দীর্ঘ রজনী পর্ব-১৪+১৫

0
461

গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:১৪

সেঁজুতি হাসান স্থির হয়ে বসে আছে। অনিলা তার ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে। তার ছেলে আসলে চাইছেটা কি।

~ মামুনী তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমি তোমাকে পৌঁছে দিবো।

সাদের কথা শুনে সেঁজুতি কন্ঠে কাঠিন্যতা এনে বললো,, অসম্ভব! আমি ওই বাড়িতে আর কখনোই পা রাখবো না। আমার মেয়ের সাথে এমন ঘটনা ঘটে গেল তা শুনেও ওই বাড়িতে আমি যাবো?? কখনোই না।

সেঁজুতির সাথে অনিলা সায় জানিয়ে বললো,, সেঁজুতি ঠিক বলেছে। ওই বাড়িতে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।

সাদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,

~ মামুনী! তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যাবে। অ*প*রাধ তোমার ভাইয়ের ছেলে করেছে। তোমার মা বাবা করেনি আর না করেছে তোমার ভাই কিংবা ভাইয়ের বউ। তাহলে তুমি কেন যাবে না! ওটা তোমারও বাড়ি। তোমার অধিকার আছে ওই বাড়িতে যাওয়ার। তাই তুমি যাবে!

রইলো নিশানের কথা! ওকে আমি দেখে নিবো। তবে তোমাকে ওয়াদা করতে হবে। তুমি নিশানের সাথে কোনো প্রকার রাগ দেখাবেনা। আর না তাকে বুঝতে দিবে সাজির ব্যাপারটা।

~ কিন্তু!

~কোনো কিন্তু নয় মামুনী। আমার উপর যদি বিশ্বাস থাকে তাহলে কোনো “কিন্তু” থাকার কথা নয়।

অনিলা রহমান ছেলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঝড়ের পূর্বাভাস লক্ষ্য করছে। তা না হলে এতো কিছু শোনার পর যেখানে তা*ন্ডব করার কথা, সেখানে দিব্যি শান্ত ভঙ্গিতে বসে সাবলীল ভাষায় কথা বলছে সাদ। অনিলা স্মিত হেসে মনে মনে বললো,, এইবার ঝড় দেখার পালা আর কতোটা ক্ষ*য়ক্ষ*তি হয় তা পরখ করার পালা।

সেঁজুতি জানে সাদ তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কথার পেছনে কোনো না কোনো যুক্তি অবশ্যই আছে।সেঁজুতি পুরো ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখলো। সাদের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,, ঠিক আছে। কিন্তু সাজিঁ কি যেতে রাজি হবে?

~সাদ সোফায় হেলান দিয়ে বসে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,, কে বলেছে সাজি সেই বাড়িতে যাবে?

অনিলা রহমান ছেলের কথায় কপাল কুঁচকে ফেললো। সেঁজুতি হাসানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।

~ তাহলে একা থাকবে কি করে?

~ একা থাকার কথা আসছে কেন? সাজি আমাদের বাড়িতে থাকবে। সাথে রেনুও যাবে। মা আছে ওর খেয়াল রাখার জন্য।

অনিলা রহমান ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

সেঁজুতি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, যাক টেনশন মুক্ত। আপা আর তুই আছিস মানেই টেনশন শেষ।

সেঁজুতির কথায় সাদ মুচকি হাসলো সাদ।

~কিছু কথা বলি মামুনী! প্লিজ মনোযোগ দিয়ে শুনে বুঝার চেষ্টা কোরো আমার কথা গুলো ।

সেঁজুতি মাথা নেড়ে বললো,, হ্যা বল বাবা।

~ শুনো তাহলে,কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ছেলে মেয়েরা এমন অনেক জায়গায় কিংবা মানুষ আছে যেখানে তারা যেতে চায় না বা মিশতে চায় না। কমফোর্টেবল ফিল করে না। তাও তাদের মা-বাবা জোর করে, ধমক দিয়ে পাঠায়।‌ তার সেই আনকফোর্টেবল ফিল করার পেছনে কারন জানতে চায় না। বুঝতে চায় না কি এমন কারন থাকতে পারে যার জন্য তাদের সন্তান এতোটা অস্বস্তি বোধ করছে।

এই ধরো যেমন সাজির ক্ষেত্রে! সাজি যেতে চাইতো না। জিজ্ঞেস করলেও বলতো না।
মা-বাবা সব সময় যেই জায়গা এবং মানুষ গুলোকে তাদের সন্তানদের জন্য সেইফ মনে করে তা সেইফ নাও হতে পারে।

কারন আমার মায়ের সাথে একজন ভালো ব্যাবহার করছে। তার মানে এই নয় আমার সাথেও তেমন ব্যাবহার করবে। তার উল্টোও ত হতে পারে!
তোমাকে এতো গুলো কথা বলার একটাই কারণ তা হচ্ছে। যেখানে দেখবে সাজি যেতে চাইছে না। সেখানে যাওয়ার জন্য জোর করো না।

যাদের সাথে মিশতে চাইবে না। তাদের সাথে মেশার জন্য জোর করো না। পারলে তাদের থেকে দুরে রাখবে।
সে মেয়ে! মেয়েদের ষষ্ট ইন্দ্রিয় সব সময় তাদের খারাপ ভালোর ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। তাদের অবচেতন মন টের পেয়ে যায়। কোন জায়গা গুলো তাদের জন্য নিরাপদ,আর কোনো জায়গা গুলো তাদের জন্য অনিরাপদ। সাজিও বুঝতে পারে মামুনী। তবে জড়তার কারনে হয়তো তোমাকে বলতে পারবে না। কিন্তু তোমাকে বুঝে নিতে হবে মামুনী।
সামনে থেকে খেয়াল রেখো প্লিজ। তুমি মা তুমি সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকবে। একজন মায়ের কাছেই কিন্তু তার সন্তান সবচেয়ে বেশি নিরাপদ হয়। একজন মা তার সন্তানকে সব চেয়ে বেশি বুঝতে পারে।

অনিলা রহমান মুগ্ধ হয়ে তার ছেলের কথা শুনছিলেন। কতটা বুঝের হয়েছে তার ছেলেটা। একদম তার বাবার মতো। তবে বাবার চাইতে সাদ একটু বেশিই বুঝের। খারাপ ভালোর সংমিশ্রণ থেকে ভালোটা বেঁছে নিতে জানে। চেয়ে বড় কথা সাদ মানুষ চিনতে পারে, যা তার বাবা কখনোই পারতো না। চিনতো না বলেই তার শোক যাত্রায় তাকে খু*ব*লে খা*ওয়া মানুষ গুলো উপহাস করে গেছে। হৃদযন্ত্র তার কর্মক্ষমতা হারানোর সাথে সাথে আপন মানুষ গুলো পর হয়েছে।
পুরোনো কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনিলা।

সেঁজুতি হাসান সাদের কথা শুনে মুচকি হেসে বলল,, বুঝতে পেরেছি।তবে আমি খেয়াল না রাখতে পারলে তুই আছিস তুই রাখবি খেয়াল।

মামুনীর কথায় মুচকি হাসলো সাদ।

~ তুই আমার ছেলে হলে মন্দ হতো না সাদ।

সেঁজুতির আক্ষেপের সুরে বলা কথাটায় সাদ উঠে এসে সেঁজুতিকে জড়িয়ে ধরে বললো, আমি তোমারও ছেলে মামুনী। আমারতো দুই দুইটা মা।

সেঁজুতি মুচকি হেঁসে পরম মমতায় সাদকে আগলে রেখে অনিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,, আমার ছেলে কিন্তু।

অনিলা প্রশস্ত হেসে মাথা নাড়ালো।

সাদের মোবাইল বেজে উঠতেই সরে এসে মোবাইল ফোন হাতে নিলো।

“ছোট মামু” নামটা দেখেই মোবাইল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
_____

সেঁজুতি বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এইদিকে সাদও বেরিয়ে পড়লো সবাইকে নিয়ে।

সাজি চাঁদকে কোলে নিয়ে সাদের পাশে বসলো। অনিলা রহমান আর রেনু পেছনের সিটে বসেছে।

চাঁদ আদো আদো বুলিতে সাজির সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। সাজিও তাকে নিজের নাম শেখাতে উদ্যত।

সাদ কিছুক্ষণ পর পর আড় চোখে সাজির দিকে তাকিয়ে দেখছে। সকালের সেই ঘটনার পর থেকে লজ্জায় তাকালো না সাজি। বরাবরই নজর লুকাতে ব্যাস্ত।

অন্যদিকে চাঁদের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে সাদকে অবলোকন করছে সাজি।

সাদ ভাই নামক লোকটাকে জড়িয়ে ধরেছিলো ভেবেই লজ্জায় দুগাল গরম হয়ে যাচ্ছে।
ইস! কি লজ্জাজনক কাজটাই না করে ফেলেছে। নির্লজ্জের মতো কাজ করেছিস সাজি। তুই আসলেই নির্লজ্জ!
নিজেকে কটাক্ষ করে কয়েকটা গা*লি দিলো সাজি।

পরক্ষনেই চিন্তা করে দেখলো। সাদ ভাইয়ের প্রতিটা কথা প্রতিটা কাজে অদ্ভুত ভালো কাজ করছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার।লাগাম ছাড়া অনূভুতি যাকে বলে। সেই লাগাম ছাড়া অনূভুতির আদলেই আজ সাদকে সবটা বলে দিয়েছে। সাজি বুঝতে পারে না সাদ নামক ব্যাক্তিটার উপস্থিতি কেন তার ছোট হৃৎপিণ্ড জুড়ে তো*লপাড় সৃষ্টি করে। কেন তাকে সবচেয়ে ভরসার মনে হয়। কই আগেতো এমন কিছুই মনে হয়নি! তাহলে এখন কেন?নিজেকে নিজে সুধালো সাজি।
উত্তরে একটা কথাই ভেসে এলো ” তুই তার প্রেমে পড়েছিস সাজি! সাদ ভাই নামক নরম গরম মানুষটার প্রেমে পড়েছিস।”

নিজের এহেন উত্তরে লাজুক হেসে জানালার কাচ ভেদ করে আসা রোদ্দুরে চোখ রাখলো সাজি।হুট করে চারপাশটা কেমন রঙিন লাগছে।মনে হচ্ছে এই ব্যাস্ত শহরে বসন্ত এসেছে। ইট পাথরের শহরে রঙিন বসন্ত হানা দিয়েছে।
———

সেঁজুতি হাসান আজ দুদিন হলো তার বাবার বাড়িতে আছে। নিশান তার ফুফির আগমনে বেজায় খুশি হয়েছিলো। কিন্তু সাজি আসেনি দেখে ঈষৎ রাগ দেখালো সেঁজুতিকে। সেঁজুতি দাঁতে দাঁত চেপে দম ধরে নিশানের কথা শুনেছিলো। সাদের কথায় চুপ করে আছে তা না হলে এতক্ষনে কিছু একটা করে বসতো। হোক সেটা নিজের ভাইয়ের ছেলে। তাতেও কিছু যায় আসতো না তার। আপাতত সবটা সাদের উপর ছেড়ে দিলো। তাইতো স্বাচ্ছন্দে দিন পার করছে।

এই দিকে বাবার সাথে অভিমান করেছে সাজি। অভিমান গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সকাল হতেই বাবার উপর অভিযোগে পাহাড় উঠিয়ে দিয়েছে। একটা অভিযোগ না বরং দুই বছরের জমিয়ে রাখা অভিযোগ।

জুবায়েরের মেয়ের করা অভিযোগে মুচকি হাসছে।তার মেয়ের প্রতিটা অভিযোগ সত্য। মেয়েটা তার বড় হলো না। ছোট্টটিই রয়ে গেলো। সেই ছোট্ট অভিমানী সাজি।

বাবা মেয়ের মান অভিমান দূর থেকে দাঁড়িয়ে শুনছে সাদ।কে বলবে মেয়েটা বড় হয়েছে! বাবার কাছে সে ছোট বাচ্চাই রয়ে গেছে। মুখ ফুলিয়ে অভিযোগের খাতা খুলে বসেছে। সেই অভিযোগ খাতায় দুই একটা অভিযোগ সাদকে নিয়েও আছে।

সাজির করা অভিযোগ শুনতেই ভ্রু কুঁচকালো সাদ।
নিজেকে কোনো ছবির ভিলেন থেকে কম কিছু মনে হচ্ছে না সাদের।ভিলেন বললে কম হবে! কোনো র*ক্ষস মনে হচ্ছে। ফেরিটেলে থাকা রা*ক্ষস! যে সব সময় রাজকুমারীকে ভয় দেখাতে আসে।

ইনশাআল্লাহ চলবে,,

গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:১৫

রিমির জন্মদিন আজ। সন্ধ্যায় ঘরোয়া ভাবে জন্মদিন সেলিব্রেট করা হবে। জন্মদিনে সাজি না গেলে কেক কাটবেনা বলেই পন করেছে রিমি। তাই সাজি সকাল সকাল বাবার সাথে কথা বলে যাওয়ার পারমিশন নিচ্ছে।

~ না গেলে হয় না মা? সন্ধ্যায় কোথাও যাওয়া কি উচিৎ?

অভিমানে বুক ভারি হয়ে এলো সাজির। নাক টেনে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে উঠলো,, তুমি এক্ষুনি আসবে বাবা। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি!

একবার বারন করাতেই অভিযোগের ঢালি সাজানো শুরু করে দিলো সাজি।

~~ দুই বছর হয়েছে একবারও এলে না। কেন আসোনি বলো?তোমার কি একবারও তোমার মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করে না? তোমার ইচ্ছে তো করবেই না। করলে এতো বছর থাকতে?

ঠোঁটে ফুলিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলে উঠলো,

~রিমির বাবা ওর সাথে কলেজে যায়। কলেজ ছুটি হলে হাত ধরে রাস্তা পার করে ওকে বাড়ি নিয়ে যায়। আইসক্রিম কিনে দেয়। তুমি জানো ও সাইকেল চালাতে পারে। ওর বাবা ওকে এসএসসি পরীক্ষার পর সাইকেল চালানো শিখিয়েছে। আর তোমাকে দেখো! একবারও মেয়ে,বউকে দেখতে এলে না।

জুবায়ের মলিন হেসে মাথা নেড়ে বললো,, অপরাধ হয়েছে আমার। আমি কেন মেয়ে,বউকে দেখতে গেলাম না। জুবায়ের তার মেয়ের মতো মুখ ফুলিয়ে কান ধরলো।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। বাবার উপর রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না সাজি। পৃথিবীতে সব চেয়ে প্রিয় মানুষ গুলোর মধ্যে একজন হচ্ছে “বাবা”। বাবা বললে বিনা বাক্যে নদীতে ঝাঁপ দিতেও দুবার ভাববে না সাজি। বাবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সাজি।

জুবায়ের কান ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। মেয়ের এমন হাসি মানেই রাগ পড়ে গেছে। মা মেয়ে একই রকম। সামনের জন দোষ নিজের কাঁধে নিলেই তাদের রাগ পড়ে যায়।

সাজি মোবাইল স্ক্রীনে তার বাবার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,, বাবা সত্যি করে বলোতো তুমি কি ওইখানে আরেকটা বিয়ে করেছো? আরেকটা মেয়ে আছে তোমার? বাই এনি চান্স মা যে বিদেশিনী বলে সে তোমার সেকেন্ড ওয়াইফ নয়তো?

জুবায়ের সাজির এহেন কথায় কেশে উঠে বললো,, আম্মু কি বলছিস এইসব। আরেকটা বিয়ে মানে?

সাজি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো।

~ তাহলে তুমি আসছো না কেন? কবে আসবে বাবা?তুমি এলেই ঘুরতে যাবো। চলে এসো প্লিজ! দেখো তোমার একটাই মেয়ে। তার এতো টাকা পয়সার দরকার নেই। তার বাবা হলেই চলবে। টাকা না থাকলেও সে তার বাবার প্রিন্সেস।

জুবায়ের দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো। মেয়ের প্রত্যেকটা কথায় বাবার প্রতি তার অভিমান নয় বরং অপূর্ণ আবদারের দেখা মিলছে। আসলেই মেয়েটাকে সময় দেওয়া হয়নি। না দেখেছে ছোট্ট সাজিকে বড় হতে। আদো আদো বুলিতে করা আবদার গুলোও পূরন করা হয়নি।

অফিসের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরোচ্ছিলো সাদ। আর তখনই সাজির গলার আওয়াজ শুনে থেমে যায়।
সাদ বুকে হাত গুঁজে এতক্ষণ সাজির কথা গুলোই শুনছে। আসলেই তো মামা সাজিকে সময় দিতে পারেনি। খুব বেশি হলে দুমাস থেকেছে।

~ ঠিক আছে মা! এতো রাগ দেখাতে হবে না। সাদকে বল। সাদ তোকে রিমিদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। আর হ্যা! ভালো দেখে গিফ্টো কিনে নিবে।

সাজির মুখটা চুপসে গেলেও কন্ঠে ঈষৎ রাগ নিয়ে বললো,

~সব সময় সাদ সাদ করো কেন? তুমি চেনো তাকে? আমি যদি এখন যেতে বলি তখন দেখবে থা*প্পড় মে*রে দাঁত ফেলে দিবে। তোমার বোনের ছেলে ডে*ন্জা*রাস বাবা! কথায় কথায় দাঁ*ত ফেলে দেয়। দরকার হলে জন্মদিনে যাবো না তাও ওই গাড় ত্যাড়াকে বলবো না।

জুবায়ের শব্দ করে হেসে উঠে বললো,,

~ এতোটা ভ’য়ং’ক’র?

~ ভ’য়ং’ক’র মানে! কঠিন ভ’য়ং’ক’র। এর সাথে যাওয়ার চাইতে আমার উচিৎ মিলিটারি ক্যাম্পে চলে যাওয়া।

সাজির কথায় হো হো করে হেসে উঠলো জুবায়ের। সাদকে নিয়ে মেয়ের যে ধারনা তা শুনেই বেশি হাসি পাচ্ছে।

এইদিকে সাদ বেকুবের মত দাঁড়িয়ে নিজের বদনাম শুনছে।কি মেয়েরে বাবা! পিঠ পিছনে এর এতো সাহস? ব*দনামের দোকান খুলে বসেছে দেখছি।সাজির অভিযোগে নিজেকে কোনো ছবির ভিলেন থেকে কম কিছু মনে হচ্ছে না সাদের।ভিলেন বললে কম হবে! কোনো র*ক্ষস মনে হচ্ছে। ফেরিটেলে থাকা রা*ক্ষস! যে সব সময় রাজকুমারীকে ভয় দেখাতে আসে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ভেবে দেখলো আসলেইতো! কখনো নরম হয়ে সাজির সাথে কথা বলেনি। বরং সব সময় থা*প্প*ড়ের ভয় দেখাতো।

সাদ পকেটে দুহাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়ালো।মাথা কাত হয়ে সাজির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সাজি চোখ বড় বড় করে নিখুঁত ভাবে এক একটা এলিগেশন লাগাচ্ছে সাদের উপর। কখনো হাত নাড়িয়ে কথা বলছে তো কখনো কপাল কুঁচকে। কখনো ভীতি প্রদর্শন করছে তো কখনো মুখ ফুলিয়ে রাখছে। সাদ মুগ্ধ হয় এতে। বার বার হাজার বার মুগ্ধ হয়। এতো বছর পার হলো তবুও মুগ্ধতায় ভাটা পড়লো না। বরং সেই মুগ্ধতা বাড়লো ব-ই কমলো না।

~ আচ্ছা বাবা সত্যি করে বলোতো। সাদ ভাই কি সত্যি ফুপ্পির ছেলে?

সাজির প্রশ্নে জুবায়ের চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, হঠাৎ এমন প্রশ্ন?

এইদিকে সাজির এহেন প্রশ্নে ঘোর ভাংলো সাদের। হকচকিয়ে গেল পুরো।এই মেয়ে বলে কি?

~ প্রশ্ন করার কারনতো আছেই বাবা। তা না হলে দেখো। আমার ফুপ্পি কত্তো কিউট!কত্তো ভালো আর শান্ত। কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলে।
ফুফাও খুউউব ভালো ছিল। সব সময় সবার সাথে কতো সুন্দর করে কথা বলতো। রাগ তো একটুও ছিল না। তুমি জানো বাবা ফুফা সবসময় আমার জন্য চকলেট কিনে আনতো। ঠিক যেমন জেঠু নিয়ে আসতো তেমন।

কিন্তু সাদ ভাইকে দেখো! একটা গুনও ফুপ্পি- ফুফার মতো পায়নি। এর থেকে তো সন্দেহ হবেই। নিশ্চয়ই ফুপ্পি এই রাগী বাচ্চাকে এডপ্ট করেছে। এইটা আমার ফুপ্পির ছেলে হতেই পারে না।

জুবায়ের মেয়ের কথায় গুরুত্ব দিলেন। নয়তো চটে যেতে দেরী হবে না। মেয়ে তার মায়ের মত উদ্ভট কথা আর যুক্তিতে ওস্তাদ। তাদের এই উদ্ভট কথা আর যুক্তিতে সহমত পোষণ না করলেই বিপত্তি। জুবায়ের সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো ঠিক বলেছিস তো। আমার মায়ের কথায় যুক্তি আছে।

সাজি মুখে হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,, হুম এতো দিন এইটাই ভাবছিলাম।

সাদ দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে বলে উঠলো,, একবার খালি হাতের কাছে পাই। চা*পকে সিদে করে দিবো।
রাগে গজগজ করতে করতে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লো সাদ।
~এই মেয়ে আমার মামুর চোখে আমাকে ঘাড় ত্যাড়া প্রমাণ করলো! আমার চাইতে মিলিটারি ক্যাম্পে যাওয়া বেটার! ওয়েট এন্ড সি !আজিবন আমার সাথেই থাকতে হবে। এই গাড় ত্যাড়া ছেলেটাই তোমার বর হবে। ফুপ্পির দত্তক নেওয়ার ছেলের বউটা তুমিই হবে সাজবাতি।
গাড়ির স্টেয়ারিংএ ঘু*সি মে*রে হিস হিস করে বলে উঠলো সাদ।
__

জুবায়ের মুচকি হেসে বলল,, কিন্তু আম্মু, আমিতো দেশে নেই। আর জানিও না দেশের এখন পরিস্থিতি মেয়েদের জন্য কতোটা সেইফ। তবে সাদ জানে, সাদ ভরসার যোগ্য ,ও তোমার খেয়াল রাখবে। তাই সাদকে বলে লক্ষি মেয়ের মতো তৈরি হয়ে রিমিদের বাসায় যাবে ঠিকাছে!

সাজি মাথা নেড়ে হ্যা বুঝালো। জুবায়ের কয়েক সেকেন্ড মেয়ের দিকে তাকিয়ে কল কেটে দিলো। এইবার দেশে না গেলেই নয়। দায়িত্বটা থেকে কিছুদিন অব্যহতি নিয়ে নীড়ে ফিরতে হবে। মেয়ে আর প্রিয়তমা তার ফেরার অপেক্ষায় আছে।

সাজি বাবার সাথে কথা বলা শেষ করে, ফুপ্পির পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। উদ্দেশ্য সাদকে রাজি করানো। রেনু মিট মিট করে হাসছে।

অনিলা স্মিত হেসে সাজিকে জড়িয়ে ধরল।

~ তা কি পরে যাবি?শাড়ি নাকি থ্রিপিস?

সাজি ডেব ডেব করে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছেনা ফুপ্পি কি বলছে। কোথায় যাওয়ার কথা বলছে?

অনিলা সাজির হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলো। আলমিরা খুলে একটা একটা করে সব কটা শাড়ি বের করতে লাগল।

সাজি অবুঝ চোখে অনিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,,

~ কোথায় যাওয়ার কথা বলছো ফুপ্পি?

অনিলা রহমান একটা টকটকে লাল শাড়ি হাতে তুলে নিলো। সেই শাড়ির আচল সাজির মাথায় নিয়ে বললো,, রিমির জন্মদিনে।

~ সত্যি!

~ হুম সত্যি। এখন দেখ শাড়িটা কেমন। আমার তো বেশ লাগছে।

~ আগে বলো তুমি কি ভাবে জানলে?

~ রেনু বলেছে। এই নিয়ে নাকি বাবার সাথে রাগারাগীও হয়েছে।

সাজি মুখ ফুলিয়ে বললো,, রাগারাগী আর কই হলো। বাবার সাথে বেশিক্ষণ রেগে থাকতে পারি না।

অনিলা রহমান অন্য শাড়ি গুলো গুছিয়ে রেখে সাজির হাতে লাল শাড়িটা ধরিয়ে দিলো।

____

বিকেলে অনিলা আর রেনু মিলে সাজিকে শাড়ি পরিয়ে দিলো।

রেনু নিজের ব্যাগ থেকে লাল লিপস্টিক এনে সাজির ঠোঁট দুটো রাঙ্গিয়ে দিলো।

অনিলা সাজির চুলে সুন্দর করে খোঁপা বেঁধে একটা আর্টিফিশিয়াল লাল ফুল সাজির খোঁপা গেঁথে দেয়।যেটা টিভির পাশে ফ্লাওয়ারবাসে সাজানো ছিল।

কান খালি দেখে রেনু তার লাল ঝুমকো জোড়া এনে দিলো। ঝুমকা জোড়া বেশ পুরোনো,একটা ঝুমকাতে দুই পাথর নেই।এতে রেনু ইতস্তত বোধ করছিলো তবে সাজি বেশ উৎসাহ নিয়েই ঝুমকো দুটো পরলো।

সাজি ভিষন খুশি এই প্রথম এমন সাজগোজ করেছে। বার বার ঘুরে ঘুরে আয়নাতে নিজেকে দেখছে।

রেনু সাজির দিকে তাকিয়ে আ*হত স্বরে বলল,, লাল চুড়ি নেই। মনে হচ্ছে দেশে প্রধান মন্ত্রী নেই।

রেনুর কথা শুনে আনিলা মুখ চেপে হাসছে। সেঁজুতি ঠিকই বলেছে, রেনুর এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আফ্রিকার ক্যাঙ্গারু হওয়া বাদেও উল্টো পাল্টা কথা বলার ক্ষমতা।

গাড়িতে বসে মাকে কল দিলো সাদ।

অনিলা সাদের কল পেতেই সাজিকে তাড়া দিয়ে গেইটের কাছে যেতে বললো।

সাজি শাড়ি ধরে পা টিপে টিপে গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সাদ বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামতে যাবে এমন সময় চোখ পড়লো গেইটের দিকে।
বার কয়েক চোখ কচলে আবার তাকালো। সোজা হয়ে বসে লম্বা শ্বাস নিয়ে মাকে কল দিলো।

অনিলা রহমান এতক্ষণ ধরে এই কলটার অপেক্ষাই করছে। কল রিসিভ করে বলে উঠলো,,
তোর বাবা যেই দিন আমাকে প্রথম প্রেম নিবেদন করে, সেই দিন আমি এই শাড়িটাই পড়ে গেছিলাম। কাকতালীয় ভাবে আমার কাছেও লাল চুড়ি ছিল না। শূন্য হাত জোড়া দেখে তোর বাবা আমাকে দু মুঠো লাল চুড়ি কিনে দেয়।

সাদ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে উঠলো,, আমাদের ফিরতে দেরী হবে মা।

অনিলা কল কেটে দিয়ে মুচকি হাসে। সেই দিনের মতো এই ব্যাস্ত শহরে আজও কি প্রেম নিবেদন হবে? কে জানে! হয়তো হবে।

ইনশাআল্লাহ চলবে,,,