#জৈষ্ঠ্যের_প্রেম (পর্ব-১৬)
লেখনীতে— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৩৩.
গ্রীষ্মকে সেলাইন দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ যাবৎ যে গ্রীষ্ম খাওয়া দাওয়া নিয়ে অনিয়ম করছে তা কারো নজরেই পড়েনি। ব্যস্ত জীবনে সময় কোথায় কারো তার খেয়াল রাখার? নাইলা হাসান বসে আছেন গ্রীষ্মের পাশে। ডাক্তার একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটার নাকি ঘুমেও অনিয়ম ছিল। তাকে দেখতে এসেছে তাদের পারিবারিক ডাক্তার এবং তার বাবার বন্ধু আশরাফুল ইসলাম। সব রকম চেক আপ শেষ করে তিনি জানালেন,
-‘ও হয়তো মা’ন’সি’কভাবে ডিপ্রেসড। এমতাবস্থায় তার সাথে থাকা দরকার পরিবারের সকলের। যথাসম্ভব তার ইচ্ছা পূরণ করা দরকার। আমি জানি না গ্রীষ্মের মতো ছেলে হঠাৎ এই অবস্থায় কেন পতিত হয়েছে! তবে আমার মনে হয় সে নিশ্চয়ই বেশ বড় কোনো মা’ন’সি’ক চাপে দিন কাটাচ্ছে। আর এটা খুবই ভ’য়া’ন’ক ব্যাপার। আমি একটা কথা বলব এখন, তবে সেটা আপনাদের ভী’ত করতে বলছি না ওর প্রতি যত্নশীল হতেই বলছি। গত মাসে সাইফুলের ছেলেটা ডিপ্রেশন থেকে আত্ম’হ’ত্যা করেছে। অথচ তার পরিবার ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে ছেলে কীসের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। যাই হোক! গ্রীষ্মের সাথে কথা বলবেন যে তার কি হয়েছে সে কি চায়! যা চায় তা দেওয়ার চেষ্টা করুন যদি সাধ্য থাকে। তবে দিতে বেশি দেরি করে ফেলবেন না। আজকাল এই ডিপ্রেশন অনেক বড় ব্য’ধি। সা’ব’ধা’নে থাকবেন। ওকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করবেন। অল টাইম! আজকালকার ছেলেমেয়ে গুলো কিছু থেকে কিছু হলেই ওই এক পথ বেছে নেয়।’
আশরাফুল ইসলাম রুম থেকে বের হতেই গ্রীষ্মের বাবা-মা দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। জুন আশরাফুল ইসলামকে নিচে অব্দি পৌঁছে দিতে তার সঙ্গেই গেল। গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই জুন বলল,
-‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ্ আঙ্কেল। আপনি অনেক বড় একটা উপকার করলেন।’
আশরাফুল ইসলাম মৃদু হাসেন। তারপর বলেন,
-‘দ্যাখো জুন! তোমার কি আসলেই মনে হয় তোমার বাবা-মা কে ভ’য় দেখানোর জন্য আমি এই কথা বলেছি?’
জুন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার আঙ্কেলকে সে নিজেই প্রথমে সব বুঝিয়ে বলেছে যে মা-বাবাকে এভাবে এভাবে বলতে হবে। তিনিও সায় দিয়েছেন। তাহলে? এখন এই কথার মানে কী! তবে কি সত্যিই তার ভাইয়ের ওইরকম কিছু করার প্রবণতা রয়েছে?
-‘গ্রীষ্মকে নিয়ে এতক্ষণ যা যা বলছিলাম একটাও মিথ্যে নয়। তোমার সাথে যখন কথা বললাম তখন মনে হয়েছে ব্যাপারটা নরমাল। বাট ইটস্ নট। আসলেই গ্রীষ্ম মা’রা’ত্ম’কভাবে ডিপ্রেসড। তুমি বুদ্ধিমতী! আশা করি বুঝতে পারছ।’
আশরাফুল ইসলাম জুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। জুন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই নিঃশব্দে কেঁদে দিল। তার হাসি খুশি, দায়িত্ববান ভাইটার হঠাৎ এ কি হা’ল হলো!
নাইলা হাসানকে জুন গিয়ে বারবার বোঝালো যে ভাই যখন মৌসন্ধ্যাকে তার জীবনে চাইছে তখন মৌসন্ধ্যাকে এনে দিলেই হয়! সে চায় না ভাইয়ের কিছু হোক! নাইলা হাসান বললেন,
-‘আমি যে অনন্যার মাকে কথা দিয়ে রেখেছি। অনন্যাকে ছেলের বউ করে আনব!’
জুন রে’গে গিয়ে বলল,
-‘ছেলেই যখন থাকবেনা তো অনন্যা দিয়ে করবে কী! আমি কিছু জানিনা আমার ভাইকে তুমি আগের মতো করে দাও। সে জীবনে অনেক ত্যাগ করেছে। আর না! এবার অন্তত তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দাও মা!’
নাইলা হাসান মেয়ের মুখের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলেন কথাটা শোনার পর। সত্যিই কি সে গ্রীষ্মের ভালো করতে গিয়ে ক্ষ’তি করে ফেলেছে!
—————
বিকেলের দিকে পলাশ মির্জা তার বাবাকে কল করে সব কিছু জানান। হাফিজ মির্জা নাতির অসুস্থতার কথা শুনে নিজেও চিন্তায় পড়ে যায়। সবদিক বিবেচনা করে তারা ঠিক করলেন গ্রীষ্মের সাথে মৌসন্ধ্যার বিয়ে দিবেন। মৌসন্ধ্যার বাবা-মা এই প্রস্তাবে খুশি হলেন। আপত্তি করার মতোই নয় এইরকম একটা প্রস্তাব। বর্ষা শুনেই গ্রীষ্মদের বাড়িতে চলে এলো। এসে জুনের সাথে সাথে ছিল। জুন বর্ষাকে সবটা খুলে বলল এবং বকাও দিল কেন সে বাড়িতে হওয়া কর্মকান্ড গুলো সম্পর্কে তাকে জানালো না!
মৌসন্ধ্যাকে তার বাবা-মা দুজনে রাতে কল করে তার মত চাইলেই সে না করে দেয়। কারণ হিসেবে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। বাবা-মা যদি আসল কারণ জানে তবে হয়তো ক’ষ্টে, অ’প’মা’নে জ’র্জ’রিত হয়ে পড়বে।
মৌসন্ধ্যা না করেছে শুনে নাইলা হাসান রে’গে গেলেন। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি রা’গলে চলবে না। তার আদরের ছেলেটা চোখের সামনে এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে মা হয়ে সে তা স’হ্য করতে পারছে না। সে ঠিক করল যেভাবেই হোক মৌসন্ধ্যাকে রাজি করাবেই।
পরদিন ভার্সিটিতে মৃন্ময় এলো মৌসন্ধ্যার সাথে দেখা করতে। তাকে দেখে মৌসন্ধ্যা সবকিছু খুলে বলল। মৃন্ময় অবশ্য আগে থেকেই সবটা জানে কিন্তু বিয়ের কথা জানেনা। কারণ এখনও পাঁচ কান হয়নি এই খবর। সব শুনে সে বলল,
-‘গ্রীষ্ম ভাই ভালো। তোর উচিত তাকে বিয়ে করে নেওয়া।’
-‘মেরুদন্ড নেই। মাম্মাস বয়! অ’হং’কা’রীও বটে।’
-‘কারো ব্যাপারে পুরোপুরি না জানে এভাবে কিছু বলা ঠিক নয়। তুই কি সেটা ভুলে গেছিস?’
মৌসন্ধ্যা তেঁতে উঠে বলল,
-‘তুই মনে হয় খুব ভালো চিনিস।’
-‘অবশ্যই। আমি তাকে ভালো করেই চিনি। কারণ ভালো মানুষ চিনতে সময় কম লাগে। খা’রা’প মানুষ তুই বছরের পর বছর একসঙ্গে থেকেও চিনতে পারবিনা। তারা সবসময় নিজেদের অন্য রূপে ঢেকে রাখে। এই যে বললি মাম্মাস বয়! মাম্মাস বয় হওয়া কি খা’রা’প? একজন মা যিনি তার সন্তানকে দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেন তার অনুগত হওয়া কি অনুচিত? গ্রীষ্ম ভাই আদ্যোপান্ত একটা সহজ সরল মানুষ। তারই সাথে দায়িত্ববান। পরিবারের বড় ছেলে হওয়াতে তার অনেক সময় অনেক কিছু সয়ে যেতে হয়েছে। ব্যবহারই বলে দেয় একটা মানুষ কেমন। আমার সাথে একদিন তার কথা হয়েছিল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেই দেখলাম গাড়ি নিয়ে কারো অপেক্ষায় ছিল। আমাকে জোর করল লাঞ্চের জন্য। টিউশন থাকায় যেতে পারিনি। এত অমায়িক তার ব্যবহার! তোর ক্ষো’ভ হয়তো সে কেন এত কথা শুনেও চুপ ছিল! আমার মনে হয় গ্রীষ্ম ভাই তার মায়ের উপর কথা বলতেই অভ্যস্ত নয়। তাই তাৎক্ষণিক কিছু বলতে পারেনি। ছোট থেকেই কেউ যদি মায়ের একেবারে অনুগত হয় সব কথা চুপচাপ মেনে চলে তাদের পক্ষে এটা ক’ষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে হঠাৎ করেই জবাব দেওয়ার। সে নানারকম দ্বিধা দ্বন্দে আটকা পড়ে হুট করে কিছু বলতে। তাছাড়া মা হলো দুনিয়ার সবচাইতে সেনসিটিভ একটা জায়গা। আর যাকে তাকে একটা কিছু বলে দিলেও মাকে কিছু বলা যায় না। মা তো মা! মানুষ হিসেবে হয়তো তার মধ্যে কমতি থাকতে পারে কিন্তু মা হিসেবে হয়তো সে তেমন নয়। মায়ের মর্যাদা সন্তানের কাছে আলাদা। প্রতিবাদ করতে গিয়ে মা’কে অ’প’মা’ন করে দেওয়া তো ঠিক কাজ নয়! এর জন্য মেরুদন্ড নেই এমন কথা বলা তোর উচিত হয়নি। তোর নিজের ছেলে যদি তোকে ভক্তি করে সেটা ঠিক কিন্তু পরের ছেলে তার মাকে ভক্তি করলেই সেটা ভুল! শোন, এমন ধারণা রাখা আমাদের কারোরই উচিত নয়। ভুল তো মানুষ মাত্র হয়। তোর উচিত তাকে একবার অন্তত সুযোগ দেওয়া। যে মানষ সন্তান হিসেবে ভালো, সে মানুষ হিসেবেও ভালো আর স্বামী হিসেবেও। মায়ের বাধ্যগত ছেলে কেবল মাকেই ভালোবাসে বৌকে বাসেনা এটা আমাদের কিছু অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের চিন্তা চেতনা। হ্যাঁ! কিছু শ’য়’তান থাকে মাকে ভালোবাসার ঢং ধরে বৌকে ক’ষ্ট দেয়। এরা নিজেরাই মা বৌয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরায়। দিনশেষে এদের জন্যই বউ, শ্বাশুড়ি দুজনকে খা’রা’প হতে হয়। কিন্তু গ্রীষ্ম ভাই সেই ক্যারেক্টারের মানুষ বলে আমার মনে হয় না। তুই তাকে আমার থেকে আরেকটু বেশি জানিস, চিনিস। তুই সেটা ভালো বলতে পারবি। আর বললি যে অহংকারী তা সে কি তোর সাথে কিছু নিয়ে অহংকার করেছে?’
মৌসন্ধ্যা দ্বিধায় পড়ে গেল। গ্রীষ্ম তার সাথে কখন অহং’কার করেছে সে মনেই করতে পারছেনা। গতকাল সে একটু জবাব দেওয়াতে মৌসন্ধ্যা তাকে এই খেতাব দিয়ে দিয়েছে। তবে পরবর্তীতে মৌসন্ধ্যা নিজেই আফসোস করেছে। এই পুরো ব্যাপারটাতে গ্রীষ্মের দো’ষ কেবল একটাই তার নজরে পড়ে। সেটা হলো তাকে ভালোবাসার। কিন্তু ভালোবাসা তো আর বলে কয়ে আসেনা। হয়ে যায়! মৌসন্ধ্যা নরম হতে চাইছে কিন্তু কোথাও কিছু একটার জন্য সে পারছে না। আর সেই কিছু একটা হয় গ্রীষ্মের মা! ওই মানুষটির জন্যই মৌসন্ধ্যা সামনে এগোতে ভ’য় পাচ্ছে।
মৃন্ময় তাকে চুপ দেখে বলল-
-‘সময় আছে। ভেবে দ্যাখ। কেউ তো তোকে জোর জবরদস্তিতে বিয়ে দিবে না। আমার তো মনে হয় গ্রীষ্ম ভাই নিজেও জোর করে তোকে বিয়ে করবে না।’
মৌসন্ধ্যা কি করবে ভেবে পেল না। সে ক্লাস না করেই হলে ফিরে গেল। মাথা ব্যথা করছে!
সন্ধ্যার দিকে মৌসন্ধ্যার হলে আসেন নাইলা হাসান। মৌসন্ধ্যা তাকে দেখে চূড়ান্ত পর্যায়ের অবাক হয়। তিনি মৌসন্ধ্যাকে বাহিরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন,
-‘তুমি এই বিয়েতে রাজি হচ্ছো না কেন?’
মৌসন্ধ্যা বলল-
-‘আপনাদের সাথে আমাদের ক্লাস ম্যাচ করে না। আপনি নিজেই তো বলেছিলেন এমন কথা। তাহলে এখন আপনি কি করে রাজি হলেন সেটা বলুন!’
-‘আমার ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মা হয়ে আমি সেসব স’হ্য করতে পারছি না। তোমাকে অনুরোধ করছি আমি রাজি হয়ে যাও। আমিই ক্লাস নিয়ে কথা তুলেছি। আমার ছেলেটা তো সেইসব নিয়ে কিছু বলেনি। তুমি কেন সেই কারণে তাকে ঘৃ’ণা করছ? এই একটা কারণে সে ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েছে। কাল গোটা দিন সে বিছানায় পড়ে ছিল। ডাক্তার বলেছে মা’ন’সিক অবস্থা ভালো না ওর। হুটহাট কিছু করে ফেলতে পারে। আমাকে নিয়েই তো তোমার সমস্যা! তবে ঠিক আছে। বিয়ের পর গ্রীষ্মকে নিয়ে তুমি আলাদা সংসার করো। আমি বলছি না যে আমার বাড়িতে জায়গা নেই। আমার ছেলে ছাড়া আমি একটা দিন থাকতে পারি না। কিন্তু এখন রাজি হচ্ছি কারণ ছেলেটার সুখের জন্যই।’
মৌসন্ধ্যা মৃদু হাসে। তারপর গম্ভীর স্বরে বলে,
-‘আপনি ভেবে বলছেন?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘ঠিক আছে। আমি তবে রাজি। কিন্তু এক শর্তে!’
-‘কি শর্ত?’
-‘আমার ক্লাস হিসেবে বিয়েটা হবে। অর্থাৎ একেবারেই সাদামাটা। আমি চাইছি না কোনোরকম অনুষ্ঠান হোক। আজ বিয়ে করে কাল অনুষ্ঠান হবে এমন কিছুই আমি চাই না। একদম ঘরোয়া ভাবে ছোট্ট আয়োজনে আমি বিয়ে করব।’
-‘সেটা কী করে সম্ভব! আমার সমাজে একটা ভাবমূর্তি রয়েছে। সেটা কীভাবে!’
-‘আপনি ঘুরে ফিরে স্ট্যাটাস আর ক্লাসেই চলে যাচ্ছেন। এরকম হলে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
-‘ঠিক আছে। তোমার যা ইচ্ছা। তবে তুমি কথা দিচ্ছ তো যে তুমি বিয়ে করবে!’
-‘হ্যাঁ। করব।’
৩৪.
গ্রীষ্ম সকালে অফিসে চলে গিয়েছিল। সে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেমন ভেঙে পড়েছে। তীব্র ব্যথা হয় বুকের কাছে। মৌসন্ধ্যা তাকে ভালো না বাসুক কিন্তু তাকে ভুল অন্তত না বুঝুক! সে যে ওই চোখের ঘৃ’ণা সইতে পারে না যে চোখকে সে ভালোবাসে!
অফিস থেকে আজ ইচ্ছে করে দেরি করে ফিরেছে। নয়টায় ঘরে ফিরতেই তার কানে এলো বিয়ের কথা বার্তা। যখন শুনল মৌসন্ধ্যা রাজি হয়েছে সে খুশি হতে পারল না। গতকাল স্পষ্ট সে মৌসন্ধ্যার চোখে ঘৃ’ণা দেখেছে তার জন্য। আজ হঠাৎ সেই মেয়েটি তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে? সে তার বাবাকে বলে দিল,
-‘আমি জানি মেয়েটাকে তোমরা জোর করেছ। সে হয়তো তাই রাজি। কিন্তু আমি রাজি নই। এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। জোর জবরদস্তি করে কিছু পেতে আমি আগ্রহী নই।’
নাইলা হাসান কি করবেন বুঝতে পারছেন না। এত কিছু করার পর এখন ছেলে বলছে বিয়ে করবে না। বর্ষা আর জুন মিলে মৌসন্ধ্যাকে কল করে বলল যে গ্রীষ্মকে জানাতে কেউ তাকে জোর করেনি। তার সম্মতি রয়েছে। মৌসন্ধ্যা শুনে মনে মনে খুশি হলো। মৃন্ময়ের ধারণা তবে সঠিক। গ্রীষ্ম তাকে সত্যিই ভালোবাসে!
পরদিন সকালে মৌসন্ধ্যা নিজে গ্রীষ্মের অফিসে গেল তার সাথে দেখা করতে। গ্রীষ্ম তখন নিজ কেবিনে ছিল। কেউ দেখা করতে এসেছে শুনে একটু অবাক হলো। তার কাছে কেউ আসার হলে আগে থেকেই জানিয়ে রাখে। হঠাৎ কে এলো? মৌসন্ধ্যাকে দেখে সে রীতিমত চমকে গেল।
মৌসন্ধ্যা এসেই বলল-
-‘আপনার ব্যাপারটা কী সেটা বলুন!’
-‘কি!’
-‘ঢং করবেন না। ভালোবাসার কথা বলে তো কান পঁচিয়ে ফেলেছেন আমার। এখন সেই ভালোবাসা কোথায় উঁড়ে গেল? আমি বিয়েতে মত দিতে না দিতেই আপনি অমত করে বসলেন!’
-‘তুমি মন থেকে রাজি নও আমি জানি। তাছাড়া তুমিই তো বলেছিলে আর যেন না যাই তোমার সামনে।’
মৌসন্ধ্যা ঠোঁট বাঁকায়। তবে গ্রীষ্ম অ’ভি’মা’ন করেছে? মৌসন্ধ্যা নিজেও তো মন থেকে বলেনি। জেদ ধরেই বলেছিল। কিন্তু সেও মনে মনে চেয়েছে গ্রীষ্ম আসুক। এই যে তার অবচেতন মন গ্রীষ্মকে চায় সে তা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে। সে নিজেই ভেবে বসেছিল তার সাথে গ্রীষ্ম যায় না কোনো অংশে। হী’নম’ন্যতায় ভূ’গেছিল সে। অথচ গতকাল যখন গ্রীষ্মের মা নিজে এসে অনুরোধ করল তখন সেই হী’নম’ন্যতা কেটে গেছে। হয়তো পুরোটা নয় কিন্তু কিছুটা। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার জীবনে হয়তো শ্বাশুড়ির সাথে বনিবনা হবে না। কিন্তু এই মানুষটা! এই মানুষটা তো স্বামী হিসেবে ম’ন্দ হবে না। এই মানুষটা যার সাথে সহজ সম্পর্ক কখনো ছিল না সে কিনা তার জন্য একটা দিন জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় পড়ে ছিল! মায়ের মুখের উপর কথা বলেছে। পাগ’লা’মি করেছে। ভাবা যায়! বর্ষ তাকে সবকিছুই জানিয়েছিল গতকাল। সেসব শুনে কেন যেন মৌসন্ধ্যা আর নরম না হয়ে পারল না। সে নিজেও তো গ্রীষ্মকে যখন তখন অ’প’মা’ন করেছে। অথচ গ্রীষ্ম তাকে কখনো একটা বা’জে কথাও বলেনি। সবকিছু রেখে কেবল ওই ছোট্ট ভুলটি নিয়ে পড়ে থাকবে! কেন? এটা সে নিজেও ভেবে পেল না। গতকাল শরৎও তাকে কল করেছিল। এবং হুকুম করেই বলেছিল,
-‘গ্রীষ্ম ভাইকে তুই বিয়ে করবি। যেভাবেই হোক তাকে রাজি করা। এত কিছু করে সে এখন বেঁকে বসলে তো আর হবে না! বিয়ে করেই তাকে আর তার মাকে ক্লাস কি সেটা ভালো করে হিসেব মতো বুঝিয়ে দিবি। বুঝেছিস!’
মৌসন্ধ্যা বেশ অবাক হলো ক্ষ্যা’পার কথা শুনে। এবং শরৎ এর এমন হুকুম শুনে তার ভীষণ হাসিও পায়। হঠাৎ কল দিয়ে এমন একটা কথা বলল হাসি না পেয়েও উপায় নেই। তবে বুঝল শরৎ খুব করে চাইছে তার আর গ্রীষ্মের বিয়ে হোক। শুধু শরৎ নয়! সবাই এই বিয়েতে দারুন ভাবে উৎসাহী। সাবাব কল দিয়ে বলেছে,
-‘তুই এত বজ্জাত! ভেবেছিলাম একটা ধুম ধারাক্কা বিয়ের দাওয়াত পাবো আর তুই সব ভেস্তে দিলি। তুই তো ভারি হিংসুটে। এখন থেকেই গ্রীষ্ম ভাইয়ের টাকা সেভিংস করার ধান্দায় পড়ে গেছিস। এত স্বামীর চিন্তা না করে দেশ ও দশের চিন্তা করা তোর উচিত ছিল।’
মৌসন্ধ্যাকে চুপ করে থাকতে দেখে গ্রীষ্ম বলল,
-‘কী হলো? কথা বলছ না কেন! দ্যাখো! তুমি প্লিজ চাপ নিও না। আমি বলেছি তো বিয়ে করব না।’
-‘কেন করবেন না?’
-‘তুমি জানো না?’
-‘না তো। আমি জানব কীভাবে!’
-‘মৌসন্ধ্যা আমি চাইছি না কারো মতের বিরুদ্ধে তার সাথে জড়াতে। কাল তো তুমিই বলেছিলে আর যাতে না যাই তোমার সামনে। আজ কেন আবার এসব কথা বলছ?’
মৌসন্ধ্যার এত ক’ষ্ট হলো গ্রীষ্ম তাকে মৌসন্ধ্যা বলাতে। এই একটা মানুষই তাকে জৈষ্ঠ্য বললে সে রা’গে না। জৈষ্ঠ্য ডাকটা এই মানুষটার মুখে ভীষণ মানায়। অথচ আজ সে কিনা মৌসন্ধ্যা বলছে!
-‘আপনি বিয়ে করবেন। এখন নাটক করে লাভ নেই। আমি মত দিয়েছি। আপনি কোন সাহসে আমায় রিজেক্ট করেন?’
-‘আমি রিজেক্ট করছি না। তুমি আমাকে কেন বিয়ে করছ? তুমি তো আমাকে পছন্দই করো না।’
-‘তাতে কী হয়েছে? পছন্দ না করলেও অনেকে বিয়ে করে। সংসার করে।’
-‘আমি সেরকম সম্পর্ক চাই না।’
-‘কেমন চান?’
-‘তোমাকে বলতে পারব না। তুমি সবাইকে না বলে দাও।’
-‘বলব না।’
-‘জেদ করো না।’
-‘করছি না জেদ। আপনি করছেন।’
-‘আমি করেছিলাম। তুমি বারণ করাতে সেটাও আর করিনা এখন।’
-‘বারণ করলেই শুনবেন? এটা কেমন ভালোবাসা?’
-‘তুমি সব ছেড়ে চলে যাবে বলেছিলে। আমি চাইনা আমার জন্য তোমার ক্যারিয়ার ন’ষ্ট হোক।’
-‘মামাতো ভাই গ্রীষ্ম যদি যায় তাহলে সত্যিই সব ছেড়ে দিব। স্বামী গ্রীষ্ম যদি যায় তবে ছাড়ব না।’
গ্রীষ্ম যেন কথাটা শুনে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মৌসন্ধ্যা এমন কিছু বলবে তার ভাবনার বাহিরে ছিল। মৌসন্ধ্যা গ্রীষ্মের দিকে একটু এগিয়ে এলো। বলল,
-‘বলুন তো গ্রীষ্মকাল কোন দুইটি মাস নিয়ে হয়!’
গ্রীষ্ম যন্ত্রের মতো জবাব দিল,
-‘বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য!’
-‘তারমানে কী দাঁড়ায়?’
-‘কী!’
-‘জৈষ্ঠ্যমাস কেবলই গ্রীষ্মকালের।’
হতবিহ্বল গ্রীষ্ম কোনো কথা বলতে পারেনা। মৌসন্ধ্যা কেবিন থেকে বের হয়ে আসার পূর্বে গ্রীষ্মকে বলল,
-‘আমি আপনাকে মন থেকেই গ্রহণ করছি। বিয়েতে মত দিতে সংকোচ করবেন না আর।’
#চলবে।