#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (১৪)
এক মাসের মাথায় উষার কল এল। যা ভয়ানক শোক বার্তার আভাস! উষার কান্নার আওয়াজ গুলো আবৃত্তির চিত্তে ভয়ের তৈরি করেছে। উতলা হয়ে এল ভেতরঘর। রাত্রী প্রায় দুটো। উন্মেষ খুব কাজ করেছে বিগত দিন গুলো। সেইজন্য ঘুমটা বেশি। ছেলেটা জাগে না যেন তার জন্যেই একটু দূরে আসার চেষ্টা করল। তবে খুব একটা লাভ হয় নি। উন্মেষের স্বভাব আবৃত্তিকে বুকে মিশিয়ে ঘুমানো। উপায়ন্তর পেল না আবৃত্তি।
“শুনছ?”
“হুম।”
ঘুম ঘুম কণ্ঠে উন্মেষের জবাব। আবৃত্তি বলল, “উষা কল করেছে। কাঁদছে খুব।”
“কি!”
“দেখ না।”
ফোন নেয় উন্মেষ। বা হাতে ঘুমের ভাবটা সরিয়ে বলে,”কি হয়েছে তোর?”
“ভাইয়া আমি শেষ হয়ে গেছি। সব শেষ হয়ে গেছে।”
“কি সব পাগলের মতো বলছিস!”
“আমায় নিয়ে যাও ভাইয়া। আমায় নিয়ে যাও প্লিজ।”
“ইয়াস কে ফোন টা দে। নিশ্চয়ই দুটোর মাঝে ঝগড়া হয়েছে।”
“ইয়াস আরেকটা বিয়ে করেছে। আমি বুঝতে পারছি না কি করব। আমি ম রে যাব ভাইয়া। আমার জন্য বি*ষ নিয়ে আসবে প্লিজ।”
তৎক্ষণাৎ ইয়াসের বাড়িতে উপস্থিত হয় উন্মেষ। সাথে আবৃত্তি ও এসেছে। মা বাবা কে জানায় নি এখনো। বয়স হয়েছে, সাথে একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। শরীর ভালো নেই তেমন। আবৃত্তি আগে হাঁটার চেষ্টা করলেই উন্মেষ থামায়।
“আমি আগে যাচ্ছি। পেছনে আসো।”
ইয়াস বসে আছে ড্রয়িং রুমে। পাশেই আধ ম রার মতো শুয়ে আছে উষা। মেয়েটার ঠোঁটের কোণে র*ক্ত। চিৎকার করল আবৃত্তি। “উষা!”
“ছোট ভাবি। ছোট ভাবি, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। সব শেষ।”
“চুপ করো উষা। চুপ করো তুমি। কিছু হয় নি।”
ইয়াসের তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। উন্মেষ যা বুঝার বুঝে নিয়েছে। ঝামেলা করতে চাইল না এই মুহূর্তে। তবে ইচ্ছে করছে ইয়াসের প্রাণ বের করে নিতে। বোন কে নিয়ে বেরিয়ে এল সে। বের হওয়ার আগে শুধু বলল,”তোকে তো আমি দেখেই নিব। ভালো করলি না।”
জীবনের ধাক্কা গুলো বড় অদ্ভুত। কে জানত ইয়াস নামক মানুষটি হুট করে মিলিয়ে যাবে উষার জীবন থেকে। দুটো বছর ব্যয় করেছে উষা। প্রথম বছরেই সম্পর্কটা গভীর হয়। দশম শ্রেনিতে উঠতে না উঠতেই ইয়াসের আবদার বাড়ে। এই মুহূর্তেই বিয়ে করতে চায়। কারণ ওর নিজের উপর নাকি ভরসা নেই। ও চায় না কোনো ভুল হয়ে যাক। ছেলেটা এমন ভাবে বুঝাল যে কিশোরী উষা সর্বোচ্চ ভুলটা করে ফেলল। বিয়ে করল লুকিয়ে এমন কি মাস দুয়েক পর ই প্রেগনেন্ট। উন্মেষ খবর নিল সব। ইয়াস নিজ থেকেই ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। এর আগে একটা চিঠি ও দিয়েছে। উন্মেষ দেখাল সেটা। আবৃত্তি পড়ল। “উষা, তুমি আমার জীবনের প্রথম মেয়ে নও। তোমার আগে ও আমার বউ আছে। আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমাদের বিয়েটা হয় আরো পাঁচ বছর আগে। অনেকটা আবেগের বসেই হয়ত বিয়ে করেছি। সবে কলেজে উঠেছি তখন। একি ক্লাসে পড়তাম। ভালোবাসাটা শা রী রিক মেলামেশাতে পরিণত হয়। কনসিভ করে ও। আমি তখন বুঝতে পারি নি কি করব। এক বড়ো ভাইয়ের সাহায্যে এ বো র্শন করাই ওর। তবে কে জানত ঐ এ বো র্শন টাই ওর গর্ভধারণ ক্ষমতা কেড়ে নিবে। মেয়েটা আবেগী, ভীষণ ভালোবাসতাম ওকে। চাইছিলাম ও যেন ইনসিকিউর ফিল না করে। তাই বিয়েটা করে ফেলি। তবে এর ই মধ্যে ওর ইচ্ছে হয় ছোট ছোট হাত পা নিয়ে খেলা করার। তবে কপাল পোড়া আমাদের। অনেক চেষ্টা করে ও বেবি হলো না। পাগলামি শুরু হলো ওর। আমি ওকে আলাদা রেখেছি। একটা ছোট জব করতাম সেটা তো জানোই। যা রোজগার হতো এতে কখনো অসুবিধা হয় নি। তাই বাসা থেকে কখনো জানতে ও পারে নি। আলাদা থাকলেও আমাদের ভালোবাসাতে ছিল সুখ। তবে একটা বাচ্চা খুব ই দরকার। তার উপর বাবা বলল আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে যার সন্তান আগে হবে তাকে মোট প্রপাটির দুই ভাগ দেওয়া হবে। তবে বাসায় তো জানে না আমি বিয়ে করেছি। এদিকে ভাইয়া বিয়ে করল সে বছর ই। সম্পত্তি পাওয়ার চান্স বেড়ে গেল। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তখনি তোমার সাথে আমার দেখা। আমার বন্ধুর কোচিং সেন্টারে যেতে তুমি। বোকা সোকা একদম ই বাচ্চা। একটা ভালো লাগা কাজ করল। ভাবলাম একটা বেবিই তো দরকার। আর তোমাকে পটাতে পারলে খুব সহজেই সবটা হয়ে যাবে। হলো ও তাই। তবে কে জানত ভাবি এত বড়ো সর্বনাশটা করবে। তোমার পেটের বাচ্চা টা ভাবির জন্যেই শেষ হয়ে গেল। ষড়যন্ত্রের জবাব দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি চাইলে আমার বিরুদ্ধে যে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারো। ভেতর থেকে জ্ব ল ছি আমি। অশান্তিতে মাথা কাজ করছে না। তোমাকে নিজের কাছে রাখতে চাইছি না আর। বাচ্চা তুমি, সুন্দরী ও। ভালো জায়গায় বিয়ে হবে। তবে যে মেয়েটা আমায় এত গুলো দিন ধরে ভালো বাসল। তাকে কি করে ছাড়ি? তাছাড়া আমার পরিকল্পনা ছিল বেবিটা হলে কোনো ভাবে বেবিটা কে সরিয়ে ফেলব। ইনিয়ে বিনিয়ে তোমায় ডিভোর্স দিব। সেসব তো আর হলো না তাই নিজ থেকেই সব বললাম। জানি কষ্ট পাবে। তবে বিশ্বাস করো আমি তোমায় ভালোবাসি নি কখনোই। তোমার সাথে করা সব প্রতারণার জন্য আমি কেবল ক্ষমা চাইতে পারি। ক্ষমা না করলেও ডিভোর্স লেটারে সাইন করে দিও। বাবা মা রেগে আছেন। তবে আমি মানিয়ে নিব আশা করি। কিন্তু দুই স্ত্রী মেনে নিবেন না। তাছাড়া আমি ওকে ছাড়তেও পারব না। অপশন হিসেবে তোমাকেই ছাড়তে হলো। ভালো থেকো।”
মেঝেতে বসে পড়ল আবৃত্তি। উন্মেষ রাগে গজগজ করছে। “হা রা মির বাচ্চাকে আমি ছাড়ব না।”
“কোনো প্রয়োজন নেই ভাইয়া।”
“উষা! তুই এখানে।”
“আমি সব শুনেছি ভাইয়া।”
“দেখো উষা,ওকে তো শাস্তি পেতেই হবে।”
“কি লাভ ছোট ভাবি? যেখানে সে কখনো আমায় ভালোই বাসে নি তাকে শাস্তি দিয়ে কোনো লাভ কি আছে আদৌ?”
বড়োদের মতো মতামত দিল উষা। এই টুকু সময়েই যেন অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে মেয়েটা। বুকের বা পাশ মোচড়াচ্ছে। আবৃত্তির ভীষণ খারাপ লাগে। সেদিন যদি আরেকটু খতিয়ে দেখত ওরা।
ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে সবাই। উষার ডিভোর্স টা হয়ে গেছে অনেক গুলো দিন। উষা এখন নিয়মিত কলেজ যাচ্ছে। যথা সম্ভব চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হওয়ার। পুরো পরিবারটা ভেঙে গিয়ে আবার জুড়ে আসে। ঝড় ঝাপটা সব ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। তিনটে টিকেট পাঠালেন আসাদ সাহেব। কক্সবাজার ঘুরে আসার জন্য এয়ার টিকেট আর হোটেল বুকিং। টিকেট পেয়েই ফোন করে আবৃত্তি। “তোমরা কি বলো তো বাবা।”
“কি করলাম রে মা।”
“এই সময়ে টিকেট পাঠায় কেউ।”
“টিকেট পাঠানোর জন্য টাইম লাগে আবার? তোরা সবে একটা ধাক্কা কাটালি। অবশ্য ধাক্কা তো যাচ্ছেই না। তাই একটু ঘুরে আয় ভালো লাগবে।”
“তিন টা টিকেট…”
“উষা যাবে না সাথে?”
“ভালো কথা মনে করিয়েছ বাবা। ঠিক আছে আমি এখন রাখি। তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা।”
“সোনা মেয়ে। তুমি আছ দেখেই না বেঁচে আছি আমরা।”
চমকে গেল আবৃত্তি। আপন বাবা মা না হয়ে ও কতটা ভালোবাসে ওকে। ভেজা নয়ন মুছে অস্পষ্ট সুরে বলল আবৃত্তি, “এভাবেই থেকে যাও বাবা। তোমরা না থাকলে আমি আসলেই বড়ো অসহায়।”
আবৃত্তি ভেবেছিল উষা ট্যুরে যেতে চাইবে না। কিন্তু মেয়েটি এক বলাতেই রাজি হয়ে গেল। বিষয়টা ভালো লাগল আবৃত্তির। জীবনে হেরে গিয়ে থেমে যাওয়ার মতো বোকামি আর দুটি নেই। লাইফটা যদি অত সহজ ই হতো তবে সে লাইফের এত মূল্য থাকত না। এসব ভাবে আবৃত্তি। উষা ব্যাগ প্যাক করেছে। সেসব ই দেখাতে এসেছে। একটা সাদা রঙের টপস রেখে যাচ্ছিল উষা। আবৃত্তি বলল,
“ওটা নিচ্ছ না কেন? ওটা তোমাকে অনেক সুন্দর লাগবে।”
“কোনটা ছোট ভাবি?”
“ঐ যে সাদা টপস।”
টপস টা হাতে নিয়ে কি একটা ভাবল উষা। আর তারপর ই ফায়ার বাকেট নিয়ে তাতে ফেলে দিল টপস। আগুনে জ্ব ল তে লাগল জামাটা। আবৃত্তির মনে হলো উষা হয়ত কোনো বিষয়ে ওর প্রতি আপসেট।
“তোমার কি হলো উষা। আমার কথায় কি রাগ করলে কোনো ভাবে?”
“না ছোট ভাবি।”
“যদি ইচ্ছে না করত তাহলে জামাটা না নিতে। এভাবে আ গু নে পু ড়ি য়ে দিলে যে।”
“জীবনে কিছু সুন্দর স্মৃতি তিক্ত হয়ে আসে ছোট ভাবি। আর সেসব স্মৃতিকে বয়ে বেড়ানোর মতো নির্বুদ্ধিতা দুটি নেই। যা আমি করতে চাচ্ছি না।”
উষার কথা না বুঝতে পারায় আবৃত্তি তাকিয়ে রইল নির্বাক হয়ে। ফোঁস কে দম ফেলে উষা। যেন কত কালের দীর্ঘশ্বাস।
“আসলে ভাবি এই টপসটা ইয়াস এনে দিয়েছিল। আমাদের ফার্স্ট নাইটে।”
হুড়মুড়িয়ে উঠল আবৃত্তি। উষা কে ধরতে গেলেই উষা বলল, “আমায় ভাঙতে দাও ছোট ভাবি। ভেঙে ভেঙেই একদিন শক্ত হব আমি। খুব শক্ত।”
কি সুন্দর কথা। বাচ্চা এক মেয়ে। জীবনে হেরে গিয়েও যেন খুব বুঝদারে পরিনত হয়েছে। সব কিছু থেকেই আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। তবেই না জীবন হবে সুন্দর।
সন্ধ্যার ফ্লাইট ছিল ওদের। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌছে গেল ওরা। হোটেলে গিয়ে চাবি নিয়ে নিল। আবৃত্তি বলল, “তুমি আমার সাথে আসো উষা।”
“কেন ছোট ভাবি?”
“আমার সাথে থাকবে।”
“কি বলো এসব! এটা হয় নাকি।”
“এটাই হয়।”
“হ্যাঁ আমি আর আবৃত্তি এটাই ঠিক করেছি।”
“ধ্যাত তোমরা যে কি বলো ভাইয়া।”
“আসো বোন আমার।”
“না ছোট ভাবি আমি একা থাকতে চাই একটু। আমি এসেছি শুধু মাইন্ড ফ্রেস করতে।”
“কিন্তু উষা…।”
“অসুবিধা হবে না আমার। জানো তো এখন আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছি। আর ব্যাগ ভর্তি করে বই এনেছি। সব কবিতার বই। সারা রাত জেগে পড়ব বলে। তুমি কাছে থাকলে হবে নাকি সেটা। দাও চাবি টা।”
ফটাফট চলে গেল উষা। উন্মেষ ও আর আটকাল না। অনেকাংশেই মেয়েটির কথা সত্য। একটু একা থেকে নিজেকে বোঝার চেষ্টা করুক। মানিয়ে নিক সবটা নিজের মতো।
শাওয়ার শেষ করে এসে আবৃত্তি দেখল কিছু লিখছে উন্মেষ। মেয়েটি দেখতে যেতেই লুকিয়ে ফেলল।
“কি হলো এটা?”
“লুকিয়ে দেখ কেন?”
“তো দেখাও কি লিখছ।”
“উহু।”
“কি সমস্যা?”
“আজ নয়। কাল দেখাব।”
“অদ্ভুত তো!”
“যাই বলো না কেন আজ দেখতে পাবে না। আজ রোমান্টিক মুডে আছি আমি।”
“রোজ ই থাকো।”
“আজ একটু বেশি।”
“কাছে আসবে না। তোমাকে সুবিধার লাগে না।”
“বর রা সবসময় অসুবিধার ই হয়। কাইন্ড অফ গুন্ডা।”
“আচ্ছা? জোর করতে আসলে আমি ও নায়িকা দের মতো হবো।”
“যেমন?”
টেবিল থেকে ফল কা টা র না ই ফ নিয়ে নিল আবৃত্তি। ফিঁচেল হেসে না ই ফ ঘুরিয়ে বলল, “দেহ ও পাবি না মন ও পাবি না শ য় তান। তার আগেই তোর পেট ফুটো করে দিব।”
“বাংলা সিনেমা।”
“আম সিরিয়াস।”
“আম অলসো মিসেস।” গাল ভর্তি হেসে আবৃত্তিকে কোলে তুলে নেয় উন্মেষ। মেয়েটির ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে দেয়। অদ্ভুত এক স্মেল আসছে শরীর থেকে। চট করেই বলে উন্মেষ, “ইচ্ছে করে শ্যাম্পু করেছ তাই না? যাতে আমায় কবজা করা যায়।”
“ছি তুমি সব সময় অশ্লীল।”
“হুম আরো হব।”
“তাই?”
“হু একদম।” ঠোঁটে হাল্কা স্পর্শ করে ফের বলে উন্মেষ,
‘তোমায় নিয়ে আমার আহাজারির নেই তো শেষ।
সুযোগ পেলেই ছোঁয়ার ইচ্ছে জাগে হুট হাট।
মাতাল হয়ে ডুবে যাই এদিক সেদিক,
মন জানে এ দু চোখে শুধু একজন ই আছে।’
চলবে……
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি