#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০৩)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
_______________
“বড় হয়ে গেছ এখন মায়ের মতামতের প্রয়োজন পড়ে না। বাপ তো কবেই গত হয়েছে। নিজে নিজে সব সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গেছ। এই দিন দেখার জন্য এত যত্ন করে লালন পালন করেছিলাম তোমায়? একটাবার মাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?” একাধারে এতগুলো কথা বলে সাওদা বেগম কিছুক্ষণ থেমে একটু বড় করে শ্বাস নিলেন। পূনরায় ছেলের উদ্দেশ্য আবার বলা শুরু করলেন, “আজকের দিনে তোমার বাবা বেঁচে থাকলে কতটা কষ্ট পেত জানো? ভালোই হয়েছে মানুষটা আগেভাগে চলে গেছে। ছেলেমেয়েদের তামাশা দেখার জন্য রেখে গেছে আমাকে। হয় তোমার বউ নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে নতুবা ওই মেয়েকে বাড়ি থেকে বেড় করে দেবে। অচেনা অজানা কোন মেয়েকে আমি আমার বাড়ির বউ হিসাবে মানবো না। এ হতে পারে না। শুনেছো তুমি?”
“শুনেছি।”
“এখন তোমার সিদ্ধান্ত জানাবে আমাকে!”
“কেমন সিদ্ধান্তে তুমি খুশি হবে?”
ছেলের পাল্টা প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলেন সাওদা বেগম। প্রতিত্তোরে বলল, “মানে, কি বলতে চাও তুমি?”
“কি বলার বাকি রেখেছো তুমি মা? কিছু না বুঝে না শুনে নিজের মতামত জানিয়ে দিলে। আবার আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইছো। তাই আমিও বললাম কেমন সিদ্ধান্তে তুমি খুশি হবে।”
“তার মানে অচেনা অজানা ওই মেয়েটার সাথেই তুমি সংসার করবে?”
“একবারও বলেছি সে কথা?”
“তাহলে?”
“রাজীব, তৃণার ছেলের আকিকায় গিয়েছিলাম ফুলতলী গ্রামে। তুমি জানোই তো। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে বাড়ি ফিরে আসছিলাম। সাথে রাজীব ও ছিল। ওদের বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক পরেই অন্বেষার বাবার বাড়ি। বিয়ে বাড়ি থেকে সানাইয়ের আওয়াজের পরিবর্তে ভাঙচুরের আওয়াজ আসছিল। কি হয়েছে জানতে বেশ কৌতূহল নিয়ে ও বাড়িতে প্রবেশ করলাম। তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না মা! অন্বেষার সৎ মা ওকে ওনার পায়ের জুতা দিয়ে দু গালে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। কেউ আটকানোর চেষ্টাও করছেনা। আশেপাশের মহিলারাও মেয়েটাকে যা নয় তাই বলে গালি দিচ্ছিল। এক কোনায় অবলার মত পড়ে আছে অন্বেষার বাবা। তার দ্বিতীয় স্ত্রী যে তার মেয়েটার সাথে জানোয়ারের মত আচরণ করছে সে ব্যপারে কোন খোঁজ খবর রাখেননি ভদ্রলোক। এসব দেখে বরাবরের মত আমার মাথা গরম হয়ে গেল। ভদ্রলোককে জানানোর পরেও তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তারপর আমি গিয়ে মহিলার হাত থেকে অন্বেষাকে উদ্ধার করলাম। আমাকে যা নয় তাই বলে গালি’গা’লাজ করলো। মন চাইছিল ক’ষে দুয়েকটা থা’প্পড় লাগিয়ে দেয়। কিন্তু আমার শিক্ষা এমন কাজে আমাকে বাধা দিল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম গ্রামের মেম্বারের গাঞ্জা’খোর, মাতাল ছেলেকে নিয়ে এসেছে অন্বেষার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তারা বিয়ে নাকচ করে দিয়েছে। আসবে না। গাঞ্জাখোরটা মাতালের মত ঢুলছিল তখনও। ভাবো একবার তুমি! আমি আর রাজীব ঘৃণ্য কাজে বাধা দেয়। এতে অন্বেষার সৎ মা সহ অনেকেই ফুঁসে ওঠে। বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে বলে এত যেহতু দরদ তাহলে তুমিই বিয়ে করো। একপ্রকার সিনেমেটিক ভাবে বিয়েটা হয়ে গেল।”
সারফারাজের দীর্ঘ বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শুনলেন মিসেস সাওদা। তারপর বললেন, “ওই গ্রামে কি কোন পুলিশ বা প্রশাসন ক্ষমতা নেই? কুরবানির গরু তোমাকেই কেন হতে হলো?”
“রাজীব পুলিশে ফোন দিয়েছিল। ওখানকার যে ওসি তিনি অন্বেষার বাবার ছোট বেলার বন্ধু। তিনিই আমাকে আলাদা করে অনুরোধ করলেন বিয়েটা করতে। মেয়েটা ভালো ছিল না ও বাড়িতে। মা! সৎ মানে তো ভালো। তাহলে ওই মহিলা এত নিষ্ঠুর কেন? অন্যের মেয়েকে নিজের মেয়ের মত জানলে খুব কি ক্ষতি হয়!”
“সবার বুদ্ধি জ্ঞান সমান হয় না সারফারাজ। বিবেক বর্জিত মানুষ অমানুষের কাতারে পড়ে। এখন বলো? তুমি কি ওই মেয়ের সাথে সংসার করতে চাও? তোমার জীবন তোমার সিদ্ধান্ত। আমি আর কিছু বলব না। অচেনা অজানা একটা মেয়ের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে?”
“বিয়েটা হওয়ার পরে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ঢাকায় ফিরলে অন্বেষার কোন একটা ব্যবস্থা করে দিব। এভাবে কি হয় নাকি। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি। যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েছে। সংসার করবো। একটা অবহেলিত মেয়েকে যদি স্থায়ী ঠিকানা দিতে পারি খুব কি খারাপ হয়ে যাবে মা?”
ছেলের কাতর কন্ঠে পিঠে কঠিন কথা বলতে পারলেন না মিসেস সাওদা। মনের মধ্যে যে ক্ষোভ ছিল ক্রমেই তা নিভে আসছে। সারফারাজের কথায় স্বায় জানিয়ে বললেন, “হয় না বাবা। তাহলে ডাকো। আমার একমাত্র ছেলের বউকে দেখব না নাকি! ডাকো?”
সারফারাজ হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। লম্বা শ্বাস নিল সে। শেষমেশ মাকে বোঝানো গেল। ভাবতেই পারেনি সারফারাজ তার মা এত সহজে সবকিছু মেনে নিবে। মায়ের উদ্দেশ্য বলল, “আমি সাইমাকে বলছি নিয়ে আসতে। তুমি বসো।”
সারফারাজ মায়ের রুম ত্যাগ করে বোনেদের রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। সাইফা, সাইমার সাথে অল্প সময়ের মধ্যে ভাব না হলেও একটু সহজ হয়েছে অন্বেষা। আগের মত অতটা জড়তা নেই। সময় গেলে হয়তো ঠিকঠাক হবে।
তিন রমনী গল্পে মশগুল। তারমধ্যে অন্বেষা শুধু মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় দুবোনের বক’বকানি শুনছে। কিছু বলছে না সে। এমন সময় সারফারাজের আগমন। দরজার সম্মুখ থেকেই তাদের উদ্দেশ্য করে বলল, “মা ডেকেছেন অন্বেষা কে। নিয়ে আয়।”
ভাইয়ের কথায় দুবোন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অর্থাৎ তারা নিয়ে আসছে। সারফারাজ আবারও মায়ের রুমের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। মায়ের সাথে কত কথা বাকি।
———————
অন্বেষা শাশুড়ি মায়ের রুমে ঢোকার আগেই লম্বা করে সালাম দিল দরজার সম্মুখ থেকে। “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।”
সাওদা বেগম উত্তর দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্। ভেতরে এসো।”
অন্বেষার দুপাশে দেহরক্ষির ন্যায় সাইমা, সাইফা দাড়ানো। মায়ের অনুমতি পেয়ে অন্বেষাকে নিয়ে রুমে ঢুকলো। ওনার রুমে এক্সট্রা কোন সোফা নেই। রুমের এক কোণায় দুটো বেতের মোড়া রাখা। সাইফা তার একটা নিয়ে অন্বেষার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল, “বসুন ভাবি।”
অন্বেষা সাথে সাথে বসলো না। সে শাশুড়ি মায়ের অনুমতির অপেক্ষা করছে। সাওদা বেগম অন্বেষার অস্বস্তি বুঝলেন। অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বসো।”
বেতের মোড়াটাই অন্বেষা বসলো। দৃষ্টি তার মেঝেতে অবনত। মিসেস সাওদা খানিকক্ষণ অন্বেষার চেহারার দিকে চেয়ে রইলেন। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে বহু পুরোনো কিছু স্মৃতি। ঝাপসা তা। ভাবনা বাদ দিয়ে বিছানায় বসা থেকে নেমে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন। সারফারাজ বরাবরের মত মায়ের বিছানায় কুশন জড়িয়ে বসে আছে। কিন্তু বর্তমানে অন্বেষা বাদে বাকি তিনটি প্রাণির দৃষ্টিতে অবাকের ছোঁয়া বিদ্যমান। কি করতে চলেছেন তাদের মা!
মিসেস সাওদা তার পুরোনো দিনের ছোট কাঠের সিন্দুক থেকে সোনার এক জোড়া বালা, একটা চিকন চেইন, আর ছোট্ট এক জোড়া দুল বের করলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন মোড়ায় বসা অন্বেষার কাছে। অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “দেখি, উঠে দাড়াও মেয়ে। বাড়ির বউদের শূন্য কান, গলা ভালো দেখাই না। এগুলো আমার শাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম ছেলের বউয়ের জন্য। ভাগ্যক্রমে তুমিই সে। এদিকে আগাও পড়িয়ে দেয়।”
যত্ন করে পড়িয়ে দিলেন গহনাগুলো। ফর্সা সুন্দর গায়ে চমৎকার লাগছে। রুমের বাকি প্রাণিগুলো মুগ্ধ দৃষ্টিতে অন্বেষাকে দেখছে। মাশা আল্লাহ্। সৃষ্টিকর্তা কত সুন্দর করে বানিয়েছেন মেয়েটাকে। যেন সব সৌন্দর্য তার জন্যই বরাদ্দ।
মিসেস সাওদা ছেলের উদ্দেশ্য বললেন, “বউকে যেখানে নিয়ে যাবে ঢেকে ঘিরে নিয়ে যেও। ঘরের চাঁদ ঘর আলো করুক। বাহিরে আলো ছড়ানোর দরকার নেই। তাছাড়া যেভাবে বিয়ে হয়েছে, হয়েছে। আমি আমার ছেলের আবার বিয়ে দিবে। সমাজ বলেও তো একটা কথা আছে। এ সময় বারবার আসে না। তুমি কি আমার সাথে একমত সারফারাজ?”
“আবশ্যই মা।” হঠাৎই সারফারাজের ফোন বেজে উঠলো শব্দ করে। শোরুম থেকে কর্মচারী ফোন দিয়েছে। সারফারাজ ফোন কেটে দিল। রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। তারপর নিজেই কল দিল। ওপাশ থেকে কল ধরতেই ব্যস্ত কন্ঠে অল্প বয়সী যুবক কন্ঠে বলে উঠলো, “ভাই? আপনে কখন আসবেন? সেই ম্যাডাম আবার আসছেন। বারবার আপনের খোঁজ করতেছেন। আপনার নাম্বার নেওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করছে। কি করবো?”
সবটা শুনে সারফারাজের কপাল বিরক্তিতে কুচকে গেল। আপদ বিদেয় হয় না কেন!
সারফারাজের সাড়াশব্দ না পেয়ে ফোনের অপর প্রান্তের যুবক কন্ঠের অধিকারী ছেলেটি পূনরায় বলল, “ভাই শুনতে পাইতাছেন?”
সারফারাজ প্রতিত্তোরে বলল, হ্যাঁ শুনছি। শোন ছোট! ম্যাডামকে যেভাবে হোক বিদেয় কর। আমি বিকালে শোরুমে আসছি।”
“আইচ্ছা ভাই।”
সারফারাজ ফোন রেখে পূনরায় মায়ের রুমে গেল। এক চক্ষুশীতলকারী দৃশ্যে তার চোখ দুটো আটকে গেল।
ইনশাআল্লাহ চলবে…..