#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |২|
‘ উচ্ছাস ভাইরা আজ আমাকে দেখতে আসছেন? কেন? ‘
সাহেদা মেয়ের চুলে সুন্দর করে খেজুর বেনী করে দিলেন। লম্বা চুলে বেনি গেঁথে বললেন,
‘ শুধু দেখবে না, কাবিনও পরিয়ে যাবে। ‘
এই যে, আবার কুসুমের চোখে জল জমল। ভেসে যাচ্ছে দুই চোখ। যতবার বিয়ের কথা শুনছে, ততবার কুসুম তার চোখের মণি টালমাটাল জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কুসুম আয়নার দিকে তাকাল। দর্পণে নিজের শ্যামলা বরণের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারছে। কোমড় অব্দি ঝুলে থাকা লম্বা চুলের বেনি সাহেদা বুকের কাছে এনে ধরলেন। বেনিতে বুকের ডান পাশ ঢেকে কোমড় অব্দি ঢেকে গেল। সাহেদা মেয়ের হাতে একটা ত্রিপিস ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ শাড়ি পরতে হবে না। আজ ত্রি পিস পড়। বিয়ের দিন প্রথমবার শাড়ি পড়বি। ‘
কুসুম খয়েরী রঙের ঝলমলে জামা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে ভাসা ভাসা চোখে চেয়ে থাকল। সাহেদা মেয়ের চিন্তা বুঝতে পারলেন। যত হোক মা তো। সাহেদা মেয়ের কপালে স্নেহের ওষ্ঠ ছোয়ালেন। কুসুম চোখ বুজে মায়ের আদর উপভোগ করল। সাহেদা মিষ্টি করে বলেন,
‘ দেখিস, স্বামির ঘরে রাজরানী হয়ে থাকবি। উচ্ছাসের মত ভালো ছেলে হয়না। তোকে আগলে রাখবে, যতনে রাখবে। তোর মায়ের রতন চিনতে ভুল হয়না কখনো। নিজের মেয়ের জন্যে সে ঠিক খাঁটি সোনাটাই পছন্দ করেছে। বুঝবি একদিন। ‘
কুসুমের বুক ভরে গেল মায়ের কথা শুনে। উচ্ছাসের কথা সবার মুখে সে শুনে এসেছে। খুব ভালো ছেলে, খাঁটি সোনা, এমন কিছু শুনতে শুনতে সে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ অব্দি সে উচ্ছাসকে চোখে দেখেনি। কুসুম বড় হচ্ছে যখন তখন উচ্ছাস হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। ছোটবেলায় উচ্ছাস তাদের বাড়ি আসত। কিন্তু ওতো ছোটবেলার কথা মনে আছে নাকি কুসুমের?
কুসুম হেলেদুলে ত্রি পিস নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। গোসল করে জামা পড়ে বের হয়। কুসুমের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। জ্বলজ্বল করছে ভেজা গা। আদুরে চোখে এক আকাশ মায়া! কুসুম বাথরুম থেকে বের হতেই উষা এল। কুসুমকে দর্পনের সামনে বসিয়ে হাতে পায়ে লোশন লাগাল। মুখে হালকা পাউডার দিয়ে, ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক ঘষে দিল। চোখে টানা টানা কাজলের রেখা এঁকে দিল। এটুকু সাজেই অপ্সরী লাগছে কুসুমকে। উষা বলল,
‘ আজ উচ্ছাসের হৃদয়হরণ হবে রে, কুসুমকুমারী। দেখিস। উচ্ছাসের নজর সরবে না তোর উপর থেকে। ‘
কুসুম খুশিতে গদগদ হল। বলল,
‘ সত্যি? আমাকে কি এতই সুন্দর দেখাচ্ছে? ‘
উষা উচ্ছল কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ রে, হ্যাঁ। দারুন লাগছে তোকে। দেখি, উঠে দাঁড়া তো। মাথায় ওড়না পিন করে দেই। হিজাব পড়ার দরকার নেই। শুধু হালকা করে ওড়না মাথায় তুলে রাখবি। ‘
কুদুম মাথা দুলিয়ে সায় দিল। উষা মাথায় ওড়না সুন্দর করে পিন দিয়ে স্যাট করে দিল। উচ্ছাসরা এসে গেছে। বসার ঘরে দারুন হইচই শোনা যাচ্ছে। উচ্ছাসের হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠও কানে আসছে। সঙ্গে এক বাচ্চার কণ্ঠ। উষা উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ তুই বস, আমি দেখে আসছি কে কে এসেছে। ‘
কুসুম বাধ্য মেয়ের ন্যায় বিছানায় পা দুলিয়ে বসে। উষা দেখে আসে। উচ্ছাসের পুরো পরিবারই বলতে গেলে এসেছে। উচ্ছাসের ফুপুর মেয়ে তার কোলে। উচ্ছাস বাচ্চাটার মুখে আপেলের টুকরো মুখে দিচ্ছে। বাচ্চাটাও হেলতে দুলতে হেসেখেলে আপেল খাচ্ছে। উচ্ছাস কুসুমের ভাই ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথাও বলছে। ইয়াহিয়া এটাসেটা জিজ্ঞেস করছে। উচ্ছাস বেশ নম্রভাবে উত্তর দিচ্ছে। উষা এস কুসুম পাশে বসল। কুসুম জিজ্ঞেস করে,
‘ কে কে এল, আপা? ‘
‘ উচ্ছাস এসেছে। চিন্তা নেই। ‘
কুসুম লজ্জায় জমে গেল। সে মোটেও উচ্ছাসের কথা ভেবে প্রশ্নটা করেনি। এমনি করেছে। অথচ তাকেই উচ্ছাসকে নিয়ে লজ্জা দেওয়া হচ্ছে। কুসুম চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ ধুর, শুধুশুধু মজা করছ তুমি। মজা করো না তো। ‘
অতঃপর কুসুমকে নিয়ে বসানো হল বসার ঘরে। উচ্ছাস কুসুমের দিকে একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আবার কোলে বসে থাকা ফুপুর বাচ্চাকে নিয়ে মশগুল হয়ে পরে। কুসুম নত মুখে বসে আছে ভাই ইয়াহিয়ার পাশে। ইয়াহিয়া উচ্ছাসদের দিকে নাগেট আর সসেজের প্লেইট এগিয়ে দেয়। বলে,
‘ আরে, এসব নিচ্ছ না কেন? খুব মজা হয়েছে। উষা বানিয়েছে। খেয়ে দেখো। ‘
উচ্ছাস একটা নিল। উচ্ছাসের বোন শিউলি উঠে এস কুসুমের পাশে বসল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছো, কুসুম আপা? ভাবি বলব নাকি আপা? ‘
কুসুম লজ্জায় আধখান হয়ে বলল,
‘ আপা’ই বলো। ‘
‘ আপা বললে আম্মা বকবে। আচ্ছা, ঠিকাছে। এখন আপা বলি। বিয়ের পর ভাবি বলব। হবে না? ‘
কুসুম মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ হবে ‘
উচ্ছাসের কাছে কুসুমকে বড্ড ছোট লাগছে। গায়ে গতরে এখনো পরিপক্কতা আসেনি। চেহারাও এখনো বাচ্চাদের মত। শিউলির সঙ্গে কথা বলতে শুনেছে উচ্ছাস। কথাবার্তাতেও এখনো ম্যাচিওরিটি আসেনি। উচ্ছাসের ভয় হয়, মায়ের কথা অনুযায়ী সে বাল্যবিবাহ করে বসবে না তো! উচ্ছাসের মা বোনের সঙ্গে রসিয়ে আড্ডা দেবার মাঝপথে বললেন,
‘ কুসুম, যা তো উচ্ছাসকে তোর বারান্দা দেখিয়ে আন। কুসুমের বারান্দায় ক্যাকটাস গাছও আছে! উচ্ছাসের তো আবার ক্যাকটাস গাছ অনেক পছন্দ। ‘
কুসুম যেতে চাইছে না। উষা কুসুমের গায়ে টোকা দিল। ফিসফিস করে বলল,
‘ উঠ! ‘
কুসুম লজ্জা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পা চলছে না তার। উচ্ছাসের দিকে চেয়ে মিনমিন করে বলল,
‘ আসুন। ‘
উচ্ছাস কোলের বাচ্চাকে নিয়েই চলল কুসুমের পিছুপিছু। যাবার পথে উচ্ছাসের মা বললেন,
‘ উচ্ছাস, মানহাকে রেখে যা আমাদের কাছে। ‘
উচ্ছাস উত্তর দিল,
‘ না, থাকুক আমার কাছে। ‘
কুসুমের পিছুপিছু উচ্ছাস বারান্দায় এল। কুসুম বারান্দার একপাশে কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। উচ্ছাস এদিক ওদিক চেয়ে দেখতে লাগল বারান্দার চারপাশ। কথা বলতে উচ্ছাসের বড্ড সংকোচ হচ্ছে। কি কথা বলবে, এই বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে? আর এই বাচ্চা মেয়ের সাথেই কি না সম্পূর্ণ জীবন কাটাতে হবে। একে তো বিয়ের অর্থ বুঝাতেই উচ্ছাসের সারা জীবন চলে যাবে। উচ্ছাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কুসুমকে জিজ্ঞেস করে,
‘ তোমার ক্যাকটাস গাছ অনেক পছন্দ? ‘
কুসুম মাথা দুলায়। উচ্ছাস কি করব বলব খুঁজে পায়না। একপাক্ষিক কথা চালিয়ে নেওয়া যায় নাকি? উচ্ছাস আবার বলে,
‘ তোমার আমাকে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই? ‘
কুসুম মাথা দুলিয়ে বলে, ‘ আছে। ‘
উচ্ছাস বিরক্ত হয়ে মনেমনে বলে, উদ্ধার করেছে। কিন্তু মুখে হাসি টেনে বলে,
‘ তাহলে জিজ্ঞেস করো। ‘
কুসুম মাথা নত করে বলে,
‘ আপনার কোলে এই বাচ্চাটা কার? আপনার? ‘
#চলবে