটা গলদ হচ্ছে, মেয়ের নাম। মামির ভাষ্যমতে, এই মেয়ের নাম আমিরা। কিন্তু রিফায়াতের বিয়ের কথাবার্তা যার সঙ্গে হচ্ছিল, তার নাম সামিরা। মেয়েটা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। কথোপকথনের ফাঁকে আরও একটা গলদ বের হয়ে এসেছে। তা হলো, মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দরী ও লম্বা। কালো বা খাটো নয়। ফুপু ছবি পাঠিয়েছেন মামিকে। বোরকা পরে ছবি তুললেও উচ্চতা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এদিকে আমিরাকে সরাসরি দেখেননি মামি। সে ঘুমুচ্ছিল তাই রিফায়াত তাকে ছবি দেখিয়েছে। ছবিটা আজই তোলা হয়েছে বিয়ের পর পরই।
সবকিছু খোলাসা হবার পর মামি আর ফুপু দুজনের মাথা ঘুরছিল। ফুপু বললেন,
– আপা আপনি ওই মেয়েকে এখনই বের করেন বাসা থেকে। রিফায়াত ওরে কোত্থেকে জুটাইছে, ওই কথা পরে শুনা যাবে। কিন্তু বাসা থেকে বের করবেন এখনই। এই মেয়ে তো মনে হইতেছে হেভি চালাক। বাসা পর্যন্ত চলে আসছে। রিফায়াতকে আল্লাহ মালুম, উলটাপালটা কী বুঝাইছে কে জানে।
ফোনে স্পিকার অন করা ছিল। বুয়া তখন মামির শোবার ঘরে গেছে কী একটা কাজে। কথোপকথনের এই অংশটুকু তার কানে গেছে। সে আচানক বলল,
– মাথা গরম কইরেন না গো, মামি। আপনাগো উপ্রে বিশাল মুসিবত ঝুলতাছে। এই মাইয়া কিন্তু কঠিন জিনিস। এই বাসা থেইকা বাইর হইবার জন্যি সে ঢুকে নাই। উলটা আপনাগোরেই বাইর কইরা দেয় নাকি দেখেন। রিফায়াত ভাইরে অলরেডি হাত কইরা ফেলছে। হেয় তো মাইয়ার কথায় উঠে আর বসে। মাইয়ারে মাথায় তুইলা রাখছে এক্কেরে। ডাইরেক্ট ঘরে নিয়া ঢুকাইছে।
মামি হতভম্ব। ফুপু ধমক দিল,
– অ্যাই বুয়া, তুমি চুপ করো। তোমাকে কে বলছে আমাদের কথাবার্তা শুনতে? যেই কাজ করতে আসছ, সেইটা করো। কান বন্ধ রাখো।
বুয়া ধমক খেয়েও পাত্তা দিল না। বলল,
– গরিবের কথা ফালাইতে নাই গো ফুপু। আপনাগো ভালোর জন্যই বলতেছি। মাথা ঠান্ডা রাখেন। মাথা গরম করলে আপনেগোই লস। এই মাইয়া আটঘাট বাইন্ধা আসছে। এই বাসায় মামির থেইকাও বেশি অধিকার অহন তার। সে হইতাছে বস।
মামি এবার ধমক দিল,
– অ্যাই, তুই যা তো। যা এইখান থেকে। এমনিতেই মাথা নষ্ট। তার উপর হাবিজাবি কথা বলতেছে। আমার থেকে বেশি অধিকার এই বাসায় আর কারও নাই। রিফায়াতেরও না। ওর মায়ের মতো আমি। নিজের হাতে কোলের মধ্যে রেখে মানুষ করছি। আর বাইরের কোথাকার কোন মেয়ে এসে বস হয়ে গেছে? তুই কী বলতেছিস, নিজেও জানিস না। যা সর।
বুয়া বলল,
– আমি জানি গো, মামি। আমি কী বলতেছি, ভালোমতোই জানি। কিন্তু আপনে অহনো বুঝবার পারতাছেন না। আপনে তো আসল কাহিনি জানেনও না। রিফায়াত ভাই আপনারে লুকাইছে।
– কী?
– হেয় আজকা বিয়া করছে। ওই মাইয়া তার বউ। কাজি অফিস থেইকা বিয়া কইরা এরপর বউ নিয়াসছে রিফায়াত ভাই। অহন আপনেই চিন্তা করেন, আসলেও কি মাইয়ারে বাইর করতে পারবেন? নাকি বসগিরি করতে পারবেন?
ব্যস, বোমা ফেটেছে। মামি আর ফুপু দুজনই বাকরুদ্ধ।
==============================
তোমার জন্য এক পৃথিবী
রেশমী রফিক
৩২।
আমিরা জড়োসড়ো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে বসার ঘরের দরজার পাশে। প্রবল ভয় ছেঁকে ধরেছে তাকে। রীতিমতো হাঁটু কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই। যে কোনো মুহূর্তে ধুপ করে পড়ে যেতে পারে। এর আরেকটা কারণ হচ্ছে, সে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। বুয়া খাবার দিয়ে গেছিল শোবার ঘরে। কিন্তু খাওয়া হয়নি প্রবল উত্তেজনার তোড়ে। বন্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনছিল বসার ঘরের চিৎকার আর কথোপকথন। একই সাথে অপেক্ষা করছিল রিফায়াতের বক্তব্য শোনার। রিফায়াতের প্রতিক্রিয়া জানতে অস্থির মন আরও বেশি অস্থির হচ্ছিল। বুকের ভেতর ধুড়ুম-ধাড়ুম হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছিল। সেই শব্দ এখনো হচ্ছে। শব্দের গতি আগের চেয়ে তুলনামুলক বেশি। আমিরার মনে হচ্ছে হৃদপিন্ড বুঝি ফেটেই যাবে। হৃদস্পন্দন এত জোরে ধুকপুক করছে যে, ক্ষণে ক্ষণে ব্যাথাও অনুভূত হচ্ছে বুকে। মাথায়ও কি কম ব্যাথা? কপালের দুপাশের রগ লাফাচ্ছে। চোখে মোটামুটি অন্ধকার দেখছে। শুরুতে ভেবেছিল আবছা আলোর ঘর থেকে বেশি আলোর মধ্যে আসায় দৃষ্টি খানিক ঘোলা হয়ে আছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ঘোলাটে থেকে আর পরিস্কার হয়নি। ওর কি তবে হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে? বুকের ব্যাথা বাড়ছে একটু-একটু করে। মাথাও ছিড়ে যাবে মনে হয়। পেটের মধ্যে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। ওটাকে থামাতে পারলে একটু ভালো লাগত। তারও আগে যেটা বেশি জরুরি তা হলো সোফায় বসা। কিন্তু সেই উপায় আপাতত নেই। বসার ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই মামি ওকে থামিয়ে দিয়েছে। কড়া সুরে বলেছে,
– ওখানেই দাঁড়াও। ভেতরে ঢুকবে না তুমি!
আমিরা দাঁড়িয়ে গেছে। রিফায়াতের দিকে তাকানোর ইচ্ছে মনের মধ্যে ঘুরঘুর করছে। কিন্তু চোখ তুলে তাকানোর সাহসটুকু সঞ্চয় করা যাচ্ছে না। মাথা নিচু করে রেখেছে সে। মামি একের পর এক প্রশ্ন করছেন। সে কোনো উত্তর দেয়নি। মামির কড়া ধমক শুনে একটু-আধটু কেঁপে উঠলেও মুখ খুলতে পারছে না। এর মানে এই না যে, সে কিছু বলতে চায় না। মুখটা কীভাবে যেন সুপার গ্লু দিয়ে আটকে আছে। অনেক চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। আমিরা অবশ্য বলার চেষ্টাও করেনি। শরীরের সমস্ত শক্তি নিমেষেই উবে গেছে যেন।
কতগুলো প্রশ্ন করার পর উত্তর না পেয়ে মামির কন্ঠ আরও কর্কশ হয়ে গেছে। তিনি এখন যাচ্ছেতাই বলছেন আমিরাকে উদ্দেশ্য করে। পরিবার, শিক্ষা আর চরিত্র নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। যেমন, আমিরা আসলে সম্পত্তির লোভে বিয়ে করেছে রিফায়াতকে। অনেকদিন ধরেই সম্ভবত অনুসরণ করছিল। রিফায়াতের খোঁজখবর নিচ্ছিল। এরপর অ্যাকশনে নেমেছে। তার ধারণা, আমিরার যে পরিবারকে রিফায়াত দেখেছে, ওটা আসল না। আমিরা কোনো চক্রের সদস্য, যাদের কাজ বাটপারি করে অথবা ফাঁদে ফেলে সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া। ওরা আমিরাকে ট্রেনিং দিয়েছে এই কাজের জন্য।
তিনি রিফায়াতকেও খানিকক্ষণ বকলেন। এই মেয়ে আজ সকালে যখন কল করে বলল, তাকে জোরজবরদস্তি বিয়ে দেয়া হচ্ছে অন্য কোথাও। তখনই বুঝা উচিত ছিল, এর পেছনে দুরভিসন্ধি আছে। রিফায়াতকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করাটাই ছিল আজকের মিশন।
সব কথা আমিরার কানে যায়নি। কিছু গেছে, কিছু এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বের হয়েছে। আমিরা সত্যিকার অর্থে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারছে না। তার মনপ্রাণ জুড়ে আছে বিছানা, যেখানে ধুপ করে শুয়ে পড়া যাবে। এই মুহূর্তে বাসার জন্যও মন উচাটন হয়েছে। এক দৌড়ে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। রিফায়াতের চুপ থাকাটা এই ইচ্ছেকে আরও বেশি উস্কে দিচ্ছে। রিফায়াতের ফুপু আছেন ফোনে। খানিক বিরতি দিয়ে তিনি ক্রমাগত বকেই যাচ্ছেন ভাতিজাকে। আমিরাকেও দোষারোপ করছেন। মামির সাথে তিনিও একমত। আমিরা কোনো কু-উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাসায় পা দিয়েছে। রিফায়াতকেও ফাঁদে ফেলেছে।
আমিরার হতাশ লাগছে খুব। তার মনে হচ্ছে বিয়ে টিকবে না। খানিক আগেও আশা ছিল, রিফায়াত এই ঝড়টা সামলে নিবে। কিন্তু সে চুপ করে আছে। টু শব্দও করছে না। চোখ তুলে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না তার উপস্থিতি। এর মানেই বুঝা যায়, মামি আর ফুপুর কথায় তার সম্মতি আছে। অথচ সারাদিনে কতশত কথা বলল, কত প্রমিজ। ভুল মানুষের সাথে নাকি বিয়েই হয় না! তাহলে এখন কেন চুপ করে আছে সে? এখন কেন জোর দিয়ে মামিকে বলছে না, আমি ভুল মানুষকে বিয়ে করিনি? পইপই করে নিষেধ করেছিল আমিরা ওকে। কাজি অফিসে বিয়ে করার দরকার নেই। রিফায়াত শুনলই না। ছোটবেলা থেকে আমিরা শুনে এসেছে, বাবা-মা বা অভিভাবক ছাড়া বিয়ে হয় না। দাদি বলত, ছেলেরা সাবালক হলে তাদের হয়তো অভিভাবকের দরকার হয় না। কিন্তু মেয়েরা নাবালিকা-সাবালিকা যেটাই হোক, অভিভাবক থাকতে হয়। নয়তো বিয়ে শুদ্ধ হয় না। কাজি অফিসে বিয়ে করলে হয়তো কাগজ-কলমে বিয়ে দেখানো হয়। কিন্তু তা কতখানি শুদ্ধ, তাও দেখার বিষয়! তাছাড়া আইন মেনে বিয়ে করাটাই সবকিছু না। ধর্মটাও তো মানতে হয়। ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে বিয়ে করাটা জরুরি। আজকের এই বিয়েটা না ধর্মমতে হয়েছে, না আইন অনুসারে। পুরোটাই ছিল এক প্রকার ধাপ্পাবাজি। এই কথাগুলো রিফায়াতকে বুঝানোই গেল না। সুযোগ দিল না সে। যতবার বলতে গেছে আমিরা, ততবার থামিয়ে দিয়েছে। আর এখন উনি ঠান্ডা মেরে বসে আছেন? এখন কেন মুখ দিয়ে কথা বের হয় না?
আমিরা অন্যমনস্ক ছিল। এলোমেলো চিন্তাভাবনারা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। এতক্ষণে তার বাসায় হুলুস্থুল পড়ে গেছে নিশ্চিত। সবাই ওকে খুঁজছে। খালা-খালু কি এসেছেন বাসায়? তাদের সাথে কি শফিক এসেছে? তারা হয়তো এখনো জানতে পারেনি, আমিরা কী কাজ করেছে। যখন জানবে, তখন কী হবে? বড় খালা নিশ্চিত বলবেন,
– তুই আমার ভাগ্নি না। আজ থেকে আমি তোকে চিনি না।
মা বলবে,
– তুই বের হ বাসা থেকে। এক বান্দি ঘরের মধ্যে জায়গা দিছি, তার মানে এই না, আরেক বান্দিও জায়গা দিব। বিয়ে যখন নিজে নিজে করতে পারছিস, এখন নিজের ব্যবস্থাও নিজে করে নে। আমার বাসার ত্রিসীমানায় পা দিবি না। তোর চেহারা যেন আমি কোনোদিন না দেখি।
বড়াপা বলবে,
– বেশি বুঝতে গেছিলি, এখন খাইছিস ধরা। তোর জন্য এটাই দরকার ছিল। খালা এত ভালো একটা প্রস্তাব আনছে, সেইটা তো মনে ধরে নাই। তোর পছন্দ হইছিল ওই ছেলেরে! নিজে নিজে আবার বিয়েও করছিস। এখন সে তোরে ঘরে রাখে না কেন? তুই গিয়ে ওই ছেলের সাথেই বুঝ। আমি তোর চেহারা আর কোনোদিন দেখতে চাই না।
এরপর আমিরা কী করবে? কোথায় যাবে? এই ঢাকা শহরে আপন বলতে ওর কেউ নেই, যে এই বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াবে। আমিরা মনে মনে বলল,
– আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আমি আর কোনোদিন কাউকে ভালোবাসব না। কোনোদিন কোনো ছেলের দিকে মুখ তুলে তাকাব না। কোনোদিন কোনো ছেলেকে পছন্দ করব না। পুরুষ জাতটাই আসলে খারাপ। স্বার্থসিদ্ধির বেলায় এদের জুড়ি নাই। এরপর স্বার্থ শেষ হয়ে গেলে তখন আর কাউকে চিনে না। না রাজু ভাই, না রিফায়াত। সব শালা এক রসুনের কোয়া।
পরক্ষণেই মনের আরেকটা অংশ বলল,
– নাচতে না জানলে উঠান বাঁকাই মনে হয়। তুই নিজের দোষে ধরা খাইছিস। রিফায়াত কি তোরে বাসা থেকে তুলে আনছে? তুই নিজেই নাচতে নাচতে ওকে কল করছিলি আজ সকালে। কী দরকার ছিল কল দেয়ার? চুপচাপ খালার পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করে ফেলতি। সেটাই ভালো হতো। এখন তো এই কুল-ওই কুল সবই গেল! এখন রিফায়াতকে বল, সম্পত্তির অর্ধেক লিখে দিতে। পারলে পুরোটাই দিতে! দেয় নাকি দেখ! অলরেডি ওর মামি আর ফুপু তোর নামে সম্পত্তি হাতানোর অপবাদ দিয়ে ফেলছে। এখন সম্পত্তি হাতা!
মন অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। আরেকটা অংশ প্রতিবাদ করল,
– অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দেবার কথা তো মন থেকে বলি নাই। বলছিলাম এইজন্য যেন রিফায়াত কখনো ডিভোর্সের নাম মুখে না আনে। ডিভোর্স দিতে হলে অর্ধেক সম্পত্তি হাতছাড়া করতে হবে, এই ভয়েই রিফায়াত সারাজীবন যেন আমার সাথেই পার করে। এটাকে কাইন্ড অফ ব্ল্যাকমেইল বলা যায়। অথবা ফাঁদ। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য তো ছিল না। রিফায়াতই যদি পাশে না থাকে, তার সম্পত্তি দিয়ে কী করব আমি?
অন্য অংশ সায় দিয়ে বলল,
– ঠিক। রিফায়াতকে আমি ভালোবাসি। সারাজীবন ওর হাত ধরেই পার করতে চাই। ও না থাকলে সম্পত্তি ধুয়ে পানি খাওয়ার কোনো মানেই হয় না।
শেষমেশ মন এই বক্তব্যে সম্মত হলো, চুলায় যাক রিফায়াত। চুলায় যাক সম্পত্তি। চুলায় যাক ভালোবাসা। আমিরার মতো মেয়ের জীবনে এইসব ভালোবাসা আসে না। আসলেও টিকে না। ভালোবাসতে যে যোগ্যতাটা দরকার হয় আজকাল, সেটা ওর নেই।
তাহলে কি রিফায়াত অধ্যায় আজ থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ? বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠল যেন। মনের গহীনে কোনো একটা অংশ ক্ষীণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে, ”আমার রিফায়াতকেই লাগবে সারাজীবন পথ চলতে।” সেই প্রতিবাদ কারও কানে পৌঁছুতে পারছে না। কারণ রিফায়াত নিজেই চাচ্ছে না ওর পাশে থাকতে। জোর করে কি কাউকে ভালোবাসা যায়? নাকি আটকে রাখা যায়?
আমিরার মন বলছে, বাসায় কল করা দরকার। বড়াপার নাম্বারটা ওর মুখস্ত আছে। রিফায়াতের মোবাইল দিয়ে কি একবার কল করবে? ফোনটা শোবার ঘরেই আছে। এতক্ষণ শোবার ঘরে বসেছিল সে। সুযোগ বুঝে কল করে ফেলতে পারত। বড়াপাকে অন্তত এইটুকু বলতে পারত, সে ভালো আছে। তার কোনো বিপদ হয়নি। পরক্ষণে মন সতর্ক হলো। আদতে কি তাই? এই মুহূর্তে কতখানি বিপদ তার মাথার উপর ঝুলছে, অনুমান করা যাচ্ছে না।
আচানক মামির বাজখাই কন্ঠ কানে ঢুকল,
– অ্যাই মেয়ে, তুমি কি বোবা? কথা বলতে জানো না? এত প্রশ্ন করছি। উত্তর দিচ্ছ না কেন? নাকি কানে শোন না?
আমিরা চমকে উঠল। আপনমনে মুখ তুলে সামনে তাকিয়েছে। হঠাৎ রিফায়াতের সাথে চোখাচোখি হলো। রিফায়াত ঠান্ডা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। অনেকটা তুমুল ঝড়ের আগে যেমন চারপাশ শান্ত হয়ে যায়, সেরকম। আমিরা ভয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। মামি এবার রিফায়াতকে ধরলেন,
– রিফায়াত, তুই চুপ করে আছিস কেন? এই মেয়ে কি সত্যিই বোবা? নাকি কালা? কী দেখে এই মেয়েকে তুই বিয়ে করছিস, বল তো? মানলাম, তুই রঙ অ্যাড্রেসে গেছিস। তারপরেও কি তোর মাথায় ঢুকল না, এই মেয়েকে তোর বাপ কী খেয়ে পছন্দ করবে? আচ্ছা মানলাম, ভাই নাহয় ছোটবেলায় মেয়ে পছন্দ করছিল। তখন হয়তো দেখতে ভালো ছিল। কিন্তু তোর ফুপু নিশ্চয়ই এইরকম মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হবে না। ইটস অ্যা কমন সেন্স! তুই কালকে মেয়ে দেখতে গেছিস। ভালো কথা। কোন অ্যাড্রেসে গেছিলি, দ্যাট ডাজন্ট ম্যাটার। মানুষের ভুল হতেই পারে। তাই বলে আজকে কেন এই মেয়েকে কাজি অফিসে নিয়ে বিয়ে করতে হবে? দুইদিনের বাত্তি ছেমড়ির মাথায় কি তোর থেকে বেশি বুদ্ধি?
পাত্র-পাত্রী কেউ কথা বলছে না। দুজনই মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। রিফায়াত শুরুতে যাওবা একটু-আধটু কথা বলেছিল। আমিরার সামনে দাঁড়িয়ে তার কথাগুলো যেন হুট করে হারিয়েছে। ফুপু বললেন,
– আপা, আপনি এই মেয়েকে বাসা থেকে বের করেন। এইসব বিয়ে-টিয়ে মানি না। রিফায়াতকে জিজ্ঞেস করবেন কোন কাজি অফিস। ওখানে গিয়ে সব সর্ট আউট করতে বলেন ভাইকে। এই বিয়ের যেন কোনো চিহ্ন না থাকে। আর এই মেয়েও যেন বিয়ের কোনো প্রমাণ বের করতে না পারে। দরকার পড়লে টাকা-পয়সা ঢালেন। আমার ভাতিজার লাইফ নিয়ে তো আমি ছিনিমিনি খেলতে দিব না এই মেয়েকে। আরেকটা কথা, কালকে থানায় যাবেন। এই মেয়ে আর তার চৌদ্দগুষ্টির নামে একটা জিডি করে রাখবেন। বলা যায় না, এরা আবার কোন দিক থেকে রিফায়াতকে ফাঁসাবে।
আমিরা প্রচন্ড বিচলিত বোধ করছে। সে এবার মুখ তুলে বলল,
– প্লিজ, থানায় যাবেন না। আমার বাবা খুব অসুস্থ। মায়ের শরীরও তেমন ভালো না। এই অবস্থায় যদি থানা-পুলিশ হয়, বাবা হার্ট অ্যাটাক করবে। আর মা কী করবে, আমি জানি না। আমার বড় খালা এইসব শুনলে আর কোনোদিন আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে না। কোনোদিন আমাদের আর্থিক সাপোর্ট দিবে না। আমরা কীভাবে চলব তখন? প্লিজ, দয়া করেন একটু। আমার ছোট বোন এখনো স্কুলে পড়তেছে। ওর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবে। আমার বাবার মেডিসিনের খরচ লাগে প্রতি মাসে অনেকগুলো টাকা। আমাদের সংসার চলে বড় খালার টাকায়। আমি প্রমিজ করতেছি, কোনোদিন এই বিয়ের কথা মুখে আনব না। কোনো প্রমাণ বের করব না। উনার আশপাশেও কোনোদিন থাকব না। আমি দরকার পড়লে ঢাকায়ই থাকব না। অন্য কোথাও চলে যাব। কিন্তু প্লিজ আমার ফ্যামিলির উপর কোনো…
মামি বললেন,
– এতক্ষণে কথা বের হয়েছে? বোবা-কালার অভিনয় শেষ তাহলে?
ফুপু বললেন,
– থানা-পুলিশের ভয় আগেই দেখানো উচিত ছিল। তাইলে আরও আগে মুখ খুলত। আপা, আমার মনে হয় এমনে ছেঁড়ে দেয়া উচিত হবে না। আপনি পুলিশ ডাকেন।
আমিরা প্রায় কাঁদোকাঁদো সুরে বলল,
– না প্লিজ। আমাকে যাইতে দেন। আমি এখনই চলে যাচ্ছি।
পুলিশের নাম শুনে আমিরার ভয় বাড়ছে। সে এক দৌড়ে চলে গেল শোবার ঘরে। বসার ঘরে আসার সময় ইউনিফর্মের সালোয়ার আর কামিজ ছিল পরনে। এর উপর বড় সাদা ওড়না জড়িয়েছিল মাথায়। এবার ঘরে ফিরে এসে বেল্ট আর ক্রসবেল্ট পরল দ্রুত। কলেজের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই দেখল, রিফায়াত এসেছে। ওর পেছনে মামি এসেছেন। তবে তিনি ঘরে ঢুকতে পারলেন না। রিফায়াত তার আগেই দরজা আটকে দিল। মামি দরজায় নক করলেন,
– রিফায়াত, দরজা খোল। তুই ওর সাথে কোনো ঝামেলায় যাইস না। এই মেয়ে কিন্তু সুবিধার না। ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। এরপর যা করার, পুলিশই করুক।
আমিরার মনে হচ্ছে, এক্ষুনি বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে। রিফায়াতকে দেখে এখন মুর্তিমান আতঙ্ক ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। খানিক আগে রিফায়াতকে দেখলে চোখমুখে যে ভালো লাগার ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ত, তা আপাতত লেজ তুলে পালিয়েছে জানালার বাইরে।
রিফায়াত গলা চড়িয়ে বলল,
– ওর সাথে আমার কিছু বুঝাপড়া আছে, মামি। সেগুলো শেষ করি। ও যেহেতু এই বাসা পর্যন্ত চলে আসছে, এত সহজে তো যেতে দেয়া যায় না। আমার মনে হয়, যেতে দেয়া উচিতও না…
রিফায়াত আরও কিছু বলছিল। আমিরার কানে তা ঢুকল না। সে ফিসফিস করে বলল,
– আল্লাহ তুমি আমাকে মৃত্যু দাও। এই দুনিয়াতে আমার বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় নাই।
তার চারপাশ আচানক অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। পৃথিবী বনবন করে ঘুরতে শুরু করল। পরক্ষণে ধুপ করে মেঝেয় পড়ে গেল সে।