প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-১৯+২০

0
385

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১৯

কোনো এক কারণে নাদিয়ার সাথে এখনো প্রিয়াঞ্জনার দেখা হয়নি। কেন হয়নি তাও এক বিস্ময়ের ব্যাপার। নাদিয়ার দেখা হলো আবার শাহবাজের সাথে। শাহবাজ সবকিছুই এনেছে তবে সয়াবিন তেল আনতে ভুলে গিয়েছে। তাই মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ আগে, প্রিয়াঞ্জনা তাকে আবার বাজারে পাঠিয়েছে তেল আনার জন্য। তখনই নীল পাঞ্জাবি পরনে আবার সেই সুপুরুষের সন্ধান পায় নাদিয়া। সকালে বান্ধবীর বোনের বিয়েতে গিয়েছিলো। ফিরেছে এখন। শাহবাজ গেট খুলেই দেখে নাদিয়া দাঁড়িয়ে। উঠান পেড়িয়ে স্টিলের মেইনগেট। নাদিয়া টোকা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো। চঞ্চল নাদিয়ার মুখে এমনিতে খই ফুটে। কিন্তু সকালে এই লোকের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই তার ভিতরে কেমন কেমন যেন করছে। বিয়েতে গেলো। সারাটা সময় কেটেছে অস্থিরতায়। ঘুরেফিরে মাথায়, মনে সকালবেলার সেই যুবক! এখন এই গোধূলিলগ্নে নীল পাঞ্জাবি পরনে সুপুরুষটাকে দেখে নাদিয়ার হৃদপিণ্ড ভয়ানক গতিতে লাফাচ্ছে। ভয়ানক মানে ভয়ানক! শাহবাজ স্বাভাবিক স্বরেই জিজ্ঞেস করলো,
“ভিতরে আসবে খুকি?”

আর হৃদপিণ্ড লাফানো! খুকি শব্দটা শুনে রাগ উঠে গেলো নাদিয়ার। হিসহিসিয়ে বললো,
“খুকি নয় নাদিয়া। আমার নাম নাদিয়া।”
শাহবাজের খেয়াল ছিলোনা নামটা। তাই খুকি বলেই সম্বোধন করেছে। বাচ্চা একটা মেয়ে।
“সরি, সরি। আমার আসলে মনে ছিলো না।”

নাদিয়ার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। ওর নামটাই যে লোকের মনে নেই সেই লোককে নিয়ে সে সারাদিন ভেবেছে! কান্না পেয়ে গেলো তার। কি অদ্ভুত!
শাহবাজ গেইট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে বললো,
“গেট লাগিয়ে দিয়ো না। আমি এখনই চলে আসবো।”
“জ্বি”
শাহবাজ চলে গেলো। মন খারাপ করে বাসায় প্রবেশ করে নাদিয়া। নাজমা উঠানে চেয়ারে বসে পাশের বাড়ির ভাবীর সাথে গল্প করছিলেন। নাদিয়াকে দেখে ডাক দিলেন। সে কিছু না বলেই ঘরে চলে গেলো। নাজমা চিন্তায় পড়লেন। তার যা রণচণ্ডী মেয়ে! না জানি আবার কি ঝামেলা পাকিয়ে এসেছে। তিনি আর বিষয়টা ঘাঁটালেন না। গল্পেই মেতে উঠলেন। এই মেয়ে এমনই। যদিও তিনি ছোট মেয়েটাকে বড়ই আদর করেন।

শাহবাজ তেল নিয়ে ফিরলো কিছুক্ষণ পরই। প্রিয়াঞ্জনা টুকটাক সব গুছিয়ে নিয়েছে। আজ রাতের মেনু আলুভাজি, ডাল আর ভাত। তবে এই আলুভাজি কিছুটা ভিন্ন ধরনের। সচরাচর আমাদের দেশে ভাতের সাথে এমন করে আলুভাজি খাওয়া হয় না। এর প্রচলন রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। প্রিয়াঞ্জনা তখন হাইস্কুলে পড়ে তাদের বাড়ির পাশের দালানে এক ভারতীয় পরিবার উঠেছিলো। সুভদ্রা মাসি বড়ই স্নেহ করতেন তাকে। এটা সেটা করে খাওয়াতেন। ভদ্র মহিলার কোনো মেয়ে ছিলোনা। দুটো ছেলে। যাই হোক তার কাছ থেকেই শিখেছে প্রিয়াঞ্জনা। প্রথমে আলু মিহি করে কেটে নিতে হবে। তারপর তা ভালো করে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এতটা পরিষ্কার যেন পানির মধ্যে আলু কাটাগুলো রাখলে স্বচ্ছভাবে দেখা যায়। ভালোকরে পানি ঝড়িয়ে একটা প্লেটে মিহি করে কাটা আলুগুলো ছড়িয়ে রাখতে হবে। যেন পানি অবশিষ্ট না থাকে। তারপর অল্প লবণ মিশাতে হবে। কিছুক্ষণ পর ডুবো তেলে ভেজে নিতে হবে। মচমচে হয়। গরম ভাতের সাথে বেশ ভালোলাগে খেতে। শাহবাজও এটাসেটা কেটে দিচ্ছে। এই কাজ শাহবাজ সবসময়ই করে। যখনই সুযোগ পায় প্রিয়াঞ্জনাকে সাহায্য করে। তা হোক রান্না-বান্না আর হোক ঘরের কাজ। আমি পুরুষ! আমি কেন এসব করবো! এমন মনোভাব কোনোকালেই শাহবাজের ছিলোনা। এই যেমন এখন লোকটা বেশ মনোযোগী হয়ে শসা কাটছে। মনে হচ্ছে এই কাজটি করাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। দুষ্টুমি চেপে বসে প্রিয়াঞ্জনার মাথায়। গ্যাসের চুলা অফ করে শাহবাজের সামনে গিয়ে বসে। শাহবাজ মুখ তুলে তাকিয়ে চোখে ইশারা করে, ‘কি?’
প্রিয়াঞ্জনা মাথা নাড়ায়। যার অর্থ ‘কিছু না তো!’ তারপর হাত বাড়িয়ে এলোমেলো করে দেয় শাহবাজের চুল। শাহবাজও কম কিসে! দপ করে ধরে ফেলে প্রিয়াঞ্জনার হাত। একটানে নিয়ে আসে কোলে। ঠোঁট ছুঁয়ায় ঘাড়ে। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“খুব দুষ্টু হয়েছো প্রিয়াঞ্জনা!”

এখনও লজ্জা! এত বছর সংসার করার পরও প্রিয়াঞ্জনা তার শাহ্কে লজ্জা পায়। এই যেমন এখন লাজুকলতার মুখে কোনো কথা নেই। শাহ্ হাসে। টাকা পয়সা চাইনা তার। কেবল একটি সুখের সংসার হলেই চলবে। এই মানুষটা থাকলেই চলবে।

চারপাশে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। পাখিরা ফিরছে নীড়ে। হলদে বর্ণ সুবিশাল আকাশ। মেঘেদের আনাগোনা তেমন চোখে পড়ছেনা। জুঁইফুল গাছের নিচে ইটের তৈরি বেঞ্চের মতো আছে। সেখানে সুমনা বসে আছে। এটি বাড়ির পিছন দিকে। ভাড়াটিয়ারা আজকাল তার দিকে কেমন নজরে যেন তাকায়। কারো চোখে করুণা, কারো চোখে তাচ্ছিল্য। খুব লজ্জা লাগে সুমনার। নিজের হাতে সাজানো, গুছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো তার। আজ নিজেকে অপাংতেয় মনে হয়। সব অপরিচিত লাগে। নিজের মুখে দু’হাত ছুঁয়ায় সুমনা। সে শ্যামবর্ণ। ঐ মেয়ে ফর্সা। তার বয়স বেশি। ঐ মেয়ের বয়স কম। সে বাচ্চা জন্ম দিতে অক্ষম। আর ঐ মেয়ের গর্ভে সন্তান। সুমনা চায় না। তবুও বারবার নিজের সাথে স্বর্ণার তুলনা করে বসে। সুমনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এই বাড়িতে তার কোনো পিছুটান নেই। কিন্তু কোথায় যাবে! কি করবে! ও অনার্স পাশ। কিন্তু চাকরি কি এতই সহজ! ডিভোর্সি মেয়েদের তো সমাজ দুচোখে সহ্য করতে পারেনা। তবুও নিজের সিদ্ধান্তকেই পাকাপোক্ত করে সুমনা। সে এই বাড়ি ছাড়বে তাও অতি শীঘ্রই। কারো গলা খাঁকারির শব্দে উদাস নয়নে সেদিক পানে চায় সুমনা। মইনুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। সুমনা নজর ফিরিয়ে নেয়। মইনুল সাহেবের দৃষ্টি অন্যরকম। সুমনা এই দৃষ্টির অর্থ বুঝে। প্রীতম যখন তাকে ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়েছিলো তার দৃষ্টিও ঠিক এমনই ছিলো। এবার আর কোনো ভুল করবেনা সুমনা। কোনো পুরুষকেই এখন সে আর বিশ্বাস করেনা। বাকিটা জীবন একাই কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তার। মইনুল দাঁড়িয়ে রইলেন।

ফাহিম এবং তার মা এলো রাতের বেলা। হুলস্থুল কান্ড। দুহাত ভরে এনেছে ফাহিম। ফল থেকে শুরু করে মিষ্টি সব। ফাহিমরা দূর সম্পর্কের আত্মীয় প্রবীরের। তবে সম্পর্ক ভালো। ফাহিমের বাবা মা রা গেছেন। সে তার মাকে নিয়ে আমেরিকায় থাকে। বড়বোন আছে একটা। পরিবার নিয়ে কানাডা থাকে। নরসিংদীর বালুচরে তাদের নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট রয়েছে। তাছাড়া তেমন সম্পত্তি এদেশে করেনি তারা। বেশি তো থাকা হয় না। অনেক মাস পরপর আসে। যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই। কথাটা শতভাগ মিলে গেলো প্রাপ্তির সাথে। সন্ধ্যায় সে মইনুল স্যারের কাছে পড়লো। আর রাতেই মা এসে বলছেন প্রীতি যেন তাকে একটা শাড়ি পরিয়ে রেডি করে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসে। কারণ ফাহিম তাকে দেখতে এসেছে! আকাশ থেকে পড়লো প্রাপ্তি! মানে কি! ফাহিম ভাইয়ের সাথে তো প্রিয়া আপার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। মা ন্যাওটা হওয়ায় মায়ের উপরে কোনো কথা বললোনা প্রাপ্তি। কিন্তু সব রাগ গিয়ে পড়লো প্রিয়াঞ্জনার উপর। প্রীতি মুচকি মুচকি হেসে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। বেশ হয়েছে। ঐদিন প্রাপ্তির জন্যই বাড়িতে বড় ঝামেলা হয়েছিলো।
“কি রে চুপসে আছিস কেন? বাবা-মা যা করে তাতেই নাকি সন্তানের মঙ্গল? তোর নীতিবাক্য না এটা?”
“খুব মজা পাচ্ছিস তাই না?”
“খুব”

টেনে বললো প্রীতি। হঠাৎ করেই কেঁদে দেয় প্রাপ্তি। প্রীতির মন গলে যায়। যত হোক জমজ বোন তো! যদিও তাদের চেহারায় মিল নেই। বরং প্রাপ্তির চেহারা প্রিয়া আপার সাথে মিলে। প্রীতির খুব মায়া হলো। মা যে কেন এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করছে! প্রীতি, প্রাপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“থাক, কাঁদিস না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”

(চলবে)….

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২০

শাহবাজ আজ কলেজে গিয়েছে। শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেওয়ার অভিজ্ঞতা তার আছে। ঢাকার অলিগলিতে অনেক টিউশনি করিয়েছে সে। তবুও আজ কিছুটা নার্ভাস ছিলো। প্রিয়াঞ্জনা অবশ্য এমন এক কাজ করেছে যে শাহবাজ সব টেনশন ভুলেই গেছে। যাওয়ার সময় নিজ থেকে চুমু খেয়েছিলো শাহবাজের গালে। তারপর ঠেলে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে দিয়েছিল। তার শাহ্ অত্যধিক খুশি হয়েই বাড়ি ছেড়েছে আজ। শাহবাজ যখন আশেপাশে থাকে তখন প্রিয়াঞ্জনার সময় এত মধুর কাটে! এত স্নিগ্ধ লাগে প্রিয়াঞ্জনার! ছাদ থেকে পুকুর দেখা যাচ্ছে। পুকুরে নীলচে আকাশের প্রতিচ্ছবি। পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘেরা আপন গতিতে ছুটে বেড়ায়। পানিতেও তাদের দুষ্টু চলন বুঝা যায়। প্রিয়াঞ্জনা তাই দেখছে দাঁড়িয়ে। দু’হাত রেলিং এ ভর করে মেঘেদের আনাগোনা দেখতে ভালোই লাগছে।
নাদিয়া আজ কলেজে যায়নি। কলেজ তার কাছে ভয়ংকর জায়গা। সেখানে গেলে তার অসুখ করে। বাবা আবার শিক্ষক সে কলেজের। ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকতে হয় তার। যা অতি কঠিন কাজ। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাই মেঝোপা তাকে বকেছে। সে নাস্তা করেনি। মন খারাপ হলে সে ছাদে আসে। তার গোলাপ গাছগুলোর সাথে কথা বলে। তারপর রাগ কমে। নাদিয়ার রাগটাও বেশ অদ্ভুত। হঠাৎ করে এত রাগ উঠে! মন চায় সব ধ্বংস করে দিক। আবার রাগ যখন পড়ে যায় তখন আফসোস হয়। যাই হোক সে এখন বেশ বিস্মিত। বিস্মিত হওয়ার কারণ আছে। ছাদে রেলিং এ ভর করে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরনে লালশাড়ি। চুল ছেড়ে রাখা। চুলগুলো কোমড় সমান। এই ভরদুপুরে এখানে মেয়ে আসলো কোথ থেকে! নাদিয়া ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেলো। পাশের বাড়ির জলি আন্টি বলেছিলেন তাদের বাড়ির ওয়ালের উপর নাকি লালশাড়ি পরে একটা মেয়ে হাঁটে। সে অবশ্য বহুদিন আগের কথা। তখন তারা এ বাসায় নতুন এসেছিলো। মা অবশ্য এই কথার সুন্দর একটি ব্যাখা দাঁড় করিয়েছেন। তার মায়ের মতে এই বাড়িটি জলিরা রাখতে চেয়েছিলো। বনিবনা হয়নি। শেষ পর্যন্ত বদরুজ্জামান সাহেব রেখেছেন। এজন্য জলি এসব কথা বলে বেড়ায়। এত বছরে তেমন কিছুই তারা দেখেনি। তবুও ভূতের ভয় নাদিয়ার রয়েই গেছে। আজ তো জলি আন্টির কথাই সত্যি মনে হচ্ছে। নাদিয়ার আবোল তাবোল ভাবনার মাঝেই প্রিয়াঞ্জনা পিছনে ফিরলো। খুব আদুরে দেখতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিয়ার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশা। ভরদুপুরে চুল ছেড়ে, লালশাড়ি পরনে এত সুন্দর মেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে! এই মেয়ে নির্ঘাত ভূত। নাদিয়া চিৎকার করে উঠে, ‘ভূত!, ভূত!’
ভ্যাবাচ্যাকা খায় প্রিয়াঞ্জনা। ভূত! কোথায় ভূত? নাদিয়া দুহাত উপরে তুলে ভূত ভূত গান গাইতে গাইতে সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগালো। প্রিয়াঞ্জনাও ছুটলো তার পিছনে। নাদিয়া খেয়াল করলো ভূতটা তার পিছনে আসছে। ‘ওরে আল্লাহ রে!’ একি মুসিবত। নিচে নেমে সামনে পেলো মেঝোপা আর মাকে। মেঝোপাকে জড়িয়ে ধরলো নাদিয়া। প্রিয়াঞ্জনা এসে দাঁড়ালো পিছনে।
“কিরে কি হয়েছে তোর?”

মেঝোপার প্রশ্নে নাদিয়া বললো,
“ছাদে লালভূত।”

নাজমা কপাল চাপড়ে বললেন,
“ওরে গাঁধা, জলির কথা এখনও মাথায় ঢুকিয়ে রাখছিস। ও প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজের সাথে না তোর দেখা হইছে? শাহবাজের বউ।”

ভূত না হওয়ায় নাদিয়া ঠিক যতটা খুশি হয়েছিলো, তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি কষ্ট পেয়েছে শাহবাজের বউ এই কথাটা শুনে। প্রিয়াঞ্জনাসহ সবাই খিলখিল করে হাসছে। কেবল থমকে আছে নাদিয়া। কোনো কথা না বলেই চলে যায় নিজ ঘরে।
প্রিয়াঞ্জনার বেশ অনেকক্ষণ কথা হয় নাজমা এবং তার মেঝো মেয়ের সাথে। প্রিয়াঞ্জনাকে ঘরে নিয়ে পুলি পিঠাও খেতে দেন নাজমা। যদিও বেশিদিন হয়নি। তবুও হৃদয়ের কোথায় যেন হু হু করে উঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে। অজান্তে চোখ ভিজে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। কাজের বাহানা দিয়ে চলে আসে উপরে। তাদের ‘চন্দ্রবিলাস’ নামক ছোট নীড়ে। মন খারাপ করে আর কি হবে। বাবা তো বলেছিলেন হয়তো পরিবার নয়তো শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনা তার শাহ্কে বেছে নিয়েছে। প্রিয়াঞ্জনা ফোন লাগায় তার শাহ্কে। কথা বলে অনেকক্ষণ। মনের কালো মেঘ দূর হয়ে যায় নিমিষে। রান্না-বান্নার কাজে লেগে যায় সে। শাহবাজ বিকেলে ফিরবে।

ফাহিমের সাথে প্রাপ্তির বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগামী শুক্রবার বিয়ে। তেমন আয়োজন হবেনা। বাড়িতেই ছোট পরিসরে অনুষ্ঠান হবে। প্রাপ্তি মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি। ঐদিন রাতে ফাহিমের মা প্রাপ্তিকে পছন্দ করে চেন পরিয়ে গিয়েছেন। এত দ্রুত ঘটছে সবকিছু। প্রীতি, প্রাপ্তি কিছু বুঝেই উঠতে পারছেনা। সুমনা চোখের সামনে এসব অনিয়ম দেখেও কিছু বলেনি। প্রতিবাদও করেনি। কোনো কিছুতেই তার কোনো আগ্রহ নেই। বাসায় নতুন করে কাজের বুয়া রাখা হয়েছে। অথচ সুমনা আসার পরে কাজের বুয়াকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন জোহরা। আজকাল তাকে কোনো কাজের কথা বলা হয় না। সেও ঘর থেকে বেশি একটা বাইরে বের হয়না৷ স্বর্ণাকে খুবই আহ্লাদ করেন জোহরা। আজ সকালে ধমকে দুধের গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। সুমনার যখন বাচ্চা পেটে ছিলো তখন ভারী ভারী কাজ করাতেন তাকে দিয়ে। বাচ্চা পেটে নিয়েই সুমনা বালতি ভর্তি কাপড় ছাদে নিয়ে যেতো। ঘর মুছতো। তার বাচ্চা নষ্ট হওয়ার সমস্ত দোষ পড়েছিলো তার ঘাড়ে। আদোও কি সব দোষ তার? এই যে এখন সে মা হতে পারবেনা এর পিছনে কি জোহরার হাত নেই? অবশ্যই আছে। প্রেগ্ন্যাসির পুরো সময়টাই কেটেছে জোহরার মন জুগিয়ে। তাও মন পেলো না সুমনা। আর হয়তো পাবেও না৷ এখন অবশ্য সুমনা এসবের ধারও ধারে না।

বিকেলের দিকে বাড়ি ছাড়লো সুমনা। কখন বেরিয়েছে কেউ টের পায়নি। মেইন গেটের বাইরে রাস্তায় যখন দাঁড়ালো তখন বুকের ভিতর অসহনীয় ব্যথা শুরু হলো তার। শারীরিক ব্যথা নয় মনের ব্যথা। এই ব্যথার কোনো চিকিৎসা নেই। এত বছরের সংসার ফেলে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সুমনা। পিছনে ফিরে সে তাকায়নি। কাঁদেনি। কেবল শূন্য লাগছিলো সবকিছু। যখন লাল বেনারসি পরে এ বাড়িতে প্রবেশ করেছিলো তখন কত স্বপ্ন ছিল চোখে। একটা সুন্দর সংসার। একটা পরিবার। সুমনা সকল পিছুটান ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। প্রীতম নামের মানুষটা তার জন্য ম রে গেছে। সেই যে ভার্সিটিতে সাপের হাত থেকে রক্ষা করেছিলো সে ছেলেটা মা রা গেছে। সুমনা এই পৃথিবীতে একা। একদম একা।

(চলবে)…