আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব-৪২+৪৩

0
466

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪২
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে সুজানা টের পেল সবার ছোটাছুটি। সবেমাত্র মুখহাত ধুয়েছে সে। মা কিছু আগেই শান্তাকে দিয়ে শাড়িটা পাঠিয়েছে। আর দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বলেছে “শাড়িটা যাতে পড়ে নেয় “।
সুজানা শাড়িটা হাতে নিয়ে রুমে পায়চারি করতে করতে শুনতে পেল অনা আবিদের গলা।

সুজান কুথায়? সুজানের কাছি যাবো।

সাথে সাথে আনিকার গলাও ভেসে এল।

সুজান আসবে। এখন অভির কাছে যাও।

নামটা শুনতেই বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে উঠলো সুজানার। সত্যি এসেছে?

শাড়িটা বুকের সাথে চেপে ধরে চুপটি করে রইলো সে।

চোখ খুললো দরজায় ঠোকা পড়ায়। কাঁপা গলায় জানতে চাইলো

কে?

রোজা উত্তর দিল।

আমি আপা। শান্তা আপু বলল শাড়িটা পড়ে নিতে। নাশতার প্লেট সাজানো শেষ হলে আসছে।

আচ্ছা।

সুজানা শাড়িটা পড়ে নিল কোনোমতে। যদিও সে শাড়ি পড়তে বেশ পটু। বহুবার সে শাড়ি পড়েছে। কিন্তু আজ কোনো কাজে মন বসছে না। অদ্ভুত কারণে সবকিছু হালকা হালকা লাগছে।

বেশ সময় নিয়ে শাড়িটা পড়ে নিল সে। তারপর দু’হাতে চুড়িগুলো। চুড়ির ঝনঝন শব্দগুলো শুনতেও আজ ভালো লাগছে। যেন এর চাইতে সুন্দর সুর বুঝি আর নেই। প্রেমে ভেসে গেলে বুঝি এমন অনুভূতি হয়?

তারপর শাড়িটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সময় নিয়ে দেখলো । নিজেকে বোধহয় এমন করে আর কখনো দেখেনি সে।
হয়ত সে ” তার ” চোখে সবকিছু দেখে বলে নিজেকে এত সুন্দর লাগছে? এই যে গালের দুপাশে লাল খয়েরী হয়ে শুকিয়ে রইলো ব্রণগুলো এগুলোও খারাপ লাগছে না। সে নিখুঁত নয় জেনেও তো অভিক ফারদিন কাউকে না দিয়ে তাকে মন দিয়েছে। তাই সে নিখুঁত হতে চাইবে না এবং তার প্রয়োজনও নেই। ভালোবাসার সংজ্ঞা যদি খুঁত নিখুঁতের মাপকাঠিতে দিয়ে হতো তাহলে ভালোবাসা লুপ্ত হতো সেই কবে। জগতে অমন নিখুঁত মানুষও কোথায়?

দরজায় আবারও ঠোকা পড়লো। সুজানা চিরুনি হাতে নিয়েছিল সবে।

কে বলে ” চিরুণিটা চুলে লাগিয়ে দরজা খুলতেই আনিকা আর জিনিয়াকে দেখে ভড়কে গেল।

খোলা চুল ঢাকতে শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে সালাম দিতেই আনিকা সালাম নিল। সুজানাকে ভালো করে পরখ করে একটু মৃদু হাসলো। বলল

আমাদের তো ভেতরে যেতে বলছেন না।

সুজানা আমতাআমতা করলো। জিনিয়ার দিকে বারবার তাকালো। কে মেয়েটি? কখনো তো দেখেনি?

সে বিছানার উপর থেকে তার সেলোয়ার-কামিজ, সাজগোজের জিনিসগুলো সরাতে সরাতে বলল,

আসুন না। আমি মাত্রই চেঞ্জ করলাম তো তাই সব এলোমেলো।

আনিকা বলল

থাক। ব্যস্ত হবেন না। সমস্যা নেই। ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ও জিনিয়া। ফুপীর মেয়ে। সিজানের বোন।

জিনিয়া সালাম দিল। সুজানা সালাম নিয়ে কুশল বিনিময় শেষে বলল

উনারা কবে এসেছেন?

এইতো তিনদিন আগেই এল। আপনি তো আমাদের খোঁজখবর নেন না আজকাল। শুধু একজনের খোঁজ রাখলে চলবে?

সুজানার চোখজোড়া লজ্জায় নত হয়ে এল। ওর কাঁচুমাচু ভাব দেখে জিনিয়া বলল

আহা ভাবি লজ্জা দিচ্ছ কেন? দেখো লজ্জা পেয়েছে।

সুজানা বলল

নাহ।

আনিকা বলল

আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি চুলটা বেঁধে নিন। আমরা আসি।

সুজানার মনে হলো আনিকা আগের মতো স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছে না। তার ভালো লাগলো না।

জিনিয়া বলল

আমি হেল্প করি? আমি খুব সুন্দর করে চুল বাঁধতে পারি।

সুজানা মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিল।

শান্তা আর মেহুল এসে পড়লো তখুনি। শান্তার সাথে ওদের পরিচয় হয়েছে। শুধু মেহুলের সাথে হয়নি। মেহুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শান্তা বলল

ও মেহুল। আমরা তিন বান্ধবী।

চিনি আমি।

মেহুল সালাম দিয়ে বলল

ভালো আছেন?

আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?

জ্বি। আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন না।

আনিকা বলল

সমস্যা নেই। আমি আছি।

জিনিয়া বলল

নতুন ভাবি আপনি বসুন। আমি চুল বেঁধে দিই। আরেহ আপনার চোখমুখ এত ফুলেছে কেন?

সুজানা আমতাআমতা করে বলল

কই? এমনি

নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করেছেন। আমারও কাঁদলে চোখমুখ এরকম ফুলে যায়।

শান্তা আর মেহুল চোখের দৃষ্টি বিনিময় করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাদেরকে সাজিয়া বেগম বলেছেন উনি বকাবকি করায় সুজানা সকাল থেকেই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলেছে।

সবাই সবার সাথে টুকিটাকি গল্প করতে করতে সুজানার চুল বাঁধা হয়ে গেল। শাড়ির কুঁচিগুলো ভালো করে ধরে পিনআপ করে দিল জিনিয়া। বলল

এবার ঠিক আছে। কিন্তু মুখ গোমড়া করে রেখেছেন তাই ভালো লাগছেনা। আরেহ হাসতে কোনো টাকা লাগে না।

সুজানা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো।

জিনিয়া বলল

আমি মামীদের বলে আসি আপনি রেডি হয়েছেন। জিনিয়া বেরিয়ে গেল। শান্তা আর মেহুল বলল

আচ্ছা আপনারা কথা বলুন।

আনিকা মাথা দুলালো।

ওরা যেতেই সুজানা বিছানার চাদর ঠিক করতে করতে বলল

আপনি বসুন না। বাচ্চারা কোথায়?

ওরা অভির কাছে।

ওহহ।

আপনি এই সম্বন্ধে রাজী আছেন সুজানা?

চাদরে হাত থেমে গেল সুজানার। ফিরে তাকাতেই দেখলে আনিকা ওর দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে।

সুজানা মহা মুশকিলে পড়ে গেল।

আনিকা বলল,

না আমার মনে হচ্ছে আপনি কেঁদেছেন। তাই জানতে চাইলাম।

সুজানা মাথা নামিয়ে রাখলো। বলল

শুরু থেকেই আমায় চেয়ে বসা মানুষটাকে ফেরানোর সাধ্যি আমার কখনো হবে না। কারো শখ, আহ্লাদ, আনন্দ আর ভরসার জায়গা হতে পারাটা আমার জন্য সৌভাগ্যের। আমি কখনোই না করতে পারতাম না।

আনিকা মৃদুমন্দ হাসলো। সুজানার টলমল করা চোখজোড়া দেখে গাল টেনে দিয়ে বলল

আপনি আমার এত কাছে চলে আসবেন এটা তো আমার জন্যও আনন্দের সুজানা।
যাইহোক যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, বাসনে বাসনে লাগলে টুংটাং আওয়াজ হয় কিন্তু। ছোট মা আর মায়ের মধ্যে মন কষাকষি হলে তারা একে অপরের সাথে কথা বলেনা ঠিক কিন্তু একে অপরকে ছেড়ে কখনো খাবার টেবিলে খেতে বসতে দেখিনি। সবাইকে খাইয়ে পাতিলের শেষের মাছের টুকরোটির এপিঠ ওপিঠ ভাগ করে খেতে দেখেছি। অসুস্থ হলে একে অপরের কাপড়চোপড় ধুঁয়ে দিতে দেখেছি। তাদের রোজ মন কষাকষি হয় কিন্তু সেসব ড্রয়িংরুম পর্যন্ত কখনোই যায় না। দিনশেষে বাসন দুটো তো আর আলাদা থাকতে পারেনা। তাদের একসাথে ভাঁজে ভাঁজে মানিয়ে থাকতে হয়। আপনার আমার সম্পর্কটাও তেমন হোক।

সুজানা চোখ জোড়া আরও টলমল করে উঠলো। যেন চোখের স্বচ্ছ জলে আনিকা নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। সে বড্ড আলতো হাসলো। সুজানার থুঁতনি ছুঁয়ে বলল

আপনার ম্যান দেখলে বলবে তার ম্যাডামকে আমি কাঁদাচ্ছি। তবে এ সুযোগে একটু সুযোগ না নিলে কি চলে? বলেই আসি ” তোমার তাকে ভীষণ রকম কাঁদিয়ে এসেছি ভাইটি “।

সুজানা কান্নাজলে হেসে ফেলল। আনিকা হেসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।

_______________________

এশারের আজান পড়ায় বাবা চাচ্চুরা মসজিদে চলে যেতেই অনা আবিদকে জিনিয়া নিয়ে এল সুজানার কাছে। এতক্ষণ পর সুজানাকে দেখে তারা দুজনেই ভীষণ উত্তেজিত। আনিকা তখন সুজানাকে কানে দুল পড়াতে ব্যস্ত। ওরা দুজন এসে সুজানার কোমর জড়িয়ে ধরে ডেকে উঠলো

সুজান বউ?

আকস্মিক আক্রমণে সুজানা হতবিহ্বল। বলল

কেমন আছেন আপনারা? এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?

অনা বলল

অভির কাছে। অভি বুলছে সুজান বউ।

সুজানা বলল

নাশতা করেছেন ?

ওকে কথা ঘুরাতে দিল না ওরা। বলল

সুজান বউ? অভির বউ?

সুজানা এবার হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নিল। সবাই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো ওদের কান্ড দেখে।

দরজার বাইরে থেকে নাজিয়া বেগম ডাক দিল সুজানাকে।

সুজু তোর হলো?

হয়েছে খালামণি।

এতক্ষণ লাগে? মানুষগুলো কি মনে করবে?

সুজানা আনিকার দিকে তাকালো। উনি বলল

সমস্যা নেই চলুন।

আগে আম্মার কাছে যাই।

ওকে।

সুজানা আগে মায়ের কাছে গেল। রাশেদা বেগম কাটা ইলিশ মাছ ধুচ্ছেন। সুজানা প্রশ্ন করলো।

ইলিশ মাছ কখন এনেছে?

সাজিয়া বেগম তেলের উপর পেঁয়াজ ছেড়ে মেয়ের দিকে আঁড়চোখে তাকালেন। রাশেদা বেগম জবাব দিলেন

তোর মায়ের মেয়ের জামাই।

সুজানা হতবিহ্বল চোখে তাকালো। গতকালকে সেগুন বাগিচায় উনি মজা করে বলেছিলেন আর সত্যি সত্যি নিয়ে এসেছে? এ কার পাল্লায় পড়লো সে? সবকিছুতে সিরিয়াস?

হবু শ্বাশুড়ির ইলিশ রান্না দিয়ে ভাত খাবে বলে আবদার? ভালো করে রান্না করতে হবে না? তুই উনাদের কাছে গিয়েছিস?

আম্মা কাছে এসেছি। আম্মা যদি…

সাজিয়া বেগম সাথে সাথেই জবাব দিলেন

কেন এখনো না গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে? আমি কি কোনো সোহবত শেখাইনি? বাড়িতে মেহমান এলে আগে গিয়ে দেখা করতে হয়। নতুন করে মায়ের অনুমতি নেয়ার কোনো মানে আছে?

সুজানার মুখখানা আরও গোমড়া হয়ে এল। শান্তা এসে সুজানার পেছনে দাঁড়িয়ে সবার মুখদর্শন করলো। রাশেদা বেগম বললেন

আহা মেয়েটাকে একটু ভালো করে বললে কি হয়? চোখের সামনে না দেখতে পেলে বুঝবে। এমন সোনা মেয়ে কারো আছে?

সুজানা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। নাজিয়া বেগম এসে বলল

সুজু কোথায়? ওমা এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছিস?

শান্তাকে জিজ্ঞেস করলেন ” কি হয়েছে?

সে ছোট করে উত্তর দিল।

আন্টি বকাবকি করেছে মনে হচ্ছে।

উনি সুজানার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন

তোর মায়ের একার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। তাই এমন করছে। আপা তুমি ওর উপর রাগ ঝাড়ছো কেন? কোথায় সেজেগুজে তোমার কাছে এল। মেয়েকে দোয়া করবে তা না করে বকছো। তুমিও পারো।

সুজানা ডুকরে উঠার শব্দে সাজিয়া বেগম বললেন

ওকে নিয়ে যাহ নাজু।

শান্তা এসে বলল

আরেহ বুদ্ধু চল। আরেহ তোকে কাঁদতে দেখলে উনারা কি মনে করবেন? সুজু! চল।

সুজানা নড়লো না। খালাম্মাকে জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে রাখলো। রাশেদা বেগম বললেন

আহা সুজুর মা তুমিও পারো। এ সময়গুলোতে মেয়েদের সাথে নরম হয়ে কথা বলতে হয়। এসময় কত ভয়ভয় কাজ করে জানোনা। তুমিও বাপু কার রাগ কার উপরে দেখাও বুঝিনা।

শান্তা আনিকাকে সব বলে ডেকে আনলো। ও এসে
সুজানাকে ধীরেসুস্থে ছাড়িয়ে নিল নাজিয়া বেগমের কাছ থেকে। ফিসফিস করে বলল

না গেলে আপনার রাগী আন্টি নিজেই চলে আসবেন।

আনিকা তাকে জোর করে নিয়ে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। ও যাওয়ার সময় মায়ের দিকে তাকালো। আম্মা কি খুশি নেই?

___

সুজানার চুলের খোপার উপরে শাড়ির আঁচলটা তুলে দিল আনিকা। তাকে অমন কান্না কান্না মুখে দেখে সবাই খানিকটা কৌতূহলী চোখে তাকালো। সুজানা সবাইকে গিয়ে সালাম করলো। সালমা বেগম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

আনজুমা বেগমকে সালাম করতে যেতেই উনি বললেন

বসো বসো মেয়ে। কখন থেকে তোমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি। কি হয়েছে? মন খারাপ কেন? আমরা এসেছি বলে মন খারাপ হয়েছে? খুশি হওয়ার কথা।

আনিকা ইশারায় কিছু বলতে উনি বললেন

এখন সালাম করেছ তাকে চিনতে পেরেছ?

সুজানা জেসমিন বেগমের দিকে তাকালেন। সেই বাড়ির সবার চেহারার ধরণের সাথে মিল আছে।

উনি অভির ফুপী।

জেসমিন বেগম হাসলেন সুজানার সাথে। বললেন

আমরা তো আজ নিয়ে যাচ্ছি না। এত কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলতে হবে না।

সুজানা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। সরল মুখে সালমা বেগমের দিকে তাকাতেই উনি বললেন

তুমি এত শুকিয়েছ কেন? এটুকুনি মেয়ের এত কিসের চিন্তা?

সবসময় খ্যাঁকখ্যাঁক করে কথা বলা মানুষটা এত মমতা জড়িয়ে কথা বলছে দেখে সুজানার চোখদুটো বার-বার ঝাপসা হয়ে উঠছে।

সুজানা আসায় হৈচৈ বেড়ে গেল। জিনিয়া বলল

মামী মামাদের আসতে বলি?

সালমা বেগম মাথা নাড়ালেন। আনিকাকে ডেকে কানেকানে কি ফিসফিস করে বলতেই আনিকা মাথা দুলিয়ে রুম থেকে চলে গেল।

জেসমিন বেগম টুকটাক প্রশ্ন জানতে চাইলো সুজানার কাছ থেকে। তার বাবা কোন স্কুলে মাস্টারি করতো। চাচা জেঠু ফুপু কয়জন? তার দাদার বাড়ি কোথায়? নানার বাড়ি কোথায়? কবে তারা এই শহরে এসেছে? এইসব।

সুজানা একটু স্বাভাবিক হলো উনার সাথে কথা বলতে গিয়ে। জানতে চাইলে দাদুকে নিয়ে আসেননি কেন?

উনি বললেন

মায়ের শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। তাছাড়া তানিয়াও বাচ্চা নিয়ে আসতে পারবেনা তাই দু’জনকে রেখে এসেছি।

আনিকা সাজিয়া বেগমকে নিয়ে আসলেন। তারপর আজীম সাহেব আর আহনাফ প্রবেশ করতেই পিনপতন নীরবতা নেমে এল। সুজানা উঠে গিয়ে সালাম করতেই উনি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

অভিক ফারদিন তো ওই ঘরে ভীষণ অধৈর্য হয়ে পড়েছে। কেউ তাকে দেখাও দেয়না, তাকে দেখতেও আসেনা। কি এক জ্বালা!

সবাই একসাথে হেসে উঠলো। সুজানা লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিল।

আজীম সাহেব অভিককে উদ্দেশ্য করে ডাকলো

অভিক ফারদিন।

কেউ একজন অভিককে বলল,তার বাবা ডাকছে। সে ফোন থেকে মনোযোগ সরিয়ে ড্রয়িরুম পার করে এসে বলল

জ্বি বাবা।

এদিকে আসা যায়।

অভিক এল। তবে ঘরে সবাইকে দেখে বাইরে দাঁড়ালো। ওখান থেকে সুজানাকে খানিকটা দেখা গেল। সেই খানিকটা দেখার মাঝে দু’জনের দৃষ্টি বিনিময় হলো। অভিককে সেই চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী ভুরু নাচাতে দেখে সুজানা হাসলো।

অভিক মাথা নিচু করে ঘরের দরজা পার হয়ে ভেতরে এল।

আজীম সাহেব সাজিয়া বেগমকে বললেন

মশাইয়ের সাথে আপনার আলাপ হয়েছে?

অভিক বলল

আমাদের অনেকদিনের আলাপ।

সাজিয়া বেগম মৃদু হাসলেন।

বাহ তাহলে তো ব্যাপার স্যাপার বহুদূর এগিয়েছে।

অভিক মাথা দুলালো। সালমা বেগম ব্যাগ থেকে ছোট সাইজের লাল রঙা একটা বাক্স বের করে দিলেন আজীম সাহেবকে। উনি সেটি খুলে সাজিয়া বেগমকে বললেন

বাকি কথা এটার পরেই হোক।

সাজিয়া বেগম সম্মতি জানালেন নীরবে। আজীম সাহেব অভিককে রিংটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

এই নাও বৎস।

অভিক রিংটি তুলে নিয়ে সুজানার দিকে তাকিয়ে আবারও ভুরু তুললো। সুজানা চোখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। জিনিয়া তাকে টেনে এনে অভিকের পাশে দাঁড় করালো। সিজানের ক্যামেরাটা নিয়ে এসে বলল

ওয়েট ওয়েট নানুকে তো ছবি দেখাতে হবে।

আনিকা এসে সুজানার আঙুলটা তুলে অভিকের হাতে তুলে দিয়ে বলল

ধর।

অভিক আঙুলটা আলতোকরে ধরে বিড়বিড় করে বলল

আঙুলের মানুষটা দরকার।

সুজানা কেঁপে কেঁপে উঠলো তার আলতো স্পর্শে ।
অভিক সেটা পড়িয়ে দিতে দিতে বলল

সুজানা আফরিদা তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে?

হুম।

কি আর করার? আপনিটাকে একলা একা দেখার ভীষণ তাড়া আমার।

চলবে………

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪৩
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

আংটি বদলের পর সবার হাত তালিতে মুখোরিত হলো পুরো রুমটা। সালমা বেগম টেবিল থেকে মিষ্টির প্লেট নিয়ে সুজানাকে খানিকটা খাইয়ে দিয়ে দিল। অভিককে বাকিটা খাইয়ে দিতে দিতে বলল

এবার বড় হতে হবে অভি।

অভিক মাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল

আমি বড় হইনি?

হয়েছিস। বয়সে। বুদ্ধিতে আন্ডা।

সুজানা শব্দহীন হেসে উঠলো। সাথে বাকিরাও। সবার মিষ্টি খাওয়াখাওয়ি হলো।

সাজিয়া বেগমকে আনিকা টেনে নিয়ে এল। অভিক আর সুজানার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। মিষ্টি চামচে তুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল

মিষ্টিমুখ করান আন্টি।

সাজিয়া বেগম চামচটা অভিকের মুখে তুলে দিতে দিতে বললেন,

আমার তো আজকে দেয়ার মতো কিছু নেই। কি দেব আমি?

অভিক খেয়ে চামচটা নিয়ে মিষ্টি কেটে উনাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন

আমি অত ছাড় দেয়ার পাত্র নই। হিসেব মতো সবচাইতে মূল্যবান রত্নটা বুঝে নিয়েছি।

সাজিয়া বেগম মিষ্টিটা চিবিয়ে হাসলেন। বললেন,

ইলিশ মাছটা রেঁধেছি। কাঁটা বেছে খেয়ে যেতে হবে কিন্তু। কাঁটা লাগলে তো আবার সমস্যা।

সমস্যা কি? গলা থেকে কাঁটা না নামা অব্দি থেকে যাব। রাতটা গল্প করে কাটিয়ে দেব। করিমের আবার রাত জাগার অভ্যাস আছে।

তাই? আমার আব্বা করিমউল্লাহ সর্দার রাতে গ্রামের চোর ডাকাত পাহাড়া দিতেন বলে রাত জাগার অভ্যাস ছিল। কিন্তু করিম কাকে পাহাড় দেয়?

করিমও চোর পাহাড়া দেয়।

তাই বুঝি?

হুমম। সবাই কি আর টাকা পয়সা চুরি করে? মানুষও চুরি করা যায় তো।

চুরি কি হলো?

তা আর বলতে? মানুষ তো চুরি হলোই, সাথে তার মন, রাতের ঘুম আর প্রিয় ট্র্যাকস্যুট। চোরটাকে ধরার কারসাজি চলছে অবশ্য।

সুজানা মৃদু হেসে মাথা নামিয়ে নিল। ইশশ ট্র্যাকস্যুটটা এখনো রয়ে গেছে।

সাজিয়া বেগম হাসলেন এবারও। বললেন,

শুরুতেই ভেবেছিলাম করিম ভীষণ ছেলেমানুষ। ছোট মানুষ। পরে দেখলাম সে ছোটমানুষের ছদ্মবেশে এক মাস্টারমশাই। তবে এখন বুঝলাম মাস্টারমশাই ভীষণ ছোট মানুষ না হলেও ভীষণরকম ছেলেমানুষ।

ভীষণরকম ছেলেমানুষটাকে পছন্দ হয়েছে?

সে যদি আমাকে অপছন্দ হওয়ার সুযোগ না দেয় পছন্দ না করে যাব কোথায়?

অভিক মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে হাসলো । বলল

আমি তাহলে নিয়ে নিলাম।

সাজিয়া বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন না। বকেছেন তাই নিজেও শান্তিতে নেই। অভিকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন

সে তো আবার বিয়ে-টিয়ে নিয়ে বড়ই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে।

আমার কাছে আছে।

কি আছে?

দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূরীকরণের মহৌষধ। এক ডোজে যথেষ্ট।

সাজিয়া বেগম ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে চুল টেনে দিয়ে বললেন

দুষ্টু ছেলে।

_____________________

বড়রা কথা বলার জন্য এক ঘরে বসলেন। বাকিদের সুজানার ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সুজানা অনামিকা আঙুলটা সেই তখন ধরে রেখেছে অন্য হাতে। বড়রা কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা জিনিয়া শান্তা আর মেহুল আগাম পরিকল্পনা করে হাসছে আর সুজানার সাথে মজা নিচ্ছে। অনা আবিদ সুজানার পাশে বসে রয়েছে ভালো বাচ্চার মতো। কিছুক্ষণ পর পর সুজানার দিকে তাকাচ্ছে। আর জানতে চাইছে ” সুজান বউ? “। তাদের কথায় হাসা ছাড়া সুজানার উপায় নেই।

কিছুক্ষণ পর সায়েম ঘরে উঁকি দিল। জিনিয়া বলল

কি অবস্থা?

সায়েম লজ্জা কান মলতে মলতে বলল

আপা তোকে ডাকে।

কে কে?

সবার চেঁচিয়ে উঠায় সুজানা অবাক চোখে তাকালো।

শান্তা বলল

স্যার নাকি?

সায়েম মাথা দুলালো। বলল

এখন যেতে বলেছে।

জিনিয়া ফিক করে হেসে উঠে বলল

ভাইয়া তুমি গিয়ে বলো যে আমরা এখন তাকে ছাড়ছিনা।

সায়েম চলেই যাচ্ছিল। সুজানা বলল

না, না এরকম বলিস না।

সবাই হেসে উঠলো। মেহুল শান্তার গায়ে ঠেস দিয়ে বলল

সখী ভালোবাসা কারে কয়?

আনিকা অনার চুলে ক্লিপ লাগিয়ে দিতে দিতে বলল

সুজানা আপনি যান। আপনারা কেন বেচারিকে এত লজ্জা দিচ্ছেন?

সায়েম বলল

তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।

সুজানা আবার সবার দিকে তাকালো। মেহুল বলল

যাহ গা*ধী।

সুজানা মাথা নেড়ে বলল

আচ্ছা।

আনিকা কপাল চাপড়ে বলল

এ কেমন মেয়ে!

আবিদ বলল

আম্মু সুজান কুথায় যায়?

অভি ডাকে।

অভি কেন ডাকে?

আনিকা সবাইকে প্রশ্ন করলো

কেন ডাকে?

সবাই হেসে উঠলো।

**

সুজানা সায়েমের পেছন পেছন যেতে যেতে বলল

কোথায়?

বারান্দায় ফোনে কথা বলছিল এতক্ষণ। এখন ছাদের দিকে গিয়েছে বোধহয়। ছাদে যা।

আচ্ছা। আম্মা ডাকলে বলিস। কেমন?

সায়েম মাথা দুলালো।

সুজানা ধীরপায়ে হেঁটে ছাদে উঠে গেল। ছাদের একপাশে সিমেন্টের বস্তা। অন্যপাশে ট্যাংক। অভিক ফোন কানে দিয়ে পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সুজানা ত্রস্তপায়ে হেঁটে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। অভিকের কথা শোনার পর সুজানা বুঝতে পারলো অভিক দাদুর সাথে কথা বলছে। সুজানার আসার টের পেয়ে সে পেছন ফিরে তাকালো।

সুজানাও লাজুকলতা ন্যায় তাকালো। অভিক ফোনটা কেটে পকেটে রেখে তার দিকে ফিরতেই সুজানা খুবই ধীরগতিতে পিছিয়ে গিয়ে হাসলো।

অভিক এগোতে এগোতে দুষ্টুমির ছলে বলল

দেরীতে আসায় আমার অভিমান জমেছে প্রথম দিনের মতো।

সুজানা হেসে পিছিয়ে গিয়ে বলল

প্রথম দিন কি করেছি?

আপনাকে পেছন থেকে ডেকেছিলাম। আর আপনি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পালাচ্ছিলেন।

সেগুনবাগিচায় যাওয়ার তাড়া পড়েছিল সেদিন।

থেমে গেল সুজানা। অভিকও থামলো।

তার আর সুজানার দূরত্ব মেপে নিল। ঠিক একটা হাত দূরে সুজানা দাঁড়িয়ে।

অনামিকায় পড়া আংটিটা এখনো অন্য হাতে মোচড়াচ্ছে। অভিক এক হাত দূরত্ব কমিয়ে আধা হাত দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো।

বলল,

আমার কাছে আসার তাড়া ছিল ?

আমি সেদিন একটা বিলেত পাস ছেলেকে বোকা বানাতে গিয়েছিলাম।

পরে কি হলো?

আমি নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। তারপর…

সে একটুখানি নিকটে আসায় সুজানা তার দিকে পুরোপুরি তাকিয়ে হাসলো। অভিক তার দু’পাশের রেলিঙে হাত ঠেকিয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। ভুরু নাচিয়ে জানতে চাইলো,

কি?

আপনি দূরের জিনিস ভালো দেখতে পান?

অভিক ভুরু কুঁচকে চাইলো। কিয়ৎপরিমাণ সময় নিয়ে পরক্ষণে হেসে উঠলো। ঝুঁকে বলল,

কাছের জিনিসও ভালো দেখতে পাই। এই যে তাকে দেখতে পাচ্ছি।

কেমন?

শাড়িতে সে আমার বাগানের ফুলের মতো। আজ থেকে সেই শাড়িটা তার। আর সে একান্তই আমার।

শিরশিরে অনুভূতি হলো সুজানার তার হাতটা অন্য পাঁচ আঙুলের ভাঁজে বন্দী হওয়ায়। কপালে কপালের স্পর্শ, নিঃশ্বাসের শব্দসন্ধি, আর সেই ভাঁজে ভাঁজে বসে থাকা পাঁচ আঙুলের স্পর্শ অনুভবে সুজানার তখন বেহাল অবস্থা। সে মিনমিন করে বলে উঠলো।

বসন্তের কোকিল অল্প সময়ের জন্য আসে। আমার ভীষণ ভয় হয়। ভালোবাসাকে যে সবাই বসন্ত বলে।

আপনি আমার জীবনে বসন্তের কোকিল নন, আমিও না। আপনি আমার বারান্দার পাশের গাছটির নরম ডালে বসা শালিক পাখিটি। যার থাকার জন্য কোনো ঋতুর প্রয়োজন হয় না। সে ডাকে, গান গায়, আমি কথা না বললে রাগ করে, মুখ গোমড়া করে, ভিজে এসে আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে পালক ঝাড়ে।
আপনি সেই শালিক পাখিটির মতো। আপনি থাকলেই আমার জন্য সব ঋতুই বসন্ত। কোকিলের বৈশিষ্ট্য তো অল্পটুকু, আর একটুখানি।
একটুখানি ভালোবেসে কি মন ভরে?
আমার একটুখানিতে পোষাবে না। আমি সুজানাকে ভীষণরকম ভালোবাসার জন্য ভালোবেসেছি। একটুখানি নয়।

তারপর, সুজানার সেই অনামিকা আঙুলটাও বোধহয় রেগে গিয়ে বাঁকা হয়ে বসলো তাকে ভালোবেসে একটুখানি ছোঁয়ায় তার তো আরও একটু বেশি চায়। ভালোবাসায় কি কম বলতে কোনো শব্দ হয়?

চলবে……