অরুণিকা পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
1272

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩০||

৪৯.
দুই সপ্তাহ পর শতাব্দীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু তার মনোযোগ একটুও পড়াশুনায় নেই। সে তাহমিদের ভাবনায় ডুবে আছে। সকালে নাস্তা করেই সে তাহমিদকে দেখতে চলে গেলো। বাসায় ইমনই তাহমিদের সাথে ছিলো। শতাব্দীকে দেখে সে বলল,
“শতাব্দী, তুমি কি কয়েক ঘন্টা বাসায় থাকতে পারবে? আমি একটা কাজে বের হবো। এরপর অরুণিকাকেও স্কুল থেকে আনতে যাবো। আমি না আসা পর্যন্ত থাকবে?”

শতাব্দী ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। কেন থাকবো না? তুমি যাও।”

তাহমিদ তখন হুইলচেয়ারে বসে শতাব্দীর উৎসাহিত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে মনে মনে ভাবছে,
“শতাব্দী আমার সাথে থাকার জন্য এতো উৎসুক হয়ে যাচ্ছে কেন? ওইদিনও বাসায় বলেছিলো, এখানে এসে থাকবে। ও কি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?”

ইমন চলে যাওয়ার পর শতাব্দী মেইন দরজা আটকে দিয়ে তাহমিদের হুইলচেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি নাস্তা করে এসেছ?”

“হ্যাঁ, তুমি খাও নি?”

তাহমিদ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। শতাব্দী হুইলচেয়ারটি ঠেলে ঠেলে বারান্দায় নিয়ে গেলো। তারপর হুইলচেয়ার ঘেষে মেঝেতে বসে পড়লো। তাহমিদ চুপ করে আছে। শতাব্দীও কিছু বলছে না। কিন্তু এই নিরবতা যেন অনেক কিছুই বলে দিচ্ছে। তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে নিরবতা ভাঙলো। শতাব্দী তাহমিদের চোখের দিকে তাকালো। তাহমিদ সেই চোখের গভীরে ভিন্ন কিছু দেখে ফেলেছে, তাই সে কিছুক্ষণ পর চোখ সরিয়ে নিলো। শতাব্দী কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তোমার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বাসায় একদম মন বসে না। মনটা সবসময় এখানেই পড়ে থাকে।”

তাহমিদ অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

শতাব্দী তাহমিদের প্রশ্ন শুনে অভিমানী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তাহমিদ বলল,
“তোমার আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না। আমি তো একা থাকি না। আরাফ, তূর্য ওরা সবাই আমাকে দেখছে। ওদের মতো বন্ধু থাকতে আমার কিছুই হবে না।”

“শুধু কি বন্ধুরাই চিন্তা করে? আর কারো বুঝি চিন্তা হয় না!”

তাহমিদ প্রসঙ্গে পালটে বলল,
“এখন অরুণিকাও আমার যথেষ্ট যত্ন নেয়।”

শতাব্দী অভিমানী কন্ঠে বললো,
“ছোট সখীর যত্ন আর আমার যত্ন কি এক?”

তাহমিদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। শতাব্দীর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না।

কিছুক্ষণ পর তাহমিদ বলল, “আমি ভেতরে যাচ্ছি।”

“কেন? এখানে কি সমস্যা? এই মিষ্টি হাওয়া কি তোমার ভালো লাগছে না?”

“না। মাথাটা ভারী ভারী লাগছে।”

তাহমিদ হুইলচেয়ার চালাতে যাবে তখনই শতাব্দী পেছন থেকে হাতল ধরে বলল,
“কোথায় যাবে বলো, আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

“আমার ঘরে।”

শতাব্দী তাহমিদকে ঘরে নিয়ে যেতেই সে উঠার চেষ্টা করতে যাবে, তখনই শতাব্দী তাকে ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”

“ওয়াশরুমে যাবো।”

শতাব্দী কিছু একটা ভেবে বলল,
“কিভাবে যাবে? তুমি তো এখনো পায়ে ভর দিতে পারো না।”

তাহমিদ মনে মনে ইমনকে বকে যাচ্ছে। শতাব্দী বলল,
“আমি নিয়ে যাবো?”

তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকে শতাব্দীর দিকে তাকালো। শতাব্দী ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। চলো আমিই নিয়ে যাচ্ছি। আমি তোমাকে বসিয়ে দিয়ে চলে আসবো।”

হুইলচেয়ারটা টেনে ওয়াশরুমের কাছে আনতেই তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি রুমের দরজা বন্ধ করে বাইরে যাও।”

“কিন্তু তুমি!”

“তোমাকে যেতে বলছি, যাও।”

শতাব্দী বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহমিদের অপেক্ষায় রুমের বাইরে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তার ড্রয়িংরুমে রাখা টেবিলের উপর চোখ পড়লো। কাচের টেবিলের নিচে একটা কাগজ সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই তাহমিদের খাবার আর ওষুধের সময়সূচি লেখা আছে। শতাব্দী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, এখন তাহমিদকে ফল কেটে দিতে হবে। সে রান্নাঘরে গিয়ে আনার, আপেল, কমলা আর আঙ্গুর সাজিয়ে একটা প্লেটে রাখলো। তাহমিদ অনেকক্ষণ পর শতাব্দীকে ডাক দিলো। শতাব্দী প্লেট হাতে নিয়ে রুমে ঢুকলো। তাহমিদ আলমারির দিকে ইশারা করে বলল,
“উপরের তাকে আমার জামা আর প্যান্ট রাখা আছে। কিছু মনে করো না তোমাকে বিরক্ত করছি। কাপড়গুলো একটু নামিয়ে দিতে পারবে?”

শতাব্দী মুচকি হেসে এক সেট জামা নামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার তো ভালোই লাগে তুমি কোনো কাজ দিলে।”

এরপর শতাব্দী তাহমিদের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই, এখন একটু এসব বন্ধ করো। এতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখতে গেলে, তোমারই কষ্ট হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছো না, সেখানেও তোমার শুচিবায়ু যায় নি!”

“পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা ঈমানের অঙ্গ। আমাকে নামাজ পড়তে হবে। তাই জামা পাল্টাবো। তারপর ওজু করবো।”

“তুমি এই অবস্থায় নামাজ পড়বে?”

“হ্যাঁ, এতোদিন সুস্থ ছিলাম, কিন্তু সিজদা দেওয়ার জন্য একটু সময় বের করতে পারি নি। আজ আমি যার রহমতে বেঁচে আছি, তাকে ভুলে থাকতে পারবো না। সেদিন আমার কিছু হয়ে গেলে, অনেক পাপ নিয়েই মরতে হতো। আল্লাহ আমাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে। আমি আর তাকে অসন্তুষ্ট করবো না। এমনিতেই ছোটখাটো অনেক পাপ করি। নিজেকে পুরোপুরি শুদ্ধ করতে অনেক সময় লাগবে। অন্তত একটা ভালো কাজ করলে, কিছুটা ভারমুক্ত হবো।”

শতাব্দী মুগ্ধ হয়ে তাহমিদের কথা শুনছে। সে বলল,
“আমি তোমাকে ওজু করিয়ে দিতে পারবো?”

তাহমিদ মুচকি হেসে সম্মতি দিলো। শতাব্দী এরপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর তাহমিদ একা একাই কাপড় পাল্টাতে লাগলো। তাহমিদের অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। শতাব্দীর তা দেখে অনেক খারাপ লাগছে। সে ইমনকে ফোন দিয়ে বলল,
“ইমন, কোথায় তুমি?”

ফোনের ওপাশ থেকে ইমন বলল,
“আমি একটা কাজে আটকে গেছি।”

“দুপুরের রান্নাও তো হয় নি। আমি তো জানতামই না এগারোটায় তাহমিদকে ফল দিতে হবে। একটু আগেই দেখলাম। আর অরুণিকার তো অনেক আগেই স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। ও কোথায়?”

“ও আরাফের সাথে। সামনে ইদ আসবে। রোজা রেখে ইদের কেনাকাটা করা সম্ভব না। তাই শপিং করতে গেছে।”

“এখন তাহমিদ কি খাবে না কিছু?”

“হ্যাঁ, আহনাফকে ফোন দিয়েছি। ও বাইরে থেকে খাবার নিয়ে বাসায় যাবে। ও হয়তো এখন রাস্তায় আছে।”

“বাইরে থেকে কেন আনবে? আমিই রান্না করি।”

ইমন বলল,
“না, বাসায় কিছু নেই। এই সপ্তাহে আমরা বাজার করার সময় পাই নি। আর তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? কোনো তাড়া আছে?”

শতাব্দী বলল,
“আমার সমস্যা নেই। আমি বাসায় বলেই এসেছি। তাহমিদেরই কষ্ট হচ্ছে।”

“ওর কেন কষ্ট হবে?”

“ওয়াশরুমে যাওয়া নিয়ে।”

“ওহ শিট। আমার মাথায়ও আসে নি এতোকিছু। আহনাফ আসলে ওকে এসব বলো না, প্লিজ। ও আমাকে আস্ত রাখবে না।”

“আচ্ছা।”

শতাব্দী কল কেটে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ হাঁটাহাঁটি করে রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো, তাহমিদ কাপড় পালটে ফেলেছে। এবার শতাব্দী রুমে এসে ফলগুলো এগিয়ে দিলো। তাহমিদও সেগুলো খেতে লাগলো। এদিকে শতাব্দী ততক্ষণে একটা চেয়ার ওয়াশরুমে রেখে তাহমিদকে সেই চেয়ারে বসিয়ে দিলো। এরপর তাহমিদের কথা মতো তাকে ওজু করিয়ে দিতে লাগলো। এরপর সে হুইলচেয়ারটিও ভালোভাবে মুছে দিলো। তারপর শতাব্দী একটা জায়নামাজ মাটিতে বিছিয়ে তাহমিদকে আবার হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিলো। তাহমিদ নামাজ শুরু করে দিয়েছে। শতাব্দী এবার ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে তা দেখতে লাগলো আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তাহমিদের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতে লাগলো। তাহমিদ নামাজ শেষ করার আগেই আহনাফ বাসায় চলে এলো। তারপর তিনজন একসাথে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারলো। এরপর শতাব্দী চলে গেলো।

বিকেলে আরাফ অরুণিকাকে নিয়ে বাসায় ফিরলো। অরুণিকা তাহমিদের সামনে এসে বলল,
“তুমি দুপুরে পায়ে ক্রিম লাগিয়েছো?”

তাহমিদ মুচকি হেসে বললো,
“হ্যাঁ, আহনাফ লাগিয়ে দিয়েছে।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি গোসল সেরে তোমাকে আমার ড্রেসগুলো দেখাবো।”

অরুণিকা চলে যেতেই তাহমিদ ভাবনায় ডুবে গেলো। তার ভাবনায় এখন শতাব্দীর বিচরণ হচ্ছে। আজ সে শতাব্দীকে যতোটা কাছে পেয়েছে, এর আগে কখনোই পায় নি। সে বুঝতে পারছে শতাব্দী তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর তার জীবনেও শতাব্দীই প্রথম মায়াবী কিশোরী। কলকাতায় আসার পর থেকে শতাব্দী ছাড়া কোনো মেয়েকে নিয়েই তার বাড়াবাড়ি রকমের অনুভূতি ছিলো না। বরং কোনো মেয়েই তাকে আকর্ষণ করতে পারে নি। কিন্তু এখন তার নিজেরও মনে হচ্ছে এই অনুভূতি দিনদিন গভীর হয়ে যাচ্ছে। তাহমিদ চায় না, এই অনুভূতি ভালোবাসায় রূপান্তর হোক। তার শতাব্দীর প্রতি মায়া জমে গেছে। কিন্তু এই মায়া বাড়তে থাকলে, সে কখনোই মানসিক শান্তি পাবে না। কারণ শতাব্দী অন্য ধর্মের। শতাব্দীর বাবা-মা এই সম্পর্ক কখনোই মানবেন না। আর তাহমিদও এই কাজ করতে পারবে না। বাবা-মা হারিয়ে সে প্রতিটা বাবা-মার অনুভূতি বুঝে ফেলেছে। সে চায় না কোনো বাবা-মা তার সন্তানকে হারিয়ে ফেলুক। তাহমিদ মনে মনে বললো,
“আমাকে শতাব্দীর কাছ থেকে দূরত্ব রাখতে হবে। ওর এই বাসায় ঘনঘন আসা বন্ধ করতে হবে।”

৫০.

কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়, ঠিক তেমনি ইভান প্রেম দিয়ে প্রেম তুলবে। মাওশিয়াত ইভানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ইভান তার মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“ইমনকে পাওয়ার জন্য এটা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।”

মাওশিয়াত কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“এখন তুমি বলতে চাইছো, আমরা এক সাথেই কম্পিউটার ক্লাসে ভর্তি হবো। আর সেখানেই ইমনকে দেখিয়ে দেখিয়ে প্রেম করবো?”

“হ্যাঁ, কারণ ইমন ওখানেই ক্লাস করছে।”

“ওকে ডান। তাহলে কাল থেকেই আমরা আমাদের নতুন মিশন শুরু করবো। মিশন ইমনকে ফিরে পাওয়া।”

মাওশিয়াত কথাটি বলেই হাসতে লাগলো। ইভানও তার সাথে হাসছে। আর তাদের একসাথে দেখে ইমন ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইভান পাশ ফিরে ইমনকে দেখে মাওশিয়াতের হাত ধরলো। মাওশিয়াত চমকে উঠলো। ইভান বলল,
“প্রেম দিয়ে প্রেম তোলার মিশন এই মুহূর্তেই শুরু করতে হবে। কারণ তোমার প্রিয় দূরে দাঁড়িয়ে আছে।”

মাওশিয়াত ওদিকে তাকাতে যাবে তখনই ইভান তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে বলল,
“বোকা নাকি তুমি? তুমি ওদিকে তাকাচ্ছো কেন? ইমন ভাববে আমরা ওকে নিয়ে কথা বলছি। চলো, উলটো দিকে হাঁটি।”

মাওশিয়াত মাথা নেড়ে শক্ত করে ইভানের হাত ধরলো। ইভান বলল,
“এভাবে হাত চেপে ধরেছো কেন?”

মাওশিয়াত হাত আলগা করে বলল,
“উত্তেজনায় কি করবো, কি করবো না বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে যুদ্ধ হচ্ছে। আর আমি যুদ্ধে অংশ নিয়েছি।”

ইভান মাওশিয়াতের কথা শুনে হাসলো। আর এদিকে ইমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের যাওয়া দেখছে। কিছুক্ষণ পর সে সায়ন্তনীর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। সায়ন্তনী ইমনকে দেখে তড়িঘড়ি করে একটা বাটি মুছে কড়াই থেকে পেঁয়াজু নামিয়ে নিলো। ইমন আনমনে বসে আছে। সায়ন্তনী ইমনের হাত ধরে বলল,
“তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।”

ইমন বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় সায়ন্তনীর হাত ছাড়িয়ে নিলো। সায়ন্তনী কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো। তখনই মাওশিয়াত আর ইভান সায়ন্তনীর দোকানে এলো। তাদের একসাথে দেখে সায়ন্তনী খুব অবাক হলো। মাওশিয়াত বলল,
“সায়ন্তনী, এক কাপ চা, আরেক কাপ কফি দাও।”

ইমন মাওশিয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাওশিয়াত আর ইমনের চোখাচোখি হতেই মাওশিয়াত চোখ সরিয়ে ইভানের হাত ধরল। সায়ন্তনী চা বানাতে বানাতে একবার মাওশিয়াত আর ইভানের দিকে তাকালো, আরেকবার ইমনের দিকে। সায়ন্তনী মনে মনে ভাবছে,
“ইমন কি এখনো মাওশিয়াতকে পছন্দ করে?”

এদিকে তূর্য অরুণিকাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। তারপর মেকাপ বক্স সামনে নিয়ে তাকে সাজিয়ে দিতে বসেছে। আহনাফ তূর্যের ঘরে এসে দেখলো, অরুণিকা আর তূর্য অনেক হাসাহাসি করছে। আহনাফকে দেখে তূর্য বলল,
“তাহমিদের এক্সিডেন্ট হওয়ায় টুইংকেল স্কুলের প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারে নি। তাই ভাবছি আজ ওর ইচ্ছেটা পূরণ করে দেব।”

আহনাফ চেয়ার টেনে বসে বলল,
“কি করবি?”

“আজ টুইংকেলকে নিয়ে শুট করবো। আমার গানটার একটা অংশে ও থাকবে।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ওটা তো প্রেমের গান! অরু ওই গানে কি করবে?”

“প্রেম করবে!”

অরুণিকা বলল, “বউ হবো না আমি?”

তূর্য হেসে বলল,
“অবশ্যই মাই টুইংকেল টুইংকেল লিটল স্টার৷ তুমি বউ হবে।”

আহনাফ বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না ওর ভিডিওটাতে কাজ কি!”

“দেখ, গানটা ছোটবেলার প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়ে। ওই ভিডিওর একটা অংশে টুইংকেল সেই নায়িকার ছোট বেলার অংশটাতে থাকবে।”

“ওখানে ছেলে কে হবে?”

“কোনো ছেলে থাকবে না। বাসার ছাদে একটা দোলনা লাগাবো। ওখানেই টুইংকেলের শট নেবো।”

অরুণিকা বলল,
“রকস্টার তুমি অনেক ভালো।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে বললো,
“এখানে ভালো হওয়ার কি আছে!”

তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তোর এতো জ্বলছে কেন? ও আমাকে ভালো বললে তোর সমস্যা কোথায়।”

আহনাফ কোনো উত্তর দিলো না। তূর্য আবার বলল,
“এটা বলিস না যে, তুই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এখন থেকেই পজেজিভ হয়ে গেছিস। ওটা শুধু টুইংকেলকে ফেরত পাওয়ার একটামাত্র উপায় ছিলো।”

আহনাফ বলল,
“বাই এনি চান্স, যদি এই চুক্তি আমি ভবিষ্যতে মেনে নিতে চাই, তখন?”

তূর্য কথাটি শুনে হাসতে লাগল। আহনাফ বলল,
“হাসছিস কেন? আমি কি হাসার মতো কিছু বলেছি?”

তূর্য অরুণিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“লিটল স্টার, তুমি একটু বাইরে যাও।”

অরুণিকা মাথা নেড়ে শাড়ির কুঁচি ধরে বেরিয়ে পড়ল। তূর্য বলল,
“তুই একটা সময় ওকে একদমই পছন্দ করতি না।”

“হ্যাঁ করতাম না। তুই যেভাবে জিজ্ঞেস করছিস, মনে হচ্ছে তুই খুব পছন্দ করতি!”

“অদ্ভুত! আমি তো কখনোই ওকে অপছন্দ করি নি।”

আহনাফ বসা থেকে উঠতেই তূর্য বলল,
“টুইংকেল এখন অনেক কিছুই বুঝে। ও চুক্তির ব্যাপারটা না বুঝলেও আমরা যে ওর ভাই না, এটা ও ভালো করেই জানে। এটাও বুঝে কে ওকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর যার কাছে ও গুরুত্ব পাবে, ও তার কাছেই থাকতে চাইবে।”

“হোয়ট ডু ইউ মিন, তূর্য!”

“আমি বোকা না, আহনাফ। তোর ব্যাপারগুলো আমি অনেক আগে থেকেই খেয়াল করেছি। একদম শুরু থেকেই। শুধু আমার সাথেই তোর যতো ঝামেলা। এই বাসায় সবাই টুইংকেলের সাথে কথা বলে, কিন্তু আমি কথা বলতে গেলেই তুই প্রহরীর মতো বসে থাকিস। আমি অনেক বার মজা করে বলেছি ওকে বিয়ে করবো। এই মশকরা সবাই বুঝেছে। শুধুমাত্র তুই বুঝিস নি। কেন আহনাফ!”

আহনাফ কোনো উত্তর না দিয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে অরুণিকার হাত ধরে তাকে টেনে তূর্যের সামনে এনে দাঁড় করালো। অরুণিকা ফ্যালফ্যাল করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য আহনাফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কি করছিস তুই?”

আহনাফ বলল,
“আমি প্রহরীর মতো বসে থাকি? ওকে ফাইন, আমি আর এখানে বসে থাকবো না। আমি তো শুধু দেখতে এসেছি তোরা কি করছিস। আমার হয়তো এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে, দুঃখিত। এখন তোরা যা ইচ্ছা কর। আই ডোন্ট কেয়া’র!”

আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে দেখলো তাহমিদ বিছানায় শুয়ে আছে। তাহমিদ আহনাফকে দেখে বলল,
“কি হয়েছে তোর?”

আহনাফ কোনো উত্তর না দিয়ে পাশের বেডে শুইয়ে বাতি নিভিয়ে দিলো। তাহমিদ দুই-তিনবার ডাকলো। কিন্তু সে কোনো সাড়া দিলো।

এখন আহনাফের মাথায় ঘুরছে অরুণিকা কেন তাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না? আরাফের ব্যাপারটা আলাদা। কারণ আরাফই একপ্রকার অরুণিকার বাবা-মার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তূর্য ও তো ওভাবে অরুণিকাকে সময় দেয় নি। তাদের মধ্যে আরাফ, তাহমিদ আর ইভানই অরুণিকাকে অনেক বেশি সময় দিয়েছে। অন্যদিকে তূর্য যতোটুকু সময় দেয়, তার চেয়ে বেশি সময় আহনাফ অরুণিকাকে দেয়। তবুও আহনাফের চেয়ে অরুণিকার কাছে তার রকস্টারই প্রিয়। আহনাফ এখন ভাবছে, কি করলে সে অরুণিকার কাছ থেকে আলাদা মনোযোগ পাবে, যেই মনোযোগটা এখন তূর্য পাচ্ছে।

চলবে-

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩১||

৫১.
ইমনের সামনেই মাওশিয়াতের হাত ধরে কম্পিউটার ক্লাস থেকে বের হলো ইভান। ইমন চুপচাপ তাদের যাওয়া দেখছে। তার এই মুহূর্তে কিছুই ভালো লাগছে না। সায়ন্তনীর সাথে সম্পর্কে গিয়েও সে মাওশিয়াতকে ভুলতে পারছে না।

ইমন কাজ শেষ করে কম্পিউটার ল্যাব থেকে বের হলো। বাইরে আসতেই দেখলো ইভান মাওশিয়াতের চুলগুলোতে আঙ্গুল চালাচ্ছে। ইমন তাদের সামনে দিয়ে বেরুতেই মাওশিয়াত ইমনকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইভানের শার্ট ঠিক করে দিতে লাগলো। ইমন তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে চলে গেলো। ইমন চলে যাওয়ার পর মাওশিয়াত বলল,
“ইভান, এগুলো কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে! কতোদিন ধরে আমরা অভিনয় করছি! কিন্তু ইমন কিছুই বলছে না।”

ইভান বলল,
“আমি ইমনকে অনেক ভালো করেই চিনি। ও এতো ধৈর্যশীল ছেলে না। ও খুব শীঘ্রই আমাদের কাছে আসবে। তারপর আমাকে প্রশ্ন করবে। এরপর তোমাকে আবার ফেরত চাইবে। তারপর…”

মাওশিয়াত ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“যদি আসে তাহলে বুঝবো, ও আমাকে এখনো ভালোবাসে। এরপর আমি ওকে সব জানিয়ে দেবো। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।”

এদিকে ইমন সায়ন্তনীর দোকানে আসতেই সায়ন্তনী তার দিকে চা এগিয়ে দিলো। ইমন সায়ন্তনীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার হাত ধরে তাকে পাশে বসালো। সায়ন্তনী বলল,
“কি হয়েছে, ইমন?”

“আমার সাথে কম্পিউটার ক্লাসে জয়েন করবে?”

“কম্পিউটার ক্লাস! কি করবো কম্পিউটার শিখে? কলেজেই তো ভর্তি হতে পারছি না। কম্পিউটার ক্লাসের টাকা কিভাবে দেবো?”

ইমন কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি ওখানে বসেই চা বিক্রি করতে পারো। ওখানে অনেক ভীড় হয়। দেখবে তোমার ভালোই ব্যবসা হবে।”

“তাই নাকি! আচ্ছা, যাবো।”

সায়ন্তনী কথাটি বলেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমনের চোখেমুখে অস্থিরতা। সায়ন্তনী সেই অস্থিরতা দেখে তার হাত ধরে বলল,
“ভালোবাসি, ইমন!”

সায়ন্তনীর কথাটি শুনেই ইমন চমকে উঠলো। তারপর সায়ন্তনীর চোখের দিকে তাকালো৷ তখনই আরাফ দোকানে এলো। ইমন আর সায়ন্তনীকে কাছাকাছি দেখে গলা খাঁকারি দিলো। শব্দ শুনে তারা দু’জনেই দূরত্ব রেখে বসলো। সায়ন্তনী আরাফকে দেখে অস্থির কন্ঠে বললো,
“আরাফ, আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে দিচ্ছি। বসো।”

সায়ন্তনী চা বানিয়ে আরাফের হাতে দিলো। আরাফ আঁড়চোখে সায়ন্তনীর দিকে তাকালো। তার চোখে মুখে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে। প্রেমে পড়লে মানুষের চেহারার মধ্যে আলাদা মাধুর্যতা ফুটে উঠে। এই কথাটির সত্যতা সায়ন্তনীকে দেখলেই বোঝা যাবে। আরাফ সায়ন্তনীকে দেখে অনেক কিছুই বুঝতে পারে। তার চোখের গভীরতা, মিষ্টি হাসি আরাফকে ভাষা ছাড়াই অনেক কিছুই জানিয়ে দেয়। শুধু সে-ই আরাফকে বুঝে না। সায়ন্তনী হয়তো কখনোই মনোযোগ দিয়ে আরাফকে দেখে নি। দেখলে হয়তো তার চোখের গভীরে জমে থাকা আক্ষেপগুলো দৃষ্টি এড়াতো না।

কেটে গেলো কয়েক সপ্তাহ। সায়ন্তনী এখন ইমনের কথায় কোচিং সেন্টারের সামনে চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে বসে থাকে। ইমন সেখানে বসেই সায়ন্তনীর সাথে সময় কাটায়। যদিও তার মূল উদ্দেশ্য এসব মাওশিয়াতকে দেখানো।

ইমন কখনো পার্ক, কখনো খোলা রাস্তায় সায়ন্তনীর হাত ধরে নিজের গল্পের মেতে থাকে। কখনোই সে সায়ন্তনীর কাছে তার স্বপ্ন, তার ইচ্ছে, ভালোলাগা এসব নিয়ে প্রশ্ন করে নি। তবে সায়ন্তনী নিজ থেকেই ইমন সম্পর্কে সব জেনে নিয়েছে।

সায়ন্তনীর মনে ভালোবাসার ঢেউ এতো তীব্র ভাবে ফুলে উঠছিল যে সে বুঝতেই পারছিলো না, ইমনের এসব ভালোবাসার প্রকাশ শুধুই লোক দেখানো। তবে সায়ন্তনী চোখ বন্ধ করেই ইমনকে বিশ্বাস করতো। তার কোনো কিছুতেই সে বাঁধা দিতো না। সে তার মাকেও ইমনের কথা বলে ফেলেছে। তিনি ইমনকে দেখতে চাইলেন। তারপর সায়ন্তনী একদিন তাকে বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত করলো। তবে ইমন একা যায় নি। অরুণিকা, আরাফ আর আহনাফকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিল। তাহমিদকে দেখার জন্য বাসায় কাউকে থাকতে হবে, তাই তূর্য তাদের সাথে যায় নি। এদিকে ইভানও মাওশিয়াতকে নিয়ে আরাফের পিছু পিছু বিনা নিমন্ত্রণে সুড়সুড় করে চলে এলো।

সায়ন্তনীদের বাসাটা অনেক ভেতরে। কলোনির পর কলোনি, তারপর ময়লা রাস্তা পার করে তারা একটা বস্তি এলাকায় চলে এলো। আশেপাশে নর্দমার পানি উপচে হাঁটার রাস্তায় চলে এসেছে। সেখানের পাশেই মানুষ বসে আছে।

সায়ন্তনীর মনে মনে খারাপ লাগছিল। কারণ সে এমন একটা পরিবেশে শুধু ইমনকেই আনলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো৷ এখন বাকিরাও এসেছে, তাই সে ইতস্ততবোধ করছিলো। এদিকে ইমন, আরাফ, ইভান আর আহনাফের এই রাস্তায় চলতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ এর চেয়ে জটিল পথ তারা আগেও পার করেছে। কিন্তু মাওশিয়াত আর অরুণিকার জন্য এই রাস্তাটা মোটেও সুবিধার ছিল না। বস্তিতে ঢুকতেই একটা কুকুর দেখে অরুণিকা লাফাতে লাগল। সে আরাফের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“আমি বাসায় চলে যাবো। দেখো সামনে ভয়ংকর একটা কুকুর!”

আরাফ অরুণিকাকে কোলে নিয়ে নিলো। মাওশিয়াত তা দেখে বলল,
“ইশ, অরুণিকার মতো ছোট হলে, আজ আমাকেও কেউ কোলে নিতো।”

ইভান ভ্রূ কুঁচকে মাওশিয়াতের দিকে তাকালো। ইমন মাওশিয়াতের দিকে একনজর তাকিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলো।
তারা সায়ন্তনীদের বাসায় আসতেই সায়ন্তনীর মা তাদের উঠানে বসার জন্য চাটাই বিছিয়ে দিলেন৷ আহনাফ পা ভাঁজ করে চাটাইয়ের উপর বসে পড়লো। অরুণিকা সবার দিকে একবার একবার তাকিয়ে আহনাফের কোলে বসে পড়লো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এতো জায়গা থাকতে কোলে বসছো কেন?”

অরুণিকা চাটাইয়ের একপাশ দেখিয়ে বলল,
“আমি এটাতে বসবো না।”

সায়ন্তনী বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল,
“অরুণিকা, এটা গরম ভাপ লেগে একটু পুড়ে গেছে৷ ময়লা নেই। তোমরা আসবে তাই আমি সকালেই চাটাইটা ধুয়ে রোদে দিয়েছিলাম।”

আরাফ অরুণিকাকে টেনে আহনাফের কোল থেকে উঠিয়ে তার পাশে বসালো। তারপর বলল,
“সব জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। তুমি তাহমিদের কাছ থেকে বাছাবাছি করার মতো বাজে স্বভাবটিই পেয়েছো।”

অরুণিকা আরাফের কথায় মন খারাপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“এখানে আমাদের মতো চুপচাপ বসে থাকবে। আমরা যা করবো, তাই করবে। তারপর তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো।”

অরুণিকা আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“কি সারপ্রাইজ!”

“পরে বলবো।”

অরুণিকা আহনাফের কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করছে। প্রথমে সে আহনাফের মতো পা গুঁটিয়ে বসলো। আহনাফের অভ্যাস খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কাঁচা মরিচ খাওয়া। অরুণিকাও তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে কট করে মরিচে কামড় বসিয়ে দিলো। সেকেন্ড খানিক পর অরুণিকা ঝাল ঝাল করেই লাফিয়ে উঠল। সায়ন্তনী ঠান্ডা লাচ্ছি নিয়ে এলো। তা খেয়েই অরুণিকার ঝাল কমলো। তবে এতোক্ষণে তার নাকের পানি চোখের পানি এক হয়ে গেছে। আর তার এই অবস্থা দেখে সবার খাওয়া বন্ধ।

অরুণিকা শান্ত হয়ে বসার পর ইভান বলল,
“তুমি মরিচটা খেতে গেলে কেন?”

অরুণিকা অভিমানী দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে তাকে একটা চিমটে দিলো। আহনাফ হাঁ করে অরুণিকার কান্ড দেখছে। আরাফ বলল,
“তুমি আহনাফকে চিমটে দিলে কেন?”

অরুণিকা বলল,
“ও বলেছে চুপচাপ বসে থাকতে, আর সবাই যা করে তাই করতে, তারপর আমাকে সারপ্রাইজ দেবে।”

তারপর সে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এটাই তোমার সারপ্রাইজ ছিল, তাই না? আর কথা বলবো না তোমার সাথে।”

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি যদি সহজ কথা বাঁকা ভাবে বুঝো, ওটাতে আমার দোষ কোথায়? আমি তোমাকে মরিচ গিলতে বলি নি। বলেছি আমাদের মতো চুপচাপ বসে থাকতে। আমি তো সবজিও নিয়েছিলাম, ওটাতো খাচ্ছিলে না!”

“আমি এই সবজি খাই না, তুমি জানো না?”

“মরিচ তো খুব খাও! তাই না?”

অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আড়ি। হুহ।”

সায়ন্তনী দু’জনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“হয়েছে, আর কতো ঝগড়া করবে তোমরা? এবার তো শান্ত হও।”

আজ পুরো সময়টা ইভান আর মাওশিয়াত নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আর এসব ইমনের একদমই সহ্য হচ্ছিলো না। হঠাৎ তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। সে হুট করেই কথার মাঝখানে সায়ন্তনীর কাছাকাছি এসে তার অধরে চুম্বন করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব। মাওশিয়াত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ইভান আর আহনাফ বিস্মিত। আরাফের চোখ দুটি স্থির হয়ে গেছে। অরুণিকাও সবার দেখাদেখি তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আহনাফ অরুণিকার তাকানো দেখে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। অরুণিকা আহনাফকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি সামনে কেন দাঁড়িয়েছো। এখানে এতো জায়গা দেখছ না?”

অরুণিকার কন্ঠ নীরবতা কাটিয়ে দিয়েছে। ইমন শব্দ শুনেই সায়ন্তনীর কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসলো। এদিকে সায়ন্তনী লজ্জায় লাল হয়ে গেছে, আর মাওশিয়াতের মনটা একেবারেই ভেঙে গেছে। সে একা একাই সামনে হাঁটতে লাগলো। ইভান ইমনের হাত ধরে তাকে বসা থেকে দাঁড় করালো। রাগী কন্ঠে বললো,
“মাথা ঠিক আছে তোর!”

ইমন ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তোমার মাথা ঠিক আছে? তোমার যেহেতু মাথা ঠিক নেই, আমার মাথাও ঠিক নেই।”

“কি করলি এটা! তাও সবার সামনে!”

সায়ন্তনী মাথা নিচু করে একপাশে সরে দাঁড়ালো। ইভানের রাগ দেখে তার আরো বেশি লজ্জা লাগছিলো। সে কারো চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। লজ্জায় হয়তো সে এবার কেঁদেই দেবে।

আহনাফ বলল,
“আমি অরুকে নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছি। তোরা তোদের সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেল।”

আহনাফ এই কথা বলে অরুণিকাকে নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার পথে মাওশিয়াতকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“সব তোমার জেদের জন্য হয়েছে। শুরুতেই যদি সবটা বুঝতে, তাহলে এতোকিছু হতো না।”

মাওশিয়াত কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“অন্তত তোমার বন্ধুর রুচি সম্পর্কে এখন জানতে পারলাম। ইমনের মন-মানসিকতা কতো নোংরা তা আজ জেনেছি। ও লোক দেখানো সম্পর্কেও আজ দাগ লাগিয়ে দিয়েছে। এখন ও ফিরে আসলেও আমি কখনো আজকের দিনটা ভুলতে পারবো না।”

আহনাফ কোনো উত্তর দিলো না। সে অরুণিকাকে নিয়ে চলে গেল।

এদিকে ইভান ইমনকে একপাশে টেনে এনে বলল,
“আমাদের সব অভিনয় ছিল। আমরা কোনো সম্পর্কে যাই নি। ভেবেছি, তুই রাগ করে আমার কাছে আসবি, অন্তত ঝগড়া করার বাহানায় আমার সাথে কথা বলবি। তুই ভাবছিস আমি মাওশিয়াতকে ভালোবাসি, তোর জন্য ওর কাছ থেকে দূরত্ব রাখছি, কিন্তু এটা একদমই সত্য না। ও উল্টো তোকে ভালোবাসে। তোকে পাওয়ার জন্য, তোকে জ্বালানোর জন্য এতোকিছু করলো। আমরা ভেবেছিলাম, আগের মতো তুই ওর কাছে আসবি। ওকে ফেরত চাইবি।”

ইমন রাগী কন্ঠে বলল,
“বার-বার আমি কেন যাবো? ও তো আসতে পারতো।”

আরাফ বলল,
“ইমন, তুই ওকে সুযোগটাই তো দিলি না। ও তোকে বলার আগেই তুই সায়ন্তনীর সাথে সম্পর্কে চলে গিয়েছিলি!”

ইমন কথাটি শুনে আরাফকে জিজ্ঞেস করল,
“আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। একমাত্র তোকেই করি, তুই বল, মাওশিয়াত কি এখন আমাকে সত্যিই ভালোবাসে?”

আরাফ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”

ইমন আর কোনো দিকে না তাকিয়ে মাওশিয়াতের পিছু নিলো। আরাফ ইমনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে পেছন ফিরে সায়ন্তনীর দিকে তাকালো। সায়ন্তনী আসামীর মতো একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরাফের সায়ন্তনীর অসহায় মুখটা দেখেই কষ্ট লাগলো। সে মনে মনে ভাবছে,
“সায়ন্তনী যদি জানতে পারে, ইমন জেদের বশে এতোদিন তাকে পুতুলের মতো ব্যবহার করেছে, তাহলে হয়তো অনেক কষ্ট পাবে।”

সায়ন্তনীর চোখগুলো ভিজে গেলো। সে ইমনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,
“ও এভাবে বিদায় না নিয়ে চলে গেল কেন! কি কথা হচ্ছিলো ওদের মধ্যে?”

চলবে-

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩২||

৫২.
“দাঁড়াও, মাওশিয়াত। প্লিজ আমার কথাটা তো শুনো।”

“ইমন প্লিজ। আমাকে আর বিরক্ত করো না।”

“আমি ভুল করে ফেলেছি। রাগের মাথায়..”

মাওশিয়াত ইমনকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“নাটক করা বন্ধ করো। তোমার কাছে মানুষের অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। সায়ন্তনী তোমাকে ভালোবাসে। তারপরও তুমি ওর সাথে অভিনয় করেছো। আমি শুরুতেই তোমাকে বারণ করেছিলাম। আর আজকে তুমি কি করলে?”

ইমন হাতজোড় করে মাওশিয়াতকে বলল,
“সরি, সরি৷ আর এমন হবে না। প্লিজ, আমার সাথে এমন করো না। আমি তোমাকেই ভালোবাসি। সায়ন্তনীকে না।”

মাওশিয়াত তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আমিও তোমাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু এই ইমনকে নয়, আগের ইমনকে। যে মানুষকে সম্মান করতো, যে অভিমানী ছিল ঠিক, কিন্তু জেদি ছিলো না। তুমি আমাকে পরিবর্তন করে এখন নিজেকেই পরিবর্তন করে ফেলেছ? আই এম সরি, ইমন। এখন আমাদের পথ ভিন্ন হয়ে গেছে।”

ইমন মাওশিয়াতের হাত ধরে বলল,
“তুমিও আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিলে! স্কুলে সবার সামনে আমাকে অপমান করতে। আমি তো সব সহ্য করেছি, শুধু এই আশায় যে তুমি একদিন সব ভুলে আমাকেই ভালোবাসবে। আমার ছোট বয়সের আবেগটা এখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। এই কারণে আমি বুঝতে পারছিলাম না তোমাকে কিভাবে ফিরিয়ে আনবো। আমি ভেবেছি আমাকে সায়ন্তনীর সাথে দেখলে তুমি রিয়েলাইজ করবে যে তুমিও আমাকে ভালোবাসো।”

মাওশিয়াত ইমন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“প্রতিদিন আর এই তামাশাগুলো সহ্য করতে পারছি না। আমি মানসিক অশান্তিতে আছি। ইভান আর তোমার মধ্যে ঝামেলাটা শুধু আমার কারণে হয়েছে। তাই একটা কথায় বলবো, ইভান তোমাকে অনেক ভালোবাসে। নিজের ভাইকে তুমি এতোদিন অবহেলা করেছো। কিন্তু ও রাত-দিন তোমার কথা ভেবেছে। তোমরা তো সব হারিয়ে ফেলেছে। এখন তুমি কি ভাইকেও হারাতে চাইছ? মানুষ নিজের জীবনটাই ভাইয়ের জন্য ত্যাগ করে দেয়। আর তুমি ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারলে না? অন্তত সেই মানসিকতা নিয়ে যদি থাকতে, তাহলে আমি সত্যিই তোমার কাছে ফিরে আসতাম। কারণ ইভান আমাকে ভালোবাসে না। আর আমিও ধীরে ধীরে তোমার গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। কিন্তু ইমন, তুমি এখন স্বার্থপর হয়ে গেছ।”

“প্লিজ আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও।”

মাওশিয়াত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তাহলে সায়ন্তনী?”

ইমন আর কিছুই বললো না। মাওশিয়াত মলিন হেসে সামনের রাস্তায় পা বাড়ালো।

দুই সপ্তাহ দেখতে দেখতেই কেটে গেছে। সবার বাড়িতেই এখব নীরবতা বিরাজ করছে। শতাব্দী সারাদিন বাসায় বসে বসে তাহমিদকে নিয়েই ভাবতে থাকে। বাবা-মাকে সে খুব ভালোবাসে। তাদের কষ্ট দিয়ে তাহমিদকে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না৷ আর তারা তাহমিদ আর তার সম্পর্ক কখনোই মেনে নেবে না। আর তাহমিদও তাকে ভালোবাসে কিনা এই ব্যাপারে শতাব্দী কিছুই জানে না। এদিকে মাওশিয়াত সারাদিন রুমে একা একা বসে থাকে। ইমন প্রতি ঘন্টায় তিন-চারবার করে কল দেয়। কিন্তু মাওশিয়াত একবারো কল রিসিভ করে না। অন্যদিকে ইমন আর ইভানের মধ্যে সব ঝামেলা মিটে গেছে। কিন্তু তাহমিদের অসুস্থতার জন্য সবার মধ্যেই বিষন্নতা বিরাজ করছে। নতুন করে এক্স-রে করার পর তার আরো সমস্যা দেখা গিয়েছে। এখন পায়ের হাড্ডি মজবুত করার জন্য থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইভান আর আহনাফ সারাদিন তাহমিদের পেছনেই পড়ে থাকে। আর তাই অরুণিকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ইমনের উপরেই পড়েছে।
এদিকে সায়ন্তনী দোকান খুলে ইমনের অপেক্ষায় বসে থাকে। দোকানে আগের মতো সবাই আসে, শুধু ইমন আসে না। সে ইমনকে অনেকবার ফোন দিয়েছিল, কিন্তু সে কল রিসিভ করে নি। তবে আরাফ মাঝে মাঝে দোকানে এসে চা খেয়ে যায়। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর সায়ন্তনী আরাফের চোখের দিকে তাকানোর মতো সাহস পাচ্ছে না। তার আরাফের সাথে কথা বলতে খুব লজ্জা লাগছে। আরাফও সেটা বুঝতে পেরে দোকানে যাওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছে।

কিছুদিন পর মাওশিয়াত স্বাভাবিক হলো। সে বাসা থেকে বের হলো। অনেকদিন পরই সে কলেজে গেলো। মনে মনে আশা করছিলো যাতে তাকে আর ইভান বা ইমন কারো মুখোমুখিই হতে না হয়। সামনে তার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। ঘরে বসে থাকলে পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। তার উপর অনেকগুলো ল্যাব করা বাকি।
মাওশিয়াত ক্লাসে ঢুকতেই ইভানের মুখোমুখি হলো। কিন্তু সে ইভানের সাথে কোনো কথা না বলে, ক্লাসে ঢুকে পড়লো। এদিকে ইভান ক্লাস থেকে বের হয়েই ইমনকে ফোন করে মাওশিয়াতের কথা জানালো। ইমনও দেরী না করে ইভানদের কলেজে পৌঁছে গেলো। ক্লাস শেষে মাওশিয়াত কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় ইমন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ইমনকে দেখেই মাওশিয়াত চমকে উঠলো। ইমন তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায় না? একেবারেই শেষ সুযোগ। আই প্রমিজ, আমি আর এমন ভুল করবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, মাওশিয়াত। আমি যা করেছি, সেটা আমার ভুল ছিল না, অপরাধ ছিল। প্লিজ আমাকে শেষ সুযোগ দাও। আমি আর কোনো মেয়ের সাথেই কথা বলবো না৷ তুমি ছাড়া কারো দিকেই তাকাবো না।”

ইভান ইমনের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো। মনে মনে বলল,
“বাহ, কোনো মেয়ের দিকেই তাকাবে না! দেখা যাক।”

ইমন পাশে ইভানকে দেখে ভ্রূ কুঁচকালো। ইভান হাতের ইশারায় ইমনের কথাগুলো শুনে শব্দহীন তালি দিতে লাগলো। মাওশিয়াত ইমনের চোখ অনুসরণ করে পেছন ফিরতেই ইমন চোখ বড় বড় করে ইভানের দিকে তাকালো। ইভানও মুহূর্তেই স্বাভাবিক হয়ে মুখটা মলিন করে দাঁড়িয়ে রইলো৷ মাওশিয়াত এবার ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সায়ন্তনীর কি হবে?”

ইমন বলল,
“আমি আজ ওকে সব জানিয়ে দেবো।”

“এরপর ও যদি এই সত্যটা মেনে নিতে না পারে?”

ইভান সামনে এসে বলল,
“আমি বোঝাব ওকে।”

মাওশিয়াত ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অভিনয় তো তোমার ভাই করেছে, তাহলে তুমি কেন বোঝাবে?”

ইমন দাঁড়িয়ে বলল,
“আমিই বোঝাব৷ আজই বলবো। প্লিজ, আমাকে একটা সুযোগ দাও।”

“কেন সুযোগ দেবো, বলো?”

“জানি না। সুযোগ দিতে হবে, তাই দেবে।”

মাওশিয়াত ভেংচি কেটে বলল,
“কাল থেকে রোজা শুরু। আমি চাই, আজই সায়ন্তনী সব জানুক। আগামীকাল যাতে সবার জীবনে নতুন সূর্য উঠে এই আশা রাখছি।”

“তুমি কি আমাকে সুযোগ দিচ্ছ?”

মাওশিয়াত মুচকি হেসে বললো,
“ইদে আমার বাসায় তোমাদের দাওয়াত রইলো। অরুণিকা, তোমার বন্ধুদের আর…”

ইভানকে দেখিয়ে বলল,
“তোমার এই ভ্রাতাকেও নিয়ে আসবে। সেদিনই সব উত্তর পাবে।”

ইমন মনে মনে খুশি হলো। কিন্তু মুখে বলল,
“দেখো, মাও‌!”

মাওশিয়াত ‘মাও’ সম্বোধন শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইভান হেসে চলে গেলো। ইমন বলল,
“সরি, মাওশিয়াত!”

মাওশিয়াত বুকে হাত গুঁজে বলল,
“ইটস ওকে। মাও নামটা খারাপ না। মিষ্টি একটা নাম।”

ইমন কথাটি শুনে মুচকি হেসে বলল,
“মাও, বলছি কি! ইদ তো আনন্দের দিন। সেদিন এই অবুঝ যুবকটাকে কষ্ট দিও না। ঠিক আছে?”

মাওশিয়াত হাসলো। ইমন বলল,
“আমি কি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব?”

“না, আমি মামার বাসায় যাবো। পাশেই বাসা। মা আজ ওখানেই আছে। বাসায় কেউ নেই। তুমি সাথে না গেলেই ভালো হবে। নিচে মামার স্টোর আছে একটা। মাঝে মাঝে ওখানে বসেন। উনি দেখলে অনেক প্রশ্ন করবেন। আমি আপতত এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছি না। তবে সময় হলে উত্তর দিতে আপত্তি নেই।”

মাওশিয়াতের শেষ কথাটি শুনে ইমন খুশি হলো। মাওশিয়াতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে ভাবতে লাগলো, কিভাবে সে সায়ন্তনীকে সত্যটা বলবে!

৫৩.

বিকেলে সায়ন্তনীর দোকানে চায়ের আসর বসলো। তূর্য তাহমিদ আর অরুণিকাকে নিয়ে দোকানে এলো। অনেকদিন পর তাহমিদ ঘোরার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছে। সাধারণত ডাক্তার দেখানোর জন্যই সে বাসা থেকে বের হয়৷ এদিকে তূর্য দোকানে এসেই সবাইকে ফোন করে সায়ন্তনীর দোকানে আসতে বলল। অনেকদিন নিজেদের ব্যস্ততার জন্য বাসায় একসাথে থেকেও আড্ডা দেওয়া হয় না।
এদিকে ইমনও সুযোগ পেয়ে গেলো। সে দেরী না করে দশমিনিটের মধ্যেই দোকানে চলে এলো। সায়ন্তনী ইমনকে দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। চায়ের কেটলি একপাশে রেখে দৌঁড়ে ইমনের সামনে এসে দাঁড়ালো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এতোদিন কোথায় ছিলে?”

তূর্য আর তাহমিদ একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অরুণিকা হঠাৎ বলে উঠলো,
“জানো, রকস্টার, ওইদিন ইমন সায়ন্তনী আপুকে..”

এতোটুকু বলেই অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে হাসলো। ইমন রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালে, তূর্য অরুণিকাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলল। তবে তূর্য আর তাহমিদ বাকিদের কাছে এসব শুনেছিল। তখনই দোকানে আহনাফ আর ইভান চলে এলো। তাদের দেখে ইমন আর কিছু বললো না। সে বেঞ্চের উপর গিয়ে বসলো। সায়ন্তনীও কিছু না বলে দোকানে ঢুকে চায়ের কাপ সাজাতে লাগলো। সবাই চুপচাপ বসে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অরুণিকাও সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো৷ এরপর বিড়বিড় করে বলল,
“সবাই এমন স্ট্যাচু হয়ে গেছে কেন?”

সে এবার ইমনের দুই হাঁটুতে হাত রেখে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “মুভ।”

অরুণিকার এমন কান্ডে ইমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তোমরা সবাই স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন? তোমাদের মাথায় কি বিজলি পড়েছে।”

ইমন বলল, “বিজলি!”

“হ্যাঁ, বিজলি। আমাদের ক্লাসে একটা বিজলি আছে। ও কি বলে জানো? ওর সেদিন জন্ম হয়েছিল, সেদিন বাইরে বিজলি পড়ছিল। তাই ওর নাম বিজলি রাখা হয়েছে। আর বিজলি পড়লে মানুষ নাকি স্ট্যাচু হয়ে যায়।”

অরুণিকা “স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র” ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। ইভান তার হাত নামিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন তুমি কথা কম বলো। আর চুপচাপ বসে থাকো।”

অরুণিকা ইভানের উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে ইভানকে ভেংচি কাটলো। তূর্য আর তাহমিদ তার মুখোমুখি থাকায়, তারা অরুণিকার মুখের ভঙ্গিমা দেখে হাসতে লাগলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোরা হাসছিস কেন?”

অরুণিকা পেছন ফিরে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তূর্য আর তাহমিদের দিকে তাকালো। তারপর ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে ইশারায় তাদের চুপ থাকতে বলল। তারপর তূর্যের কানের কাছে গিয়ে বলল,
“ওদের কিছু বলবে না। ঠিক আছে? ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা।”

তূর্য মুখ চেপে হেসে বলল,
“কি বলছো এগুলো?”

“এখন ওরা ভাববে ওদের নিয়ে কথা বলছি।”

অরুণিকা কথাটি বলেই মুখে হাত দিয়ে হাসলো।

তারপর তাহমিদের কানের কাছে এসে বলল,
“ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা!”

তাহমিদ কানে হাত দিয়ে অরুণিকাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “কি!”

অরুণিকা আবার ফিসফিস করে বলল,
“আরেহ, আমি তো ওদের জ্বালানোর জন্য বলছি। ওরা ভাববে ওদের নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু আমি তো ব্লা ব্লা করছি। বুঝেছো?”

তাহমিদ মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বুঝলাম।”

অরুণিকা আবার বলল,
“ওরা তিনটাই দুষ্টু ছেলে। ইমনও এখন দুষ্টু হয়ে গেছে। ও এখন ইভানের মতোই আমাকে বকা দেয়।”

ইমন ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এই ও কি বলছে তোদের কানে কানে?”

অরুণিকা বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসে বলল,
“বলবো না। এটা আমাদের সিক্রেট।”

আহনাফ অরুণিকার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
“আমরাও তোমার ক্লু লেস কথা শুনতে আমরা আগ্রহী নই।”

তখনই আরাফ এলো। আরাফ এসেই অরুণিকার পাশে বসে পড়লো। তারা অনেকক্ষণ টুকটাক কথা বললো৷ তাদের ক্লাসে ঘটা হাস্যকর কথাগুলো ভাগাভাগি করলো। চা-নাস্তাও করলো। এবার ইমন সিদ্ধান্ত নিলো, যাওয়ার আগে সায়ন্তনীকে সব জানিয়েই যাবে। তাই সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।

সায়ন্তনীর সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো। সায়ন্তনী বলল,
“ইমন, কিছু বলবে?”

এদিকে ইভান ছাড়া বাকিরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন বলল,
“আই এম সরি, সায়ন্তনী। আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”

ইমনের মুখে এমন কথা শুনে সায়ন্তনীর বুকটা খালি হয়ে গেলো। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কি বলছো, ইমন?”

ইমন বাকি কথাগুলোও সায়ন্তনীকে বলল। সায়ন্তনী সব শুনে বলল,
“আমি তো তোমার সাথে অভিনয় করি নি। আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল না।”

“আমি জানি। আমাকে ক্ষমা করে দাও, প্লিজ।”

“তুমি কি সত্যিই মাওশিয়াতের সাথে নতুনভাবে সব শুরু করছো?”

ইমন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। সায়ন্তনী ধপ করে বেঞ্চে বসে মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে রাখলো। সে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলো। সে এতোগুলো মানুষের সামনে কাঁদতে চায় না। তবুও পারছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো শরীরে আবরণ না থাকলে, সব ছিঁটকে বেরিয়ে পড়তো। তার গলাটা ভারী ভারী লাগছিল। ভালোভাবে নিঃশ্বাসও ফেলতে পারছিলো না। অরুণিকা ধীর পায়ে সায়ন্তনীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর ইমনের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল,
“তুমি একদম ভালো না। তুমি আপুকে কাঁদালে কেন? তুমি জানো, আপু কত ভালো?”

ইমন হাঁটু গেড়ে সায়ন্তনীর সামনে বসে পড়লো। বলল,
“আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি হয়তো…”

সায়ন্তনী মাথা তুলে ছলছল চোখে ইমনের দিকে তাকাতেই ইমন কথা থামিয়ে দিলো। সায়ন্তনী বলল,
“অপরাধ করো নি। পাপ করেছো। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবে না। আমার মা আর ভাই ছাড়া কেউ নেই। আমার মা মুসলিম, বাবা হিন্দু ছিলো। তারা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছিল। তারপর বাবা একদিন আমাদের রেখে চলে যায়। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা বিয়ে করেছিলো, তাই দাদা-নানার পরিবারের কেউই আমাদের মেনে নেয় নি। তারপর থেকে আমাদের জায়গা বস্তিতে হয়েছিল। আমি কোনো ধর্মই পালন কর‍তাম না। আমি কখনোই ভাবি নি আমার জীবনে ভালোবাসা আসবে। ভালোবাসার জন্যই তো আজ এতো কষ্ট হচ্ছে আমাদের। এরপর তোমাকে ভালো লাগার পর মাকে বললাম, আমি মুসলিম হবো। মাও তা-ই চাইতো। এরপর ধর্মান্তর হওয়ার পর আল্লাহর কাছে তোমাকে চাইতাম। পেলামও। কিন্তু এভাবে তো পেতে চাই নি।”

“সরি, সায়ন্তনী!”

“সরি? এই দোকানে বসেছি। আজ পর্যন্ত কেউ স্পর্শ করতে পারে নি আমাকে। তুমি তো আমার শরীরে দাগ লাগিয়ে দিয়েছ, ইমন।”

ইভান বলল,
“কি বলছো এসব সায়ন্তনী? এগুলো এখন খুব স্বাভাবিক!”

আরাফ ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই চুপ কর।”

সায়ন্তনী ইভানের সামনে এসে বলল,
“তোমাদের মতো পুরুষের কাছে স্বাভাবিক। আমাদের মতো মেয়েদের কাছে অনেক বেশি কিছু। ভালোবাসার অর্থই প্রেমিকাকে স্পর্শ করা না। আমি এটাই শিখেছি। কিন্তু দোষ তো আমার। আমিই বাঁধা দেই নি। কারণ আমি তো ভাবতাম, অন্তত ইমন প্রতারণা করার মতো ছেলে না। কিন্তু সব প্রতারকই তো ভালো সেজেই প্রতারণা করে।”

ইমন বলল,
“প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও, সায়ন্তনী।”

“না, ইমন। আমি তোমাকে আটকাবো না। তুমি চলে যাও। আমার সামনেও আর এসো না। কিন্তু আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। কারণ আমি অভিনয় করি নি। ভালোবেসেও অভিনেত্রীর খেতাব পেয়েছি, শুধু তোমার জন্য। এখন যাও এখান থেকে। আর এই দোকানের আশেপাশে আসবে না।”

অরুণিকা সায়ন্তনীর হাত ধরে বলল,
“আপু, তুমি রাগ করো না।”

সায়ন্তনী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“যাও, তুমিও। আমি চাই না আমার কষ্টগুলো তোমার উপর আসুক। কিন্তু সত্য তো এটাই, মেয়েরাই এই সমাজে বেশি প্রতারিত হয়। তোমার সাথে এমন…”

ইমন সায়ন্তনীকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“প্লিজ, সায়ন্তনী। তুমি খারাপ কথা বলো না।”

ইভান রাগী কন্ঠে বললো,
“তুমি এসবের মধ্যে অরুণিকাকে কেন টেনে আনছো?”

সায়ন্তনী বলল,
“আমি শুধুই উদাহরণ দিলাম। এতেই এতো খারাপ লাগছে? তাহলে ভাবো, সত্যটা তো আমার সাথে ঘটেছে। আমার কেমন লাগছে?”

তূর্য অরুণিকার হাত ধরে ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর তামাশাগুলো তুই একাই শেষ কর।”

আরাফ আর ইমন ছাড়া সবাই চলে গেলো। সায়ন্তনী বলল,
“তোমরাও যাও।”

ইমন চলে যেতেই আরাফ সায়ন্তনীর কাছে এসে বলল, “সায়ন্তনী!”

“কিছু কি বলার বাকি আছে?”

“জীবনকে কি আরেকবার সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি….”

“প্লিজ, আরাফ। যাও। আমি আর নিতে পারছি না।”

আরাফ মাথা নেড়ে চলে গেলো। আরাফ চলে যাওয়ার পর সায়ন্তনী দোকান বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে ডুঁকরে কেঁদে উঠলো। দুই হাত তুলে বলল,
“আমি তোমার কাছে ইমনকে চেয়েছিলাম, এখনো সেই চাওয়া থেমে থাকবে না। আমি আমার ভালোবাসা ভিক্ষা চাই। আমি জোর করবো না। কাউকে জোর করবো না। কিন্তু এমন কি হওয়া সম্ভব না, ও নিজেই আমার কাছে ফিরে আসবে?”

সায়ন্তনী কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি ওকে কিভাবে ভুলে থাকবো? কিভাবে মেনে নিবো যে এসব অভিনয় ছিল? আমি তো অভিনয় করি নি। ভালোবেসেছিলাম। খুব ভালোবেসেছিলাম।”

চলবে-