#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪০
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
সুজানা শাড়ি পাল্টে কামিজ গায়ে মুখহাত ধুঁয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই খাটের উপর মাকে পা ভাঁজ করে বসা দেখতে পেল। শপিং ব্যাগটা খুলে শাড়িটা মেলেছে তারপর চুড়ির বাক্সটা খুলছে। সুজানা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে মায়ের পেছনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মা বুঝতে পারলেন মেয়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রশ্ন ছুঁড়লেন
শাড়িটার বেশ দাম হবে। ছেলেটা টাকা পয়সা কামাই?
সুজানা তোয়ালেটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে জানতে চাইলো
কোন ছেলেটা আম্মা?
যে শাড়িটা দিল।
সুজানা জবাব দিল না।
সাজিয়া বেগম চুড়ির বাক্স খুলে চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন। বললেন
পছন্দ ভালো। টাকা পয়সা কামাই ও?
মাথা ধরেছে আম্মা। আগে চা খাই?
শাড়ি আর চুড়ি গুলো নিয়ে বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে সাজিয়া বেগম বললেন
বানিয়ে রেখেছি। খেয়ে যাহ।
সুজানা চটজলদি প্রশ্ন করলো।
এসব নিয়ে কোথায় যাচ্ছ আম্মা?
এগুলো যার কাছ থেকে এনেছিস তাকে ফেরত দেব। আর বলব এইসব জিনিস দেয়ার মানুষ তোর আছে। শুধু শুধু তোর পেছনে টাকা খরচা না করে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া ভালো।
কার কথা বলছ?
মশকরা করছিস? আমি জানি না এসব কে দিয়েছে তোকে? মিথ্যে বলে তুই করিমের সাথে দেখা করতে গিয়েছিস?
প্রশ্ন খুব রুঢ় গলায় বললেও সুজানা হাসি পেল। সে বহুকষ্টে হাসি চেপে ভেজা তোয়ালেটা জানালায় মেলে দিতে দিতে বলল
তোমাকে এভাবে কেউ দিলে ফেরত দিতে?
উদ্দেশ্য এইরকম থাকলে নিশ্চয়ই দিতাম।
সুজানা ফিরে বলল
ওর উদ্দেশ্য তুমি বুঝতে পেরে গেছ?
কেন তুই বুঝিসনি? শোন সুজানা এতদিন কেন পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করবি বলছিলি আমি এবার বুঝে গিয়েছি। আমি তোকে অত সময় দিচ্ছি না। করিমকে কাল আসতে বলবি।
সুজানা মাথা নাড়ালো। সাজিয়া বেগম যেতে যেতে বললেন
এখনো এটুকুনি ছেলে! রুইমাছ কিনে দিচ্ছে, শাড়ি কিনে দিচ্ছে। শয়তানি সব। আসুক একবার এখানে।
সুজানা দরজা বন্ধ করে হেসে নিল। অভিক ফারদিনের কপালে দুঃখ আছে।
সাজিয়া বেগম রাগ করে করিমের নাম্বারটাও ব্লক করে দিয়েছে। কি সুন্দর সুন্দর কথা বলে গলানো হচ্ছিল উনাকে। অসভ্য ছেলে।
______________
রাতের খাবারটা মাত্রই খেয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে সুজানা। অভিকের দেওয়া বইটা শেষের দিকে। আজকে অন্যকিছুতে তার মন বসছে না। সবকিছু হালকা হালকা লাগছে। এই মুহূর্তে অভিক ফারদিন ছাড়া অন্য সবকিছু ঝাপসা। এত এত চিন্তায় তার মাথা ঝিমঝিম করছে। কি করে আসন্ন পরিস্থিতিকে সে সামাল দেবে?
সুজানা ফোনটা কয়েকবার চেক করলো। একটা ছোট্ট মেসেজ এসেছিল সে বাসায় পৌঁছানোর পর।
পৌঁছেছেন?
সুজানার হাতটাও যেন কাঁপছিল তখন ” জ্বি” বলার সময়। কত পরিচিতের মতো তারা আজ কথা বলেছে। গোঁটা তিন মাসের জমিয়ে রাখা অভিমান গুলো এক দেখায় আলতো হয়ে গেল। সুজানা একফোঁটা সুযোগও পায়নি বলার ” গত তিনমাস আপনি আমার খোঁজ নেননি “।
তার এত এত সাজিয়ে রাখা কথাগুলো যেন তখন কোথায় হারিয়ে গেল । নিজেকে এত পাগল পাগল এর আগে কখনো মনে হয়নি।
খেয়াল করলো তার ফোনটা বাজছে। ফোনের স্ক্রীনে ” এ ” লেটার স্পষ্ট। সে চোখ বন্ধ করলো। রোজ শোনা ফোনের টিউনটা অন্য দিনের চাইতে আজ বেশি ভালো লাগছে শুনতে। চোখ মেলতে যাবে তার আগেই টিউন অফ হয়ে গেল। চোখ মেলে দেখলো মা ফোনটা কানে ধরে রেখেছে। আর ঠোঁট নেড়ে বলল
ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি সুজানার আম্মা বলছি।
করিমের গলা না শুনে কোনো এক মহিলার গলা শুনতে পেলেন সাজিয়া বেগম।
আমি সুজানার আম্মাকেই খুঁজছি।
গলা শুনে সুজানা চমকে গেল। এটা কি রাগী আন্টি?
সাজিয়া বেগম মেয়ের দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন
আপনি কে বলছেন? এটা তো করিমের নাম্বার।
ওপাশে খানিকটা নীরবতা। তারপর আওয়াজ এল।
আমি নবকুঠির থেকে বলছি। অভিক ফারদিনের মা। আমাকে চিনতে পেরেছেন?
সাজিয়া বেগম দ্রুত সুজানার দিকে তাকালেন। সুজানা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকালো মায়ের দিকে। তার বুকটা অসম্ভব রকম কাঁপছে।
সাজিয়া বেগম বললেন,
মাস্টারের মায়ের সুজানাকে কি দরকার হতে পারে?
বাচ্চার বাবার একটা মেয়ের শখ ছিল যে বাইরে বেরোনোর আগে চশমাটা খুঁজে দেবে।
আর আমার মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দেয়ার মতো একটা মানুষ। আমার পর ছেলেটাকে দেখে রাখার মতো বিশ্বস্ত কাউকে। অনেক দেরী হয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম সুজানাই তিনজনের শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারে আর ভরসার জায়গা হতে পারে।
সাজিয়া বেগম খেয়াল করলেন সুজানা মাথা নামিয়ে মেঝেতে চোখ ফেলে রেখেছে। তার চোখে টলমল করছে জলের ধারা।
মায়ের চোখের দিকে না তাকিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিল সে। সাজিয়া বেগম এবার মুখ খুললেন।
ও বিয়ে করতেই চায় না। অনেক কষ্টে আমি রাজী করিয়েছি ফাইনাল পরীক্ষার পর ওর বিয়ে নামাবো। আপনি ওর কাছ থেকে যা আশা করছেন তা পাবেন না।
আমি ওকে আমার মতো করে শিখিয়ে পড়িয়ে নেব। বকুনিঝকুনি দেয়ার পর পাঁপড় ভেজে খাওয়াবো। আজ আড়ি দিলে কাল আবার ভাব করে নেব। দিনশেষে ও আমাদের সাথে ভালো থাকবে। আপনি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে প্রশ্ন করে দেখুন ও এখন আর বিয়ে বিমুখী নেই।
ফোনটা ওকে দিন। ওর সাথে জাস্ট দুটো কথা বলব। যদি ও চায় এই ফোন আসা যাওয়া অটুট থাকবে। যদি না চায় কখনোই আর ফোন যাবে না।
সাজিয়া বেগম ধীরপায়ে হেঁটে রান্নাঘরে গেল। রান্নাঘরে মায়ের প্রবেশ দেখে সুজানা ওড়নার কোণায় মুখ মুছতে থাকলো।
কথা বলতে চায়।
সুজানা ফোনের দিকে তাকালো।
নে।
ফোনটা নিল সে। মায়ের ইশারায় কানেও দিল। তার নাক টানার শব্দ ওপাশে স্পষ্ট হতেই সালমা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন
আমাকে শুনতে পাচ্ছ মেয়ে?
সুজানা চোখের কোণা মুছতে মুছতে ছোট্ট করে জবাব দিল
জ্বি।
আমার অপরিপূর্ণ সংসার পরিপূর্ণ করার জন্য একটা অপরিপক্ক সুজানার দরকার। তাকে পরিপক্ব করার দায়িত্ব এই সংসারের। শোনো মেয়ে আমার পরে আমার হাবাগোবা ছেলেটার দায়িত্ব কিন্তু তোমাকে নিতে হবে।
তোমার মাকে বুঝাও তুমি ছাড়া এই বাড়ি অসম্পূর্ণ। এই বাড়ি ছাড়া তুমি অন্যকোথাও অসম্পূর্ণ। কাল এসে তোমাকে দেখে যাব। অভির দেয়া শাড়িটা পড়ো। ঘোমটার আঁচলটা একটু লম্বা রেখো। অনামিকা আঙুলটা তোমার মাস্টারমশাইয়ের জন্য খালি রেখো। আমি লুকিয়ে একটা কালো টিপ নিয়ে যাব যাতে আর কারো নজর না পড়ে। আমাদের জন্য দুটো টোস্টবিস্কিট আর একটু গরম চায়ের ব্যবস্থা থাকলেই হবে।
চলবে
#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪১
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
দিনটা শুক্রবার।
সকালের ব্রেকফাস্টে সালমা বেগম সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আজ মেয়ে দেখতে যাবেন।
যদিও গত মাঝরাত্রির অব্দি এ নিয়ে তারা বড়রা সবাই আলাপ আলোচনা করেছে। জিনিয়া, জিনিয়ার ভাইয়ের বউ তানিয়া আর আনিকা ছিল না তাই খাওয়ার টেবিলে ঘটা করে বলার কারণ।
কোন মেয়ে, কে সে, কোথায় তার বাড়ি এত্তগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন সালমা বেগম। অভি চুপচাপ খাচ্ছে। আজ তার অনেক কাজ।
জিনিয়া বলল
মামী বউয়ের ছবি দেখাও। আমিও যাব প্লিজ।
আনিকা বলল
মেয়েটার নাম তো বলো ছোট মা। অভি তুই বল। সত্যি মেয়ে দেখতে যাব আমরা?
হ্যা।
মমতাজ বেগম বললেন
ছোট বৌমা সবাইকে মেয়েটার ছবি দেখিয়ে দাও। তাহলে তো হয়ে গেল। তারপর সবাই গিয়ে দেখে এসো। শুভকাজে দেরী করতে নেই।
আনিকা বলল,
দাদু তুমি সবকিছু জানো?
বৃদ্ধা সালমা বেগমের দিকে তাকালেন। বললেন
জানি। তবে আরেকটু আগে হলে বিষয়টা মন্দ হতো না।
আনিকা খেতে খেতে বলল
অভি ছবি দেখা। সিজান তোর কাছে আছে?
না আপু।
সালমা বেগম বললেন
ওর ফোন তো ঘরে। আচ্ছা আমি নিয়ে আসছি।
সালমা বেগম চলে গেলেন। আনিকা বলল
নাম কি রে অভি? কি করে? পড়াশোনা? নাকি চাকরি? কোথায় দেখেছিস? তোর সাথে পরিচিত নাকি? ধুরর সবাই সবকিছু জানে আর আমি কিছুই জানিনা।
মমতাজ বেগম রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন
আহা আমার নাতবৌটার তর সইছেনা। তুমি এখন ছবি দেখে খুশি হয়ে যাবে বোন।
কেন খুশি হবো? মেয়েটাকে আমি চিনি?
আহনাফকে হাসতে দেখে আনিকা চোখ রাঙিয়ে বলল
তুমি হাসছ কেন? তুমিও সবকিছু জানো?
হুমম।
ওমা সবাই সবকিছু জানে। শুধু আমাকে কেউ কিছু বলেনি। আমি খাবোই না। এখন আমাকে কেউ কিছু বলে না দেখছি।
ও চেয়ার ছেড়ে উঠে যাবে তখনি অভি টেনে বসিয়ে দিল। বলল,
খেয়ে তারপর উঠো।
আহনাফ হেসে উঠে বলল,
তুমি কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলে তাই ডাকেনি কেউ। কাল রাতে সব আলাপসালাপ শেষ।
জিনিয়া চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল,
ধুরর মামী গেল যে গেল আর এল না। আমি গিয়ে নিয়ে আসি।
সে চেয়ার ছেড়ে উঠে কিছুদূর যেতেই সালমা বেগমকে দেখলো। ছবিটা চট করে নিয়ে চলে এল। তারপর ভালো করে ছবির মেয়েটাকে দেখে অভিকের দিকে তাকালো। অভিক ডিম পাউরুটির নাশতায় চামচ কেটে মুখে তুলতে তুলতে চোখ তুলে তাকালো। জিনিয়া আঙুল দ্বারা ওয়াও দেখিয়ে বলল
মামাহ জিতছো।
পিঠের উপর ঠাসস ঠাসস বসে গেল মায়ের চড়।
ও তোর মামা? বেয়াদব মেয়ে।
সবাই হেসে উঠলো টেবিল কাঁপিয়ে। আনিকা ততক্ষণে ফোনটা কেড়ে নিয়েছে। ছবিটা ভালো করে দেখে বামে ডানে আঙুল স্লাইড করে বলল
এগুলো তো সুজানার ছবি। ওই মেয়েটার ছবি কোনটা?
অভি দেখ তো।
অভি খেতেই থাকলো। চিবোতে চিবোতে আনিকার দিকে তাকালো। আনিকা সবার মুখদর্শন করলো। জিনিয়া আনিকার হাতে ফোন দেখে বলল
আরেহ এটাই তো বউ। মামী এটাই দিয়েছে।
আনিকা আবার তাকালো ছবিটার দিকে। তারপর অভিকের দিকে তাকালো। মিনমিন করে উচ্চারণ করলো
সু—জা—না?
সবার ঠোঁটে ফিচেল হাসি। অভিক খাওয়া শেষ করে ঢেকুর তুলতে তুলতে চলে গেল তার ঘরে।
আনিকার চেয়ারের পেছনে আনজুমা বেগম এসে দাঁড়ালেন। বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
হাতের ফোনে সুজানার ছবিটাতে আঙুল বুলিয়ে বললেন,
হ্যা সুজানা। ও কি করে, কোথায় থাকে, অভির সাথে কোথায় দেখা সব নিশ্চয়ই এবার জেনে গিয়েছ? এবার আর কোনো প্রশ্ন করো না। আজ সন্ধ্যায় তুমিও যাচ্ছ। সুজানা তো আমাদের দেখতে আসে। আজ আমরা তাকে দেখতে যাই।
আনিকা চোখ তুলে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালেন।
সুজানার সাথে তো….
এসব আর বলো না। সুজানা তো ওই বিয়েতে রাজী হচ্ছিল না।
কি করে এই বিয়েতে রাজী হবে তাহলে? অভির সাথে? অভি ওকে পছন্দ করে? হ্যা রে অভি। এমা ও চলে গেল। আচ্ছা অভি সুজানাকে বিয়ে করবে বলেছে?
আনজুমা বেগম হেসে বললেন,
তোমার ছোট মায়ের তাড়া দেখে বুঝতে পারছ না?
দাদু ফোঁড়ন কেটে বললেন,
নাতবৌ পুরোনো স্মৃতিগুলো একটু মনে করে দেখো। যেখানে এই বাড়িতে একই দৃশ্যপটে তারা দুজন ছিল। বুঝতে পারবে সবটা। তাদের মুখচাপা ছিল, চোখ নয়। আমি আমার ঝাপসা চোখে দেখতে পেয়েছি তোমরা তোমাদের ভালো চোখে না দেখতে পেয়ে অনেক কিছু মিস করে গেলে।
আনিকা ভাবনায় পড়ে গেল। মুখভার দেখে আনজুমা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
তোমাকে এভাবে দেখলে অভির কি মনে হবে? ভাববে তুমি খুশি নও । আমারও এরকম কিছু আগেই মনে এসেছিল। সুজানা থাকতে কেন আমরা অভির জন্য অন্য মেয়ে দেখব? কিন্তু ওদের ছাত্রী শিক্ষকের সুন্দর সম্পর্ক দেখে এরকম কিছু মুখ ফুটে বলাটা দোষের মনে হয়েছিল। এখন সুজানা কিন্তু তোমার জা হবে। তুমিই মনে হয় একদিন আফসোস করে বলেছিলে সুজানা যদি আর ক’টা দিন থাকতো তুমি ওর কাছ থেকে কেক বানানোটা শিখতে । এখন তুমি পুরো সুজানাটাকেই শিখে নিতে পারবে। বন্ধু হয়ে তাকে গ্রহণ করে নেবে । আমাদের পর এই বাড়ির কর্তী তোমরা দু’জন। তোমাদেরকে তোমাদের পরের প্রজন্মরা অনুসরণ করবে।
ভালো থাকার আগে ভালো রাখার চিন্তা করতে হয় বৌমা। জীবনটা সেখানেই সুন্দর যেখানে ভোগ নয় উপভোগটাই মূখ্য বিষয়। তোমার একার ভোগে কোনো আনন্দ নেই, যত আনন্দ সব সবাইকে নিয়ে উপভোগে। কথাটা মনে থাকবে তো?
আনিকা মাথা দুলালো। বলল,
হ্যা।
তার মনে পড়ে গেল ঠান্ডা কফির পেয়ালা সামনে ওদের দুজনের অর্ধরাত্রি জেগে গল্প করার স্বাক্ষী সে ছিল।
অথচ সে বুঝে উঠতে পারেনি। সে বুঝতে পারেনি সুজানার সেই কথার মানে যেদিন সে বলেছিল ” আপনাদের সম্পর্কগুলো ভীষণ সুন্দর! ”
এই সুন্দর সম্পর্কগুলোর একটা ভাগ নিয়ে সুজানা তবে আসুক।
_________________
সুজানার ছোট খালাম্মা এসেছে বেলা এগারোটার দিকে। সাইফের মা রাশেদা বেগম আর সাজিয়া বেগম হাতে হাত লাগিয়ে নাশতা পানির আর রাতের খাবারের আয়োজন শুরু করেছে সকাল থেকে। যদিও উনারা বারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু ওভাবে ছাড়া যায় না। ভালো দেখায় না। সুজানা গত বুধবারেই নিজের মাইনেটা পেয়েছিল। তাই ঘরের বাজার-সাজার ছিল। ফ্রিজে মাছ মাংস ছিল। আর কিছু কিনে আনা হয়েছে।
সুজানা সারাটাদিন খেয়াল করলো মায়ের মুখ প্রচন্ড রকম ভার। সারাদিন তার সাথে একটা কথাও বলেনি। একবার কাজ করে দিতে ডাকেওনি। নিজ থেকে সব করে যাচ্ছে রাশেদা বেগম আর ছোট বোন নাজিয়া বেগমকে নিয়ে।
সুজানার ছোট খালাম্মা বোনের কাছ থেকে ওই বাড়ি সম্পর্কে একে একে সব জানতে চাওয়ার সময় সুজানা আড়াল থেকে মায়ের মুখে শুনলো তিনি আনিকার মামীকে নিয়ে চিন্তিত। মানুষটা সুজানাকে সত্যি পছন্দ করেছেন ছেলের জন্য। তিনি এখন কি বলবেন? যদিও সকালে সালমা বেগম ফোন করে উনাকে আশ্বস্ত করেছেন যে ব্যাপারটা উনারা দেখবেন। তারপরও খচখচানিটা যেন যাচ্ছে না। কি হতে যাচ্ছে উনি জানেন না। হঠাৎ করে সবটা কেমন পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু মাস্টারমশাইকে দেখার আগ্রহটা ক্রমশ বাড়ছে। সেদিন তাহলে অত রহস্য করে হাসার এই কারণ? ফোনের করিমের সাথে সেই মাস্টারের একটা আকাশ সমান তফাত!
_____________
মাগরিবের আজানের পর পরই ঘরদোর গুছিয়ে ঝাড়ু দেয়া হয়েছে। সাইফ আর সায়েম তার ছোট খালাম্মার ছেলে নাফিজ সহ দোতলা থেকে সোফা টানাটানি করে হয়রান হয়ে পড়েছে। রোজা আর তার খালাতো বোনটা নতুন বেডশীট, বালিশের কভার আর ঘরের পুরোনো পর্দা সরিয়ে নতুন পর্দা পড়িয়েছে। মেহুল আর শান্তাকে সাজিয়া বেগম ফোন করে আসতে বলেছেন। সরিষাবাড়ি থেকে তাদের দুজনের বাড়ির পথ হেঁটে গেলে দশ বারো মিনিটের। দুজনেই একসাথে এসেছে সাজিয়া বেগমের কথায়। সুজানা সেসবের কিছুই জানেনা। এক আকাশ ভয়, সংকোচ, জড়তা নিয়ে ঘরের একটা কোণা দখল করে বিষণ্ণ মনে বসে থাকার পরেই যখন বান্ধবীদের গলার আওয়াজ শুনতে পেল এক নিমেষেই মনটা ভালো হয়ে গেল তার। রুম থেকে বের হতেই দেখলো পুরো বাসার রঙ পাল্টে গেছে। যেদিকে চোখ যায় রঙিন আর রঙিন।
শান্তা আর মেহুলকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে ছিল সে অনেকক্ষণ। তার বুক যে কাঁপছে বন্ধুরা কি টের পায়?
সুজানার এমন অবস্থা দেখে তারা দুজনেই হাসলো। মেহুল তার গালের দু’পাশে হাত রেখে বলল
আমাকে ওইদিন কিন্তু খুব বকেছিলি! ভাগ্যিস তোকে নীল শাড়িটার মালিকানা দিয়েছিলাম। কোথায় পেতি নাহয় মাস্টারমশাইকে?
সুজানা আবারও ঝাপটে ধরে বলল,
আমার ভয় ভয় করছে রে।
শান্তা পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
ধুরর মহিলা। সামনে যাবি আর এক হাত নিজের কোমরে রাখবি আরেক হাতে তাহার কাঁধ চাপড়ে বলবি মিস্টার জামাই দেহি পকেটে হাত রাখো আর টাকা বাইর করো মুইর বান্ধবীগোর লাগি।
যাহ দুষ্টু।
হেসে উঠলো সবাই মিলে। ছোট্টখাটো ফুলটব নিয়ে ড্রয়িং রুমে সাইফ প্রবেশ করে বলল
তোমরা এসে পড়েছ?
মেহুল হেসে মাথা দুলালো। শান্তা বলল,
ওরে একটু ভালো করে দেখো সাইফ ভাই। এখানে আসছে তাই ইচ্ছামতো পাউডার মাখছে। আল্লায় সুন্দর বানায়ছে তারপরেও ঘষামাজার শেষ নাই তার।
মেহুল পিঠে চড় মেরে বলল,
তুই মাখিসনি না? শুধু আমার কথা বলিস। অসভ্য।
সবাই আরেকদফা হাসলো।
সাইফ সুজানাকে বলল,
কি রে বুদ্দু? তোর কাঁদাকাটি শেষ হয়েছে? বলেছিলাম না তোকে আগে বিয়ে দেব।
আমি এখন বিয়ে করে ফেলছি?
আরেহ আজ দেখতে আসছে কাল বিয়ে।
সুজানা “যাহ” বলে ওদের নিয়ে চলে গেল। মেহুল রান্নাঘরে তার হবু শ্বাশুড়ির সাথে গল্প গুঁজবে মত্ত হয়ে গেল। আর শান্তাকে ডেকে সাজিয়া বেগম সেই শাড়ি চুড়ির প্যাকেটটা ধরিয়ে দিল।
________
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটাই পড়তে পড়তে রাস্তায় গাড়ির হর্নের আওয়াজ শোনা গেল। পাশের বিল্ডিং থেকে সুজানাদের প্রতিবেশীরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে সুজানার হবু বরকে দেখা যায় কিনা। সাইফ, সায়েম আর নাফিজ তাদের এগিয়ে নিয়ে আসতে গেল। তারা নানান পদের মিষ্টান্ন ও ফলমূল নিয়ে এসেছে সাথে পান সুপারি।
সবাইকে তিন তলায় নিয়ে আসলো সবাই মিলে। ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই নাজিয়া বেগম আর রাশেদা বেগম তাদের পরিচয় দিয়ে কলাকুশলী বিনিময় করলেন। সালমা বেগম ঘরের একোণা ওকোণায় চোখ বুলিয়ে জানতে চাইলেন
তারা মা মেয়ে কোথায়?
নাজিয়া বেগম বললেন,
আসছে। আপনাদের ছেলে আসেনি?
এসেছে। ও ওর বাবা ভাইয়ের সাথে নীচে। আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমরা আজকে শুধু দেখতে এসেছি।
তাড়া কিসের? মাত্রই তো এলেন। বসুন।
সাইফের সাথে হেসে খেলে কথা বলে দরজার বাইরে রাখা পাপসে জুতো মুছতে মুছতে ঘরের ভেতর চোখ রাখলো অভিক। সাইফ বলল
সমস্যা নেই। জুতো নিয়ে ঢুকা যাবে। সায়েম আন্টিকে ডেকে আন। আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। আমি বাকিদের নিয়ে আসছি।
অভিক জুতো মুছতে মুছতে বলল,
নো প্রবলেম।
সালমা বেগমরা সবাই ভেতরের ঘরে চলে গেল।সাইফ ডেকেছে শুনে সাজিয়া বেগম দ্রুত চলে এলেন ড্রয়িংরুমে। এসেই সাইফের বদলে সেদিনকার সৌম্যদর্শন মাস্টার ছেলেটাকে পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় দেখলেন। পাপসে জুতোর বালি মুছতে ব্যস্ত সে মাথা নীচু করে।
সাজিয়া বেগমের হাতে মিষ্টির প্লেট। ছেলেটা মুখ তোলার আগে তিনি শাড়ির আঁচল টেনে মুখ ডাকলেন। অভিক সরু চোখে তাকালো। কিছুক্ষণ পর সালাম দিতেই সাজিয়া বেগম সালামের জবাব দিয়ে বললেন
ভেতরে আসুন।
না। আমি আগে করিমের আন্টিকে খুঁজছি।
সাজিয়া বেগম শাড়ির আঁচল ধীরে ধীরে সরালেন। উনার চোখদুটো গোলগাল দেখালো। অভিক দেয়ালে লাগিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগ তুলে বড় সাইজের মাছটা বের করতে করতে বলল
করিম কথা দিয়েছিল ইলিশ মাছ নিয়েই আসবে।
সাজিয়া বেগম মাছের ব্যাগ থেকে বের করা মাছটার দিকে হা করে তাকালেন।
অভিক বলল
এটা নেওয়া যাবে? বাজার থেকে বয়ে আনতে গিয়ে হাত ব্যাথা হয়ে গেল।
সাজিয়া বেগম এগিয়ে এসে মাছের মুখের সাথে বেঁধে দেয়া রশিটা ধরে নিল । অভিক হাত ঝেড়ে হাসলো । তার সাথে সাজিয়া বেগমের ঠোঁটের কোণায় হাসির দেখা দিল । তিনি নিজের অন্য হাতের প্লেট দেখিয়ে বলল
করিম কি হাতের বানানো মিষ্টি খায়?
অভিক চামচ তুলে মিষ্টি কেটে খেল নিজে। হবু শ্বাশুড়িকে খাইয়েও দিল। বলল
ভালো ছিল।
এবার বাকিদের নিয়ে ভেতরে আসা যায়।
আজ কিন্তু আমি থেকে যেতে এসেছি।
নতুন পাটি আর বালিশ কেনা আছে।
অভিক হেসে মাথার পেছনটাতে হাত বুলালো।
সাজিয়া বেগম মাছটা নিয়ে যাওয়ার সময় আবারও ফিরে চাইলেন। বললেন
যাইহোক, রুইমাছটা কিন্তু ভালো ছিল।
অভিক প্রশংসায় ভাসলো তাই হাসলো ভীষণ চমৎকার করে।
চলবে………..