অন্তহীন বসন্ত পর্ব-২৫+২৬

0
269

#অন্তহীন_বসন্ত~২৫
লিখা- Sidratul Muntaz

কয়েকটি থমকানো মুহূর্ত কাটল। তারপর বিলকিস অবন্তীকে ধরে টানতে টানতে ঘর পর্যন্ত নিয়ে গেল। নিশান্তর সাথে একটা কথাও বলল না। নিশান্ত ওভাবেই কিছুক্ষণ স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

বিলকিস অবন্তীকে নিয়ে একটি ফাঁকা ঘরে ঢুকে দরজা আটকালো। থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল,” ও এখানে কেন এসেছে? তুই ডেকেছিস?”

অবন্তীর ঠোঁট কাঁপছে ঠকঠক করে৷ কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। বিলকিসের নজর গেল অবন্তীর হাতের দিকে। ফোন বক্সটা শক্ত করে চেপে রেখেছে সে। বিলকিস রাগী গলায় বলল,” এটা কি?”

অবন্তী দ্রুত ফোন বক্স পেছনে লুকিয়ে ফেলতে চাইল। বিলকিস তৎক্ষণাৎ ক্ষীপ্র বেগে অবন্তীর হাত থেকে বক্সটি ছিনিয়ে নিল। তারপর অগ্নিদৃষ্টিতে বলল,” এতো দামী ফোন কোথায় পেলি? নিশান্ত দিয়েছে? ”

অবন্তী কথা বলল না। কান্না সামলাতে মুখে হাত চেপে ধরল। তার নীরবতা বিলকিসের ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কষে একটা চড় দিল সে অবন্তীর গালে। এবার অবন্তী ফুঁপিয়ে উঠল। বিলকিস কড়া গলায় বলল,” বেহায়া, নির্লজ্জ, সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে কি করছিলি তোরা? যদি আমি না দেখে অন্যকেউ দেখতো? অলরেডি কতজন দেখেছে আল্লাহ জানে। মান-সম্মান বলে আর কিছু থাকল না। দোয়া কর যেন তোর বাবার কানে কথা না যায়। এইটা যেভাবে এনেছিস সেভাবেই ফেরত দিয়ে আসবি৷ এখনি যা।”

বিলকিস ফোন বক্সটি অবন্তীর দিকে বাড়ালো। অবন্তীর চোখ দু’টি জ্বলে উঠল। ফোন দেওয়ার বাহানায় নিশান্তর কাছে ক্ষমা চাইতে পারবে সেই খুশিতে মন উত্তেজিত হলো। ওই সময় বিলকিসকে দেখে অবন্তীর মাথা কাজ করছিল না। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিশান্তর গালে চড় মেরে দিয়েছে। কিন্তু ঘটনাটা মোটেও ইচ্ছাকৃত ছিল না। নিশান্ত কি বুঝবে সেটা? যদি অভিমান করে বসে? অবন্তী প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। বাড়ি ভর্তি মানুষজন। অবন্তীর কান্না-মাখা চেহারা দেখে অনেকেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু এসবে অবন্তীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে। সে ঝড়ের গতিতে ছাদে উঠে গেল। কিন্তু নিশান্তকে কোথাও পাওয়া গেল না। সিঁড়িতেও সে নেই। অবন্তী নিচে নেমে খুঁজে দেখল। নিশান্ত কোথাও নেই। তীব্র হতাশা নিয়ে ফিরল অবন্তী। বিলকিস দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। অবন্তীর হাতে ফোন বক্স দেখে প্রশ্ন করল,” চলে গেছে?”

অবন্তী মাথা নাড়ল। তার ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলতে। কিন্তু মায়ের সামনে কাঁদার সাহস নেই। বিলকিস হাত বাড়িয়ে ফোন বক্সটি নিতে নিতে বলল,” এটা এখন থেকে আমার কাছে থাকবে। সময়, সুযোগ বুঝে ফেরত দিয়ে দেব। যা চোখ-মুখ ধুঁয়ে আয়। এই ঘটনা এখানেই শেষ হওয়া চাই।”

বিলকিস তখন আর কিছু বলল না। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর অবন্তীর জন্য আরও বিপদ অপেক্ষা করছিল। বিলকিস তাকে প্রচুর মার-ধোর করল। তার জন্য ফোন হাতে নেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা হলো। বাড়ির বাইরে পা রাখাও নিষেধ। অবন্তীর আক্ষেপ শুধু একটা জায়গাতেই। নিশান্তর সাথে কথা বলা হলো না। তার জন্যে ছটফট করছিল মনটা। সেদিনের পর থেকে বিলকিস তাকে এমন কড়া পাহারায় রেখেছে যে একবারের জন্যেও ফোনের কাছে ঘেঁষতে পারেনি অবন্তী। আর অদ্ভুতভাবে, সেদিনের পর থেকে নিশান্তও তাকে একটা বার ফোন করেনি। নিশ্চয়ই চড়ের ব্যাপারটা নিয়ে সে রেগে আছে। নাহলে বুঝি এতোদিন অবন্তীর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারতো! অবন্তী যে তার রাগ ভাঙাবে সেই উপায়টুকুও নেই। চারদিন কেটে গেল। অবন্তীর মনে হচ্ছে সে মারা যাচ্ছে। দেহ আছে, প্রাণ নেই। নিশ্বাস নিতে হাজার কষ্ট৷ এভাবে কি বাঁচা যায়? নিশান্তর সঙ্গে একবার দেখা করতেই হবে। অবন্তী চায় না যে নিশান্ত তার উপর জমানো রাগ নিয়ে কানাডায় চলে যাক। একদিন অবন্তী লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে সব জড়তা-সংকোচ ভেঙে মায়ের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করল যাতে অন্তত একবার তাকে ফোন দেওয়া হয়। সে শুধু নিশান্তর সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়; শেষ বারের মতো। বিলকিস প্র‍থমে প্রচন্ড রেগে গিয়েছিল। পরে অবন্তীর অনবরত কান্না দেখে খানিক সদয় হলো। পাঁচমিনিটের জন্য তাকে কথা বলার অনুমতি দেওয়া হলো। কিন্তু শর্ত ছিল- বিলকিসের সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলতে হবে। আর এই কথা বলাই যেন শেষবার হয়। অবন্তী রাজি হলো। কারণ ওই মুহূর্তে রাজি হওয়া ছাড়া অন্যকোনো উপায় ছিল না।
বিলকিসের সামনে দাঁড়িয়েই অবন্তী পরপর দশবার নিশান্তর নাম্বারে ডায়াল করল। আর দুঃখজনকভাবে একবারও নিশান্ত ফোন ধরল না। অবন্তী পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেল। বিলকিস সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলল,

” দেখলি, কার জন্য এতো কাঁদছিস? ও তো তোর ফোনই ধরল না। একবার কানাডায় ফিরে গেলে তোর কথা মনেও রাখবে না। এখন তোদের মধ্যে যে ভালো-লাগা তৈরী হয়েছে সেটা সাময়িক। দুইদিন গেলেই মুছে যাবে। নিশান্ত এখনও ছোট। আবেগে ভাসছে বলেই তোর সাথে প্রেম করছে। কিছুদিন পর দেখবি তোকে পাত্তাও দিবে না। তখন হাজার কেঁদেও কূল পাবি না। কোথায় ও আর কোথায় তুই। মায়ের কথা স্মরণ করবি তখন। তোর ভালোর জন্যই বলছি সমহ থাকতে এখনি সরে আয়। শুধু শুধু জীবনে একটা কালো অধ্যায় যুক্ত করার কোনো মানেই হয় না।”

অবন্তী মোবাইল ফেরত দিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল। মায়ের প্রতিটি কথা তীক্ষ্ণ ফলার মতো আঘাত করতে লাগল হৃদয়ে। এতো অসহ্য, অস্থিরতা, কষ্ট নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? নিশান্ত কেন এমন করছে? অন্তত একটা বার ফোন ধরলে কি এমন ক্ষতি হতো? অবন্তী সারাদিন ঘর থেকে বের হলো না। বিলকিসও অবন্তীকে ডাকল না। সে চিন্তা করল, কিছুসময় অবন্তীকে একা নিজের মতো থাকতে দেওয়া উচিৎ। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সব ভুলে যাবে। শুধু সময়ের প্রয়োজন। রাতে একবার খাওয়ার জন্য বিলকিস অবন্তীর ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল। তখন দেখল অবন্তীর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ নয় বরং খোলা। এর মানে কি অবন্তী বাইরে বের হয়েছিল? সারাদিন কাজের মধ্যে থাকায় আজ বিলকিস তেমন একটা নজর দেয়নি অবন্তীর দিকে। সে ভেবেছিল অবন্তী হার মেনে নিয়েছে। কিন্তু এখন ঘরে ঢুকে দেখা গেল অবন্তী কোথাও নেই। বারান্দা, বাথরুম সব জায়গায় খোঁজা হলো। ঘরের প্রতিটি কোণা তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও অবন্তীর হদিশ পাওয়া গেল না। বিলকিসের মাথায় বাজ পড়ল। সাথে সাথে মিরাজ উদ্দিনকে ফোন করে অফিস থেকে ফিরে আসতে বলল। তারপর দু’জন মিলে বের হলো অবন্তীকে খুঁজতে। তারা নিশ্চিত ছিল অবন্তী হেলেনের শ্বশুরবাড়িতেই যাবে। কারণ সেখানে নিশান্ত আছে। বিলকিস আর মিরাজ উদ্দিন সেদিকেই রওনা হলো। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। পৌঁছাতে সারারাত লেগে যাবে হয়তো। বিলকিস অবন্তীকে মনে মনে বকতে লাগল। ঠিক রাত বারোটায় তাদের প্রতিবেশী ফোন করে জানাল, অবন্তী বাড়ি ফিরে এসেছে। বিলকিসও মিরাজ উদ্দিনকে নিয়ে দ্রুত ফিরে এলো। দরজার কাছে অবন্তীকে দাঁড়ানো দেখেই সবার আগে বিলকিস ঠাসিয়ে দু’টো চড় দিল। তারপর চুলের মুঠি ধরে প্রশ্ন করল,

” কোথায় গেছিলি? সত্যি কথা বল!”

অবন্তী ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,” নিশান্তর সাথে দেখা করতে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা নাকি গতরাতে কানাডা চলে গেছে। দেখা হয়নি।”

অবন্তীর কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে মার খেয়ে নয় বরং নিশান্তর সাথে দেখা হয়নি বলেই তার যত দুঃখ। বিলকিস আরও কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে অবন্তীকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। আশেপাশে মানুষ জমে গিয়েছিল। সবাই দেখছিল অবন্তীর মার খাওয়ার দৃশ্য। বিলকিস অবন্তীকে হাত-পা বেঁধে ঘরে বন্দী করে রাখল। যদিও সে জানতো অবন্তী এখন আর পালাবে না। কারণ নিশান্ত চলে গেছে। তবুও সে হাত-পা বাঁধার কান্ডটা করল শুধুই অবন্তীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। মিরাজ গম্ভীর মুখে বললেন,” বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না বিলকিস? মেয়েটা এমনিতেই কত কষ্ট পাচ্ছে। ওকে ছেড়ে দাও।”

বিলকিস কড়া গলায় বলল,” কোনো বাড়াবাড়ি হয়নি। সব একদম ঠিকাছে। যেই মেয়ে বাসা থেকে পালাতে পারে প্রেমিকের সাথে দেখা করার জন্য সে আরও অনেক কিছুই করতে পারে। এখনি এই মেয়েকে না থামালে সে বড় সর্বনাশ ঘটাবে। আর তোমার কি মনে হয়? রিমার ছেলে ওকে জীবনে বিয়ে করবে?”

মিরাজ আশাহত কণ্ঠে বললেন,” তা মনে হয় না। কিন্তু মেয়ে তো আমাদের। সে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছে। মা হিসেবে তোমার উচিৎ ওকে বোঝানো। এইভাবে শাস্তি দিলে কি সমস্যার সমাধান হবে?”

” হবে। অবশ্যই হবে। অনেক বুঝিয়েছি তোমার মেয়েকে আমি। অসংখ্যবার সাবধান করেছি। কিন্তু ও আমার কথা শোনেনি। নিজের বড় সর্বনাশ না ঘটিয়ে ও ছাড়বে না। ওর জন্য এমন শাস্তিই ঠিকাছে।”

অবন্তীকে সারাদিন খাবার দেওয়া হলো না। সে পানি পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। রাতে বিলকিস নিজে অবন্তীর জন্য খাবার নিয়ে এলো। জোর করে অবন্তীকে খাওয়াতে গেলে সে বমি করে সারা ঘর ভাসিয়ে দিল। তারপরের কিছুদিন অবন্তীর প্রচন্ড জ্বর গেল। শরীর অত্যন্ত দূর্বল। বিছানা ছেড়েই উঠতে পারে না। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে শুধু একটা নাম আওড়ায়,” নিশান্ত, নিশান্ত, নিশান্ত।”

বিলকিস দিশেহারার মতো হয়ে গেল। একমাত্র মেয়ের এই দূরাবস্থায় তাকে সুস্থ করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ালো। অবশেষে নিজের মান-সম্মান বিসর্জন দিয়ে, মুখ ছোট করে, এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিশান্তর সাথে যোগাযোগ করল বিলকিস। মোবাইলে ইন্টারনেট রিচার্জ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় হেলেনের একাউন্ট থেকে নিশান্তর আইডি নিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করল। নিশান্তকে সহজেই পাওয়া গেল। বিলকিস প্রথমে অবন্তীর অসুস্থতার কথা জানাল। তারপর একফাঁকে জিজ্ঞেস করল,

” তুমি অবন্তীর ব্যাপারে কতটুকু সিরিয়াস? ওকে বিয়ে করতে চাও?”

নিশান্ত বলল,” হ্যাঁ চাই।”

” ভেবে বলছো? তোমার পরিবার কখনও এই সম্পর্ক মানবে না সেটা জানো?”

” জানি।”

” তাও কিভাবে এমন কাজ করলে তোমরা? অবন্তী না হয় ছোটমানুষ। কিন্তু তুমি তো বড়। তোমার তো বোঝা উচিৎ ছিল তাই না?”

” আন্টি আমি কি অবন্তীর সাথে দেখা করতে পারি?”

” সেটা কিভাবে সম্ভব? তুমি কোথায় আর ও কোথায়? দেখা কিভাবে হবে?”

” আপনি বললে আমি আসব।”

” এখানে আসতে চাও? ঠিকাছে, তোমার ইচ্ছা। আমার দিক থেকে কোনো নিষেধ নেই। আমি শুধু চাই আমার মেয়েটা সুস্থ হয়ে উঠুক।”

কানাডা থেকে বাংলাদেশে হুট করে চলে আসা সহজ ব্যাপার না। তাই বিলকিস অনুমতি দিয়েছিল। সে শুধু দেখতে চাইছিল যে নিশান্ত কি করে! দুইদিন কেটে গেল। নিশান্তর কোনো খোঁজ নেই। বিলকিস ধরেই নিয়েছিল যে সে আসবে না। কিন্তু বিলকিসকে অবাক করে দিয়ে তৃতীয় দিনের মাথায় নিশান্ত হাজির হলো।

চলবে

#অন্তহীন_বসন্ত ~ ২৬
লিখা- Sidratul Muntaz

যে জ্বরের তোপে অবন্তী বিছানা ছেড়েই উঠতে পারছিল না; নিশান্তকে দেখে মুহূর্তেই তার সেই জ্বর ভালো হয়ে গেল। গা ঝাড়া দিয়ে সুস্থ মানুষের মতো হাঁটা-চলা করতে লাগল। এই কয়দিন বিলকিস তার মুখে একফোঁটা হাসি দেখেনি। অথচ নিশান্ত বাড়িতে পা রাখা মাত্রই অবন্তীর হাসির শব্দে ঘরে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। যেন উৎসব লেগেছে কোনো। রান্নাঘরে দাঁড়িয়েও বিলকিস শুনতে পাচ্ছে অবন্তীর হাসির শব্দ, কথা-বার্তা। অথচ এই মেয়ে গতকালও অস্পষ্ট স্বরে কথা বলছিল। তার কথা বোঝার জন্য মুখের কাছে কান পেতে দিতে হচ্ছিল। নিশান্তর গলার আওয়াজ পাওয়া না গেলেও অবন্তীর উচ্চস্বরের হাসির আওয়াজ ঠিক পাওয়া যাচ্ছে। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বিলকিস। ঘরে তেমন কিছু নেই। নিশান্ত হুট করে চলে আসবে সে ভাবেওনি। ছেলেটাকে এখন কি খেতে দেওয়া যায়?

অবন্তী আগে মন-প্রাণ ভরে নিশান্তকে দেখল। নিশান্ত বলল,” শুনলাম তুমি নাকি খুব অসুস্থ? ডাক্তার দেখিয়েছো?”

অবন্তী খুশি খুশি কণ্ঠে বলল,” দেখিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার কিছু করতে পারেনি। আমার অসুস্থতা তো শরীরের না, মনের। মন সুস্থ হলেই শরীর অটোমেটিক সুস্থ হয়ে যাবে।”

” তাহলে কি এখন মন সুস্থ হয়েছে?”

” তোমাকে দেখার পর সুস্থ না হয়ে কোথায় যাবে বলো?”

অবন্তী তৃষ্ণার্তের মতো নিশান্তর হাত দু’টি চেপে ধরল। নিশান্ত অবন্তীর হাত মুঠোয় নিয়ে প্রতিটি আঙুলে চুমু দিতে দিতে বলল,”আই এম স্যরি অবন্তী। সেদিন তোমাকে না বলেই চলে যেতে হয়েছিল। বাড়ি ফেরার পর আম্মুর কাছে ধরা খেয়ে গেলাম। আর আম্মুকে তো তুমি চেনোই। আমার ফোন সিস্ট করে রাখল। কানাডায় না ফেরা পর্যন্ত ফোন আর ফেরত পাইনি। কিন্তু আমি নিয়ন ভাইয়ার ফোন থেকে তোমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম। আন্টির জন্য পারিনি। প্রত্যেকবারই ফোন আন্টি ধরেছিল। আমি কথা না বলে কেটে দিয়েছি। যাওয়ার আগেও তোমাকে জানাতে পারিনি। তুমি আমার টেনশনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে তাই না?”

অবন্তী মুখ মলিন করে বলল,” ছাড়ো সেসব কথা। তুমি তো এখন চলে এসেছো। আমি অনেক ভালো আছি। দেখেছো, আমার মা আমাকে কত্ত ভালোবাসে! আমাকে সুস্থ করার জন্য তোমাকে ফোন করে এখানে নিয়ে এলো।”

” আন্টি ফোন না করলেও আমি কয়েকদিনের মধ্যে এমনি চলে আসতাম। ওইখানে মন টিকছিল না একদম। তোমার কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না যে!”

অবন্তী টলমল চোখে তাকিয়ে বলল,” তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো তাই না?”

” হুম৷ আর আন্টিও তোমাকে অনেক ভালোবাসে।” তারপর সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আই উইশ, আম্মুও আমাকে এতোটা ভালোবাসতো। তাহলে কোনো প্রবলেমই হতো না।”

” ধূর, এসব কেন বলছো? রিমা আন্টিও তোমাকে ভালোবাসে। আসলে কি বলোতো, আমার মতো অযোগ্য মেয়েকে মেনে নেওয়া একটু কঠিনই তো বটে। তাই উনি এমন করছেন।”

” প্লিজ, এসব কথা আর কখনও বলবে না। তুমি কোন দিক দিয়ে অযোগ্য? আমার কাছে তোমার চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই।”

এই পর্যায় বিলকিস ঘরে ঢুকল নাস্তার ট্রে নিয়ে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রথমে একটু কাশি দিল। অবন্তী লজ্জা পেয়ে দ্রুত নিশান্তর হাত ছেড়ে দিল। নিশান্তও অপ্রস্তুত হয়ে দূরে গিয়ে বসল। বিলকিস ঢুকতে ঢুকতে রাশভারী কণ্ঠে বলল,” কেমন আছো নিশান্ত?”

” এইতো আন্টি। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

” আমি কেমন আছি সেটা তো তুমি জানোই৷ তোমার বাসার সবাই জানে তো তুমি যে বাংলাদেশে এসেছো?”

নিশান্ত বিব্রতস্বরে বলল,” না।”

বিলকিস হতাশ সুরে বলল,” তাহলে? কি বলে বের হয়েছো? নাকি তুমিও অবন্তীর মতো পালিয়ে এসেছো বাসা থেকে? ”

নিশান্ত ভ্রু কুচকে অবাক হয়ে বলল,” অবন্তীর মতো মানে? অবন্তী বাসা থেকে পালিয়েছিল নাকি?”

অবন্তী অসহায় দৃষ্টিতে বিলকিসের দিকে তাকাল। যাতে বিলকিস সেদিনের ঘটনা না বলে। কিন্তু বিলকিস বলে দিল,” হুম। তোমরা কানাডা চলে যাওয়ার পরদিনই পালিয়েছিল। তোমার সাথে দেখা করার জন্য একা একা নারায়ণগঞ্জ গিয়ে ফিরে এসেছে।”

বিলকিস কথা শেষ করে শক্ত চোখে অবন্তীর দিকে তাকিয়ে রইল। নিশান্ত হতবাক। অবন্তী অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে রইল। নিশান্ত বলল,” এরকম কেন করলে অবন্তী? যদি কোনো বিপদ হতো?”

অবন্তী উত্তর দিল না। তখন কি এতো বিপদ নিয়ে ভাবার সময় ছিল? তার অবস্থা হয়েছিল বিশাল সমুদ্রে তীর হারা নাবিকের মতো। বিলকিস ঠিক অবন্তী আর নিশান্তর মাঝে একটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর জেরা করার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল,” কি ঠিক করলে তোমরা? এভাবেই কি চলবে? তোমাদের এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সেটা তোমরা দু’জনেই জানো। তবুও সম্পর্কে জড়ালে কি ভেবে? কিসের আশায়?”

অবন্তী চুপ করে রইল। তার এখন একটু ভয় ভয় লাগছে। মা আবার নিশান্তকে বকবে না তো? বেচারা এতো দূর থেকে কষ্ট করে এসে কি বকা খাবে শেষমেষ? নিশান্ত শুকনো গলায় বলল,” আমি এখনও কিছু ভাবিনি আন্টি। কিন্তু আপনি বললে আমি আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলব। তারা যদি না মানে তাহলে আমি দেশে চলে আসব। কোনো বিজনেস অথবা জব করব। তারপর অবন্তীকে বিয়ে করব।”

বিলকিস মৃদু হাসল। বলল,” এখনি তোমাকে কিছু করতে হবে না। কারণ আমি আমার একমাত্র মেয়েকে এতো দ্রুত বিয়ে দেব না। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে রাখা ভালো। তুমি যদি মনে করো তোমার আব্বু-আম্মুকে রাজি করাতে পারবে তাহলে খুবই ভালো। যদিও আমার তা মনে হয় না। তোমার আব্বুর কথা জানি না। কিন্তু তোমার আম্মুকে আমি যতদূর চিনি.. সে জীবনেও অবন্তীকে মানবে না। আর আমিও আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ কোনো অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে চাই না। এমন কোনো ঘরে তাকে পাঠাতে পারব না যেখানে তার সুখ-শান্তি নিয়ে চিন্তায় থাকতে হবে। আর আমি অবশ্যই এটাও চাই না যে তুমি অবন্তীর জন্য নিজের ফ্যামিলি ছেড়ে আসো। তুমি তাদের একমাত্র সন্তান। আমি নিজের মেয়ের সুখের জন্য মা-বাবার কাছ থেকে তাদের সন্তান কেঁড়ে নিতে পারব না। এতো স্বার্থপর না আমি।”

অবন্তী আর নিশান্ত চুপ করে শুনছে। অবন্তীর মুখ ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে মা এখন খুব কঠিন কিছু কথা শোনাবে। যা মেনে নেওয়া তার এবং নিশান্ত দু’জনের জন্যই খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। অবন্তীর ধারণাকে সত্যি করে বিলকিস এবার বলল,

” তাও যদি তোমরা চাও সম্পর্কে রাখতে তাহলে আমি তোমাদের সাপোর্ট করব। কিন্তু তার আগে আমার কথা তোমাদের মানতে হবে।”

নিশান্ত এবার মাথা তুলে তাকাল। সপ্রশ্নে বলল,” কি কথা আন্টি?”

” আমি কিছু শর্ত দিবো। শর্তগুলো যদি ঠিকঠাক পালন করতে পারো তাহলে কথা দিলাম আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। আর না পারলে নিশান্ত তুমি এখনি এখান থেকে চলে যাবে। আর কখনও অবন্তীকে চোখে দেখবে না।”

নিশান্ত বিপন্ন কণ্ঠে বলল,” আমি সব শর্ত মানতে রাজি আন্টি।”

বিলকিস হেসে জিজ্ঞেস করল,” শর্ত না শুনেই রাজি?”

নিশান্তকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। বিলকিস হালকা গলায় বলল,” আচ্ছা শোনো, প্রথম শর্ত হলো এখন থেকে তোমরা দু’জনই মন দিয়ে পড়াশুনা করবে আর ক্যারিয়ারে ফোকাস করবে। দ্বিতীয় শর্ত, দিনে সর্বোচ্চ একবার ফোনে কথা বলা যাবে কিন্তু প্রতিদিন নয়। আর‍ যখন তুমি অবন্তীর সাথে ফোনে কথা বলবে তখন আমি থাকব সামনে। তৃতীয় শর্ত, যেটা সবচেয়ে কঠিন। তোমাদের কাছে থাকবে পাঁচবছর সময়। এই পাঁচবছরে তোমরা একদমই দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবে না। শুধু মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলার মাঝেই তোমাদের সম্পর্ক সীমাবদ্ধ থাকবে। আর নিশান্ত, তোমার জন্য এই সময়টুকু একটা চ্যালেঞ্জের মতো হবে। এর মধ্যেই নিজেকে তোমার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আর তোমার বাবা-মাকেও রাজি করাতে হবে। যদি তারা অবন্তীকে মানতে রাজি হয় তবেই কেবল পাঁচবছর পর তোমাদের বিয়ে সম্ভব। এই সবগুলো শর্ত যদি পূরণ করতে পারো তাহলে বেস্ট অফ লাক। আর নাহলে তোমাদের সম্পর্ক আজকে, এই মুহূর্তে এখানেই শেষ করে দিতে হবে। বলো, রাজি আছো তোমরা?”

অবন্তী প্রায় সাথে সাথেই বলল,” আমি একদম রাজি না।”

বিলকিস বড় বড় চোখে অবন্তীর দিকে তাকাল। সেই মুহূর্তে নিশান্ত বলল,” আমি সব শর্তে রাজি।”

বিলকিস নিরুত্তাপ গলায় বলল,” ভেরি গুড।”

অবন্তী ফুঁসে উঠে বলল,” পাগল হয়ে গেছো? পাঁচবছর দেখা না করে থাকার মানে বোঝো? আর তোমার মা কোনোদিন রাজি হবে না সেটা তো তুমি জানোই। তাও কেন চ্যালেঞ্জ নিচ্ছো নিশান্ত?”

অবন্তীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিশান্ত বিলকিসের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল,” আর যদি আমি পাঁচবছরের আগেই সব শর্ত পূরণ করতে পারি?”

বিলকিস শ্রাগ করে বলল,” তাহলে তো আরও ভালো। আমার কোনো প্রবলেম নেই। আমি শুধু আমার মেয়েকে সুখে দেখতে চাই।”

অবন্তী কাতর গলায় অনুরোধ করল,” প্লিজ মা, এতো নিষ্ঠুর হয়ো না। আমরা অন্তত ছয়মাসে একবার দেখা করব। প্লিজ!”

বিলকিস কঠিন গলায় বলল,” একদম না। আমি যখন বলেছি দেখা-সাক্ষাৎ চলবে না মানে চলবেই না। এমনও হতে পারে যে তোমাদের এই অনুভূতি শুধুই আবেগ। কোনো ভালোবাসা না। বছরের পর বছর দেখা না করে থাকলে তোমরা হয়তো একে-অপরকে ভুলে যাবে।”

অবন্তী আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” এটা কখনোই হবে না।”

” না হলে তো ভালোই। তোমাদের ভালোবাসা কতটা পিউর সেটাও প্রমাণ হয়ে যাবে। ”

অবন্তীর হাউমাউ করে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে। নিশান্ত বলল,” আন্টি আমি কি অবন্তীকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেতে পারি?”

” বাইরে মানে? কোথায়?”

” পাঁচবছর ধরে দেখা হবে না। তাই আজকে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা আমরা একসাথে কাটাই? এটা আমার আবেদন।”

বিলকিস নিরস গলায় বলল,” পাঁচঘণ্টা না। কিন্তু একঘণ্টা সময় দিতে পারি। দূরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।”

নিশান্ত উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল,” থ্যাঙ্কিউ আন্টি। আপনি অনেক ভালো। ”

বিলকিসের হাসি পেলেও হাসল না। চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথেই অবন্তী নিশান্তর বাহুতে সজোরে আঘাত করে বলল,” তুমি এটা কি করলে? কেন রাজি হলে? সত্যিই কি পাঁচবছর আমরা দেখা না করে থাকব? পারবে তুমি থাকতে? বুঝেছি তুমি আমাকে একদমই ভালোবাসো না। কারণ ভালোবাসলে কখনও এমন শর্তে রাজি হতে না।”

অবন্তীর বকবকানি থামাতে নিশান্ত তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। আসক্ত কণ্ঠে বলল, ” শশশ, আর কখনও এটা বলবে না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”

চলবে