#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৮||
৭৯.
“কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়া তুই এই কথা কিভাবে বললি? তুই কি জানিস তুই কি বলেছিস?”
তূর্য ইভানের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সামনে এগুতে লাগলো। ইভান আবার এসে জেরা করতেই তূর্য বলল,
“আমি এখন উপমাকে বিয়ে না করলে সারাজীবন এই অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তার চেয়ে ভালো বিয়ে করে সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলি।”
“তুই উপমাকে ভালোবাসিস না, তারপরও ওকে বিয়ে করবি?”
“ভালো তো আমি কাউকেই বাসি না। এখন অন্তত যে আমাকে ভালোবাসে, তাকেই তো বিয়ে করা উচিত, তাই না?”
“কি বলছিস এসব? তূর্য দেখ, চিন্তাভাবনা করে কথা বল। তোর ভুলভাল সিদ্ধান্ত, পরবর্তীতে আমাদের সবাইকে সমস্যায় ফেলবে।”
তূর্য কোনো উত্তর না দিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলো। সারাদিন শহরের অলিগলি হেঁটে সে উপমাকে নিয়েই ভাবতে লাগলো৷ উপমার সাথে অনলাইনে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করে তাকে ভালোবাসার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই সে উপমাকে অনুভব করতে পারছে না। এখন তার মধ্যে অনুভূতির অভাব আছে নাকি উপমাই থাকে সেই ভালোবাসাটা দিতে পারে নি, এটা নিয়েই তূর্য দ্বিধায় আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে পিছু হটে যাওয়া মানেই তার সম্মান নষ্ট হওয়া।
এদিকে আদিল বাসায় এসে পুরো দিন উপমাকে পর্যবেক্ষণ করলো আর বুঝলো এই মুহূর্তে তার বোনকে ভালো করার একমাত্র উপায় রিকিকে উপমার সামনে নিয়ে আসা। তাই সে দেরী না করে বাবাকে ফোন করে সব ঘটনায় খুলে বললো। করিম সিদ্দিক ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“আর আমি উপমাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবো, এটা তুই কিভাবে ভাবলি?”
“তোমার মেয়েই তো পাগল হয়ে যাচ্ছে। তুমি এসেই বরং সামলাও। কিছু হলে আমাকে আর মাকে দোষারোপ করতে পারবে না কিন্তু।”
“আমি কিসের অভাবে রেখেছি তোদের? বিদেশে বসেও আমাকে শান্তি দিলি না তোরা দুই ভাই-বোন। তোর মা কি করছিল এতোদিন? মেয়েকে তো চোখে চোখেই রাখতে পারলো না।”
“বাবা প্লিজ। এসব বলে তুমি মা আর তোমার মধ্যে ঝামেলা করো না।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমার দেশে আসতে সময় লাগবে। আগে ছুটি নিতে হবে অফিস থেকে। এরপর টিকেট করতে হবে। তারপরই আসতে পারবো। এমনি বললেই আসা যায় নাকি?”
করিম সিদ্দিক রাগ করে ফোন রেখে দিলেন। মিসেস জুলেখা সব জানার পর উপমাকে মারতে চাইলেন, কিন্তু আদিলই মাকে আটকিয়েছে। এদিকে উপমা মনে মনে অনেক খুশি। ভাইয়ের মুখ থেকে শুনেছে রিকি তাকে বিয়ে করতে চায়। এতোটুকু শুনেই সে কিছুটা স্বাভাবিক হলো। আর মায়ের বকুনি খেয়েও সে আনমনে হাসছিল। আদিল বোনের চোখ দেখে বুঝলো, উপমার ভালো থাকা রিকির মাঝেই আছে। সে নিজেও একজনকে ভালোবাসে। তাই বুঝে, ভালোবাসা মানুষকে কতোটা উন্মাদ করে দেয়। এখন সে তূর্য ওরফে রিকির সব তথ্য বের করে তবেই আগাবে।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আদিল অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে, শুধু এতোটুকুই জানলো, তূর্যের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কেউই নেই। সবাই দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কেমন দুর্ঘটনায় মারা গেছে এটা এখনো বের করতে পারে নি। আদিল আরো জেনেছে তূর্যের পরিবার তার বন্ধুদের নিয়েই। আর বিয়ে হলে উপমাকেও তাদের সাথে এক ঘরে থাকতে হবে, যেটা আদিলের পছন্দ হয় নি। তূর্য বর্তমানে কলকাতায় আছে, তাই এখন বিয়ে হলে উপমাকে সে কলকাতায় নিয়ে যাবে, যেটা করিম সিদ্দিক কখনোই মেনে নেবেন না। পড়াশুনার দিক থেকে চিন্তা করলে তূর্যের অনার্স শেষ। সে সবেমাত্র মাস্টার্সে মাত্র ভর্তি হয়েছে। পড়াশুনায় তেমন ভালো নয়। তাই বাংলাদেশে চাকরির প্রতিযোগিতায় তূর্য পাশ করবে কিনা, এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এতোটুকুই তূর্যের পরিচয়। তবে রিকি সম্পর্কে তথ্য নিতে গিয়েই আদিল এই পাত্রকে ফেলে দেওয়ার মতো ভাবলো না। কারণ রিকি নিজেকে প্রকাশ না করেই যেভাবে খ্যাতি পেয়েছে, প্রকাশ করলে হয়তো সে আরো উপরে উঠতে পারবে। তার নিজস্ব ব্যান্ড আছে। সে নিজের এলবাম বের করেই লক্ষ টাকা আয় করতে পারছে। মাঝে মাঝে কলকাতার বিভিন্ন সিনেমায় সে গান করে। তবে সেখানে তার বেশি পরিচিতি নেই। তূর্যের সব কিছু জানার পর করিম সিদ্দিক দেশে আসার সিদ্ধান্ত বাদ দিলেন। কারণ তিনি একমাত্র মেয়েকে এভাবে এতো দূরে পাঠাবেন না। কিন্তু উপমা বাবার ‘না’ শুনেই পাগলের মতো কান্নাকাটি করতে লাগলো। মিসেস জুলেখা মেয়ের অবস্থা দেখে পাথরের মতো বসে আছেন। একটামাত্র মেয়েকে কিভাবে কলকাতায় থাকা একটার ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন, যেখানে ছেলের কোনো বাবা-মা নেই, কোনো অভিভাবক নেই, থাকে বন্ধুদের সাথে। এভাবে তো মেয়ে দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু মিসেস জুলেখা আর আদিল এই কথা কোনোভাবেই উপমাকে বুঝাতে পারলো না।
এদিকে ইভানের ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় সে আর বাংলাদেশে থাকতে চাইছে না। আর তূর্যের সিদ্ধান্তেও তার পুরোপুরি বিশ্বাস না থাকায় সে এখনো বাকিদের এই ব্যাপারে কিছুই জানায় নি। অন্যদিকে উপমার জোরাজুরিতে করিম সিদ্দিক তার অফিস থেকে ছুটি নিয়ে টিকেট কাটলেন৷ পরের সপ্তাহে তিনি দেশে আসবেন। বাবার দেশে আসার খবর শুনে আদিল আবার তূর্যের সাথে দেখা করলো। এবারও তূর্য বিয়ের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় আদিল এই সম্পর্ক আগানোর জন্য তূর্যকে বাবা-মার সাথে দেখা করার প্রস্তাব দিলো। এদিকে এসব দেখে ইভানও বুঝে গেলো, তূর্য আর বোঝাবুঝির পর্যায়ে নেই। তাই সে তূর্যের সাথে আর কথা না বলে সরাসরি আরাফকে বিষয়টা জানালো। তূর্য বিয়ে করতে চাইছে, এটা আরাফ আর তাহমিদ কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু ইমন খবরটা শুনে খুবই খুশি হলো আর বলল,
“শেষমেশ তূর্য বিয়ে করে আমাদের উদ্ধার করছে।”
ইমনের কথা শুনে আহনাফ মনে মনে বলল,
“আমাদের না, আমাকেই বিশেষ ভাবে উদ্ধার করছে।”
আহনাফ সাথে সাথেই তূর্যকে ফোন করে বলল,
“তুই বিয়ে করছিস এটা শুনেই আমার অনেক ভালো লাগছে।”
তূর্য চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“আমি কি ঠিক করছি, আহনাফ?”
“অবশ্যই। এটাই তো বিয়ে করার বয়স।”
এরপর আহনাফ বসে বসে গুগল ঘেঁটে বিয়ে করার ধর্মীয়, শারীরিক আর মানসিক সুবিধাগুলো বের করে তূর্যকে পাঠাতে লাগলো। এসব দেখে তূর্য কিছুক্ষণের জন্য নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত হলেও পরক্ষণেই তাহমিদ আর আরাফ তাকে ফোন করে বলতে লাগল, বিয়ে কোনো ছেলেখেলা না। এই পরিস্থিতি বিয়ে করে সে উপমাকে কোথায় রাখবে? আর যেখানে সে উপমাকে ভালোই বাসে না, সেখানে কোন যুক্তিতে সে উপমাকে বিয়ে করবে? এসব কথায় তূর্য আরো দ্বিধায় পড়ে গেলো।
এদিকে আহনাফ অরুণিকার ঘরে এসে বলল,
“একটা খুশির সংবাদ আছে!”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি সংবাদ?”
“ঘরে ভাবী আসবে।”
অরুণিকা পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে বলল,
“শতু আপুর তো বিয়ে হয়ে গেছে!”
“তাহমিদের না।”
অরুণিকা খুশি হয়ে বলল,
“মাওশিয়াত আপু আর ইমনের বিয়ে?”
“আরেহ না।”
অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে অবাক হয়ে বলল,
“আরাফ বিয়ে করবে!”
“আরাফ না। ভেবে দেখো।”
অরুণিকা বিছানায় ধপ করে বসে বলল,
“তাহলে তুমিই করবে আর কি!”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি করবো মানে? আমি ছাড়া কি বাসায় আর কেউ নেই?”
“হ্যাঁ, তুমিই আছো। বাকিরা তো করবে না।”
“আমি বলেছি ঘরে ভাবী আসবে। তোমার বুঝে নেওয়া উচিত ছিল….”
অরুণিকা আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার বউ আমার ভাবীই হবে।”
“আমার বউ তোমার ভাবী হবে, আমার তো ভাবী হবে না!”
“তুমি এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা কেন বলছো? সোজাসুজি বলে দাও কে বিয়ে করছে।”
“তূর্য বিয়ে করছে।”
অরুণিকা অবাক হয়ে বলল, “রকস্টার!”
আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, রকস্টার।”
অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে বলল,
“ও তো আমাকে বলেছে ও বিয়ে করবে না।”
আহনাফ সাথে সাথেই ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কেন, ও বিয়ে করুক, না করুক তোমার কি!”
“ও আমাকে বলেছে করবে না।”
“এখন তো করছে।”
অরুণিকা আহনাফকে সরিয়ে দিয়ে আরাফকে এসে জিজ্ঞেস করতেই আরাফও হ্যাঁ বললো। তখন অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে বললো,
“ও আমাকে বলেছে ও বিয়ে করবে না। ও বিয়ে করলে আমি ওর সাথে কথায় বলবো না।”
আহনাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“ও বিয়ে করলে তোমার সমস্যা কি?”
“হ্যাঁ, আমার সমস্যা আছে।”
“কি সমস্যা?”
“তোমাকে কেন বলবো?”
“দেখো অরু, ও বিয়ে করবে মানে করবে।”
“না, ও বিয়ে করবে না। রকস্টার নিজেই আমাকে বলেছে ও বিয়ে করবে না। ও আমাকে মিথ্যে কেন বলবে তাহলে?”
“অদ্ভুত মেয়ে তো! ও বিয়ে করলে তোমার সমস্যাটা কোথায় আমি বুঝতে পারছি না!”
আরাফ এবার জোর গলায় বলল,
“তোদের ঝগড়া করতে ইচ্ছে করলে, ঘর থেকে বের হ। এমনিতেই ওই ছেলে প্রেম করে আমাদের ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে, আর এদিকে তোরা দুইজন সকাল সন্ধ্যা কুকুরের মতো চিল্লাফাল্লা করিস। যাবি এখান থেকে তোরা?”
আরাফের ধমক খেয়ে অরুণিকা চুপসে গেলো। যাওয়ার আগে সে আহনাফের হাতে চিমটে দিয়ে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। আর আহনাফ হাত ধরে সেই বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।
৮০.
তূর্য অনেকক্ষণ ধরে সোফায় বসে আছে। আর তার পাশে তাহমিদ। অন্যদিকে আদিলের পাশে ইভান বসে আছে। আর তাদের মুখোমুখি ইমন বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তূর্যের মুখোমুখি বসে আছেন করিম সিদ্দিক আর তার স্ত্রী মিসেস জুলেখা। তূর্যের জোরাজুরিতে তাহমিদ আর ইমন বাংলাদেশে এসেছে৷
এদিকে করিম সিদ্দিক তূর্য ও তার বন্ধুদের ভালোভাবে দেখে বলল,
“তুমি বিয়ের পর উপমাকে কোথায় রাখবে?”
তূর্য একবার তাহমিদের দিকে তাকালো, আরেকবার ইভানের দিকে। আদিল তূর্যের তাকানো দেখে বুঝলো এই নিয়ে তূর্য হয়তো এখনো দ্বিধায় আছে। সে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমরা বাসায় কে কে থাকো?”
ইভান সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
“আমরা বাসায় ছ’জন থাকি। আর আমাদের একটা বোন আছে।”
মিসেস জুলেখা উৎসাহ নিয়ে বললেন,
“শুনলাম, তোমরা তো বন্ধু। বোনটা কি তোমার নাকি তূর্যের?”
“না, আরাফ আর আহনাফের কাজিন। ওরা তো আসতে পারি নি। নয়তো দেখা হয়ে যেতো।”
“ওহ, আচ্ছা। মেয়েটা তোমাদের সাথে থাকে! তোমরা এতোগুলো ছেলে! ওর বাবা-মা নেই?”
“না আন্টি, আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়রা একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে।”
“কেমন এক্সিডেন্ট!”
ইভান এবার সবার দিকে একনজর তাকালো। তারপর বলল,
“আমরা অনেক ছোট ছিলাম। কি হয়েছিল ঠিক মনে নেই। আমরা এক চাচার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম, ওখান থেকে এসেই শুনলাম সবাই মারা গেছে। বাসায় আগুন লেগেছিল।”
করিম সিদ্দিক ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“ইন্না-লিল্লাহ। সবাই মারা গেছে? মানে তোমাদের সবার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, সবাই মারা গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“এটা কি বাংলাদেশে হয়েছিল?”
“জ্বি।”
“কবে হয়েছিল?”
“আমরা অনেক ছোট ছিলাম, আংকেল। আমাদের সময় তারিখ মনে নেই। আর এরপর চাচার সাথে কলকাতায় চলে গিয়েছিলাম।”
“এখানে তোমাদের বাড়ি কোথায়?”
“চাঁদগাও ছিল।”
করিম সিদ্দিক ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“আহ! আট কি নয় বছর আগে ওদিকে মৈত্রী গ্রুপের বিল্ডার্সরা থাকতো। ওখানেই তো আগুন লেগেছিল শুনেছি। ওই বাড়ির সবাই মারা গিয়েছিল। পত্রিকায় এসেছিল কেউ বেঁচে ফেরে নি। তোমরা ওই বংশের কেউ না তো!”
ইমন ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না, না, আংকেল। ওদিকে না।”
মিসেস জুলেখা স্বামীকে বললেন,
“আরেহ, চাঁদগাও কি একটু খানি জায়গা নাকি? অন্যদিকে কোথাও হবে। কিন্তু আমি এমন খবর পড়ি নি। হয়তো মনে নেই। কতো সংবাদ আসে, আগুন লাগে, বিস্ফোরণ হয়, খুন হয়। এই খবরটা হয়তো চোখে পড়ে নি। নয়তো এক পরিবারের এতোজন মারা গেছে, পত্রিকায় তো আসার কথা।”
তূর্য মনে মনে বলল,
“এরা যেভাবে সি আই ডির মতো তদন্ত করছে, মনে হচ্ছে বিয়ের পর আমাকে প্রশ্ন জগতে প্রবেশ করতে হবে। এখনো সময় আছে, এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ায় ভালো। নয়তো আমার সারাজীবন এই প্রশ্ন উত্তরের মধ্যে দিয়েই চলে যাবে। এই প্রশ্নগুলোর চেয়ে তো কোর্স পরীক্ষার প্রশ্নগুলো সহজ ছিল।”
এবার মিসেস জুলেখা তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বাবা, তূর্য। তুমি তো খুব ভালো গান করো। উপমা আমাকে শুনিয়েছিল।”
তূর্য বিনয়ী হেসে বলল, “জ্বি, আন্টি।”
“একটা গান শুনাও তো।”
মিসেস জুলেখার কথায় তূর্য, তাহমিদ আর ইভান অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। ইমন মুখ টিপে হাসলো। ইমনকে হাসতে দেখে আদিল মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মা, কি বলছো এসব!”
মিসেস জুলেখা ছেলেকে ধমক দিয়ে বললেন,
“তুই চুপ কর। দেখতে হবে না, আমার মেয়ের পছন্দ কেমন?”
তারপর তিনি তূর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“বাবা, তুমি শুরু করো।”
তূর্য সবার দিকে একনজর তাকালো। তাহমিদ ধীর কন্ঠে বললো,
“বাবা, একটা ভদ্র গান গেও। আর আমাদের মান-সম্মানটাও রক্ষা করো।”
তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে গাইতে লাগলো নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গানটি। ব্যস, গান শেষ হওয়ার পর পরই মিসেস জুলেখা খুশি হয়ে বলে ফেললেন,
“আমার ছেলে পছন্দ হয়েছে।”
করিম সিদ্দিক হেসে বললেন, “আমারও।”
মিসেস জুলেখা আবার বললেন,
“তো বাবা, তুমি তো বিয়ের পর উপমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাবে, তাই না?”
“জ্বি আন্টি। ও যেতে চাইলে যাবে। এমনিতেই আমরা সবাই আগামী বছর বাংলাদেশেই ফিরবো। আমাদের পড়াশুনাও শেষ হয়ে যাবে। আর সময়ও শেষ। আমরা তো ওই দেশে পারমানেন্ট ভিসা পাই নি। আর আমাদের সিটিজেনশিপও নেই। অনেকের সাহায্য ছিল, তাই এতো বছর থাকতে পেরেছি।”
“ওহ আচ্ছা। তাহলে কি করবে?”
তূর্য কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“উপমা যেতে চাইলে যাবে। আর আমি ভাবছি ওকে নিয়েই যাবো, একমাস থাকার পর দেশে নিয়ে আসবো। তারপর এখানেই বাসা নিয়ে ফেলবো। আর পরীক্ষাটা দেওয়ার জন্য হয়তো আমাকে আবার কলকাতা যেতে হবে। তারপর পরীক্ষা দিয়েই এখানে চলে আসবো।”
“ঠিক আছে। আরেকটা কথা। কেউ তো বড়জন আছেই তোমাদের। তাদের সাথে দেখা হলে ভালো হতো। তোমার ওই চাচা, যার কথা বলেছিলে, তার সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দাও।”
“জ্বি, দেখা করাবো। আপনারা বরং কলকাতায় আসলে ভালো হবে। বাসাটাও চিনে নিবেন। সবার সাথে পরিচয়ও করিয়ে দেবো।”
এবার আদিল বলল,
“এটা ভালো বলেছো। আমরা বরং এক সপ্তাহের জন্য কলকাতায় যাই। তারপরই বিয়ের কথাবার্তা আগাবো।”
চলবে-
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৪৯||
৮১.
কলকাতায় এসে মাওশিয়াতের বাবা-মা, মিরাজ হাসান আর তিশা হাসানের সাথে দেখা করলেন উপমার বাবা-মা। ছেলের তো একজন অভিভাবক প্রয়োজন। অভিভাবক ছাড়া মেয়েকে ছেলের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব না। মূলত উপমার জোরাজুরিতেই তারা এই সম্পর্কে আগাচ্ছেন। নয়তো মেয়েকে এমন অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই তাদের ছিল না। তবে করিম সিদ্দিক আর মিসেস জুলেখার তূর্যকে পছন্দ হয়েছে। তারা সবাই কথাবার্তার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলেন দুই মাস পর একেবারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করবেন।
এদিকে তূর্য কলকাতায় ফেরার পর থেকে অরুণিকা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তূর্য তার আশেপাশে এলেই সে দূরে চলে যাচ্ছে। আহনাফের বিষয়টা একদমই পছন্দ হচ্ছে না। সে ভয়ে আছে, অরুণিকার এমন হাবভাব দেখে যদি তূর্য বিয়ে করতে না চায়?
বিকেলে অরুণিকা রুমে বসে টিভি দেখছিল। তখনই তূর্য তার সামনে এসে বসলো। অরুণিকা হাত নাড়িয়ে বলল,
“সরো। আমি টিভি দেখছি।”
তূর্য অরুণিকার দুই পা ধরে তাকে টেনে নিজের কাছে আনলো। অরুণিকা পা ভাঁজ করে বলল,
“কি সমস্যা তোমার?”
তূর্য মুখ ছোট করে বলল,
“আমার টুইংকেলটা কেন আমার সাথে রাগ করেছে?”
আহনাফ তখনই রুমে এসে তাদের একসাথে দেখে বলল,
“কি হচ্ছে? তূর্য, দেখছিস না ও টিভি দেখছে! তুই এদিকে আয়।”
তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এই তোর কি সমস্যা? আমি আমার টুইংকেলের সাথে কথা বলছি।”
“ও তোর সাথে কথা বলবে না। আয় এদিকে, বিয়ের শপিংয়ের লিস্ট করতে হবে।”
অরুণিকা আহনাফের কথা শুনে তূর্যের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে আগের জায়গায় বসে পড়লো। তূর্য আহনাফের কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে আবার ধরে টেনে তার কাছে আনলো। এবার আহনাফের প্রচুর রাগ হলো। সে রাগটা দমিয়ে তূর্যকে টেনে উঠাবে, তখনই অরুণিকা বসা থেকে উঠে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুমি দেখছো না রকস্টার আমার রাগ ভাঙাতে এসেছে? তুমি কেন ওকে বিরক্ত করছো?”
হুট করে এমন কথা শুনে আহনাফের খুব খারাপ লাগলো। সে তূর্যের হাত ছেড়ে দিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, কথা বল তোরা।”
তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তূর্য কপাল চাপড়ে বলল,
“আহনাফ, তুই আবার গাল ফুলিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
তারপর অরুণিকাকে বলল,
“দেখলে তো, আহনাফ রাগ করে চলে গেলো!”
অরুণিকা আহনাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও কি আমার কথায় রাগ করেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, আমি ওর রাগ ভাঙাতে পারবো। তুমি আগে আমার রাগ ভাঙাও।”
এরপর অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে তাকালো। তূর্য অরুণিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমার টুইংকেল কেন রাগ করেছে?”
অরুণিকা মলিন মুখে বললো,
“তুমি আমাকে বলেছ, বিয়ে করবে না। কিন্তু এখন বিয়ে করছ কেন?”
“হ্যাঁ, বিয়ে তো করতে চাই নি। কিন্তু এখন তো হয়ে যাচ্ছে।”
“এখন তো আমাকে কেউই সময় দেবে না।”
“কেন দেবে না? কে বলেছে দেবে না?”
“তুমিই তো বলেছো।”
তূর্য কপাল চাপড়ে বলল,
“ওটা তো এমনি বলেছি।”
“না, কেন বলবে? একদিন সবাই বিয়ে করে ফেলবে, তখন সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমাকে কেউ দেখবে না। আমার সাথে কথাও বলবে না, ঘুরতেও নিয়ে যাবে না। তুমি বলেছ, তুমি সবসময় আমার সাথে কথা বলবে। সবাই বিয়ে করলেও তুমি করবে না। সবাই ভাবী নিয়ে ঘুরবে, আর তুমি আমাকে নিয়ে ঘুরবে। কিন্তু দেখো, তুমিই বিয়ে করে ফেলছো! আমার তো কেউ নেই। এক কাজ করো, আমাকেও বিয়ে দিয়ে দাও। আমিও তখন আমার বর নিয়ে ঘুরবো।”
তূর্য হাতে মুখ গুঁজে বলল,
“হায় আল্লাহ, এ মেয়েটা বলে কি!”
তারপর অরুণিকার দিকে তাকিয়ে তার দুই হাত ধরে বলল,
“আমি, তুমি আর তোমার ভাবী, আমার তিনজন একসাথে ঘুরবো।”
“ভাবী কি আমাকে শতু আপুর মতো ভালোবাসবে?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। ভালোবাসবে না কেন? আমার টুইংকেলকে ভালোবাসতে পারবে না এমন কেউ আছে?”
“না, আগে আমি ভাবীর সাথে কথা বলবো। তারপরই বুঝবো।”
তূর্য এবার উপমাকে ফোন দিয়ে অরুণিকার সাথে কথা বলিয়ে দিলো। অরুণিকা প্রায় এক ঘন্টা উপমার সাথে কথা বলার পর তূর্যকে ফোন দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমি ভাবীকে ভাবী বলবো না কিন্তু। সুইট স্টার বলবো। কারণ ভাবী অনেক সুইট।”
তূর্য মুচকি হাসলো। ফোনটি কানের কাছে এনে উপমার মিষ্টি কন্ঠ শুনে বলল,
“আগে বলো আমার টুইংকেলকে কেমন লেগেছে?”
উপমা হেসে বলল,
“অনেক মিষ্টি একটা বাচ্চা। ও এতো সুন্দর করে কথা বলে! আমাকে বলছে, আমি যাতে ওর সখী হয়ে যাই। তারপর রকস্টার আর আমাকে নিয়ে সে বাইরে ঘুরতে যাবে। জানো, এতোদিন আমি খুব চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু ওর সাথে কথা বলে মনে হচ্ছে, আমি বিয়ের পর একটা বোন পাবো।”
তূর্য প্রশান্তির হাসি দিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ, উপমা। তোমার কথাটা শুনে ভালো লাগলো। টুইংকেল আমাদের ছয় জনেরই প্রাণ। আমি চাই, তুমি ওকে আমাদের মতোই আগলে রাখো। ওর কিছু হলে আমরা সহ্য করতে পারবো না।”
“অরুণিকাকে অনেক ভালোবাসো, তাই না?”
“হ্যাঁ, নিজের চেয়েও বেশি। ওকে ছাড়া আমার দিনটাই ফিঁকে লাগে। এতোদিন বাংলাদেশে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। এখন ওকে দেখার পর থেকে সব ভালো লাগছে।”
উপমা হেসে বলল,
“আচ্ছা, আমিসহ থাকলে হয়তো বিরক্ত লাগতো না।”
তূর্য মলিন হাসলো। উপমা মনে করছে, সে উপমাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তো অনুশোচনা থেকে বাঁচার জন্য বিয়ে করছে। উপমা যদি জানতে পারে, সে উপমাকে ভালোবাসতো না। এসব সময় কাটানোর জন্য ছিল, তখন অনেক কষ্ট পাবে।
তূর্য উপমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফোন কেটে দিয়ে মনে মনে বলল,
“সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে, আমি কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছি না। আমি এতো দুর্বল তো আগে ছিলাম না।”
এদিকে ইভানকে রহমত চাচা ফোন করলেন। তিনি অনেকক্ষণ ইভানের সাথে কথা বললেন। তার সাথে কথা বলার পর থেকেই ইভান ভাবনায় ডুবে গেলো। আহনাফ তাকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে?”
বাকিরাও ততোক্ষণে ইভানের সামনে এসে বসলো। সবাই ইভানকে চিন্তিত দেখে ভাবছে, কিছু একটা তো হয়েছে। এবার তাহমিদ বলল,
“ইভান, কার ফোন ছিল?”
ইমন বলল,
“হ্যাঁ, ভাই। কে ফোন দিয়েছে? কখন থেকে এভাবে পাথরের মতো বসে আছিস।”
ইভান এবার তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“এভাবে কি দেখছিস?”
ইভান থমথমে কন্ঠে বলল,
“রহমত চাচা তোর বিয়ের খবর কিভাবে জানলো?”
“মানে? আমি তো উনার সাথে কথায় বলি নি।”
“তাহলে উনি তোর বিয়ের কথা কিভাবে জানলো? এই খবর তার কাছে যাওয়া একদমই অসম্ভব ছিল। কারণ আমরা ছ’জন, আর মাওশিয়াতের বাবা-মা ছাড়া এটা কারোই জানার কথা না।”
আরাফ কিছু একটা ভেবে বলল,
“উনি কি মাওশিয়াতের বাবা-মার সাথে যোগাযোগ করে?”
ইমন বলল,
“না। উনারা তো সালেহ আলীকে চেনে। রহমত চাচা তো কখনো কলকাতায় আসে নি।”
“তাহলে কি সালেহ আলীর সাথে যোগাযোগ আছে?”
তাহমিদ বলল,
“হয়তো অরুণিকা কাউকে বলেছে!”
ইভান অরুণিকাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে “না” বললো। এবার ইমন মাওশিয়াতকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলো। সেও বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে জানালো, তাদের সাথে সালেহ চাচার কোনো যোগাযোগ নেই।
আহনাফ বলল,
“তবে কি কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে?”
হঠাৎ ইমনের টনক নড়লো। সে সাথে সাথে মাওশিয়াতকে কল করলো আর বলল,
“তোমাদের বাসার কাজের মহিলাটি কি জানে তূর্যের বিয়ে?”
“হ্যাঁ কেন জানবে না? তিনি তো আমাদের সাথেই থাকে। ইনফ্যাক্ট, উনি সবসময় তোমাদের কথায় জিজ্ঞেস করে। উনার তো অনেক আফসোস হয় তোমরা একা একা থাকো তাই।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
“কিন্তু তুমি উনার কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?”
“এমনিতেই। আচ্ছা উনাকে আপতত আমাদের কথা কিছুই বলো না। আর তুমি সময় নিয়ে আমাদের বাসায় এসো।”
ইমন কল কেটে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমরাই পিছিয়ে আছি। শত্রুপক্ষ জানে, আমরা কি করছি, কি করছি না। রহমতুল্লাহ, আগের মহল্লায় আমাদের ওঠাবসার খবর সালেহ চাচার মাধ্যমে পেয়েছিল। নতুন এলাকায় যাওয়ার পর আমাদের বাসায় পারমানেন্ট কাজ করার জন্য এক মহিলা এসেছিল। কান্নাকাটি করছিল, তাকে কাজে রাখার জন্য। কিন্তু আমরাই তাকে রাখি নি। কিছুদিন আগে আমি সেই মহিলাকে মাওশিয়াতদের বাসায় দেখেছি। সে নাকি সাড়ে তিন বছর ধরে সেখানেই কাজ করে। তার মানে কি? মাওশিয়াতের কাছ থেকে সে সব তথ্য নিয়ে আমাদের শত্রুদের দিচ্ছে। আর রহমত চাচা সেখান থেকেই সব খবর পেয়েছে।”
চলবে-
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
৮২.
দুই মাস পর, উপমা আর তূর্যের বিয়ে উপলক্ষে ছ’জনই অরুণিকাকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তাদের সাথে মাওশিয়াত আর তার বাবা-মাও এসেছে। আদিল আগে থেকেই তাদের থাকার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তার এক বন্ধুর মামার ফ্ল্যাট খালি ছিল। এখন সবাই সেখানেই উঠেছে।
আগামীকাল সন্ধ্যায় এনগেজমেন্ট। উপমা তার বান্ধবীদের ফোন করে জানাচ্ছে, তার রিকির সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে। কিন্তু তার বান্ধবীরা কোনোভাবেই তার কথা বিশ্বাস করছে না। উপমা সবাইকে একটা কথায় বলছে,
“আগে দেখা করিস, তারপর আমার স্টার তোদের সব কনফিউশান দূর করে দেবে।”
পরের দিন থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। আর উপমা জানালার গ্রিল ধরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আদিল বোনের কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কি রে, মন খারাপ কেন? তোর প্রিয় স্টারের সাথেই তো তোর বিয়ে হচ্ছে।”
উপমা মলিন মুখে বললো,
“ভাইয়া, এই বর্ষায় বিয়েটা না রাখলে হতো না? মানুষ শীতের সময় বিয়ে করে। আর তোমরা বর্ষায় বিয়ের অনুষ্ঠান রেখেছো। দেখো, আজ নিশ্চিত বৃষ্টি নামবে। আর এই বৃষ্টি এক সপ্তাহ ধরে থাকবে।”
“থাক, সবাই শীতে বিয়ে করে, আর আমার বোন বর্ষায় করবে। চিন্তা করিস না, তোর বিয়েটা অনেক স্পেশাল হবে। আমি তোর জন্য এই দিনগুলো স্পেশাল বানিয়ে দেবো। দেখবি, তখন বর্ষা আসলেই আমার কথা মনে পড়বে।”
উপমা ভেজা কণ্ঠে বলল,
“বর্ষা কেন, আমার তো প্রতি ঋতুতেই তোমার কথা মনে পড়বে।”
আদিল বোনকে জড়িয়ে ধরলো। আদিলের খুব কান্না পাচ্ছে। একটা মাত্র বোন তার! বিয়ে দিয়ে দিলে ঘরটা খালি হয়ে যাবে।
এদিকে সন্ধ্যায় সব অতিথিরা চলে এসেছে। ছেলেপক্ষের সবাই উপস্থিত হওয়ার পর তূর্যকে ঘিরে উপমার বান্ধবীদের ভীড় জমলো। সেই হাত, সেই চুল, তাহলে কি উপমা সত্যি কথায় বলেছিল? এটাই ‘রিকি দা স্টার?’ কিন্তু এভাবে বিশ্বাস করা তো সম্ভব না। তাই সবাই তূর্যকে গান গাওয়ার অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু এতো সহজে তূর্য আজ গান গাইবে না। সে বলল, অন্যদিন শুনাবে। আদিল তূর্যকে উপমার বান্ধবীদের ভীড় থেকে বের করে সোফায় বসালো। কিছুক্ষণ পর মিসেস জুলেখা উপমাকে একটা সোনালি রঙের শাড়ি পরিয়ে নিয়ে এলেন। তারপর তিনি উপমাকে তূর্যের পাশে বসিয়ে দিলেন৷ উপমা লজ্জায় তূর্যের দিকে তাকাতে পারছে না। তূর্যের মাখা সেই পরিচিত সুগন্ধির ঘ্রাণটা তার নাকে এলো। উপমার কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগছে। তার মনের মধ্যে উত্তাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, রিকির সাথেই তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। রিং পরানোর পর অরুণিকা উপমার হাত ধরে বলল,
“আজ থেকে তুমি আমার সুইট স্টার। ঠিক আছে?”
উপমা মুচকি হেসে অরুণিকার থুতনি ধরে বলল,
“আর তুমি আমার মুনলিট।”
অরুণিকা গালে হাত দিয়ে বলল,
“ওয়াও, আমার নামটা খুব পছন্দ হয়েছে।”
করিম সিদ্দিক মাওশিয়াতের বাবাকে বললেন,
“বেয়াই সাহেব, ভাবছি আমরা দুইদিন পর আক্দ অনুষ্ঠানটা করবো। তারপর এক সপ্তাহ পর মেয়েকে উঠিয়ে দেবো।”
মিরাজ হাসান বললেন,
“জ্বি, যেটাতে আপনাদের সুবিধা।”
রাতে বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলো। অরুণিকা জানালার বাইরে হাত বের করে দিয়ে বৃষ্টির স্পর্শ অনুভব করছে। তখনই আহনাফ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। সে বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। অরুণিকা আহনাফকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি এভাবে ভ্যাবলা কান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
আহনাফ ধীর কন্ঠে বললো,
“তুমি আমাকে একটুও সম্মান করো না।”
“আমি আবার কখন অসম্মান করলাম?”
“এই যে এখন ভ্যাবলা কান্ত বললে! এটা অসম্মান না?”
“ওটা তো এমনিতেই বলেছি।”
“সবাইকে তুমি কতো সুন্দর করে সম্বোধন করো। আমার সাথে তোমার কি সমস্যা? অরু, বলো না, আমার সাথে কেন এমন করো?”
অরুণিকা কিছু না বলে চলে যেতে নিবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে বলল,
“দাঁড়াও আমার পাশে।”
“না, দাঁড়াবো না।”
কথাটি বলেই অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে চলে গেলো। অরুণিকা যাওয়ার পর আহনাফ জানালার বাইরে বৃষ্টিস্নাত শহরকে দেখতে লাগলো। তার মনটা আজ অশান্ত। এই মুহূর্তে তার কিছুই ভালো লাগছে না। অরুণিকাকে সে কিভাবে নিজের করে পাবে, সেটাই ভাবছে। জোর করে কি ভালোবাসা পাওয়া যায়? সে তো তার পিচ্ছি অরুকে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন অরুণিকা বড় হয়ে যদি তাকে ভালোবাসতে না পারে? এখনই এমন খিটখিটে ভাব দেখায়, বড় হলে হয়তো সহ্যই করতে পারবে না। আহনাফ শক্ত করে জানালার গ্রিল আঁকড়ে ধরলো। তার গলা ভারী হয়ে আসছে। ভেজা কন্ঠে সে দু’টো শব্দ বের করল শুধু,
“ভালোবাসি অরু।”
সকালে ইভান রাস্তায় বের হয়ে দেখলো পানি জমে পুরো রাস্তা ভরে গেছে। প্যান্ট ভাঁজ করে সে পানিতে নেমে পড়লো। একটু বৃষ্টিতেই শহরের এই রূপ তার চির পরিচিত। ছোট ছোট বাচ্চারা পানিতে ধাপাধাপি করছে। কাল রাতে আহনাফের জ্বর উঠেছিল। তাই এই মুহূর্তে তার জন্য ওষুধ কিনতেই সে ফার্মেসিতে যাচ্ছে। মেইন রোডে আসতেই একটা গাড়ি জোরে তার সামনে দিয়ে চলে গেলো। আর রাস্তার সব পানি তাকে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। ইভান সেখানেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত ড্রেনের পানি রাস্তার পানির সাথে মিশে গেছে, দ্বিতীয়ত সেই পানিগুলোই তার মুখে এসে পড়েছে।
এদিকে গাড়িটা কিছুদূর গিয়ে থামলো। তারপর আবার পেছনে এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। তারপর গাড়ির গ্লাস নামিয়ে একটা মেয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“সরি সরি সরি, আমি আপনাকে দেখি নি। আচ্ছা, এই নিন টিস্যু। সব ময়লা পানি আপনার মুখে এসে পড়েছে। আসলে কিছু বদমাশ লোক আমার পিছু করছিলো, তাই হুড়োহুড়িতে খেয়াল করি নি।”
ইভান পরিচিত কন্ঠ শুনে চোখ খুলে দেখলো, এটা তো সেই মেয়েটাই। ইভান এক ঝটকায় টিস্যুটা টেনে নিয়ে মুখটা মুছে গাড়ির জানালায় ভর দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বদমাশ লোকগুলো এখনো আপনার পিছু ছাড়ে নি? নাকি জন্মের পর থেকেই আপনার পিছু নিচ্ছিলো?”
সানায়া হাঁ করে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি? আপনি, সেই লোকটা?”
“জ্বি, আমিই সেই ব্যাক্তি যার গায়ে আপনি কখনো পানি ঢেলে দেন, কখনো রিকশা থেকে ফেলে দেন, আবার এখন একেবারে গোসল করিয়ে দিয়েছেন।”
সানায়া গাড়ির দরজা খুলে নামতে গিয়ে রাস্তায় পানি দেখে আর নামলো না। ইভান হনহনিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো। ইভানের এমন অবস্থা দেখে সানায়ার খুব খারাপ লাগলো। সে গাড়িটা একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে গাড়ির অন্য দরজা খুলে উঁচু রাস্তায় উঠে দাঁড়ালো। তারপর ইভানের পিছু এসে বলল,
“সরি, আপনি আমার উপর রাগ করেছেন?”
ইভান রাগী দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্লিজ এখান থেকে যান। নয়তো আপনাকে সেই বদমাশ লোকগুলো উঠিয়ে নিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, আগে আমার কথাটা তো শুনুন। দেখুন একবার আমার কথা শুনলে আপনার নিশ্চিত আমার উপর মায়া হবে।”
“আমি কারো মায়ায় পড়ি না।”
কথাটা বলেই ইভান হাঁটা শুরু করলে সানায়া তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কেন? আপনি কি মানুষ না?”
“মানে?”
“মানুষ মানেই মায়ায় পড়বে। মানুষের মন আছে, মানুষ মহৎ হয়। সবগুলো শব্দই ম দিয়ে, তাই তাদের অন্যের সমস্যার কথা শুনলে মায়া লাগবে, স্বাভাবিক!”
“আমার এতো সময় নেই যে যার-তার সমস্যার কথা শুনে মায়া বাড়াবো!”
ইভান কথাটি বলেই চলে যাবে তখনই সানায়া চেঁচিয়ে বললো,
“আমাকে এ্যাটিটিউড দেখাচ্ছে! হুহ।”
ইভান পেছন ফিরে একনজর সানায়ার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। সানায়াও সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে গিয়ে বসলো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“সব পুরুষ মানুষের একটাই সমস্যা, নিজেদের মহামানব মনে করে।”
৮৩.
তিন কবুল বলেই তূর্য আর উপমার আক্দ সম্পন্ন হলো। আক্দ হওয়ার পর তাদের পাশাপাশি বসানো হলো। আর তূর্যকে ঘিরে বসে রইলো উপমার বান্ধবীরা। তাদের মধ্যে একজন বলল,
“ভাইয়া, আপনি তো অনেক ভালো গান করেন, একটা গান শুনাবেন?”
আরেকজন বলল,
“হ্যাঁ, আপনার ভালোবাসার মানুষটার জন্য না হয় গান করেন। সে হয়তো আপনার গান শুনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে।”
তূর্যকে পাশের বাসার ভাড়াটিয়ার ছেলের গিটার এনে দেওয়া হলো। সে গিটারটিতে সুর তুলে কন্ঠে গান ধরলো,
“কারণে-অকারণে, নিষেধে বা বারণে,
তোমার নামেই যত জোছনা নিলাম,
নিয়মে-অনিয়মে, দহনে বা ধারণে,
আমায় নিখোঁজ ভাবো বাঁ পাশেই ছিলাম।
.
চোখে জল নোনা কি? নিয়ে গেল জোনাকি
কেন আমি পথে একা দাঁড়িয়ে?
আলোদের পিয়নে, সোডিয়াম নিয়নে যেন
সবই কোথায় হারিয়ে…
.
আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে.. তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি, তোমার স্বপ্নে পুড়ে যাই
এমন সাধের পৃথিবীতে..তোমায় চেয়েছি পুরোটাই
পুরোটাই…”
উপমা অবাক হয়ে তূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বুকের মাঝে হঠাৎ একটা পাথর চেপে বসেছে। সে শুনেছিল, ভালোবাসার মানুষ চোখের দিকে তাকিয়ে গান করে। কিন্তু তূর্য একটিবারের জন্যও তার দিকে তাকালো না। তূর্যের চোখ কখনো অরুণিকার দিকে, কখনো বা উপমার বান্ধবীদের দিকে, কখনো বা নিচের দিকে যাচ্ছে। গান শেষ হওয়ার পর উপমার এক বান্ধবী তার কাছে এসে বলল,
“তুই অনেক ভাগ্যবতী রে, তোর ক্রাশের সাথেই তোর বিয়ে হয়েছে। তাও আবার যেমন তেমন ক্রাশ নয়, একেবারে সেলেব্রিটি ক্রাশ! ভাইয়াকে চোখে চোখে রাখিস কিন্তু। যেমন হ্যান্ডসাম, তেমনি চমৎকার তার কন্ঠ, তার উপর আবার সে সেলেব্রিটি মানুষ। এসব সেলেব্রিটিদের সংসার বেশিদিন টিকে না।”
উপমা ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ও আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না।”
এদিকে অরুণিকা তূর্যের পাশে বসে ছবি উঠাচ্ছে। তূর্য একবারও ক্যামেরা ম্যানকে বলছে না, উপমার সাথে তার ছবি উঠিয়ে দিতে। উপমা তাই মন খারাপ করে বসে আছে। এদিকে রাতে তূর্যও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। এক সপ্তাহ পর সে উপমাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। তবে এর মধ্যে তূর্য একবারো উপমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে দেখায় নি। উপমাও তূর্যকে বিরক্ত করে নি।
পাঁচদিন পর আকাশে রোদ উঠেছে। আরাফ অরুণিকাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা মেয়ে দৌঁড়ে তার কাছে এসে বলল,
“ভাইয়া একটা সাহায্য করবেন?”
আরাফ মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটির চোখেমুখে ভীতি।
পরিবেশ ঠান্ডা। কয়েকদিন বৃষ্টি পড়েছিল, তাই মিষ্টি রোদ উঠলেও ঠান্ডা বাতাস বইছে। তবে এর মধ্যেও মেয়েটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অরুণিকা বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”
মেয়েটা কাঁপা কন্ঠে আরাফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কিছু লোক আমার পিছু নিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে ফলো করছে। আমি একটা কল করতে পারবো? আসলে আমার ফোনটা বাসায় রেখে এসেছি।”
আরাফ তার ফোন এগিয়ে দিতেই মেয়েটা একটা নম্বরে কল দিয়ে বলল,
“সাহিল, কোথায় তুমি?”
ওপাশ থেকে সাহিল বলল,
“রাহি! তুমি এটা কার নম্বর থেকে ফোন করেছো?”
“রাস্তায় একজনকে পেয়েছি, সেখান থেকেই কল করেছি।”
“তুমি জানো আমি কে? আমি সাহিল মির্জা। তুমি যে কারো কাছ থেকে ফোন নিয়ে আমাকে ফোন করতে পারবে না। তোমার ফোন কোথায়?”
রাহি রাগী কন্ঠে বললো,
“সরি সাহিল মির্জা, ভুল হয়ে গেছে আমার। তবে একটা কথা জানিয়ে দেই, আপনার কর্মকান্ডের ফলস্বরূপ আমাকে এখন রাস্তায় নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে। থাক, আপনার এখানে আসতে হবে না। আপনার তো সময় নষ্ট হবে। আমি না হয় অন্য কারো সাহায্য নেবো।”
কথাটা বলেই রাহি কল কেটে দিয়ে নম্বরটি ডিলিট করে দিলো। আর সাথে সাথেই সাহিলের কল এলো। রাহি কল রিসিভ করেই বলল,
“কেন ফোন দিয়েছ?”
“কোথায় তুমি?”
“জাহান্নামে।”
সাহিল চেঁচিয়ে বলল, “কোথায় তাড়াতাড়ি বলো?”
রাহি ঠিকানা বলতেই সাহিল দশ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলো, সাথে আরো দুইটা গাড়ি এসেছে। আরাফ এতোক্ষণ রাহির সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল। সাহিলকে দেখে রাহি দৌঁড়ে যেতেই আরাফ হাঁটা শুরু করলো। সে অরুণিকাকে নিজের সামনে এনে পেছন ফিরে সাহিলের দিকে তাকালো। অরুণিকা ব্যথায় বলে উঠলো,
“আহ! আরাফ, তুমি এতো শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছো কেন?”
আরাফ সাথে সাথেই হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ওহ সরি। খেয়াল করি নি।”
তারপর আরেকবার সে পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো সাহিল মির্জা তার বডিগার্ড নিয়ে গাড়িতে উঠে গেছে। আরাফ গাড়িগুলোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“শাহেদ মির্জা আমাদের পরিচয় কেঁড়ে নিয়ে, নিজের ছেলেকে উপরে উঠিয়ে দিয়েছে। এই অন্যায়ের প্রতিশোধ তো একদিন নিবোই, মির্জা সাহেব। আজ মির্জা গ্রুপের এমডির সাথে দেখা হয়ে গেলো, কাল আপনার সাথে দেখা হবে।”
দুই সপ্তাহ পর তূর্য আর উপমার বিয়ের দিনটি চলে এলো। উপমা বউ সেজে স্টেজে বসে আছে। বর পক্ষ আসার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু বর এখনো আসছে না। বিয়ে বাড়িতে সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। উপমার বান্ধবীরা বলাবলি করছে,
“স্টার হয়তো বউ রেখে পালিয়েছে।”
আদিল বার-বার ফোন দিচ্ছে তূর্যকে, কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। বাকিদের ফোনেও কল যাচ্ছে না। আদিল বোনের দিকে একনজর তাকিয়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলো। গাড়ি নিয়ে সে সোজা তূর্যরা যেই বাসায় উঠেছিল, সেখানে গেল। গিয়ে দেখলো দরজা খোলা, আর পুরো ঘর এলোমেলো। আদিল ঘর থেকে বের হতেই পেছন থেকে কেউ একজন তার পিঠে ছুরি ঠেকালো। আদিল পিছু ফিরতেই মুখোশধারী লোকটা তার একপাশে ছুরিকাঘাত করলো। আদিল সাথে সাথেই ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো।
এদিকে তূর্য আর আরাফ ক্লাবে এসেছে। বাকিরা কেউ আসে নি। তূর্য ক্লাবে আসতেই সবাই তাকে বরণ করে নিলো। কিন্তু তূর্য আর আরাফের চোখে-মুখে আতংক। তারা ক্লাবে ঢুকেই সোজা করিম সিদ্দিকের কাছে চলে গেলো। আর তূর্য বলল,
“আংকেল, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আমাদের এখনই কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। আপনি উপমাকে বিদায় করে দিন।”
“কি বলছো এসব? এভাবে হুট করে বিদায়?”
“প্লিজ আংকেল, আমরা এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।”
তূর্য স্টেজে উঠে উপমার হাত ধরে তাকে স্টেজ থেকে নামালো। এদিকে করিম সিদ্দিক আদিলকে ফোন করছেন। অনেকবার কল হওয়ার পর ওপাশ থেকে আদিল কল রিসিভ করে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বাবা, আমি তূর্যদের ফ্ল্যাটে এসেছিলাম। কেউ একজন আমার কাঁধে ছুরি চালিয়েছে। অনেক রক্ত যাচ্ছে। আমাকে এখান থেকে নিতে আসো৷ সাথে পুলিশও নিয়ে আসো।”
করিম সিদ্দিক ছেলের এমন কথা শুনে হিতাহিতজ্ঞান হারালেন। তূর্য আর আরাফ আদিলের উপর আক্রমণ হয়েছে শুনে আরো চিন্তায় পড়ে গেলো। তারা সবাই তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাটে গেলো। এরপর আদিলকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করালো। সেখান থেকেই তূর্য উপমাকে বাসায় নিয়ে গেলো। উপমা শাড়ি পরিবর্তন করে তার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। তূর্য এরপর তাকে নিয়ে স্টেশনে চলে এলো। উপমা যদিও ভাইকে এই অবস্থায় ফেলে যেতে চাচ্ছিল না। কিন্তু বাবা-মার চুপচাপ হয়ে থাকা, আর তূর্যের জোরাজুরিতে সে কলকাতায় যেতে বাধ্য হলো। আর এদিকে ডাক্তারও বলেছে, আদিল এখন ঠিক আছে। ক্ষত এতো বেশি গভীর ছিল না। তাই উপমাকে হাসপাতাল থেকে বের করানো গেলো। নয়তো তূর্য টেনে নিয়ে আসতে চাইলেও সে আসতো না।
বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে উপমা। তার হাতে মেহেদি, মুখে এখনো বিয়ের সাজ। শুধু বিয়ের শাড়িটাই পরিবর্তন করে একটা সাধারণ জামা পরেছে। তার পাশে তূর্য স্থির হয়ে বসে আছে। তূর্য ও তার বন্ধুদের থমথমে চেহারা দেখে সে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। তার জীবন এমন জায়গায় মোড় ঘুরিয়েছে, সে এর কোনো শেষ খুঁজে পাচ্ছে না। তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন। একদিকে আজ তার বিয়ে, আর তার বর বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তাকে স্টেজ থেকে নামিয়ে তার সাথে অজানা পরিবেশে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে তার ভাইয়ের উপর হামলা হয়েছে, অথচ সে তার পাশে থাকতে পারছে না। এভাবে তো কারো বিয়ে হয় না। জীবনে সে এমন বিয়ে হতেও দেখে নি। তার এই চমৎকার দিনটা আজ নষ্ট হয়ে গেলো।
চলবে–