অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব-১৭+১৮

0
337

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

মাহমুদের একরোখা মনোভাবে বাঁধা সৃষ্টি করলো ভাইয়া। বিচক্ষণ মানুষ গম্ভীর স্বরে বললেন,
-“এখনই আমাদের যাওয়া ঠিক হবেনা। গতকাল মা যেহেতু গিয়েছেন, আমাদের একটু সময় নেওয়া উচিত। এখন গেলে তরীর বাবা উত্তেজিত হয়ে যেতে পারেন।”

মাহমুদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে শুধালো,
-“তাহলে করণীয় কী?”

ইরা বলল,
-“এখনই যেহেতু তরীকে তার পরিবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে না। আমার মনে হয় এখন চুপ থাকা উচিত। কিছুদিন পর নাহয় ঠান্ডামাথায় আরেকবার প্রস্তাব রাখা যাবে।”

মাহমুদ স্বস্তি পেলো না। ভাই-ভাবির কথাও ভেবে দেখলো। এখন যাওয়াটা উচিত হবেনা।
এখন আর চাইলেও তরীকে সামনে পাওয়া যাবেনা। ওর বাবা-মা নিশ্চয়ই এখন আর তাদের বাসায় আসতে দেবেনা। কপাল চেপে ধরলো দু-হাতে। ঝিমঝিম করে উঠলো মাথা।
সকালে ভাইয়ার অফিস থাকায় দ্রুত রাতের খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লো তারা।

★★★
শান্ত, স্নিগ্ধতার প্রতীক হয়ে আসে শরৎ। যৌবনে হেসেখেলে আবেদনময়ী করে তোলে নিজেকে। সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিকের মতো মুগ্ধ হয় মানুষ। শিশিরভেজা শিউলি লুটিয়ে পড়ে দূর্বাঘাসের বুকে। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শরৎ এর এই অনুপম সৌন্দর্যে বিভোর মাহমুদ তরীকে তুলনা করলো শিশিরভেজা শিউলির সাথে। সে দূর্বাঘাস। তার সৌভাগ্য বলে কোমল সুগন্ধি ফুল তার বুকে লুটিয়ে পড়বে কোন একসময়। মেয়েটা তখন কতখানি লজ্জা পাবে ভেবেই হাসলো মাহমুদ। ভাবতে ভাবতেই হাতের কফি ঠান্ডা হয়ে এলো। ঘরে ফিরে ঠান্ডা কফি রেখে দিল। কলেজের জন্য বের হতেই সিঁড়িতে চোখাচোখি হয়ে গেল তরীর বাবার সাথে। মাহমুদ সচারাচর দেখা হলেই সালাম দেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। তরীর বাবা সালামের জবাব দিয়ে পাশ কাটিয়ে উপরে উঠে গেলেন। ভালো-মন্দ কিছু বললেন না। মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে পড়লো। আজকাল একা একাই কলেজ যেতে হয়। তরীর দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তার দেখা পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।

ক্লাস শেষ দিয়ে ক্লান্ত মাহমুদ ঘন্টার পথ পাড়ি দিলো। বাস জার্নি করে দাঁড়ালো তরীর ক্যাম্পাসের সামনে। রোদের তেজ ম্লান হয়ে এলেও গরম পড়ছে খুব। শার্টের টপ বোতাম দুটো খোলা। ক্লান্তি এসে ভর করেছে চোখ দুটোতে। পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে গেল। তরীর দেখা পাওয়া গেল না। মাহমুদের শিথিল কপালে ঢেউ বয়ে গেল। পকেট হাতড়ে মুঠোফোন বের করে চাপলো তরীর নম্বরে। রিং হতে হতে শেষ মুহূর্তে ফোন ওঠালো তরী। নিস্তেজ কন্ঠে বলল,
-“হ্যালো।”

মাহমুদের সমস্ত গ্লানি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। শীতল বাতাস শরীর ছুঁয়ে দিলো যেন। থেমে থেমে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
-“কোথায় আপনি, তরী?”

তরী চুপ করে রইলো খানিকক্ষণ। শোনা গেল শ্বাস-প্রশ্বাসের নমনীয় শব্দ। সাড়া না পেয়ে মাহমুদ ফের বলল,
-“ক্যাম্পাসে দেখছি না কেন আপনাকে?”

এতক্ষণে তরীর মৃদু স্বর ভেসে এলো,
-“আজ ক্লাস এটেন্ড করিনি।”

-“আমি ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”

তরীর উৎকণ্ঠা টের পেলো মাহমুদ।
-“আপনি আমাকে না জানিয়ে কষ্ট করে কেন গেলেন?”

মাহমুদ তরীর অস্থিরতায় হাসলো।
কাতর গলায় শুধালো,
-“আমি ভীষণ ক্লান্ত, তরী। একটু দেখা দেবেন?”

তরী কিছু বললনা। খট করেই লাইন কে*টে দিল। মাহমুদ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। ফোন পকেটে ঢুকানোর কোন তাড়া নেই। কিছু একটার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরই তরীর নম্বর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। ঠোঁটের কোন চওড়া হলো মাহমুদের। যেন সে জানতো তরী দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ঠিকই তাকে কল দেবে। এক ঝলক দেখা দিয়ে তৃষ্ণা মেটাবে। রিসিভ করতেই তরীর শুভ্র মুখশ্রী ভেসে উঠলো। গভীর চোখজোড়া তাকেই দেখছে। খানিকটা দ্বিধা, খানিকটা লজ্জার মিশেলে মোহনীয় রূপ সৃষ্টি হলো। মাহমুদ বিভোর নয়নে চাইলো। তরীর চিকন ঠোঁট জোড়া নড়েচড়ে উঠলো,
-“ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। দুপুরে খেয়েছেন?”

তরীর এই যত্ন টুকু ভীষণ আদুরে আদুরে ঠেকলো মাহমুদের কাছে। সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে একটুখানি সতেজ বাতাস ছুঁয়ে দিলো শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। নিজেকে কেমন সুখী সুখী মনে হলো। ছোটো স্বরে জবাব দিলো,
-“নাহ্, কলেজ থেকে আপনার ক্যাম্পাসে চলে এসেছি।”

তরীর ভীষণ দুঃখ দুঃখ লাগলো। কাতর চোখজোড়া টলমল করে উঠলো। মাহমুদ হাসলো। নিস্তেজ গলায় বলল,
-“এতটা মায়া দেখাবেন না, তরী। আমি যে আর দূরে থাকতে পারবোনা।”

তরীর এলোমেলো চোখজোড়া কিছু বলতে চাইছে। সময় নিয়ে অধিকার খাটিয়ে বলল,
-“তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরুন। এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”

মাহমুদ বাধ্য ছেলের মতো মাথা ঝাঁকাল। প্রফুল্লচিত্তে লাইন ডিসকানেক্ট করে পকেটে ঢুকালো। বাস ধরলো। বাস কন্ট্রাক্টরের হাঁকডাঁকের বিরক্তিও আজ তাকে ছুঁতে পারলোনা। জানালায় উঁকি দিয়ে আকাশে তাকালো। রাশি রাশি শুভ্র মেঘ পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। মাহমুদ বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখের পাতা এক করে নিলো। চোখজুড়ে তরী, শুধুই তরী।

★★★

ছোট্ট অরু ড্যাবড্যাব করে তরীকে দেখছে। তরীর নজরে পড়লো অনেকক্ষণ ধরেই অরু তাকে দেখছে। সে ভুরু উঁচিয়ে শুধালো,
-“কী?”

অরু ভাবুক হয়ে বলল,
-“তোমার কি বিয়ে হয়ে যাবে?”

-“কে বলল তোকে?”

-“আমি জানি। তোমার বিয়েতে আমি কিন্তু নাচবো। অনেক আনন্দ করবো।”

তরী বলল,
-“বিয়ে হলে তো আমি শশুর বাড়ি চলে যাবো। তখন কী করবি?”

অরু কোমরে একহাত রেখে হাত নাড়িয়ে বলল,
-“ওমা তুমি তো আবার আসবেই!”

ছোট্ট তরী বুঝলোনা বিয়ে মানে কী। শুধু বুঝলো আপুর বিয়ে হলে সে খুব আনন্দ করতে পারবে।
তরী বলল,
-“এখন চল ঘুম পাড়িয়ে দিই।”

অরু বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তরী হাত বুলিয়ে দিলো তার মাথায়। বেশিক্ষণ লাগলোনা, অরু ঘুমিয়ে পড়লো।
তরীর চোখে ঘুম নেই। ফোন হাতে বসে রইলো। মুঠোফোনে তীব্র শব্দ হতেই ভাবলো মাহমুদ বুঝি তাকে স্মরণ করেছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই হাসি হাসি মুখটি ম্লান হয়ে গেল।
“তিয়াস ভাইয়া” নামটা জ্বলজ্বল করে উঠতেই তরী চমকে উঠলো। বুকের ভেতর বিষাক্ত এক যন্ত্রণা হলো। রিসিভ করার ইচ্ছে হলোনা তার। প্রথমবারেই কল কে*টে গেল। দ্বিতীয়বার কল বাজার পর তরীর মনে হলো একবার কথা বলা উচিত। তিয়াস ভাইয়াকে সে বিয়ে করতে পারবেনা ব্যাপারটা খুলে বলতে পারলে হয়তো তিনি বুঝবেন। লম্বা শ্বাস নিলো তরী। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কল রিসিভ করলো।
ভেসে এলো পুরুষালি স্বর। কোমল হয়ে শুধালো,
-“ কেমন আছো তরী?”

তরী ওই কোমল স্বরে কোন অনুভূতি খুঁজে পেল না। তার সমস্ত আবেগ, প্রেম ওই একজনের জন্যই। তরী স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,
-“ভালো।”

-“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না?”

তরী তিয়াসের প্রশ্নের জবাব দিলোনা। মেজাজ খা*রা*প হলো তার। কন্ঠের ভিত মজবুত রেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো।
-“তুমি আমায় তুমি করে কেন ডাকছো, ভাইয়া?”

তিয়াস বোধহয় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেল। নিজেকে সামলাতে তার খনািক সময় লাগলো। বলল,
-“এখন কি আর তুমি ছোটো আছো? বড়ো হয়েছো না?”

তরীর রাগ ধীরে ধীরে বাড়লো। চোখমুখ শক্ত করে বলল,
-“বড়ো হই আর ছোটো। তুমি আমায় তুই করেই ডাকতে। ছোটোবেলায় বোনের মতো কোলেপিঠে চড়িয়েছো। নিশি আপু তো আমার বড়ো, তাহলে তাকে কেন তুমি ডাকছো না?”

-“নিশি আর তুমি কি এক হলে?”

-“কেন নয়?”

-“তুমি কি বুঝতে পারছোনা, তরী?”

তরী কন্ঠস্বর উঁচু করলো,
-“কী বুঝবো আমি? আমি জানি তুমি আমার বড়োভাই। ব্যস, এই সুন্দর সম্পর্কে কেন অন্য সম্পর্ক টা*ন*ছো? তোমায় নিয়ে অন্যকিছু ভাবতে আমার লজ্জা হয় বিশ্বাস করো।”

-“সময়ের ব্যাপার তরী। সবটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
তিয়াস হয়তো ভাবছে তরী লজ্জা পাচ্ছে। অথচ এটা বুঝলোনা তরীর মন তাকে ঠাঁই দিতে নারাজ।
খট করে লাইন কে*টে ফোন সুইচ অফ করে রাখলো তরী। ঝিম মে*রে শুয়ে রইলো। পাগল হয়ে যাচ্ছে সে।

মাহমুদ ফোনে ট্রাই করলো তরীকে। ফোন সুইচ অফ বলছে। চিন্তা হলো তার। একবার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। খোলা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তরীকে আবারও ট্রাই করলো। বারবার সুইচ অফ দেখাচ্ছে। মাহমুদের মন উতলা হয়ে উঠলো। তরী যদি তার হয়ে যেতো, তবে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতো তাকে। চাইলেই যে সবটা সম্ভব হয়না।
কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নেমে পড়লো সে।

★★★

দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজির ক্লাস নিয়ে বের হলো মাহমুদ। ফোনের স্ক্রিনে তরীর বার্তা। চোখ রাখলো মাহমুদ। বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁয়ে দিতেই বার্তাটি স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো।

❝আমার ভার্সিটির পাশের কফিশপে আসতে পারবেন? আমি ক্লাস শেষে অপেক্ষা করবো।❞

তরী তাকে ডেকেছে! দিন দিন তরীর এই পরিবর্তন মাহমুদকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। বুঁদ হয়ে থাকতে চায় তার ডিঙি নৌকার মাঝে। মাহমুদ তরীর স্বাভাবিক কথাতেও কেমন ভালোবাসা খুঁজে পায়। সে হাসে, কারণে-অকারণে।

#চলবে…….

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

শরৎ এর কোমল, স্নিগ্ধ বিকেলে আকাশে কালো মেঘ জমলো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি প্রেমময় অনুভূতির বার্তা পাঠালো। মাহমুদের সামনে সাদা জামায় আচ্ছাদিত এক লাজুক রমণী। লজ্জায় হেলেদুলে পড়া রমণীকে মুহূর্তেই কাশফুল মনে হলো। যে মৃদু বাতাসে নিপুণ তালে হেলেদুলে নেচে ওঠে। কাশফুল শুভ্রতার প্রতীক। তরীও ঠিক শুভ্রতায় মোড়ালো নিজেকে। আঁটসাঁট করে বাঁধা চুলগুলো খানিকটা ঢিলে হয়ে কানের পাশ গড়িয়ে বেরিয়ে এলো। তরী হাত বাড়িয়ে সেগুলো কানের পাশে গুঁজে নিলো। সামনেই মাহমুদ তাকে দেখে চলেছে। অথচ সে মাহমুদকে ডেকে আনার যথাযথ কারণটি বলতে পারছেনা। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকা মাহমুদ কোন তাড়া দেখালোনা। তরী ঠোঁট ভেজালো। নিজেকে ধাতস্থ করে শক্ত গলায় বলল,
-“কাল তিয়াস ভাইয়া কল দিয়েছেন।”

মাহমুদের দৃষ্টি নড়ে উঠলো। ভুরু উঁচিয়ে শুধালো,
-“তিয়াস কে?”

তরী শান্ত চোখে তাকালো মাহমুদের চোখে। হুট করেই কেমন তার সাহস বেড়ে গেল৷ আজকাল মাহমুদকে দেখলেই তার অস্বস্তি হয়না। তবে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। আজ তেমন কিছুই ঘটছেনা। স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,
-“বাবা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছেন! মানে আমার কাজিন।”

মাহমুদের চোয়ালে কঠিন হয়ে উঠলো। কপালের পাশ ঘেঁষে নীল রঙা রগগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শান্ত, শক্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
-“কী বলেছে?”

-“তুই থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।”

শান্ত মাহমুদ রা*গ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় নামলো। চোখ বুজে হেলান দিয়ে বসলো। মিনিট দুয়েক পার হতেই ধপ করে চোখের পাতা খুলে বসলো। একেবারে শান্ত, যেন কিছুই হয়নি। মাহমুদ বলল,
-“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

তরীর রা*গ হলো। মানুষটা কিভাবে এতটা শান্ত আছে! তার কী রাগ বলতে কিছুই নেই? ফোঁস করেই নিশ্বাস ছাড়লো। মাহমুদকে আর কিছুই বলার প্রয়োজন মনে করলোনা। কফি প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছে। তরী ঢকঢক করে গিলে নিলো। মাহমুদ শান্তভাবে তাকিয়ে আছে। তাকে কিছু না বলেই তরী হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো কফিশপ থেকে। মাহমুদ পিছুপিছু গেলোনা। বসে রইলো আরও ঘন্টাখানেক।

★★★

বেলা গড়াবার সাথে সাথে দূর দিগন্তে সূর্য ডুবি ডুবি। নীল আকাশে সাদা-কালো মেঘের ভেলায় ঝুপ করেই ছড়ালো লালিমা আস্তরণ। এগিয়ে এলো সন্ধ্যা। ঘন হলো অন্ধকার। মাগরিবের নামাজ আদায় করে মসজিদ থেকে বের হলেন তরীর বাবা। পাশাপাশি এগিয়ে এল মাহমুদ। সালাম বিনিময় করে ভালোমন্দ খোঁজ নিলো।
তরীর বাবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। রাশভারি গলায় বললেন,
-“কিছু বলতে চাও? তরীর ব্যাপারে হলে আমি শুনতে চাইছিনা।”

মাহমুদ দুর্বোধ্য হাসলো। পথটা সুন্দরভাবে পরিষ্কার হয়ে গেল। তাকে কোন ছুতা খুঁজতে হলোনা। তরীর বাবা নিজেই তরীর কথা তুললেন। মাহমুদ নম্র ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
-“তরীর নাকি বিয়ে ঠিক?”

-“হ্যাঁ, শোনোনি তোমার মায়ের কাছে?”

মাহমুদ মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো,
-“জি শুনেছি।”
অতঃপর প্রশ্ন করলো,
-“তরী কি বিয়েতে রাজি?”

তরীর বাবার এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা বিরক্তি এবার রা*গে পরিণত হলো। রাগত স্বরে বললেন,
-“সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তরী আমার মেয়ে। ওকে চিনি আমি। আমার উপর কখনো কথা বলবে না আমার মেয়ে।”

মাহমুদ হালকা হাসলো। তরীর বাবা জ্বলে উঠলেন।
-“হাসছো কেন?”

-“এই যে আপনার কঠিন আত্মবিশ্বাস নিজের প্রতি! যে আত্মবিশ্বাসের বলে সন্তানের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন। একবারও তার মতামত জানার প্রয়োজন মনে করলেন না। আপনি জানেন আপনার মেয়ে কখনো আপনার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলবেনা। এটাকে পুঁজি করেই যা ইচ্ছে করতে পারবেন, কিন্তু ভেতর থেকে মেয়েটাকে পড়তে পারবেন না। একসময় নিজের দুঃখগুলো বলার জন্যেও তখন মেয়েটা আপনাদের ভরসা করবে না।”

-“আমি তরীর বাবা। তার জন্য যেকোন সিদ্ধান্ত আমি অনায়াসে নিতে পারি। তাছাড়া তোমার সমস্যা কোথায়, আমি বুঝলাম না।”

-“ভুল কিছু বলে থাকলে ক্ষমা করবেন আঙ্কেল।
তরীকে আমি পছন্দ করি। তাই তার মতামত জানাটা আমার জন্য জরুরি।”

তরীর বাবার মনে হলো এতদিন নম্র-ভদ্র ছেলে বলে যাকে জানতেন, সে এক নি*র্ল*জ্জ ছেলে। কিভাবে মুখের উপর বলে দিলো সে তরীকে পছন্দ করে! বি*স্ফো*রণ ঘটলো যেন!
মাহমুদ মাথানিচু করে আছে। এতটুকু নি*র্ল*জ্জ না হলে যে তরীকে আর পাওয়া হবে না।
তরীর বাবা চোয়াল শক্ত করে বললেন,
-“তুমি কি আমার মেয়ের বিয়েতে বাঁধা দিতে চাইছো?”

-“আমি শুধু তরীর মতামত জানতে চেয়েছি।”

তরীর বাবা তীব্র আ*ক্রো*শে ফেটে পড়লেন। নিজেকে ঠান্ডা রা*খা*র চেষ্টা করে বললেন,
-“তোমার সাথে আমাদের কোন শ*ত্রু*তা নেই। শুধু শুধু ঝা*মে*লা করোনা। দ্রুত অন্য বাসা দেখো।”

লম্বা কদম ফেলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পার করে নিলেন তরীর বাবা। মাহমুদ অলস ভঙ্গিতে ঘরে ফিরলো।
তরীকে শান্তনা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতি যে হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। তরীর বাবা নিজ জায়গা থেকে ঠিক। ভাইকে কথা দিয়ে তার খেলাপ করতে পারবেন না তিনি। কিন্তু অন্যদের চোখে উনার একটা ত্রুটি স্পষ্ট। সেটা হলো মেয়ের মতামত না নেওয়া।
মাহমুদ বুঝলো খুব সহজে তরীর বাবা মানবেন না। তবে সেও এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না। অজান্তেই তরী তার হয়ে বসে আছে। মাহমুদের দায়িত্ব তাকে ধরে রাখা। শক্ত বন্ধনে আটকে রাখা।

★★★

ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলো তরী। বাসার পরিবেশ বেশ রমরমা। বড়ো চাচা-চাচি সহ অনেকেই উপস্থিত। তরীকে দেখে চাচি এগিয়ে এলেন। আদুরে স্বরে আফসোস করলেন,
-“আমার মেয়েটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দেখো ঘামে ভিজে কী অবস্থা!”

তরী সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেল। অন্য সময় হলে চাচির এই আদরটুকু সে অনায়াসে লুফে নিতো। এখন কেমন যেন স্বা*র্থ মনে হয় সবকিছু।
গোসল সেরে বসতেই মিঠু হুড়মুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। তরী ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-“কী হয়েছে?”

মিঠু একবার পেছনে দরজার দিকে তাকালো। দরজা ভিড়িয়ে সাবধানে এসে দাঁড়ালো তরীর পাশে। সরল চোখে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি কিছু বলবে না?”

তরীর বোধগম্য হলো না মিঠুর কথা। জিজ্ঞেস করলো,
-“কী বলবো?”

-“তুমি কি সত্যিই তিয়াস ভাইয়াকে বিয়ে করে নিবে? তাহলে মাহমুদ ভাইয়া?”

তরী আৎকে উঠলো। মিঠু কি মাহমুদের কথা জেনে গিয়েছে? তপ্ত শ্বাস ছেড়ে পাশে বসলো মিঠু। হুট করেই কেমন বড়ো হয়ে গেল ছেলেটা। ভরসার গলায় বলল,
-“আমি বাবা-মাকে কিছু বলিনি আপু।”

তরী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
-“কী করবো আমি? বাবা যদি জানে আমিও মাহমুদকে পছন্দ করি, তাহলে আরও আগেই মানবেন না। প্রেম-ভালোবাসার বিয়ে বাবার পছন্দ নয়।”

-“তাই বলে চুপ করে থাকবে? আজ বড়ো চাচা আর চাচি কেন এসেছে জানো?”

তরী প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। মিঠু বলল,
-“বাবা খবর দিয়ে এনেছেন। আজ না-কি তোমাকে রিং পরিয়ে যাবে।”

তরীর দুনিয়ায় ঘুরে উঠলো। চোখেমুখে বিস্ময়ের সাথে সাথে স্থান নিয়েছে আতঙ্ক।
হঠাৎই মায়ের আগমন।
-“দুজন এখানে কী গল্প জুড়েছিস? তরী একটা নতুন জামা পরে তৈরি হয়ে বাইরে আয়। মিঠু তোকে তোর বাবা ডাকছে।”

মিঠু বেরিয়ে যেতেই মা আলমারি থেকে একটা জামা বের করে দিলেন। তরী এখনো ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মায়ের সাথে জামা পরে বেরিয়ে এল বসার ঘরে। এক এক জনের আদর ভালোবাসা আজ আদিখ্যেতা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। চাচি তরীর হাত টে*নে রিং পরিয়ে দিলেন বিনা বাক্যে। তরী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। সবার দু-একটা কথা কানে বেজে চলেছে। তার মধ্যে চাচি বেশ হেসে হেসেই বললেন,
-“আমাদের তরীটা যে এখনো ছোটোবেলার মতোই লাজুক রয়ে গিয়েছে। তিয়াসের সাথে কথা বলতেও নাকি লজ্জা পায় মেয়েটা। সমস্যা নেই। সামনের সপ্তাহে ফোনে বিয়েটা হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তরীর বাবা বললেন,
-“হ্যাঁ আপাতত বিয়েটা হয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত। তিয়াসও দেশে ফিরুক আর তরীরও পড়াশোনা শেষ হোক। তখন নতুন করে সব আয়োজন করা যাবে। আজকাল মানুষের বিশ্বাস নেই। তিনতলার ছেলেটা হয়তো ঝা*মে*লা বাঁধাতে পারে!”

তরীর আজ চমকে যাওয়ার দিন। একের পর এক শক সে নিতে পারছেনা। সামনের সপ্তাহে বিয়ে মানে কী?
মাথা ঘুরে উঠলো তার। তরী কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। মা ব্যাপারটি খেয়াল করে জিজ্ঞেস করলেন,
-“শরীর খা*রা*প লাগছে?”

তরী হ্যাঁ সূচক মাথা দুলালো। বড়ো চাচা বললেন,
-“মেয়েটা জার্নি করে এসেছে। যাও বিশ্রাম নাও।”

তরী উঠে গেল। সন্ধ্যা নাগাদ সবাই বাসায় ফিরে গেলেন। মিঠু অনেকক্ষণ ধরেই বাসায় নেই। মাহমুদকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। রিং হচ্ছে কিন্তু রেসপন্স নেই। রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়লো তরী। সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাদে উঠলো। বুকের ভেতর হাউমাউ কান্নার শব্দ হলো। বাইরের জগতের কাকপক্ষী ও জানতে পারলোনা। নিরবে চোখের জল গড়ালো। পেছন থেকে শান্ত স্বর শোনা গেল,
-“কাঁদছেন কেন, তরী?”

#চলবে……..