তুমি শুধু আমারই হও পর্ব-২০+২১

0
389

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী

|২০|

উৎসবের ডাকে হুশ ফিরে অর্নির। উৎসব তখনো বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। আর অর্নি বিছানার এক পাশে দাঁড়ানো। নিজের চিন্তা-ভাবনায় নিজেই বেশ বিরক্ত হলো অর্নি। ইশ্! কি লজ্জার বিষয়? উৎসব যদি বুঝতে পারে অর্নি এখন উৎসবকে জড়িয়ে ধরার কল্পনায় চলে গেছিলো তাহলে আজ আর রক্ষে থাকবে না। ক্ষেপিয়ে পাগল বানিয়ে ছাড়বে৷ উৎসব উঠে অর্নির সামনে দাঁড়ালো। বললো,
–“কি ভাবছো তখন থেকে?”

অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“কি্ কিছু না তো।”

কথাটা কোনোমতে বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। একপ্রকার পালিয়ে আসলো। ওর লজ্জা লজ্জা লাগছে ভীষণ। অবাধ্য মনটা আর কিছু ভাবতে পারলো না? বেছে শুনে সেই জড়িয়ে ধরার কথাটাই মাথায় এলো? ইশ্! কি বিচ্ছিরি কান্ড। অর্নির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উৎসব ফোঁশ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়ে মনে হয় না কখনো নিজ মুখে ভালোবাসি বলবে ওকে। তবে মনে মনে উৎসব ঠিক করে নিলো যতক্ষণ না ভালোবাসি বলছে অর্নির সাথে কথা বলবে না৷ উৎসবও দেখতে চায় ওর কঠিন রুপটা অর্নি কিভাবে মেনে নেয়৷

নূরের বিছানায় বসে হাঁপাচ্ছে অর্নি। নূর ভ্রু কুঁচকে ফেললো। জিজ্ঞেস করলো,
–“এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? মনে হচ্ছে কিছু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে পাবলিকের মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে এসেছিস।”

নূরের কথায় অর্নি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ওর দিকে। নূর বললো,
–“ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? সত্যিটাই বলছি__আচ্ছা বাদ দে, কি হইছে সেটা বল।”

–“উৎসব ভাইয়ের ঘরে গেছিলাম।”

–“হ্যাঁ তো?”

–“তোর ভাইয়ের সে কি রাগ ভালোভাবে কথাই বললো না আমার সাথে। কেমন গম্ভীর স্বরে কথা বললো।”

–“এখন রাগ কমেছে?”

অর্নি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। নূর বললো,
–“এখনো রাগ কমলো না?”

অর্নি মাথা নাড়ালো। তারপর একে একে সব বললো। সবকিছু শুনে নূর হতাশ হলো বেশ৷ এই মেয়েকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। নূর হতাশ চোখে তাকিয়ে বললো,
–“কি এমন চেয়েছিলো ভাইয়া? জাস্ট তোর মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটাই তো শুনতে চেয়েছিলো। ভালোবাসি বললেই দেখতি ভাইয়ার পাহার সমান রাগ গলে পানি হয়ে যেতো৷ এইটুকু বলতে পারলি না?”

–“লজ্জা লাগে না আমার উৎসবের ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসি বলতে? আর উনি তো জানেনও আর বোঝেনও যে উনাকে আমি ভালোবাসি। তাহলে এরপরও মুখে বলতে হবে কেন?”

–“তুই তোর লজ্জা নিয়ে থাক। এদিকে অন্যকেউ এসে ভাইয়াকে নিয়ে যাক৷ তখন ভালো হবে।”

অর্নি কাঁদোকাঁদো চোখে তাকালো নূরের দিকে। নূর মুখ ঘুরিয়ে নিলো। অর্নি গিয়ে জাপ্টে ধরলো নূরকে। নূর নিজেকে ছাড়াতে গিয়েও ছাড়াতে পারলো না। অর্নি বললো,
–“দোস্ত একটা আইডিয়া দে না, কিভাবে উৎসব ভাইয়ের রাগ ভাঙানো যায়? তোর তো ভাই, আই হোপ তুই জানিস। বল না দোস্ত।”

–“আমার ভাই হলেও ইন ফিউচার তোর জামাই হবে জামাই। সো এখন থেকেই ব্রেন খাটিয়ে দেখ কিভাবে কি করলে আমার ভাইয়ের রাগ সহজেই কমে যাবে।”

–“এমন করিস কেন? তুই একটা আইডিয়া দে না প্লিজ। নেক্সট টাইম থেকে তোর ভাই রাগ করলে নিজের ব্রেন খাটিয়েই তোর ভাইয়ের রাগ ভাঙানোর আইডিয়া বের করবো আমি পাক্কা।”

নূর সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
–“তারমানে, এরপরও ভাইয়া যাতে রেগে যায় সেরকম কাজ করবি তুই?”

অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“আমি আবার সে কথা কখন বললাম?”

নূর কিছু বললো না। শান্ত’র ফোন আসায় উঠে ব্যালকোনিতে চলে গেলো। এদিকে অর্নি বসে বসে ভাবতে লাগলো কি করে উৎসবের রাগটা ভাঙানো যায়?

শায়লা বেগম সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছেন। অর্নি গোমড়া মুখে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো৷ তা দেখে শায়লা বেগম বললো,
–“মুখটা ওমন করে রেখেছিস কেন?”

–“তোমার ছেলের রাগ তো কমছেই না আন্টি।”

–“সেকিরে, এখনো রাগ কমেনি?”

অর্নি গোমড়ামুখে না জানালো। শায়লা বেগম মুচকি হেসে অর্নির দিকে ঘুরলো। অর্নির গালে হাত রেখে বললো,
–“আমি একটা আইডিয়া দিবো? নাইনটি পার্সেন্ট কাজে দিবে।”

অর্নির চোখদুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। বলো,
–“বলো, বলো প্লিজ।”

শায়লা বেগম মৃদু হেসে কিছু একটা বললেন অর্নিকে। অর্নি সবটা শুনে বললো,
–“বলছো? এতে তোমার ওই গোমড়ামুখো ছেলের রাগ কমে যাবে তো?”

–“চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?”

অর্নি আর কিছু বললো না। শায়লা বেগম নাস্তা বানানো শেষ করে অর্নিকে বললো,
–“এখন চল আমার সাথে।”

অর্নি বিনাবাক্য শায়লা বেগমের পেছন পেছন চলে গেলো। ঘন্টা খানেক বাদে অর্নি গুটিগুটি পায়ে নূরের রুমে গেলো। নূর তো অর্নিকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। অর্নি বললো,
–“আমি ছাদে যাচ্ছি, তোর ভাইকে একটু পাঠিয়ে দিস মিনিট পাঁচেক বাদে?”

নূর মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। অর্নি এবার চলে গেলো ছাদে। মিনিট পাঁচেক বাদে নূর উৎসবের রুমের দিকে পা বাড়ালো। উঁকি দিয়ে দেখলো উৎসব সোফায় বসে অফিসের ফাইল দেখছে। ফাইলে দৃষ্টি রেখেই উৎসব বললো,
–“উঁকিঝুঁকি মারছিস কেন? যা বলার ভিতরে এসে বল।”

নূর ভিতরে গিয়ে সোফায় ভাইয়ের পাশে বসলো। তারপর বললো,
–“ভাইয়া অর্নি তোমাকে একটু ছাদে ডাকছে।”

–“কেন ও রুমে আসতে পারে না?”

–“ও আসবে না এখানে৷ তুমি ছাদে যাও।”

উৎসব ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তোর ফ্রেন্ডকে এখানে আসতে বল। কাজ আছে আমার। উঠতে পারবো না এখন।”

নূর উৎসবের দুই হাত ধরে বললো,
–“ভাইয়া যাও না প্লিজ প্লিজ।”

উৎসব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফাইল বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো৷ তারপর এগিয়ে গেলো ছাদের দিকে। নূর অর্নিকে টেক্সট করে জানিয়ে দিলো উৎসব ছাদের দিকে যাচ্ছে।

ছাদে উঠে উৎসবের ভ্রু কুঁচকে গেলো। ছাদের কোথাও দেখলো না অর্নিকে। বিরক্ত হলো ক্ষানিকটা। যেই সিড়ির দিকে পা বাড়াবে অমনি পেছন থেকে এক-জোড়া হাত এসে জড়িয়ে ধরলো উৎসবকে। উৎসব বুঝতে পারলো এটা অর্নি-ই। উৎসব অর্নির হাত ছাড়িয়ে অর্নির দিকে ঘুরতে চাইলে অর্নি কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
–“পেছনে ঘুরবেন না প্লিজ।”

উৎসব অর্নির হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো৷ অর্নি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ধীর গলায় বললো,
–“ভা্ ভালোবাসি উৎসব।”

চমকে উঠলো উৎসব৷ অর্নি নিজ মুখে ওকে ভালোবাসি বলছে? বুকের ভিতর কেমন একটা করে উঠলো। উৎসব এবার একটানে অর্নিকে নিজের সামনে নিয়ে এলো। অর্নির দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাতেই থমকে গেলো উৎসব৷ নীল রঙা শাড়ি পড়ে আছে অর্নি। দুহাত ভর্তি চুড়ি৷ চোখে কাজল৷ আহামরি কোনো সাজ নেই আর। আজ দ্বিতীয় বারের মতো অর্নিকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখলো উৎসব। উৎসবের হার্টবিট যেন থমকে গেছে৷ বুকের মাঝে এক ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো উৎসবের মনে। উৎসবকে নিজের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্নি একহাতে শাড়ি খামচে ধরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ উৎসব দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে পরপর কয়েকটা শ্বাস নিলো। তারপর অর্নির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“শাড়ি পড়েছো হঠাৎ?”

–“হুম।”

–“কেন?”

–“আপনার জন্য।”

কথাটা বলে মাথা নিচু করে নিলো অর্নি। অর্নির কথায় উৎসব চমকালো। মেয়েটা ওর জন্য শাড়ি পড়েছে? ভাবতেই মনে অন্যরকম এক প্রশান্তি ছেয়ে গেলো৷ তবুও সেটা প্রকাশ করলো না মুখে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
–“কেন ডেকেছিলে?”

অর্নি কাঁদোকাঁদো চোখে তাকিয়ে বললো,
–“আপনার এখনো রাগ কমেনি?”

উৎসব মুচকি হাসলো। অর্নির গালে হাত রেখে বললো,
–“চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখেও কেউ রেগে থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না৷ তার উপর যদি আবার সেই মানুষটা আমার জন্যই শাড়ি পড়ে আমার সামনে আসে তাহলে তো রেগে থাকার প্রশ্নই আসে না।”

অর্নি মাথা নিচু করে নিলো। লজ্জা পেলো বোধহয় ক্ষানিকটা। উৎসব অর্নির দুই গালে হাত রেখে অর্নির মুখ উঁচু করলো৷ দুজনের চোখে চোখ পড়লো৷ উৎসব বললো,
–“একটু আগেই কি বললে? আবার বলো না___”

অর্নি আবার মাথা নামিয়ে নিলো। কাঁপা স্বরে বললো,
–“ভা্ ভালোবাসি আপনাকে।”

–“শেষমেশ তাহলে ভালোবাসি বললে নিজ মুখে?

কথাটা বলে উৎসব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অর্নিকে। অর্নিও আলতো ভাবে হাত রাখলো উৎসবের পিঠে৷ অর্নিকে জড়িয়ে ধরেই উৎসব ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“আমিও ভালোবাসি তোমাকে। ”

উৎসবের বলা ভালোবাসি কথাটা অর্নিকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিলো। অদ্ভুত এক অনূভুতি সৃষ্টি হলো মনে।

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অর্নি আর উৎসব। অর্নি উৎসবের কাঁধে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷ আকাশে আজ বড় করে চাঁদ উঠেছে। মাঝেমধ্যে মৃদু বাতাস বইছে চারিপাশে। বাতাসে অর্নির খোলা চুলগুলো উড়ে উৎসবের মুখে গিয়ে লাগছে। অর্নি ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে চুলগুলো হাত-খোপা করতে গেলেই উৎসব অর্নির হাত ধরে আটকে দেয়। বলে,
–“খোপা করো না।”

–“কিন্তু আপনার চোখমুখে গিয়ে বারবার পড়ছে তো।”

–“পড়ুক, সমস্যা নেই। ভালোই লাগছে আমার।”

উৎসবের কথায় অর্নি আর খোপা করলো না চুল। খুলেই রাখলো৷ উৎসব অর্নির চুল আঙুলে পেচিয়ে আবার খুলে ফেলছে৷ এরকমই করছে অনেকটা সময় যাবত৷ অর্নি চাঁদের দিকে তাকিয়েই বললো,
–“আমায় দেখতে কেমন লাগছে বললেন না তো?”

উৎসব ক্ষানিকটা সময় নিরব থাকলো৷ তারপর বললো,
–“ভালো।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো উৎসবের দিকে। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
–“শুধু ভালো?”

উৎসব লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললো,
–“এখন শাড়ি পড়া অবস্থায় তোমায় কেমন লাগছে, কতটা সুন্দর লাগছে এটা যদি আমি বলতে যাই তাহলে তুমিই লজ্জা পাবে৷ তাই বলছি না।”

উৎসবের কথার আগামাথা বুঝলো না অর্নি। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। উৎসব বললো,
–“বুঝলে না?”

অর্নি মাথা নাড়ালো। উৎসব বললো,
–“আমি বলতে চাইছি না, তবুও যেহেতু তুমি বুঝতে পারছো না তাহলে বলতেই হচ্ছে আমায়। বলি তাহলে?”

অর্নি কিছু না বলে তখনো তাকিয়ে আছে উৎসবের দিকে৷ উৎসব অর্নিকে নিজের কিছুটা কাছে টেনে বললো,
–“আমার নিজেকে ধরে রাখতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে জানো? অবাধ্য মনটার নিষিদ্ধ কিছু পাওয়ার ইচ্ছে করছে বারবার।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো উৎসবের দিকে। উৎসব তপ্ত শ্বাস ফেলে অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
–“সহজ ভাবে বলতে গেলে, তুমি যদি এখন আমার বিয়ে করা বউ হতে না? তাহলে আর নিজেকে এত কষ্ট করে ধরে রাখতে হতো না৷ সরাসরি তোমায় কোলে তুলে নিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতাম।”

উৎসবের এহেন কথায় অর্নির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। লজ্জা পেয়ে গেলো ভীষণ। উৎসবকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে অর্নি। উৎসবের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে পরপর কয়েকটা লম্বা শ্বাস টেনে দৌড়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো অর্নি।

চলবে~

#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা_সাথী

|২১|

উৎসব আজ পুরো পরিবার নিয়ে অর্নিদের বাসায় এসেছে। এতকিছুর পর অর্নি ওকে নিজ মুখে ভালোবাসি বলেছে, তাই ওকে এবার নিজের করে নেওয়ার জন্যই স্ব পরিবারে হাজির হয়েছে অর্নিদের বাসায়। অর্নিকে হারাতে চায় না ও। কিছুতেই না। অর্নি অবশ্য জানে না উৎসব ওরা আসবে আজ। তাই তো বিকেলের দিকেই টায়রার সঙ্গে শপিংয়ে বেরিয়ে পড়েছে। উৎসব ওরা অর্নিদের বাসার কাউকে না জানিয়েই এসেছে। সবকিছু শুনে মিসেস অদিতি অর্নিকে ফোন করতে চাইলে শায়লা বেগম বললো,
–“এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই, আমরা আছি তো। অর্নি আসুক না, মনমতো শপিং করেই আসুক। আমাদেরই তো ভুল আমরা কিছু না জানিয়েই হুট করে চলে এসেছি।”

মিসেস অদিতি হেসে বললেন,
–“আসলে আপনারা একটু জানিয়ে আসলে আমাদের জন্য সুবিধা হতো৷ হুট করে__”

–“জানানোর স্কোপই তো পেলাম না। ঘন্টা খানেক আগে উৎসব হুট করেই জানালো। প্রথমে তো আমরাও অবাক হয়েছিলাম। এভাবে হুট করেই সবকিছু হয় নাকি? কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার মেনে আসতেই হলো। ভাবলাম যে বিয়েটা দুদিন পর হবে সেটা আজ হলেই বা ক্ষতি কি?”

মিসেস অদিতি হাসলেন। আরো টুকটাক কথা বলে উঠে গেলেন কিচেনে। স্বল্প সময়ে যা যা আয়োজন করা যায় তাই করবেন। সামনে অবশ্য হালকা খাবার দেওয়া হয়েছে। এখন ভারী কিছুর আয়োজন করা প্রয়োজন। মিসেস অদিতি কিচেনে গিয়ে অর্নবকে ফোন করে জানালেন সব। অর্নবও মায়ের ফোন পেয়ে বেরিয়ে পড়লো অফিস থেকে।

সন্ধ্যার পর হাতে এক-গাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে গুনগুন করে গান করতে করতে বাড়ি ফিরলো অর্নি। ড্রয়িংরুমের সোফায় চোখ পড়তেই থেমে গেলো ও। উৎসব ওর পুরো পরিবার নিয়ে বসে আছে। ভ্রু কুঁচকে ফেললো অর্নি। উৎসব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্নির দিকে। অর্নি উৎসবের আব্বুকে সালাম দিলো। তিনি হেসে টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করলো অর্নিকে। অর্নিও হাসিমুখে উত্তর দিলো। নূর উঠে এসে অর্নির সাথে ওর রুমে চলে এলো। অর্নি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“ব্যাপার কি? সবাই আজ আমাদের বাসায়?”

নূর হেসে একপাশ থেকে অর্নিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“ভাইয়ার আর তর সইছে না তোকে নিজের করে পাওয়ার জন্য।”

–“মানে কি?”

–“মানে ভাইয়া বিকেলে হুট করেই আব্বু-আম্মুকে জানালো ভাইয়া তোকে বিয়ে করতে চায়, আর আজকেই। প্রথমে আব্বু আম্মু ভাইয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ভাইয়া বুঝতে নারাজ৷ ভাইয়ার কথা হলো, আবার যদি তোদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তখন? ভাইয়া তোর থেকে আর দূরে দূরে থাকতে পারবে না৷ সবথেকে বড় কথা যেখানে তোরা দুজন দুজনকে ভালোবাসিস, দুই পরিবার রাজি সেখানে এত দেরী করে হবে কি?”

সবশুনে অর্নি অসহায় চোখে তাকালো নূরের দিকে। ছেলেটা কি পাগল? এভাবে কেউ বিয়ের কথা বলে? একটুও লাজ-লজ্জা নেই ছেলেটার। নূর অর্নিকে বললো,
–“তাহলে আমার ভাবী হওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?”

–“আচ্ছা দোস্ত এত তাড়াহুড়ো করার সত্যিই কোনো দরকার আছে? আমার নিজের বিয়ে নিয়ে কত্ত প্ল্যান ছিলো জানিস? তোর ভাইয়ের জন্য দেখছি এখন সেসব কিছুই পূরণ হবে না আমার।”

–“ইচ্ছে তোমার পূরণ করার দায়িত্ব আমার।”

দরজার কাছ থেকে কথাটা বললো উৎসব৷ অর্নি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো উৎসবের দিকে। এ্যাশ কালার পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা পড়েছে উৎসব৷ পাঞ্জাবীর হাতা ফোল্ড করা। কি কিউট লাগছে ছেলেটাকে। উৎসব ভিতরে ঢুকে বললো,
–“ওভাবে কি দেখছো?”

অর্নি হকচকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো৷ উৎসব মুচকি হাসলো। উৎসব আবারো বললো,
–“তোমার বিয়ে নিয়ে যা যা প্ল্যানিং আছে, সব পূর্ণ করবো আমি। কিন্তু আপাতত আমার বউ হয়ে আমার ইচ্ছে পূর্ণ করো তুমি। ব্যাস এতটুকুই।”

টায়রা আর নূর মিলে অর্নিকে রেডি করিয়ে দিলো। বেবি পিংক কালারের শাড়ি পড়ানো হয়েছে অর্নিকে। দুজনে মিলে অর্নিকে ড্রয়িংরুমে এনে উৎসবের পাশে বসিয়ে দিলো। নূর গিয়ে বসে পড়লো রুশানের পাশে। নিহাল আর শান্ত’র পুরো পরিবারও উপস্থিত আছেন এখানে অতঃপর দুই পরিবারের সম্মতিতেই ঘরোয়া ভাবে উৎসব আর অর্নির বিয়ে সম্পন্ন হয় আজ। অর্নির ইচ্ছেমতো অর্নব আর ওর বিয়ের অনুষ্ঠান একসাথে করা হবে।

অর্নি রুমে বসে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। এতক্ষণ যেন দম আটকে বসে ছিলো সবার সাথে৷ নূর আর রুশান এসে বসলো অর্নির দুই পাশে। নূর বললো,
–“তুই তো এখন থেকে আমার ভাবী রাইট? আচ্ছা তোকে ভাবী বলবো নাকি নাম ধরে ডাকবো? সম্পর্কে তো আমার থেকে বড় হয়ে গেলি এখন কি তুমি বা আপনি করে বলতে হবে তোকে? ভাবছি আমি এসব।”

অর্নি চোখ রাঙিয়ে তাকালো নূরের দিকে। নূর বললো,
–“কি? ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন?”

অর্নি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আমি বাঁচি না আমার জ্বালায় আর তুই আমাকে এরমাঝেও আবার জ্বালাতে এসেছিস?”

রুশান অর্নির মাথায় টোকা মেরে বললো,
–“তোর আবার কি হইছে?”

–“এমনিতেই উৎসব ভাইয়ের জ্বালানোর শেষ ছিলো না আমাকে। উনার মনমতো না চললেই ধমকি-ধামকি শুরু করে দিতো৷ অধিকারবোধ দেখাতো প্রখর ভাবে। আর এখন? এখন তো উনার বিয়ে করা বউ, আমার কপালে আর কি কি আছে আল্লাহ ভালো জানেন।”

অর্নির কথায় নূর আর রুশান হাসলো। নূর বললো,
–“আমার ভাইয়া তোর সাথে হম্বিতম্বি করলেও তোর প্রতি ভাইয়ার ভালোবাসাটা কিন্তু বরাবরের মতোই প্রখর।”

এ কথাটা অস্বীকার করার মতো সাধ্য অর্নির নেই৷ উৎসব অর্নিকে সত্যিই সবথেকে বেশি ভালোবাসে। ওর নিজেকে ধন্য মনে হয় উৎসবের মতো একটা ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে বলে৷ উৎসবের ভালোবাসা পায় বলে৷

উৎসব আর অর্নি, অর্নির ঘরের ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ অর্নি দুই হাতে ব্যালকোনির গ্রীল আকঁড়ে ধরে দাঁড়িয়েছে৷ উৎসব অর্নির হাতের উপর হাত রাখতেই অর্নি চমকে তাকালো উৎসবের হাতের দিকে৷ উৎসব বললো,
–“এত চুপচাপ কেন আজ?”

অর্নি সামনে তাকিয়ে বললো,
–“আপনার সামনে কবেই বা বকবক করেছি আমি উৎসব ভাই?”

উৎসব রাগী চোখে তাকালো৷ অর্নি আমতা আমতা করে বললো,
–“স্যরি__”

উৎসব বললো,
–“অর্নি___”

–“হু?”

–“তুমি আমার বিয়ে করা বউ, এটা এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার।”

–“আমারো না। আচ্ছা এভাবে হুট করেই বিয়ের কথা মাথায় এলো কেন? আমাকেও কিচ্ছু জানালেন না।”

–“জানি না, ইচ্ছে হলো তোমাকে নিজের করে নেওয়ার তাই আর দেরী করলাম না৷”

অর্নি কিছু বললো না। উৎসব অর্নির দিকে ঝুঁকে বললো,
–“আর তাছাড়া এখন আর তোমাকে স্পর্শ করতে কোনো কারন লাগবে না। সমাজ কি বললো, মানুষ কোন চোখে দেখলো আমাদের এসবের পরোয়া করতে হবে না। যদিও বা আগেও এসবের পরোয়া করিনি আমি।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। উৎসব মুচকি হেসে সরে দাঁড়ালো। উৎসব আচমকাই প্রশ্ন করলো,
–“অর্নি আমার সাথে আমাদের বাসায় যাবে না আজ?”

উৎসবের এমন প্রশ্নে অর্নি থতমত খেয়ে গেলো। কি জবাব দিবে ভেবে পেলো না৷ উৎসব আবারো বললো,
–“এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে, আমরা একসাথে থাকতেই পারি৷ আমি কিন্তু তোমাকে সাথে করে নিয়েই যাবো৷ রেখে যাবো না আর এ বাসায়।”

অর্নির কিছু একটা হলো। দ্রুত অন্যদিকে ফিরে তাকালো৷ বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে উৎসবের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“মাথা ঠিক আছে আপনার? কিসব বলছেন?”

–“কি এমন বললাম? আমি শুধু বলেছি আমার বউকে আমি সাথে করে নিজের বাসায় নিয়ে যাবো।”

–“উঁহু, একদম না। ভুলেও এ কথা কাউকে বলতে যাবেন না৷ একেই তো হুট করে এসে বিয়ে করে ফেললেন এতেই প্রচুর শকে আছি৷ আর কোনো শক নিতে পারবো না আমি।”

উৎসব অর্নির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“কিন্তু আমি যে আমার বউকে ছাড়া আর থাকতে পারবো না।”

অর্নি ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,
–“এতদিন তো দিব্যি ছিলেন। যেই আজ বিয়ে হলো অমনিই বলছেন বউ ছাড়া থাকতে পারবেন না।”

উৎসব অর্নিকে ঘুড়িয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো,
–“ইউ নো না? বিয়ের আগে শত শত বছর বউকে ছাড়া থাকা যায়। বাট বিয়ের পর একরাতও বউকে ছাড়া থাকা যায় না।”

অর্নি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
–“ছাড়ুন তো আমায়, এতসব বোঝার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।”

রাতের ডিনার সেরে উৎসব ওরা চলে গেছে। অর্নি মায়ের হাতে হাতে সব কিছু গোছগাছ করে নিজের রুমে চলে গেলো। উৎসব সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো ওকে। সবাইকে বলতেও চেয়েছিলো, কিন্তু অর্নি রাজি হয়নি। তাই উৎসবও জোর করেনি৷ এত দিন তো দূরে দূরে থেকেছে, থাকুক না আর কয়েকটা দিন ক্ষতি কি? আর ক’টা দিন যাক, ঠিকই কোনো না কোনো ভাবে অর্নিকে নিয়ে যাবে ও বাসায়। মনে মনে ভেবে রেখেছে উৎসব।

বিছানায় এসে গাঁ এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো অর্নি। রাতের খাবারটাও খেয়ে ঘুমায়নি। উৎসব ওরা খাওয়ার সময় বেশ কয়েকবার জোরাজোরি করেছিলো কিন্তু অর্নি পরে খাবে বলে আর খায়নি৷ শপিং থেকে ফেরার সময় টায়রা আর অর্নি দুজনেই রেস্টুরেন্ট থেকে পেটভর্তি খেয়ে এসেছে। তাই সে সময়ে ক্ষুধা ছিলো না। মাঝ রাত্রিরে ঘুম ভেঙে যায় অর্নির। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেয়ালঘড়িতে দেখলো দুইটা বাজে৷ পেটের মধ্যে ইদুর দৌড়াচ্ছে এখন। তাই কিচেনে চলে গেলো খাবার আনতে। ফ্রোজেন রুটি বের করে ভেজে নিলো। আর গরুর গোশত বের করে গরম করে নিলো। তারপর খাবার নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখলো উৎসবের অনেকগুলো মিসড কল। অর্নির ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। এই ছেলে নির্ঘাত বেশ চটে আছে ওর উপর ফোন রিসিভ না করায়। অর্নি ভাবলো ফোন দিবে। কিন্তু আবার মনে হলো উৎসব হয়তো ঘুমিয়ে আছে এখন ফোন দিলে ঘুম নষ্ট হবে। তাই টেক্সট করলো,
–“স্যরি, আপনারা যাওয়ার পরই সবকিছু গোছগাছ করে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আর ফোনটাও সাইলেন্ট মুডে ছিলো তাই ফোন রিসিভ করতে পারিনি।”

অর্নি টেক্সট করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে উৎসব ফোন করলো। অর্নি বেশ অবাক হলো। এতরাত হয়েছে এখনো ঘুমায়নি? অর্নি দ্রুত ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে উৎসব বললো,
–“এদিকে আমার ঘুম হারাম করে ওপাশে মহারানী শান্তির ঘুম দিচ্ছিলো তাই না?”

–“স্যরি আসলে__”

–“ইট’স ওকে। এখনো জেগে কি করছো?”

–“ডিনার করছি___আপনি এখনো ঘুমাননি কেন সেটা বলুন?”

–“বউ পাশে না থাকলে ঘুম হয়?”

–“এই মাঝরাত্রিরে আপনার আবার শুরু হলো বাজে বকা?”

উৎসব ইনোসেন্ট গলায় বললো,
–“বাজে বকছি কোথায়? বিয়ে করেছি অথচ বউ পাশে নেই। বউয়ের থেকে দূরে আছি এটা কার ভালো লাগে বলো?”

–“এত কথা না বলে ঘুমান।”

–“আচ্ছা শোনো না__ভালোবাসি বউ।”

উৎসবের মুখ থেকে ‘ভালোবাসি বউ’ শুনে মুচকি হাসলো অর্নি। তারপর লাইন কেটে দিলো। উৎসবও মুচকি হেসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। এবার একটু শান্তিতে ঘুমানো যাবে। অর্নি খাওয়া শেষে প্লেট কিচেনে রেখে আবারো শুয়ে পড়লো। এখন ঘুম আসবে না কিছুতেই। তাই ফোন নিয়ে এফবিতে লগইন করলো। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেঞ্জ করে ম্যারিড দিলো, সাথে উৎসবের আইডি অ্যাড করে দিলো। মূহুর্তেই লাইক কমেন্টস এ পোস্ট ভরে যাচ্ছে। অর্নি একেক জনের রিয়্যাকশন দেখে মুচকি হাসছে।

চলবে~