অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব-০৩

0
519

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_০৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

দিনের অর্ধেক সময় কলেজে কাটিয়ে বাসায় ফিরলো মাহমুদ। ঠান্ডা পানিতে গলা ভিজিয়ে স্থির হলো। অতঃপর লম্বা গোসলে শরীর ভিজিয়ে নিল। ভেজা চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতেই ছাদে পা বাড়ালো।
ছোট্ট একটি মেয়ে। বড় বড় চোখ, মুখে একরাশ মায়া। এক প্যাকেট চিপস হাতে ছাদের একপাশে গড়ে ওঠা ফুলগাছ গুলো ছুঁয়ে ছুয়ে দেখছে। অল্প চাপা নাক ফুলিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। চোখের পাপড়ি কচি কিশলয়ের মতো নড়েচড়ে উঠছে। এমন ছোট্ট একটি মেয়ের পিঠ ছড়ানো চুল ভীষণ অবাক করলো মাহমুদকে। হয়তো এখন থেকেই চুলের যত্নে বেশ মনযোগ দিচ্ছে সবাই।
চমৎকার দেখাচ্ছে এই ছোট্ট মেয়েটিকে। মাহমুদ অনেকক্ষণ ধরেই তাকিয়ে রইলো। এতদিনে জানা হয়ে গিয়েছি ছোট্ট মোমের মতো চমৎকার পুতুলটি বাড়িওয়ালার ছোট মেয়ে।

অরু আপন মনে ফুলের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। ফুল তার ভীষণ প্রিয়। সুযোগ পেলেই ছুটে ছাদে আসে। হুট করে নজর গেলো ছাদের একপাশে একটি লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ধারণা লোকটি তার দিকে নয়, তার চিপসের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত খেতে চাচ্ছে। তা নয়তো কি? ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে গেল অরু। একহাত কোমরে রেখে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে বলল,
-“আপনি কি চিপস খেতে চাচ্ছেন?”

মাহমুদ অল্পবিস্তর হাসার চেষ্টা করেও হাসলোনা। অন্যথায় এই ছোট্ট বাঘিনীর থা*বা*য় পড়ে প্রা*ণ*না*শ হয়ে যায়। দেখা গেলো মেয়েটি কেঁদেকেটে সমুদ্র তৈরি করে ফেললো! এতে তার জেল জরিমানা হলেও হতে পারে। বাড়িওয়ালার মেয়ে বলে কথা।
মাহমুদ কিছু বলার পূর্বেই অরু চিপসের প্যাকেট সরিয়ে নিলো। বলল,
-“দেবো না আপনাকে চিপস। কেন দেবো? একদম তাকাবেন না। আমার পেট ব্যথা করবে।”

স্তব্ধ হয়ে গেল মাহমুদ। পরক্ষণেই নিঃশব্দে হেসে বলল,
-“কিন্তু আমার যে তোমার কাছ থেকে চিপস খেতে ইচ্ছে করছে!”

-“আমারতো এইটুকুন চিপস।”
মুখ ছোটো করে দুই-আঙুলে পরিমাপ করে দেখালো অরু।

মাহমুদ মায়া মায়া চোখে তাকালো। সে আবিষ্কার করলো ফুলগাছের পাশে আরও একটি ফুল। যে তাকে পিটপিট নজরে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। মাহমুদ তাকে একটু রাগিয়ে দিতে চাইলো।
মেকি উপহাসের সুরে বলল,
-“তোমার মন খুবই ছোটো। তাইতো আমায় চিপস দিচ্ছো না।”

মাহমুদের ঔষধে কাজ হলো। তেতে উঠলো অরু। কোমরে হাত দিয়ে আঙ্গুল ঘুরিয়ে পুরো ছাদ দেখালো মাহমুদকে। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
-“এই বিশাল বাড়িটা দেখছেন না? এটা আমাদের বাড়ি। আমরা অনেক বড়লোক। যারা বড়লোক, তাদের মনটাও বড়। তাই আমার মন ছোট নয়, একদম নয়।”

মাহমুদ মিটিমিটি হাসলো। অরুর মতোই মুখভঙ্গি নিয়ে বলল,
-”তাহলে চিপস দিতে এতো কার্পন্য কেন করছো?”

অরু কাঁদোকাঁদো চোখে তাকালো। গাল ফুলিয়ে মাহমুদের দিকে চিপসের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো। সে প্রমাণ করতে চাইলো তার মন ছোটো নয়। একদমই ছোটো নয়। বিশাল বড় মনের অধিকারী সে।
তার গভীর টলটলে চোখ বলে দিচ্ছে মাহমুদ চিপস হাতে নিলেই বড়োসড়ো একটা সর্ব*নাশ ঘটবে! কেঁদে ফেলবে অরু। হয়তো ছাদে শুয়েই গড়াগড়ি খাবে।
নিচু হয়ে অরুর সামনে বসলো মাহমুদ। শিমুল তুলোর মতো তুলতুলে নরম গাল টে*নে দিয়ে বলল,
-“তোমার চিপস আমার লাগবেনা। আমিই তোমাকে চিপস কিনে দেবো। নেবে তুমি?”

অরু নাকমুখ কুঁচকে অনবরত গাল ঘষে চললো। গাল টা*না*টা*নি খুবই বিরক্ত করে তাকে। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে গাল ফুলিয়ে বলল,
-“আমার গাল ধরবেন না। আমি পছন্দ করিনা।”

-“যদি ধরি? তুমি কী করবে?”

-“আমিও আপনার গাল টে*নে দেবো।”

-“তুমি কি সব সময়ই এমন ঝগড়া করো?”

অরু রে*গে যাচ্ছে। তা দেখে মৃদু হাসছে মাহমুদ।
রাগে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে উঠলো অরু। বলল,
-“আমি ঝগড়া করিনা।”

অরুকে অতিরিক্ত মাত্রায় চটে যেতে দেখে মাহমুদ তাকে আরেকটু সাহায্য করলো। রাগের মাত্রা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিতে বলল,
-“আমি তো দেখলাম তুমি বেশ ঝগড়া করতে জানো।”

-“আমি কিন্তু রে*গে যাচ্ছি। আমি মোটেও ঝগড়া করিনা।”
বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো অরু।

★★★

পানির ট্যাংক দুটো পরিষ্কার করার জন্য রামি, মিঠু দুজনকে দুটো ট্যাংকে ঢুকিয়ে দিলো তরী। সারাদিন স্কুলে থাকায় হাতের নাগালে পায়নি তাদের। দুজনে পরিষ্কারের কাজ করছে কম দুষ্টুমি করছে বেশি। ট্যাংকের গায়ে জমে ময়লা হাতে নিয়ে মিঠু বলল,
-“রামি, আমি বিশাল বড় একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছি। এবার আর কেউ আমাকে এওয়ার্ড নেওয়া থেকে আটকাতে পারবেনা। কাভি নেহি।”

রামি বেশ একটা পাত্তা দিলো বলে মনে হলোনা। অবজ্ঞার সুরে বলল,
-“তোর আবিষ্কারে আমি ভরসা করতে পারছিনা। দেখা গেলো নিজের আবিষ্কারের উপর এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে তুই নিজেই ম*রে গেলি। তাহলে জনগণ কিভাবে তোর উপর আস্তা রাখবে? দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেশ ও জাতির এতবড়ো ক্ষতি আমি কিছুতেই হতে দিতে পারিনা।”

বেশ অসন্তুষ্ট হলো মিঠু। বলল,
-“আগামীতে এওয়ার্ড প্রাপ্ত একজন সম্মানিত বিজ্ঞ লোককে অপমান করার অধিকার তোর নেই। তুই নিতান্তই এক মূর্খ।”

-“মহামান্য সম্মানিত বিজ্ঞ লোক, আপনাকে অপমান করার অনুতাপে আমি জ্বলেপুড়ে যাচ্ছি। আপনার বিশাল আবিষ্কার সম্পর্কে জানা আমার জন্য অত্যন্ত জরুরী। নইলে যে আমি ম*রে যাবো। আপনার পা ধরে গড়াগড়ি খাবো। অনুগ্রহ করে যদি বলতেন আপনার আবিষ্কার সম্পর্কে, তবে বড়ই কৃতার্থ হতাম।”

মিঠু দাম্ভিকতার সাথে মাথা উঁচু করলো। বিজ্ঞদের মতো ধারনা দিলো তার আবিষ্কার সম্পর্কে। ট্যাংকে জমে থাকা লাল রঙের ময়লা হাতে নিয়ে বলল,
-“এগুলো দিয়ে দারুণ চা বানানো যাবে। চুমুক বসালেই মনে উড়ুউড়ু প্রজাতিরা ডানা ঝাপটে বলবে আহ্ কি চমৎকার! এই দারুণ আবিষ্কারের জন্য বোধহয় এওয়ার্ড হিসেবে আমার একটা ফোন পাওয়া উচিত।”

রামি বলল,
-“তাহলে তোর বাপকে বলিস চিনি, চা-পাতা আনার দরকার নেই? এগুলো দিয়েই জম্পেশ চলবে। এগুলো খাবি আর ডায়রিয়া ছুটিয়ে ঘরে বাইরে দৌঁড়াবি। আমি নিজে তোকে এওয়ার্ড দেবো। আমার পক্ষ থেকে এওয়ার্ড হিসেবে থাকছে একশো একটা জু*তা*র বাড়ি।”

-“আহা ব্যাপারটা তুই বুঝলিনা। আমিতো এই চমৎকার চা তোকে খাওয়াতে চাচ্ছি।”

রামি হাতে জমে থাকা ময়লা পানি ছুঁড়ে মারলো মিঠুর দিকে।
-“ব্যাটা তুই খা।”
ফের মিঠু ছুঁড়লো। তরী বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। করতে বলেছে কী আর করছে কী?
দুজনের ছোঁড়াছুড়ি দেখে ধমকেও থামাতে পারেনি তরী। লাঠি খুঁজতে ছাদের অন্যপাশে গেল। চোখজোড়া স্থির হয়ে গেল। সামনে আর এগোতে পারলোনা। অরুর ফোলা ফোলা গাল দুটো রা*গে আরেকটু ফোলে আছে। হাত নেড়েচেড়ে ত*র্ক করে যাচ্ছে মাহমুদের সাথে।
মাহমুদ নামক অদ্ভুত লোকটি নিঃশব্দে কেবল হেসে যাচ্ছে। একগাদা হাসিতে সামনের দাঁতগুলো চকচক করে উঠছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত আপাদমস্তক লোকটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো তরী।
খুব বেশি ফর্সা নয়, আবার কালোও বলা যায়না। শক্তপোক্ত পেটানো শরীর। হাতভর্তি কুঁচকুচে কালো রোম। টিশার্টের উপরে ফুলেফেঁপে ওঠা পেশি স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। বারবার ব্যাক ব্রাশ করে চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। সাধারণ একজন পুরুষমানুষের মতোই দেখতে।
পুরো মানুষটিকে দেখে অসাধারণ মনে না হলেও তার চোখদুটোতে কিছু একটা আছে। ভীষণ ধারালো তার নজর। যা এক পলকেই তরীকে জবুথবু লজ্জায় ফেলে দিতে সক্ষম। তরীর ধ্যান-জ্ঞান কয়েক মুহুর্তের জন্য মাহমুদের উপর সীমাবদ্ধ হলো।

হুট করেই মাহমুদের নজরে নজর পড়লো। চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। তরী তাকিয়ে থাকার সাহস পেলোনা। ফের লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। সে কেন এভাবে তাকাতে গেল? ইশ! নিজেকেই নিজে ভীষণভাবে বকলো।
এখান থেকে কেটে পড়ার ছুতো খুঁজলো। এগিয়ে গেলো অরুর দিকে। তার হাত ধরে বলল,
-“তোকে সেই কখন থেকে খুঁজে যাচ্ছি আমি। এখানে কখন এলি?”

অরু চোখ পিটপিট করে তাকালো। সরল মনে বোকা বোকা স্বরে বলে ফেললো,
-“তুমিই তো আমাকে এখানে দাঁড় করিয়ে ছাদের ওপাশে গেলে। তাহলে খুঁজলে কখন?”

হকচকিয়ে উঠলো তরী।
যদি এই মুহূর্তে ছাদটা ফাঁক হয়ে যেতো, তবে একমুহুর্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকতোনা। ভয়ংকর রকম লজ্জা থেকে বাঁচতে লুকিয়ে পড়তো। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো তার। অরুর মোটেও উচিত হয়নি চরম সত্যিটা মাহমুদ নামক লোকটির সামনে প্রকাশ করা। কারো সামনে লজ্জিত হওয়ার অপমান সহজভাবে নিতে পারার গুণ তার নেই। অপমানে চোখ ফেঁটে কান্না আসছে। তরীর মতে অরু তাকে লোকটির সামনে অপমান করলো। ভীষণ রকম অপমান। যা তার আত্মসম্মানে লেগেছে। রাগে ক্ষোভে সে কড়া চোখে তাকালো। ধমকে উঠলো অরুকে,
-“একদম নিজের দো*ষ ঢাকার চেষ্টা করবিনা, অরু। আমি তোকে আমার সাথেই দাঁড় করিয়েছি।”

মি*থ্যা চাপিয়ে দিয়ে অরুকে কোলে নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগের উদ্দেশ্যে পা চালালো তরী। অরু মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করলো আপু কখন তাকে নিজের সাথে দাঁড় করালো? ওদিকে মিঠু আর রামি দুষ্টুমিতে ব্যস্ত।

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটিবারের জন্যও দৃষ্টির হেরফের হয়নি মাহমুদের। তীক্ষ্ণ নজরে তরীকে পর্যবেক্ষণ করলো সে। দুদিন আগের স্মৃতি রোমন্থন করলো। মেয়েটাকে সহজ করার উদ্দেশ্য থাকলেও তাকে আরও বিব্রত দেখালো সেদিন। খিচুড়ি দিয়ে অনবরত চোখের পলক ঝাপটে কোনভাবে পালিয়ে এলো সে। মেয়েদের সকল রূপের বাইরে সৌন্দর্যমন্ডিত আরেকটি রূপ হলো লজ্জা পাওয়া রূপ।
মাহমুদের মনে হলো লজ্জা পেলে মেয়েদের চমৎকার লাগে। লজ্জা নামক নতুন রূপটি যখন সামনে আসে? তখন তাদের সকল দৈহিক সৌন্দর্য ফিকে হয়ে যায়। চোখে ভাসে কেবল লজ্জায় জড়োসড়ো মুখটি।
এই রূপ দেখার জন্য একজোড়া স্বচ্ছ চোখ প্রয়োজন।
মাহমুদ ছাদের দরজায় তাকিয়ে থাকে নিমেষহীন। মনে কোন নতুন ভাবনার সঞ্চার হয়। অতঃপর দু-ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে কিছু শব্দ।
-“আপনি বড্ড বেশিই লাজুক, তরী।”

#চলবে……..