গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-১৫+১৬

0
329

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_১৫

পুরনো আঙটি, ক্ষয়ে গিয়ে দুই আনা চার রত্তির মতো আছে। তবে পুরনো স্বর্ণ আর রিসিট না থাকায় আলো পেলো মাত্র সাত হাজার টাকা! অবশ্য সাত হাজারও আলোর জন্য বিশাল ব্যাপার। শপিং এর জন্য তিন হাজার রেখে, বাকি চার হাজার কলেজ ব্যাগের ভেতর লুকিয়ে ফেললো। ব্যাগের ভেতরে একদম নিচের দিকে সেলাই খুলে নিয়েছিল আলো। সেই ছেঁড়া জায়গা দিয়ে টাকা ঢুকিয়ে আবার সেলাই করে দিয়েছে। কালো সুতো আর সুঁই সাথে করেই নিয়ে এসেছিল। রাতুলের সাথে গিয়ে প্রথমেই এক হাজার টাকা দিয়ে একটা পার্টি ব্যাগ কিনেছে। এত দামি ব্যাগ আলো এর আগে কখনো ব্যবহার করেনি। মা আর বোনেরা কখনো পাঁচশো ছয়শোর উপর ব্যাগের জন্য খরচ করেনি। বাকি দুই হাজার দিয়ে সুইমিং করার জন্য টপস আর প্যান্ট নিয়েছে। লিপস্টিক আর ফাউন্ডেশনও নিয়েছে। হাতে বাকি থাকা পাঁচশো টাকা আর খরচ করেনি। রিসোর্টে গেলে হাতে কিছু রাখা দরকার।

বাসায় ফিরে দেখে ধুন্ধুমার কান্ড। মেজো আপা আয়েশা আর মা দেলোয়ারা বেগম গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করছেন। আপার স্বামী খলিল দুলাভাইও আপার সাথে তাল মিলিয়ে চেঁচামেচি করছেন।

বিষয় হলো খলিল, শাশুড়ি দেলোয়ারা বেগমের কাছ থেকে ধার নেওয়ার আগে বলেছিল কয়েকমাসের ভেতর লাভ সহ লাখ টাকা ফেরত দেবে। মাস পেরিয়ে গেল, কিন্তু এখনও খলিলের টাকা দেওয়ার খবর নেই। দেলোয়ার বেগম গত কয়েকদিন ধরেই মেয়ে আয়েশাকে এই বিষয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। দেলোয়ারা বেগমের ইচ্ছে ছিল টাকাগুলো পেলে স্বর্ণকারের দোকানে যাবেন। এক জোড়া কানপাশা বানাবেন। স্বর্ণের দাম হুহু করে বাড়ছে। আর দাম কমার কোন সম্ভবনাও নেই। এখনো ছোটো মেয়ের বিয়ে বাকি। ছেলের বিয়েতেও কিছু না হোক একটা চেইন অন্ততঃ দিতে হবে। নিজের জন্য সোনার কিছুই তখন থাকবে না। কানপাশাটা তাই নিজের জন্য বানিয়ে রাখতে চান। আজ যখন হঠাৎ আয়েশা বাসায় আসে, দেলোয়ারা বেগম খুশি হয়ে যান। ধরেই নিয়েছেন আজ আয়েশাকে নিয়ে যাওয়ার সময় খলিল টাকা নিয়ে আসবে। আশিকের দেওয়া টাকা থেকে মেয়ে জামাইয়ের জন্য ভালো বাজার করিয়েছেন। মুরগী, মাছ দুটোই রেখেছেন দুপুরের আয়োজনে। কিন্তু এই বিদায়বেলায় যখন খলিল আর আয়েশা টাকাপয়সার কথা কিছু পরিষ্কার না করে চলে যেতে উদ্যত হয়, তখন মুখ ফুটেই টাকার কথা তোলেন দেলোয়ারা বেগম।

“খলিল, বাবা টাকাটা পাইলে খুব ভালো হইতো। জানোই তো আতিয়া আগের মতো টাকা পয়সা দেয় না। আশিকের বেতন কত! ডাক্তার দেখামু, টেস্ট করুম। টাকা পয়সা হাতে নাই।”

কণ্ঠে দরদ আর অসহায়ত্ব এনে বলেন দেলোয়ারা বেগম।

“আতিয়া আপা টাকা দেয় না ক্যান? খোঁজ খবর করেন আম্মা। কোন ব্যাটার পাল্লায় পড়ছে নাকি! বহুত ভাদাইম্মা লোক থাকে, এমন একা মহিলাগো কামাই খাইতে প্রেম ভালোবাসার কথা কইয়া ফুসলায়। আপা তো কয়দিন আগেও বিয়া বইতে অস্থির আছিল। আপনে কইলে খোঁজ নিয়া দেখি।”

“সেরকম কিছু মনে হয় না বাবাজি। ঐ লোন টানে দুইটা। আয়েশার বিয়ার সময় লোন নিয়েছে, সেই লোনও টানতে হয়।”

“ইসস, কয় টাকা খরচ হইছে আমার বিয়াতে যে বছর ধইরাও লোন শোধ হয় না! সব বানানো কথা। দেখ গে কারে কারে দেয়, না নিজের জন্যে জমায়।”

“আইচ্ছা আতিয়ার লগে কথা কমু নে। অখন খলিল বাবা, তোমার কাছে যেটা পামু তা দিয়া যাও।”

“আম্মা, টাকা থাকলে আপনার এইভাবে চাওয়া লাগতো না। নিজেই দিতাম। আপনার মেয়েরে খাওয়াইতাছি, আর টাকা কয়টা কী!”

“তুমি না কইলা মাস ঘুরতে লাভ সহ টাকা আমার হাতে দিবা।”

“কইছিলাম তো। কিন্তু যে স্কিমে টাকা দিছি, তা পুরাই লস হইছে। কিছু পাই নাই।”

“এটা কী কও! আমি তোমারে নগদ দিলাম পঁচিশ হাজার, কানের সোনার দুল দিলাম। চার আনির দুলের দামও পঁচিশ আসে। আমারে তুমি বলছো লাভ সহ লাখ টাকা দিবা।”

“বলছিলাম তো। আর আপনেই পুরানো স্বর্ণ বিক্রি করতে গিয়া দেখি সব খাদ। পনেরো হাজারও পাই নাই। আপনের টাকার সাথে নিজে আরও ষাট হাজার দিছি স্কিমে। সব পানিত গেছে। সেটা কি চাইছি আপনের কাছে?”

“আমার কাছে ক্যান চাইবা? তোমার টাকা তুমি কেমনে লস করছো তুমি জানো। আমারে আমার পঞ্চাশ হাজার দিয়া দাও। এই টাকা আমার জান পানি করা টাকা। টাকা তোমারে ফেরত দিতেই হইবো।”

“না দিলে কী করবেন? মামলা করবেন? আপনের মেয়ের কাবিন একলাখ টাকা না? একবারে কাবিনের টাকা হাতে দিয়া মাইয়া দিয়া যামু বেশি উল্টাপাল্টা কথা কইলে।।শাশুড়ি বইল্লা সম্মান দিতাছি।”

আয়েশা ভয় পেয়ে যায়। খলিল যেমনই হোক, তাকে ভালো রেখেছে। শ্বশুর বাড়িতে টাকা পয়সা অপরিমিত না থাকলেও, টানাটানি নাই। মায়ের জন্য ঝামেলা করে নিজের সংসারে অশান্তি চায় না। আর এই টাকা যে খলিল ফেরত দিবে না তা আয়েশা আগেই জানতো।।টাকা খলিল ব্যবসায় লাগিয়েছে। আর খলিলের ব্যবসা ভালো হওয়া তো আয়েশারই লাভ। স্কিমের বাহানা না করলে এই টাকাগুলো বাবার বাড়ি থেকে নিতে পারতো না। বাবা বেঁচে নাই। বড়োবোন আতিয়ার সাথে সম্পর্ক ঠান্ডা। ভাই আজ বাদে কাল বিয়ে করলে আর চিনবে না। মা বাঁচবে কয়দিন। আর বাঁচলেও কী! মা তো আয়েশাকে চালাবে না। মাই চলে ছেলেমেয়ের আয়ে। আতিয়ার মতো লেখাপড়াও নেই যে চাকরি করে খাবে। তাই স্বামীর পক্ষ নেওয়াই সর্বোত্তম ভাবলো আয়েশা।

আলো বাসায় ভয়ে ভয়ে ঢুকে দেখে মা, বোন, দুলাভাই সব হইচই করছে। নিম্ন আয়ের বাসা। এখানে অভিজাত এলাকার মতে একজনের ঘরের তামাশায় আরেকজন খিল দেয় না।বরং এগিয়ে এসে মজা নেয়। এখানেও তাই উত্সাহী মানুষজন আসর জমিয়েছেন। কেউ দেলোয়ারা বেগমের পক্ষে তো কেউ আয়েশার পক্ষে। কেউ কেউ দু’জনকেই থামতে বলছেন।

আলো আতিয়া আর আশিককে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বলে।

আলোর ফোন দেখে আতিয়া ভয় পেয়ে যায়। ভেবেছে কেউ কিছু দেখে ফেললো কিনা। পরে আলোর কথা শুনে স্বস্তি পায়। এমন কিছু যে হবে ও আগেই জানতো। টাকা পয়সা নিয়ে খলিল সুবিধার না সে আগেই জানে। বিয়ের সময় থেকে ধাপে ধাপে ভালো টাকাই বের করেছে। তবু বোনটা ভালো আছে দেখে কিছু বলেনি। আয়েশা যদিও ওকে পছন্দ করে না। ভাবে আতিয়া সবসময় কড়া কড়া কথা। খলিলকে বিয়ে করতে চাওয়ার সময়ও আতিয়া বাঁধা দিয়েছিল। তখন দেলোয়ারা বেগমও ভেবেছেন আতিয়া আয়েশাকে হিংসে করে। খলিল দেলোয়ারা বেগমের আদরের জামাই। কিন্তু স্বার্থে আঘাত লাগলে সবাই রূপ পরিবর্তন করে। বিশেষ করে যেখানে সবাই স্বার্থপর।

“আতিয়া, কার ফোন? কোন সমস্যা?”

“মিসবাহ্, আমাকে আগে হোস্টেল নিয়ে যান।।কাপড় পাল্টাবো। এত সেজেগুজে বাড়ি যেতে পারবো না।।আমার বোন আর বোনের স্বামী এসেছে বাসায়। একটু পারিবারিক ঝামেলা। বাসায় যাওয়া দরকার।”

“আচ্ছা চলো। চিন্তা করো না। এখন তুমি আমার আমানত কিন্তু। কোন সমস্যা হলে জানাবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার বাসায় লোক পাঠাবো।”

আয়েশা আর দেলোয়ারা বেগমের ঝগড়া থামাতে আশিক বাসায় চলে এসেছে। এর মাঝে আতিয়াও এসে পৌঁছায়। শাড়ি পাল্টে নিয়েছে সোনিয়ার হোস্টেলে। মুখের সাজগোজও ধুয়ে ফেলেছে। এখন দেখে মনে হচ্ছে আতিয়া হাসপাতাল থেকেই এসেছে। সারাদিন খুশিমনে কাটানোর পর বাসায় ঢুকে এই অবস্থা দেখে মন তিতা হয়ে যায়।

“আম্মা থামো। আয়েশা তুইও থাম। খলিলরে নিয়ে বাসায় যা। টাকা দেওয়া লাগবে না যা।”

দেলোয়ারা বেগম তেড়ে উঠেন, “এই তুই লাগবো না বলিস ক্যান। আমার টাকা।”

“আমার টাকা আম্মা। আমার কষ্টের টাকা। আমার মৃত স্বামী শাহীনের দেওয়া কানের দুল। যেই দুল তুমি তোমার কাছে সাবধানে রাখবে বলে আজ থেকে তেরো বছর আগে নিয়ে গিয়েছিলে।”

আয়েশা খলিলের সাথে চলে গিয়েছে। আতিয়ার কথার পর ঝগড়া আর বেশিদূর আগায় না। দেলোয়ারা বেগম জিদ দেখিয়ে ভেবেছেন আতিয়ার টুকটাক আঙটি চেইন যা ওনার কাছে আছেন তা ভাব দেখিয়ে ফেরত দিবেন। বাকিগুলোতো ভেঙে এটা সেটা বানিয়ে ফেলেছেন। চুড়িগুলো আছে, তবে দুইভরির চুড়ি দিয়ে দেওয়ার মতো মন হয় না, যতই জিদ থাকুক। কিন্তু জিনিস বের করে দেখেন একটা আঙটি নেই। অল্প কিছু জিনিস, এর ভেতর একটা জিনিস না থাকলে তা চোখে পড়বেই। রাত দুপুরে আবার হইচই শুরু করেন দেলোয়ারা বেগম।

(চলবে)

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_১৬

“আলো, আঙটি তুই দেখছস?

“না ভাইয়া। আর তুমি আমারে এই কথা জিগাইলা ক্যান? আম্মার আঙটি আমি আলমারি খুইল্লা ক্যান নিমু? কোন অনুষ্ঠান হইলেও তো আম্মা আমারে স্বর্ণের কিছু পরতে দেয় না, হারিয়ে ফেলুম ভাইব্বা।”

“গত কয়েক মাসে টাকা হারাইতাছে অল্প বিস্তর। আজ স্বর্ণ হারালো। ঘটনা কী বুঝলাম না। তোকে জিগ্যেস করলাম কারণ বাসায় তো সকাল থেকে আমি, আতিয়া আপা কেউ ছিলাম না। তুই, আম্মা, আর আয়েশাই ছিলি।”

দেলোয়ারা বেগম বলেন, “আশিক তোর কি মনে হয় টাকা পয়সা ঘরের মানুষ সরাইতেছে?”

“আমার খটকা লাগে আম্মা। বাইরের কেউ কে আসছে বাসায় যে আলমারি খুইল্লা খালি আঙটি নিবো? কোন বুয়াও নাই। আর বাইরের চোর চুরি করলে একটা দুইটা জিনিস কেন নিব কও? নিলি সব নিব। এত ভদ্র চোর কই আছে যে চেইন, বড়ো কানের দুল এসব নেয় নাই, শুধু ছোটো আঙটি নিছে। এর দুই কারণ এতটুকু টাকাই দরকার। আর তার একসাথে বেশি কিছু নেওয়ার সাহস নাই।”

বলে আলোর দিকে তাকায় আশিক। আলো চেষ্টা করছে নিজেকে শান্ত রাখার। কিছুতেই স্বীকার করবে না। ভাইয়া যাই বলুক আলো নিরীহ চেহারাই করে রাখবে ভাবে। বেশি রাগ দেখালে বরখ উল্টো সন্দেহ করবে।

“আয়েশা আপা নেয় নাই তো? আপা তো বাসায় আসলেই গয়নার কৌটা খুইল্লা সব বাইর করে।আয়নার সামনে পরে।”

দেলোয়ারা বেগম ভ্রু কুঁচকায়। কথা মিথ্যা না। এই অল্প কয়টা গয়নার উপর আয়েশার ভালো টান বোঝে দেলোয়ারা। বাসায় আসলে বের করে এটা সেটা পরে। যাওয়ার আগে অনেক সময় জোর করে বলে দেলোয়ারা বেগম খোলায়। না হলে আয়েশা এমন ভাব করে যেন গয়না খোলার কথা মনেই নাই। আশিকও আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু আলোকে চোখে চোখে রাখতে হবে ভাবে। আতিয়া তো বরাবরের মতোই বিরক্ত। তবে আশিকের কথায় বোনকে নিয়ে একটু সন্দেহ হয়। তার তিন হাজার টাকাও বাসা থেকেই হারিয়েছে নিশ্চিত আতিয়া। আলোর দিকে আসলেই কারও নজর রাখা হয় না। নিজের মতো বড়ো হচ্ছে। মাথার উপর বাবার আদর, শাসন নেই। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের অনেক রকম আব্দার থাকে, আহ্লাদ থাকে। আলোর সেগুলো জানানোর জায়গা নেই। বলার জায়গা নেই। বাবার যে স্নেহ, ভালোবাসা আতিয়া পেয়েছে তার মতো না হলেও কিছুটা আশিক আর আয়েশাও পেয়েছে। কিন্তু আলো কিছুই পেতে পারেনি। বাবা যখন মারা যায় আলোর বয়স তখন সবে দশ বছর। আতিয়া আড়ালে আশিকের সাথে কথা বলে ঠিক করো বোনটার সাথে একটু কথা বলা দরকার। দু’জনেরই মনে হচ্ছে হাত টানের অভ্যাসটা আলোরই হয়েছে। কিশোরী সুলভ এটা সেটা কেনার জন্য হতে পারে। কিন্তু বাসায় আলোর দামি কিছু আতিয়ার নজরে পরে না। আলো কোচিং এ থাকলে জিনিসপত্র ঘেটে দেখতে হবে কী কী আছে। তাদের মা দেলোয়ারা বেগম নিজেই অসচেতন। আলো কোন একটা বিপদ ঘটিয়ে ফেলার আগেই দেখতে হবে বিষয়টা। রাতে ঘুমানোর আগে দেলোয়ারা বেগমের কাছে আসে আতিয়া।

“আম্মা, আলমারির চাবি নিজের সাথেই রাখবা। স্বর্ণের যে দাম বাড়ছে, এই কয়টা জিনিস গেলেও লাখ টাকার ব্যাপার।”

আতিয়ার কথায় দেলোয়ারা বেগম মাথা নেড়ে সায় দেন। বলেন, “তোর কি মনে হয় আয়েশা নিছে?”

“না আম্মা। আয়েশা বড়ো চাহিদা রাখার মেয়ে। যা চায় বড়ো চায়। যেমন টাকার কথা আমি জানতাম যে খলিল কোনদিন ফেরত দিব না। আর আয়েশাও জানতো তার স্বামী একটা বাহানা দিয়া টাকা বাহির করতেছে। তাও সে আটকায় নাই, কারণ এখানে সে নিজের লাভ দেখছে। তবে চুরির অভ্যাস নাই। আর ও নিলে মোটা চেইন নিতো, টলটলে আঙটি না।”

“তোর কার কথা মনে হয়?”

“কারও উপর দোষ দিতেছি না আম্মা। তবে সত্যি বলতে আমরা কেউ আলোর দিকে নজর দেই না। আলো আসলে কতটুকু কী লেখাপড়া করতেছে সেই জানে। এই বয়সী একটা মেয়ে নিজের মতো বড়ো হইতেছে। ওর সাথে কোচিং এ মাঝেমধ্যে যাইয়ো। আসলে কী প্রাইভেট পড়ে না স্যারের কথা বলে মাসে মাসে দেড় হাজার টাকা অন্য কিছু করে। আর প্রতিদিনই দেরিতে আসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, বলে ছুটির পর স্যার ক্লাসেই বাড়তি পড়ায়, সামনে বোর্ডের পরীক্ষা তাই। এইটা আমার বিশ্বাস হয় না। টাকা ছাড়া ফ্রি কোথাও কেউ পড়ায় না এখন আর।”

“হইতে পারে। আমার কাছে টাকা চাইয়া হয়রান হলো গত কয়েকদিন। কী জানি বিদায় অনুষ্ঠান আছে। এক হাজার চাইছিল।”

“বিদায় অনুষ্ঠান কয়বার হয়! তুমি ওর সাথে যাবা কাল কী অনুষ্ঠান নিজে দেইখা আসবা।”

আলো আড়াল থেকে সবই শোনে। রাগে ওর হাত পা চিড়বিড় করতে থাকে। একটা আব্দার পূরণ করার বেলায় কেউ নাই, আর শাসনের বেলায় সব টনটনে। দুটো টাকা দিতে না দিতে ভাই ওকে নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা করছে। আশিকের উপর রাগ হয়। আশিকই আতিয়া আর মায়ের মাথায় এগুলো ঢুকিয়েছে। কাল রাতুলের সাথে রিসোর্টে আলো যাবেই। বুদ্ধি করে আজকের শপিং এর জিনিসগুলো রাতুলের কাছে রেখেছিল। এগুলো ওর কাছে দেখলে খবরই ছিল।

মিসবাহ আজ বিকেলেই দোকান থেকে বের হয়েছে জানতে পেরেছন জাহানারা। এমনিতে ছেলে কখন কই যায় এত কিছু খোঁজ রাখার মানুষ তিনি নন। আর মিসবাহ তো বাচ্চা ছেলে না। কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনার জন্যই ছেলের ব্যাপারে খোঁজ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। বাষট্টি বছর বয়সে এসে চল্লিশ বছর বয়সী ছেলের গতিবিধি লক্ষ রাখতে হবে এটা জাহানারা বেগম কখনো ভাবেননি। তরুণ ছেলে হাসানকে নিয়েও তার এত চিন্তা হচ্ছে না, যতটা মিসবাহর জন্য হচ্ছে। যে বয়সটা আবেগে ভেসে যাওয়ার ছিল, সেই বয়সটা মিসবাহ শতভাগ মা বাবা ভাইবোনের পেছনে দিয়েছে। একুশ বাইশ বছর থেকে বাবার সাথে ব্যবসার কাজ শিখেছে। একসময় বাবার মৃত্যুর পর পুরো ব্যবসা সেই সামলেছে। সময়ের প্রয়োজনে বিয়ে করিয়েছেন ছেলেকে। সেই বিয়ে, বৌ নিয়েও ছেলের অতিরিক্ত কোন আহ্লাদ ছিল না। বরং এই নিয়ে ওনার গর্ব ছিল যে ছেলে স্ত্রৈণ নয়। মিসবাহর প্রথম স্ত্রী পায়েরার চলে যাওয়ার জন্য অনেকে আড়ালে আবডালে স্ত্রী সংসার নিয়ে মিসবাহর উদাসীন, অমনোযোগী থাকা, জাহানারার অতিরিক্ত নাক গলানোকে দায়ী করলেও জাহানারা বরং পুলক অনুভব করতেন যে বড়ো ছেলে মা ছাড়া কিছু বোঝে না। সময়ের সাথে শরীরের শক্তি হারিয়েছেন, আর বাকি সন্তানদের উপর নিয়ন্ত্রণও।মেঝো ছেলের বৌ রত্নাকে পায়েরার মতো শাসনে রাখতে পারেন না। হামিদ, হাসান দুই ভাইও মিসবাহর মতো একান্ত অনুগত নয়। যে ছেলে শুধুই মায়ের বলে যে চাপা একটা অহংকার বিরাজ করতো মনে, আজ তার সেই গর্বের জায়গায় কার যেন আঁচড় পড়ছে। মনে মনে নিজেকে গালি দেন। কেন আগেই উদ্যোগী হয়ে মিসবাহকে বিয়ে করালেন না আবার। দীর্ঘদিন একা থাকাই কাল হয়েছে মিসবাহর। তাজা হরিণের নরম মাংসের স্বাদ পাওয়া সিংহ হয়তো হরিণ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু একটা খেয়ে ক্ষুধা মেটায়। কিন্তু জলজ্যান্ত হরিণ সামনে আসলে তখন তার মোহ কাটানো অসম্ভব হয়ে যায়। সেই মোহের পেছনে ছুটে শিকারের জালে পা দেয়। তেমনই মোহের পেছনে ছুটছে মিসবাহ। জাহানারা মনে মনে বিরক্ত হন। যেই বয়সে মানুষ এসব প্রেম ভালোবাসা করে সেই বয়স মিসবাহ কবেই ফেলে এসেছে। চল্লিশ বছর বয়সে এসে এগুলো যে প্রেম টেম না ভালোই বুঝেন। দীর্ঘদিন একা থাকার ফলে শারীরিক চাহিদার আকর্ষণ এড়াতে পারছে না মিসবাহ। আর এই শরীর একজনেরটা পেলেই হলো। তাই ধরে বেঁধে আয়নার সাথে বিয়েটা দিয়ে দিতে চান। বৌয়ের আদর সোহাগে একরাত কাটালে এসব ডাইনির কথা মাথা থেকে এমনিই চলে যাবে। আয়নার ছেলে আছে, আগের ঘর ভেঙেছে। এই মেয়েকে নিজের নিয়ন্ত্রণেও রাখতে সহজ হবে। এমনই দুর্বল অবস্থায় আছে।

মিসবাহ ঘরে ঢুকে দেখে মা বসার ঘরে বসে তসবি পড়ছেন। মুখটা থমথমে। মিসবাহ পাশে গিয়ে বসে “আম্মা, এখানে বসে আছেন যে?”

“তোর অপেক্ষা করি। তোরে তো পাওয়াই যায় না।”

“আমি তো প্রতিদিনই বাসাতে ফিরি। পাওয়া যায় না মানে কী!”

“এখনো ফিরস ঠিক। কিন্তু কোনদিন আমরা সবাই তোর মন থেইক্কা বাহির হইয়া যামু কে জানে। তখন বাইরে সংসার পাতবি।”

“আম্মা এই বাড়ি এত কষ্ট করে গড়ে তুলছি। সংসার করলে এখানেই করবো, নিজের বাড়িতে। বাইরে সংসার পাতবো কেন?”

“বাহ! এতদিন কইতি এই বাড়ি আম্মা আপনের। আইজ কস বাড়ি তোর। কোনদিন কইবি সবাই বাহির হন আমার বাড়ি থেইক্কা। এসব পড়াইতেছে কেউ তাই না। নিজের মাইয়ার উপরও কোন টান নাই আর তোর। পলিন পরীক্ষায় খারাপ করসে জানোস।”

“সাত বছরের মেয়ে আম্মা। পড়া ধরালেই পড়তে পারবে। রত্না ওর ছেলেটাকে পড়ানোর সময় একটু পড়ালে মেয়েটা বুঝতো। স্যারের কাছে তো পড়তেই চায় না। আর আম্মা, কী কথার কী মানে করেন! আমি বলতে চাইছি সংসার করলে আপনাদের সাথে মিলেমিশেই করবো। এই বাড়ি অবশ্যই আপনের। আমার ভাইদেরও। আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের মুখে উল্টাপাল্টা কথা লইয়া ঘরে অশান্তি আইনেন না।”

“পলিনের দেখাশোনা করার জন্য মা দরকার। নটি বেটি না। মা হওয়ার মতো মাইয়া দরকার। মিসবাহ তুই সত্যই শান্তি চাস?”

“চাই।”

“তাইলে এই শুক্রবারই আয়নার লগে তোর বিয়া দিমু। তুই না করতে পারবি না।”

মিসবাহ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। “আম্মা এই শুক্রবার আপনাকে নিয়ে আতিয়ার বাসায় যাব। সামনাসামনি দেখেন। ভালো লাগবে আপনার। নটি বেটি না, পলিনের মা হওয়ার মতোই ভালো মেয়ে। সারাজীবন আপনার কথা শুনেছি। এইবার আমার কথা শুনে দেখেন।”

(চলবে)