#অন্তহীন_বসন্ত~৩১
লিখা- Sidratul Muntaz
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিলকিস বাড়িতে নেই। জেসমিন বেগম খুবই অসুস্থ৷ দেখা-শোনার জন্য বিলকিস টাঙ্গাইল গেছে। টাঙ্গাইলে অবন্তীর নানুবাড়ি। জেসমিন বেগম বিলকিসের নানী। মায়ের অনুপস্থিতিতে ঘরের সব কাজ অবন্তীকেই সামলাতে হচ্ছে। কিন্তু ইদানীং অবন্তীর কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না। মা থাকলে ঘর-দোর ঝকঝকে পরিষ্কার করে রাখতো। এখন সবকিছু নোংরা- অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে। অবন্তীর কিছু করতে ভালো লাগে না। পড়াশুনাতেও তেমন মন নেই। আইসিটিতে খারাপ রেজাল্ট করায় সেদিন ল্যাবে নিয়ে ইব্রাহীম স্যার একঘণ্টা কথা শোনালেন। বায়োলজি পরীক্ষায় অবন্তী একটা শব্দও লেখেনি। তবুও দয়া করে স্যার এক মার্ক দিয়েছেন। যখন ক্লাসে সবার সামনে খাতা ডিস্ট্রিবিউশন হচ্ছিল আর মার্কস বলা হচ্ছিল তখন মফিজ স্যার উচ্চস্বরে অবন্তীর নাম ধরে ডাকলেন,” অবন্তী, তুমি খুবই ভালো রেজাল্ট করেছো। একেবারে একশোতে একশো পেয়েছে। শুধু দুইটা শূন্য নেই। মানে এক।”
সবাই হেসে উঠল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে অবন্তীও হেসে উঠল। কারণ সে খাতায় কিছুই লেখেনি।তার শূন্য পাওয়া উচিৎ ছিল। তাও সে এক পেয়েছে। এটা তো খুশির সংবাদ। অবন্তী হাসিমুখে খাতা আনতে গেল। মফিজ স্যার বললেন,” এই প্রথম কোনো স্টুডেন্ট দেখলাম যে ১ পাওয়ার পরেও দাঁত বের করে হাসছে। ”
সবাই আবার হেসে উঠল। এবার অবন্তী বুঝল তাকে অপমান করা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা তার গায়েই লাগল না। কারণ সে একদম পড়াশুনা করেনি। যদি করতো তাহলে নিঃসন্দেহে ভালো মার্কস পেতো। অবন্তী ছাত্রী হিসেবে খারাপ না। এসএসসি’তে গোল্ডেন পেয়েছিল। কিন্তু এখন তার কি যেন হয়েছে। একদম পড়াশুনা করতে মন চায় না। বিলকিস ফিরলেন পনেরো দিন পর। ঘরের অবস্থা দেখে তার মাথায় হাত৷ অবন্তী ঘরটাকে গোরস্থান বানিয়ে রেখেছে। বিলকিস ফিরেই ঘর পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ল। নোংরামি সে একদম দেখতে পারে না। কলেজ থেকে এসে মাকে পেয়ে অবন্তী জড়িয়ে ধরল। বিলকিস হাসফাস করে বলে উঠলেন,” ছাড়তো, এই তোর এই অবস্থা কেন?”
অবন্তী হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,” কি অবস্থা?”
” তোর গলা, ঘাড়, এমন ফুলে যাচ্ছে কেন? তুই তো মোটা হয়ে যাচ্ছিসরে মা।”
অবন্তী অবিচলিত গলায় বলল,” কোথায়?”
” আয়নায় গিয়ে নিজের চেহারা দ্যাখ! কি অবস্থা হয়েছে। কাল থেকে ডায়েটিং শুরু করবি।”
অবন্তী বুঝতে পারল না মা তাকে দেখে এমন কেন বলছে? রাতে খেতে বসে বিলকিস খেয়াল করল অবন্তী আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। মিরাজ উদ্দিন মেয়ের নামে বিচার দিলেন।
” তোমার মেয়ে সারাক্ষণ শুয়ে-বসে থাকে। আমি একটু চা দিতে বললেও রেগে যায়। পরে নিজেকেই বানিয়ে খেতে হয়। মাঝে মাঝে তো রান্না করতেও ভুলে যায়। আমি অফিস থেকে এসে রান্না করি।”
বিলকিস অবাক হয়ে বলল,” কি আশ্চর্য! রান্না করতে ভুলে গেলে ও কি খায়?”
মিরাজ উদ্দিন বললেন,” তোমার মেয়ের তো এখন নতুন অভ্যাস তৈরী হয়েছে। প্রতিদিন সকালে উঠে আমার থেকে টাকা নিবে। তার নাকি ঘরের খাবার ভালো লাগে না। বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে। রোজই তার কিছু না কিছু খেতে ইচ্ছে করে।”
বিলকিস দেখল অবন্তী মুঠো ভরে শুধু ভাত নিচ্ছে। তার প্লেট দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। বিলকিস বিস্মিত গলায় বলল,” এসব কি অবন্তী? তুই এতো ভাত নিচ্ছিস কেন? এজন্যই তো তোর চেহারার এই অবস্থা! দিন দিন বেলুনের মতো ফুলছিস।”
অবন্তী রাগ দেখিয়ে বলল,” ছিঃ, মা হয়ে তুমি আমার বডি শেমিং করছো?”
” মায়েরা বডি শেমিং করলে সেটাকে বডি শেমিং বলে না। কেয়ারিং বলে। তোর গাল দু’টো দেখেছিস তুই? একদম আলুর মতো লাগছে।”
” মা! আমি খাবোই না ধ্যাত।”
অবন্তী প্লেট রেখে উঠে চলে গেল। বিলকিস হাঁ করে তাকিয়ে থেকে মিরাজ উদ্দিনকে বলল,” কি হয়েছে?”
মিরাজ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন,” আমিও ওকে কিছু বলে শান্তি পাই না। হুটহাট রেগে যায়। একটু পরেই দেখবে আবার খেতে এসেছে। না খেয়ে ও থাকতে পারে না। আগে আমাদের এক পট চালেই হয়ে যেতো। কিন্তু এখন চাল লাগে দেড় পট।”
বিলকিস রাগী স্বরে বলল,” ছি, বাবা হয়ে মেয়ের খাওয়ার হিসাব করছো? আমি বললাম দেখে তুমিও বলবে?”
” আরে আমিও কি এতো মিন করে বলেছি? আমার সব রোজগার তো ওর জন্যই করি। ও না খেলে আর কে খাবে বলো?”
রাতে বিলকিসের ঘুমটা ভেঙে গেল খটরখটর শব্দে। শব্দটা আসছিল রান্নাঘর থেকে। প্রথমে বিলকিস ভাবল ইঁদুর। তাই খুব একটা পাত্তা দিল না। কিন্তু একটু পরেই বুঝল ইঁদুর নয়। রান্নাঘরে মানুষ আছে৷ কারণ ফ্রীজ খোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বিলকিস উঠে বসল। ধীরপায়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখল অবন্তী সিংকের উপর পা তুলে বসে আচারের বয়মে আঙুল ডুবিয়ে খাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠল বিলকিস। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল অবন্তীর কান্ড। তারপর ঘুমাতে চলে গেল।
___________
সকালে অবন্তী তৈরী হচ্ছিল কলেজে যাওয়ার জন্য। বিলকিস এসে বলল,” শোন তোকে আজ কলেজে যেতে হবে না।”
” কেন মা?”
” আজকে আমার একটা কাজ আছে। তোকে নিয়ে আমি আমার ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো।”
” তোমার ফ্রেন্ডের বাসায় যাওয়ার জন্য আমি কলেজ মিস দিবো নাকি? আশ্চর্য!”
বিলকিস কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। কঠিন গলায় বলল,” এমন করে বলছিস যেন পড়াশুনার ব্যাপারে কত সিরিয়াস তুই? তোর রেজাল্ট কার্ড তো আমি দেখেছি। বায়োলজিতে মাত্র এক পেয়েছিস৷ আর আইসিটিতে মনে হয় স্যার তোকে দয়া করে পাশ মার্ক দিয়েছেন।”
অবন্তী ইতস্তত গলায় বলল,” এবার প্রশ্ন খুব কঠিন এসেছিল তাই…নেক্সট এক্সামে ভালো করার চেষ্টা করব।”
” দেখা যাবে। এখন যা বলছি তাই কর। কলেজ যেতে হবে না। তোর বাবা অফিসে চলে গেলেই আমরা বের হবো।”
অবন্তী ওয়েটিংরুমে বিলকিসের সাথে বসে আছে৷ তার খুব ক্ষিদে পাচ্ছে। কাতর গলায় বলল,” আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকব মা? আমার তো ক্ষিদে পেয়ে যাচ্ছে।”
বিলকিস চোখ বড় করে বলল,” এক ঘণ্টা আগেই না বাসা থেকে তিনটা পরোটা খেয়ে এলি? এখন আবার ক্ষিদে পাচ্ছে কেন? তোর পেটে কি রাক্ষস ঢুকেছে?”
কথাটা বিলকিস একটু বেশিই জোরে বলে ফেলেছিল। ওয়েটিংরুমে যারা ছিল প্রায় প্রত্যেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অবন্তী লজ্জা পেয়ে গেল। বিলকিস ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে বলল,” নিচে ক্যান্টিন আছে। যা কিছু একটা খেয়ে আয়।”
অবন্তী সাথে সাথে খুশি হয়ে বলল,” থ্যাঙ্কিউ মা।”
বিলকিস ভ্রু কুচকে তাকাল। আজ-কাল খাওয়ার কথা শুনলেই অবন্তী খুব খুশি হয়ে যায়। ক্যান্টিন থেকে বার্গার নিয়ে এসে অবন্তী খেতে শুরু করল। একটা বাচ্চা মেয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার খাওয়া দেখছিল। অবন্তী দ্রুত অন্যদিকে ঘুরে গেল। বিলকিস বলল,” কি হয়েছে?”
” ওই মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে মা। যদি নজর লাগিয়ে দেয়?”
বিলকিস হাসতে হাসতে বলল,” ওরও মনে হয় খেতে ইচ্ছে করছে। ওকে ডেকে একটু হাতে দিয়ে দে না!”
অবন্তী বাচ্চাদের মতো জেদ করে বলল,” না। আমার খাবার ওকে কেন দিবো? আমার কম পড়ে যাবে।”
বিলকিস আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। অবন্তী বার্গারে সস ঢালতে ঢালতে বলল,” আচ্ছা মা, তোমার ফ্রেন্ডের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল না? তাহলে আমরা হসপিটালে কেন এলাম?”
বিলকিস ঠান্ডা স্বরে বলল,” আমার কিছু চেকাপ করাতে হবে সেজন্য।”
একটু পর ডাক্তারের একজন এসিস্ট্যান্ট এসে ডাকল,” এখানে বিলকিস রহমান কে আছেন?”
” জ্বী, আমি।”
” প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাবেন তাই না?”
” জ্বী।”
” আসুন।”
অবন্তীর বুক ধ্বক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। অতিরিক্ত উত্তেজনায় সামান্য বিষমও খেল। বিলকিস মেয়ের মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে বলল,” আয় আমার সাথে।”
অবন্তী দ্রুত টিস্যুতে হাত মুছে মায়ের পেছন পেছন গেল। ফিসফিসিয়ে বলল,” মা, তুমি কনসিভ করেছো নাকি? আল্লাহ, আগে বলবে না এই কথা? বাবা জানে?”
বিলকিস আগুন গরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” আমার না, তোর প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাতে এখানে এসেছি।”
এই কথা শুনে অবন্তীর হিঁচকি উঠে গেল। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। স্থানুবৎ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বিলকিস হাত ধরে টেনে অবন্তীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ডাক্তারের চেয়ারে বসে আছে নাজমা। বিলকিসের কলেজ জীবনের বান্ধবী ছিল সে। অবন্তী তাকে খুব ভালো করেই চেনে। কিন্তু মা তার কাছে কেন নিয়ে এলো অবন্তীর প্রেগন্যান্সি টেস্ট করানোর জন্য? কি লজ্জা! অবন্তীর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপছে। সে মাথা তুলে তাকাতেও পর্যন্ত পারছে না। নাজমা বলল,” বিলকিস, কি অবস্থা?”
” ভালো নাজমা। তুই কেমন আছিস?”
” চলছে মোটামুটি… ব্যস্ত জীবন আমার। অবন্তী, কেমন আছো মা?”
অবন্তী জবাব দিল না। মৃদু হাসল কেবল। ভয়ে একবার হাত-পা জমে যাচ্ছে তো আরেকবার আতঙ্কে কপাল থেকে ঘাম ঝরে যাচ্ছে। মা এটা কি করল তার সাথে? আগে বুঝলে অবন্তী জীবনেও এখানে আসতো না। তার ইচ্ছে করছে ছুটে পালাতে। নাজমা হাসিমুখে বলল,
” তারপর কি অবস্থা? প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাবি?”
” হুম। কিন্তু আমার না, আমার মেয়ের। ”
অবন্তী সঙ্গে সঙ্গে মাথা নুইয়ে ফেলল। নাজমা হতবাক চিত্তে বলল,” ওমা, অবন্তীর বিয়ে হলো কবে?”
” এইতো, কিছুদিন আগে।” কথাটা বলেই কড়া দৃষ্টিতে অবন্তীর দিকে তাকাল বিলকিস। এদিকে অবন্তী পারছে না শুধু আঁচল দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে রাখতে। নাজমা হকচকিয়ে বলল,” এতো দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিলি? এই বয়সে প্রেগন্যান্সি তো খুব রিস্কি।”
বিলকিস বলল,” আমি এখনও শিউর না। আগে পরীক্ষা করে দেখি। আশা করি রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে। তাই না অবন্তী?”
অবন্তীর পা কাঁপছে। কাঁপা গলায় বলল,” হ্যাঁ। ”
নাজমা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,” চলো অবন্তী, ওই বেডটায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ো।”
অবন্তী নিঃশব্দে আদেশ পালন করল। নাজমা কিছুক্ষণ অবন্তীর চেকাপ করল। চলে আসার সময় বিলকিস জানতে চাইল,” রিপোর্টটা কখন পাওয়া যাবে?”
নাজমা জিজ্ঞেস করল,” বেশি ইমারজেন্সী?”
” হ্যাঁ। ”
” ঠিকাছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে রেডি করে দিবো। তোর আসার দরকার নেই। আমি একদম আমার এসিস্ট্যান্টকে দিয়ে তোর বাড়িতেই পাঠিয়ে দিবো।”
” থ্যাঙ্কিউ দোস্ত।”
অবন্তী বিলকিসের সাথে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলো। পথে কেউই কোনো কথা বলল না। বাড়িতে যাওয়ার পরেও বিলকিস এই প্রসঙ্গ নিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। অবন্তীও কিছু বলার সাহস পায়নি। পরদিন রিপোর্ট পাওয়া গেল। অবন্তীকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ফাইলটা তার হাতে ধরিয়ে দিল বিলকিস। অবন্তী খুলে দেখল রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। যা ভেবেছিল তাই হলো! বিলকিস দরজা বন্ধ করেই অবন্তীর গালে কষিয়ে একটা চড় মারল। অবন্তী কথা বলল না। চোখ ছাপিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল শুধু।
বিলকিস অবন্তীর মুখোমুখি বসে থমথমে গলায় প্রশ্ন করল,” এখন বল, এসব কিভাবে হলো?”
অবন্তী কথা বলতে পারছে না। গলায় কিছু একটা বিঁধে আছে যেন৷ বিলকিস কপট স্বরে জানতে চাইল,” আমি যখন ছিলাম না তখন নিশান্ত বাসায় এসেছিল তাই না?”
অবন্তী দুইপাশে মাথা নাড়ল। বিলকিস বলল,” তাহলে?”
অবন্তীর মাথাটা নিচু হতে হতে থুতনি একদম বুকের সাথে লেগে গেছে। আড়ষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আমি গিয়েছিলাম ওর রিসোর্টে।”
” কয়বার গিয়েছিস?”
অবন্তীর কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। চোখ থেকে অনর্গল পানি পড়ছে। বিলকিস পুনরায় হাত উঠিয়ে বলল,” কথা বল নাহলে আরেকটা থাপ্পড় খাবি। তোকে জ*বাই করে ফেলতে মন চাইছে আমার।”
অবন্তী কাঁদতে কাঁদতে সবকিছু স্বীকার করল৷ তারা প্লেনে করে কক্সবাজার গিয়েছিল সেই কথাও জানাল। বিলকিস সবকিছু শুনে মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। অবন্তী কাঁদতে থাকল ফুঁপিয়ে। একটু পর বিলকিস বলল,” কিভাবে করলি এই কাজটা? একবারও কি আমাদের কথা মনে হয়নি তোর? আর করেছিসই যখন এই সর্বনাশ কেন ঘটালি? প্রটেকশন বলে কি পৃথিবীতে কিছু নেই?”
অবন্তী অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল। নিজের মায়ের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে চরম বিতৃষ্ণা কাজ করছে। কিন্তু উপায় নেই। বিলকিস মেজাজ খারাপ করে বলল,” তুই না হয় জন্মের বোকা। কিছু বুঝিস না। তাই বলে কি নিশান্তও বোঝে না? সে কিভাবে এই কাজ করল? ছেলে মানুষ এতো হাঁদা হয়?”
অবন্তী নিচু গলায় বলল,” ও আমাকে ঔষধ কিনে দিয়েছিল। কিন্তু আমি খাইনি।”
” খাসনি কেন?”
” মনে ছিল না।”
বিলকিস অবন্তীকে সাথে সাথে আরেকটা চড় মারল। অবন্তী বিছানায় উল্টে পড়ে গেল। তার গাল গরম হয়ে উঠল। একহাত গালে ঠেঁকিয়ে কাঁদতে লাগল সে। বিলকিস উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,” এখনি নিশান্তকে ফোন কর। আর এই ঘটনা জানা। তোকে আমি দুইদিনের বেশি বাসায় রাখতে পারব না। ওকে বলব তোকে যাতে এসে নিয়ে যায়। ফোন লাগা দ্রুত।”
অবন্তী মোবাইল হাতে নিল। নিশান্তর নাম্বার ডায়াল করল। অনেকক্ষণ রিং বেজে কেটে গেল। অবন্তী বলল,” ফোন ধরছে না।”
বিলকিস স্পষ্ট গলায় বলল,” যখনি ধরবে তখনি আমার কাছে এনে দিবি। মনে থাকবে?”
অবন্তী মাথা নাড়ল। বিলকিস বের হয়ে যেতেই অবন্তী আবার ফোন করতে লাগল নিশান্তকে। কিন্তু নিশান্ত কিছুতেই ফোন ধরছে না। তাকে গুড নিউজটা জানাবে কিভাবে অবন্তী? অবশ্য এটা এখন আর গুড নিউজ নেই। অবন্তীর জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যাড নিউজ হয়ে গেছে।
চলবে
#অন্তহীন_বসন্ত~৩২
লিখা- Sidratul Muntaz
অনেকক্ষন চেষ্টা করেও নিশান্তকে ফোনে পাওয়া গেল না দেখে অবন্তী সিদ্ধান্ত নিল মেসেজ করবে। কিন্তু এমন একটা কথা তাকে কিভাবে জানানো যায়? অবন্তী চেয়েছিল সরাসরি ফোন করেই বলতে৷ ভিডিওকলে বলতে পারলে আরও ভালো হতো। তাহলে নিশান্তর রিয়েকশনটা দেখা যেতো। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে পারছে না অবন্তী। শেষমেষ মেসেজই লিখল, ” আই এম প্রেগন্যান্ট। ”
মেসেজ সিন হলো দুপুর দুইটার দিকে। তার ঠিক দুই মিনিট পরই নিশান্তর ফোন এলো।
অবন্তী মনমরা স্বরে বলল,” হ্যালো, কোথায় ছিলে তুমি? সকাল থেকে ফোন ধরছিলে না কেন? ”
নিশান্ত উত্তেজিত গলায় বলল,” ঘুমাচ্ছিলাম কিন্তু তোমার মেসেজ দেখে চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেছে আমার। তুমি কি লিখেছো মেসেজে?এটা কি সত্যি?”
অবন্তী দুঃখিত গলায় বলল,”হুম। ”
নিশান্ত আধশোয়া অবস্থায় ছিল। অবন্তীর উত্তর শুনে উঠে বসে মাথায় হাত রাখল এবার। আরও দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে বলল,” মানে?”
” মানে আমি সত্যিই প্রেগন্যান্ট নিশান্ত!”
” হায় হায়।”
” স্যরি। আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে চাইনি। ”
নিশান্ত হঠাৎ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল, ” আমাকে বিপদে ফেলতে চাওনি মানে? আগে বলো এসব কিভাবে হলো? হাউ?”
অপরাধী কণ্ঠে অবন্তী উত্তর দিল, ” আমি ঔষধগুলো খেতে ভুলে গেছিলাম… ”
” মানে কি? দেখো আমার সাথে প্র্যাংক কোরো না। এমনিতেও খুব টেনশনে আছি আমি।”
” প্র্যাংক কেন করব আজব? ঠিকাছে তোমার বিশ্বাস না হলে এখনি রিপোর্টের ছবি দিচ্ছি। ওয়েট।”
অবন্তী সাথে সাথেই ছবি সেন্ট করল। নিশান্ত ছবিতে স্যাড রিয়েক্ট দিল। তারপর প্রশ্ন করল তীব্র হতাশ গলায়,” তুমি ঔষধ খাওয়ার কথা কিভাবে ভুলে গেলে? আমি বার-বার বলেছিলাম অবন্তী।”
” কি করব? মনেই ছিল না।”
” এইটা কোনো কথা হলো? এত্তো ইম্পরট্যান্ট একটা ব্যাপার তুমি ভুলে গেলে?”
অবন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ” শেষদিন মায়ের কাছে ধরা খাওয়ার পর এসব কিছু আর মাথায় ছিল না। ”
” ঔষধটা তোমার গাড়িতে বসেই খেয়ে নেওয়া উচিৎ ছিল।”
” আচ্ছা যেটাই হোক, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এসব বললে তো আর বদলাবে না। এখন আমি কি করবো সেটা বলো? ”
” আমি কিভাবে বলব? তোমার মতো আমিও তো শকড।”
অবন্তী নরম গলায় জানতে চাইল,” তোমার কি কথাটা শুনে একটুও ভালো লাগছে না?”
নিশান্ত দরাজ কণ্ঠে বলল,” ভালো কেন লাগবে? এটা কি ভালো লাগার মতো কোনো ব্যাপার? তুমি ভাবতেও পারছো না কতবড় বিপদ ডেকে এনেছো।”
অবন্তী কোনো কথা বলল না। তার মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল। সে ভেবেছিল নিশান্ত একটু হলেও খুশি হবে। কিন্তু তার মধ্যে সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। নিশান্ত দুশ্চিন্তায় চোখ কচলাতে লাগল। তারপর রুক্ষ গলায় বলল, ” আচ্ছা ভাবতে দাও। আমি পরে ফোন করছি।”
নিশান্ত ফোন কেটে দিতে নিচ্ছিল তখন সাথে সাথেই অবন্তী আবার বলল,”আরে শোনো, আসল কথাই তো এখনও বললাম না।”
” কি কথা?” নিশান্তর গলা এখন এতো গম্ভীর শোনাচ্ছে যে অবন্তী বলতেও ভয় পেল। তবু আমতা-আমতা করে বলে ফেলল,” মা তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
” আন্টি হঠাৎ কি ব্যাপারে কথা বলতে চায়? কিছু বুঝতে পারেনি তো?”
অবন্তী নিচু গলায় বলল,” মা সব জানে।”
” কি?” হতভম্ব হয়ে গেল নিশান্ত।
” কিভাবে জানল?”
অবন্তী সবকিছু প্রথম থেকে বলতে শুরু করল। নিশান্ত কপালে হাত রেখে বলল,” আড়াই মাস হয়ে গেছে অথচ তুমি একবারও টের পেলে না? আল্লাহ! এই তুমি না সাইন্সের স্টুডেন্ট?”
অবন্তী লজ্জিত স্বরে বলল,” তুমিও এখন মায়ের মতো বলতে শুরু করেছো। আচ্ছা আমি কি ডাক্তার? কিভাবে বুঝবো? জীবনে আর কখনও প্রেগন্যান্ট হয়েছি নাকি?”
নিশান্ত হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল। অবন্তী বলল,” আর তুমিও তো বোঝোনি। এই কয়দিন ধরে তোমাকে আমি বলছিলাম না আমার ঘন ঘন ক্ষিদে পায়, বমি আসে, মাথা ঘুরায়, সেদিন এসেম্বলিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।”
” এই ওয়েট, এসেম্বলিতে অজ্ঞান হওয়ার ঘটনা তো তুমি আমাকে বলোনি!”
অবন্তী জীভ কাটল। সে আসলেই এই ঘটনা নিশান্তকে বলেনি কারণ কলেজের মাঠ থেকে ক্লাসরুম পর্যন্ত অবন্তীকে ইব্রাহীম স্যার কোলে করে এনেছিলেন। তিনি আবার মেয়েদের ক্রাশ। অবন্তী একবার মজা করে বলেছিল ইব্রাহীম স্যার তারও ক্রাশ। তাই নিশান্ত এই কথা জানলে মাইন্ড করতে পারে ভেবে অবন্তী বলেনি ইচ্ছে করেই।
” ওহ, বলিনি তাই না? তাহলে মনে হয় ভুলে গেছিলাম।”
” এটাও কি ভুলে যাওয়ার মতো কথা? আগে আমাকে বললে আমি অবশ্যই বুঝতাম। আর বমির ব্যাপারটা আমি সিরিয়াসলি নেইনি কারণ অনেক বেশি খেলে আমারও বমি ভাব হয়৷ আমি এটা নরমাল মনে করেছিলাম। তুমি যদি আমাকে আরও ভালো করে বোঝাতে তাহলে আন্টি কিছু জানার আগেই একটা ব্যবস্থা নেওয়া যেতো।”
অবন্তী চোখ বড় করে বলল,” ব্যবস্থা নেওয়া যেতো মানে? তুমি কি ব্যবস্থা নিতে চাও? খবরদার, এবোর্শনের কথা মুখেও আনবে না। তাহলে কিন্তু তোমার গলা টিপে ধরব আমি।”
“আমি তো সেই কথা বলিনি।”
” অন্য ব্যবস্থা আবার কি? দেখো তোমার কথার মানে আমি বুঝি। তুমি এটাই মিন করেছো। ”
” আমি এটা মিন করিনি অবন্তী।”
” মিথ্যা বোলো না। আর শোনো, মা কি বলেছে জানো?”
” কি?”
” মা বলেছে আমাকে আর ঘরে রাখবে না। তুমি যাতে এসে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।”
” সত্যি এই কথা বলেছে?”
এমন সময় বিলকিস এসে দরজায় নক করল,” অবন্তী, কার সাথে কথা বলছিস? নিশান্ত নাকি?”
অবন্তী ভয়ে কেঁপে উঠে বলল,” ওইতো মা চলে এসেছে। এই তুমি লাইনে থাকো। আমার খুব ভয় করছে।”
নিশান্ত কিছু বলল না। কিন্তু তারও খুব ভয় করছে। পাশাপাশি নর্ভাস লাগছে। অস্থিরতায় মুখ চেপে ধরল। অবন্তী দরজা খুলতেই বিলকিস হাত বাড়িয়ে বলল,” দেখি, ফোনটা দে আমাকে।”
অবন্তী চুপচাপ দিয়ে দিল। তারপর বিছানায় গিয়ে একটা কোণায় গুটিশুটি হয়ে বসল৷ দুশ্চিন্তা লাগছে তার। মা নিশান্তকে কি বলবে কে জানে? বিলকিস অবশ্য অবন্তীর সামনে কথাই বলল না। ফোন নিয়ে অন্যঘরে চলে গেল।
__________
” আব্বু,তোমার সাথে জরুরী কথা ছিল।” নিশান্ত অনেক ইতস্তত করে বাবার রুমে ঢুকেছে। ছেলেকে দেখে জাবির সাহেবের মুখে চওড়া হাসি ফুটল। আজ-কাল তো ছেলে তার কাছেই আসে না। সারাক্ষণ ভার্সিটি, ক্লাস, ফ্রেন্ডস, জব ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এতো ব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফিরে মরার মতো ঘুমায়। তার সাথে কথা বলতেই মায়া লাগে। তিনি বোঝেন না, তার এতো টাকা-পয়সা থাকা সত্ত্বেও তার ছেলেটা কি করে বিগড়ে না গিয়ে এমন দায়িত্বশীল হলো। তিনি নিজের ছেলেকে নিয়ে মনে মনে খুব গর্বিত। জাবির বললেন,” আয় বাবা।”
নিশান্ত হাসিমুখে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। জাবির কাপড় ইস্ত্রি করছিলেন। নিশান্ত বলল,” বাবা, আমি হেল্প করি?”
” করবি? আচ্ছা, কর।”
জাবির সাহেব ছেলের হাতে ইস্ত্রি দিলেন। নিশান্ত খুব যত্নের সাথে বাবার শার্ট, ফরমাল প্যান্ট ইস্ত্রি করতে লাগল। জাবির রকিং চেয়ারে ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বসলেন। খোশমেজাজে প্রশ্ন করলেন,” তারপর? তোর দিন-কাল কেমন যাচ্ছে?”
” ভালো না বাবা। তোমার একটা হেল্প আমার খুব দরকার। সেই ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছি।”
জাবির মনে মনে হাসলেন। তার ধারণা সঠিক হয়েছে। নিশ্চয়ই বড়-সড় কিছু আবদার করবে নিশান্ত। সেটা ঠিক কি হতে পারে তিনি আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন৷ কিন্তু মাথায় কিছু এলো না। নিশান্ত বলল,” বাবা আমি তোমার কাছে বিশেষভাবে কখনও কিছু চাইনি। আসলে চাওয়ার প্রয়োজনই হয়নি। কারণ তুমি চাওয়ার আগেই আমার সব প্রয়োজন বুঝে নিয়েছো। যখন যেটা দরকার সেটাই আমাকে এনে দিয়েছো৷ তুমি পৃথিবীর বেস্ট বাবা। ”
জাবির কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,” যা বলতে চাস সরাসরি বল। এতো তেল মাখতে হবে না।”
নিশান্ত এবার হেসে দিল। জাবিরও হেসে উঠলেন উচ্চশব্দে। নিশান্ত খুব অস্বস্তি মেশানো গলায় বলল,” বাবা আমি ঠিক করেছি বিয়ে করবো।”
কথাটা বলে সে একবারও বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারল না। কাপড় ইস্ত্রি করতে লাগল। যদিও তার সকল মনোযোগ বাবার উত্তরের অপেক্ষায়। জাবির সাহেব হয়তো ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না। চট করে প্রশ্ন করলেন,” কি বললি?”
নিশান্ত এবার ইস্ত্রি করা বন্ধ রেখে বাবার কাছে এলো। হাঁটু মুড়ে বাবার মুখোমুখি বসে অনুরোধের স্বরে বলল,” আমি একটা মেয়েকে অনেক ভালোবাসি। তাকে বিয়ে করতে চাই।”
জাবির চোখ বড় করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন। নিশান্তর চেহারা রক্তহীন, সাদা কাগজের মতো দেখাচ্ছে। জাবির হেসে বললেন,” এটা তো খুশির খবর।”
নিশান্ত হাসল। জাবির প্রশ্ন করলেন,” কিন্তু মেয়েটা কে? খ্রিস্টান না তো আবার?”
” একদম না। খাঁটি বাঙালি মেয়ে। পিউর মুসলিম।” নিশান্ত গড়গড় করে বলল।
” মুসলিম আবার বাঙালিও? গ্রেইট!”
” আব্বু তুমি মেয়েটাকে চেনো।”
এবার জাবির আরও অবাক হলেন,” তাই নাকি? কে সেই সৌভাগ্যবতী রমণী?”
নিশান্ত মাথা নিচু করে আড়ষ্ট গলায় বলল,” অবন্তী।”
জাবির বিভ্রান্ত হলেন,” অবন্তী কে?”
” হেলেন মামীর বড়বোনের মেয়ে।”
জাবির একটু ভেবে বললেন,” সানভীর বউয়ের চেইন চুরি করেছিল সেই মেয়েটা নাকি? সর্বনাশ!”
নিশান্ত বিব্রত স্বরে বলল,” অবন্তী চুরি করেনি আব্বু। এসব ভুল-ভাল কথা তোমাকে আম্মু বলেছে তাই না?”
” আচ্ছা বাদ দে। কিন্তু এই মেয়েকে তুই বিয়ে করতে চাস মানে? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। ওর সঙ্গে তোর সম্পর্ক কিভাবে হলো?”
” এইসব অনেক কাহিনী। একদিন সময় করে বলবো। তুমি শুধু এখন বলো, তুমি রাজি কি-না? তাহলে আমি এই মাসেই অবন্তীকে এখানে নিয়ে আসব।”
” রিল্যাক্স। এতো তাড়া কিসের? এখনও কি তোর বিয়ের বয়স হয়েছে? আগে পড়াশুনা শেষ কর। সময় আসুক, তারপর দেখা যাবে।”
” না আব্বু। সময় একদম নেই। যত দ্রুত সম্ভব আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।”
জাবির ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি হয়তো ছেলের কথার আগা-মাথা ধরতে পারছেন না। হেসে বললেন,” মানে কি? কেন?”
নিশান্ত আরও স্পষ্ট করে বলল,” কারণ অবন্তী প্রেগন্যান্ট।”
কথাটা বলে ফেলার পর নিশান্তর মনে হলো সে ভুল করেছে। আরও ভালো করে বুঝিয়ে বলা দরকার ছিল। কিন্তু সে আর কিছু বলার আগেই হিংস্র বাঘিনীর মতো রিমা তেড়ে এসে ঢুকল ঘরের ভেতর।
” কি বললি তুই? অবন্তী প্রেগন্যান্ট মানে?”
মাকে দেখে নিশান্ত বিব্রত এবং বিরক্ত হলো। এটা মায়ের খুব বাজে একটা স্বভাব। আড়ি পেতে কথা শোনা। নিশান্ত কিছু বলতে চাইলেই রিমা ফোঁসফোঁস করে উঠল,” খবরদার ওই মেয়েকে বিয়ে করার চিন্তাও করবি না। বিয়ের আগে যেই মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয় সে তো চরিত্রহীনা।”
” আম্মু এসব কি ফালতু কথা বলছো তুমি?”
নিশান্তর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। রিমা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” আমি ফালতু কথা বলছি না, তুই ফালতু কাজ করছিস৷ আর তোর বাবা যদি এই ফালতু কাজে তোকে উৎসাহ দেয় তাহলে আমি তোর বাবার থেকে ডিভোর্স নিবো। যেই সংসারে ওই ফালতু মেয়ে আসবে সেই ফালতু সংসারে আমি থাকবই না।”
” অবন্তী ফালতু হবে কেন? সে কি করেছে তোমার সাথে? কেন তুমি ওকে এতো অপছন্দ করো আম্মু?”
জাবির মা-ছেলের তর্ক দেখে হকচকিয়ে গেলেন,” আরে থামো, কি শুরু করলে তোমরা?”
রিমা তেতে উঠে বলল,” তুমি মুখে কুলুপ এঁটেছো কেন? ছেলেকে কিছু বলবে না? থাপ্পড় দিয়ে ওর মাথা থেকে বিয়ের ভূত নামাও।”
জাবির নিশান্তর দিকে চেয়ে কঠিন গলায় বলল,” এসব কিভাবে হলো নিশান্ত? ওই মেয়ে প্রেগন্যান্ট কিভাবে হলো?”
নিশান্ত সম্পূর্ণ ঘটনা বিস্তারিত জানাল। শুধু জানাতে পারল না তাদের গোপন বিয়ের ব্যাপারটা। বাবা-মায়ের অনুমতির তোয়াক্কা না করে তারা বিয়ে করেছিল এই কথা জানাজানি হলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। রিমা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল বিছানায়,” হায় আল্লাহ, এই দিনও দেখতে হলো আমার? আমি যা ভেবেছিলাম তাই। ওই মেয়ে তোকে ফাঁসিয়েছে। ইচ্ছে করে প্রেগন্যান্ট হয়েছে যেন তুই ওকে বিয়ে করিস।”
” আজ নাহয় কাল আমি ওকে এমনিও বিয়ে করতাম আম্মু। পার্থক্য শুধু একটাই। এখন বিয়েটা দ্রুত করতে হবে।”
রিমা চিৎকার করে উঠল,” শুনলে তোমার ছেলে কি বলছে? এর মানে সে আমাদের মতামতেরও পরোয়া করে না।”
জাবির ক্লান্ত গলায় বললেন,” নিশান্ত, তুই এখন ঘরে যা। এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব।”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে নিশান্ত আর একটাও কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল। পরে এই নিয়ে রিমা আর জাবির সাহেবের মধ্যে অনেক কথা কাটাকাটি হলো। রিমা শুধু চেঁচামেচি করছিল। নিশান্ত বুঝতে পারছে বাবাকে মানানো সম্ভব হলেও মাকে মানাতে গেলে খুব বেগ পেতে হবে। নিশান্ত খুব ভেবেচিন্তে ঠান্ডা মাথায় রিমার সাথে কথা বলার প্রস্তুতি নিল।
সন্ধ্যায় রিমা রান্নাঘরে কফি বানাচ্ছিল আর ডিনার তৈরী করার জন্য চপিংবোর্ডে সবজি কাটছিল। নিশান্ত রান্নাঘরে ঢুকেই মিষ্টি গলায় বলল,” আম্মু, আমি হেল্প করব?”
রিমা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল ছেলের দিকে। রাগী গলায় বলল,” লাগবে না৷ এসব করে কোনো লাভ নেই। তুই যেটা চাইছিস সেটা অসম্ভব।”
নিশান্ত হার মানল না। পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রিমাকে। আদুরে স্বরে বলল,” প্লিজ আম্মু, এইরকম কোরো না। আই লভ হার৷ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। ”
” এমন চরিত্রহীন মেয়েকেই কেন ভালোবাসতে হবে তোর? পৃথিবীতে কি আর কোনো মেয়ে ছিল না?”
নিশান্ত রুষ্ট হয়ে বলল,” তুমি বার-বার অবন্তীকে চরিত্রহীন কেন বলছো আম্মু? ও যদি চরিত্রহীন হয় তাহলে তোমার ছেলেও চরিত্রহীন। কারণ প্রেগন্যান্ট সে একা একা হয়নি।”
রিমা সবজি কাটা থামিয়ে এবার ছেলের দিকে ঘুরল। ছেলের গালে হাত রেখে মৃদু গলায় বলল,” ওই মেয়ে তোকে বশ করেছে বাবা। তুই এটা বুঝতে পারছিস না। নাহলে পৃথিবীতে এতো মেয়ে থাকতে ওর প্রতিই কেন তোর সব আকর্ষণ থাকবে?”
” কারণ আমি ওকে ভালোবাসি। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।”
রিমা দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” মোটেও স্বাভাবিক না। ভালোবাসা থাকলে সে প্রেগন্যান্ট হয়ে তোকে বিয়ের জন্য চাপ দিতো না। তোর কি মনে হয় ও আসলেই ঔষধ খেতে ভুলে গেছিল? এই কথা তুই বিশ্বাস করলেও আমি করব না। সবকিছু মা আর মেয়ের প্ল্যান। তোকে প্রেশার দেওয়ার জন্য ওরা এটা করেছে। অবন্তী শুধু ভালোবাসে তোর টাকা। তুই বুঝতে পারছিস না।”
নিশান্ত মাথা ঠান্ডা রাখল। ধৈর্য্য নিয়ে বলল,” অবন্তী এরকম মেয়ে না আম্মু। সে খুব ভালো মেয়ে। ওকে তুমি একটুও চেনো না। আমি চিনি।”
” তুই কচু চিনিস। ওকে ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছি আমি৷ ওর মা যেমন শেয়ানা মেয়েকেও বানিয়েছে তেমন। দুই মা-মেয়ে মিলে তোর ব্রেইনওয়াশ করে রেখেছে তাই এখন আমার কথা বুঝবি না। তবে একটা কথা মনে রাখিস, সময় গেলে সাধন হবে না। এই মেয়েকে বিয়ে করলে পস্তাবি।”
” আচ্ছা, আমি পস্তাতে চাই।”
” আমি তো ওকে কোনোভাবেই মেনে নিবো না। একদিক দিয়ে তুই ওকে বিয়ে করবি আর অন্যদিক দিয়ে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
নিশান্ত কাতর গলায় বলল,” এইরকম কথা বলে না আম্মু, প্লিজ।”
রিমা মৃদু হেসে বলল,” এসব আহ্লাদীপনা করে কোনো লাভ নেই বাবা। তোর সারাজীবনের প্রসঙ্গ এটা। কোনো ছেলেখেলা না।”
নিশান্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাকে বুঝিয়ে আসলে কোনো লাভ নেই। বাবাকেই ম্যানেজ করতে হবে। নিশান্ত জাবির সাহেবের ঘরে গেল। তিনি বারান্দায় বসে ছিলেন। নিশান্তকে দেখেই বললেন,” এদিকে আয়৷ তোর কথাই ভাবছিলাম।”
নিশান্ত বাবার পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,” আশা করি তুমি ভালো কিছু ভেবেছো আব্বু।”
জাবির সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করে বললেন,” অবন্তীকে এখানে নিয়ে আয়।”
নিশান্ত হেসে উঠল। তীব্র আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” থ্যাঙ্কিউ আব্বু।”
খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে এলেই জাবির বাঁধা দিয়ে বললেন,” পুরো কথা আগে শেষ করতে দে। অবন্তীকে এখানে আনার পর আমি নিজের খরচে ওর চেকাপ করাবো। কোনো রকম কমপ্লিকেশন ছাড়া বাচ্চা এবোর্ট করা হবে। ”
নিশান্তর চেহারা থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল। সে থমথমে কণ্ঠে জানতে চাইল,” তারপর?”
” তারপর আর কি? ওর যদি ইচ্ছে করে কিছুদিন আমাদের সাথে থাকবে। কানাডা ঘুরে দেখবে। তারপর ওকে ফিরে যেতে হবে। ”
” ও। তার মানে তুমিও আম্মুর মতো অবন্তীকে মানবে না তাইতো?”
” আমি তো একবারও ডিনাই করিনি। তোদের কারোরই এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। একটা এক্সিডেন্টের জন্য এভাবে হুট করে বিয়ে করে ফেলার প্রশ্নই আসে না। একসময় দু’জনই আফসোস করবি। যখন বিয়ের সময় হবে তখনও যদি তোর মনে হয় অবন্তীকেই তোর ভালো লাগে তাহলে ওর সাথে বিয়ে হবে! কোনো প্রবলেম নেই আমার। যদিও আমার মনে হয় ততদিনে তোর মন বদলে যাবে। এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু আপাতত আমার কাছে এর চেয়ে বেটার সলিউশন আর কিছু মনে হচ্ছে না। অবন্তীকে আসতে বল। আমি অনুমতি দিলাম।”
নিশান্ত কিছু বলল না। মাথা নুইয়ে চুপ করে রইল। জাবির হাসিমুখে বললেন,”এখন জড়িয়ে ধরতে পারিস।”
জাবির হাত মেলে দিলেন। নিশান্ত উঠে দাঁড়াল। শক্ত এবং থমথমে গলায় বলল,” আমি এই কাজের জন্য অবন্তীকে আসতে বলব না আব্বু। স্যরি।”
” ঠিকাছে। এজ ইউর উইশ।”
নিশান্ত রাগ করে সেই রাতেই বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে একটা হোটেলে উঠল। সারারাত চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল বাংলাদেশে চলে যাবে। তার একাউন্টে যে পরিমাণ টাকা আছে তা দিয়ে কয়েক বছর আরামে কাটানো সম্ভব। সে আর অবন্তী সংসার শুরু করবে। আর বেবি হওয়ার পর মা-বাবা এমনিই সব মেনে নিবে। নিশান্ত সবকিছু ঠিকঠাক করে সকালে এয়ার টিকিট কাটতে গিয়ে দেখল তার ক্রেডিট কার্ড ব্লক করা হয়েছে। হোটেলের বিল পেমেন্ট করতে গিয়ে পকেটের সব টাকা খরচ হয়ে গেল। এখন এই দেউলিয়া অবস্থায় বাংলাদেশে যাওয়া তো দূর, সে শহরের বাইরেও পা রাখতে পারবে না! এদিকে অবন্তী অনবরত ফোন করছে। ফোনে না পেয়ে মেসেজ করল,” নিশান্ত, মা জিজ্ঞেস করছিল কবে আসবে তুমি?”
চলবে