#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (১১)
প র কী য়া শব্দটি খুবই নিচু মানের। আর এই প র কী য়া র দায়ভার এড়াতেই কীনা বিয়ের পর উন্মেষ আর আবৃত্তির যোগাযোগ হারিয়ে যায়। পুরো পৃথিবীর নিকট সবটা ঠিক দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় ভুগছিল দুটি অতৃপ্ত হৃদয়।
সন্ধ্যায় যখন বাড়িতে এল ওরা, তখন আবৃত্তি একদম ই চুপচাপ। মেয়েটি যেন হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। থমকে গেছে ওর পৃথিবী। উন্মেষ স্বাভাবিক। অভ্যেস হয়ে এসেছে সব টা।
“নামো,এসে গেছি।”
নিশব্দে নেমে গেল আবৃত্তি। আঁচল ছুঁই ছুঁই মাটি। নিজে হাতে মেয়েটির আঁচল ঠিক করে দিল উন্মেষ।
“আমি তোমাকে খুব ঘৃণা করি উন্মেষ।”
“জানি সেটা।”
“কেন ওখানে নিয়ে গেলে আমায়?”
“আমার ভেতরকার সামান্য যন্ত্রণা অনুভব করাতে।”
“ঠিক করলে না এটা।”
“কোনো কিছুই ঠিক ছিল না আবৃত্তি। গত কয়েকবছরে ঠিক হয় নি কিছুই।”
“খুব ঘৃণা করি তোমায়। অন্তত আজকের দিন টার জন্য হলে ও আমি তোমায় ঘৃণা করি। ভীষণ ঘৃণা করি। ভীষণ ভাবে…।”
“তাহলে বুঝো আমার বুকে কতটা ঘৃণা জন্মানোর কথা।”
হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল আবৃত্তি। ছলছল নয়ন দেখাতে চায় না উন্মেষ। দাঁত কামড়ে পরিস্থিতি সামলায়।
“এই স্মৃতি টুকুই সহ্য হলো না তোমার? আর আমার সবটা জুড়ে যে স্মৃতি বইছে,সেটা কেমন করে সহ্য করেছি আমি।”
“ঠিক করলে না উন্মেষ। এই সময়ে এসে আমায় এত যন্ত্রণা না দিলেও পারতে।”
“তুমি ঠিক করেছিলে নি ষ্ঠু র মেয়ে।”
“চলে যাও প্লিজ। এই নি ষ্ঠু র মানুষকে আগলে নিও না আর।”
“বহু আগেই সরিয়ে দিয়েছ। আর শোনো সরে যেতে চাইলেই সরে আসা যায় না।”
থেমে গেছে আবৃত্তির কান্না। উন্মেষ কাছে আসল। মাথায় স্পর্শ করল ধীর হাতে।
“কালকের জন্য সত্যিই দুঃখিত। তুমি বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছিল। জামা না বদলে দিলে জ্বর বেড়ে যেত আরো।”
প্রায় এক সপ্তাহ কেঁটে গেছে। আবৃত্তি খুব ই শান্ত। বাড়ি এসে থেকে নিজের ঘরে শুয়ে থাকে। লেখার সাথে ও টুকটাক কথা বলতে চায় না। খানিক বাদেই বলে,পরে কথা বলি আপু। আন্দাজ করে থেমে যায় লেখা। এমনি তে ওর জন্য আবৃত্তির জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হলো। পরক্ষণেই মনে পড়ল উন্মেষের কথা। ছেলেটির ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এই কাজটি করেছে সে। তার জীবনের ভরসা নেই। সেখানে উন্মেষের জীবনকে, ও নেতিয়ে দিতে পারে না। অন্তত ওর ভালোবাসা সেটা করতে বলে না। সেই সকল ভাবনা থেকেই না এমন সিদ্ধান্ত। আবৃত্তিকে নিতে এসেছে লেখা। সাথে অবশ্য উন্মেষ ও এসেছে। ললিতা বেগম নাস্তা রাখলেন।
“কত দিন পর এলে বাবা। আজ থেকে যাও।”
“অন্য একসময় থাকব মা। আজ আসার কথা ছিল না। তবে আপনার মেয়ে শুনল না কথা।”
“খুব জ্বালায় তোমায়?”
“ছি ছি কি বলছেন। লেখা খুব ই লক্ষি মেয়ে। মাঝে মাঝে বায়না করে এই যা।”
স্বামীর কথাতে হাসল লেখা। ললিতার কাছে এসে বসল। জুসের গ্লাস এগিয়ে দিল।
“তোমার জামাই,কখনো আমার দোষ ধরেছে মা? সবটা নিজের উপর নিয়ে নেয়। বড়ো ভাগ্যবতী আমি।”
কপালে টুপ করে চুমু খেলেন ললিতা।
“সেই জন্যেই বোধহয় তোর হাতে সময় দিলেন না সৃষ্টিকর্তা।”
“মা, তুমি আবার কান্না করছো!”
“কাঁদি না তো মা। বোস তোরা আমি রান্নার ব্যবস্থা করি।”
“তার আগে কথা দাও রান্না ঘরে গিয়ে কাঁদবে না।”
“ধুর বোকা, রান্না ঘরে কেউ কাঁদে?”
“তুমি কাঁদো মা। আমি তো তোমাকে চিনি।”
বুক টা হু হু করে উঠল ললিতার। চট করে চলে এলেন তিনি। রান্না ঘরে এসে কাঁদতে লাগলেন বিরামহীন। জীবনের সমস্ত কান্না রান্না ঘরেই কেঁদেছেন তিনি। কাউকে দেখতে দেন নি। অথচ তার মেয়েটা ঠিক ই দেখে নিয়েছে।
বুকে বই রেখে চোখ বন্ধ করে ছিল আবৃত্তি। হঠাৎ মাথায় স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলল।
“কি রে ঘুমাস নি তুই?”
“না। তুই কখন এলি আপু? বললি না তো আসবি।”
“বললে তো তুই নিষেধ করতি।”
“নিষেধ কেন করতে যাব?”
“ওমা আমি জানি না বুঝি। যদি বলতাম ফিরে যাওয়ার কথা তুই সরাসরি নাকোচ করে দিতি। আমি তো জানি সেসব।”
“কিছু দিন পর যাব আপু।”
“আমি তোকে নিতেই এসেছি। আর যেতে ও হবে।”
কথা শেষে মলিন হাসল লেখা। চোখে জল চিক চিক করে। বুকে অসহ্য এক যন্ত্রণা। “শোন,আমি বুঝতে পারি আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। ভরসা হারিয়ে ফেলছি রে। তুই কথা দে আমায়,সব টুকু দিয়ে উন্মেষকে দেখে রাখবি। আমায় যে খুব ভালোবাসে ছেলেটা। আমি ছাড়া ম রেই যাবে। তুই ওকে বাঁচিয়ে রাখবি বোন।”
লেখার অপারেশন আজ। শেষ চেষ্টাটা করতে চায় সবাই। আবৃত্তি বোনের হাত ধরে বসে আছে। বুকটা হু হু করছে। অন্য দিকে উন্মেষ বিচলিত। ভীষণ বেপরোয়া হয়ে গেছে ছেলেটা। সব কিছু ফেলে বার বার লেখার নিকট আসছে। মেয়েটা কে বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে আষ্টেপৃষ্টে। সবাই কাঁদছে। উন্মেষকে এতটা পাগলামি করতে দেখা যায় নি আগে। সব গুলো মানুষ সামলানোর চেষ্টা করল ওকে। তবে কেউ যেন পারছে না। বিগত দুই মাস ধরে লেখা একে বারেই অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারে না। আবৃত্তি যত্ন নিয়েছে সর্বদা। এমন কি প্রথম এক মাস লেখার সাথেই ঘুমিয়েছে। লেখার শ্বাস গুলো ঘনঘন। আবৃত্তিকে কাছে ডাকে।
“আপু কথা বলিস না প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিচ্ছু ঠিক হবার নেই আবৃত্তি। সব কিছু বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে।”
“এমন কথা বলিস না আপু। তোর কিছু হবে না রে। তোর কিছু হতে দিব না। তুই ছেড়ে যাস না আপু। ম রে যাব আমি।খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। খুব বেশি কষ্ট। কি করব আমি। কি করে বাঁচাব তোকে। আল্লাহ এত নি ষ্ঠু র কেন হলেন।”
“কাছে আয় বোন। পাগলামি করিস না।”
মুখটা কাছে নিল আবৃত্তি। লেখা শব্দহীন চুমু একে দিল কপালে। হাতটা বুকে চেপে ধরে বলল,”পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বিনিময়ে হলে ও তুই ওকে দেখে রাখবি বোন। কথা দে আমায়, সামলে নিবি ওকে।”
“আপু….।”
“কথা দিলি তো?”
“দিলাম কথা।”
হাউমাউ করে কাঁদছে আবৃত্তি। লেখা শুকনো হাসল। উন্মেষ পাগলের মতো ছুটছে এদিক সেদিক। লেখার দু চোখ বেয়ে নেমে গেল জলের স্রোত। মেয়েটা দেখে যাচ্ছে ওর প্রিয়তম কে, ওর প্রথম ও শেষ ভালোবাসা কে। কেবল দেখেই যায় এ দেখার যেন কোনো শেষ নাই।
ভাগ্য অদ্ভুত। যা ভাগ্যে লেখা থাকে তা কখনোই বদলাবে না। বদলায় নি লেখার জীবন ও। মেয়েটি চলে গেল তিন দিন। শুধু তাই নয় এরই সাথে ঘটে গেছে দম বন্ধ এক ঘটনা। লেখার যখন অপারেশন হয় তখন পাশের এক ভবনে আগুন লাগে। অপারেশন প্রায় শেষ আর হতাশাজনক ভাবে অপারেশন সাকসেস ও হয় নি। লেখার নিথর দেহটা নিয়ে যাওয়া হয় পাশের লা শ ঘরে। সেখানে আরো কিছু দেহ ছিল। মূলত মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন অংশ পঁ**চে যাওয়াতে দুগন্ধ বের হচ্ছিল। তাই অন্য ঘরে নিয়ে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা হচ্ছিল। তখনি ঘটে দূর্ঘটনা। পাশের ভবন থেকে আ গু ন এসে পড়ে সে ঘর টাতে। লেখার ম**রদেহ সহ আরো দুটো ম**রদেহ পুড়ে যায়। মৃ ত স্ত্রীর দেহের জন্য পাগলামি করে উন্মেষ। আগুনের মাঝেই ছুটে যায়। এক সময় বা হাতের এক পাশ পু*ড়ে ও যায়। গার্ডরা এসে ওকে ধরে নিয়ে আসে। ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে উন্মেষ। কান্নার রোল পড়ে গেছে। শোকের উপর শোক। লেখার পু ড়ে যাওয়া দেহটা নিয়ে আসা হয়। শেষ দেখার সুযোগ হয় নি কারোর। জ্ঞান ফেরার পর একদমই স্থির হয়ে যায় উন্মেষ। লা**শ দাফন করার সময় ও কোনো কথা নেই। আবৃত্তি ঘরের এক কোণে বসে পাগলের মতো কান্না করে। কেউ ভালো নেই কোথাও। যন্ত্রণায় সবার অবস্থা খারাপ। এই ভয়ানক শোকে কাটল তিনটে দিন। সবার চোখ মুখের অবস্থা খুব ই খারাপ। খাওয়া দাওয়া করে না কেউ ই। নিদ্রাহীন চোখ। কলি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। এই খবর পেয়ে চলে এসেছে আজ। ওর ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে হাসি খুশি তে থাকা পরিবারটা এতটাই ভেঙে গেছে। লেখার মতো সুন্দর একটি প্রাণ এই পৃথিবীতে নেই। দু চোখের কোণ বেয়ে ঝরছে পানি। চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে চুলোতে ভাত বসাল সে। দিতিয়ার ঘরে গিয়ে বলল,”খালাম্মা, এই ভাবে তো জীবন যাইব না। না খাইয়া থাকলে তো ভাবি মনি আর ফিরা আইব না।”
“তুই এখন যা কলি।”
কলি এবার এল আবৃত্তির ঘরে। মেঝেতে পড়ে আছে আবৃত্তির দেহ। গোসল নেই কত দিন। গায়ে জড়ানো মলিন শাড়ি। এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে এদিক সেদিক। কলি আঁচল টেনে দিল বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল কয়েকবার।
“আবৃত্তি আপা মনি আপ্নে ও যদি এমনে ভাইঙা পড়েন তো সামাল দিব কেডা। কেউ তো একজন সামলান।”
“আপু চলে গেল কলি।”
“উঠেন আপ্নে। গোসল কইরা আহেন আমি গরম পানি কইরা দেই।”
“কেন এমন হলো বলো তো কলি। আমার আপু তো সুখেই ছিল।”
“আগে গোসল কইরা আহেন।”
গরম পানি দিয়ে গেল কলি। আবৃত্তিকে গোসলে পাঠিয়ে এল উন্মেষের ঘরে। ছেলেটার মাঝে এত বেশি পরিবর্তন এসেছে যে মনে হচ্ছে প্রাণহীন একটা দেহ। একটা ছবি হাতে বসে আছে। চোখ নিবদ্ধ বাহিরে থাকা গাছ গুলোর দিকে। রোজ সকালে পাখিদের আনাগোনা দেখতে ভালোবাসত লেখা। উন্মেষকে তুলে নিত মাঝে সাঝে। বায়না করত এক সাথে ভোর দেখবে বলে। বিজনেস এর কাজে বাহিরে গেলে কত বায়না জমে থাকত হৃদয় জুড়ে। এক রাত ভরে সেসব বায়নার লিস্ট করত লেখা। তারপর এক একটা বায়না পূরণ করত উন্মেষ। মেয়েটি আজ নেই তিন দিনের ও বেশি সময়। নিশ্চয়ই অনেক বায়না জমা করে রেখেছে। তবে উন্মেষ জানে না সেসব। জানবেও না কখনো। মেয়েটি অন্তরে ছোট ছোট মায়া বপন করে দিত। সে মায়া আজ পাহাড় সমান রূপে দহন দিচ্ছে। উন্মেষ ফুঁপিয়ে উঠে। কলির হৃদয়টা ছ্যত করে উঠল। উন্মেষকে কিছু বলার মতো ভাষা পেল না। শুধু দেখতে লাগল স্ত্রীর সাথে অন্তত বিচ্ছেদে ভেঙে যাওয়া এক ভগ্ন হৃদয়ের স্বামীকে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি