জৈষ্ঠ্যের প্রেম৷ পর্ব-১২

0
301

#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-১২)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

২৫.
জানালার কাচ ভেদ করে রুমের মধ্যে আলো প্রবেশ করল। সেই আলোর ছটায় মৌসন্ধ্যার গাঢ় ঘুমটা ভেঙে গেল। পিটপিট করে কয়েকবার চোখ খোলার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় তবুও ঘুমের রেশ কাটেনা। ঘুম যেন আকড়ে ধরেছে তাকে শক্ত করে।

দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুনে সে আর শুয়ে থাকতে পারল না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল বর্ষা নেই। ওয়াশরুমের দরজাটা বন্ধ ভেতর থেকে। অর্থাৎ তাকেই গিয়ে এই মুহূর্তে দরজাটা খুলতে হবে। আলুথালু অবস্থায় উঠে গিয়ে সে দরজা খুলল। দরজার ওপাশে এপ্রিল দাঁড়িয়ে আছে। মৌসন্ধ্যাকে দেখেই বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
-‘মাত্র ঘুম থেকে উঠলে? সবাই নাস্তা খেতে বসেছে। তোমাদের ডাকছে। জলদি আসো।’
-‘এই তো আসছি। তুই যা নাস্তা কর।’

এপ্রিল চলে যেতেই মৌসন্ধ্যা দরজা লক করে পুনরায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। একটু গড়াগড়ি করে আবার উঠে পড়ল। বর্ষা ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
-‘কে আসছিল?’
-‘এপ্রিল। নাস্তা করতে ডেকে গেল।’
-‘যা ফ্রেশ হয়ে আয়। বেশি দেরি করলে বকা খেতে হবে।’
-‘দেরি যা হওয়ার হয়েই গেছে।’

মৌসন্ধ্যা ব্যাগ থেকে নিজের একটা লম্বা কালো কূর্তি আর কালো রঙেরই প্লাজো বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। গোসল করেই নিবে একেবারে। দেরি হয়েছে যখন আরেকটু হলে আহামরি কোনো ক্ষ’তি হয়ে যাবেনা। গতকাল রাতের লম্বা জার্নির ফলে শরীরটা এখনও ম্যাজম্যাজ করছে।

মৌসন্ধ্যাকে গোসলে যেতে দেখে বর্ষাও আর তাড়াহুড়ো করল না তৈরি হতে। ধীরে সুস্থে নিজেকে ধাতস্থ করে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করতে থাকে।

————
বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা নিচে এসে দেখল চারিদিকে এলাহি কারবার। ডেকোরেশনের লোক আনা হয়েছে। আশেপাশের লোকদের দাওয়াত করা হয়েছে, তাই রান্নার আয়োজন চলছে। পুকুরে জাল ফেলা হচ্ছে। ছেলেরা সবকয়টা খুব ব্যস্ত। সাবাব আর মুকিত লুঙ্গিতে গুজ দিয়ে গাছে উঠছে ডাপ পাড়ার জন্য। তাদের চোখে মুখে উৎসব উৎসব ছাপ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই কাজ করতে তারা দুজন বেশ আগ্রহী। শরৎ আর শ্রাবণকে পুকুরের পাড়ে দেখা গেল জেলেদের সাথে কথা বলতে। আশ্বিন আর আষাঢ় বাহিরে ডেকোরেশনের ওদিকে তদারকি করছে। ডেকোরেশনের লোকদের থেকে কি কি কতটুকু পরিমাণের লাগবে তার হিসেব নিচ্ছে, বোধ হয় বাজারে যাবে। মামারা সবাই ড্রয়িং রুমে বসে নানাজানের সাথে গল্প করছে। তাদের সাথে রয়েছেন জুনের স্বামী আবিরও। বেচারার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এখানে বসে থাকতে ইচ্ছুক নয়। তার নয়া বউকে ফেলে বড়দের ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক আলাপে তার মন বসছে না। বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা বাহির থেকে এসে ডাইনিং এর দিকে যাওয়ার সময় শুনতে পেল ছোট মামা খুশিতে গদগদ হয়ে বলছেন,
-‘দেখেছেন ভাইজান! ছেলেগুলো কত বড় হয়ে গেছে! সব কাজ এখন তারা নিজেরাই করছে। আমাদের এখন ছুটি।’

কথাটা বলে নিজেই হো হো করে হাসল। তার সাথে তাল মেলালেন সেজো মামা আর মেজো মামা। বড় মামা আর নানাও হাসলেন কিন্তু তাদের হাসিতে শব্দ নেই।

খাবার টেবিলে এসে মৌসন্ধ্যা একটু চমকে উঠল। গ্রীষ্ম আর আহরার বসে আছে। তাদের খাওয়া শেষ বলা চলে। এখন চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। বর্ষা তাদের দেখে হেসে বলল,
-‘তোমাদেরও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো নাকি!’

প্রশ্নের জবাবটা আহরার কিংবা গ্রীষ্ম দেওয়ার আগে বর্ষার মা-ই দিলেন। রান্নাঘর থেকে হাতে দুই কাপ চা নিয়ে বের হয়ে এসে বললেন,
-‘আজ্ঞে না। ওরা দুইজন তো আপনার মতো রাজার ছাও না। ওদের সকাল সেই ছয়টাতেই হইছে। আপনার মতোন দশটা বাজে তাদের ঘুম ভাঙেনা। ছেলেগুলো সকাল থেকে কাজে কাজেই ব্যস্ত। খাওয়ার সময়ও পায় নাই।’

কথা বলতে বলতেই চায়ের কাপ দুজনের দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। তারপর হঠাৎ করেই গলার স্বর পালটে নরম সুরে বলল,
-‘বাবারা, পরোটা নাও। চায়ের সাথে পরোটা চুবিয়ে খেতে মজা আছে। একবার খেয়েই দ্যাখো।’
আহরার বলল,
-‘না না আন্টি। অলরেডি তিনটা খেয়েই ফেলেছি। আর পারব না।’
-‘গ্রীষ্ম নাও।’
-‘না মেজো আম্মু। আর খাব না।’

দুজনেই উঠে চায়ের কাপ নিয়ে বাহিরের দিকে রওনা দিচ্ছিল তখনিই পেছন দাঁড়িয়ে থাকা মৌসন্ধ্যাকে দেখে থেমে গেল। সে যে এইখানে ছিল কেউই টের পায়নি। বর্ষা চেয়ার টেনে বসতে বসতে মৌসন্ধ্যাকে বলল,
-‘দাঁড়াই আছিস কেন শুধু শুধু! তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। মাছ ধরা দেখতে যাব।’

মৌসন্ধ্যা একবার আহরার আর একবার গ্রীষ্মের দিকে তাকালো। সৌজন্যতার খাতিরে মৃদু হাসে। দুজনেই একটু সরে তাকে যাওয়ার জায়গা করে দিল। সে জায়গা পেয়ে বর্ষার পাশে গিয়ে বসল। গ্রীষ্মের এখন আর বাহিরে যেতে ইচ্ছা করল না। কিন্তু উঠে পড়েছে! মৌসন্ধ্যা আছে জানলে সে আরো দুইটা পরোটা নিয়ে বসে থাকত। কেবল তার একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। আহরারই ভালো সুযোগ করে দিল। সে উল্টো ঘুরে টেবিলে গিয়ে পুনরায় বসে বলল,
-‘বাহিরে চা খাওয়ার থেকে এখানে বসে চা খেয়ে গেলেই ভালো হয় গ্রীষ্ম। আয় ব্যাটা! এইখানেই এসে বোস। চা টা শেষ করে নেই।’
বর্ষা হেসে বলল,
-‘হ্যাঁ গ্রীষ্ম ভাইয়া। আসো এইখানে বসো। আমরা একটু গল্প করি খেতে খেতে।’

মৌসন্ধ্যার ইচ্ছে করছিল লা’থি মে’রে বর্ষাকে চেয়ার থেকে ফেলে দিতে। ওই লোক চলে যাচ্ছে তো যাক না! তার কি দরকার তাকে আবার ডেকে এনে বসানোর! এমনিতেও গ্রীষ্ম আশেপাশে থাকলে সে অ’স্ব’স্তিতে পড়ে যায়। যত সম্ভব এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু তা আর হয় না। ঘুরে ফিরে গ্রীষ্মের সামনেই পড়তে হয়।

এপ্রিলের আম্মু এসে বর্ষা আর মৌসন্ধ্যাকে ডিম ভাজা দিয়ে গেলেন। হটপট এগিয়ে দিলেন পরোটা নিয়ে খাওয়ার জন্য। আবার হাতে করে আলুর দম নিয়ে আসতেই বর্ষা আহা করে উঠল। পরোটা দিয়ে ঝাল আলুর দম বর্ষা খুব পছন্দ করে। অবশ্যই তার মায়ের হাতে বানানো আলুর দম বেশি পছন্দ করে। সে দেখেই বুঝে গেল আলুর দমটা তার মা রেঁধেছে। সে বলল,
-‘ছোট আম্মু, আলুর দমটা কি আমার আম্মু করেছে?’

ছোট মামি বর্ষার গাল হালকা টিপে দিয়ে বলল,
-‘হ্যাঁ, আপনার আম্মুই করেছে। আপনি তো আবার আমাদের হাতেরটা খাবেন না। তাই!’
-‘কি যে বলো! খাব না কেন? তোমার রান্না করা গরুর কালাভূনা আমার কত পছন্দের তুমি জানো?’
-‘জানি তো। রাতের মেন্যুতে সেটা থাকছে।’
-‘গ্রেইট! জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হবে সারাদিন তাহলে। কি বলো গ্রীষ্ম ভাই!’

গ্রীষ্ম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
-‘অবশ্যই!’

বর্ষা আর আহরার গল্পে মেতে উঠল। মৌসন্ধ্যা জানে সে এখন গ্রীষ্মকে নিয়ে ভাবলে আরো বেশি অ’স্বস্তিতে পড়বে। তাই সব ভুলে সে আপনমনে খেতে থাকে। এদিক ওদিক তাকায় না। গ্রীষ্ম সরাসরি মৌসন্ধ্যার দিকে তাকাতে পারছেনা। অন্য সময় অবশ্য এমন সংকোচ হয়না। আজ যেন বারবার মনে হচ্ছে সে একটা চো’র। আর এভাবে তাকালে হয়তো মৌসন্ধ্যার কাছে তার বড় ধরনের চু’রি ধরা পড়ে যাবে।

সে দ্রুত চা শেষ করে উঠে পড়ল। আহরারকে বলল,
-‘তাড়াতাড়ি আয়। পুকুরে বোধ হয় জাল ফেলেছে।’
-‘এইতো আসছি।’

বর্ষাও তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করল। মাছ ধরার ব্যাপারটা তার খুব পছন্দের। ছোট বেলা থেকেই তার একটা আনন্দ কাজ করে মাছ ধরা দেখতে। সে আহরার যাওয়ার পর পরই চা না নিয়েই চলে গেল। তার মা এসে যখন দেখল মেয়ে চা না নিয়েই চলে গেল তখন আপনমনে তাকে বকতে বকতেই চায়ের কাপ দুটো মৌসন্ধ্যার হাতে ধরিয়ে দিল।

চায়ের কাপ দুটি নিয়ে মৌসন্ধ্যা পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্ষা একেবারে জেলেরা যে পাশে জাল টেনে ওঠাচ্ছে সেদিকে দাঁড়িয়ে আছে। মৌসন্ধ্যার সেদিকে যেতে অনীহা কাজ করে। সে এইপাশে দাঁড়িয়ে থেকেই দুই তিনবার বর্ষার নাম ধরে ডাকল। বর্ষার মনযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হলেও আষাঢ়ের মনযোগ আকর্ষণ করল সে। আষাঢ়কে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই সে বিব্রত হয়ে পড়ল। তার হাতে দু’টো কাপ দেখে আষাঢ় জিজ্ঞেস করল,
-‘চা এনেছিস? বর্ষার জন্য!’
-‘হু।’
-‘ওর খাওয়া লাগবেনা। আমাকে দে, আমি এখনও চা খাইনি।’

মৌসন্ধ্যাকে কিছু বলতে না দিয়ে আষাঢ় তার হাত থেকে একটা কাপ নিয়ে আগের জায়গায় চলে গেল। সে বর্ষার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল মাছ দেখাতেই সে আটকে আছে। সাথে চৈত্র আর এপ্রিলও রয়েছে। সে বাগানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সাবাব আর মুকিত গাছ থেকে নামছে। সেদিকে তাকিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ছেলে দুইটা বেশ কিছু ডাব আর নারিকেল পেড়েছে। মৌসন্ধ্যা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল,
-‘কি ভাইয়েরা কাজ শেষ!’
মুকিত হেসে বলল,
-‘ইয়েস ছোট বোইন। কাজ ক্ষ’ত’ম।’
দুইজন খুব হাপাচ্ছে। সাবাব তো ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা করে ফেলেছে। সে তুলনায় মুকিত কিছুটা ভালো অবস্থানে। সাবাব একটা ডাব নিয়ে ফটাফট কেটে পানি খেতে লাগল ঢকঢক করে। কিছুটা খেয়ে মুকিতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘ডাবটা খুব মজা। খেয়ে দ্যাখো।’
মুকিত ডাব হাতে নিলেই সাবাব আদেশের সুরে মৌসন্ধ্যাকে বলল,
-‘এই মুটকি! সারাক্ষণ খাওয়ার তালে থাকিস শুধু। ধর ডাবগুলো নিয়ে ছোট ঘরে রাখ। শরীর কমবে।’

মৌসন্ধ্যার রা’গ নাকের ডগায় এসে পড়ল কথাটা শুনে। থমথমে গলায় বলল,
-‘পারব না। আর আমি গোসল করে আসছি। এখন এগুলো হাতে তুললে ময়লা হয়ে যাব।’
-‘কি বললি তুই! তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে দুনিয়ার আর কেউ গোসল করেনা? শুধু তুই একা করিস! আমিও তো গোসল করেছি। তবুও গাছে উঠলাম। আর তুই সামান্য ডাব ধরবিনা। অজুহাত দিচ্ছিস! নে ধর। এই নারিকেলের ছড়াটা হাতে নে।’

সাবাব মৌসন্ধ্যার দিকে নারিকেলের ছড়াটা এগিয়ে দিয়ে জোর করতে লাগল সেটা ধরার জন্য। মৌসন্ধ্যা নাক কুঁচকে ওয়াক করে বলে উঠল,
-‘ছিঃ দূরে যা। তোর গা থেকে ভূস ভূস করে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে।’
-‘কি! এই তুই কি বললি! আমার গা থেকে ভূস ভূস করে গামের গন্ধ বের হচ্ছে? এত বড় অপবাদ! ভালো করে শুকে দ্যাখ কি সুগন্ধি। দ্যাখ দ্যাখ!’

এবার নারিকেলের ছড়া ফেলে সাবাব তার হাত উঁচু করে মৌসন্ধ্যার দিকে বগল দেখিয়ে তার গায়ের গন্ধ শুকতে বলছে। ইয়াক বলেই মৌসন্ধ্যা সেখান থেকে দৌঁড়ে পালায়। আসার পথে চা টাও পড়ে গেছে। মৌসন্ধ্যার কেমন মাথা ভনভন করছে। গন্ধটা বোধ হয় নাকে ঠুসে গেছে একেবারে।

২৬.
দুপুরে বেশ আয়োজন করে পাড়া প্রতিবেশীদের খাওয়ানো হলো। তারপর বিকেল বেলায় বাড়ির মেয়েরা সবাই মিলে ছাদে গিয়ে বসল। আচার খেতে খেতে সবাই গল্প করতে থাকে। একটু পরেই এপ্রিল কোথা থেকে ছুটে এলো হাতে একটা অ্যালবাম নিয়ে। বেশ উচ্ছাসিত হয়ে সে বলল,
-‘সবাই দ্যাখো! আমি কি পেয়েছি! এইটাতে আমাদের সবার ছোট বেলার ছবি আছে।’
জুন বলল,
-‘তাই নাকি? কই দেখি তো!’

অ্যালবামটা এপ্রিলের বাবার অর্থাৎ ছোট মামার। তিনি বংশের প্রতিটা বাচ্চার ছবি যোগাড় করে এই অ্যালবামটা বছর দুয়েক আগে সাজিয়েছেন। অধিকাংশ ছবি অবশ্য তার নিজের তোলা। ফটোগ্রাফির বেশ শখ তো তাই যখন তখন তাকে ছবি তুলতে দেখা যেতো।

তাদের সবার ছবি দেখার মধ্যেই ছাদে উপস্থিত হলো বাড়ির সবগুলো ছেলে। তারা এসেই মেয়েদের গোল হয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো। কাছে এগিয়ে দেখতে পেল তারা সবাই বেশ মনযোগ দিয়ে একটা অ্যালবামের ছবি দেখছে। শ্রাবণ একটা ছবি দেখতে পেয়েই বলল,
-‘আরে এটা তো আমি!’
জুন বলল,
-‘এটা তুই!’
-‘হ্যাঁ, কি সুন্দর না?’
-‘খুব সুন্দর। এতক্ষণ ভেবেই পাচ্ছিলাম না এত সুন্দর বানরের মতো দেখতে ছেলেটা কে!’
সবাই হো হো করে হেসে উঠল কথাটা শুনে। শ্রাবণ খেয়াল করল নিজেদের মানুষ ছাড়াও বেশ কিছু বাহিরের মানুষ রয়েছে। অর্থাৎ জুনের খালাতো বোনেরা। তাদের সামনে এভাবে বলাতে সে ভারি ল’জ্জা পেল। মুকিত তাকে সান্তনা দিয়ে বলল,
-‘ভাই আমার! মন খারাপ করছ কেন? এই হিং’সুটে মেয়ে তোমার সৌন্দর্য দেখে হিং’সে করেছে বলেই এমন বলছে। তার কথায় পাত্তা দিও না।’

একে একে সবার ছবি পাওয়া গেল। এর মধ্যে সাবাবের মেয়েদের জামা পরা একটা ছবি পাওয়া গেল। শরৎ আর আশ্বিনের হাত ধরে মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মায়ের মেয়ের শখ ছিল তাই মেয়েদের জামাও কিনে রাখত কিন্তু মেয়ে হয়নি বিধায় ছোটবেলায় মাঝে মাঝেই সাবাবকে মেয়ে সাজিয়ে রাখত। বর্ষা আর মৌসন্ধ্যা এত হাসল ছবিটা দেখে! এরপর পাওয়া গেল গ্রীষ্ম, আষাঢ় আর শ্রাবণের এক সাথে একটা ছবি। তারপর একটা ছবি দেখে সবার চোখ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে গেল। বুঝে উঠতে পারল না ছবিটা কার। মৌসন্ধ্যা অবশ্য চিনতে পারল। ছবিতে থাকা নয় মাসের ছোট বাচ্চাটি সে। গায়ে কোনো জামা কাপড় নেই কেবল একটা ডায়াপার পরে আছে আর হাতে কৃত্রিম ফুল। কিন্তু তার চোখে মুখে কোনো হাসি নেই। বরং চোখ খিচে ফুলগুলো দুই হাতে চেপে ধরে হা করে কাঁদছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে জোর করে তার ছবিটা তোলা হয়েছে। সবাই ভাবছে এইটা আবার কে! মৌসন্ধ্যার ভীষণ ল’জ্জা লাগছিল। এই ছবিটা তাদের বাসাতেও আছে। সে সরিয়ে রেখেছে কারণ নিজেকে এইরূপে দেখতে তার ভালো লাগেনা। ছোট মামার উপর রা’গ হয়। এটা কেমন ছবি তুলল! একটা জামা পরিয়ে নিলে কি এমন ক্ষ’তি হতো? মৌসন্ধ্যাকে আরো বেশি অস্ব’স্তিতে ফেলে দিয়ে বর্ষা বলে উঠল,
-‘মৌ, এটা তুই না? তোদের বাসায় এই ছবিটা কত দেখেছি আর এখন কিনা ভুলে বসার উপক্রম হলো।’

আকস্মিক বেশ কিছু কৌতূহলী চোখ মৌসন্ধ্যার দিকে পড়তেই সে দ্রুত হাত দিয়ে ছবিটা ঢেকে অপর পাতা উল্টাতেই শ্রাবণ তার হাত সরিয়ে নিয়ে বলে উঠল,
-‘এই এরকম ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতেছিলি ক্যান! কেমন দেখা যায়!’
মৌসন্ধ্যার রা’গে গা জ্ব’লে উঠল। তবুও কিছু বলল না। তখনই সাবাব বলল,
-‘এই পিছে তো দ্যাখো! ওইটা গ্রীষ্ম ভাই না?’

মৌসন্ধ্যার পেছনেই একটা ছেলে বেশ বিরক্তিকর মুখভঙ্গি ফুঁটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অবশ্য দূরত্ব রয়েছে অনেকটা। তবুও ছবিতে উঠে এসেছে। মৌসন্ধ্যা এই ছেলেটাকে আগেও দেখেছে। তবে জানত না সঠিক এইটা কে। এটা যে গ্রীষ্ম তা তার ধারণারও বাহিরে। সাবাবের কথা শুনে জুন ও মাথা নেড়ে সায় দিল,
-‘হ্যাঁ এটা তো ভাইয়া! কিরে ভাইয়া? তুই মুখটা এইরকম করে রেখেছিলি কেন?’

ছবিটা দেখে গ্রীষ্ম নিজেই চমকে গেছে। তার নিজেরও মনে নেই এইটা কবেকার। তবে তার ধারণা মৌসন্ধ্যাকে ওইরকম চিৎকার করে কাঁদতে দেখেই সে মুখ কুঁচকে রেখেছে। ছোট বেলায় তার একটা অভ্যাস ছিল এখনও আছে। পিচ্চি বাচ্চাদের গ’লা ফাঁ’টিয়ে কান্না করার শব্দ সে স’হ্য করতেই পারেনা।

সবাই গ্রীষ্ম আর মৌসন্ধ্যাকে নিয়ে হাসতে লাগল। এই একটা ছবিতে এরকম উদ্ভট দুইটা চেহারা দেখে হাসি আটকে রাখা দুষ্কর। মৌসন্ধ্যা পাতাটা উল্টে দিল। তার ভীষণ ল’জ্জা লাগছে। ভীষণ মানে ভীষণ! তার ল’জ্জাটা আরেকটু বাড়িয়ে আহরার বলে উঠল,
-‘তুমি ছোট থেকেই এত কিউট!’

কথাটা শুনে মৌসন্ধ্যা কিছু বলতে পারল না। কি বলবে! ল’জ্জায় মাথা তুলেই দেখল না। শুধু মুঁচকি হাসে। ব্যাপারটা গ্রীষ্ম কিংবা আষাঢ় কারোরই ভালো লাগল না। ভালো লাগল না সাবাবেরও। তার মস্তিষ্কে এবার আহরারকে নিয়ে স’ন্দে’হ ঢুকছে। না না, বড় ভাইয়ের প্র’তিদ্ব’ন্দী বাড়ছে বই কমছে না। তাও আবার এমন প্রতিদ্ব’ন্দী যারা নিজেরই আপন মানুষ। ভাই আর বন্ধু! কিছু একটা এবার না করলেই নয়! সে চট করে অনেক কিছু ভেবে ফেলল।

#চলবে।