#প্রিয়তমা_প্রজাপতি🩷 [পর্ব-০৮]
~আফিয়া আফরিন
বাড়ির পরিবেশ ভীষণ শান্ত আর শীতল। একটু আগে মিফানের বলা কথাটা সবার কর্ণ কুহুর পর্যন্ত পৌঁছেছে। আলম খন্দকার গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আজকের দিনে এমন সম্মানহানি জনক একটা ঘটনা ঘটতে হলো? আগে বললে কি হতো!
দৈনন্দিন কর্মমুখর জীবন প্রবাহের গতানুগতিকের মধ্যে এমন কিছু দিন ও মুহূর্ত আসে যা বর্ণনা করা কখনোই সম্ভব নয়।
অনিন্দিতা বড়ো ঘরের এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসন্ন ঝড়ের কথা ভাবতেই চোখে পানি টলমল করে উঠছে। মনে কু ডাকছে। কি হবে এখন?
পুরো ঘর জুরে নিস্তব্ধতা। উপস্থিত মেহমান কারো মুখেই কোন কথা নেই। সবাই আলম খন্দকারের মুখ পানে চেয়ে আছেন, তার কথা শোনার অপেক্ষায়।
এক সময় এই শুনশান ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল। আলম খন্দকার গম্ভীর কন্ঠে অনিন্দিতা কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের এই সম্পর্ক কয়দিনের? আমি যে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম কাউকে ভালোবাসো কিনা, যেদিন আমাকে কেন কিছু জানানো হয়নি আমি তার উত্তর চাই!’
অনিন্দিতা কিছু বলবে তার আগেই মিফান সামনে এসে দাঁড়াল। থেমে থেমে বলল, ‘বড় আব্বু আসলে মূল দোষটা আমার। ও আমাকে না, আমিই ওকে ভালোবাসি সেই ছোটবেলা থেকে। ওর তো আমার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।’
‘তখন তোমাকে জিজ্ঞেস করা হবে তখন তুমি উত্তর দিবে। এই প্রশ্নটা আমি অনিন্দিতাকে করেছি। বলো।’
অনিন্দিতা মুখ তুলে তাকালো। সবার দৃষ্টি তার দিকে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, ‘আসলে আব্বু একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। মানে আমি, না মানে আমি না। হ্যাঁ আমিই, মিফান আমায় বলেছিল।’
‘হ্যাঁ আমি না আমি করে পরিষ্কার ভাবে কথাটা বল।’
অনিন্দিতা একবার মিফানের দিকে তাকাল। ছেলেটা এত অসুস্থ ছিল? কয়েক দিনের মধ্যেই চোখ মুখ একদম শুকিয়ে গেছে। কপালে রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে গেছে। ক্ষতস্থান তা দগদগ করছে। এত কিছুর মধ্যেও তার চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে আকুতি মিনতি, একটু ভালোবাসা পাওয়ার। এই ভালোবাসা সাধারণ নয়, হৃদয় উজার করা ভালোবাসা। হাসিতে প্রকাশ পায় সেই ভালোবাসা, চোখে মুখে প্রকাশ পায় সেই ভালোবাসা।
আধুনিক যুগের দাঁড়িয়ে মিফান ক্ষণে ক্ষণে অনিন্দিতা কে ভালোবাসার কথা বলে গেছে, বিরামহীন ভাবেই বলে গেছে।
মিফান যদি সমস্ত নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলতে পারে, তবে সে কেন পারবে না? অনিন্দিতা নিজেও তো মানুষ, আর সেও মিফানকে অপ্রকাশ্যে ভালবেসে। তা হলে আর বলে দিতে সমস্যা কোথায়?
কোন কিছু ভাবলো না অনিন্দিতা। রইলো না আর কোন দ্বিধাদ্বন্দিতা। স্পষ্ট কন্ঠে জানান দিলো, ‘আব্বু আমি মিফানকে ভালোবাসি!’
নিস্তব্ধ ঘরটাতে ধাতবের ঝঙ্কার লাগল। নিশ্চুপ হয়ে গেলো সবাই। শুধুমাত্র মিফানের এর মধ্যে রংবেরঙের বেলুনের উরাউরি শুরু হল। তার প্রজাপতি তাহলে তাকে ভালোবাসে! এতদিনে স্বীকার করে নিলে কি হতো? যুদ্ধ বেজে যেত কি!’
এইবার নীরবতা ভাঙলেন মিফানের বাবা রাশেদ খন্দকার।
‘তোর সাহস দেখে আমি আশ্চর্য মিফান। অনি তোর থেকে বয়সে বড়ো, ভুলে গেছিস? এসবে কি কখনো সম্পর্ক হয়? পাগল তুই? যা হয়েছে, সব ভুলে যাহ।’
মিফান স্থির কন্ঠে বলল, ‘বয়সে বড় তাতে কি এসে যায় বাবা? বয়স এমন কি? এটি একটি সংখ্যা মাত্র! অনিন্দিতা ও এই জিনিসটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিল। আর তোমরা এই যুগে দাঁড়িয়ে এসব ব্যাকডেটেড কথা বলছো?’
রাশেদ খন্দকার কড়া ধমক দিলেন ছেলেকে, ‘চুপপ…!’
তাকে থামিয়ে দিলেন আলম খন্দকার। উপস্থিত মেহমানদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। এনাদের কি বলবেন এখন? ক্ষমা চাওয়ার মত মুখ কি আদৌ তার রয়েছে?
যাওয়াদের বাবার সামনে এসে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ভাইজান, খুব বড় মুখ করে আপনাদের ডেকে নিয়ে এসেছিলাম। আজকে যা হলো, জানি এসবের কোন ক্ষমা নেই। তবুও,, আপনারা…!’
যাওয়াদ এগিয়ে এলো। বিনম্র ভঙ্গিতে বলল, ‘আঙ্কেল আপনি ক্ষমা চাওয়ার কথা কেন বলছেন? এখানে তো ক্ষমা চাওয়া বা ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই আসে না। দুজন মানুষ দুজন মানুষকে ভালবাসে, তারা যদি সারা জীবন একসাথে থাকতে চায়; তবে তাই হোক। এত ভালোবেসে যদি শেষ পর্যন্ত কপালে অপূর্ণতা লেখা থাকে, তাহলে দুপক্ষ থেকেই চরম আফসোসের শিকার হবে। দুজন দুজনকে এতো ভালোবাসে, ওদেরকে মিলিয়ে দেওয়া তো আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে; তাইনা!
আর আমার সাথে তো অনিন্দিতার বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়ে যায় নাই। শুধু আজকে দেখা করার বিষয়টা। আমি তো অনিন্দিতা কে ভালবাসি নাই, কিন্তু ঐ ছেলেটা অর্থাৎ মিফান ভালোবেসেছে! তাহলে আপনি বিবেক দিয়ে চিন্তা করেন, মেয়েকে আপনি কার কাছে তুলে দিবেন? দুইজন মানুষ; একজন অনেক আগে থেকে ভালবাসে, আর একজন আপনার মেয়েকে এখনো ভালোবাসা শুরুই করে নাই। তাহলে এই দুইজনের মধ্যে যে অনেক আগে ভালবাসে, অনিন্দিতাকে থেকে তার হাতে তুলে দেওয়া বেটার না? আর ছোটবেলার প্রেম তো, এটা খাঁটি এখানে কোন আবেগ নেই। আফসোস রাখতে দিয়েন না আঙ্কেল, ভালবাসতে দিন।’
স্পষ্ট কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল চোখে মুখে। ‘মেয়েটাকে মানুষ করেছিলাম বড় আদরে যত্নে। ওর জীবনে কখনো কোন চাওয়া অপূর্ণ রেখেছি কিনা মনে পড়ে না। অনিন্দিতা জন্মানোর পর যখন ওর মায়াকাড়া মুখটা দেখেছিলাম, তখনই ওর মাকে বলেছিলাম এই মেয়ের জীবনে কোন অপূর্ণতা আমি রাখবো না। আমার জানা মতে রাখিও নি। কিন্তু অজান্তে কত বড় একটা অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস আজ মিফান এসেছিল সব কথা পরিষ্কার করে বলল। না হয়তো তিনটা জীবন এলোমেলো হতো। আর আমাকে সারা জীবন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বেঁচে থাকতে হতো।’
তারপর তিনি অনিন্দিতার নিকট এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘মা রে, বাবাকে কষ্ট না দিলে হতো না? তুমি যদি একবার বলতে তুমি মিফানকে ভালোবাসো, আমি কি অমত করতাম? মিফান তো নিজেদেরই ছেলে। ঘরের ছেলেমেয়ে ঘরেই থাকলো।’
অনিন্দিতার চোখ বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল কিন্তু সে নির্বাক রইলো।
যাওয়াদ এর বাবা বললেন, ‘তাহলে ভাইজান আমরা আসি এইবার। ভালো থাকবেন, আর মনে কোনো সংশয় রাখবেন না।’
আলম খন্দকার যে তাদের থেকে যেতে বলবেন বা একবেলা খেয়ে যেতে বলবেন এইটুকু সাহস তার হলো না। বিনম্র ভঙ্গিতে বললেন, ‘জি ভাইজান।’
যাওয়াদ যাওয়ার সময় কি মনে করে মিফানের সাথে হাত মেলালো। দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘এই যে রোমিও সাহেব ভালো থেকো। আর তোমার কপাল কেটে গেছে সেখানে ব্যান্ডেজ করে নিও। আসছি কেমন!’
‘ভাই আপনার কোনো আফসোস নাই তো?’
যাওয়াদ ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘থাকতো যদি তোমাদের মিল না হতো। যেহেতু তোমাদের মিল হয়ে গেছে, তাহলে সেখানে আমার তো কোন আফসোস থাকার প্রশ্নই আসে না।’
ওরা চলে যাওয়ার পর ঘর জুড়ে আবার নিস্তব্ধতা। অনিন্দিতা সবার সামনে আর মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। আশেপাশে যখন তাকিয়ে দেখল কেউ তার দিকে চেয়ে নেই, সুযোগ বুঝে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ওই সময় অবনী পিছন থেকে হাত টেনে ধরল। অনিন্দিতা বোনের দিকে ঘুরে তাকাতেই সে বলল, ‘ভালোই তো ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস তোরা। আমাদের চোখের সামনে দিন দিন এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, আর আমরা কেউ টের পেলাম না। তোরা দুইজন তো দেখি চুরি করলেও কাউকে ধরা দিবি না।’
‘চোর কি কখনো চুরি করে ধরা দিতে চায়?’
অবনী প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, ‘তোর নাকি এতদিন প্রেম করলি আমরা কেউ ধরতে পারলাম না কেন?’
‘আপু আমরা মোটেও প্রেম করিনি। মিফানের দিক থেকে প্রেম প্রকাশ্য থাকলেও আমার দিক থেকে সেটা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রকাশ্য।’
‘এখন বাবা কি করবে?’
‘জানিনা।’ অনিন্দিতা অসহায় মুখে বলল।
মিঠানের মা এই বাড়িতেই ছিলেন। তিনি এগিয়ে এলেন মিফানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুই যে এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবি এটা তো আশাতেই ছিল না। যদি আগে আমাদের বলতি তাহলে হয়তো এত সমস্যা হত না, আর মান সম্মানটাও ধুলিস্যাৎ হতো না।’
আলম খন্দকার তাকে থামিয়ে দিয়ে অবনীর উদ্দেশ্য বললেন, মিফানকে ঘরে নিয়ে কপালে ব্যান্ডেজ করে দিতে। উনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিবেন।
অবনী মিফান কে নিয়ে ঘরে এলো। এতক্ষণ সবার সামনে চুপচাপ থাকলেও এখন বকবক শুরু করে দিল।
‘তুই কি রে মিফান? তোর সাহস দেখে আমি তো অবাক। একেবারে সবার সামনে প্রেমের কথা বলে ফেললি। বাবাকে সবসময় ভয় পাই, আমরা তো কখনোই এমন কিছু মুখ দিয়ে বলতেই পারতাম না। অনিন্দিতা ঠিক এই কারণেই সাহস করে উঠতে পারে নাই। তোর কথা শুনে আমি প্রথমে যা অবাক হয়েছিলাম, আমার তো হার্ট খুলে হাতে আসার মত অবস্থা হয়েছিল।’
‘এত বকবক না করে কপালটা একটু ড্রেসিং করে দাও। যা মাথাব্যাথা করতেছে।’
‘প্রেম করবি আর এইটুকু মাথাব্যথা সহ্য করতে পারবি না, তা আবার হয় নাকি? পরে তো তোর জন্য আরও মাথা ব্যাথা অপেক্ষা করতেছে।’
‘তোমার কি মনে হয় আপু সবাই রাজি হবে?’
‘তুই জানিস না মিফান, বাবা অনিন্দিতা কে ঠিক কতটা ভালোবাসে। ওর সুখের জন্য সবকিছুই দিয়ে দিবে। আর তুই সেখানে আমাদের নিজের পরিবারের ছেলে, তোকে তো আরোও আগেই দিয়ে দিবে। আমি বড় হলেও বাবার সব সময় অনিন্দিতার প্রতি বেশি ভালোবাসা ছিলো।’
‘তাহলে মেনে নিবে বলছো?’
‘ওরা মানবে না ওদের ঘাড় মানবে।’
‘তোমার পিচ্চি দুইটা কই? দেখছি না যে? চকোলেট নিয়ে এসেছিলাম, ডাক দাও।’
‘ওরা ওদের বাবার সাথে বাইরে গেছে।’
‘ওহ।’
এমন সময় অনিন্দিতা এলো। মিফানের দিকে রাগি চোখে তাকালো। মনে হচ্ছে তাকে কাচা গপগপ করে খেয়ে ফেলবে।
অবনী মিফানের কপালে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে বলল, ‘কি রে অনু, তুই এভাবে রাগে ফুঁসছিস কেন? পিপড়া না মৌমাছি কি কামড়েছে তোকে?’
‘কিছুনা। ওরা বলতেছে, মিফানের আর আমার বিয়ের কথা। আশ্চর্য, হাঁটুর বয়সী ছেলেকে আবার কি বিয়ে করব আমি?’
অবনী হাসতে হাসতে বলল, ‘মুখে এসব বলছিস। আর মনের মধ্য যে লাড্ডু ফুটতেছে তা তো কথার ধরনেই বোঝা যাচ্ছে।’
অনিন্দিতা চুপ মেরে গেলো। অবনী দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আমি বসার ঘরে যাই। কে কি কথা বলে দেখে আসি।’
অবনী চলে গেল। দরজা দিয়ে আবার উঁকি মেরে দুজনকে বলল, ‘শোন আমি চলে যাচ্ছি, এইটুকু সময়ের মধ্যে আবার দুজনের প্রেম করা শুরু করে দিস না। এইটা তোদের প্রেম করার জায়গা না আর এখন তোদের প্রেম করার সময় না। আমি দুই মিনিটে গিয়ে পাঁচ মিনিটে আবার ফিরে আসছি।’
অবনী চলে গেলে অনিন্দিতা মিফানের দিকে একবার তাকালো। মিফান কিছু বলল না।
অনিন্দিতা বলল, ‘এখন কিছু বল।’
‘কাকে?’
‘কাকে আবার কি? চুপ করে আসিস কেনো?’
‘তো কি নাচবো নোরা ফাতেহির মতো? আর এখন আমার নিজের ভাগ্য দেখে নিজের ই হিংসে হচ্ছে।’
অনিন্দিতা সন্দিহান চোখে বলল, ‘কেনো?’
‘তুমি কে যে তোমাকে সব বলতে হবে?’
‘আমি কেউ না?’
‘কেউ না কেন? তুমি অনিন্দিতা, এইতো!’
অনিন্দিতা মুখ বাঁকিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। মিফান উঠে দাঁড়িয়ে ফের নিজেকে বলল, ‘তুমি আবারো জিইত্যা গেছো, মাম্মা!’
.
.
.
চলবে…..!
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]