#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|১৩|
সপ্তাহ দুই পরের কথা।
কিছু নোটসের জন্য অর্নি নূরদের বাসায় যায়। সারা বিকেল দুই বান্ধবী জমিয়ে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ আনিতা বের হয় বাসায় যাওয়ার জন্য। রুম থেকে বের হতেই উৎসবের সাথে ধাক্কা লাগে অর্নির। উৎসব ছোট্ট করে ‘স্যরি’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। যা মোটেও হজম হলো না অর্নির। যে ছেলে অর্নিকে দেখলেই একপ্রকার দৌড়ে আসে ওর সাথে কথা বলার জন্য, সবসময় ওর আশেপাশে থাকে। আজ সেই ছেলে এভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো? একবার চোখ তুলে তাকালোও না? ব্যাপারটা ভালো লাগছে না অর্নির। অর্নিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নূর বললো,
–“দাঁড়িয়ে পড়লি যে?”
নূরের কথায় অর্নি সম্বিত ফিরে। নিচে নেমে নূরের আম্মুকে বিদায় জানিয়ে চলে আসতে নিলেই অর্নিকে আটকে দেন উনি৷ রাতের খাবার না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না। অগ্যতা অর্নিকে থাকতেই হলো।
রাতের খাবার শেষে অর্নি আর নূর সোফায় বসে আছে৷ অর্নি আড়চোখে উৎসবকে দেখছে৷ খাবার টেবিলে দুজনে মুখোমুখি বসেছিলো। কিন্তু তখনো একবারের জন্যও অর্নির দিকে তাকায়নি৷ কোনোরকম কথা বলার চেষ্টাও করেনি৷ যা অর্নির একদমই ভালো লাগছে না। চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে৷ অর্নিদের থেকে কিছুটা দূরের একটা সোফায় বসে একমনে ফোন দেখছে উৎসব। অর্নি আড়চোখে তাকাচ্ছে বারবার। নূর মৃদু হেসে বললো,
–“লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়াকে দেখছিস?”
চমকে তাকালো অর্নি। নূর মুচকি হাসলো। অর্নি তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
–“তোর ভাই আজকাল কেমন পাল্টে গেছে না?”
নূর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
–“কেন?”
–“আগে উৎসব ভাই আমাকে দেখলে কথা বলতে আসতো, বারবার দেখতো আমাকে। আর এখন না কথা বলছে না ভুলেও একবার তাকাচ্ছে।”
অর্নির আড়ালে নূর হাসলো। বললো,
–“ভাইয়া তোর সাথে কথা না বলাতে তোর খারাপ লাগছে? ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবকিছু?”
অর্নি উৎসবের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবেই বললো,
–“হ্যাঁ__”
–“সত্যি?”
নূরের কথায় হুশ ফিরলো অর্নির। দ্রুত বললো,
–“না মানে__”
–“তাহলে আর কি? তুই তো আর ভাইয়াকে ভালোবাসিস না। তো ভাইয়া শুধু শুধু তোর পেছনে কেন পড়ে থাকবে? তুই চাস না ভাইয়া তোকে ভালোবাসি বলুক, তাই ভাইয়া তোকে বিরক্ত করা ছেড়ে দিয়েছে। তুই তোর মতো থাক, আর ভাইয়া ভাইয়ার মতোই থাকুক।”
অর্নি শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো নূরের দিকে। নূর এবার অর্নির আরো কিছুটা কাছে গিয়ে বললো,
–“দোস্ত জানিস, ইশা আপু ভাইয়াকে প্রচুর ভালোবাসে। যে করেই হোক এবার ইশা আপুর সাথেই ভাইয়ার প্রেমটা আমি করিয়ে দিবো।”
অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো নূরের দিকে। জিজ্ঞেস করলো,
–“এই ইশাটা আবার কে?”
–“বড় চাচার মেয়ে, কালই আসবে আমাদের বাড়িতে। ভাইয়া বিডিতে ব্যাক করেছে শোনার পর থেকেই পাগল হয়ে আছে এখানে আসার জন্য। কিন্তু এক্সামের জন্য আসতে পারেনি। ফাইনালি কাল আসবে।”
অকারনেই ইশা মেয়েটাকে অর্নির সহ্য হচ্ছে না। বিশেষ করে এই বাড়িতে এসে থাকবে সেটা অর্নির মোটেও ভালো লাগছে না। নূর অর্নির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। বললো,
–“ইশা আপু কাল আসলে আমি বলবো ভাইয়াকে প্রপোজ করতে। আই হোপ, ভাইয়া রাজি হয়ে যাবে। কয তুই তো আর ভালো__”
নূরকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো অর্নি। থমথমে গলায় বললো,
–“বাড়ি ফিরবো, আসছি।”
নূরের আম্মু কথাটা শুনতে পেয়ে বললো,
–“একটা মার খাবি, একা যাবি নাকি? দাঁড়া উৎসবকে বলছি আমি।”
–“না আন্টি, দুটো গলি পরেই তো বাসা। আমি একাই যেতে পারবো৷”
নূরের আম্মু অর্নির কথার কোনো তোয়াক্কা করলেন না৷ উৎসবকে ডেকে বললেন অর্নিকে দিয়ে আসতে৷ উৎসবও আম্মুর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ালো৷ উৎসব বেরনোর আগে নূরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“নূর, তোর ফ্রেন্ডকে আসতে বল৷”
এইটুকু বলেই উৎসব চলে গেলো৷ নূর অর্নিকে ভালো করে লক্ষ্য করছে৷ নূরের হাসি পাচ্ছে বেশ অর্নিকে দেখে৷ অর্নি বললো,
–“দেখলি? উৎসব ভাই কিভাবে চলে গেলো? তোর মাধ্যমে আমাকে যেতে বলছে। কই আগে তো এরকম করতো না। আগে তো কথা বলে বলে আমার কানের পোকা বের করে ফেলতো। আর আজ, আজ দেখলি__”
অর্নির এরকম সব প্রশ্নে নূর ঠোঁট চেপে হাসলো। বললো,
–“আগে তো তোকে ভালোবাসতো, এখন তো আর___”
–“ভালোবাসে না তাই না?”
–“তাই তো মনে হচ্ছে।”
অর্নির কাঁদোকাঁদো চেহারা দেখে নূরের বেশ হাসি পাচ্ছে৷ নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
–“ভাইয়া বাইরে অপেক্ষা করছে তো, যা।”
অর্নি কিছু না বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। অর্নি যেতেই নূর ফিক করে হেসে দিলো। বিড়বিড় করে বললো,
–“ফাইনালি আমার ভাইটাকে ভালোবাসতে শুরু করলি। ভাইয়া যখন জানবে তুইও ভাইয়াকে ভালোবাসতে শুরু করেছিস, তখন তো ভাইয়ার জ্বালাতন আরো বেড়ে যাবে। বি রেডি ডিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড, উপস্ স্যরি ডিয়ার উডবি ভাবী।”
–
অর্নি বের হতেই উৎসব গাড়ির দরজা খুলে দিলো৷ অর্নি জোরে শব্দ করে গাড়ির দরজা লাগিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা লাগালো। উৎসব নিজেও অর্নির পিছু নিলো। দুজনেই চুপচাপ হাঁটছে। অর্নি নিজেই নিরবতা ভেঙে বললো,
–“আপনি বাসায় ফিরে যান উৎসব ভাই। এইটুকু পথ আমি একাই যেতে পারবো।”
উৎসব সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
–“আম্মু বাসায় দিয়ে আসতে বলেছে, মাঝপথে ছেড়ে যেতে বলেনি।”
অর্নি শান্ত চোখে তাকালো উৎসবের দিকে। বললো,
–“শুধু আন্টি বলেছে বলে?”
উৎসব হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অর্নির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তা নয়তো কি?”
–“কিছু না।”
বলেই অর্নি আবার হাঁটতে শুরু করলো৷ বেশ কিছুটা সময় আবারো নিরব থাকলো দুজনে। এবারেও অর্নি নিরবতা ভেঙে বললো,
–“আপনার কি হয়েছে উৎসব ভাই?”
উৎসব কপাল কুঁচকে বললো,
–“কিছু না তো।”
–“পালটে গেছেন অনেক।”
উৎসব কোনো জবাব দিলো না। অর্নিও জবাবের আশা করলো না আর। কয়েকদিন যাবত উৎসবের নিরবতা ওকে বড্ড পোড়াচ্ছে৷ তবে কি অর্নি___আর ভাবতে পারলো না কিছু। অর্নির মনে হচ্ছে খুব কাছের কিছু অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে বাসার কাছে এসে পড়েছে ওরা। অর্নি উৎসবের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কয়েক সেকেন্ড কেটে যায় এভাবেই৷ অর্নির দু হাত কচলাচ্ছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও পারছে না। উৎসব সেই সবটা খেয়াল করলো খুব মনোযোগ সহকারে। তারপর বললো,
–“কিছু বলবে?”
অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“আ্ আসছি।”
উৎসব ছোট করে ‘হুম’ বললো। অর্নি আসছি বলেও দাঁড়িয়ে থাকলো সেখানে। বললো,
–“ভি্ ভিতরে চলুন না___”
–“ইট’স ওকে, আসছি আমি।”
বলেই উৎসব উলটো ঘুরে দু কদম এগোলো। অর্নি পিছু ডেকে বললো,
–“শুনুন।”
অর্নির ডাকে থেমে যায় উৎসব। অর্নির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি তাক করে বললো,
–“কিছু বলবে?”
আনিতা দু দিকে মাথা ঝাকিয়ে না বোঝায়। উৎসব আবারো চলে যেতে গেলেই অর্নি বললো,
–“আপনার কিছু বলার নেই?”
–“কি বলবো?”
–“যে কোনো কিছু, কিছুই কি বলার নেই?”
–“উঁহু।”
উৎসবের জবাবে অর্নি একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে এক ছুটে বাসার ভিতর চলে গেলো। অর্নির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উৎসব বাঁকা হেসে বললো,
–“সোজা পথে কাজ না হলে কিছু কিছু সময় বাঁকা পথেই যেতে হয় মিস অর্নি। খুব বেশি দেরী নেই তুমি নিজে আমার কাছে আসবে, আমাকে ভালোবাসি বলবে। সেই মূহুর্তটার অপেক্ষায় আছি আমি।”
কথাগুলো একা একা বলেই আবার উলটো ঘুরে বাড়ির পথে হাঁটা লাগালো উৎসব৷
–
বাসায় ফিরে সবেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো উৎসব। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ এলো। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো নূর দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো উৎসব। নূর ভিতরে ঢুকে বিছানায় বসে বললো,
–“অর্নি কিছু বললো ভাইয়া?”
–“তোর ফ্রেন্ড এত সহজেই মুখ ফুটে মনের কথা বলবে বলে তোর মনে হয়?”
নূর ক্ষানিকটা সময় নিরব থেকে বললো,
–“এভাবেই আগাও, দেখবে বেশি সময় আর ওয়েট করতে হবে না। ঠিকই এসে ভালোবাসি বলবে।”
–“দেখা যাক কি হয়।”
কথাটা বলে উৎসব নূরের চুলে বিলি কেটে দিলো। নূর ভাইকে ঘুমাতে বলে চলে গেলো নিজের রুমে।
–
দুটো ক্লাস শেষে মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে নূর রুশান আর অর্নি। অর্নির অবশ্য আড্ডায় মন নেই৷ ওর মাথায় শুধু উৎসবের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। ও মানতে পারছে না ছেলেটা এভাবে বদলে গেছে। হঠাৎই অর্নির চোখ আটকায় দূরে বটগাছের নিচে বসা উৎসব আর একটা মেয়ের দিকে। অর্নি কিছু সময় সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। নূরকে বলে,
–“তোর ভাইয়ের সাথে ওই মেয়েটা কে রে নূর?”
নূর একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। তারপর বেশ খুশি মনে বললো,
–“তোকে তো একটা কথা জানানো হয়নি অর্নি।”
অর্নি সেদিকে কোনো পাত্তা দিলো না। একদৃষ্টে উৎসব আর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে৷ নূর আবারো নিজের মতো করেই বললো,
–“ওটা ইশা আপু, কাল রাতেই এসেছে। ভাইয়া নিজে গিয়ে রিসিভ করেছে ইশা আপুকে৷ কি সুন্দর না ইশা আপু? ভাইয়ার সাথে মানাবে সুন্দর বল? জানিস দুজনে যখন একসাথে বাসায় ঢুকেছে, ইশ্ কি কিউট লেগেছে। দুজনকে একসাথে এত্ত ভালো___”
অর্নির নূরের উপর রাগ হলো বেশ৷ ক্ষানিকটা উঁচু গলায় বললো,
–“এইসব আজাইরা প্যাঁচাল পারবি না আমার সামনে৷ কোনো ইশার টিশার কথা শুনতে ইচ্ছুক না আমি।”
নূর মুচকি হাসলো৷ অর্নিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“আহা! শোন না, ইশা আপু বলছে আজই ভাইয়াকে প্রপোজ___”
অর্নি নিজেকে নূরের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
–“চুপ, একদম চুপ। একটা কথাও বলবি না আর।”
কথাটা বলে অর্নি নিজেই সেখান থেকে উঠে চলে গেলো৷ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নূর আর রুশান ফিক করে হেসে দিলো৷
–
লাইব্রেরীতে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে অর্নি। চোখদুটো বইয়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও মস্তিষ্কে উৎসব আর ইশার কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ইশা কি সত্যিই আজ উৎসবকে প্রপোজ করবে? উৎসব কি রাজি হবে? তবে কি উৎসব অর্নিকে ভালোবাসে না? এরকম হাজারো চিন্তা মাথায় ঘুরছে৷ অর্নি আর না পেরে ঠাস করে বই বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখলো৷ সেল্ফে বইটা রেখে বেরিয়ে পড়লো লাইব্রেরী থেকে। উদ্দেশ্য বাসায় ফিরবে এখন। তাই নূর আর রুশানকে টেক্সট করে জানিয়ে দিলো ও বাসায় যাচ্ছে।
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে অর্নি। এমন সময় দেখলো রাস্তার অপর প্রান্তে উৎসব আর ইশা। রাস্তা পার হচ্ছে দুজনে। ইশা উৎসবের একটা বাহু ধরে আছে৷ তা দেখে ধপ করেই অর্নির মাথায় আগুন জ্বলে গেলো৷ রাগে গাঁ রিঁ-রিঁ করছে। ইচ্ছে করছে ওখানে গিয়ে ইশাকে কষে দুইটা থাপ্পড় মারতে৷ ইচ্ছাটাকে নিজের মাঝেই চেপে রাখলো অর্নি। একটা রিকশা ডেকে দ্রুত উঠে পড়লো রিকশায়। রিকশা চলতে শুরু করেছে। অর্নি আরো একবার পিছু ফিরে উৎসবের দিকে তাকালো রাগান্বিত চোখে।
চলবে~
#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|১৪|
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে অর্নি। কিছুতেই ঘুম ধরা দিচ্ছে না চোখে। বড্ড অস্থির অস্থির লাগছে। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে৷ তাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো এক মগ কফির জন্য। বেশ কিছুক্ষণ পর কফির মগ হাতে ব্যালকোনিতে গিয়ে দাঁড়ালো অর্নি। দৃষ্টি দূর আকাশে। কিছুক্ষণ বাদে বাদে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। হঠাৎই উৎসবের কথা মনে হলো ওর। উৎসবের এমন হঠাৎ বদলে যাওয়াটা ও মানতে পারছে না। উৎসবের নিরবতা ওকে ভীষণ ভাবে কষ্ট দিচ্ছে। রুম থেকে ফোন এনে নূরের নাম্বারে ডায়াল করলো। নাম্বার বিজি পেয়ে বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ করলো। বেশ কিছু সময় বাদে নূর কলব্যাক করলো৷ দ্রুত ফোন রিসিভ করলো অর্নি। নূর জিজ্ঞেস করলো,
–“স্যরি দোস্ত, আসলে শান্ত’র সাথে কথা বলছিলাম তো তাই তোর ফোনটা ধরতে পারিনি।”
অর্নি উদাস কন্ঠে বললো,
–“ইট’স ওকে৷ আমারই বোঝা উচিত ছিলো তোর আর শান্ত ভাইয়ের নতুন একটা সম্পর্ক হয়েছে। এসময় তোর নাম্বার বিজি থাকবেই। স্যরি।”
নূর কপাট রাগ দেখিয়ে বললো,
–“এই ফর্মালিটি কাকে দেখাচ্ছিস তুই? শান্ত’র সাথে আমার নতুন একটা সম্পর্ক হয়েছে তাতে কি? তোর যখন ইচ্ছে হবে ফোন দিবি৷ তুই আর রুশান আগে যেমন ছিলি ইন ফিউচার তেমনই থাকবি।”
অর্নি ছোট্ট করে ‘হুম’ বললো। নূর বললো,
–“এতরাতে ফোন দিলি যে? কিছু হইছে?”
নূরের প্রশ্নে অর্নি আমতা আমতা শুরু করে দিলো৷ ও কিভাবে উৎসবের কথা জিজ্ঞেস করবে ভেবে পাচ্ছে না। অর্নিকে এমন আমতা আমতা করতে দেখে নূর চট করেই বুঝে ফেললো ও কি বলতে চায়। নূর মুচকি হেসে বললো,
–“ভাইয়ার কথা জানার জন্য ফোন করেছিস?”
–“না মানে___”
–“বুঝেছি বুঝেছি৷ আমার থেকে লুকাতে হবে না৷ কি জানতে চাস বল?”
অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“তোর ওই কাজিন ইশা, ও কি উৎসব ভাইকে সত্যি সত্যিই প্রপোজ করেছে?”
অর্নির কথায় নূর নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বললো,
–“জানি না রে, ভাইয়ার সাথে কথা হয়নি আমার। তবে সন্ধ্যায় দুজনে যেভাবে হাসতে হাসতে বাসায় ফিরলো মনে তো হচ্ছে___”
অর্নি খট করে লাইন কেটে দিলো। বাকী কথাটুকু ওর মোটেও শুনতে ইচ্ছে করছে না। নূর বার কয়েক ফোন করলো অর্নিকে। কিন্তু অর্নি আর রিসিভ করেনি। শেষে ফোন বন্ধ করে রেখেছে৷
–
ক্লাসের ফাঁকে অর্নি খুব সাবধানে নূরের ব্যাগে ওর গুরুত্বপূর্ণ একটা নোটস রেখে দিলো। ঠিক করেছে এই নোটসের বাহানায় বিকেলে নূরদের বাসায় যাবে অর্নি। অর্নিকে লুকিয়ে নোটস রাখতে দেখে নূর ঠোঁট চেপে হাসলো। তারপর আবার ক্লাসে মনোযোগ দিলো৷
বিকেলের দিকে অর্নির কাজ সহজ করে দিয়ে নূরই ফোন করলো অর্নিকে। অর্নি ফোন রিসিভ করতেই নূর বললো,
–“দোস্ত তোর নোটস ভুলে আমার কাছে চলে এসেছে। তুই নিতে আসবি নাকি আমি___”
নূর পুরো কথা শেষ করার আগেই অর্নি চট করে বললো,
–“আমি নিতে আসছি।”
–“আচ্ছা, তাহলে তাড়াতাড়ি আসিস।”
অর্নি ছোট্ট করে ‘হুম’ বলে লাইন রেখে দিলো। তারপর ঝটপট রেডি হয়ে মিসেস অদিতিকে বলে নূরদের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
নূরদের বাসার কলিংবেল বাজাতেই ইশা এসে দরজা খুলে দিলো৷ ইশাকে একদমই আশা করেনি অর্নি। ইশাকে দেখেই অর্নির গাঁ টা জ্বলে উঠলো। দুদিন আগে যেভাবে উৎসবের হাত ধরে ছিলো কথাটা মনে হতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। তবুও সামলে নিলো নিজেকে। ইশা অর্নির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“কে তুমি?”
–“নূরের ফ্রেন্ড।”
অর্নির কথায় ইশা দরজা ছেড়ে সোফায় বসা উৎসবের পাশে গিয়ে বসে পড়লো৷ যা দেখে অর্নির বিরক্ত লাগছে খুব। রাগান্বিত চোখে দেখছে ইশাকে ও। উৎসবের সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। ও নিজের মতো ব্যস্ত। আর ইশা ব্যস্ত উৎসবকে দেখতে। নূর এসে অর্নির কাঁধে হাত রাখতেই ও চমকে নূরের দিকে তাকায়৷ নূর বললো,
–“এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? রুমে চল।”
বলেই নূর হাঁটা লাগালো। অর্নিও কিছুক্ষণ ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে থেকে নূরের সাথে গেলো। নূর সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো,
–“দেখছিস ইশা আপু সবসময় ভাইয়ার আশেপাশে থাকে। সুন্দর লাগছে না দুজনকে?”
–“মোটেও না, একটুও সুন্দর লাগছে না। ওই মেয়েকে উৎসব ভাইয়ের থেকে দূরে দূরে থাকতে বলবি।”
বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বললো অর্নি। নূর থেমে গিয়ে অর্নির দিকে তাকালো এবং বললো,
–“কেন?”
এবারে অর্নি আমতা আমতা শুরু করলো। কি বলবে নূরের প্রশ্নের জবাবে? অর্নিকে আমতা আমতা করতে দেখে নূর মুচকি হেসে বললো,
–“বুঝেছি।”
অর্নি চোখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি?”
নূর অর্নিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“এটাই যে, তুইও ভাইয়াকে ভালোবাসিস। তাই তো ইশা আপুকে সহ্য হয় না তোর।”
–“না মানে__”
নূর অর্নিকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“আর লুকাতে হবে না। তোর মুখ দেখলেই মনের কথা বুঝে যাই আমি।”
অর্নি মাথা নামিয়ে নিলো। নূর অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“আমি ভাইয়াকে ডেকে দিচ্ছি, সবকিছু ঠিকঠাক করে নিবি আজই। নয়তো সত্যিই কিন্তু পরে ভাইয়াকে হারাবি তুই। ইশা আপু কিন্তু সত্যিই ভাইয়াকে পছন্দ করে।”
অর্নি চকিত তাকালো নূরের দিকে। নূর অর্নিকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। দুজনে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলো। অতঃপর নূর দাঁড়িয়ে বললো,
–“তুই বোস, আমি ভাইয়াকে ডেকে পাঠাচ্ছি রুমে।”
অর্নিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নূর বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। কিছুক্ষণ বাদেই উৎসব উপস্থিত হলো সেখানে। পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নূরকে কোথাও দেখতে না পেয়ে অর্নিকে জিজ্ঞেস করলো,
–“নূর কোথায়?”
–“কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে রুম থেকে।”
উৎসব কপাল কুঁচকায়। তারপর বলে,
–“তাহলে ও যে আমাকে এক্ষুনি ঘরে আসতে বললো?”
অর্নি কিছু না বলে চুপ করে রইলো। উৎসব ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেই অর্নি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
–“শুনুন।”
দাঁড়িয়ে পড়লো উৎসব। কয়েক কদম এগিয়ে অর্নির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অর্নি মাথা নিচু করেই বললো,
–“আ্ আপনি এখন কথা বলেন না কেন আমার সাথে?”
–“তুমিই তো চাও না।”
জবাবে অর্নি আর কিছু বলতে পারলো না। উৎসব বললো,
–“আর কিছু বলবে?”
অর্নি তখনো চুপ। উৎসব আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ালো সেখানে। অর্নি কিছু না বলাতে উৎসব চলে গেলো রুম থেকে।
–
সন্ধ্যা নাগাদ নূর আর অর্নি ছাদে উঠেছিলো। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় ইশা উৎসবের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলছে,
–“আমি তোমাকে ভালোবাসি উৎসব।”
উৎসব কিছু না বলে হাত ছাড়িয়ে নিলো। ইশার থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। দরজার সামনে অর্নিকে দেখতে পেয়ে উৎসব বাঁকা হেসে ইশাকে বললো,
–“আমি ভেবে রাতের মধ্যেই জানাচ্ছি তোকে।”
এইটুকুন শুনেই ইশা খুশিতে আটখানা হয়ে যায়৷ অর্নি আর ছাদে পা বাড়ায়নি। নূরকে নিয়ে নিচে নেমে গেছে। বিছানায় বসে কাঁদোকাঁদো চেহারায় অর্নি বললো,
–“দেখলি তোর ভাই আর আমাকে ভালোবাসে না।”
–“কে বলছে তোকে?”
–“দেখলি না ইশা প্রপোজ করাতে ভাবার জন্য সময় নিলো? আমাকে যদি ভালোবাসতো তাহলে তো সরাসরি ইশাকে না করেই দিতো।”
নূর ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“তুই যে ভাইয়াকে ভালোবাসিস একবারো বলেছিস? বলিস নি তো৷ তাহলে ভাইয়া অন্যকাউকে ভালোবাসুক বা বিয়ে করে বাসর করুক তাতে তোর কি?”
অর্নি রাগান্বিত চোখে তাকায় নূরের দিকে তারপর বললো,
–“একদম উল্টাপাল্টা বলবি না। এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে আছে।”
নূর এবার নরম হয়ে এলো। অর্নিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“তুই ভাইয়ার কাছে গিয়ে একবার মুখ ফুঁটে বল না তোর মনের কথাটা৷ ভাইয়া তোকে সত্যিই ভালোবাসে।”
–“বলছিস?”
–“হ্যাঁ আমি বলছি, তুই জাস্ট একবার সাহস করে বলে দে।”
নূর আবারো উৎসবকে ডেকে পাঠিয়েছে নিজের ঘরে৷ এবার আর অর্নি নূরকে কোথাও যেতে দেয়নি। শক্ত করে নূরের হাত ধরে আছে। উৎসব এসে নূরকে বললো,
–“ডেকেছিস কেন?”
–“আমি না তো, অর্নি ডেকেছে তোমায়৷ ও তোমাকে কি যেন বলবে। তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।”
নূরের কথায় অর্নি নূরের হাত খামচে ধরলো। নূর তাকালো অর্নির দিকে। অর্নি চোখ দিয়ে ইশারা করলো নূরকে না যেতে। নূর হেসে অর্নির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অর্নির দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
–“অল দ্যা বেস্ট জানু। আর শোন, এবার যদি না বলতে পারিস তাহলে তোর সাথে আর কথাই বলবো না আমি।”
নূর বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। অর্নি এবারেও চুপচাপ আছে। তা দেখে উৎসব বললো,
–“যা বলার দ্রুত বলো, ইশা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”
এই মূহুর্তে উৎসবের মুখে ইশার নাম শুনে অর্নির মাথায় ধপ করেই আগুন জ্বলে গেলো। তেড়ে উৎসবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
–“ইশার সাথে আপনার এত কিসের ঢলাঢলি হ্যাঁ? আপনি না আমাকে ভালোবাসেন?”
–“কোথায় যেন শুনেছি___যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে নই, যে তোমাকে ভালোবাসে তাকে ভালোবাসো। আর এখানে তো ইশা আমাকে ভালোবাসে তাই আমার উচিত___”
অর্নি উৎসবের একটা হাত খামচে ধরলো৷ যার কারনে উৎসব কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না৷ অর্নির আড়ালে উৎসব হাসলো। অর্নি তখনো শক্ত করে উৎসবের হাত খামচে ধরে আছে৷ উৎসবের হাতে অর্নির নখ ক্ষানিকটা ডেবে গেছে। উৎসব তবুও কোনো রকম শব্দ করলো না। উৎসব বললো,
–“কি হয়েছে?”
–“আপনি ইশাকে ভালোবাসবেন না।”
উৎসব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কেন?”
–“আমি বলেছি তাই।”
–“তোমার কথা আমি শুনবো কেন?”
–“জানি না, শুধু এইটুকু জানি আপনি ইশাকে ভালোবাসবেন না।”
–“বা রে! নিজেও আমাকে ভালোবাসবে না আবার আমাকে ইশাকেও ভালোবাসতে দিবে না।”
–“হ্যাঁ দিবো না।”
–“কেন?”
–“জানি না।”
–“জানো না? আচ্ছা ইশা অনেকটা সময় যাবত অপেক্ষা করছে আমার জন্য, আমি আসছি।”
উৎসব চলে যেতে চাইলে অর্নি ওর হাত ধরে বললো,
–“যাবেন না আপনি।”
উৎসব অর্নির দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। অর্নি আবারো বললো,
–“আ্ আপনি শুধু আ্ আমার হয়েই থাকবেন, শুধু আ্ আমাকেই ভালো্ ভালোবাসবেন অন্যকাউকে না।”
উৎসব মুচকি হাসলো। অর্নিকে একটানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। অর্নির দু গালে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকালো। তারপর বললো,
–“তবুও ভালোবাসি বলবে না?”
অর্নি কেঁপে উঠলো উৎসবের স্পর্শে। ওর বুকটা ধরফর ধরফর করছে৷ মাথা তুলে একবার তাকালো উৎসবের দিকে। উৎসব আবারো বললো,
–“#তুমি_শুধু_আমারই_হও, আমার আর কিচ্ছু চাই না। অন্য আর কোনো মেয়েকে লাগবে না।”
অর্নি কিছু না বলে আচমকাই জড়িয়ে ধরলো উৎসবকে। উৎসবের বুকে মাথা রেখে বললো,
–“আপনার নিরবতা আমাকে বড্ড পোড়ায় উৎসব ভাই। আপনি আমাকে আর ইগনোর করবেন না প্লিজ। আর হ্যাঁ আপনি ইশার কাছে যাবেন না। ওকে আপনার আশেপাশে দেখলে আমার সহ্য হয় না। ইশা যখন আপনাকে স্পর্শ করে তখন গাঁ জ্বলে যায় আমার। ইচ্ছে করে খুন করে ফেলি ওকে।”
উৎসব মুচকি হেসে বললো,
–“এই যে আপনি বলেছেন, এখন আপনার কথা কি ফেলতে পারি আমি? একদমই না। ইশা আর স্পর্শ করতে পারবে না আমাকে। আপনি শুধু আমার হয়ে থাকেন কেমন?”
উৎসবের কথার প্রত্যুত্তরে অর্নি আর কিছু বললো না। উৎসবের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে ওকে জড়িয়ে ধরে রইলো।
চলবে~