অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব-১৫+১৬

0
360

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৫
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

সকাল থেকেই ঘরে বসে আছে তরী। মাথার ভেতর এক স্তূপ যন্ত্রণা। মা কখন থেকে নাস্তা করার জন্য ডাকাডাকি করে যাচ্ছেন। তরী বিরক্ত হয়ে বলল,
-“তোমরা খেয়ে নাও। আমার এখন ভালো লাগছেনা।”

মা কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করলেন। সময়মতো খাবার না খাওয়া উনার অপছন্দের একটি কাজ। মিঠু একবার তরীর ঘরের দরজায় চোখ রাখলো। ভেতর থেকে লক করা নয়, তবে চাপিয়ে রাখা। বিয়ে বাড়ির ঘটনা তার অজানা নয়। সেরকম কিছু একটা নিয়েই যে তরী আপসেট সেটা বুঝতে পারলো।
বাবা তরীকে খাবার টেবিলে না দেখেই গম্ভীর গলায় কয়েকবার ডাকলেন। তরী বাবাকেও একই কথা বলে বসে রইলো। তাড়া আছে বলে বাবা নাস্তা করে বেরিয়ে গেলেন।
সবকিছুই কেমন বিষাক্ত লাগছে। সবার আদর ভালোবাসাও তেতো মনে হচ্ছে। অযথায় মেজাজ খা*রা*প হলো তরীর। বুকের ভেতর গড়ে ওঠা ভয় বারবার ঘন্টা বাজিয়ে জানান দিচ্ছে বড় কিছু হারাতে চলেছে সে। পরক্ষণেই তরী ভাবলো ‘হারাবেটা কী? তার কিছু ছিলো না-কি?’ মাহমুদের সাথে তো তার কোন নামের সম্পর্ক ছিলোনা। সে বিয়ে করলেই বা তার কি যায় আসে!
মনকে কঠিন করে ঘর ছেড়ে বের হলো। নাস্তার টেবিলে বসেও খুব একটা গিলতে পারলোনা। ক্ষণে ক্ষণে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।

★★★

গতকাল রাতে প্রচন্ড ক্ষো*ভ নিয়েই তরীকে ছাদে আসতে বলে নক করেছিল মাহমুদ। মেয়েটা মেসেজ সিন করে রেখে দিয়েছে। রিপ্লাই করার প্রয়োজন মনে করেনি। এতে আরো মেজাজ খা*রা*প হলো তার। চোয়াল শক্ত করে দাঁত দাঁত চাপলো। দু’হাতে মাথার চুল খামছে ধরলো। চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো তার। ক্রমাগত পায়চারি শেষে দু-ঘন্টা পর ছাদ থেকে নেমে এলো। তরী এলো না। ফোন সুইচ অফ রেখে শুয়ে পড়েছিল মাহমুদ। আকশসম রাগ গিয়ে জমা হলো তরীর উপর। রাতে ঠিকঠাক ঘুম হলোনা। ভোরের দিকেই একটু ভারী ঘুম হয়েছিল। চোখদুটো এখনো অনেকটা লাল হয়ে আছে। নিজের মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো মাহমুদ। মায়ের সাথে আরেকবার কথা বলা উচিত। কলেজের জন্য তৈরি হয়ে নাস্তার টেবিলে বসলো। আয়েশা সুলতানা দুই ছেলেকে নাস্তা দিয়ে নিজেও বসে পড়লেন। মাহমুদ সরাসরি বলল,
-“তরীর যে অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেটা তুমি কিভাবে জানলে?”

আয়েশা সুলতানা চোখ তুলে ছেলেকে দেখে নিলেন। সরল গলায় বললেন,
-“ওর মায়ের কাছেই শুনেছি। চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ের ব্যাপারে ওর বাবা কথা দিয়ে রেখেছেন। তরীর পড়াশোনা শেষ হোক, ততদিনে ছেলে লন্ডন থেকে ফিরুক। পরেই বিয়ের কাজ শুরু হবে।”

রামি ঝট করেই মাথা তুলে তাকালো। এতক্ষণ তার ধ্যান-জ্ঞান ছিলো খাবারে। তরীর বিয়ে ঠিক হলো কবে? মাকে জিজ্ঞেস করে বসলো,
-“কখন তরী আপুর বিয়ে ঠিক হলো? কই মিঠুও তো আমায় বলেনি।”

-“ওর বাবা মা ছাড়া কেউ জানেনা। তরীও জানেনা। সেদিন উনারা তরীর বড় চাচার সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। আমিও গিয়ে বসেছি। তখন তরীর মা নিজেই বললেন আমাকে।”

ভুরু কুঁচকে গেল মাহমুদের। তরী জানেনা! এ কেমন কথা? মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা দিয়ে দেওয়া কেমন কাজ?
সে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
-“তরী যেহেতু জানেনা। তাহলে নিশ্চয়ই বিয়ের কথা একেবারে পাকাপাকি হয়নি। তুমি প্রস্তাব রাখতে সমস্যা কোথায়?”

আয়েশা সুলতানা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছেন। ছেলে কখনো এমন খোলামেলা কথা বলে না। এমন অনুচিত আবদার দেখে বুঝলেন হয়তো ছেলে খুব পছন্দ করে তরীকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-“আমি বলে দেখবো। তবে মনে হয়না তরীর বাবা রাজি হবেন। তাছাড়া তরী কী বলে সেটাও জানতে হবে।”

মাহমুদ কথা বাড়ালোনা। দ্রুত নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লো। তরী আলাদা রিকশা নিয়ে চলে গেল।
এখান থেকে তার বিষাদের পাতার সূচনা। তাকে অবাক করে দিয়ে মাহমুদ ও আর ডাকলোনা। মন বিষিয়ে উঠলো তরীর। দুদিনেই মানুষ এতটা পর হয়ে যেতে পারে? অবশ্য দো*ষ*টা তারই ছিলো। যেছে কারো সঙ্গ দেওয়া উচিত নয়। বিনিময়ে সে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই পেল না।
আজ আর লেকচারেও মন বসছেনা। পাশ থেকেই সোমা জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর কী হয়েছে রে তরী? তোকে এমন আপসেট দেখাচ্ছে কেন?”

তরী সযত্নে সত্যটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-“এমনিতেই আজ শরীরটা ভালো লাগছেনা।”

-“বাসায় চলে যাবি?”

তরী একবার ভাবলো বাসায় চলে যাবে। পরক্ষণেই মত বদলে ফেললো। এখন বাসায় গেলেই সবকিছু মনে পড়ে যাবে। একাকীত্ব এসে ঝেঁকে ধরবে তাকে। এখানে সবার সাথে থাকলে কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারবে সবকিছু। মাথা দুলিয়ে অসম্মতি জানালো। সোমা বলল,
-“তাহলে চল, বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি।”

-“চল।”
দুজনে বাইরে এসে ঘাসের উপর বসলো। একবার ভাবলো সোমাকে সবটা খুলে বলবে। তারপরই ভাবলো না থাক। ক্লাস ছুটির পর বেরিয়ে গেল দুজন। দু’জনের বাসা ভার্সিটি থেকে বিপরীতে হওয়ায় দুজন দুদিকে এগিয়ে গেল। পরপর দুটো বাস এসে চলে গেল। তরী যাত্রী ছাউনির বেঞ্চিতে বসে রইলো। বাসায় যেতে মোটেই ইচ্ছে করছেনা। চোখমুখ লাল হয়ে আছে।
মাহমুদ নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। তরী যে পরপর দুটো বাস ইচ্ছেকৃত মিস দিয়েছে সেটাও স্পষ্ট দেখলো। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে তরীর হাত চেপে ধরলো।
-“চলুন তরী।”

এভাবে হাত চেপে ধরায় তরী চমকে উঠলো। মাহমুদকে দেখেই হাত ছাড়িয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। তবে কিছু বললোনা। মাহমুদ অপলক চেয়ে থেকে দেখলো মেয়েটার অভিমান। দুর্বোধ্য হাসলো সে। কেউ দেখার আগেই নিপুণভাবে মিলিয়ে গেল সেই হাসি। মাথা ঝাঁকিয়ে শুধালো,
-“নক করেছিলাম আপনাকে। ছাদে আসেন নি কেন?”

তরী চোখমুখ শক্ত করে বলল,
-“আপনি বললেই কি যখন-তখন আমায় ছাদে আসতে হবে?”

তরীর মাঝে স্পষ্ট রাগ। আজ আর কোন লজ্জা, অস্থিরতার চিহ্নটুকু নেই। মাহমুদ সাধারণ বিষয়েও মুগ্ধ হলো। মৃদু হেসে বলল,
-“ঠিক আছে, ইচ্ছে না হলে ছাদে আসতে হবেনা। তবে আমার কিছু কথা আছে। আসুন আমার সাথে।”

তরীর রাগ বাড়লো তরতর করে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। মানুষটি কী সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে। অথচ তার ভেতরটা এক নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। তার উপরে ঠুনকো একটা খোলস অবশিষ্ট আছে। ভেতরটা ভঙ্গুর। নিজেকে শক্ত রেখে বলল,
-“আমার কোন কথা শোনার নেই।”

-“কিন্তু আমার বলার আছে। আপনাকে শুনতে হবে, চলুন।”
মাহমুদের কন্ঠে স্পষ্ট অধিকারবোধ।
তরী আশেপাশে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। যতক্ষণ না মাহমুদের কথা শুনবে দেখা যাবে নাছোড়বান্দা এখান থেকে নড়বেনা। তরী মাহমুদের পিছু পিছু হাঁটলো। কাছেই একটা কফিশপে বসলো। গ্লাস ভেদ করে রাস্তার কোলাহলে চোখ রাখলো তরী। মাহমুদ তরীকে এক পলক দেখে বলল,
-“আমার দিকে ফিরুন।”

তরী দৃষ্টি বাইরে রেখেই বলল
-“আপনি বলতে পারেন। শুনছি আমি।”

মাহমুদ ভুরু কুঁচকে তাকালো। মিটিমিটি হেসে বলল,
-“ভয় করছে তাকাতে?”

তরী সরাসরি মাহমুদের চোখে চোখ রাখলো। চোখমুখ শক্ত করে বলল,
-“ভয় করতে যাবে কেন?”

-“মা আমার জন্য মেয়ে দেখেছে। সব ঠিকঠাক থাকলে বিয়েটাও হয়ে যাবে।”

ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। আর একটু হলেই চোখে পানি এসে পড়বে। তরী কোনভাবে মুখ থেকে বের করলো,
-“সেটা আমাকে বলছেন কেন?”

-“আপনি আমার কাছে খুব ভালো একজন বন্ধু, সেজন্যই বলছি।”

তরীর মেজাজ খারাপ হলো। সে একজন ভালো বন্ধু! এটাই এনাফ, আর কিছু না! তরী ত্যাড়াস্বরে শুধালো,
-“আপনার সাথে আমি কবে ঘটা করে বন্ধুত্ব করলাম?”

মাহমুদ ঠোঁট টিপে হাসলো। তরীকে এই মুহুর্তে ভীষণ ভালোলাগছে দেখতে। আর বোধহয় রাগানো ঠিক হবেনা। মাহমুদের গভীর চোখজোড়া স্থির হলো। কোমল স্বরে বলল,
-“আমি মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করছিনা, তরী।
আমি শুধু আপনার।”

তরী চমকে তাকালো। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। খানিক পর উপলব্ধি করলো তার ভেতরটা ঠান্ডা হচ্ছে একটু একটু করে। রাগ পড়ে যাচ্ছে সর্বোচ্চ গতিতে। মাহমুদ টেবিলের উপর থাকা তরীর ডান হাতে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দিলো। আস্তে আস্তে দুহাতের মুঠোয় কবজা করতে নিতেই তরী হাত ছাড়াতে চাইলো। গাল ফুলিয়ে আছে মেয়েটা। অশান্ত দৃষ্টি এদিকওদিক ঘুরছে। মাহমুদ নিবিড় স্বরে বলল,
-“আপনি ছাড়া আমি খুশি থাকতে পারবোনা, তরী। আমার আপনাকেই লাগবে।”

তরী ঢোক গিললো। হাত ছাড়িয়ে অভিমানী স্বরে জানান দিলো,
-“আমি আপনার কিছু হই না। তাই আমাকে ছাড়া খুশি না থাকার প্রশ্নই ওঠে না।”

মাহমুদ নিঃশব্দে হাসলো।
-“আপনি আমার অনেককিছু, তরী। আমার চোখের দিকে তাকান। এই চোখজোড়া বলে দেবে আপনি আমার সবকিছু।”

তরী এবার লজ্জা পেতে লাগলো। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
-“আমি বাসায় যাবো। দেরি হলে বাবা-মা চিন্তা করবেন।”

-“আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, তরী। প্লিজ আরেকটু বসুন!”

তরী আর ওঠার জন্য তাড়া দেখালোনা। মাহমুদ বলল,
-“আপনি বড্ড বোকা, তরী। ভীষণ বোকা।”

তরীর রাগ লাগলো। নাকের পাটা ফুলে উঠছে তার।
মাহমুদ বলল,
-“আপনি আমায় জিজ্ঞেস করতে পারতেন। আমায় না জেনেই মায়ের একটা পছন্দের ভিত্তিতে কষ্ট দিলেন আমায়। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি আমি। বুকে হাত দিয়ে দেখুন।”

তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই গাল দুটো আরক্তিম হলো। এলোমেলো হয়ে গেল দৃষ্টি। দ্রিমদ্রিম হাতুড়ি পেটার শব্দ হলো হৃৎযন্ত্রে।

★★★

বাড়ি ফিরেই সবচেয়ে বেশি সারপ্রাইজ হয়েছিল তরী। বসার ঘরে আয়েশা আন্টি বসে আছেন। খুব আয়োজন করেই এসেছেন।
তরী রামিকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কী ব্যাপার রামি। তোরা এত কিছু নিয়ে এসেছিস? কোন খুশির খবর আছে না-কি?”

তরী ভাবলো ইরা বোধহয় প্রেগন্যান্ট। পরক্ষণেই ভাবলো প্রেগন্যান্ট হলে নাহয় শুধু মিষ্টি নিয়ে আসতো। এত ফল-মূল, মিষ্টি আনার কী মানে হতে পারে? রামি মিটিমিটি হেসে বলল,
-“সুন্দরী, আমার না হও, তাতে আফসোস নেই। তবে আমার ভাইয়ের তোমায় হতেই হবে।”

তরী চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। রামি মৃদু হেসে ফিসফিস করে তরীর কানে বলল,
-“আমরা ভাইয়ার জন্য তোমাদের বাসায় সমন্ধ নিয়ে এসেছি।”

তরী বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। কই মাহমুদ তো তাকে কিছু জানায় নি! এভাবে তাকে চমকে দেওয়ার মানে কি! ভুরভুর করে লজ্জা ছড়ালো তার চোখেমুখে।
তবে ভয় হচ্ছে তরীর। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। বাবা একবার অমত করলে আর রাজি করানো সম্ভব নয়। ভালোলাগার সাথে সাথে আতঙ্ক এসে ভর করলো। হাতের তালু ঘামছে ঘন ঘন। রুমের ভেতর পায়চারি চলছে তার।

আয়েশা সুলতানার অস্বস্তি হচ্ছে। উনারা যেহেতু অন্যত্র কথা দিয়ে ফেলেছেন, তখন প্রস্তাব রাখা উচিত না। তাছাড়া ব্যাপারটি তিনি স্পষ্ট জেনে বুঝে নিজের ছেলের জন্য এসেছেন। তরীর বাবা বললেন,
-“আপনি কিছু জরুরি কথা বলবেন বলেছিলেন। সেই কখন থেকেই তো বসে আছেন।”

আয়েশা সুলতানা প্রচন্ড নার্ভাস। নিজেকে ধাতস্থ করে প্রস্তাব রাখলেন,
-“মেজো ছেলেকে বিয়ে করাতে চাচ্ছি। তরীকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
এতটুকু বলেই থেমে গেলেন আয়েশা সুলতানা। থামতে হলো। অস্বস্তি ভরা চোখে তরীর বাবা-মাকে দেখলেন। তরীর বাবার দৃষ্টি একেবারে শান্ত। যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। আয়েশা সুলতানা মনে মনে আগত ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলেন।

#চলবে……..

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

থমথমে পরিবেশ। গুমোট, নিস্তব্ধতা ভেতরের অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলছে। আয়েশা সুলতানা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন। দরজার মোটা পর্দার আড়ালে এক-জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। ভেতর ঘরে তুমুল অস্থিরতা। টানটান উত্তেজনা কাজ করছে। বাবার একটা হ্যাঁ, না তে তার জীবনের অনেক কিছু পাল্টে যাবে। হয়তো সুন্দর গোছানো একটি জীবনে পদার্পণ করবে নয়তো সবটা ওলটপালট হয়ে যাবে। তরী মনে মনে শতবার বিধ্বস্ত হলো। খুব করে চাইলো তার জীবনের জোড়াটা শক্তভাবে লেগে থাকুক মাহমুদের সাথে।

নিস্তব্ধতার বুক ছিঁড়ে রুক্ষ স্বর শোনা গেল। মরুভূমির মতো খা খা করে উঠলো অন্তঃকরণ।
বাবা গম্ভীর স্বরে আয়েশা সুলতানার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“দুঃখিত! আপনাকে খুশি করতে পারছিনা। আমি আপাতত মেয়ের বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছিনা।”

আয়েশা সুলতানা খানিকটা চুপ রইলেন। নিরব হয়ে ধাতস্থ করলেন নিজেকে। শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলেন। বললেন,
-“এখন বিয়ে দিতে না চাইলে না দেবেন। এতে আমাদেরও খুব একটা আপত্তি নেই। আপনারা রাজি থাকলে আপাতত আংটি পরিয়ে রাখা যায়।”

তরীর মা সরাসরি কিছু বলছেন না। তবে চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে ‘তরীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেটা আপনি জেনেও কীভাবে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন?’
যদিও তরীর মা মুখ ফোটে কিছুই বললেন না, তবুও আয়েশা সুলতানার অস্বস্তি বাড়লো। লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পেলেন না।
তরীর বাবাকে ক্রমশ গম্ভীর দেখালো। কাঠখোট্টা স্বভাবের মানুষটি নিজের গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বললেন,
-“আমি আমার বড়ো ভাইকে কথা দিয়ে রেখেছি। কথা বরখেলাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ভাতিজা দেশে ফিরলেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে যাবে।”

আয়েশা সুলতানা আর কথা খুঁজে পেলেন না। এই মুহূর্তে কথা বলা মানে নিজের অসম্মান ডেকে আনা। উঠে পড়লেন তিনি। রামির মুখ ফ্যাকশে দেখালো। তরী আপুকে তার ভীষণ পছন্দ। অন্য কোথাও বিয়ে হবে শুনেই কেমন বুক জ্বালা করছে।

পর্দার আড়ালের পা জোড়া থেমে গেল। তর্জন-গর্জন করে বর্জ্রপাত হলো। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো তরীর। তার বিয়ে ঠিক, অথচ সে অবগত নয়। তাও আবার যাকে সারাজীবন বড়োভাই মেনে এসেছে, তাকে কিভাবে স্বামীর আসনে বসাবে? আকাশ-পাতাল এক হয়ে গেল যেন। বিষন্নতার ভীড় ঠে*লে বাড়লো রাগের মাত্রা। টানা চোখ দুটো কানায় কানায় জলে ভর্তি। টুপটাপ বৃষ্টি ফোঁটার মতো ঝরে গেল সমস্ত আশা, আকাঙ্ক্ষা। মাথার ভেতর একদলা ভোতা অনুভূতির সঞ্চার হলো। প্রচন্ড রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠলো মন। বাধ্য সন্তানের ট্যাগ লাগানো তরী পারলোনা বাবা-মায়ের মুখের উপর চিৎকার, চেঁচামেচি করতে। কেবল টুপ করে ভোরের ফুলের মতো ঝরে গিয়ে মিইয়ে গেল। তার জীবনের রঙিন অধ্যায় হারিয়ে সাদা-কালো অধ্যায় পাতা খুলে বসলো। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে খিল পড়লো ভেতর থেকে। আঁটকে রাখা জলকণার ভারিবর্ষণ হলো।

তরী কাঁদছে। শব্দহীন নিরব কান্না। টকটকে লাল চোখ দুটো তার অপ্রকাশিত ভালোবাসার সাক্ষী। সে তো জীবনে প্রেম চায়নি। আর না মাহমুদকে প্রথম দেখায় মুগ্ধ হয়েছে। তার প্রেমে কোন নিমন্ত্রণ ছিলোনা। একেবারে উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রেম। তবুও এত গভীরতা, মায়া, কেন? এই কেন এর উত্তর তরী খুঁজে পেলোনা। শুধু বুঝতে পারলো এই প্রেম তার জীবন-মরণের প্রেম। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া প্রেম। তার কষ্ট বুঝি কেউ উপলব্ধি করতে পারবেনা! বাবা-মাকে ও ছাড়তে পারবেনা আর না তাকে বশীকরণ করা ওই মানবকে। কেন এলো তার জীবনে? তাকে এভাবে দগ্ধ করা খুব কি প্রয়োজন ছিল? ফোন বেজে চলেছে তুমুল শব্দে। তরী ধরলোনা। অবহেলায় পড়ে থাকা মুঠোফোন বারবার শব্দ করে অতিষ্ঠ করে তুলছে তাকে। তরী এখন ফোন রিসিভ করলেই কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে। এতটাও ছোট হতে চায়না সে।

★★★

মায়ের কাছে রিফিউজ হওয়ার কথা শোনার পর থেকেই প্রচন্ড মেজাজ খা*রা*প হয়ে আছে মাহমুদের। এই মুহূর্তে তরীকে খুব প্রয়োজন। মাহমুদ জানে তাকে কাছে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবুও ফোনে একটুখানি প্রশান্তি খুঁজলো। অথচ মেয়েটা লাপাত্তা। তাকে ভয়*ঙ্কর যন্ত্রণায় ফেলে নিশ্চিন্তে পড়ে আছে। মাহমুদ আবারও কল দিলো। বরাবরের মতো এবারও সাড়া নেই। মাথা ধরেছে ভীষণ। মা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আর দ্বিতীয়বার তরীদের বাসায় সমন্ধ নিয়ে যেতে পারবেন না। টিশার্ট ছাড়িয়ে ফ্যানের নিচে বসে রইলো মাহমুদ। মাথার ভেতর এখনো ধপধপ করে উঠছে।

রাতে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো। লজ্জাবতী তরীর নম্বর থেকে কল এলো। মাহমুদ পলকহীন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে। ভীষণ চেনা এই নম্বর তাকে খানিক স্তব্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। মাহমুদ ধীরে সুস্থে ফোন রিসিভ করলো। কানের পাশে শক্ত করে ধরলো মুঠোফোন। ওপাশ থেকেও নিরবতা। মাহমুদ স্তব্ধতাকে বিদায় জানিয়ে শব্দ তুললো,
-“তরী!”

ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ শোনা গেল। তরী কাঁদছে। বিচলিত হলো মাহমুদ। কন্ঠে উৎকন্ঠা ঝরে পড়লো,
-“কাঁদছেন কেন, তরী? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছো তো!”

তরী ফুঁপিয়ে উঠে চাপা গলায় বলল,
-“কিচ্ছু ঠিক হবে না। বাবা মানবে না।”

-“আমি কি আপনাকে এমনি এমনি বোকা বলি, তরী? আপনি সত্যিই বোকা। অল্পতে ভেঙে পড়লে চলবে? আমরা মানাবো আপনার বাবাকে। কোন না কোন পথ নিশ্চয়ই আছে। আপনি একদমই কাঁদবেন না।”

-“আপনি বাবাকে জানেন না। বাবা একরোখা। নিজের সিদ্ধান্তের উপর কারো মতামত টুকুও পছন্দ নয় উনার।”

-“চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”
অতঃপর স্বর কোমল হয়ে এলো মাহমুদের। কঠিন আবেগ নিয়ে শুধালো,
-“তরী, আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ভিডিওতে আসবেন?”

তরী এমনিতেও ভিডিও কলে ভীষণ লজ্জা পায়। তার ওপর আয়নায় তাকিয়ে দেখলো নিজের এলোমেলো অবস্থা। চোখমুখ ফুলে বি*শ্রী অবস্থা। জবাব না পেয়ে মাহমুদ আবারও বলল,
-“কী এত ভাবছেন, তরী? আপনাকে সবরকম ভাবেই আমার চোখে স্নিগ্ধ লাগে। প্লিজ আসুন না, তরী!”

তরী দ্বিধা ভরা গলায় জবাব দিলো,
-“আচ্ছা।”

মাহমুদ খট করেই লাইন কে*টে দিলো। তরী এক ছুটে ওয়াশরুম থেকে চোখেমুখে পানি দিয়ে এলো। মাহমুদ ভিডিও কল দিয়ে বসেছে। হাজারো অস্বস্তি নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে ফোন সামনে ধরলো তরী। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলে উসকোখুসকো, মলিন চেহারা। তবে ঠোঁটের কোনে ঠাঁই পেলো নিটোল হাসি। মুহুর্তের জন্য তরীর সংকোচ দূর হয়ে গেল। ফোলা ফোলা চোখজোড়া ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। ঘোর লাগলো তরীর। এত সুন্দর মানুষ হয়? তরীর চোখ বলছে তার দেখা সেরা রূপবান এই লোক। অনিমিখ তাকিয়ে রইলো ক্লান্তিমাখা চেহারায়। মাহমুদ চুপটি করে তাকিয়ে দেখলো তার তরীর চোখের মুগ্ধতা, ভাসা ভাসা চোখজোড়া। চমৎকার হেসে উঠলো সে। রগঢ় করে শুধালো,
-“এমনভাবে কী দেখছেন, তরী?”

তরী ভড়কালো। লজ্জায় জবুথবু হয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
-“কিছু না।”

মাহমুদের অনুরাগী স্বর,
-“আমি অনেককিছু দেখছি, তরী। এক টুকরো স্নিগ্ধ ভোর, বিলের জলে ফোটে ওঠা রঙিন পদ্ম।
আপনার দু-অক্ষরের ছোট্ট নামটি আমার পাশে চাই তরী। আপনি কেবল আমার তরী হবেন। আপনার হাতটি ধরার সুযোগ দেবেন আমায়?”

তরী কথা খুঁজে পেলোনা। সুখ সুখ যন্ত্রণায় বুকটা ধক করে উঠলো। একটু আগের বিরহ যেন তাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল বহুদূর। সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে বসলো এক মুহুর্তের জন্য। তরী আবেগে ভেসে উঠলো,
-“আমি শুধু আপনার হতে চাই। আপনি ছাড়া আর কারো নয়।”

মাহমুদের চোখ ঝলমল করে উঠলো। প্রশান্তিতে ভরে উঠলো মন। প্রফুল্লচিত্তে হেসে উঠলো। ফিসফিস ধ্বনিতে আওড়ালো,
-“আপনি শুধু আমার, তরী।”

টুপ করেই কল কে*টে গেল। দ্বিতীয়বার কল ব্যাক করার পরও ধরলোনা তরী। মাহমুদ ধরে নিলো হয়তো লজ্জা পেয়েছে নয়তো ঘরে কেউ এসেছে।
তরী ঠিক থাকলে সে সবরকম যুদ্ধে নামতে রাজি।
আজ একবার ভাইয়ার নম্বরে ডায়াল করলো।

-“কিরে কেমন আছিস?”

মাহমুদ শান্ত স্বরে জবাব দিলো,
-“হুম ভালো। তোমরা দুজন কেমন আছো?”

-“আলহামদুলিল্লাহ তোর ভাবি, আমি ভালোই আছি।”

মাহমুদ ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো। সময় নিয়ে নিচু স্বরে শুধালো,
-“কাল একবার তোমরা দুজন আসতে পারবে?”

-“কেন? জরুরি কিছু?”

-“হ্যাঁ, তোমাদের প্রয়োজন।”

-“অফিসের পর আসলে চলবে?”

-“এসো সময় করে।”

-“ঠিক আছে।”

ভাইয়ার সাথে কথা শেষ করে রামির ঘরে একবার উঁকি দিলো মাহমুদ। ছেলেটা পড়তে চায়না মোটেই। এখনো পড়ার টেবিলে উদাস হয়ে বসে আছে। কী যেন ভেবে চলেছে! মাহমুদ নিঃশব্দে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথায় দু’আঙ্গুলে টোকা দিয়ে বলল,
-“পড়া বাদ দিয়ে কী এত ভাবছিস?”

রামির কপালে চিকন দু-একটা ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত স্বরে বলল,
-“আচ্ছা ভাইয়া, তরী আপুকে কিডন্যাপ করলে কেমন হয়? তখন দেখা যাবে আঙ্কেল মেয়ে হারানোর শো*কে রাজি হয়ে যেতে পারে।”

মাহমুদ বলল,
-“ পড়া বাদ দিয়ে এসব ভাবছিস? তোর দুষ্টু বুদ্ধি নিজের মাথায় রাখ। খবরদার আমাদের উপর এপ্লাই করতে আসবিনা। কিডন্যাপ করলে দেখা যাবে তরীর বাবা আমাদের দিয়ে জে*লে*র ঘানি টা*না*চ্ছে*ন!”

রামি ভাবুক হয়ে বলল,
-“তাহলে কী করা যায়?
আমি তরী আপুকে চাই মানে চাই। দরকার পড়লে তাদের দরজায় গিয়ে অনশন ধর্মঘট ঘোষণা করবো।”

বিরক্ত হয়ে তাকালো মাহমুদ।
-“অনশনে তুই ম*র*বি। তাতে তরীর বাবার কী?
তারচেয়ে বরং মন দিয়ে পড়াশোনা কর। এটা কাজে দেবে।”

রামি চোখমুখ কুঁচকে বলল,
-“পড়াশোনা আমার মোটেই ভালোলাগে না। কোন বাসায় কাজের লোক হিসেবে আমাকে রাখবে কি-না খোঁজ নিয়ে দেখো।”

মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কথা বাড়াতে চাইলোনা। এক্ষুণি এখান থেকে যাওয়া উচিত। নয়তো কথা বলেই ছেলেটা সারারাত পার করে দেবে। লম্বা কদমে রামির ঘর ছাড়লো মাহমুদ।

★★★

সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়। বড়োভাই আর ভাবি এসে উপস্থিত। সন্ধ্যার চায়ের আড্ডা বসলো মাহমুদের ঘরে। মা ছাড়া তারা বাকি চারজন উপস্থিত। মাহমুদ তরীর ব্যাপারে কথা তুললো। তাদের সম্পর্কের কথা গোপন রেখে জানালো সে তরীকে পছন্দ করে। এতে তরীর উপর চা*প কম আসবে। মা যেতে চাচ্ছেন না। মাহমুদ চায় এবার সরাসরি সে যাবে, সাথে ভাই-ভাবি। একটা হেস্তনেস্ত সিদ্ধান্ত হবে। তরীকে যে তার বড্ড প্রয়োজন।

#চলবে……..