#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ৩২
উচ্ছ্বাস শান্ত ভঙ্গিতে সব শুনে বলে, ‘পাঁচ মিনিট শান্ত হয়ে আমার কথা শুনো। তারপর অভিযোগ করবে, কুসুম। আমি বাঁধা দেব না। জাস্ট ফাইভ মিনিট’স! ‘
কুসুম থামে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে উচ্ছ্বাসের থেকে কিছুটা দূরে বিছানায় বসে। তা দেখে উচ্ছ্বাস ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘দূরে বসেছ কেন? কাছে এসো।’
কুসুম উপলব্ধি করল, উচ্ছ্বাসের গলায় কাতরতা। উচ্ছ্বাসের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস নেই উপলব্ধিতে বুক কেপে উঠল কুসুমের। না চাইতেও, উদভ্রান্তের ন্যায় এগিয়ে গিয়ে উচ্ছ্বাসের পাশে এসে বসল। কিছুক্ষণ নিরবতা। অতঃপর হাত বাড়িয়ে উচ্ছ্বাস কুসুমের হাত নিজের হাতে আলতো করে চেপে ধরল।
কুসুমের চোখের দিকে চেয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করল। অভিমানে অভিমানিনি দিগ্বিদিকশূন্য। উচ্ছ্বাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে থাকে,
‘বিদেশ থেকে আসার পর, আমি চেম্বার খুলি। সেই সঙ্গে প্ল্যান করি, নিজের একটা হসপিটাল খোলার। হসপিটাল খোলা চাট্টিখানি কথা না জানোই তো। অনেক টাকার ব্যাপার। আমরা অনেকজন ডাক্তার ব্যাচমেট মিলে আমরা টাকা জমিয়ে শেয়ার কিনি। হসপিটালের জন্যে সবাই কিছু টাকা জমাই। বাকি টাকা ব্যাংক থেকে লোন নেই। হসপিটালের কাজ শুরু হয়েছে কদিন হয়েছে। কিন্তু জমি নিয়ে এখন ঝামেলা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের খপ্পরে পরেছে জমি। ভালো এবং দামি জমি হওয়ায় তাদের নজরে জমির লোভ। আজকে এসেছিল সাইটে ওরা। আমি কয়েকটা কটু কথা বলে দিয়েছিলাম। আসলে রাগে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। তখন সাইটে ওরা কিছু না বললেও, আজকে বাড়ি আসার পথে কজন মুখ বাঁধা লোক হঠাৎ করে আক্রমন করে উঠে। হঠাৎ সবকিছু হওয়ায় ঠাল সামলাতে পারিনি। নিভে গেছিলাম। তার ফল এসব আঘাত, এই চোট!’
কুসুম হতভম্ব চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে চেয়ে রইল। টালমাটাল জলে দু চোখ ভিজে। গড়িয়ে পরল জলের বিন্দু। এমন আঘাতে ক্ষতবিক্ষত উচ্ছ্বাসকে আগে দেখেনি কুসুম, এবং এখনও দেখার সাহস নেই। কুসুম কিছুক্ষণ হাত বাড়িয়ে উচ্ছ্বাসের কপালে থাকা ব্যান্ডেজ ছুঁয়ে দিল। উচ্ছ্বাস চোখ বন্ধ করে অনুভব করল কুসুমের হাতের ছোঁয়া। কি নরম করে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে কুসুম। যেন সামান্য ছোঁয়ায় ব্যথায় মরণ হবে উচ্ছ্বাসের। উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে কুসুমের চোখের পানি আঙুল দিয়ে মুছে দিল। বাচ্চাদের মত করে বোঝানোর ভঙ্গি করে বলল,
‘সামান্য চোট। ঠিক হয়ে যাবে। কেঁদো না।’
কুসুম কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। নাক টেনে টেনে বলল,
‘আপনার জীবন কি এখন ঝুঁকিতে? কিছু কি করে ফেলবে ওরা আপনার? সত্যি করে বলেন।’
উচ্ছ্বাস কুসুমকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি করে বলল,
‘আমি আসার পথে মামলা করে এসেছি। অবশ্য মামলায় কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই আমি উপর মহলের কিছুজনকে ধরেছি। এসব পাতি নেতাদের তারাই দেখে নিবে। চিন্তা করো না।’
কুসুম আশ্বস্ত হল। আনমনে চেয়ে রইল উচ্ছ্বাসের বুকের দিকে। খানিক পর উচ্ছ্বাসের বুকে আলতো করে হাত রেখে ভেজা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
‘আমি যদি আপনার বুকে একটু মাথা রাখি, আপনি কি খুব বেশি ব্যথা পাবেন?’
কি নিদারুণ আবদার! যে কেউ শুনে গলে যেতে বাধ্য। আর এ তো স্বয়ং উচ্ছ্বাস। কুসুমের একটুখানি আবদারে সকল ব্যথা যার সুখ হয়ে যায়! উচ্ছ্বাস দুহাত বাড়িয়ে দিল। চোখের ইশারা করে বলল,
‘আসো, ঝাঁপিয়ে পরো এই বুকে।’
কুসুমের চোখ ঝলমল করে উঠল। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে সে। কুসুম ঝাঁপিয়ে পরল না। বরং আলতো করে মাথা রাখল তার বুকে। উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের সর্বত্র হাসি ছড়িয়ে। মেয়েটা বুকে মাথা যতবার রাখে, সুখে কেমন কুকড়ে যায় উচ্ছ্বাস। কখনও ভাবেনি, এই ছোট্ট মেয়ের মধ্যেই তার জীবনের সব সুখ লুকিয়ে থাকবে! কখনও ভাবেনি, বিয়ে নামক বন্ধনে এতোটা মায়া, এতটা মহব্বত লুকিয়ে আছে! বিয়ে করেছে সে। এখন যদি একটা বাচ্চা থাকত তাদের? কেমন হত? কোমরে আঁচল গুঁজে রান্না করা বউকে দেখে যেমন নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখী মনে হয়, তেমন করে বাচ্চাকে শাসন করা মা হিসেবে কুসুমকে দেখতে কি অস্বাভাবিক সুন্দরই না লাগবে! উচ্ছ্বাস মনেমনে সেসব কল্পনা করে ক্ষণেক্ষণে রোমাঞ্চিত হতে থাকে। পরপরই নিজের ভাবনায় লাগাম টানে। বাচ্চা তার চাই, অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু সে কথা দিয়েছে তার পরিবারকে। কুসুমের পড়াশোনা শেষ হলেই বেবি প্ল্যান করবে তারা। তবে এতোটা বছর ধৈর্য্য ধরা আদৌ সম্ভব হবে উচ্ছ্বাসের জন্যে? অপেক্ষায় ক্লান্ত উচ্ছ্বাস কি মরে যাবে না? তবে কিছুই করার নেই। বিয়ে করেছে অবেলায়। তাই বেলা হবার আগে নিজের ইচ্ছে আপাতত ধামাচাপা দিতে হবে।
______
রাত যত বেড়েছে, উচ্ছ্বাসের জ্বর হুহু করে বেড়েই চলেছে। কুসুম শেষবারের মত থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপে,১০৩° জ্বর। কুসুমের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। একা একা সব সামলাতে পারছে না, সবাইকে ডাকতে চাইছে সে। কিন্তু উচ্ছ্বাস মানা করছে। খামোকা সবাই ক্ষতবিক্ষত উচ্ছ্বাসকে দেখলে চিন্তায় সেখানেই মূর্ছা যাবে। কুসুম একহাতে চোখের জল মুছে মুছে উচ্ছ্বাসের শরীর মুছে দিল। উচ্ছ্বাসের সারা গা গরম হয়ে আছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কুসুম স্যুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করল তাকে। কিছুটা খেয়েই পুরোটাই বমি করে ফেলে দিল। কুসুম পরল মহা বিপাকে। ফল কেটে এনে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। কিছুটা খেয়েই হাত দিয়ে মানা করল উচ্ছ্বাস। কুসুম জোর করল না। বাটি রেখে দিয়ে আরো একবার নরম হাত রাখল উচ্ছ্বাসের উত্তপ্ত কপালে। ইশ, পুড়ে যাচ্ছে যে হাত। কুসুম ভেজা ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘এতোটা জ্বর। কি করব আমি? কমছে না কেন এই জ্বর। আপনার কথামত ঔষধ তো দিলাম। তাও কমছে না। আমি কি খালা.. আম্মাকে ডেকে আনব, প্লিজ!’
উচ্ছ্বাস হাত বাড়িয়ে মানা করল। গায়ের কম্বলটা নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল, ‘ খু–ব ঠা–ন্ডা লা-গ-ছে।’
কুসুম কি করব ভেবে পাচ্ছে না। হাত দিয়ে পায়ের পাতা মালিশ করে দিল, হাত মালিশ করে দিল। হিটার এনে পাশে রাখল। কুসুম যখন এত ব্যস্ত তখন হাত বাড়িয়ে উচ্ছ্বাস জ্বরের ঘোরে কুসুমকে নিজের দিকে টেনে নিল। কুসুমের গলায় মুখ রাখলে কুসুম উপলব্ধি করে তার গলায় কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কুসুম ছোট্ট করে উচ্চারণ করল, ‘জ্বরে পুড়ে যাচ্ছেন। ঔষধ দেই আরেকটা?’
উচ্ছ্বাস শুনল না। বরং স্ত্রীকে নিজের সঙ্গে বেধে ফেলল আরেকবারের মত। কুসুমও হার মানল চরম উত্তাপের কাছে। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরল উচ্ছ্বাসকে।
#চলবে
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব- ৩৩
ইয়াহিয়া ওয়েডস ঊষা শিরোনামে কিছুটা ধুমধাম করেই বিয়ে হচ্ছে কুসুমের ভাইয়ের। ঊষা এবং ইয়াহিয়া যখন একসঙ্গে স্টেজে বসে ছিল, কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল তাদের। বোধ হয়েছিল, এমন সুন্দর বোধহয় আর কাউকেই লাগার নয়। কুসুমের বুকের ভেতর অস্থির লাগছে ভীষন। ভাইয়ের বিয়েতে দৌড়াদৌড়ি করার ফাঁকে, বারবার এসে উচ্ছ্বাসকে দেখে যাচ্ছে। নিজের এক ছোট বোনকে রেখে গেছে উচ্ছ্বাসকে সর্বদা দেখে রাখার জন্যে। জ্বর কমেনি এখনো পুরোপুরি। মাথা ঘুরাচ্ছে বারবার। সকালে বিয়েতে আসার আগে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে। কাটার জায়গায় ছোট একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। কুসুম কত করে বলল, ব্যান্ডেজ থাকুক, ইনফেকশন হয়ে যাবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? উচ্ছ্বাসের ভাষ্যমতে, বিয়েতে কাউকে ব্যান্ডেজ পরে যেতে দেখেছ, কুসুম?
কুসুম অগ্যতা মেনে নিতে হল উচ্ছ্বাসের জেদ।
বিয়ের একফাঁকে কুসুম ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এল উচ্ছ্বাসের দিকে। এন্টিবায়োটিক ঔষধ উচ্ছ্বাসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবারও বেরিয়ে গেল হন্তদন্ত পায়ে। উচ্ছ্বাস মৃদু হাসল। কে বলবে, এই বাচ্চা মেয়েকেই উচ্ছ্বাস একটাসময় বিয়ে করতে চায়নি, সংসার বুঝবে না দেখে।
ঊষার বিদায়ের সময় ঊষার বাবার চোখে এক ফোঁটা জল নামেনি। বরং মেয়েকে বড্ড কঠিন হাতে তুলে দিলেন ইয়াহিয়ার দিকে। ঊষা সব দেখে। চোখের জলে ভেসে যায় মুখ। বিয়ের সময় বাবার এমন কঠোরতা মানতে কষ্ট হচ্ছে তার। যাই হোক, বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে না করে বাবার পছন্দকে অপমান করেছে ঊষা। এটা তো তার প্রাপ্যই ছিল। ঊষার মা মেয়ের হাতে তার বিয়ের বালা পরিয়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলেন। মা জাতি কখনো রাগ করে থাকতে পারে না। তারা স্রষ্টা কর্তৃক নরম স্বভাব পেয়েই পৃথিবীতে আসে। ঊষা মায়ের কাঁধে মাথা রাখে। চোখের জল আর বাঁধা মানে না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ঊষা। কুসুমের চোখেও জল। ঊষা আপার কান্না তার সহ্য হচ্ছে না। ঊষা আপাকে কাদতে দেখলে ছোটবেলা থেকেই কুসুমের কান্না আসত। তারপর দুজন জড়াজড়ি করে কাদতে বসত। কুসুমকে কাদতে দেখে উচ্ছ্বাস একহাতে কুসুমের কাধে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে টেনে নিল। বাচ্চাদের বোঝানোর ভঙ্গি করে বলল,
‘বোকাদের মত কাদছ কেন, মেয়ে? ঊষা তোমাদের বাসায় যাচ্ছে, আর কোথাও না।’
কুসুম নাক টেনে বলল, ‘জানিনা কেন কান্না আসছে। অথচ কান্না আসার কথা না আমার। খুশিতে আমার এখনও বুক কাপছে। অনুভব করতে পারছি আমি।’
উচ্ছ্বাসের কৌতুক বোধ হল। সে কিছুটা ঝুঁকে এল কুসুমের দিকে। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
‘আড়ালে আসো। কান পেতে শুনি, কেমন কাপছে।’
কুসুম চমকে উঠলো। পরপরই চোখ রাঙিয়ে তাকাল। উচ্ছ্বাস ভয় পাওয়ার অভিনয় করে দু কদম পিছিয়ে গিয়ে মিটমিট করে হাসে।
_______________________
ফুলের বিছানার মধ্যখানে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ঊষা। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করে কাপছে। হৃদপিন্ড যেন এক্ষুনি বেরিয়ে মাটিতে পরবে। ইয়াহিয়ার সঙ্গে প্রথম এক ঘরে, এক বিছানায়। ভাবলে সর্বাঙ্গ ভয়ানক শিউরে উঠছে। ঊষা শুনতে পায়, দরজা লাগানোর শব্দ। চমকে উঠে বিছানার চাদর খামচে ধরে সে। জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঊষা। ইয়াহিয়া ঊষার দিকে একপল চেয়ে দেখে। ঊষার অস্বাভাবিকতা পরখ করে ঠোঁটে সর্বত্র হাসি ফুটে উঠে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় স্ত্রীর দিকে।
‘ঊষা?’
ধীমে এই সম্বোধন ঊষাকে ভূমিকম্পের মত কাপিয়ে তুলল। নত চেহারায় উত্তর দিল,
‘হু?’
‘অজু আছে? নামাজ পরতে পারবে?’
ঊষা হ্যাঁবোধক সম্মতি দেয়। ইয়াহিয়া উঠে মেঝেতে দুটো জায়নামাজ বিছায়। দুজন একসঙ্গে নামাজ আদায় করে মোনাজাতে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে অনেকক্ষন।
ঊষা দোয়া করে চুপ করে বসে আছে বিছানায়। ইয়াহিয়া জায়নামাজ ভাঁজ করে জায়গায় রেখে বিছানায় এসে বসে। গাঢ় চোখে ঊষার দিকে তাকায়। একটু পর মিটমিট করে হেসে বলে,
‘তুমি বোধহয় তোমার ওয়াদার কথা ভুলে গেছ, ঊষা? মনে করিয়ে দেব আমি?’
ঊষার যে লজ্জায় মারা যাচ্ছে। কি করে ওয়াদা পালন করবে সে? ঊষা ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে ফিরে যায়। ইয়াহিয়া এগিয়ে আসে। ঊষাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ঠোঁট বরাবর ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলে,
‘কষ্ট হচ্ছে ওয়াদা পালন করতে? আমি হেল্প করব, বউ?’
ঊষা চমকে তাকায় ইয়াহিয়ার চোখের দিকে। তবে ধীরে ধীরে তার দু চোখ নিমিষে বন্ধ হয়ে যায় ভয়ংকর এক ঠোঁটচুম্বনের অনুভবে।
________________________
বিয়ের পর, অনেকদিন ধরে কুসুমের পড়াশোনা স্থগিত ছিল। এখন আপাতত সকল ঝামেলা শেষ হয়েছে। উচ্ছ্বাস কুসুমকে নর্থ সাউথে ভর্তি করে দিয়েছে। রোজ বাসা থেকে উচ্ছ্বাস হসপিটাল যাবার পথে দিয়ে আসে, আসার সময় ড্রাইভার বাসায় নিয়ে আসে। এভাবেই কুসুমের ব্যস্ত জীবন চলছে। উচ্ছ্বাসের হসপিটালের কাজও শুরু হয়ে গেছে। আপাতত চারতলা বিল্ডিং করে হসপিটাল করা হবে। এখানেই ছোটখাটো ল্যাব করা হবে, ডাক্তার বসবে। তার থেকে যে টাকা লাভ আসবে, সে টাকা দিয়ে বাকি কাজ সারা হবে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী এগুচ্ছে উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাস ঠিকই বলেছিল। সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, বাবার পরিচয়ের বাইরে গিয়ে নিজের কিছু পরিচয় করতে চায়। সম্পূর্ন নিজের টাকায় আজ উচ্ছ্বাস সফলতার পথ দেখার পথে। না লেগেছে বাবার টাকা, না লেগেছে কোনো পাতি নেতার সুপারিশ। উচ্ছ্বাস নিজের দমে চেষ্টা করেছে এবং সে পেরেছেও।
কটাদিন ভালো গেলেও, আজকে কুসুমের শরীর বড্ড দুর্বল লাগছে। শরীরের ব্যথায় রীতিমত মারা যাচ্ছে কুসুম। কুসুমের শরীর খারাপ দেখে উচ্ছ্বাসের মা কুসুমকে আজ ভার্সিটি যেতে দেন নি। বাসায় আপাতত বিশ্রাম নিচ্ছে সে। মাঝেমাঝে রান্নাঘরে গিয়ে টুকটাক কাজও করছে। শ্বশুরবাড়িতে কাজ নিয়ে কেউ খোঁটা না দিলেও, কুসুম নিজের ইচ্ছেই কাজ করে এখানে। নিজের ভালো লাগা থেকে করে। আজ উচ্ছ্বাসের ফিরতে দেরি হবে। সাইটে যাবে একটু। কুসুম শ্বশুরের জন্যে চা করছিল। ভ্যাপসা গরমে হঠাৎ করে কুসুমের মাথা ঘুরে উঠল। কুসুম দ্রুত ক্লান্ত হাতে পাশের দেয়াল ধরে ফেলল। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে কুসুমের। কুসুম দেয়াল ধরে ধীরে বেসিন থেকে পানি নিয়ে মাথায় পানি দিল। উত্তপ্ত মাথা কিছুটা ঠাণ্ডা হল এবার। ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গিয়ে পানি বের করল। তবে বিপত্তি ঘটল এবার। পানি খাওয়ার আগেই বোতলসহ মাথা ঘুরিয়ে মেঝেতে পরে গেল কুসুম। প্লাস্টিকের বোতল মেঝেতে পরে শব্দ তুলল। কুসুম আল্লাহর নাম করে ততক্ষণে মেঝেতে লুটিয়ে।
______________________________
হইহই রবে পরিপূর্ন উচ্ছ্বাসদের বাড়ি। চারদিকে কল্লোল লেগে গেছে। সবাই এই মুহূর্তে খুশি হলেও, একমাত্র খুশি হতে পারছেন না উচ্ছ্বাসের মা এবং স্বয়ং উচ্ছ্বাস। কুসুমের জ্ঞান এখনো ফেরেনি। উচ্ছ্বাসের মা রুমে থাকা সবাইকে বেরিয়ে যেতে বললেন ঘর ছেড়ে। সবাই একে একে সন্দেহের দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের মায়ের দিকে চেয়ে বেরিয়ে গেল কুসুমের ঘর ছেড়ে। সবাই বেরিয়ে গেলে পারুল গম্ভীর চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। উচ্ছ্বাস এখনো গায়ের এপ্রোন অব্দি খুলেনি। থমথমে চেহারার কুসুমের পাশে বসা। পারুল গলা খাঁকারি দিয়ে কথা তুললেন,
‘তোর খালমনিকে কি উত্তর দিবি এখন? সে রাস্তায়। পারছে না উড়ে চলে আসতে। এসেই তোর আর আমার ক্লাস নিবে সে। কি করবি এখন?’
উচ্ছ্বাস গাঢ় চোখে কুসুমের দিকে চেয়ে দেখল। মেয়েটাকে পইপই করে বলে দিয়েছে, একটু সতর্ক থাকতে। সে সবসময়ই সতর্ক ছিল। কিন্তু সেদিনের জ্বর সব উল্টেপাল্টে দিয়েছে। জ্বরের কারণে শরীরে দূর্বলতা থাকায় এসব বিষয়ে মনোযোগ দেবার কথা মনে ছিল না। আর এই বিষয়ের সুযোগ কুসুম ইচ্ছে করেই নিয়েছে। কি করবে এই মেয়েকে নিয়ে উচ্ছ্বাস? সবসময় তাকে জ্বালানোর ধান্দা করে মেয়ে! মেয়েটা তাকে পাগল করে ছেড়ে দেবে একদিন রাস্তায়।
উচ্ছ্বাস কোনরূপ উত্তর দিচ্ছে না দেখে পারুল আর কথা বাড়ালেন না। ছেলের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলা অশোভনীয় দেখায়। তাই পারুল এসব বিষয়ের কথাবার্তার স্থগিত করলেন। সোফা ছেড়ে উঠে কুসুমের পাশে এস বসলেন। কুসুমের চুলে হাত বুলিয়ে নরম গলায় ছেলেকে বললেন,
‘খেয়াল রাখ নিজের বৌ-বাচ্চার। যেমন করেই আসুক, এই বাচ্চা এ বাড়ির প্রথম উত্তরসূরি। তার খেয়াল রাখা আপাতত তোর ডাক্তারি থেকেও গুরুত্বপূর্ন। কুসুমের জ্ঞান ফিরলে, ওর সঙ্গে চেঁচামেচি করবি না। মনে রাখবি, ওর মন খারাপ মানে আমার নাতিপুতির মন খারাপ। ঠিকাছে? তুই কুসুমের পাশে বস। আমি তোর জন্যে চা পাঠাচ্ছি।’
পারুল মনেমনে খুশিতে পারছেন না, উরে আসমানে চলে যেতে। কিন্তু ছেলেকে তো সেটা বোঝানো যাবে না। সবাই যেন বুঝে, ছেলের এই আহাম্মক আচরণে তিনি ক্ষিপ্ত, মোটেও খুশি নন। কিন্তু আসল কথা তো, তিনি পারছেন না ছেলেকে এই মুহূর্তে ছোটবেলার মত কোলে করে দোল খাওয়াতে। ইশ! তার নাতিপুতি আসবে! ঘরে বাচ্চাদের কলকল ভেসে থাকবে সবসময়। পারুল রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে মোবাইলে বাচ্চাদের নাম দেখতে লাগলেন। কোনটা রাখা যায়? উল্লাস নাকি শুভ্রতা?
#চলবে