অরুণিকা পর্ব-৫৩ এবং বোনাস পর্ব

0
1003

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৫৩||

৮৮.
আজ বাসা ভর্তি অতিথি। মাওশিয়াতের খুব কাছের আত্মীয়রাও টুইংকেল হাউজে চলে এসেছে। চারটার পর অনুষ্ঠান শুরু হবে। অরুণিকার খুব ইচ্ছে ছিল এই অনুষ্ঠানে গানের আয়োজন করবে। কেউ পারুক বা না পারুক সবাইকেই গান গাইতে হবে৷ আর গান গাইতে না পারলে তাকে ডেয়ার দেওয়া হবে৷ আর ডেয়ার দেওয়ার দায়িত্ব একমাত্র অরুণিকার কাছেই থাকবে। সে অনেকদিন ধরেই ইমনের কাছ থেকে তার এই আয়োজনের সম্মতি খুঁজছিল। কারণ যার এনগেজমেন্ট সে যদি রাজি হয়, তাহলে সবাই অংশগ্রহণ করতে বাধ্য। তবে অরুণিকার মূল উদ্দেশ্য ইমানের কন্ঠে গান শুনা। আর যদি সে গান গাইতে না চায়, তাহলে তার প্রিয় মানুষের নাম জেনে নিতে পারবে। দু’টোই অরুণিকার অনুকূলে আছে।
কিছুক্ষণ পর আবার বেল বেজে উঠলো। অরুণিকা শব্দ শুনে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সানায়া আপি এসেছে হয়তো।”

ইভান বুকে হাত গুঁজে অন্যদিকে মুখ ঘোরালো। অরুণিকা দরজা খুলেই দেখলো সানায়া দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশে রাহি। দু’জনেই অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরলো। সানায়া অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“তুমি চেয়েছো, তাই আমরা এসেছি।”

তারা ঘরে ঢুকতেই সানায়ার সাথে ইভানের চোখাচোখি হলো। ইভান সানায়াকে দেখেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। সানায়া আর রাহি দু’জনই আকাশি রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। তবে সবচেয়ে বেশি সানায়াই ইভানকে মুগ্ধ করেছে। এই মেয়ের মধ্যে নিশ্চিত কোনো মুগ্ধতা আছে। নয়তো মনে এতো ঘৃণা থাকার পরও এই মেয়েটা তাকে বরাবরই আকর্ষণ করতে পারে। সানায়া জুতোয় টকটক শব্দ তুলে ইভানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ইভানের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। ইভান সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,
“আজকে তোমার সাথে কি বদমাশ লোকগুলো আসে নি?”

সানায়া ইভানের কথা শুনে থেমে গেলো। পিছু ফিরে বলল,
“না, ওদের বলে দিয়েছি, যেখানে যাচ্ছি সেখানে আরেকটা বদমাশ লোক আছে। সেই লোকটা থাকতে ওদের বদমাশি করার প্রয়োজন নেই।”

ইভান রাগী দৃষ্টিতে সানায়ার দিকে তাকালো। নেহাতই তিন বছর আগে সানায়া অরুণিকাকে একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, তাই ইভান চুপ করে আছে। নয়তো শত্রুর মেয়েকে নিজের চোখের সামনে সে একদমই সহ্য করতে পারছে না।
যদিও সানায়ার সাথে ইভানের আকস্মিকভাবে অনেকবার দেখা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশে আসার পর তারা যেই জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়েছিল, ভাগ্যক্রমে সেই এলাকায় রাহিদেরও বাসা ছিল। সেই সূত্রে সানায়ার সাথে ইভানের অনেকবার দেখা হয়েছিল। আর প্রতিবারই সানায়ার উল্টোপাল্টা আচরণে ইভানের তার প্রতি রাগ বাড়তেই লাগলো।

এদিকে ছ’জনই তখন অরুণিকাকে পাশের একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল, যেই স্কুলে রাহি পার্ট-টাইম শিক্ষকতা করতো। আর অল্প সময়ের মধ্যেই অরুণিকার কলকাতার স্বরে কথা বলা, আর তার মায়াবী চেহারার জন্য রাহির তাকে খুব পছন্দ হয়ে যায়। এরপর থেকেই রাহি অরুণিকার সাথে দেখা করার জন্য মাঝে মাঝে তার বাসায় আসতো। একই এলাকায় থাকতো বিধায় তাদের মধ্যে খুব ভাব জমে যায়। বিশেষত উপমার সাথে তার খুব ভাব জমেছিল। দু’জনই বিকেলে কথাবার্তা বলে সময় কাটাতো। আর সানায়াও মাঝে মাঝে রাহির সাথে দেখা করার জন্য তাদের বাসায় আসতো। তখনই প্রথমবারের মতো উপমার সাথে সানায়ার দেখা হয়েছিল। ছ’জন তখন সানায়াকে রাহির বান্ধবী হিসেবেই চিনতো।

কিন্তু একদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে অরুণিকার সাথে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। তার স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা নির্মাণাধীন ভবন সামনে পড়ে। সেই ভবনটির কাঠামো খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখাও ছিল, এই রাস্তা দিয়ে চলাচল নিষেধ। কিন্তু অরুণিকা এসব খেয়াল করে নি। সে নিজের মনেই সেদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখনই উপর থেকে একটা পিলার ভেঙে পড়ার মুহূর্তেই সানায়া তাকে টেনে সরিয়ে দিয়েছিল। যদিও অরুণিকা ভবনটির ঠিক নিচ দিয়ে হাঁটছিল না। তাই পিলারটিও তার থেকে অনেক দূরেই পড়েছিল। কিন্তু অরুণিকার ভাষ্যমতে সানায়া না থাকলে সে পিলারের নিচেই পড়তো। আর সেটাই সে ছ’জনকে ভালোভাবে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে সানায়ার সাথে অরুণিকা আর উপমার আলাদা ভাব জমে যায়। শুরুর দিকে ইভান ছাড়া বাকি পাঁচজনের সাথেই সানায়ার খুব কথাবার্তা হতো। তূর্য তো একপ্রকার সানায়ার সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছিল। সানায়াও তূর্যের গান শুনার জন্য তার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। এসব দেখে উপমার অনেক খারাপ লাগতো, তবুও সে চুপ করে থাকতো। বরং সানায়া আর তূর্যকে আরো বেশি কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে নিজে রান্নাঘরে বসে চোখের জল ফেলতো। কিন্তু একদিন তারা হঠাৎ সানায়ার পরিচয় পেয়ে যায়। তারা জানতে পারলো সানায়া শাহেদ মির্জার ছোট মেয়ে। আর রাহি, সাহিল মির্জার বাগদত্তা। তবে আরাফ রাহিকে আগেও একবার সাহিল মির্জার সাথে দেখেছিল। কিন্তু সে এটা কারো কাছেই প্রকাশ করে নি। এরপর থেকেই ছ’জনই সানায়ার সাথে কথাবার্তা বলা কমিয়ে ফেলে। অন্যদিকে অরুণিকা আর উপমাকে বলে দিয়েছিল তাদের সাথে কম কথা বলার জন্য। কিন্তু অরুণিকা ছ’জনকে পালটা প্রশ্ন করে চুপ করিয়ে দিয়েছিল।
কেন সে সানায়া আপি আর রাহি মিসের সাথে কথা বলতে পারবে না?
অরুণিকার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছ’জনের কাছে ছিল না। তবে রাহির সাথে ছ’জনের তেমন একটা কথা হতো না। তাই সে এসব গায়ে মাখে নি। কিন্তু সানায়ার মনে প্রশ্নের দানা বাড়তেই থাকে। সে নিজেকেই প্রশ্ন করতে থাকে,
“কেন তারা আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকে? কেন আমার সাথে আর আগের মতো কথা বলতে আসে না? তূর্যও আর গান শোনায় না। অজুহাত দিয়ে সরে যায়। তারা কি জেনে গেছে আমি খুনির মেয়ে? বাবা কি তাহলে সত্যিই খুনী?”

নিজের বাবাকে নিয়ে এমন বিতর্ক সে ছোটবেলা থেকেই সে শুনে এসেছে। তাই কেউ তার কাছ থেকে দূরত্ব রাখতে চাইলে, তার মনে হয় বাবার কারণেই তার সাথে এমন হচ্ছে।

এদিকে রাহি শাড়ির কুচির দিকে তাকাতে তাকাতেই সামনের দিকে হাঁটছিল। তখনই আরাফ বলে উঠল,
“সামনে তাকিয়ে হাঁটুন।”

রাহি চোখ তুলে আরাফকে দেখে চমকে উঠল। অল্পের জন্য আরাফের মুখোমুখি হয় নি। সে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই আরাফ বলল,
“ডায়নিংয়ে বসুন। নাস্তা করে নিন।”

রাহি মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। আরাফ আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। আর রাহি পিছু ফিরে আরাফের দিকে তাকালো, আর আনমনে হাসলো।

আরাফকে দেখলেই তার খুব শান্তি লাগে। মানুষটা কতো শান্ত! মানুষের কতো সাহায্য করে! কি সুন্দর করে এই সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছে৷ অরুণিকার কাছ থেকেই শুনেছে আরাফ অনেক দায়িত্ববান ছেলে। মাঝে মাঝে সে নিজ থেকেই আরাফ সম্পর্কে জানতে চায়। এতে তার একদমই বিরক্ত লাগে না। বরং সে আরাফ সম্পর্কে একই কথা বহুবার শুনেছে। তবুও তার স্বাদ মেটে নি। তার মধ্যে আরাফকে নিয়ে একটা ঘোর তৈরি হয়ে গেছে, যা রাহি নিজেই বুঝতে পারছে না। আর এই ঘোর তাকে ভিন্ন জগতে নিয়ে গেছে। যেখানে তার বর্তমানের কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু আছে সে আর তার আরাফকে নিয়ে বিশাল পরিসরের ভাবনা। রাহি টুকটাক লেখালেখি করে। আর ইদানিং তার লেখাগুলো আরাফকে ঘিরেই শুরু হয়।

এদিকে আবার বেলে বেজে উঠলো। ইভান আর তাহমিদ একে অপরের দিকে তাকালো। সব অতিথিই চলে এসেছে। এখন শুধু একজনের আগমন বাকি। হয়তো সে-ই এসেছে। তাদের দু’জনের সাথে আহনাফ আর ইমনও এগিয়ে গেল দরজার কাছে। দরজা খুলতেই দেখলো কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটি। লোকটি ঘরে ঢুকেই ইমনের হাত ধরে তার সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন করলো। তারপর ইভান, তাহমিদ আর আহনাফের সাথেও তিনি আলিঙ্গন করলেন। আরাফ তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“আপনি এসেছেন তাই খুশি হয়েছি।”

ইমনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন সুলতান মুন্সী। সুলতান মুন্সীকে দেখে চমকে উঠলো ইমান। সে আস্তে করে নিজেকে আদিলের পেছনে আড়াল করে নিলো। ইমন মিরাজ হাসানকে উদ্দেশ্য করে সুলতান মুন্সীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,
“আংকেল, ইনি মিস্টার সুলতান মুন্সী। আমাদের নেক্সট প্রজেক্টের ইনভেস্টর। উনি নিজেও একজন বড় ব্যবসায়ী। আমরা আমাদের নতুন প্রজেক্টের জন্য উনার সাহায্য নিচ্ছি। দেশে আসার পর উনি আমাদের অনেক সাহায্য করেছিলেন।”

সানায়া আর রাহি সুলতান মুন্সীর পরিচয় শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। সানায়া রাহির হাত ধরে বলল,
“তার মানে ইনিই সুলতান মুন্সী, যার সাথে বাবার এতো শত্রুতা? আর তার ছেলেকেই আপু ভালোবাসে? ও মাই গড, বাবা যদি জানতে পারে, আমি এখানে এসেছি, যেখানে সুলতান মুন্সী এসেছে, নির্ঘাত আমার প্রাণ নিয়ে নেবে।”

রাহিও ভয়ার্ত চোখে সুলতান মুন্সীর দিকে তাকিয়ে রইলো। সাহিল যদি জানতে পারে, তাহলে তাকেও কোনো অংশে ছাড়বে না।

এদিকে অরুণিকা অতিথিদের ভীড়ে ইমানকে খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ইমান খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাচ্ছে। অরুণিকা ইমানকে চলে যেতে দেখে ঘর থেকে বেরুতেই আহনাফ তার হাত ধরে ফেললো। অরুণিকা আহনাফের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আহনাফ তার হাত আলগা করে দিয়ে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”

অরুণিকা আহনাফের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আহনাফও তার পিছু পিছু গিয়ে দেখলো, অরুণিকা ইমানের পিছু নিচ্ছে। আহনাফ দৌঁড়ে এসে অরুণিকার পথ আটকে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো, বলো?”

ততোক্ষণে ইমান গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অরুণিকা রাগী দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি সবসময় আমাকে বিরক্ত করো।”

আহনাফ আলতো করে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো, সেটা তো বলো? আর আমি কি তোমাকে একা বাইরে যেতো দেবো, হুম?”

“হ্যাঁ, এখন এটাই শিখে ফেলো। বিয়ের পর তো বউকেই সময় দিতে হবে।”

“হ্যাঁ, বউকেই তো দেবো। আমার বউ তো আমার সাথেই থাকবে। ওকে এক সেকেন্ডের জন্যও দূরে যেতে দেবো না।”

অরুণিকা পা ধাপিয়ে বলে উঠল,
“উফ! তোমার ফিল্মি ডায়লগগুলো আমাকে শুনাবে না, প্লিজ। আমার ভালো লাগে না এসব।”

আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে মলিন হাসলো। তারপর বলল, “বাসায় চলো।”

অরুণিকা গেইটের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আদিল ভাইয়ার বন্ধু চলে গেল কেন?”

আহনাফ অরুণিকার প্রশ্ন শুনে কিছুটা দমে গেল। সে ঠান্ডা গলায় বলল,
“হয়তো কোনো কাজে বেরিয়েছে। একটু পর চলে আসবে।”

আহনাফ তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতেই অরুণিকা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো। আহনাফ তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,
“অনেক কোমলভাবে তোমার হাতটা ধরেছিলাম, অরু। আর তুমি এভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার মনটাই ভেঙে দিলে! কিভাবে ভালোবাসলে তুমি আমার মায়ায় জড়াবে, বলো? আমি আর কিভাবে তোমাকে আমার ভালোবাসা বোঝাবো?”

আহনাফের বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অরু আমাকে ভালোবাসুক। শুধু একটুখানি ভালোবাসুক না হয়। আমার তাতেই চলবে।”

চলবে–

#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||

৮৯.
ইমন আর মাওশিয়াতের এনগেজমেন্টের পর অরুণিকার শর্ত মোতাবেক অনুষ্ঠান শুরু হলো। একে একে সবাই গান করলো। কেউ কেউ গানের পরিবর্তে অরুণিকার প্রশ্নের উত্তর দিলো। এবার অরুণিকা রাহিকে বলল,
“রাহি আপু, এবার তোমার পালা। একটা গান করো।”

রাহি লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে ফেললো। সানায়া বলল,
“রাহি গান গাইতে পারে না। ওর সুরই ঠিকভাবে আসে না। তবে ও ভালো লেখালেখি করতে পারে। ওকে নিজের লেখা পড়ে শুনাতে বলো। ওর লেখা শুনে তোমরা মুগ্ধ হয়ে যাবে।”

অরুণিকা বলল,
“হ্যাঁ আপু। শোনাও একটা।”

রাহি চোখ তুলে আরাফের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো। রাহি তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে বলল,
“আমি কিছুদিন আগেই লেখাটা লিখেছিলাম। ওইটাই পড়ে শুনাচ্ছি।”

রাহি মোবাইল থেকে লেখাটি বের করলো। ফোনের স্ক্রিনে কালো অক্ষরে লেখাগুলো জ্বলজ্বল করছে। রাহি সেকেন্ড খানিকের জন্য চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল,
“আরাফ, এই লেখাটা তোমাকে নিয়েই লিখেছি। তুমি হয়তো বুঝবে না। কিন্তু আমার জীবনে আসা সব পুরুষের মধ্যে তুমিই অনেক আলাদা।”

রাহি চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পড়তে লাগলো,
“সেদিনটা খুব ব্যস্তময় দিন ছিল৷ ব্যস্ততার ভীড়ে আমি ব্যস্ত মানুষের মতো ছুটছিলাম। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো তার সাথে। ভালোভাবে তাকানোর সুযোগটাও পেলাম না। শুধু তার কন্ঠ শুনলাম। এভাবে অনেকবার তার কন্ঠ শুনেছি। কিন্তু তাকে দেখা হয় নি৷ কিভাবে দেখবো! আমি তো অন্ধ হয়ে গেছি। আমার চোখের আলো কেউ এসে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এখন আমি তা-ই দেখি, যা আমাকে দেখানো হয়। কিন্তু আমার মনটা এখনো উন্মুক্ত। তাই মন ভরে তাকে শুনি, শুনতে চাই। তবে আমার কোনো অনুভূতি নেই। নেই কোনো চাওয়া-পাওয়া। শুধু একটাই ইচ্ছে আছে, যদি সেই কন্ঠ রোজ শোনার সুযোগ হতো। বেশ জমতো আমার সেই দিনটা।”

রাহি মোবাইল থেকে চোখ তুলে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফও তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার আর রাহি চোখ সরালো না। উলটো আরাফই চোখ সরিয়ে নিলো। রাহির লেখা অনুভূতির অংশটি শুনে সবাই হাততালি দিচ্ছিল, শুধু সানায়া অবাক হয়ে রাহির দিকে তাকিয়ে ছিল। এরপর সানায়ার গান গাওয়ার পালা এলো। সে সোজা হয়ে বসে বলল,
“আমার গান গাইতে অনেক ভালো লাগে। দাঁড়াও, আগে আমি একটু ভাবি, কোনটা গাইবো।”

রাহি চোখ বাঁকা করে সানায়ার দিকে তাকালো। আর কানে হাত গুঁজে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর সানায়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“শুরু করছি। ঠিক আছে?
বলো, কেন তুমি দূরে দূরে!
কেন আমি একা?
হৃদয়ে চুরমার
আনো না…
তুমিই আমার, স্বপ্ন ঢেকে থাকা।
নামে না রোদ্দুর।
দেয়ালে দেয়ালে, খেয়ালে খেয়ালে
হিসেবে-বেহিসেবে তোমাকেই খুঁজি
আড়ালে আড়ালে, কোথায় হারালে?
ফিরে তুমি আর আসবে না বুঝি?”

সানায়ার ভাঙা কন্ঠ শুনে সবাই মাথা নিচু করে রইলো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ওয়েট ওয়েট ওয়েট, তুমি এই লিরিক্স কোথায় পেয়েছো?”

সানায়া বলল, “শুনেছি।”

“তুমি কি আদৌ শুনেছো? আমার তো মনে হয় না। তুমি পুরাটাই ভুল গেয়েছো। না জানলে গাইবে কেন?”

ইভান শব্দ করে হাসলো। ইভানকে হাসতে দেখে সানায়া রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। তূর্য বলল,
“আমি গেয়ে শুনাচ্ছি। ওয়েট।
বলো না কেন তুমি বহুদূর?
কেন আমি একা?
হৃদয়ে ভাঙচুর, জানো না
তুমি হীনা এ আমার
স্বপ্ন মেঘে ঢাকা, নামে না রোদ্দুর।”

সানায়া হেসে বলল,
“আমি ইচ্ছে করেই ভুল গেয়েছি, যাতে তুমি আমাকে শুদ্ধ করে দেওয়ার জন্য গানটা গাও।”

ইভান এবার মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এখন নিজের অপারগতা ঢাকার চেষ্টা করছে!”

সানায়া কিছু বলতে যাবে, রাহি তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলো। এবার আহনাফের গান গাওয়ার পালা এলো। সে ইচ্ছে করেই গান না গেয়ে বলল,
“অরু, তুমি আমাকে যেকোনো ধরণের প্রশ্ন করো। আমি উত্তর দেবো।”

অরুণিকা হেসে বলল,
“আচ্ছা বলো। আরাফ কার সাথে তোমার বিয়ের কথা বলেছে!”

আহনাফ আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ বলল,
“আমিই বরং এই উত্তরটা দেই।”

আরাফ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে উঠে দাঁড়ালো, আর বলল,
“আমি আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি।”

সবাই আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ অরুণিকাকে ডাক দিয়ে বলল,
“অরু, এদিকে আসো।”

অরুণিকা কিছুটা অবাক হলো। সে একনজর উপমার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই তাহমিদ তাকে ইশারায় সামনে যেতে বলল। অরুণিকা আরাফের কাছে যেতেই আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“দাদা, বাবা, ভাইয়া আর চাচাদের অবর্তমানে আমি তোমার অভিভাবক। জুবায়ের আংকেল মৃত্যুর আগে তোমাকে আমাদের দায়িত্বে দিয়ে গেছেন। আর আমি এই দায়িত্বটা সারাজীবনের জন্য অন্য কারো হাতে তুলে দিতে চাচ্ছি।”

অরুণিকা ভয়ার্ত চোখে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি চাই ইমন আর মাওশিয়াতের বিয়ের পর আহনাফ আর অরুর আক্দটা হয়ে যাক।”

অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে গেলো। আহনাফ অরুণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

এদিকে সব অতিথিরা চলে যাওয়ার পর অরুণিকা আরাফের সামনে এসে বলল,
“আরাফ, তুমি আমাকে না বলে এই সিদ্ধান্ত কিভাবে নিয়েছো? তুমি অন্তত আমার পছন্দ-অপছন্দ জানতে পারতে।”

আরাফ শান্ত কন্ঠে বললো,
“এটা আমার সিদ্ধান্ত না। এটা তোমার বাবার সিদ্ধান্ত ছিল।”

“বাবার সিদ্ধান্ত ছিল, তাই বলে সেটাই মানতে হবে? সেদিন যদি আহনাফের কিছু হয়ে যেতো, তাহলে তাদের সিদ্ধান্তের কি কোনো মূল্য থাকতো!”

অরুণিকার কথা শুনে আহনাফের গলা আটকে গেলো। ইভান ধমকের সুরে বলল,
“অরুণিকা, বেশি কথা বলবে না। আরাফ তোমার খারাপ চাইবে না।”

অরুণিকা আহনাফের কাছে এসে বলল,
“তুমি কি এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছো? তোমারও কি খারাপ লাগছে না!”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“না, আমার কোনো সমস্যা নেই।”

অরুণিকা ছলছল চোখে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“যদি বলি আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি, তবুও আমাকে বিয়ে করবে?”

আহনাফ অরুণিকার কথা শুনে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ বলল,
“তোমার পছন্দ কি সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তোমার পছন্দটা আমার পছন্দ হয় নি।”

অরুণিকা অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমন ভ্রূ কুঁচকে আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“অরুণিকা আবার কাকে পছন্দ করে? আমি তো এই ব্যাপারে কিছুই জানি না।”

আরাফ বলল,
“জানার জন্য চোখ কান খোলা রাখতে হয়। আর আমার অরুর ব্যাপারে, সব চোখই খোলা ছিল, এখনো খোলা আছে। তাই আমি ভালোভাবেই দেখেছি, এবং বুঝেছিও।”

অরুণিকা কিছু বলতে যাবে উপমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“অরু, প্লিজ ভাইয়ার কথায় রাজি হয়ে যাও। তোমার জন্য আহনাফ ভাইয়ার চেয়ে ভালো কেউ হবে না। ভাইয়া তোমার যেভাবে খেয়াল রাখে, অন্য কেউ রাখবে না। আজকাল কি ছেলেদের বিশ্বাস আছে, বলো? কোনদিক দিয়ে মেয়েরা ঠকে যায়, তারা নিজেরাই বুঝে না। আর তুমি তো সেই ছোট বেলা থেকেই আহনাফ ভাইয়াকে চেনো।”

তূর্য উপমার কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আর অরুণিকা উপমার দিকে তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তে কেউই তার অনুভূতি বুঝতে চাইছে না। সে যে ইমানকে পছন্দ করে, এটা কাউকে বোঝানো সম্ভব না। যেখানে পাত্র স্বয়ং আহনাফ, সেখানে আহনাফকে ছেড়ে ইমানকে যোগ্য পাত্র মনে করার কোনো লক্ষণ কারো কাছেই নেই। কারণ সবাই আহনাফকেই ভালোভাবে চেনে। এমনিতে ইমান গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করে। তার কাজগুলো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আরাফ কোনোভাবেই অরুণিকাকে ইমানের সাথে বিয়ে দেবে না। পুরো রাত উপমা অরুণিকাকে এটাই বুঝিয়েছে।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই অরুণিকা আহনাফের রুমে ঢুকে আহনাফের পাশে বসলো। আহনাফের মাত্রই ঘুম ভেঙেছে। অরুণিকাকে দেখে সে তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। অরুণিকা আহনাফের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“একটা অনুরোধ রাখবে, আহনাফ?”

আহনাফ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। তার ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি।

অরুণিকা বলল,
“আমি ইমানকে পছন্দ করি। কিন্তু আমি জানি না ও আমাকে পছন্দ করে কি না। তুমি একবার ওকে জিজ্ঞেস করবে ও আমাকে ভালোবাসে নাকি। অথবা আমাদের একবার দেখা করিয়ে দাও, আমি নিজেই জিজ্ঞেস করবো। তারপর ও যদি না বলে দেয়, তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করে নেবো। কিন্তু ও যদি হ্যাঁ বলে, তাহলে তুমি আরাফকে রাজি করাবে। ঠিক আছে?”

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি তোমার কাছে অপশনাল?”

অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, তুমি আমার কাছে অপশনাল কেন হবে? যদি ইমান আমাকে ভালো না বাসে, তাহলে আমি তো আমার পছন্দ ওর উপর চাপিয়ে দিতে পারবো না৷ তাই এরপর আমার ভাগ্যে যা লেখা থাকবে, তাই হবে। কিন্তু আমি….”

আহনাফ অরুণিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা, আমি দেখছি।”

অরুণিকা খুশি হয়ে আহনাফের গাল টেনে দিয়ে বলল,
“আমি জানি, তুমি আমার জন্য এটা অবশ্যই করবে।”

আহনাফ মলিন মুখে বললো,
“তোমার জন্য আমি সব করতে পারবো অরুণিকা।”

অরুণিকা মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আহনাফ মনে মনে বলল,
“শুধু তোমাকেই ছাড়তে পারবো না।”

চলবে–