#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৩|
কুসুম মাথা নত করে বলে,
‘ আপনার কোলে এই বাচ্চাটা কার? আপনার? ‘
উচ্ছাস চমকে উঠে। চোখ মেলে কুসুমের দিকে চায়। আবার কোলে থাকা বাচ্চার দিকে চেয়ে সঙ্গেসঙ্গে তার ভ্রু কুচকে যায়। কুসুমের দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘ আমাকে দেখে কি মনে হয়? আমার দুই বছরের বাচ্চা আছে? বাচ্চাসমেত বিয়ে করতে এসেছি? ‘
কুসুম ভাসা ভাসা চোখে এবার উচ্ছাদের দিকে চেয়ে দেখে। সুদর্শন ছেলে উচ্ছাস ভাই। লম্বাটে খুব। এই যে তার দিক তাকাতে কুসুমের মাথা উচু করতে হচ্ছে। কুসুম তার কাঁধের চেয়েও নিচে। পেটানো দেহ। প্রশস্ত বুক। চেহেরা দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে তার বাচ্চা আছে। তবুও কুসুম প্রশ্ন করল,
‘ তবে এই বাচ্চা কার? ‘
উচ্ছাস মৃদু নিঃশ্বাস ছেড়ে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে যায় তার ভেতরের সমস্ত শান্তি-প্রশান্তি। উচ্ছাস বলে,
‘ আমার ফুপুর বাচ্চা, নাম মানহা। ‘
কুসুম শুনে লজ্জা পেয়ে যায়। সে মনেমনে কি না কি ভেবে ফেলেছে! ইশ! এই যে লজ্জায় এখন আর কুসুম মুখ তুলে চাইতে পারছে না। গা লজ্জায় জ্বলছে। একজন অবিবাহিত ছেলেকে সে বাচ্চার বাবা বানিয়ে দিয়েছে। কুসুম মৃদু স্বরে বলল,
‘ সরি! আসলে আপনার ফুপুকে আমি আপনাদের বাড়িতে আগে দেখেনি। তাই এই প্রশ্ন করে ফেলেছি। ‘
উচ্ছাস মানহার গালে চুমু দিয়ে কুসুমের দিকে চায়। বলে,
‘ ইটস ওকে। তোমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার আছে? ‘
কুসুম সঙ্গেসঙ্গে মাথা নাড়ায়, ‘ না, না। নেই। ‘
মূলত, কুসুম ভয় পাচ্ছে। সে প্রশ্ন করতে গেলে কিসব অদ্ভুত প্রশ্ন কর বসবে তার ঠিকঠিকানা নেই। তার চেয়ে বরং চুপ থাকাই ভালো। কথাও বাড়ল না, অদ্ভুত প্রশ্নও করা হল না।
উচ্ছাস এবার বলে,
‘ মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে হয়না। তবুও যেহেতু বিয়ে করতে এসেছি। বয়স জানা ভালো। তোমার বয়স কত? ‘
কুসুম উত্তর দেয়, ‘ ১৫। সামনের বছর ফেব্রুয়ারিতে ১৬ হবে। ‘
উচ্ছাস ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। বিষম খেয়ে কেশে উঠে। কুসুম এসে উচ্ছাসের কোল থেকে মানহাকে নিজের কোলে নিয়ে উচ্ছাসের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মুখে বলতে থাকে, ‘ দূর,দূর,দূর। ‘
উচ্ছাস কিছুসময় পর থামে। হাত বাড়িয়ে বলে,
‘ আমি ঠিক আছি। কাশি এসেছিল শুধু। এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। ‘
কুসুমের কোলে মানহা কাদঁছে। নতুন মানুষ বলে হয়ত চিনতে পারেনি। উচ্ছাস মানহাকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। মানহার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই সে শান্ত পাখির ন্যায় হয়ে যায়। উচ্ছাসের কাধে মাথা গুঁজে আঙ্গুল চুষতে থাকে। উচ্ছাস কুসুমের দিকে চেয়ে বলে,
‘ এত ছোট বয়সে বিয়ে করছ, ভয় করছে না? ‘
কুসুমের মুখ ছোট হয়ে যায়। সে মিনমিন করে বলে,
‘ মা বলেছে দেখে করছি। ‘
উচ্ছাস আর কথা বাড়ায় না। মানহাকে নিয়ে বলে,
‘ এখন যাওয়া যাক। অনেক কথা বলেছি। তোমার বারান্দাটা সুন্দর। নিজে লাগিয়েছ এসব গাছ? ‘
উচ্ছাস সামনে এগিয়ে যায়। কুসুম পিছু পিছু আসতে আসতে বলে,
‘ হুঁ। গাছ আমার ভালো লাগে। ‘
যাক, এই দিকে উচ্ছাসের সঙ্গে কুসুমের মিল রয়েছে। উচ্ছাস শান্তি পেল মনেমনে। উচ্ছাস এসে বসে আগের জায়গায়। মানহা মাকে দেখে তার কোলে যাবার বায়না ধরে। উচ্ছাস মানহাকে ফুপুর কোলে দেয়। কুসুম এসে ভাইয়ের পাশে বসে। উচ্ছাসের মা ছেলের হাঁটুতে টোকা দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
‘ কুসুম কেমন লেগেছে রে? ‘
উচ্ছাস মায়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
‘ আম্মা, তুমি তো আমাকে বাল্যবিবাহ দিয়ে দিচ্ছ। এসব পুলিশ জানলে তোমাকে সহ আমাকেও ধরে নিয়ে যাবে। সচেতন ডাক্তার হয়ে আমি বাল্যবিবাহ করব? ‘
উচ্ছাসের মায়ের মুখের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। তিনি আগের ন্যায় ফিসফিস করে বললেন,
‘ বিয়ে হচ্ছে নাকি এখন? এখন তো শুধু কাবিন হবে, সংসার করবে না কুসুম। ১৮ পাড় হলে সংসার করবে। পুলিশ কিছু করবে না। আমাকে আর আইন শেখাস না। এখন বল, মেয়ে ঠিক আছে? কাবিন পড়াব? ‘
উচ্ছাস অসহায় কণ্ঠে বলে,
‘ আরো একটু ভাবলে হয় না, আম্মা? এত ছোট মেয়ে..’
উচ্ছাসের মা এবার যেন বেশ বিরক্ত হলেন। তিনি উচ্ছাসের কথা কানেও তুললেন না। নিজের বোনের দিকে চেয়ে বললেন,
‘ সাহেদা, কাবিনের কাগজ তৈরি তো? শুভ কাজে দেরি করা ঠিক হবে না। ‘
ইয়াহিয়া মাঝখানে কথা বলে,
‘ উচ্ছাস, তোমার মত হলে আমরা কথাবার্তা এগুব। ‘
উচ্ছাস আর কি বলবে? মা নিজেই তো সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করে রেখে দিয়েছেন। উচ্ছাস নম্র স্বরে বলে,
‘ আম্মার কথাই আমার কথা। ‘
সবার মুখ প্রসন্ন হয়। উচ্ছাসের মা ছেলের দিকে খুশি খুশি চোখে তাকান। উচ্ছাসের বোনেরা খুশিতে বাকবাকুম করে উঠে। ইয়াহিয়া মৃদু কন্ঠে বলে,
‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘
অতঃপর কাজী ডাকা হল। কুসুমকে কাবিননামায় সাক্ষর করতে বলা হলে, কুসুমের চোখে আবারও জল চলে এল। মায়ের দিকে ভাসা ভাসা চোখে চেয়ে কেঁদে ফেলল। সাহেদা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়ের হাতে কলম তুলে বললেন,
‘ কাঁদিস না। সাক্ষর কর। ‘
উচ্ছাস এসব দেখে যায়। বিড়বিড় করে বলে,
‘ বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করার জ্বালা দেখো। কাঁদার কথা আমার কারণ আমাকে ধরেবেঁধে বিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কি হচ্ছে? কনে কাঁদছে। উফ!’
উচ্ছাসের মনেমনে বেশ য”ন্ত্রণা অনুভব হল। মায়ের প্রতি ভীষন অভিমান জন্মালো মনে। কুসুম একসময় কাঁদতে কাঁদতে সাক্ষর করে দিল। উচ্ছাসের বেলায় উচ্ছাস দেরি না করে কলম তুলে সাক্ষর করল। সাক্ষর করার আগে দোয়া করল,
‘ আল্লাহ! এই বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে সংসার করা ক্ষমতা আর ধৈর্য্য তুমি আমাকে দিও। ‘
উচ্ছাস সাক্ষর করার পর বাড়িতে হইচই লেগে গেল। সবাই একে অন্যের মুখে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন। ইয়াহিয়া এসে উচ্ছাসের সঙ্গে কোলাকোলি করল। কুসুমের হাত উচ্ছাসের হাতে রেখে ভেজা কণ্ঠ বলল,
‘ নিজের কলিজা ছিঁ”ড়ে তোমার হাতে দিলাম। দেখে রেখো। বাবা নেই আমাদের। আমিই নিজের হাতে ওকে বড় করেছি। ওর দোষকে অদেখা করে বুঝিও। সারাজীবন একসঙ্গে থেকো। যাই হয়ে যাক, একে অপরের হাত ছেড়ে দিও না কখনো। ‘
উচ্ছাস কুসুমের হাত ধরে। কি নরম হাত। উচ্ছাসের হাতের মধ্যে যেন ডুবে যাচ্ছে। উচ্ছাস ইয়াহিয়ার দিকে চেয়ে বলে,
‘ চেষ্টা করব ইন শা আল্লাহ! ‘
ইয়াহিয়া মৃদু হাসে। অতঃপর খাবারের দিকটা দেখার জন্যে চলে যায়। কুসুম এখন উচ্ছাসের পাশে বসে। উচ্ছাসের কোলে আবারও মানহা বসে আছে। ফুপু উচ্ছাসের মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। আপাতত মেয়ের কোনো খোঁজ নেই তার। উচ্ছাস মানহার মুখে একটু একটু করে আপেল দিচ্ছে। মানহা খাচ্ছে আর খেলছে। কুসুম এসব দেখে যাচ্ছে। কুসুমের কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে উচ্ছাসের পাশে বসতে। তাই সে উঠে গিয়ে উষার পাশে বসে পরল।
#চলবে