হাওয়ায় ভাসা উড়ো চিঠি পর্ব-১০

0
157

#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (১০)

সকাল থেকে প্রচন্ড পেট ব্যথা। এখন দুপুর হয়ে এসেছে। আবৃত্তির পেট ব্যথা যেন দ্বিগুন হারে বাড়ছে। মেয়েটি সাপের মতো মোচড়ায়। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। ইদানীং সমস্যাটা বেড়েছে খুব। নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। চোখ দিয়ে জল নেমে আসছে। কলিং বাজল তখনি। আবৃত্তির শরীরে এক ফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। কলি কে ডাকে সে। “কলি কলিং বাজে দেখো তো কে এল। আর একটু গরম পানি বসাও তো। পেটে গরম ভাব দিতে হবে।”

“ঠিক আছে আপা মনি।”

দরজা খুলে কলি দেখল উন্মেষ দাঁড়ানো। সে বলল,”ভাই জান আজকে এত আগে আগে আইলেন যে।”

“কিছু ফাইল নিতে এসেছি। ভুলে রেখে গিয়েছিলাম।”

“আইচ্ছা।”

তড়িঘড়ি করে চলে গেল উন্মেষ। কলি গেল রান্নাঘরে। পানি বসানোর জন্য হাড়ি নামানোর সময় কাচের বোতল পড়ে গেল। সেই বোতলের এক অংশ লাগল পায়ে। চেঁচিয়ে উঠল কলি। আবৃত্তি তখন ঘুমিয়ে জল। উন্মেষ ছুটে এল। দেখল কলির পা কে টে ছে। বিরক্ত হলো সে।
“সাবধানে কাজ কর। কত খানি কে টে গেল।”

কলির চোখে পানি। উন্মেষ বলল,”কি করছিলি এখানে?”

“আবৃত্তি আপা মনির পেট ব্যথা। গরম পানির ভাব দাওয়ার লাইগা পানি গরম দিতে আইছিলাম।”

“আর তখনি নিজের পা টা কা ট লি!”

উত্তর করে না কলি। উন্মেষ ওকে ঘরে পৌছে দেয়। বেশ অনেকটা কে টে ছে। মলম আর ব্যান্ডেজ দিয়ে ফিরে আসতেই আবৃত্তির গোঙানি কানে আসে। মেয়েটা আর্তনাদ করে বলছে,”কলি একটু গরম পানিটা নিয়ে এসো। যন্ত্রণা বেড়েছে।”

দ্বিধায় পড়ল উন্মেষ। গরম পানি বসিয়ে যায় আবার কলির ঘরে। কলি চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলেছে। কে টে ছে অনেকটা। ব্যথায় হিচকি তুলছে। উন্মেষ বুঝতে পারল একে বলে লাভ হবে না আর। এ নিজেই আধ ম রা।

গরম পানি নিয়ে আবৃত্তির ঘরে যেতেই উন্মেষ দেখল মেয়েটি আগে থেকেই পেট উন্মুক্ত করে রেখেছে। নজর ঘুরিয়ে নিল উন্মেষ। আবৃত্তির চোখ দুটো বোজা। মেয়েটি ঠোঁট কামড়ে নিজের ব্যথা দমানোর প্রয়োসে। উপায়হীন উন্মেষ এগিয়ে এল। গরম পানির ব্যাগটা আলগোছে ধরল আবৃত্তির পেটের উপরে। এতে কিছুটা আরাম বোধ হলো মেয়েটির। বেশ কিছুটা সময় এভাবেই চলল। উন্মেষ একবার ও তাকাল না আবৃত্তির দিকে। মেয়েটি যখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে তখন উন্মেষ উঠে এল। যাওয়ার পূর্বে আবার চোখ গেল উন্মুক্ত উদরে। দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে মেয়েটির শাড়ি নামিয়ে দিল।

ঘরে এসে ফাইল গুছিয়ে নিতেই তুমুল বৃষ্টির শুরু। ফোন এল। আলমাস সাহেব জানালেন আজ ওনারা আসতে পারবেন না। কারণ ঐদিকে ঝড় চলছে খুব। উন্মেষকে বলা হলো দ্রুত বাড়ি ফিরতে। হুম বলে রেখে দিল উন্মেষ। অফিস গেল না আর। তাছাড়া আবৃত্তির শরীর ও খারাপ। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। উন্মেষের খেয়াল হলো বৃষ্টির পানি আসছে জানালা দিয়ে। তড়িঘড়ি করে ছুটল আবার। আবৃত্তি জানালার কাছে একদম। পানি এসে ভিজিয়ে দিয়েছে ওকে। চট করে জানালা বন্ধ করে দিল। এদিকে আবার লোডশেডিংয়ের শুরু। জেনারেটর নষ্ট হয়ে আছে। চার্জার লাইট নেই বাসায়। ফোনের ফ্লাস জালিয়ে মোম ধরাল। ড্রয়িং রুমে আর কলির ঘরে একটা দিয়ে আরেকটা রাখল আবৃত্তির রুমে। জুবুথুবু হয়ে গেছে আবৃত্তি। ভ্রু কুঞ্চিত করল উন্মেষ। হালকা হাতে মেয়েটির কপাল স্পর্শ করতেই বুঝল জ্বরে অবস্থা খারাপ। তার উপর বৃষ্টির পানিতে অর্ধ ভেজা শরীর। হাল্কা স্বরে মেয়েটি কে ডাকল উন্মেষ, “আবৃত্তি, আবৃত্তি, উঠে বসার চেষ্টা করো।”

কথাটা কানে যায় নি মেয়েটির। জ্বরের প্রভাব খুব বেশি হওয়াতে অনেক টাই চেতনা হীন সে। এক পর্যায়ে কাঁপতে লাগে আবৃত্তির দেহ। কোমল গোলাপি ঠোঁটটা যেন আরো রক্তিম হয়ে উঠেছে। শুকনো ঢোক গিলল উন্মেষ। আবৃত্তির গালে হাল্কা করে চাপর দিয়ে আবার ডাকতে লাগল। “উঠো আবৃত্তি।”

চেতনাহীন আবৃত্তি উঠল না। বরং আরো বেশি করে আকড়ে ধরল বিছানা। সাথে বক্ষস্থলে চেপে ধরল উন্মেষের হাত। এবার উন্মেষ পড়ল বিপদে। ছেলেটা কি করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে আকাশে মেঘ ডাকছে গুরুম গুরুম। ভেজা শরীর স্পষ্ট হয়েছে। এভাবে থাকলে মেয়েটির বড়ো কোনো রোগ বাঁধবে। আলগোছে কোলে তুলে নিল উন্মেষ। বাচ্চা ছানার মতো করে গুটিশুটি হয়ে রইল মেয়েটি। বহু চেষ্টা করেও পুরোপুরি জ্ঞান ফিরাতে পারল না। আবৃত্তির শাড়ি বদল করে নর্মাল টপস পরিয়ে দিল উন্মেষ। মেয়েটি একদম ই জ্ঞানহীন। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। বেডে রেখে উঠে যেতেই হাতটা আকড়ে ধরল। উন্মেষের হৃদয় কেঁপে উঠে। কিছু বলছে আবৃত্তি। অস্পষ্ট তার কণ্ঠ। নিচু হয়ে শোনার চেষ্টা করল উন্মেষ। আবৃত্তি বলছে, “যেও না চলে। প্লিজ যেও না।”
ঠিক তারপর পর ই বলছে,”আমি তোমায় ভালোবাসি না। ভালোবাসি না তোমায়।” জ্বরের ঘোরে নানান কথা বার্তা বলল আবৃত্তি। উন্মেষ অনেকটা ভিজে গেছে। মেয়েটির শাড়ি বদলের সময় বুক ধরে এসেছিল। চোখ ভিজে এসেছিল কোনো এক যন্ত্রণায়। অসহায় লাগছিল নিজেকে। ভীষণ ভাবে অসহায়।

সারা রাত আবৃত্তির কাছেই ছিল উন্মেষ। কত বার মেয়েটি কেঁপে উঠেছে হিসেব হীন। জ্বর টা নেমেছে এখন। ঘুমিয়ে জল হয়ে আছে। উন্মেষের চোখে আলো আসতেই ঘুম নেমে গেল। আবৃত্তির পাশেই আধশোয়া হয়ে বসে রইল। মেয়েটির মাথায় হাত বুলাল কয়েক বার। এলো চুল গুলো গুছিয়ে দিল। আর তার পর পর ই মেয়েটির কপালে একে দিল উষ্ণ ঠোঁটের পরশ।

কলি বলল,”আবৃত্তি আপা মনি আপ্নে উইঠেন না।”

তবু উঠার চেষ্টা করল আবৃত্তি। মাথা নাড়াতে ও কষ্ট হচ্ছে। কলি সাহায্য করে দিল। আবৃত্তি থ হয়ে বসে। কলিই বলল, “কি যে হইছিল আপ্নের। শরীরে জ্বর যে হু হু কইরা বাড়তেছিল।”

“জ্বর বেড়েছিল খুব?”

“হ মনে হইতেছিল গরম পাতিলায় হাত রাখছি।”

“আপু কি ঘরে কলি? একটু ডেকে দাও না।”

“ভাবি মনি তো ঘরে নাই।”

“কোথায় তাহলে?”

“কাইল তো খুব বৃষ্টি আছিল তাই আইতে পারে নাই কেউ।”

“ও।” বলে থেমে গেল আবৃত্তি। দেখতে পেল নিজের গায়ের জামাটা। কিছু সময় ভ্রু কুঞ্চিত করে থেকে কলিকে প্রশ্ন করবে ভাবল। তবে ততক্ষণে চা হাতে চলে এসেছে উন্মেষ। চুল গুলো এলোমেলো। কলি উঠার চেষ্টা করতেই উন্মেষ বলল, “সাবধানে। তোর পায়ের যা অবস্থা!”

কথাটা বুঝে নি আবৃত্তি। উন্মেষ চা রাখতে রাখতে বলল,”তোর চা দিয়ে এসেছি। ধীরে ধীরে ঘরে যাবি। বিকেলে ডাক্তার নিয়ে আসব।”

“ঠিক আছে ভাইজান। আমি যাই,কোনো দরকার হইলে ডাইকেন।”

“হু যা।”

কলি চলে গেল। আবৃত্তি চা তুলতে যেতেই উন্মেষ বলল,”আমি দিচ্ছি।”

চা নিল আবৃত্তি। মুখটা কেমন গম্ভীর।
“জামা আমিই বদলে দিয়েছি।”

হঠাৎ উন্মেষের এমন কথাতে চমকে যাওয়ার কথা থাকলেও চমকাল না মেয়েটি। শুধু একবার তাকাল। চা শেষ করে রেখে দিল কাপটা। উন্মেষ ধীর হস্তে মেয়েটার মাথায় হাত ছোঁয়াল। চোখ বন্ধ করে রইল মেয়েটি।
“জ্বর নেমে গেছে।”

প্রতিক্রিয়া দেখাল না আবৃত্তি। উন্মেষ ফের বলল,”কিছু বলছো না যে।”

“কি বলব?”

“কিছু একটা। অন্তত ভালো খারাপ রিয়েক্ট করা যেতেই পারে।”

“আমার কোনো অনুভূতি নেই।”

“মিথ্যে কেন বলো যখন সে মিথ্যেটা কোনো কাজেই দিবে না।”

“সত্যি ছিল এটা।”

“থাক আর সত্য মিথ্যে জানতে চাই না।”

“শোনো, আমাকে কিছু দিনের জন্য বাসায় দিয়ে আসবে প্লিজ? ”

“হঠাৎ!”

“প্লিজ দিয়ে আসো আমায়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

অনেকটা ভনিতা করে এবার উন্মেষ বলল,
“তাহলেই বুঝো আমার কেমন লেগেছিল।”

“উন্মেষ! তুমি এটা বলতে পারো না।”

“কথা বলিও না আবৃত্তি।”

“সব তো ঠিক ই ছিল। আজ তাহলে এমন কেন বললে তুমি। এর জন্যেই আমি আসতে চাই নি।”

সামান্য লাল হয়ে এল উন্মেষের চোখ। আবৃত্তি সেসব পরোয়া না করে বলল,
“তুমি তোমার কথা রাখো নি তবে?”

“দোষ দিবে না আবৃত্তি। আমি আমার দিক থেকে কখনোই কমতি ছিলাম না।”

“বুঝেছি।”

“কি বুঝলে?”

“আজ আমি এখানে উপস্থিত আছি তাই সব কিছুর এত ঘাটতি।”

রাগ হলো উন্মেষের। আবৃত্তি নাক ফুলিয়ে বসে রইল। দুজনের মধ্যেই একটা আক্ষেপ রইল। একটা সময় পর উন্মেষ বলল,”আমার দিক থেকে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তবে এখনো আমার অনুভূতি ম রে যায় নি আর না কখনো যাবে। আমার প্রথম ভালোবাসা,প্রথম অনুভূতি ছিল।”

নিজেকে নিষ্ঠুর মনে হলো আবৃত্তির। মনে পড়ল দিতিয়ার বলা কথা গুলো। এক সময় বলল,”আন্টি তবে ভুল বলে নি কিছু। আমি সত্যিই আমার আপুর সংসার ভাঙতে এসেছি।”

দু চোখে জল। আবৃত্তির ফুপানোর শব্দ শুনছে উন্মেষ। মেয়েটার দিক থেকে নজর ফিরিয়ে মনে মনে বলে, ‘এত ভালো না হলে ও পারতে। অন্তত আমার জীবনটা এভাবে পঁচে যেত না।’

দুপুরের দিকে ফিরে এল সবাই। আবৃত্তি হঠাৎ করেই বাড়ি যেতে চাইছে এ বিষয়টা হজম হলো না লেখার। সে তো সরাসরি উন্মেষকে অভিযোগ করল। “তুমি ওকে কিছু বলেছ?”

“কি বলব?”

“তাহলে বাড়ি যেতে চাইছে হঠাৎ।”

“তাকে জিজ্ঞাসা করো।”

“অদ্ভুত! কাল ও তো সব ঠিক ছিল।”

“তুমি বসো তো।”

“বসেই তো ছিলাম।”

“আবার বসো। পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে তাই না?”

“কি করে বুঝলে?”

“ম্যাজিক।” বলেই গাঢ় হাসল উন্মেষ। লেখার পা টা নাড়াচাড়া করে দিল। এতে শীতল হয়ে এল লেখার চোখ। ঠিক কতটা ভালোবাসা থাকলে মানুষ এমন করতে পারে?

উন্মেষ ই দিতে এসেছে আবৃত্তিকে। আজ ও আঁচলের ঠিক নেই মেয়েটির। চুল গুলো উড়ে গেছে বাতাসে। গাড়ি থেমেছে অনেক সময়। আবৃত্তির যখন ধ্যান ভাঙে তখন দেখতে পায় উন্মেষ তাকানো।
“লজ্জা পেলে না তো।”

“কেন লজ্জা পাব!”

“শাড়ি ঠিক তো করো আগে।”

“ঠিক করার কি আছে?”

“সেটাই।” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল উন্মেষ। আবৃত্তি তাকিয়ে দেখল এটা ওদের বাড়ি নয়। বরং বাড়ি থেকে উল্টো পথ। চিরচেনা সবুজ মাঠ। চিন্তিত কণ্ঠে মেয়েটি বলল, “এখানে কেন এলাম আমরা?”

“অতীতকে অনুভব করতে।”

“আমি চাই না।”

“না চাইলে ও যেতে হবে।”

“উন্মেষ প্লিজ।”

“একা কেন জ্ব ল ব আমি? তুমি ও তো সমান দোষী তাই না। ভালো তো আমি একা বাসি না।”

নীরব হয়ে এল আবৃত্তির দৃষ্টি। মেয়েটির চোখে মুখে ভয়। উন্মেষ তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকিয়ে রইল নিষ্ঠুর নারীটির পানে। যা সইবার ক্ষমতা নেই তা কেন করতে যাবে!

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি