গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:২৪
সাদের এমন ডাকে ডুকরে কেঁদে উঠলো সাজি। নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হয়েছে,তা না হলে সাদ ভাই আসবে কেন?এমন করেইবা ডাকবে কেন? সাজি মুখে হাত চেপে কাঁদছে।
সাজির কান্নার আওয়াজ পেয়ে সাদ উতলা হয়ে উঠে। দরজায় ধা*ক্কা দিয়ে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললো,, দরজা খুলতে বলেছি সাজি। তাড়াতাড়ি দরজা খোল নয়তো ভে*ঙে ফেলবো।
সাদের এমন কথায় হিচকি তুলতে তুলতে দরজার খুলে দিল সাজি। টাইয়ের নট ডিলে করতে করতে রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করলো সাদ।
সাজি মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। সাদ সাজির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মুখ থেকে জোর করে হাত সরিয়ে নিল। সাজির চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছিল। সাদ আলতো হাতে সাজির চোখ মুছে দুগালে হাত রেখে বলল,, এতো কাঁদতে হয়? পরীক্ষা তো সব ভালোই দিয়েছিস। তাহলে কাদছিস কেন?কনফিডেন্স নেই নাকি?
সাজি কান্নারত গলায় বলল,, ফেইল করেছি তাইনা সাদ ভাই?
সাদ মুচকি হেসে আলগোছে সাজির চুল ঠিক করে দিতে দিতে বললো, ফেইল না তবে অল্পের জন্য গোল্ডেন মিস হয়েছে। সাদের কথা শুনে সাজি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,সত্যি!
সাদ দুই ভ্রু নাচিয়ে বলল, সাদ কখনো মিথ্যা বলে না। সাজঁবাতির ব্যাপারে তো কখনোই না।
সাদের কথা শেষ হতে না হতেই ঝড়ের গতিতে সাদের বুকে ঝাঁ*পিয়ে পড়লো সাজি। সাজির এমন কাজে সাদ হতভম্ব হয়ে গেছে। দুহাত দু’দিকে ছড়িয়ে মুখটা ইষৎ হাঁ করে রেখেছে।সাদ বুঝতে পারছেনা কি করবে। মেয়েটা খুব বেশি কষ্ট পেলে কিংবা খুব বেশি খুশি হলে এমন কাজ করে বসে। নেহাত আজ রেজাল্ট দিয়েছে নয়তো আজকের দিনটা বিগত একটা মাসের মত যেতো। সাদ লম্বা শ্বাস নিয়ে দু’হাতে আগলে নেয় সাজিকে। সাজি খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,, সাদ ভাই আমি পাশকরে ফেলেছি। ভেবেছিলাম পরীক্ষা ভালো দিলেও ভাগ্য হয়তো সহায় হবে না। কিন্তু দেখেছেন আমি এপ্লাস পেয়েগেছি। রাতের ঘুম হা*রাম করা সফল হয়েছে বলুন?
সাজির যেন খুশির ঠিকানা নেই ।সাদ সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,, বিগত একমাস আমার ঘুম হা*রাম করাটাও সফল হয়েছে।
সাদের কথা কর্ণগোচর হতেই সাজির সম্বিৎ ফিরল। হকচকিয়ে সাদকে ছেড়ে সরে আসতেই সাজিকে আটকে দিলো সাদ।
সাজির মাথাটা বুকে আলতো করে চেপে ধরে নরম গলায় বলল,এইখানটায় ক*ষ্ট হয় সাজি। কাজের চাপে থাকায় খোঁজ খবর নিতে পারিনি। কিন্তু তার শাস্তি এতো কঠিন হবে জানতাম না। দেখেও না দেখার মতো কি করে থাকতি তুই? কই আমিতো পারতাম না!সেইতো বাহানা দিয়ে চলে আসতাম।কি করে থাকতি তুই বল!
সাদের কথায় সাজির ভীষণ খারাপ লাগলো।সাজি বুঝতে পারছে ব্যাস্ত না থাকলে সাদ কখনোই এমন করতো না। নিজের ভিতর অপরাধবোধ কাজ করছে। সাজি দুহাতে সাদের পিঠ জড়িয়ে ধরে বললো,, ভীষণ রেগে ছিলাম। একটা কল দিয়ে খবর নিলে কি হতো!মিস করতাম খুব। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে ঠিকই খবর নিতাম আমি। আপনার মতো না যে সব ভুলে বসে থাকবো। হুহ!
সাজির কথা শুনে সাদ মুচকি হেসে বললো, কেন খবর নিতি অভিমানী! আমি কে হই যে খবর নিতে হবে?
সাদের কথা শুনে সাজি মাথা তুলে সাদের দিকে তাকালো। সাদ দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললো,, কেন খবর নিতি বল! সাদের এমন কথায় সাজি আমতা আমতা করে বলল,, নিজেকে প্রশ্ন করুন। আপনি কেন এতো উতলা হতেন?
সাদ সাজির কথা শুনে ঠোঁট চেপে হেসে সাজির কপালে আলতো করে ঠোঁট আটলো। সাজি চোখে বুঁজে নিতেই সাদ সাজির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,, আমার প্রিয়তমা তুই! সাজেঁর বেলায় ইষৎ অন্ধকার ঘরের সাজবাতি তুই। তাই এতো উতলা হই।
সাদের তপ্ত নিঃশ্বাস ঘাড়ে পড়তেই শিউরে উঠলো সাজি। পিঠে জড়িয়ে রাখা হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো । কেঁপে উঠা ওষ্ঠদয়ে না বলা কিছু কথা বলার চেষ্টা করতেই সাদের এমন কথায় থেমে গেলো ।সাদের মুখে প্রিয়তমা শব্দটা ভীষণ আদুরে ঠেকছে কানে।
সাদ সাজির মুখের দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়ালো। মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়েগেছে। আর কিছুক্ষণ তাকালে হয়তো কোনো ভুল করে ফেলবে। সাদ সরে দাড়াতেই সাজি আর একসেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো। সাদ ভাই নামক মানুষটার সামনে আর কিছুক্ষণ থাকলে লজ্জায় ম*রে যেতো।সাজি সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বার কয়েক সাদের বলা কথাটা আওড়ালো,, প্রিয়তমা, প্রিয়তমা,প্রিয়তমা,।
দুইদিন ধরেই জুবায়ের কিছু বলবে বলবে বলছে। কিন্তু বরাবরই কিছুনা বলে কাটিয়ে দিচ্ছে।
আজ জুবায়ের এই নিয়ে পঞ্চম বারের মতো অনিলাকে কল দিয়েছে। জুবায়েরের একটাই কথা মেয়ের রেজাল্ট দিয়েছে তাই একসপ্তাহ গিয়ে থাকতে হবে। অনিলা বুঝতে পারছেনা রেজাল্টের সাথে এক সপ্তাহ থাকার কি সম্পর্ক। কিন্তু জুবায়ের শুনতে নারাজ। ছোট ভাইয়ের আবদার করা দেখে অনিলা আর না করতে পারলো না। বিনা বাক্যে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাছাড়া সাজিকেও কথা দিয়েছিলো পরীক্ষা শেষ হলে সপ্তাহখানেক তার সাথে থাকবে। অবশেষে এখন সময় হলো।
এইদিকে সাজি ভীষণ খুশি। বাবাকে বলে ফুপ্পিকে আনানোর ব্যবস্থা করেছে ভাবতেই লাফিয়ে উঠছে।ফুপ্পি বাড়ি এলে সাজি বাড়ি থেকে বের হওয়ার লাইসেন্স পেয়ে যায়। ড্রাইভার আংকেল এসেছে সপ্তাহ দুই হলো,বের হলেও কোনো সমস্যা হবে না।বাবাকে বলে রেখেছে ফুপ্পি এলেই ঘুরতে বের হবে। মেয়েটার কোনো আবদার আজ ওবদি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পূর্ন করতে পারেনি। তাই মেয়ের কথায় জুবায়ের আর না করতে পারলো না।
সাদের অফিস থেকে কল আসার পর পরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। অফিসের কাজে আউট অফ টাউন যেতে হবে। কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে হয়তো দুইদিন সময় লাগবে। সাদ তার মাকে কল করে সবটা জানিয়ে রায়হানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
অনিলাকে পেয়ে সাজি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। পুরোদিন ফুপ্পির পেছনে পেছনে ছুটছে।
কাল ঘুরতে বের হবে এই নিয়ে নানান রকম প্ল্যানিং করে ফেলেছে। সেই প্ল্যানিং গুলো বাবার সাথে শেয়ার করবে বলে বার কয়েক কল করলো। কিন্তু বারবার ফোন সুইচ অফ আসায় মেসেজ করে দিলো।
পরেরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই যথা সময়ে সাজি আর অনিলা বেরিয়ে পড়লো।পুরো বিকেলটা শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াবে। রাতের খাবার খেয়ে তবেই ফিরবে। সাজির এমন কথা শুনে সেঁজুতি ক্ষেপে গেলেও অনিলা রহমানের সামনে কিছু বলতে পারেনি। অনিলা ইশারায় মানা করেছে কিছু বলতে। রেনুর যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও চাঁদের শরীর ভালো নেই যার দরুন রেনু যেতে পারেনি। অগ্যতা সাজি আর অনিলা রহমান বেরিয়ে পড়লো।
সাদের কাজ শেষ হতেই রায়হান সহ বেরুলো। দুইদিন লাগার কথা সেখানে একদিনেই সব কাজ হয়ে গেছে। আপাতত বাড়ি ফেরার পালা। দুইদিনে অনেক ধকল গেছে। সাদ মায়ের কাছে শুনেছে সাজি সহ ঘুরতে বেরিয়েছে।সাজি প্রায় সময় অনিলা রহমানকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় তাই সাদ তেমন একটা মাথা ঘামালো না। গাড়িতে বসে সাজির ছবি গুলো এক এক করে দেখতে লাগলো। সাদের মতে সাজি নামক মেয়েটা তার ক্লান্তির অবসান। আপাতত প্রিয়তামার মুখায়বব দেখে সেই ক্লান্তির রেশ কাটাতে চাইছে সাদ।
অন্যদিকে সেঁজুতি পুরো ঘর জুড়ে পায়চারি করছে। কাল থেকে জুবায়ের কল করছে না। অনলাইনেও নেই। সেঁজুতি যতবার নাম্বারে কল দিয়েছে ততবারই ফোন সুইচ অফ বলছে। সেঁজুতি গা দিয়ে ঘাম ছুটে গেলো। জুবায়ের কখনো এমন করে না। তাহলে আজ কি হলো। সেঁজুতির মন মস্তিষ্ক জুড়ে সব অদ্ভুত বা*জে খেয়াল আসছে। সেঁজুতি মোবাইল হাতে নিয়ে আসফাস করছে। দুইদিন আগেও লোকটার সাথে রাগ দেখিয়েছে এই ভেবেই চোখ জোড়া ভিজে উঠলো।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,
গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:২৫(১ম খন্ড)
শপিং মলের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো সাদ। পুরো মার্কেট ঘুরে ঘুরে চারটা শাড়ি কিনলো। একটা মায়ের জন্য, একটা মমতাময়ী মামুনীর জন্য আর দুইটা সাজির।সাজির জন্যে কেনা শাড়ি দুটোর সাথে ম্যাচিং করে চুড়ি , ঝুমকো নিলো। রায়হান সাদের সাথে হেঁটে হেঁটে তার শপিং করা দেখছে এতক্ষণ। চুড়ি আর ঝুমকো কেনার সময় রায়হান হেসে কুটিকুটি হওয়ার অবস্থা। সাদ একটা একটা করে ঝুমকো হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড করে চোখ বুজে রাখছে। রায়হান এই ভেবে হাসছে তার স্যার ঝুমকো পরিহিতা ম্যামকে কল্পনা করেই শপিং করছে। রায়হানের দাঁত কে*লা*নো দেখে সাদ দাঁতে দাঁত চেপে শাসালো । কিন্তু তেমন একটা কাজ হলো না। রায়হান বে*সরমের মতো হেসেই চলেছে। শেষে সাদ রায়হানের উপর গিবআপ করে দিলো।সাদ জানে এখন হাজার বকলেও কাজ হবেনা। সাদের কেনাকাটা শেষ হতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
শহর জুড়ে সন্ধ্যা নেমেছে । শহরের মানুষ গুলোর নীড়ে ফেরার ভীষণ তাড়া। গাড়ি গুলো একটা অন্যটাকে ওভারটেক করে ছুটে চলেছে। সাদ বাইরের দিকে তাকিয়ে ভীষণ বিরক্ত হলো। এমন করে ড্রাইভ করলে হয়তো সময় বাঁচবে ঠিকই, কিন্তু একটু এদিক ওদিক হলে জিবন হা*রাবে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মোবাইলে চোখ রাখলো সাদ।
বেশকিছুটা সময় পর রায়হান হুট করেই গাড়ি থামিয়ে দিলো। সাদ মোবাইলে দিকে চোখ রেখে বলল,, কি হলো গাড়ি থামালে কেন?
রায়হান সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,, স্যার আমাদের সামনের দুটো গাড়ির সামনেরটা এক*সি*ডেন্ট করেছে ।
সাদ তৎক্ষণাৎ মুখ তুলে সামনে দিকে চাইলো।
~ কি ভাবে কি হয়েছে?
~ একটা ট্রা*ক এসে পাশ থেকে মে*রে দিয়েছে। ড্রাইভারের স্পট ডে*থ আর যে দুইজন মহিলা ব্যাকসিটে ছিলো তাদের অবস্থা মনে হয় তেমন ভালো না। বাঁ*চ*বে কিনা সন্দেহ।
~এক*সিডে*ন্ট হয়েছে কতক্ষনে!এখনো কোনো এ*ম্বু*লেন্স এলো না কেন। রায়হান আমি বের হচ্ছি তুমি গাড়ি সামনে নাও। বাই এনি চান্স এ*ম্বু*লেন্স আসতে দেরি হলে আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
সাদ চিন্তিত ভঙ্গিতে মোবাইল হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। রায়হান সাদের কথায় হা সূচক মাথা নেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
সাদ দৌড়ে এগিয়ে গেলো। মানুষের ভিড় ঠেলে গাড়ির সামনে দাড়াতেই থমকালো সাদ। গাড়িটা তার খুব বেশি পরিচিত। এই গাড়ির নাম্বার প্লেটের নাম্বারটা সাদ হাজার বার দেখেছে যার দরুন এই নাম্বারটাও মুখাস্ত। সাদ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা পায়ে গাড়ির কাছে যেতেই চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। গাড়ির সামনের পাশটা চ্যা*পটা হয়ে গেছে। যা দেখার পর যে কেউ বলবে ড্রাইভারের স্প*টডে*থ হওয়াটা স্বাভাবিক ।
সাদ উ*ন্মা*দের মত জানালার কাঁচে আ*ঘা*ত করতে লাগলো। সাদের এমন পা*গ*লামো দেখে একটা ছেলে এসে ইট দিয়ে বাড়ি মে*রে গাড়ির জানালার কাঁচ ভে*ঙ্গে দিলো।
সাদ মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করে গাড়ির ভেতরে তাকাতেই চুপসে গেল। সেকেন্ডের মধ্যে বুকটা ভারি হয়ে এলো। মনে হচ্ছে কেউ গ*লা চে*পে ধরে রেখেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। সাদের চোখ বেয়ে জল উপচে পড়ছে।কাঁপা কাঁপা হাতে অনিলা রহমানের র*ক্তা*ত্ত মাথায় হাত রেখে ধীর গলায় ডাকলো ,, ম,মা!
অনিলা রহমান নিভু নিভু চোখে সাদের দিকে তাকালো। অনিলা চোখ দিয়ে ইশারা করে সাজিকে দেখালো। সাজি মাথা চু*ই*য়ে র*ক্ত পড়ছে যা অনিলা রহমানের ধুসর রঙের শাড়ি র*ক্তি*ম বর্ণ করে দিয়েছে। সাজির দিকে তাকাতেই ঠোঁট কামড়ে কা*ন্না আটকালো সাদ। যাদের ঘিরে তার সাজানো পৃথিবী তাদের এই অবস্থায় দেখে সাদ কি করবে বুঝতে পারছে না।দাঁত মুখ খিচে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। কয়েকজন লোক মিলে দরজা খোলার জন্য টা*না হে*ছ*ড়া শুরু করে দিয়েছে। সবাই চাইছে বাকি দুজন যেন বেঁ*চে ফিরে। তাই যে যার মতো চেষ্টা করে যাচ্ছে।
রায়হান সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছুটে এলো। গাড়ির ভেতরে থাকা মানুষ গুলোকে দেখে পা জোড়া বরফের ন্যায় জমে গেলো। সাদের মতো রায়হান নিজেও স*কের মধ্যে আছে।
এম্বু*লেন্স আসতেই কিছু ছেলে মিলে রাস্তা ক্লিয়ার করে দিলো। অনেক চেষ্টার পর গাড়ির দরজা খুলতে পেরেছে। অনিলা রহমানের সেন্স থাকলেও সাজি সেন্সলে*স,পালস্ রেটো ধীরে ধীরে কমে আসছে। অনিলা রহমানকে এম্বুলেন্সে তোলা হলো। সাদ পুরোই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। পা*গ*লের মতো একবার এম্বুলেন্সের কাছে যাচ্ছে, আবার গাড়ির কাছে যাচ্ছে ।
সাজিকে এ*ম্বু*লেন্সে তোলার পর রায়হান সাদকেও তাদের সাথে দিয়ে দিলো। ড্রাইভারকে এখনো গাড়ি থেকে বের করা যায়নি। ড্রাইভারকে বের করার চেষ্টা চলছে। রায়হান ড্রাইভারের ডিটেল্স দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
সাদ এম্বুলেন্সে ভেতরে অনিলা রহমান আর সাজির হাত ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো ডু*ক*রে কাঁ*দছে। খুব প্রিয় দুটো মানুষকে এই অবস্থায় দেখে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা সাদ। অনিলা রহমানের চোখের কোন বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। ক*ষ্টের ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। বারবার সাদকে কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা।
রায়হান স্পিড বাড়িয়ে এম্বুলেন্সের সামনে গিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করতে লাগলো। মনে মনে শুধু একটাই দোয়া দুইজনের যেন কিছু না হয়। দুইজনের মধ্যে একজনের কিছু হলে সাদ কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। তার বাঁ*চা দু*স্কর হয়ে পড়বে। তাই রায়হান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে দুইজনেই যেন সুস্থ হয়ে ফিরে।
পাঁচ মিনিটের রাস্তা সাদের কাছে পাঁচ ঘণ্টার মতো লাগছে। বার বার ড্রাইভারকে স্পিড বাড়াতে বলছে।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,
গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:২৫(২য় খন্ড)
এশার নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে আছে সেঁজুতি। চোখ মুছে জায়নামাজ গুটিয়ে উঠে পড়লো। জুবায়েরের ফোন এখনো ওবদি বন্ধ। লোকটাকে সেঁজুতি চেনে যার দরুন ফোন বন্ধ দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে । দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকালো সেঁজুতি। ঘড়িতে তখন আটটা বেজে বিশ মিনিট,মেয়েটা ফুপ্পিকে পেলে ঘরদোর ভুলে বসে।না জানি কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছে। কল না দিলে আজ ফিরবেই না। সেঁজুতি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অনিলার নাম্বারে ডায়েল করলো। কল গেলো না বরং একজন নারী ভরাট কন্ঠে বলছে” ডায়েলকৃত নাম্বার এই মুহূর্তে বন্ধ আছে”। বিরক্তে সেঁজুতির ললাট কুঁচকে এলো। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, মেয়েটা আপার মোবাইলটা রাখলো না।ছবি তুলে তুলে চার্জ সব খেয়ে ফেলেছে। আজ ঘরে আসুক!ঘুরাঘুরি বের করবো।
রেনু চাঁদকে কোলে নিয়ে নিচে নামতেই সেঁজুতি বিড়বিড় করে বলা কথা গুলো শুনে ফেললো।
চাঁদকে সোফার উপর বসিয়ে সেঁজুতি শিয়রে বসে বললো,, খালা এতো টেনশন কিসের? ড্রাইভারকে কল দিলেই হয়। সাজি আপা নিশ্চই ড্রাইভারের মোবাইল দিয়ে ছবি তুলবে না!
রেনুর কথা শুনে সেঁজুতি খুশিতে রেনুর হাত ধরে গদগদ কন্ঠে বললো,,রেনু তুই পড়ালেখা করলে শিওর কোনো সিক্রেট ইন্টেলিজেন্ট টিমের হেড হতি। এতো বুদ্ধি তোর।
রেনু সেঁজুতির কথা পুরো না বুঝলেও তাকে বুদ্ধিমতী বলেছে এইটা ঠিকই বুঝেছে।তাই দাঁত বের করে হেসে উঠলো।
সেঁজুতি ড্রাইভারের নাম্বারে কল দিবে এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। সেঁজুতি মোবাইল রেখে বললো,, কল দিতে হবেনা। চলে এসেছে যা গিয়ে দরজা খোল।
সেঁজুতির কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই রেনু হড়বড়িয়ে দরজার কাছে চলে গেলো। তড়িগড়ি করে দরজা খুলে হা করে তাকিয়ে রইল রেনু।
সেঁজুতি রেনুর ছুটাছুটি দেখে বরাবরের মতো মাথা চাপড়ালো।
রেনু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে সামনাসামনি কখনো না দেখলেও অনেকবার ভিডিও কলে দেখেছে। যার দরুন চিনতে অসুবিধা হলোনা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আর কেউ না সাজি আপার বাবা।
জুবায়ের রেনুকে অবাক হতে দেখে বললো,, কি হয়েছে রেনু?
রেনু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,, খালু !খালাম্মা আপনার জন্য টেনশন করছে আর আপনি মোবাইল না ধরে বাড়িতে চলে এসেছেন?আজ আপনার খবর আছে।
রেনুর কথা শুনে জুবায়ের শব্দ করে হেসে উঠলো।
সেঁজুতি ঠিকই বলেছে,রেনু অন্য সবার থেকে আলাদা। সরল মনের অধিকারী মেয়েটা।
সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রেনু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কি করছে সেটাই বুঝতে পারছে না। সেঁজুতি চাঁদের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রেনুকে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,, রেনু! তুই মানুষ হবি না। দরজার সামনে দরজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষ ঘরে ঢুকবে কি করে?
সেঁজুতির গলা পেয়ে রেনু সরে দাঁড়ালো। জুবায়ের মুচকি হেসে সেঁজুতির দিকে তাকিয়ে আছে। সেঁজুতির কোনো নড়চড় নেই। সেঁজুতি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে চোখ জোড়া অশ্রু জলে শিক্ত হয়ে উঠেছে, শুধু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়।
জুবায়ের তার প্রেয়সীর অভিমানী চোখ জোড়ার অভিমান পড়তে দেরি হয়নি। জুবায়ের সেঁজুতির সামনে দাঁড়াতে সেঁজুতি হাউমাউ করে কেঁ*দে জুবায়েরের বুকে ঝাঁ*পি*য়ে প*ড়লো।
রেনু দরজা আটকে চাঁদকে কোলে নিয়ে মুচকি হেসে রুমে চলে গেল।
সেঁজুতি কাঁ*দতে কাঁ*দতে হেঁচকি উঠে গেছে। জুবায়ের সেঁজুতির মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে করতে বললো,, এতো কাঁদলে আসলাম কেন? তোমার মেয়ে রে*গে*মে*গে একাকার!মেয়ে বউকে কেন দেখতে আসলাম না। এখন এসে যখন এইসব দেখছি তখন থাকার মানেই হয় না। ছাড়ো চলে যাচ্ছি।
~~~~
সাজি আর অনিলার অবস্থা ক*রুণ। হাসপাতালে আনার পর পরই পরীক্ষা নীরিক্ষা শুরু হয়।,সাজির মাথায় আ*ঘা*তটা গ*ভীর। মস্তিষ্কের র*ক্ত*ক্ষ*রন হলে কর্টেক্স এবং ব্রেন স্টোম সম্পর্ন ভাবে ন*ষ্ট হয়ে ব্রেন ডে*ড হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া সাজির একটা পা বা*জে ভাবে ফ্রে*ক*চার হয়েছে । সাজির অতিসত্বর সার্জারি দরকার।। অন্যদিকে অনিলা রহমানের মাথার ডান পাশ দরজার সাথে জোরে বা*ড়ি খাওয়ার দরুন থেঁ*ত*লে গেছে,সার্জারিতে দেরী হলে ওনার একটা চো*খ কর্মক্ষমতা হারাবে বলে ধারণা করছে, সাথে ডান হাতে ফ্রে*কচার হয়েছে। সব মিলিয়ে দুইজনের অবস্থান শো*চ*নীয়।চিফ সার্জন দুইজনের ইসিজি রিপোর্ট এবং এক্স-রে দেখে OT-1 আর OT-2 তাড়াতাড়ি রেডি করার জন্য বলেছে।
সব শোনার পর সাদ বুঝতে পারছিলো না কি করবে। সাদ কোনো প্রকার ফর্মালিটি পূরন না করেই বসে ছিল। সাদকে হাসপাতালের ফর্মালেটি পুরন করতে বলার পর সাদ তার ক্রেডিট কার্ড আর পিন নাম্বার দিয়ে সরে আসে। সাদের অবস্থা বুঝতে পেরে রায়হান সকল প্রকার ফর্মালিটি পুরন করে দেয়। রায়হান জানে এই মুহূর্তে সাদের কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই।
OT-1 আর OT-2 মুখামুখী, দুইরুমে দুইজনের অপারেশন চলছে। সাদ মাঝখানে করিডোরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর ডুকরে কেঁদে উঠছে। ঠিক কি করা দরকার, কোথায় গেলে সব ঠিক হবে সেটাই বুঝতে পারছেনা সাদ। নিজের মাথার চু*ল নিজে টা*নছে বসে বসে।
রায়হান সাদের মোবাইল নিয়ে সরে এসে মোবাইলে লক খুললো। রায়হান জানে সাদ ওই অবস্থায় নেই যে ফোন করে সবটা জানাতে পারবে। রায়হান কনট্রাক নাম্বার গুলো থেকে মামুনী লেখা নাম্বারটা খুঁজে নিয়ে ডায়েল করলো।
সেঁজুতি তখন চোখ মুছে জুবায়েরকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই মোবাইল ফোন বে*জে উঠলো। সেঁজুতি ফোন হাতে নিয়ে দেখে সাদের নাম্বার থেকে কল এসেছে।
সেঁজুতি তড়িগড়ি করে করে মোবাইল রিসিভ করতেই।অপর প্রান্ত থেকে রায়হান বলে উঠলো,,
ম্যাম আমি সাদ স্যারের পিএ রায়হান বলছি।
সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে বললো,, সাদের পিএ? সাদ কোথায়?
সেঁজুতির কথা শুনে জুবায়ের মোবাইল হাতে নিয়ে লাউড স্পিকার অন করলো।
রায়হান কয়েক সেকেন্ড থেমে বললো, উনিও আছে। কিন্তু কথা বলার অবস্থায় নেই। আপনারা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন।
রায়হানের কথা কথা কর্ণগোচর হতেই সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,, হাসপাতালে মানে? ক
কি হয়েছে সাদের?
জুবায়েরের উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,, কথা বলছনা কেন রায়হান! সাদ ঠিক আছে?
রায়হান ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বললো,, স্যার ঠিক আছে, কিন্তু স্যারের মা আর সাজি ম্যাম ঠিক নেই। ওনাদের এ*ক্সি*ডেন্ট হয়েছে। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ!
রায়হানের কথা শুনে সেঁজুতি বোবা চোখে জুবায়েরের দিকে তাকালো। মুখ খুলে কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারলো না। কেউ যেন গ*লা চে*পে ধরে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। জুবায়ের নিজেকে সামলে দাঁত মুখ শক্ত করে লাউড স্পিকার বন্ধ করলো। অতঃপর রায়হানের কাছ থেকে হাসপাতালে ঠিকানা জেনে নিলো। সেঁজুতি আ*হা*জারি করে কাঁ*দছে।কি থেকে কি হচ্ছে মাথায় ধরছে না। সেঁজুতির এমন আ*হাজা*রিতে রেনু হড়বড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সেঁজুতি বুক থা*ব*ড়ে চিৎ*কার করে কাঁ*দছে। জুবায়ের চোখ মুছে সেঁজুতিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। রেনু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। রেনুর কান্না দেখে রাফি আর চাঁদ কান্না শুরু করে দিলো।
ঘন্টা পার হয়েছে অপারেশন থিয়েটার থেকে এখনো বেরোয়নি ডাক্তাররা। শুধু দুই জন নার্স বেরিয়ে দুই ব্যাগ রক্ত নিয়ে আবার ভেতরে চলে গেলো।
সেঁজুতি ইতিমধ্যে দুইবার সে*ন্সলে*স হয়ে গেছে। জুবায়ের না নিজেকে সামলাতে পারছে না সেঁজুতি আর সাদকে পারছে।
রায়হান অফিসে কল দিয়ে সবটা জানিয়ে দিলো।
সাদ নিঃ*প্রাণ প্রায়। দৃষ্টি জোড়া স্থির হয়ে গেছে সেই কখন। এখনো ওবদি চোখের পলক ফেলেনি। সেই নিঃপলক চোখ জোড়া থেকে অনবরত নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। একটা ঘন্টা পার হয়নি সাদের মনে হচ্ছে যেন একশত বছর পার হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা কি স্থির হয়ে আছে!না কি ঘড়ি সময় ভুল বলছে! বুঝে পায় না সাদ, আর না সেটা বুঝার সেই ক্ষমতা আছে এখন। সাদের কাছে মনে হচ্ছে রাত গভীর নয় বরং দীর্ঘ হচ্ছে। চারজন মানুষের দীর্ঘ শ্বাস যেন এই দীর্ঘ রজনীতে বি*ষাদের সুর গাইছে। সাদ জানে এই বি*ষা*ক্ত রজনী আজ দীর্ঘ হবে,এই অপেক্ষার রজনী আজ দীর্ঘ হবে। এমন দীর্ঘ রজনী যেন কারো জিবনে না আসুক। যে রজনী প্রিয় মানুষ হা*রা*নোর ভ*য়ে পার করতে হবে সেই দীর্ঘ রজনী যেন কারো জিবনে না আসুক।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,